• কবিতা

    কবিতা- ফিরে পাওয়া হারানো সুখ

    ফিরে পাওয়া হারানো সুখ
    প্রদীপ শর্ম্মা সরকার

    একান্ত সুখের মুহূর্ত।
    কত মুখ মনে পড়ে এই সময়ে–
    সব হারিয়ে যাওয়া মুখ, শরীর।

    কত যে বিচ্ছিন্ন সুখ!
    এক একটা প্রবাল দ্বীপের মত–
    শুধু তো রঙীন নুড়ি পাথর নয়,
    অক্ষৌহিনী পেলব প্রাণ,
    সারাদিন ভেসে বেড়ানো টুকরো জুড়ে জুড়ে
    আসমুদ্র বিস্তার–চপলা রাগিনী যেন!

    সূর্য্য প্রণামের মুদ্রায় ঊর্ধমুখী জলজ প্রাণী–
    মাহেন্দ্রক্ষণে বাসনা নিঃসরণ,
    ফোঁটা ফোঁটা রঙিন কামনার লোভ উদগীরণ,
    যুগান্তের সঞ্চয়ে সমুদ্রের গর্ভে রঙিন মেলা
    স্বর্গারোহন উপেক্ষা ক’রে ডুবুরীর পাতাল প্রবেশ পছন্দ তালিকার শীর্ষে।

    হয়তো আছেন উন্মত্ত নিশিযাপন শেষে
    তুরীয় আনন্দে হালকা পালকে ভেসে,
    জলের মত বালি ছুঁয়ে,
    এক নিমিষে দম নিয়ে
    চু কিৎকিৎ উচ্চারণে সুগভীর তলদেশে,
    আবার ফিরে পেতে রঙদার ফসিল ও প্রবাল অন্তরঙ্গতা!

  • কবিতা

    কবিতা- তুমি যেভাবে ভালোবাসো

    তুমি যেভাবে ভালোবাসো
    –প্রদীপ শর্ম্মা সরকার

     

     

    সকালের নরম সুরটাকে মাথার স্মৃতিকোষে জমা রেখে,
    দিনভর চুঁইয়ে পড়া সুখী তানতোড়া বিন্যাসে,
    মেঘের কোলে দুই নিষাদের গলাগলি হৃদ্যতায়,
    মধ্য গগনে দীপকের চকিত গমকে,
    টুপটাপ কিছু বৃষ্টির ফোঁটা বুনো ফুলের গাল বেয়ে,
    আকাশপথের শৈব উদারতার বিস্তীর্ণ উঠোনে,
    ঝর্ণা হয়ে ওঠা উথালপাথাল আবেগজলে,
    অনিশ্চিত জয়জয়ন্তী বিষাদ মেখে–

    তুমি ঝর্ণা হ’য়ে গায়ে পড়ো,
    নদী হয়ে ধাওয়া করো,
    বাতাস হ’য়ে জড়িয়ে থাকো,
    কান্না হ’য়ে একলা মনকে সঙ্গী করো।

    তুমি যেভাবে ভালোবাসো,
    যেভাবে কাঁদো হাসো,
    যেভাবে পরজ হ’য়ে হাওয়ায় ভাসো,
    যেভাবে সবুজ মনে অবুঝ নেশা,
    অবিশ্রান্ত ভ্রান্ত সুখের ক্লান্ত পাশা,
    অকাল বোধন আড়াল খুঁজে
    একলা রোদন,
    খুব বেয়ারা প্রায় অশোভন,
    সঙ্গম শেষে ফিনকি দিয়ে রক্ত শোধন,
    তোমার ভালোবাসার রকমফেরে,
    চোরাগোপ্তা আসন ছেড়ে,
    মালা চন্দন মায়া বন্ধন
    ভালোবাসার ঘন্টা নেড়ে,
    অলীক সুখী চিরদুখী
    আকাশকুসুম কল্পলোকের সিঁড়ি ভেঙে,
    বর্ষাশেষে সাতটি সুরের রঙপালকে দিব্যি হাসো,
    আপন ঢঙে আপন রঙে ভালোবাসো,
    মিথ্যে নাটক অভিনয়ের সংলাপে যে সত্যি খোঁজো,
    সংক্ষেপে জমি মেপে তুমি যেমন ভালোবাসো।

  • কবিতা

    কবিতা- প্রণাম না পর নাম

    প্রণাম না পর নাম
    -প্রদীপ শর্ম্মা সরকার

     

     

    ঘনশ্যাম ডাকে যে কি সুখ!
    উদ্গত নাছোড় ভক্তি, না কি বৃন্তহীন প্রেম!
    অরণ্যের নিঝুম অশ্বত্থ বেদীতে
    স্বচ্ছ বিশ্বাসের দিকশূন্য নিরাবয়ব আকুতি–
    সে কি নীল লোহিত প্রেম?
    না কি দোতারার অশিক্ষিত আক্ষেপ!

    পাখির জীবনেও এমন ঘনঘোর সন্ধ্যা আসে,
    যেদিন পক্ষাঘাতে পাথর ডানা মেলে
    উড়তে হয় ঘরমুখো।
    উদ্দাম বাতাস,ভারি নিতম্বের গজগমণ,
    চোখারোখা নিলাজ উদ্ধত কুচশৃঙ্গ,
    বিষণ্ন দামিনীর হতাশ গর্জন,
    ইচ্ছেনদীর অস্বচ্ছ প্রেম উদক–
    শুধু অন্ধকার দিগন্তের মোহময় হাতছানি।

    প্লাবন আসে উন্মাদের সোহাগজলে,
    তবু, মাধ্যাকর্ষণ জয়ী হয় যথারীতি।
    কবি দেখেন “নীল অঞ্জনঘন পুঞ্জছায়ায় সম্বৃত অম্বর”,আর,
    পাখি দেখে অবিশ্বাসী কৃষ্ণমেঘের চাদর।

  • কবিতা

    কবিতা- প্রার্থনা

    প্রার্থনা
    –প্রদীপ শর্ম্মা সরকার

     

     

    তোমার ভাবনার বর্ণপরিচয়
    যেন এক অনিকেত বাউন্ডুলে।
    যেখানে শুরু হয় বোধ নিকেতনের ভিত গড়া
    সেখানেই সমাহিত তোমার বল্মীক মহাকাব্য।
    গড়াপেটার সৌরমন্ডলে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের অবগুণ্ঠন তুমি–
    ভেঙে পড়া বিশ্বাসের বাবলা গাছের নির্যাস,
    দিকশূন্য পথিকের অবিন্যস্ত লজ্জাবস্ত্র,
    সময়ের শৃঙ্খলে গলিত ক্ষার,
    যতবার হেঁটে পার হ’তে চাই তোমার বর্ণ পরিচয়ের মুখবন্ধ
    শুধু মেঘে ঢাকা তারাদের স্পষ্ট বিদ্রূপ দৃশ্যমান হয়–
    সবার চোখে কি আর জলবিদ্যুৎ খেলা করে?
    সমানুপাতিক বিন্যাসের করুণায় তারা উচ্ছল হয়–
    অপেক্ষায় আছি, একদিন ঠিক
    অবশিষ্ট কিছু জ্যোতি এসে
    আমার দুয়ারের খিল খুলে দেবে–
    অজ্ঞান তিমিরের জড়তা কেটে যাবে,
    পাঠশালার উঠোনে বৈশাখী ধুলোকণা
    চাঁদের পাহাড় গড়বে।
    আমি হতবাক আকাশ
    তোমার আলোর নিকেতনের জন্য
    অনুর্বর জমির ইজারাদার।

  • কবিতা

    কবিতা- থাক শুধু ইঙ্গিত

    থাক শুধু ইঙ্গিত
    –প্রদীপ শর্ম্মা সরকার

     

     

    চাই না ভালোবাসার উচ্চকিত ঘোষণা–
    শুধু ইঙ্গিত থাক চোখের কোণে।

    পাপড়ি ঠোঁটের আর্দ্রতায় রোদের ঝিলিক থাক,
    মেঘের সংলাপে দুই নিষাদের অন্তরঙ্গ উচ্চারণ থাক,
    নদীর জলে থাক তিরিতিরি কম্পন–

    ফুলের বাগানে ভ্রমরের গুনগুন গুঞ্জন থাক,
    সময়ের সরণীতে পলাশের পল দীর্ঘায়িত হোক,
    বাঁশের বাঁশিতে বাজুক লম্বা মীড়ের হাসি।

    কণকচাঁপা আঙ্গুলে প্রতীক্ষার মুদ্রা শোভা পাক,
    অনিদ্রার যন্ত্রণায় সুখ-স্বপ্নের আনাগোনা থাক অবিরাম।
    প্রবল গর্জনে ধেয়ে আসা প্রেমের ঢেউ নয়,
    অনুভূতির চোরাস্রোত বয়ে চলুক
    বুকের বাম অববাহিকায়–

    সত্যিই কোন বাড়তি আশ্বাস চাই না,
    কারণ , ভালোবাসায় ঘোষণা জরুরী নয়।

  • কবিতা

    কবিতা- নবজন্ম

    নবজন্ম
    –প্রদীপ শর্ম্মা সরকার

     

     

    বিলাসী দুঃখ সামলাতে গিয়ে সন্তপ্ত হয় জীবন–
    পরন্তপ উগ্রতায়, শয্যা কাঁটায় ভ’রে যায়
    প্রেমহীন শূন্যতায় মরুদ্যানের খোঁজ পড়ে যখন–
    কাঁটাপথ যাত্রাই সার হয়,
    আগুনের পরিখা পথরোধ করে।

    একদিন লগ্নি করা সব সুখ
    ফিরে আসবে সুদে আসলে–
    না পাওয়াটাই যখন ভবিতব্য মনে হয়
    ঠিক তখনই একটা অঙ্কুরকে হাসতে দেখি–
    সেই মুহূর্তে গান হয়ে ওঠে বিষাদের দীর্ঘশ্বাস।

    বিধিবদ্ধ যৌনতার মাঝপথে পৌরুষ শিথিল হয়,
    স্তনবৃন্তে ক্ষোভের কামড়
    পচনশীল প্রেমের সংকেত হয়ে প্রতিভাত হয়।
    রাগ স্খলনের লাভাস্রোত ঊরুসন্ধিতে বিতৃষ্ণার পুষ্করিণীর জন্ম দেয়।

    এমন সময়ে হাজার জন্মের সুখ-সঙ্গত- শপথ
    কক্ষপথের গ্রহণ কাটিয়ে ওঠে–
    বৈশ্বানর তেজষ্ক্রিয়তা হারায়–
    অচলায়তন ভেঙে পড়ে তাসের ঘরের মত,
    গৃহকোণের আদর উন্মুখ হয়
    সৃষ্টির ডালি সাজাতে ;
    অজ্ঞাতবাস থেকে ফিরে আসে প্রেম,
    না-বলা কথারা ফুল হয়ে ঝরে পড়ে
    জীবনের পুষ্পপাত্রে।

    এখন ঝর্ণা লাফ দিয়ে নদী হয়,
    মেঘ বিনা গর্জনে বৃষ্টি হয়,
    আকাশ তারার চুমকিতে সেজে ওঠে,
    সাগরের জল গভীর গোপন আত্মকথায় উদ্বেল হয়–
    প্রেমের নতুন নামকরণ হয় সুহাসিনী।

  • কবিতা

    কবিতা -টুকুর নিশিরাত

    টুকুর নিশিরাত
    -প্রদীপ শর্ম্মা সরকার

     

     

    চাঁদের মাটিতে কালো দিনবদলের যামিনী–
    পৃথিবীর মাটিতে তখন জ্যোৎস্নার ছলাৎছল–
    টুকুর নিশিরাতে হৈমন্তী পূরবী জানালার ধার ঘেঁষে নলবন অভিসার,
    বাঁকা চাঁদের আঁচল খসে নিশিরন্ধ্র বিভাজিকা।

    চুরি করা সুখ নিয়ে গর্ভিনী অহংকার
    বৃন্দাবনী লুকোচুরি, নিলাজ রাস।
    গোঠের বেণু শিখিপাখায় ভর ক’রে
    উন্মনা চঞ্চল মনে ঢেউ।

    টুকুর একান্ত নিশিরাত
    তখন বাঁকা চাঁদের নাগাল পেরিয়ে
    বাঁকেবিহারীর শ্যাম কল্যাণ রূপে চটুল বিভঙ্গে
    তমালশাখে ফুলের ঝুলনে।

    টুকুর নিশিরাত এখন এয়ো স্ত্রীর অনির্বাণ প্রদীপ,
    সন্ধ্যার অমোঘ গার্হস্থ্য,
    ঘোলাটে আবেগ, দায়সারা মৈথুন, আর,
    সমন্বয়ের ঝুলন্ত সেতু–
    আকাশছোঁয়া সুপ্রোথিত দাম্ভিক স্তম্ভ।

  • কবিতা

    কবিতা- মাটি-মা–

    মাটি-মা–
    -প্রদীপ শর্ম্মা সরকার

     

     

    তুমিই প্রথম বুঝিয়েছিলে পৃথিবীর একটা নিজস্ব গন্ধ আছে–
    আমি শুধিয়েছিলাম “তোমার গায়ের মত?”
    তুমি বুকে জড়িয়ে বলেছিলে
    “ওরে পাগল, আমার গায়ের গন্ধ তো আমি চিনিই না”।
    আরো বলেছিলে, “তবে আমি খুব করে মাটিতে গড়াই , জানিস!”

    তুমিই প্রথম মাটির গন্ধ চিনিয়েছিলে আমাকে–
    একেবারে মা মা গন্ধ,
    একা দুপুরে মায়ের ছেড়ে যাওয়া শাড়িটা
    দলা পাকিয়ে নাকের কাছে রেখে অতল মৃত্তিকা ভ্রমণ–
    তুমিই শিখিয়েছিলে সারা পৃথিবীতে
    একটাই অকৃত্রিম সুগন্ধ–
    মাটির সুখমাখা গন্ধ।

    তুমিই বলেছিলে সারা ব্রহ্মাণ্ডে
    একটাই আদি-অনন্ত শব্দ “মা”।
    এই শব্দটিকেই কেটে ছিঁড়ে
    কত না গবেষণা!
    নাভিমূলের ব্রহ্মনাদ থেকে
    মহাকাশের আভোগী উচ্চারণ–
    অনু-পরমানু সঙ্গী করে
    ভাসমান অনুভূতির যোগ্যতম শব্দবন্ধ “মাটি মা”।
    প্রিয়তমার আবেগ জমি সিঞ্চনের সুধারস মাখা
    শব্দবন্ধ “মাটি মা”।
    তুমিই প্রথম শিখিয়েছিলে
    মাটিতে গড়ালে মা হয়ে ওঠা যায়।

  • কবিতা,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    কবিতা- বিনিসুতোয় প্রেম

    ।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ।।

     

    বিনিসুতোয় প্রেম
    -প্রদীপ শর্ম্মা সরকার

     

     

    প্রেমের ভাষ্যে যথারীতি মেদূরতা,
    সঙ্কল্প, সেও ভীত চোখে চায়–
    যুগোত্তীর্ণ প্রেম আসলে ব্যথা,
    প্রেমের শপথ বুদবুদ হয়ে যায়।

    প্রেম বোঝে না বয়সের জটিলতা,
    অনুপানে তার সংখ্যার সাথে সখ্য–
    বিনোদনে তার আগ্রাসী মধুমিতা,
    বিদ্যুল্লতা বেষ্টনে কাঁপে বক্ষ।

    অন্য সে প্রেম গলিপথে শুধু বিস্ময়,
    নটরাজের তান্ডব সেও প্রেম–
    হাতে হাত রেখে সাহসিনী আজ দুর্জয়,
    নয় আদিসুখ ,প্রেম নিকষিত হেম।

    বিনিসুতো দিয়ে বুনে রাখা যত স্মৃতি
    জলরঙে আঁকা একান্ত অভিসার–
    ঘি এর সাথে অগ্নি শোধনে প্রীতি
    সংখ্যাসখ্যে কুসুমিত সংসার।

  • কবিতা,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    কবিতা- নিরুচ্চার

    ।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

     

    নিরুচ্চার
    –প্রদীপ শর্ম্মা সরকার

     

     

    যতবার দেখি ভোরের কমলা
    তোমার ভেজা শরীরে,
    ততবার আমি মরে যাই।

    যতবার দেখি ফিরতি আলোয় কমলা তোমার চিবুক ছুঁয়ে,
    ততবার মরি নতুন করে বাঁচব বলে।

    যতবার দেখি থমথমে সুখ,
    পিলসুজের জমাট অন্ধকারে–
    ততবার কথারা আমার ঠোঁট ছুঁয়ে মায়াভাষ্য।

    কতবার তুমি-আমি মরি
    একগলা হাঁসফাঁস কথাজলে,
    অনুচ্চারিত প্রেম-উপকথনের মায়া সরোবরে।

    যতবার দেখি দীঘিজলে সাদা হাঁস ভাসে,
    পাশে গিয়ে ভাসি পালক ছুঁয়ে–
    ছোট ছোট ঢেউ কথা বলে নিরুচ্চারে,
    অবিনাশ সুখে মায়া-মোহে।

You cannot copy content of this page