-
গল্প- বিবেক দংশন
বিবেক দংশন
– পারমিতা ভট্টাচার্য‘আচ্ছা মা আর কতদিন সহ্য করবে ওই পাগলীটার অত্যাচার? ওকে কোনও অ্যাসাইলামে পাঠানোর ব্যবস্থা তো করলেই হয়। বহু বছর তো হলো মা।’
কিছুটা রাগান্বিত গলায় রীণা কথাগুলো বলছিল তার মাকে।
‘পাগলী বলিস না। হাজার হোক ওতো তোর বোন।’
‘আমিও আর পারছি না মা। প্রতি দিন এতো মারধোর, অশান্তি আমিও আর সহ্য করতে পারছি না।’
রীণার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মা বলল – ‘আমি বুঝি তোর জ্বালাটা। ওর জন্য তোরও একটা নিজের সংসার হচ্ছে না। যেই দেখাশোনায় আসে, সেই পাগলী বোন দেখে ফিরে যায়।’
টপটপ করে চোখের জল ফেলতে ফেলতে রীণা বলল – ‘এবার তোমরা কাবেরীর একটা ব্যবস্থা করো মা।’
ইন্দিরা দেবী ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো রীণার দিকে।কাবেরী জন্ম থেকেই পাগল নয়। সেও ছিল রীণার মতই সুস্থ, স্বাভাবিক একটা মেয়ে। যদিও সে কম কথা বলা, লাজুক স্বভাবের মেয়ে ছিল। লেখাপড়াতেও সে ছিল যথেষ্ট ভালো। পুজো করে পেট চালানো বাবা একটাও প্রাইভেট শিক্ষক দিতে পারেনি কাবেরীকে কোনও দিনই। তবুও মাধ্যমিকে দারুণ রেজাল্ট করে। পয়সার অভাবে সায়েন্স পড়তে পারেনি সে। তাই আর্টস নিয়েই ভর্তি হয়। এই সময়ই ঘটে যত অনর্থ। প্রাইভেট স্যারের সাথে তার মন পড়লো এক সূত্রে বাঁধা। অপূর্ব সুন্দরী কাবেরী ভেসে গেল আবেগের স্রোতে। স্যার তাকে কথা দিয়েছিল বিয়ে করবে বলে। এর পর প্রেগনেন্সি রিপোর্ট পজেটিভ এলে কাবেরী খুশি মনে স্যার আনন্দ বাবুকে সব জানায়। তার পরেই ভোল পাল্টে যায় স্যারের। বনেদি বাড়ির ছেলে আনন্দ ভ্রষ্টা মেয়ে বলে অপবাদ দিয়ে স্কুলে সবার সামনে অপমান করে কাবেরীকে। এর পর বড়লোকের সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়েও করে নেয় সে। কাবেরীকে ঠেলে দেয় ডাস্টবিনের অন্ধকারে। এই ধাক্কাটাই সামলে উঠতে পারেনি মৃদুভাষী কাবেরী। ঘরে-বাইরে অপমানিত হতে হতে একসময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে সে। না,ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা তারা নিতে সক্ষম হয়নি। কারণ বড়োলোকদের পকেটের টাকা সকলের মুখ বন্ধ করতে সক্ষম। গরীব সনাতন বাবুদের মতো লোকেদের জন্য কোনও সাহায্যের হাতই সেদিন এগিয়ে আসেনি। আর আনন্দদের মতো লোকেরা তাই সমাজে বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেরিয়েছে চিরকাল। মাঝখান থেকে শেষ হয়ে গেছে এই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারটি।
সে দিন রাতে প্রচন্ড ধ্বস্তাধ্বস্তির পর ইন্দিরা দেবী মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন এভাবে আর চলতে পারে না। সারা রাত তার পাগলী মেয়েকে পাহারা কে দেবে দিনের পর দিন? একটু চোখের আড়াল হলেই সে পালিয়ে যায় এখান ওখান। তাই এর পর থেকে কাবেরীর ঠিকানা হলো একটা বদ্ধ ঘর। সারা দিন দরজা জানালা বন্ধ ঘরের মধ্যে ভ্যাপসা দুর্গন্ধের ছড়াছড়ি। এক পিঠ চুল ছিল কাবেরীর। এখন তা কাটতে কাটতে ঘাড় অবধি এসে ঠেকেছে। শুধুমাত্র খাবার দেওয়ার সময় আর ওষুধ খাওয়ানোর সময়ই বাড়ির লোকেরা তার ঘরে ঢোকে। কারণ, তার অমানসিক অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতা বাড়ির লোকেদের আর নেই। এভাবেই মন্দের ভালো কেটে যাচ্ছিল তাদের দিনগুলো। কিন্তু একদিন ঘটল বিপত্তি। একদিন কাবেরীর বাবা সনাতন বাবু তাকে খেতে দিতে গিয়ে দরজা বন্ধ করতে ভুলে যায়। সেই সুযোগে কাবেরীও বেরিয়ে পড়ে ঘরের বাইরে, বাড়ির বাইরে….একেবারে সোজা রাস্তায়। যখন খোঁজ পড়লো তখন শূন্য ঘর। সারা দিন তার কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না। পুলিশে নিখোঁজ ডায়েরি তারা করেনি। পাড়ার ছেলেরা সবাই দিন রাত এক করে খুঁজতে লাগলো কাবেরীকে। আত্মীয় স্বজনরাও খবর পেয়ে খোঁজ খবর নিতে লাগলো চারিদিকে। সে দিনটা এভাবেই কেটে গেল। পরের দিন ভোরে জেলেরা মাছ ধরতে গিয়ে পুকুর পারে ঝোপের ভিতর থেকে কাবেরীর সংজ্ঞাহীন প্রাণটা উদ্ধার করে বাড়িতে খবর দেয়। তখনও তার হৃৎপিন্ডটা সচল ছিল। যদিও ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত জামাকাপড় আর সারা শরীরে আঘাতের চিহ্নে তাকে চেনাই যাচ্ছিল না। কষ বেরিয়ে এসেছে রক্ত যা শুকিয়ে গেছে। সারা পাড়া ভেঙ্গে পড়েছে সেই পুকুর পারে। তারই মধ্যে কিছুজন কাবেরীকে তুলে নিয়ে এলো বাড়িতে। কারোর বুঝতে বাকি রইল না ঘটনাটা ঠিক কী ঘটেছে।
কাবেরীর জ্ঞান আসতেই ইন্দিরা দেবী আর মাথার ঠিক রাখতে পারলো না। তার চুলের মুঠি ধরে বাড়ির উঠোনে নিয়ে এসে ফেললো। গায়ের যতটুকু জোর আছে তা সবটুকু প্রয়োগ করে চ্যালা কাঠ দিয়ে মারতে লাগলো তাকে। কাবেরীও কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে শান্ত হয়ে পড়ে। ইন্দিরা দেবীও দাওয়ার খুঁটি ধরে মাটিতে মাথা ঠুকে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। ওদিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় বাবা সনাতন বাবু জল নিয়ে একবার মেয়ের মুখে দেয়, একবার ইন্দিরা দেবীর মুখে দেয়। অবশেষে ইন্দিরা দেবী একটু ধাতস্থ হলে মনে মনে স্থির করেন – আর নয়। ভগবান যখন দেখেও বিচার করতে পারেন না তখন এ ঘটনার বিচার সে নিজেই করবে।পর দিন সকালটা ছিল রৌদ্রকরোজ্জ্বল। সামনেই পুজো এসে গেছে। আকাশে বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ। দাওয়ার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে কী যেন আনমনে ভাবছে ইন্দিরা দেবী। হয়তো রীণার আর কাবেরীর ছেলে বেলার কথা। কত খুশিতে ভরা ছিল এই সংসারটা। অভাব থাকুক, কিন্তু আনন্দের অন্ত ছিল না।
এক লহমায় কী ভাবে যে কী হয়ে গেল! এত খুশি চারিদিকে, অথচ কত বড় অন্ধকারের চাঁই এ পরিবারটির পাঁজরে পোঁতা হয়ে গেছে। কোথাও কোনও আনন্দ নেই, খুশি নেই। দু’ চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়েই পড়ছে ইন্দিরা দেবীর। অন্য দিন এতক্ষণে তাঁর ঠাকুর ঘরের কাজ সারা হয়ে যায়। আজ সে শিউলি তলা থেকে একটা ফুলও কুড়িয়ে ঠাকুরের চরণে দেয়নি। মনে মনে বিড়বিড় করে বলে চলেছে – ‘ঠাকুর, এই তো তোমার বিচার।’
ক্রমে সে তার মনকে দৃঢ় করে। নিজেকে বোঝাতে থাকে….’এটা আমাকে পারতেই হবে।’
সে খুঁটিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। রান্না ঘরে গিয়ে চা বসায়। ততক্ষণে বাড়ির সকলেই উঠে গেছে। সবাইকে চা দিয়ে এক কাপ চা নিয়ে কাবেরীর ঘরে যায় সে। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া প্রাণটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। মাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সে। ইন্দিরা দেবী কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। চা’টা কাবেরীর দিকে এগিয়ে দিতে গিয়ে তার হাতটা আজ একটু কেঁপে উঠল। বুকের ভিতর হাজার হাজার সর্প দংশন করে চলল। যেমনই হোক নাড়ি ছেঁড়া ধন তো তার। কিন্তু একাজ তাকে করতেই হবে।সেদিন বাড়িতে কেউই ছিল না। কাবেরীর মা ছাড়া। রীণা সকালে কলেজ বেরিয়ে গিয়েছিল আর সনাতন বাবু গিয়েছিল একটু দূরে কয়েক ঘর যজমানের বাড়ি পুজো করতে। দুপুরে বাড়ি এসে কাবেরীর নিথর দেহ ঘরে দেখল তার বাবা। চিৎকার করে উঠলেন তিনি। তার চিৎকারে পাড়ার সবাই এক এক করে বাড়িতে জমা হতে লাগলো। শুধু ইন্দিরা দেবী পাথরের মত বসে রইল দওয়ায় খুঁটি ধরে। আজ চোখের জল যেন বাষ্প হয়ে গেছে তার। গলা দিয়ে তার আর কোনও স্বর বেরোচ্ছে না। শুধু একটা দলা পাকানো কান্না গলার মধ্যে আটকে আছে তার। সবাই জানলো, গতদিনের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরেই মৃত্যু হয়েছে কাবেরীর। ইন্দিরা দেবী কাউকে কিচ্ছুই বলতে পারলো না। এমন কি বাড়ির লোকেদেরও না। শুধু বিবেক দংশনে পুড়ে ছাই হতে থাকলো তার মাতৃ হৃদয়। কী করে পারলো সে? এই একটা প্রশ্নই তাকে কুরেকুরে খেতে লাগলো। ঠাকুরের সামনে মাথা ঠুকে ঠুকে আজ কপালে তার গভীর ক্ষত। কিন্তু আজ আর ভগবানের কাছে তার কিছু যেন বলার নেই। কাবেরী মারা যাওয়ার পর থেকে ইন্দিরা দেবীও খাওয়া – দাওয়া ছেড়ে দেয়। কিছু দিনের মধ্যেই সে বিছানায় শয্যাগত হয়ে পড়ে। ডাক্তার বলে, শোক কাটিয়ে উঠতে না পারলে তাকেও বাঁচানো মুশকিল হয়ে যাবে। এমতাবস্থা সংসারের যখন, তখন রীণাকে পছন্দ করে পাত্র পক্ষ খবর পাঠায়। এ কথা কানে শুনে ইন্দিরা দেবী একটু সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু মনের যন্ত্রণা কাউকে বলতে না পারাটা যে কী কষ্টের তা ইন্দিরা দেবী বুঝতো। সেই অঘ্রাণেই রীণার বিয়ে হয়ে যায়। রীণার বিয়ের পর ফাঁকা বাড়িতে ইন্দিরা দেবী হাঁফিয়ে উঠতো সর্বক্ষণ। হার্টের প্রবল সমস্যা দেখা দেয়। মনের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে একদিন রাতে যে ঘুমের ওষুধ কাবেরীকে চায়ের সাথে খাইয়েছিল সে, সেই ওষুধই সে নিজেও খায়। তার পর সব শেষ। কী ভাবে একজনের ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যাত হয়ে একটি পরিবার সমূলে শেষ হয়ে গেল এটা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে।
সমাপ্ত।
-
গল্প- ছন্দপতন
ছন্দপতন
– পারমিতা ভট্টাচার্যআজ মহাসপ্তমী। আলোর রোশনাই আর ঢাকের আওয়াজে গমগম করছে চারিদিক। একরাশ অন্ধকার শুধু রাইয়ের মনের গহীনে। তার জীবনে কোথাও কোনও খুশি নেই, আনন্দের ঝলকানিও নেই। গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেছে তার বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব। আজ রাস্তায় খুশির ঝলকে মেতে ওঠা মানুষের ঢল দেখে তার মনে পড়ে যায় শুধুই অর্কর কথা। দু’ বছর আগেও অর্ক এ সময় জীবিত ছিল। যদিও উত্থানশক্তিরহিত হয়ে গিয়েছিল সে। তবুও তার বারংবারের একটাই আকুতি ছিল, পূজা মণ্ডপে যাওয়ার। কিছুতেই তাকে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে রাখা যাচ্ছিল না। একে তো যন্ত্রণায় সারা শরীর দুমড়ে, মুচড়ে, কুঁকড়ে যাচ্ছিল, অন্য দিকে পাড়ার মণ্ডপে গিয়ে ঠাকুরের মুখ দেখার শেষ ইচ্ছা। নিয়ে গিয়েছিল রাই তাকে পাড়ার পূজো মণ্ডপে। কি যে খুশি ছিল সে, সে দিন তা ধারনাও অতীত। কিন্তু আজ সব ফাঁকা। রাইয়ের চোখের জল আজ যেন কিছুতেই বাগ মানছে না। তার শাশুড়ি মা তাকে অনেক বার নিয়ে যেতে চেয়েছেন পাড়ার মণ্ডপে। কিন্তু সে কিছুতেই পারেনি সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে।
আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে অর্কর মৃত্যু হয় ক্যান্সারে। প্রথম দিকে কিছুই তেমন বোঝা যায়নি। পরে ক্রমে তার শরীর খারাপ হতে থাকে। আস্তে আস্তে তার ওজন কমতে থাকে। বীভৎস রকমের রোগা হয়ে যায় সে। কেমোথেরাপির পরেই তার সারা মাথা নেড়া হয়ে যায়। অবশেষে সব যন্ত্রণার মুক্তি ঘটিয়ে অর্ক ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। অর্কর মৃত্যুর পর রাইয়ের বাপের বাড়ির লোকজন অনেক চেষ্টা করেছিল তাকে নিয়ে যাওয়ার, নিজেদের কাছে রাখবার। কিন্তু এক মাত্র ছেলের মা বাবা ছিল রাইয়ের শ্বশুর শাশুড়ি। রাইকেও ভীষণ ভালোবাসতেন তারা। তাছাড়া রাইয়ের শ্বশুর বাড়ির চারিদিক জুড়ে ছড়িয়ে ছিল অর্কর স্মৃতি। ইচ্ছে করলেও এই বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি যেতে পা ওঠেনি রাইয়ের। তাই পাঁচ বছরের মেয়ে তৃষাকে নিয়ে সে শ্বশুর বাড়িতেই রয়ে গিয়েছিল। বহু চেষ্টা করে সে অর্কর অফিসের কাজটা জোগাড় করেছিল। যদিও অর্কর অফিসের কলিগরা এ ব্যাপারে তাকে খুব সাহায্য করেছিল। এই চাকরিটা পেতে রাই প্রায় মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কারণ, বাড়িতে বৃদ্ধ দুই মানুষের খরচ, মেয়ের পড়াশোনা, সংসার খরচা…. কোথা থেকে চালাবে সে? যা কিছু জমানো টাকা ছিল সবই অর্কর চিকিৎসায় শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন সে কথাই মনে মনে ভাবে রাই – কত স্বপ্ন ছিল, কত আশা ছিল ছোট্ট মেয়ে তৃষাকে নিয়ে তাদের। জীবনের কিছু স্বপ্ন কোনও দিনই পূরণ হয়ে না। এই সবই ভাবতে থাকে রাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে। হঠাৎই তার সংবিৎ ফেরে ছোট্ট তৃষার ডাকে। ছোট্ট তৃষা আর তার ঠাকুমা কল্পনা দেবী জোর দিতে থাকে রাইকে ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। অবশেষে ওদের জেদের কাছে হার মানতেই হয় রাইকে।
আলমারি খুলে দাঁড়িয়েই থাকে রাই। কত দিন পর যে সে আলমারি খুলল। সারা আলমারি জুড়ে শুধুই অর্কর স্মৃতি। তার উপহার দেওয়া বিভিন্ন সময়ের শাড়ি। শাড়িগুলো সরাতেই তার হাতে লাগলো একটা ছোট্ট শিশি। সন্তর্পণে সেটাকে চকিতে লুকিয়ে ফেলল সে। চোখ তার ভেসে যাচ্ছে জলে। অবশেষে শাড়ি পরে সে তৈরি হল যেমন তেমন করে। কল্পনা দেবী ওদের নিয়ে পূজা মণ্ডপে গেলেন। কিন্তু রাই যেন স্থির হতে পাচ্ছে না একটুও। পুরনো স্মৃতি তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। মণ্ডপে একটু থেকেই রাই বাড়ি ফিরে এলো। ঘরে এসে দরজায় তুলে দিলো খিল। আস্তে আস্তে আলমারিটা খুলে সেই লুকনো শিশিটা হাতে নিয়ে সে অর্কর ছবির সামনে তীব্র কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। কত স্মৃতি মনের মাঝে ভিড় করে আসে আজ।
সেদিনও ছিল এরকমই এক সন্ধ্যা। সে বার পূজো এসেছিল দেরিতে। বাড়ির সবাই গিয়েছিল সত্যনারায়ণ পূজোতে পাশের বাড়ি। অর্কর তখন লাস্ট স্টেজ। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া শরীর আর মৃত্যু যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট চিৎকারে রাই তখন বিধস্ত। কিছুতেই আর সহ্য করতে পারত না অর্কর অসহ্যকর গোঙানি। আস্তে আস্তে রাই মনস্থির করে নিয়েছিল অর্ককে সে এই যন্ত্রণা থেকে চিরমুক্তি দেবে। কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব? মেরে ফেলবে সে অর্ককে? এত ভালোবাসা, এত প্রেম, এত স্বপ্ন এক লহমায় নিজের হাতে কি করে শেষ করবে সে? কিন্তু অর্কর আর্ত চিৎকার আর তীব্র যন্ত্রণা বাধ্য করে রাইকে অর্ককে চিরমুক্তি দেবার সিদ্ধান্ত নিতে।
নার্সিং ট্রেনিং নিয়ে থাকার সুবাদে ডক্টরের প্রেসক্রাইব করা ইনজেকশন রাই-ই দিত অর্কর মেরুদণ্ডে। সারাদিনে দু’বার এই ইনজেকশন দিতে হতো। সকালে একবার দিয়ে রাই অফিস যেত। আবার সন্ধ্যায় একবার দিত। আসলে অর্কর চিকিৎসা করাতে গিয়ে ধনে- প্রাণে শেষ হয়ে গিয়েছিল অর্কর পরিবার। তাই শেষটায় আর নার্সিং হোমের খরচ কুলান করতে পারছিল না রাই। আর তাছাড়া কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি নেবার কোনও ক্ষমতাই অর্কর শরীরে ছিলনা। তাই শেষে অর্ককে নার্সিংহোম থেকে বাড়ি নিয়ে চলে এসেছিল রাই। এই ভেবে যে কটা দিন বাঁচে বাড়ির লোকের সাথেই থাকুক সে। কিন্তু অর্কর জীবনের এই ভয়াবহ অবস্থা রাইকে একপ্রকার পাগল করেই তুলেছিল। তাই সে মরিয়া হয়ে উঠেছিল অর্ককে এই বীভৎস যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবার জন্য।
অফিস থেকে ফিরেই রাই ঘড়িতে দেখল আটটা বাজে। আজ ফিরতে তার একটু দেরিই হয়ে গেছে। ছোট্ট তৃষার বায়না মেটানোর জন্য রাই বাড়ি আসতেই তার শাশুড়ি মা ছোট্ট তৃষাকে নিয়ে পাশের বাড়ি সত্যনারায়ণ পূজোতে গেলেন। কিন্তু এ কি? এ কোন অর্ক কে সে দেখছে? আজ অর্কর শরীরের যন্ত্রণা এতই তীব্র যে সে একটু শুতে পর্যন্ত পাচ্ছে না। সাথে শ্বাস কষ্টের কারণে বিছানা থেকে সমস্ত জিনিস মাটিতে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে থাকে সে। চোখ দু’টো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে এক্ষুণি তার। কিন্তু প্রাণ পাখির বড্ড মায়া। তাই সে খাঁচা কেটে উড়তে চেয়েও উড়তে পারছে না। রাইও হতবুদ্ধির মত দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। সেও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে। অর্ককে ইনজেকশন দেওয়ার সময় হয়ে গেছে এমনিতেই। রাই আজ মরফিনের ডোজটা বাড়িয়ে অর্কর শরীরে ভরে দেবে বলেই মনস্থির করল, কিন্তু তার হাত কেঁপে উঠল। বুকের ভিতর হাজার দামামা বাজতে লাগলো, হৃৎপিণ্ডটা এক লহমায় ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইল তার। রাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো অর্কর বুকে। অর্কও শিশুর মত কাঁদতে থাকে তীব্র যন্ত্রণায়। ভালোবাসার মানুষের এত যন্ত্রণা, এত কষ্ট আর সহ্য করা যায়না। সে এবার নিজেকে শক্ত করলো আর মনে মনে বলল ‘আমাকে পারতেই হবে।‘ রাই মরফিনের ইনজেকশনের শিশিটা হাতে নিল, ইনজেকশনের সিরিঞ্জটা শক্ত করে ধরল আর পরিমাণের থেকে তিনগুণ মরফিন ঢুকিয়ে দিল অর্কর শরীরে। এরপর শুধুই অপেক্ষা। মাটিতে ধপ করে বসে পড়লো রাই। ভাবলেশহীন অবস্থায় কতক্ষণ সে বসে ছিল তা সে নিজেও জানেনা। সম্বিত ফিরে এলো যখন, তখন সে কাঁপা হাতে অর্কর কপালে হাত দিয়ে দেখল বরফের মত ঠাণ্ডা তার দেহ। পালসও স্তব্ধ হয়ে গেছে। মাটিতে ধপ করে পড়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে গেল রাই।
যখন জ্ঞান এলো অর্কর দেহ তখন ফুলে ফুলে ঢাকা। একটুও কান্না পাচ্ছে না রাই’এর। কি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে অর্ক। আজ আর কোনও যন্ত্রণা নেই, তীব্র কষ্ট নেই। একেবারে স্থির হয়ে গেছে রাইও। কতটা ভালবাসলে যে ভালবাসার মানুষকে মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়া যায় তা শুধুমাত্র সেই জানে।
আজ মহা সপ্তমী। পূজো এসেছে তার নিয়ম মেনে। ছোট্ট তৃষার গলার আওয়াজে আবার উঠে দাঁড়ায় রাই। অত্যন্ত সন্তর্পণে আলমারিতে লুকিয়ে রাখে মরফিনের খালি শিশিটা। না, কোনও অপরাধবোধ কাজ করেনা রাই’এর মনে। সে মনে মনে শুধু এটুকুই ভাবে.. বড্ড ভালবাসত সে অর্ককে। অর্ক আজও তার জীবনের গোটা আকাশ জুড়ে বিরাজমান। অর্ককে সে মেরে ফেলেনি কখনই, তাকে এক আকাশ মুক্তি দিয়েছে বাঁচবার জন্য।
সমাপ্ত।
-
গল্প- বোধন
বোধন
-পারমিতা ভট্টাচার্যঅঞ্জন আর দীপিকার বিয়ে হয়েছে সাত বছর। কলকাতার বহুতল আবাসনে বেশ অনেকটা অর্থ খরচ করে ওরা একটা দুই কামরার ফ্ল্যাট কিনেছিল। দু’জনেই চাকরি করে। ফ্ল্যাটটাও খুব সুন্দর করে সাজিয়েছিল দীপিকা। এভাবে বেশ ভালই কাটছিল দু’জনের জীবন। এরপর দীপিকা প্রেগন্যান্ট হল। ওদের তো খুশির অন্ত নেই। সাথে দুই পারিবারেরও।অঞ্জনের চাপেই প্রায় বলতে গেলে দীপিকা অফিস থেকে ছুটিটা একটু আগেভাগেই নিয়ে নিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। দীপিকা পা হড়কে পড়ে গেলে সব আশা ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। পনেরো দিন যমে- মানুষে টানাটানি করার পর দীপিকা সুস্থ হলেও বাচ্চাটাকে বাঁচানো গেল না। সেই থেকে এখনও অবধি দীপিকা নিঃসন্তান। অঞ্জন যদিও চেষ্টার কোনও খামতি রাখেনি। বহু ডাক্তার দেখিয়েও কোনও সুরাহা মেলেনি। একটা সন্তানকে কেন্দ্র করে ওদের জীবন থেকে কেমন যেন সমস্ত আনন্দ, খুশি উধাও হয়ে গেছে। কে যেন এক ফুঁয়ে সমস্ত আশা –আকাঙ্খাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। দীপিকা নিজেকে দোষী ভাবতে ভাবতে চলে যায় গভীর ডিপ্রেশনে। এরপর অঞ্জনের মা অর্চনা দেবীও পরবর্তী প্রজন্মের আশায় তার আবার বিয়ে দিতে চান। অর্চনা দেবী প্রায়ই বলতে থাকেন— ‘আর কটা দিনই বা বাঁচব? নাতি নাতনির মুখ দেখে মরতে পারলে তবেই মরে শান্তি পাবো।’ কিন্তু অঞ্জন? কিছুতেই রাজি হয়না বিয়েতে। ও দিকে অর্চনা দেবী তো নাওয়া- খাওয়া ছেড়ে পণ করেছেন মরার আগে নাতি –নাতনির মুখ দেখলে তবেই শান্তি পাবেন। দীপিকাও অঞ্জনকে বলে মায়ের কথা মেনে নিতে। এক বিষম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় অঞ্জনকে। একদিকে অবুঝ মা অন্যদিকে নিজেদের মানসিক যন্ত্রণা, দুঃখ, কষ্ট যা তাদেরকে কুড়ে কুড়ে খেতে থাকে।
এমতবস্থায় তারা ঠিক করে যে সন্তান দত্তক নেবে। কিন্তু এতেও অর্চনা দেবী একেবারেই বেঁকে বসে। কিছুতেই তাঁকে রাজি করানো যায় না। অন্যদিকে দীপিকাও ডিপ্রেশনে চলে যেতে থাকে বিশ্রীভাবে। ডাক্তারবাবুও পরামর্শ দেন সন্তান দত্তক নেওয়ার। অঞ্জন নিজের মাকে অনেক বোঝাতে থাকে –তার কথা, দীপিকার কথা। কিন্তু তিনি নিজের সিদ্ধান্তেই অনড় থাকেন। কোনও শুভ অনুষ্ঠানে তিনি নিয়ে যেতে চান না দীপিকাকে। সব মহলেই দীপিকাকে বাঁজা বলে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। দীপিকাও আজকাল কোথাও যেতে চায়না। সেও ধীরে ধীরে কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। অফিসও যায় খেয়াল খুশী মত। এসব নিয়ে অঞ্জনও পড়ে মহা বিপাকে।
শেষে অঞ্জন সিদ্ধান্ত করেই নিল যে তারা বাচ্চা দত্তক নেবে। যদি দীপিকাকে বাঁচাতেই হয় তবে দু’টো কচি কচি হাতের খুব দরকার ওদের। আর মাকে যেমন করেই হোক বোঝাতে হবে।অফিস থেকে আসার সময় অঞ্জন সোজা গেল একটা হোমে। তার বন্ধুদের থেকে হোমের ঠিকানা সে আগেই নিয়ে রেখেছিল। হোমে কথাবার্তাও বলে সে। একটু হলেও আশার আলো সে দেখতে পেল সেদিন। বুকের থেকে জগদ্দল পাথরটা যেন একটু হলেও নড়ে চড়ে উঠে তার।
এর কিছুদিন পর ব্যস্ত অঞ্জন হঠাৎই দীপিকাকে একদিন বলল—‘চলো, আজ আমরা একটু ঘুরে আসি।’
‘লং ড্রাইভ? কতদিন যাইনি।কিন্তু তোমার অফিস?’– জিজ্ঞাসা করল দীপিকা।
‘আজ অফিসে ছুটি নিয়েছি। তুমিও যেওনা আজ অফিস। দু’জনে মিলে ঘুরে আসি চলো একটা জায়গা থেকে।’—বলল অঞ্জন।
‘কোথা থেকে?’—আবার জিজ্ঞাসা করলো দীপিকা।
অঞ্জন বলল—‘চলোই না। একটা অন্য জগত থেকে ঘুরে আসি। আর কোনও প্রশ্ন নয় দীপু।’
দীপিকা কি যেন বলতে চাইছিল। ওকে থামিয়ে দিয়ে অঞ্জন বলল –‘রেডি হও।’
দীপিকা দেখল শহরের উপকণ্ঠে একটা সুন্দর জায়গা। কত ফুল, কত গাছ। কত ফুলের মত শিশুরা খেলা করছে মাথে। সে এক মনোরম দৃশ্য। অঞ্জন আর দীপিকা সেই মাঠে এসে দাঁড়ালো। দীপিকার আর বুঝতে বাকি রইলো না তারা কোথায় এসেছে। সমস্ত ফরম্যালিটি শেষ করে এক বছরের ছোট্ট বৃষ্টিকে কোলে পেল দীপিকা। খুশিতে চোখে জল চলে এলো দীপিকার। এই কোমল স্পর্শের অপেক্ষায় ওদের জীবনটা ব্যর্থ হতে বসেছিল। এবার বাড়ি ফেরার পালা।
কিন্তু বাড়ি এসে মহা বিপত্তি দেখা দিল। অঞ্জনের মা অর্চনা দেবী কিছুতেই সেই বাচ্চাকে মেনে নিলেন না। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল অঞ্জন তার মাকে। কিন্তু তাঁর সেই একই কথা –‘বলেছিলাম আর একটা বিয়ে কর। কার না কার অবৈধ সন্তান উঠিয়ে নিয়ে এলি। আমি ওকে মানিনা। ও আমার রক্তের কেউ নয়।’ কেউ কিছুই বোঝাতে পারল না অর্চনা দেবীকে। তিনি ছোট্ট বৃষ্টিকে ছুঁয়েও দেখেন না। আদর করা, কোলে নেওয়া, গল্প বলা তো দূরের কথা। কিন্তু একদিন ঘটল অঘটন। ছোট্ট বৃষ্টির রাত থেকে প্রবল জ্বর। সাথে খিঁচুনিও হতে লাগলো। মাথায় জলপটি, জ্বর কমার ওষুধ কিছু দিয়েই তার জ্বর কমানো গেল না। অগত্যা হাউস ফিজিসিওন এর কথায় নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হলো বৃষ্টিকে। টানা তিন দিন চোখ মেলে তাকালো না সে। ওইটুকু শরীরটাতে সূচ বেঁধানো আছে তার। দীপিকা তো পাগলের মত হয়ে গেছে প্রায়। একনাগাড়ে কেঁদেই চলেছে। অঞ্জনেরও কোনও ভাষা নেই তাকে সান্তনা দেবার। অঞ্জন শুধুই ডাক্তারের কাছে মিনতি করছে –‘আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিন।’ এই বলে। এই কদিনে অর্চনা দেবী একবারও আসেনি ছোট্ট বৃষ্টিকে নার্সিংহোমে দেখতে। কিন্তু যখন ছেলে- বউ থাকেনা তখন তিনি ধর্না দিয়ে পড়ে থাকেন ঠাকুরঘরে। হাজার হোক, নিজের রক্ত নাই হোক বৃষ্টিকে পেয়ে ওনার ছেলে –বউএর জীবনে খুশির ঝলক এসেছে। সেটা কি তিনি বোঝেন না? সবই বোঝেন। আর তার জন্যই তো বৃষ্টির এতো বড় বিপদটা ঘটলো। কেউ জানুক আর নাই জানুক, তিনি তো জানেন। ছোট্ট বৃষ্টি সেদিন পা পা করে এসে তাঁর সাধের নাড়ুগোপালের নাড়ু তুলে খাচ্ছিল। তাই দেখে অর্চনা দেবী মাথার ঠিক রাখতে পারেন নি। হাত থেকে টেনে ফেলে দিয়েছিলেন আধ-খাওয়া নাড়ু। শুধু তাই নয়, গালে কষিয়ে দিয়েছিলেন দু’টো চড়। সেই আঘাতই সহ্য করতে পারেনি ছোট্ট বৃষ্টি। এর ফলেই রাত থেকে প্রবল জ্বর এসে যায় তার। এখন বিবেক দংশনে জর্জরিত অর্চনা দেবীর সহায় একমাত্র সেই ভগবানই। নাওয়া – খাওয়া ছেড়ে পড়ে আছেন ভগবানের পায়ে যাতে বৃষ্টি ভাল হয়ে বাড়ি ফিরে আসে।
হঠাৎ,অর্চনা দেবী যখন গোপালের পায়ে পড়ে কাঁদছেন আর বৃষ্টির ভাল হয়ে যাবার মিনতি করছেন ঠিক তখনই অঞ্জন তার মাকে চিৎকার করে ডাকতে থাকে। ছেলে দেখল মা ঠাকুরের পায়ে পড়ে কাঁদছে। তার ডাক শুনে তড়িঘড়ি ছুটে এলেন তিনি। অঞ্জন করুণ স্বরে মাকে বলল—‘তোমাকে এক্ষুনি নার্সিংহোমে যেতে হবে মা। বৃষ্টির জ্ঞান ফিরে এসেছে।আর শুধুই তোমাকে ডেকে যাচ্ছে ঠাম্মা ঠাম্মা করে। চলোনা মা। আজ সব ভুলে ওই ছোট্ট মেয়েটার মুখ চেয়ে। অর্চনা দেবী তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যান। নার্সিংহোমে গিয়ে দেখেন পাগল প্রায় দীপিকাকে। অর্চনা দেবীকে দেখে তাঁর পায়ে পড়ে কাঁদতেই থাকে সে। তাকে শান্ত করে বৃষ্টির কাছে ছুটে যান অর্চনা দেবী। বৃষ্টির মাথায় হাত রাখতেই চোখ মেলে দেখে ঠাম্মাকে। অমনি ঠাম্মা বলে ডেকে ওঠে সে। সেদিন আর তিনি বাঁধা দিলেন না তাঁকে ঠাম্মা ডাকাতে। প্রাণভরে শুনতে লাগলেন সেই বহু আকাঙ্খিত ডাক। চোখের জল আর ধরে রাখতে পারেন না অর্চনা দেবী। ঠাকুরের প্রসাদী ফুল ছুঁইয়ে দেন বৃষ্টির কপালে।
এরপর দুর্গাপুজোতে তারা সবাই মিলে যায় গ্রামের বাড়ি। বাড়ির পুজো, হৈ হৈ ব্যাপার। বৃষ্টিও এখন পুরো সুস্থ। ষষ্ঠীর দিন আচমকাই অর্চনা দেবী বৃষ্টিকে কোলে নিয়ে বাড়ির সকল লোকের সামনে মা দুর্গার বোধনের সময় ঠাকুর দালানে এলেন। মায়ের আশীর্বাদী ফুল ছোঁয়ালেন বৃষ্টির কপালে। হেরে গেল তাঁর বনেদি আভিজাত্যের দেমাক। জয়ী হল তাঁর মমত্ববোধ। শেষ অবধি তাঁর মনে শুভ বুদ্ধির উন্মেষ ঘটল দেবী মহামায়ার বোধনের মধ্য দিয়ে। তিনি এটা বুঝলেন যে রক্ত দিয়ে সবসময় সম্পর্কের বিচার হয়না, সম্পর্ক হল আত্মিক বন্ধন। দূর থেকে দীপিকা আর অঞ্জন দেখতে লাগলো এই তো তাদের চেনা মা। যাকে তারা এতদিন পাগলের মতো খুঁজেছে। আজ তাদের বাবা- মা হওয়া সার্থক। ওরাও গিয়ে দাঁড়ায় অর্চনা দেবীর পাশে। শুরু হয় দেবী দুর্গার বোধন।
-
কবিতা- জলকলমে আঁকা ছবি
জলকলমে আঁকা ছবি
– পারমিতা ভট্টাচার্যমন চায় হেঁটে যাই বেলাভূমি ধরে
গায়ে মাখি সমুদ্র সফেন ঢেউ
জলকলমে লিখে রাখি জলকেলি সুখ
অবসরে কখনও পড়বে কি কেউ?রাত্রির তৃষিত বুক চুঁইয়ে টুপ্ টাপ
নরম শিশিরের কণা নেমে আসে
রাত জাগা ফুলেরা নেয় অপূর্ব সেই ঘ্রাণ
আনন্দধারার লহমা উঠে সতেজ সবুজ ঘাসে।আসে আসুক জীবন নদে দুকূল ভাসানো বান
হেলায় আমি টপকে যাবো সকল বাঁধা টুটে
আমি ছন্নছাড়া,কাছি ছেঁড়া,ঝড়ে ভাসা তরী
যত অবহেলা রাখি আজ বজ্র করপুটে।ভোরের সূর্য ছড়িয়ে দেয় আলতো নরম রোদ
পর্দাগুলো শিহরিত,হাওয়ায় কাঁপে বেশ
বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিল তৃষিত,শুষ্ক বুক
বাঁধ ভেঙেছে চাঁদের আলো,অমানিশা হল শেষ।মেঘের চাদর সরিয়ে দিয়ে আকাশের ক্যানভাসে
ফিনিক দেওয়া জোৎস্না আবার রাত্রি যাপন করে
মেঘে মেঘে পেঁজা তুলো মৃদু হাওয়ায় ভাসে
খিলখিলিয়ে হাসছে শরৎ বাঁধ ভাঙা রোদ্দুরে। -
কবিতা- তুলসীর ওম
তুলসীর ওম
– পারমিতা ভট্টাচার্যচারিদিকে দেখি মুখ- মুখোশের রংমিলান্তি খেলা
ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কে মিশে যায় উষ্ণতার পারদ,
ধূসর,বালুকাময় আজ হৃদয়ের তটভূমি
একমুঠো উড়োসুখ জমা হয়
ধূসর ছাইদানির অন্তরালে…রোদ চশমার আড়ালে লুকিয়ে রাখি
চোখের গভীর কালি,
মুখে অনাবিল হাসি,অথচ বুকে
বিদ্ধ বিচ্ছেদের তরবারি,
প্রাক্তন স্মৃতিরা টেনে হিঁচড়ে
নিয়ে গিয়ে ফেলে শ্মশানের ছাইয়ের স্তুপে।শেষমেষ পড়ে তো থাকবে সেই একমুঠো ছাই,
তবুও এতো অহংকার,এতো ঘৃণা মনে
লোভ – লালসাকে করপুটে গচ্ছিত রেখে
বাঁচি হাস্য মুখে।
তবুও পড়ন্ত বিকেলে অস্তরাগ মেখে
জীবন ভরে ওঠে তুলসীর ওমে। -
কবিতা- আহরণ
আহরণ
– পারমিতা ভট্টাচার্যকুয়াশার চাদর জড়িয়ে রাত্রি নেমে আসে
অভিমানী পৃথিবীর বুকে।
চাঁদের আলোয় সে হয় আরও মোহময়ী,
স্বচ্ছবসনা চিন্তাগুলো তখন জন্ম দেয় আরও একটা কবিতার।
ঢেউ এর তরঙ্গে ফুটে ওঠে
প্রতিটা অক্ষরের কাব্যিক বিন্যাস।
একলা ঢেউ, সারারাত বালিয়াড়ির বুকে
লুটোপুটি খায় অন্তহীন সোহাগে।
সমুদ্রের ধার ঘেঁষে হেঁটে যাই আমি একা,
দিগন্তরেখা হাতছানি দিলে,
ডিঙি নৌকার আর ভরসা করিনা।
পাড় ভেঙ্গে, ঢেউ ভেঙে এগিয়ে যাই
মুক্তোর মতো সুন্দর একটা কবিতা আহরণে।
কতকাল অপেক্ষা করি,
কখন রাতে, ঝাউপাতা পিছলে টুপ করে খসে পড়বে একটা কবিতার ছন্দবদ্ধ প্রকাশ।
আলো – আঁধারিতে আকাশের থেকে
তারারা খসে পড়ে টুপটাপ,
কোন অভিমানে…….কে জানে। -
কবিতা- মানুষের ধর্ম
মানুষের ধর্ম
– পারমিতা ভট্টাচার্যআজ আর অন্যায়ের সাথে কোনও আপোস নয়
এবার তোলো প্রতিবাদের বজ্রকঠিন আওয়াজ,
জাতের নামে বজ্জাতি করা ধর্মান্ধরা জানে না
আসলে ধর্ম নামের কী মানে।
যে ধর্ম তরোয়ালের সাথে ত্রিশূলের
ভয়ংকর যুদ্ধ বাঁধায়,
যে ধর্ম মানুষের চোখের জল মোছানোর বদলে
লাশ ফেলে প্রতিনিয়ত ধর্মের জিগির তুলে,
যে ধর্মধ্বজার বাহকেরা শয়তানের আস্তানা করে
পবিত্র মন্দির- মসজিদ- গির্জা,
সে ধর্ম আমি চাই না, সে ধর্ম আমি মানি না।
ধর্ম তো মনের শক্তি,
যা মনের মলিনতা দূর করে ফুৎকারে।
তাই নয় কি?
কোরান- পুরাণ- বাইবেলের মধ্যে
কোনও মতবিরোধ আছে কি?
ওরা সবাই মুখে বলে সাম্যের কথা,
আর সুযোগ বুঝে গায়ে মেখে নেয়
লাল, নীল, সবুজ, গেরুয়া রঙ।
গিরগিটির মত রঙ পাল্টায় ওরা
স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে।
কেউ কি রাখে খোঁজ বুভুক্ষর পেটের খিদের?
কিম্বা বস্তির শতছিন্ন পোশাকের মেয়েটার?
কিম্বা যে দুধের শিশু শুকনো স্তনে মুখ লাগিয়ে
খিদের জ্বালায় চিৎকার করে, কেউ রাখে না খোঁজ।
ঝুলি ভরে নিয়ে আসে গাল ভরা কথা,
উপুড় করে ভাষণ দিয়ে উধাও হয়ে যায়।
ধর্ম আর রঙ এক সময় একে অন্যেতে হয় সম্পৃক্ত,
আমি সেই নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি,
যেখানে ধর্ম মানুষে মানুষে লাগবে না জাতের লড়াই,
যেখানে ধর্ম আনবে মানুষের মনে সুখস্মৃতি,
যেখানে ধর্ম ত্রিশূল আর তরোয়ালকে করবে স্থিতধী,
সেই ধর্মই হোক মানুষের বিশ্বাস,
সেই ধর্মই হোক মানুষের ধর্ম। -
কবিতা- মা গাছ
মা গাছ
– পারমিতা ভট্টাচার্যসুবিশাল প্রান্তরে একা দাঁড়িয়ে
একটি মা গাছ।
তীব্র রোদে মা গাছের আড়াল করা ছায়ায়
গুটিসুটি মেরে নিশ্চিন্তে ঘুমোয়
শিশু চারা গাছটি।
মৃদু হাওয়ায় ঝাঁকড়া মাথা নাড়তে নাড়তে
জঙ্গলের রূপকথার গল্প শোনায় মা গাছ,
ছোট্ট চারা গাছ ঘুমিয়ে পড়ে নিশ্চিন্তে।
রাতের ছায়ার আলো- আঁধারিতে মা গাছ
আলতো করে বিলি কেটে দেয় সন্তানের মাথায়।
এক দিন মেঘ কালো করে নেমে আসে অন্ধকার
চারিদিকে হৈ হৈ করে ওঠে কাল বৈশাখী,
ঝড়ের দামামা বাজে ‘রনং দেহী’ বলে।
মা গাছ সমস্ত শরীর দিয়ে আগলে রাখে
তার আত্মজ শিশু গাছটি-কে।
আর বলে……
‘যদি কোনও দিন এই ঝড়ের পর ঘুম ভেঙ্গে
মা কে না দেখতে পাস?’
মায়ের বুকে ঝাঁকড়া মাথাটা গুঁজে দিয়ে
ডুকরে কেঁদে ওঠে শিশু গাছ,
জীর্ণ- শীর্ণ শরীরটা কাঁপিয়ে।
চোখে জল মেখে মা গাছটি মনে মনে ভাবে,
‘আর কটা দিনই বা থাকবো বল
তোকে আঁকড়ে ধরে?
মানুষের লোভাতুর চোখ, কুঠার- কুড়ুল
নিত্যই আমায় জরিপ করে।’ -
কবিতা- অতঃপর
অতঃপর
– পারমিতা ভট্টাচার্যকোনো এক অলৌকিক ছায়াপথ ধরে
চলো হাঁটি, গুটি গুটি পায়ে।
তোমার চোখের দৃষ্টি পথে আজ গড়ি বসত,
প্রদীপখানি জ্বেলে ধরো আমার হৃদয়পানে,
অতৃপ্ত যত বাসনারা আজ প্রকাশিত হোক
লজ্জাসন্ধি ছিঁড়ে।
নিঃশ্বাসে মিশুক আজ নাড়ীর যত গতি,
শীৎকারে মাঠময় হোক গলার মুক্তমালা।
আলোর শিখায় যেমন বাদল পোকা দেয় ঝাঁপ,
আমিও দেখি তোমার চোখে আমার সর্বনাশ।না, বাদল পোকা হতে পারিনি কখনো,
খড়কুটোর মতো আকঁড়ে ধরেছি সংস্কার।
প্রদীপের আলতো, নরম আলোয়,
মেপে গেছি শুধু নিঃশ্বাসের উত্তাপ।
তবু ,মন বলে বারবার……….
জন্মদাগ মুছে একটা গান লিখে যাবো,
সামনের বসন্তের অপেক্ষা আর নাই বা করলাম!! -
কবিতা- সাড়ে তিন হাত জমি
সাড়ে তিন হাত জমি
-পারমিতা ভট্টাচার্যসহানুভূতি কাম্য ছিল না কখনোই,
অনুভূতিরা তাই সূক্ষ্ম আচ্ছাদন
ভেদ করে,স্ফুলিঙ্গের মত প্রকাশিত হতে চায়।জীবনে হিসেবী হতেই হবে বুঝি?
দুয়ে – দুয়ে চার যদি নাই হয়!!
তবে কী স্তব্ধ হয়ে যাবে জীবনের গতি?হিসেবেও ভুল হয় মাঝে মাঝে
একটু বেহিসেবী হলে ক্ষতি কী?সারা জীবন জুড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে থাকে,হিসেবী দস্তখত,
কিন্তু বরাদ্দ জমি তো সেই, সাড়ে তিন হাত।