-
কবিতা- স্বীকারোক্তি
স্বীকারোক্তি
-পাপিয়া ঘোষ সিংহআঁধার নেমেছিল এক দশক কাল আগে,
চক্রান্তের জাল বিছানো চলছিল তারও পূর্বে,
টারেন্টুলারা দল বেঁধেছিল, লাল,নীল,সবুজ গেরুয়া—একটা স্বপ্নের ইমারত ধূলিসাৎ করেছিল ষড়যন্ত্রীরা,
জীবন- যৌবন নিয়ে ফাটকা খেলায় সাথী ছিল
জ্ঞানী থেকে অতিজ্ঞানী পরজীবীরা।
বিদ্যা বিকোচ্ছিল রাস্তাঘাটে বিনিময় প্রথায়।ঘরে ঘরে লুঠ চলছিল অর্থ, ইজ্জত, ইমানের,
উইপোকারা দরজা, জানালার মত আবরণ-
খুলে খুলে ফেলছিল,নগ্ন করছিল সমাজকে।বুকফাটা আর্তনাদে কম্পিত হচ্ছিল মেদিনী,
পুড়ছিল মন, পুড়ছিল চেতনা, বিলীন হচ্ছিল শিক্ষা।
তারপরেও রক্তে প্রতিবাদের অঙ্গার সঞ্চিত হচ্ছিল ধীরে ধীরে।স্ফুলিঙ্গ আকাশ ছু়ঁতে যাওয়ার আগেই বিষ্ফোরণ,
বাঁচার তাগিদে সত্য-মিথ্যা বেরিয়ে এলো অর্গল ভেঙে,
স্বীকারোক্তি! অনুরণিত হচ্ছে পাথর ভাঙার শব্দ।এক ভয়ংকর যুগের অবসান, দীর্ঘ সময় পর
নব্য উষার অভ্যুদয়ে, পথ সমুখপানে চলার। -
কবিতা- একটু উষ্ণতার জন্য
একটু উষ্ণতার জন্য
-পাপিয়া ঘোষ সিংহতোমার উষ্ণতায় গলে যাচ্ছিল মনের বরফ
বাঁধভাঙা উচ্ছাসে বয়ে চলছিল সে,
যাত্রাপথের দু’পাশে সেই মিঠা জলের স্পর্শে-
রঙবেরঙের হরেক ফুল স্বপ্ন রচনা করছিল।
পাখিরা গাইছিল জীবনের গান।হঠাৎ ব্যস্ততার ঝোড়ো হাওয়ায় সব উলোটপালট হয়ে যাচ্ছে,
প্রেমের নাব্যতা কমে গেছে,
দু’কুল ছাপিয়ে- স্বপ্ন ভাঙার কান্না।ভালোবাসার ভাটায় ফুলগুলো নুইয়ে পড়ছে,
নদীর জলোচ্ছ্বাস স্তিমিত, গতিপথ বড়ই বন্ধুর।
বসন্ত আসছে না বলে শীত বিরাজমান
জড়তায় কু়ঁকড়ে যাচ্ছে এ মন।পাখিরা পরিযায়ী হয়ে উষ্ণতার খোঁজে
পর্ণমোচী জানান দিচ্ছে ঝড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা।
তুমি আসবে, ভালোবাসবে? উষ্ণতা ছড়াবে-
হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা।
দিশেহারা আমি শুধু একা ——- -
কবিতা- মাটি
মাটি—
– পাপিয়া ঘোষ সিংহআকাশের কালো মেঘ, সূর্যের আলোকে ঢেকে দিয়ে-
বার্তা দিল, মহাপ্রলয়ের আগমনের।
আমি জামাকাপড়, আসবাব সামলাচ্ছি,
হঠাৎ ঝঞ্ঝা এসে উড়িয়ে দিল, আমার হৃদয়তটের আগল,
উড়ন্ত আঁচল সামলানোর দূর্বার চেষ্টা ব্যর্থ।পরে মহাপ্রলয়ের তান্ডবে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল আমার সাধের নীড়।
হৃত আবরণ মাথা ও দেহের,
ছিন্নভিন্ন চারিদিক,
আশ্রয়হীন, পাখির মত হাতডানা ঝাপটে
অশ্রুস্রোতে ভাসছে হৃদয়।বৃষ্টিস্নাত নরম মাটিতে স্থির আমি একবার
দিশেহারা মনে উঁকি দিয়ে দেখলাম,
আমি দাঁড়িয়ে আছি , মাটির বুকে।
না, সরে যায়নি সে আমার পায়ের তলা থেকে।মন বললো, যে মহাপ্রলয়ে আমি আজ বিধ্বস্ত,
গাছ -গাছালি, মুখ থুবড়ে পড়েছে,
পাখ-পাখালি সর্বহারা।
মাটিও তো সেই মহাপ্রলয়ের মুখোমুখি।
তবুও অটুট, অপরাজেয়।যুগযুগান্ত ধরে কত জয়রথের চাকায় পিষ্ট,
কত দাম্ভিকের পদভারে দলিত,
রূদ্র প্রকৃতির নিষ্ঠুর লালসায় ধর্ষিতা, লাঞ্ছিতা।
তবুও মাটি চির ভাস্বর, অমলিন,
স্নেহময়ী, কোমল, সহনশীল— জন্মদাত্রী মা, -
কবিতা- মনের সাধ
মনের সাধ
-পাপিয়া ঘোষ সিংহআমার যে খুব ইচ্ছে করে নদীর মতো চলি,
চলতে চলতে কলকলিয়ে মনের কথা বলি।
আবার কখন হয় যে মনে, ময়ূর হ’তাম যদি,
মেঘ পিয়া’র সামনে আমি নাচতাম নিরবধি।যদি আমি পাখি হ’তাম, উড়ে যেতাম তোমার কাছে,
থাকতো না আর ভয় পিছুটান, দুষবে সমাজ পাছে।
না হয় আমি হ’তাম যদি লজ্জাবতী লতা,
তোমার ছোঁয়ায় না গুটিয়ে জাগত কথকতা।হ’তাম যদি ঋতু আমি, প্রিয় আমার পিয়া’র,
পরশ দিতাম মিঠেল হাওয়ার, ফুলের মূর্ছনার।
না হয় ধরো বাগানে তোমার হ’তাম লাল গোলাপ,
পাপড়িগুলো শেখাতো তোমায় প্রেমের সংলাপ।আমি যদি হ’তাম কোনো সমুদ্দুরের ঢেউ,
আছড়ে পড়লে বুকে তোমার, বকতো না তো কেউ।
তোমার জামার কাপড় হ’লে হোতো বড়ো ভালো,
জাপটে ধরে দিবানিশি, প্রেমের সুধা ঢালো।আচ্ছা, আমি হ’তাম যদি তোমার গলার হার,
সুযোগ পেতাম দিনরাত্তির কন্ঠে ঝুলে থাকার।
হ’তাম যদি ভাষা তোমার, ঐ ঠোঁট আর চোখে
ভালোবাসি এই কথাটি, উঠতো ফুটে মুখে।মনের সাধ পূরণ আমার হবে কি কখনও?
তোমার মনের ইচ্ছেগুলো হয় কি এমনতরো?
সাধ আমি সাধ্য করে দেখিয়ে দিতে পারি,
ভালোবাসা এমনই হয়, জোর যে তার ভারি। -
কবিতা- এক সন্ধ্যায়
এক সন্ধ্যায়
-পাপিয়া ঘোষ সিংহদেশজুড়ে নেমেছে মহামারী, চারিদিকে নিস্তব্ধতা,
ভয়,একাকীত্ব, অন্ধকার হয়ে চেপে ধরেছে অক্টোপাসের মত।
আজ খুব দ্রুত সন্ধ্যা এসেছে ঘনিয়ে,
এই মন সাহারা খোঁজে, ভালোবাসাহীন দ্বীপে।একটা আলোর নিশানা ক্রমেই যাচ্ছে দূরে সরে,
আজকে ঐ আলোর সাহচর্য বড়ো প্রয়োজন ছিল।
দিশাহারা প্রাণ আঁকড়ে ধরতে চাইছে আলোকে,আলোর বড়োই ব্যস্ততা,
সে চলেছে তার আপন গতিতে, শহরের পর শহর ছাড়িয়ে,
পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল বা কোনো মরুপ্রান্তরে।বাদলা পোকাগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে আমার প্রতিচ্ছবি,
এমনি করেই খুলে পড়ছে আমার ডানা, পাখা।
এই সন্ধ্যায় অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা আমি একাকী,
শুধু একটা শব্দ মন ভাঙছে,ওপার থেকে কেউ হাতুড়ি মারছে মনে।। -
কবিতা- মেঘ পিওনের ডাক
মেঘ পিওনের ডাক
-পাপিয়া ঘোষ সিংহআজকে ভোরে সূর্য শিখা দেয়নি আমায় দেখা,
মেঘ পিওনের ডাক শুনলাম, চোখ মেলে তুই তাকা!
মেঘের হাতে কে পাঠালো, বৃষ্টি দিনের গান,
বসন্তের আজ বর্ষা সাথে প্রেমের উপাখ্যান-
ছোট, ছোট মুক্তো দানা পড়ছে ঝরে,ঝরে,
রোদের আজ রাগ হয়েছে ,যায় না দেখা তারে।টাপুর-টুপুর, বাদ্যি বাজে, কোকিলের গীত কই?
আমের মুকুল বৃষ্টি ছোঁয়ায় পড়ছে নুয়ে ঐ।
লজ্জাবতী অবনতা, ডালিয়া, মল্লিকা,
অপরাজিতায় ভরেছে আজ ছাদবাগানের শাখা।
উদাস আমি আকাশ পানে দেখছি মেঘের সাজ,
মনপাখিটার ডানা মেলে,উড়িয়ে দিলাম আজ,পৌঁছে গেলাম একনিমেষে তেপান্তরের পারে,
ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর সেই ভালোবাসার নীড়ে।
সেথায় পেলাম, আমার সূজন, বসন্ত-রোদ্দুর,
উদাস এ মন, প্রাণ পেয়েছে, প্রেমে – ভরপুর।
বর্ষা যেমন আজ এসেছে বসন্তের বুকে নেমে,
ঠিক তেমনই আমরা দু’জন,উঠব মেতে প্রেমে। -
কবিতা- তোমায়-আমায় মিলে
তোমায়-আমায় মিলে
-পাপিয়া ঘোষ সিংহ
যদি আঁধার ঘন কালো মেঘ নিয়ে কাছে আসো,
আমি বৃষ্টি হয়ে পড়বো ঝরে,বলবো ভালোবাসো।
তুমি যদি ঝড়ের মাতন হও, তান্ডব শুরু করো,
আমি পল্লবী হয়ে পড়বো নুয়ে পারলে তুলে ধরো।তুমি আকাশ হবে আমার ,পাতবে বিশাল বুক,
আমি আলোর মালা হয়ে, তোমায় দেবো অঢেল সুখ।
তুমি উচ্চ পাহাড় হবে, রহস্যময় ,গভীর ইতিহাস,
আমি ঝরণাধারা হয়ে তিরতিরিয়ে করবো কথা ফাঁস।তুমি অতল সমুদ্র হবে,ডাকবে গভীর গরজনে
আমি কল্লোলিনী নদী,মিশে যাবো তোমার সনে।
তোমার গভীর গহন বনে,উঁচু গাছের ডালে ডালে,
পক্ষী হয়ে কোরবো কূজন,আর নাচবো তালে তালে।তুমি শীতের কঠিন বরফ,বড়োই শক্ত তোমার ধরণ,
আমি ভোরের মিঠি রোদ, তাপে গলাবো তোমার মন।
আমার বসন্তবাহার তুমি, আমি রঙিন পুষ্পরাজি,
তুমি ভ্রমর হয়ে চুষবে মধু, আমার জীবন তরীর মাঝি।। -
কবিতা- সব হারিয়ে তোমায় পাওয়া
সব হারিয়ে তোমায় পাওয়া
-পাপিয়া ঘোষ সিংহআজকে হঠাৎ মনসাগরে বাঁধভাঙা এক ঢেউ,
ভাসিয়ে দিল, ভয়,পিছুটান,চারপাশে নেই কেউ
ঢেউয়ের তোড়ে ভাঙল আমার শরীর, মনের আগল,
সব হারালাম?না কি দিলাম, ভেবে উদাস পাগল!মন হারিয়ে মন পাওয়া যায়, বলে শুনি লোকে,
আমার এ মন সমর্পিত, অনেক দিনের থেকে।
বেশ তো ছিলাম, দেওয়া-নেওয়া, চাওয়া-পাওয়া নিয়ে,
জীবনভরা মান-অভিমান, দুঃখে প্রলেপ দিয়ে।অনেক ব্যথা-যন্ত্রণারা ঘুমিয়ে ছিল মনের মাঝে,
রোজনামচা হ়েঁসেল ঠেলে কাটছিল দিন ব্যস্ত কাজে।
মন কপাটে খিলটি এঁটে, দিব্যি ছিলাম সুখের ভ্রমে,
চলতি পথে,দখিন হাওয়া ডাক পাঠালো আমার নামে।সজোরে এক ধাক্কা দিয়ে খুলল মনের দ্বার,
হ’লাম আমি দখিন হাওয়ার, সে হ’ল আমার।
হাওয়ার জোরেই খুলে গেল, সকল আবরণ,
হারিয়ে ফেলি লজ্জা আমার, জাগে শিহরণ।আজকে আবার সমর্পিতা,আমি তোমার তরে,
পেয়েছি যে প্রেমের পরশ,নিয়েছি আঁচল ভরে।
সব হারিয়েও সব পেয়েছি,তোমার মনের সাড়া,
সাগর স়েঁচে মুক্তো পেয়ে হয়েছি পাগল-পারা। -
কবিতা- আজি এ বসন্তে
আজি এ বসন্তে
-পাপিয়া ঘোষ সিংহবসন্ত এসেছে দ্বারে ঋতুর নিয়মে,
ভ্রমরের গুঞ্জন ফুলেদের প্রেমে,
লাল,নীল, হলুদ ফুটে শাখে -শাখে,
কোকিলের কুহুতান, রাঙা অনুরাগে।প্রকৃতি সেজেছে ঠিক, নববধূ সাজে,
গুনগুন, কলতানে সুরধ্বনি বাজে।
আমগাছে ডালে ডালে মুকুলের ভীড়ে,
গর্ভবতী লাজে নত,আগমীর তরে।অগ্নিবীনার সুরে মেতে ওঠে সবে,
এসেছে বসন্ত দ্বারে, রাঙা অনুভবে।
ভোলায় বিদ্বেষভাব, বলে ভালোবাসো,
বিভেদের জাল ছিঁড়ে কাছাকাছি এসো।আজি এ বসন্তে প্রেম জাগে মনে,
মেতেছি মনের মেলায় আবিরের সনে।
রঙে রঙে রাঙা মন, ছুটি পেতে চাই,
মুক্ত গগন মাঝে,ডানা মেলি তাই।আমার মনের রঙ দিলাম তোমাকে,
তোমার রঙিন মন ছুঁয়ে যাক তাকে।
মনখারাপের মেঘ,দখিনা বাতাসে
উড়ে গিয়ে,সুখের খবর নিয়ে আসে।এসো আজ সবে মিলে মাতায় ভূবন,
বসন্তের রঙে রঙে রঙিন হোক মন। -
কবিতা- আত্মকথা
আত্মকথা
-পাপিয়া ঘোষ সিংহআমি এক নারী ‘
সদা কর্মরত নিজের পরিবারে, –
বিরাম বিশ্রাম নেই,
নেই অধিকার সুখ চাহিবারে,
এ সংসারে বহুরূপে আমার ভূমিকা__
কন্যা, মাতা, ভগ্নী স্ত্রী, – সেবিকা ।
তবু আমার নেই কোন নিজস্ব ঠিকানা,
আমার ঠাঁই – – পিতা, স্বামী, পুত্রের আস্তানা ।
আমার আছে দুচোখ ভরা স্বপ্ন,
কোন মূহূর্ত তো আমার হোক ,
___থাকি আমাতে মগ্ন ।
না সময় নেই, নিজেকে নিয়ে ভাবনার,
অপর কে ভালো রাখায় যে – আরও বেশি দরকার ।
অষ্টপ্রহর আমার কাজ, –নেই পরিত্রাণ,
অবসরের নেই বয়স আমার, – – নেই কাজের মূল্যায়ন ।
আমি নারী, তাই হতে হবে আমায় সর্বংসহা,
আমাকে অবলা আখ্যা দিয়ে,__তোমরা মানব – মহা??
আমার ও কথা আছে, অনেক কিছু দিতে পারি আমি,
জ্ঞান গরিমা, শক্তি সাহস, কিসে কম আমি??
অপলা, গার্গী, মৈত্রেয়ী, ছিলেন বিদুষী যত,__
ঝাঁসীররানী লক্ষীবাঈ, রিজিয়া সুলতানারমত ।
অবলা নয় আমি, নয় অসহায়,__
নারী আমি, সৃজন করি সর্বদায় ।
আমার স্নেহ কে দূর্বলতা ভেবে কোরনা ভুল,
দুর্বৃত্ত কে করি না ক্ষমা, – মা হয়েও কুপুত্রের বুকে___ দিতে পারি ত্রিশূল!!
স্নেহ, ভালোবাসা, ক্ষমা, সৃজনশীলতা_
এই নিয়েই নারীর কোমলতা ।
রবে চিরকাল__, নইলে সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে,
সমাজ উঠবে না গড়ে, থাকবে না ভালোবাসা_____মানবে, মানবে,
নারী আমি, জন্ম দিই, এ সমাজের
উত্তর পুরুষেরে,
ধৈর্য্য আছে, শক্তি আছে, এ সবের
দায় সহিবারে ।
আমি আছি মনে নিয়ে অফুরান স্নেহ- মায়া,
গর্বিত আমি, – নারী রূপে জন্ম লভিয়া ।