• চিঠি

    চিঠি- এক সাহসী পদক্ষেপের পরিণাম

    এক সাহসী পদক্ষেপের পরিণাম
    – বিশ্বদীপ মুখার্জী

     

    শান্তিপুর
    নদীয়া।
    12/08/2019

    আমার মিতু,

                      আজকাল চিঠি লেখার চলন উঠেই গেছে। এটা তো হোয়াটসঅ্যাপ আর ম্যাসেঞ্জারের জমানা। তাও তোকে চিঠি না লিখে থাকতে পারলাম না। হ্যাঁ, তোকে ‘তুই’ বলেই সম্বোধন করবো। জানি, তোর কোনও আপত্তি হবে না। আমাদের ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ তে আসা, আর ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’ তে আসা একটা ইতিহাস। জানিস, প্রায় মনে পড়ে সে দিনের কথা, যে দিন প্রথম বার তোর সাথে ফোনে কথা হয়েছিল। সেই থেকে শুরু। তার পর কী ভাবে যে কী হয়ে গেল, সেটা না তুই বুঝতে পারলি, না আমি। তুই লিখতে ভালোবাসতিস। নানা কারণে, সংসারের নানা ঝামেলার মাঝে হারিয়ে গিয়েছিল তোর লেখা। তোর লেখা কবিতা ডায়রীর পাতায় বন্দি হয়ে রয়ে গিয়েছিল। যে দিন প্রথম তুই নিজের কবিতা পড়াস আমাকে, সে দিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছিলাম যে তোর কবিতা কে ডায়রীর পাতা থেকে বের করে জনসমূহের সামনে নিয়ে আসবো। আজ আমি তোর থেকে অনেক দূরে। কিন্তু আমাদের এই দূরত্বটা তোর লেখার প্রতি আমার ভালোবাসা কে বিন্দু মাত্র কম করতে পারেনি। তোর সব লেখা, সব বই পড়ি আমি। তোকে তো বলেছিলাম, তোর লেখা কে আমি নিজের সন্তানের মত ভালোবাসি।

    জীবনের এক বড় অধ্যায় জুড়ে শুধু তোরই নাম লেখা আছে মিতু। জানতাম তুই কোনও দিনই আমার হবি না। তাও তোর প্রতি যে ভালোলাগাটা আমার হৃদয়ে নিজের বাসা বেঁধেছিল সেটা প্রতিনিয়ত পূর্ণতা পাচ্ছিল। তুই যখন নিজের ইতিহাস আমায় বলতিস, কষ্ট হত আমার। ইচ্ছে হত তোর চোখের জল নিজের হাত দিয়ে মুছে দিই। অবশেষে এক দিন আমার হাত নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকলো না। অজান্তেই এগিয়ে গেল তোর গালের দিকে। মুছে দিলো তোর চোখের জল। সে দিন তোর চোখের জল কোনও বাধা মানেনি। আমার বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলি তুই। তুই কাউকে কোনও দিন নিজের কাছে পাসনি। কেউ ছিল না যাকে তুই মনের দুটো কথা বলে শান্তি পেতিস। কেউ ছিল না যে তোকে বুঝতো। একটা নির্বিকার মানুষের সাথে জীবনযাপন করা যে কতটা দুষ্কর, সেটা তোকে দেখে প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলাম। আমি কারোর বিষয় খারাপ মন্তব্য করতে চাই না মিতু। শুধু একটি প্রশ্ন মনে বারবার জাগে। তোর কষ্ট, তোর চোখের জল কি সে দেখতে পেল না, যার জন্য তুই নিজের সর্বস্ব খুইয়ে দিয়েছিলিস? নিজের অস্তিত্ব পর্যন্ত খুইয়ে দিয়েছিলিস তুই। আসলে কি জানিস মিতু…. নারী চরিত্র চিরকাল আমাদের সামনে অবলা। স্বাধীন হয়ে বাঁচার অধিকার যেন সে জন্ম নেওয়ার সাথে সাথেই খুইয়েছে। প্রত্যেক নারী কে জীবনের প্রতিটি হিসেব মেলাতেই হবে। সে হিসেব মেলার মত হোক বা না হোক। তুইও অনেক এমন হিসেব মিলিয়েছিস যে হিসেব কোনও ভাবেই মেলে না। কিন্তু জীবন এমন ভাবে চলে না মিতু। প্রত্যেক প্রাণীর নিজের জীবনে নিজের মত করে বাঁচার অধিকার আছে। এটা ঈশ্বরপ্রদত্ত অধিকার। তোরও অধিকার আছে নিজের জীবন নিজের মত করে বাঁচার। জীবনে অনেক ধাক্কা খেয়েছিস তুই। অনেক চোখের জল ফেলেছিস। কেউ ছিল না রে তোর পাশে। কেউ ছিল না যে তোর দুঃখ কে নিজের দুঃখ মনে করতো। জীবনের দীর্ঘদিন নিজের বুক ফাটা আর্ত চিৎকার কে নিজের বুকের মধ্যেই চেপে রাখার পর এক দিন তুই আমায় পেলি। তোর জীবনে এই পরিবর্তনটা দরকার ছিল। মিতু, বলতে দ্বিধা নেই, আমি যদি তোর জীবনে না আসতাম তাহলে তোর বুকের ভিতর চেপে থাকা আর্তনাদ এক দিন আগ্নেয়গিরির মত বিস্ফোরিত হতো। তখনও কি কেউ থাকতো তোর পাশে? জলে ডুবতে থাকা মানুষ হাতের কাছে যা পায় সেটা ধরেই বাঁচতে চায় সে। কেন না বেঁচে থাকা তার অধিকার।

    মিতু, জানি আমাদের সম্পর্ক কে দুনিয়া কোনও দিনই ভালো নজরে দেখবে না। মানুষের মনের গভীরে ঢুকে তার কষ্ট কে বোঝার ক্ষমতা এই সমাজের নেই। সমাজ কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম বানিয়ে দিয়েছে। মানুষের হাজার কষ্ট হোক, তাকে সেই নিয়ম মেনেই চলতে হয়। সেই নিয়মই মাঝে মাঝে মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। যাদের মধ্যে প্রতিবাদ করার ক্ষমতা আছে তারা জীবন যুদ্ধে এগিয়ে যেতে পারে। তুই সমাজের কিছু নিয়ম কে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলিস। তবেই আজ তুই জীবন যুদ্ধে অনেকটাই এগোতে পেরেছিস। একটা কথা সব সময় মনে রাখবি মিতু। কারোর পরিচয়ে বেঁচে থাকা মানুষের দুর্ভাগ্য। মানুষের নিজের পরিচয়ে বেঁচে থাকা উচিত। তবেই সে আসল সম্মান পায়। প্রায় অর্ধেক জীবন তুই অন্যের পরিচয়ে বেঁচে থাকলি। তাই যথেষ্ট সম্মান কোনও দিনই পাসনি তুই। আজ তোর নিজেস্ব পরিচয় আছে, তাই আছে যথেষ্ট সম্মানও। তোর একটা সাহসী পদক্ষেপের জন্য যে সমাজ এক দিন তোর বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল, আজ সেই সমাজই তোর পদধুলি নেওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এটাই তো আমি চাইতাম মিতু। তুই নিজের পরিচয়ে বেঁচে থাক, এটাই ছিল আমার স্বপ্ন।

    সত্যি বলতে আজ নিজের উপর আমার গর্ব হয়। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এক মানুষ কে নতুন জীবন দিতে সক্ষম হয়েছি আমি। এটাই আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি। মনে আছে, তুই আমায় বলেছিলিস যে যদি সম্ভব হতো তাহলে তুই আমার সাথে ঘর করতিস। আমাদের সন্তান হতো, হতো এক ছোট্ট পরিবার। চিন্তা করিস না মিতু। আমাদেরও ছোট্ট পরিবার আছে, আমাদেরও সন্তান আছে। আমরা তিন জন.. আমি, তুই আর তোর লেখা সমস্ত কবিতা। তোর লেখা কবিতাই তো আমাদের সন্তান মিতু, আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন তোর কবিতা। আরও বড় কর আমাদের সন্তান কে। উন্নতির শিখরে নিয়ে যা তাকে।

    আমি আজ দূরে চলে এসেছি মিতু, তার পিছনে কারণ ছিল। আমার হয়েও পুরোপুরি আমার না হতে পারাটা কোথাও না কোথাও তোর মনে কষ্ট দিচ্ছিল। যখনই আমাকে দেখতিস, তোর এই কষ্টটা তোর মুখে ফুটে উঠতো। প্রভাব পড়ছিল তোর লেখাতেও। নিজের কলমের মাধ্যমে চাবুক চালাতে তুই অভ্যস্ত। চারিদিকে ঘটে যাওয়া নোংরামির উপর তোর কলম মারাত্মক চাবুক চালাতে পারে। অদ্ভুত ধার তোর কলমে। সেই ধার আমি কমে যেতে দেখছিলাম। শুধু প্রেম আর বিরহের লেখা পাচ্ছিলাম আমি তোর থেকে। তোর মনের কষ্ট ফুটে উঠছিল তোর কলমে। না মিতু, না…. তুই এক প্রতিবাদী কবি। প্রেম, বিরহের কবিতা তো অনেক মহিলা কবিই লিখতে পারে। ক’জন মহিলা কবির মধ্যে প্রতিবাদ করার ক্ষমতা আছে? ক’জন মহিলা কবি নিজের কলমের মাধ্যমে সমাজে ঘটে যাওয়া নোংরামির উপর মোক্ষম চাবুক চালাতে পারে? তুই পারিস সেটা। আমি চাইতাম তোর এই পরিচয় বজায় থাকুক। তাই তোর থেকে দূরে সরে যাওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হলো আমাকে। তুই নিজেকে মজবুত করে নিয়েছিস মিতু। তুই এই সত্যটা মেনে নিয়েছিস যে আমি এক দমকা হাওয়া হয়ে তোর জীবনে এসেছিলাম। এতেই আমি খুশি।

    অনেক লেখা হলো। আর নয়। একটা কথা সব সময় মনে রাখবি মিতু। এই দমকা হাওয়া তোর থেকে দূরে গিয়েও তোর পাশেই আছে। তোর প্রতিটি নিঃশ্বাসে আছে এই দমকা হাওয়া, তোর লেখা প্রতিটি অক্ষরে আছে এই দমকা হাওয়া। যেখানেই থাকি না কেন, চিরকাল তোর হয়েই থাকবো আমি। ভালো থাকিস মিতু। ভালো রাখিস আমাদের সন্তান কে। আরও অনেক বড় করিস তাকে। এখানেই শেষ করলাম।

    ইতি,
    তোর দমকা হাওয়া।

    এম পি নগর
    ভোপাল।

  • কবিতা

    কবিতা- দমকা হাওয়া

    দমকা হাওয়া
    – বিশ্বদীপ মুখার্জী

     

    সেই হাতটা বহু দিন ধরেনি কোনো কলম
    অভিশপ্ত জীবনের জঞ্জাল উঠিয়ে সে আজ ক্লান্ত।
    টেবিলের এক কোণায় অবহেলায় পড়ে থাকা ধুলো মাখা কলম
    আজ শ্রাবণের বৃষ্টির মত ঝরতে চায় অবিশ্রান্ত।
    কলম কখনো নেয়নি থামার শপথ
    যেতে চায় সেই হাতের কাছেই বারংবার
    এক দমকা হাওয়া নিয়ে আসে সেই হাতে নবস্ফূর্তি,
    যেন তাতে হয় নতুন প্রাণের সঞ্চার।
    নিজের পুরনো রূপে ফিরে আসা কলমও
    আজ উৎসাহিত,
    চারিদিকে উঠবে নতুনের জয়ধ্বনি আবার,
    সেই দমকা হাওয়ার হাত ধরে
    কলম আজ কবিতার সাথে হয়েছে একাকার।
    সেই নিষ্প্রাণ হাত আবার উঠিয়েছে আওয়াজ,
    উড়িয়েছে বিজয় কেতন আজ নিজ শৌর্যেই।
    তোমার ফিরে পাওয়া কবিতা গুলোর জন্ম
    সেই অজানা দমকা হাওয়ার বীর্যেই।

  • গল্প

    গল্প- শাস্তি

    শাস্তি
    – বিশ্বদীপ মুখার্জী

    বেশ কিছু দিন হলো মোটা অর্থ রোজগার করতে শুরু করেছি। আগে যে কোম্পানীতে কাজ করতাম, তাতে কম বেতনের জন্য বেশি টাকা জমাতে পারিনি। অগত্যা বিরক্ত হয়ে শেষ অবধি চাকরিটা ছাড়তে হলো। প্রায় ছ’ মাস এদিক-ওদিক ঘুরে অবশেষে এই কাজটা পেলাম। সুদিনের মুখ দেখতে পেলাম। আগে প্রয়োজনের থেকে কম অর্থ রোজগার হতো, এখন বেশি হয়। তাই খরচটাও বেড়েছে। এতো দিন আমি ছিলাম একা, কিন্তু একা থাকাটা এখন সম্মানহানির ব্যাপার হয়ে গেল। গার্ল ফ্রেন্ডের প্রয়োজন বোধ হলো। সৌভাগ্যবশত সেই ইচ্ছেটাও পূর্ণ হলো আমার। সপ্তাহের শেষে গার্ল ফ্রেন্ডকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, সিনেমা দেখা অথবা কোনো ভালো রেস্তোরাঁতে খেতে যাওয়া নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। টাকার সুখ কি হয় , সেটা জানতে পেরে সর্বদাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে থাকতাম আমি। অল্প হলেও অর্থের অহংকার যে আমার হয়েছিল সেটা বলতে দ্বিধা নেই। পৃথিবীতে এমন কোনো জিনিস নেই যেটা অর্থ দিয়ে ক্রয় করা যায় না, এই ভাবনাটা মনে এবং মস্তিষ্কে নিজের বাসা বেঁধে নিয়েছিল।

    সে দিনটা ছিল রবিবার। আমার ছুটির দিন। সকাল-সকাল রিয়ার মানে আমার প্রেয়সীর ফোন এলো। আমায় বলল – ‘আজ সারা দিন আমি কিন্তু তোমার সাথেই কাটাতে চাই।’
    ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। সে আবার বলতে। রণবীর কাপুরের খুব ভালো সিনেমা এসেছে। দেখতে যাবে কী?’ আমি প্রস্তাব রাখলাম।
    রিয়া লাফিয়ে উঠল।
    ভেবেছিলাম রণবীর কাপুরের সিনেমাটা দুপুরের শো-তে দেখবো। আগে কোনো রেস্তোরাঁতে লাঞ্চ সেরে তার পর সিনেমা দেখা। কিন্তু যেটা ভাবলাম সেটা হলো না । বর্ষা কালে মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। দুপুরের ঠিক আগে এমন মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো, যে সিনেমা দেখার প্রোগ্রামটা স্থগিত করতে হলো। রিয়াকে ফোনে বললাম -‘সন্ধ্যা ছ’টা বেজে তিরিশ মিনিটে একটা শো আছে। সেটা দেখবো। তারপর এক সাথে ডিনার করে ফিরবো।’
    রিয়ার মনটা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল , সেটা বলাই বাহুল্য। তার সারা দিনটা আমার সাথে কাটানো হলো না।
    অপয়া বৃষ্টি থামলে বিকেল চারটে নাগাদ দেখা করার প্ল্যান হলো।
    এবার কোনো বাধা সৃষ্টি হলো না। প্রায় তিনটে নাগাদ থেমে গিয়েছিল বৃষ্টি। ঠিক বিকেল চারটে আমরা দেখা করলাম ধর্মতলায়।
    রিয়া জিজ্ঞেস করলো- ‘সিনেমা শুরু হতে তো এখন ঢের দেরি। যাবে কোথায় এখন?’
    ‘কোথাও বসে গল্প করা যাক।’ আমি বললাম।
    ‘কোথায়?’
    খানিক চিন্তা করে বললাম- ‘আশেপাশে বসার জায়গা বলতে একটি আছে, প্রিন্সেপ ঘাট। গঙ্গার ধারে বসে গল্প করতে পারবো।’
    ‘যদি আবার বৃষ্টি নামে?’
    আমি আকাশের দিকে তাকালাম। বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হলো না। দুপুরে যে আকাশে কালো ঘন মেঘ জমেছিল,সেটা কেটে গিয়ে এখন নীল স্বচ্ছ আকাশ দেখা দিয়েছে। পশ্চিম প্রান্ত থেকে সূর্যের রক্তিম আভা দেখে যেন মন জুড়িয়ে যায়।
    ‘আকাশের অবস্থা দেখে তোমার কি মনে হয় যে বৃষ্টি হতে পারে? আমার তো মনে হয় না।’ আমি বললাম।
    ‘কি জানি, বাবা। বর্ষা কালে কিছু বলা যায় না।’

    যাই হোক, অবশেষে আমার যুক্তিটাই কাজে এলো। আমরা প্রিন্সেপ ঘাটের দিকে এগোলাম। ধর্মতলার মোড় থেকেই একটা ট্যাক্সি নিলাম। হেঁটে যাওয়া সম্ভব ছিল, কিন্তু দু’টো কারণে হেঁটে গেলাম না। প্রথমত, একটু সময় লাগতো বেশি এবং দ্বিতীয় কারণ হলো বেশি হাঁটা রিয়ার অভ্যেস নেই। খানিক পরেই প্রিন্সেপ ঘাটের গেটের সামনে আমাদের ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো।
    ট্যাক্সির ভাড়া চুকিয়ে আমরা পার্কের দিকে এগোবো ঠিক এমন সময় এক ভিখারী আমাদের পথ আটকে দাঁড়ালো। ভিখারীটি মহিলা, বেশ বয়স হয়েছে বলে মনে হলো। গায়ে ময়লা শতছিন্ন কাপড়। গায়ের রং বেশ কালো, এক মাথা রুক্ষ চুল। শরীরটা বেশ ভালোই কুঁজো। ভিক্ষা চাইবার জন্য হাতে কোনো বাটিও নেই তার। কাঁপা-কাঁপা গলায় আমাদের বলল- ‘কিছু দে বাবা, কিছু দে। খাইনি রে, কিছু দে।’
    তাকে দেখেই একরাশ বিরক্তির কন্ঠে রিয়া বলল- ‘ওহ মাই গড! কি নোংরা। যা এখানে থেকে, দূর হো। ইস …. আমার পুরো ড্রেস খারাপ করে দেবে । গায়ে কি বিশ্রী গন্ধ।’
    ঠিক মনে হলো রিয়ার সামনে কোনো মানুষ নয়, কুকুর জাতীয় কোনো পশু দাঁড়িয়ে আছে, যার স্পর্শমাত্র সে সম্পূর্ণ অস্পৃশ্য হয়ে উঠবে। এহেন জাতির মানুষেরাই রাস্তার ধারে, নালী-নর্দমাতে শুয়ে-বসে থাকা কোনো ছোটো কুকুরের সন্তানকে কোলে উঠিয়ে আদিখ্যেতা করতে ছাড়ে না। দোষ শুধু রিয়াকে দিলে অবিচার করা হবে। সেই ভিক্ষুককে দেখে আমারও গা টা কেমন গুলিয়ে উঠেছিল। একরাশ ঘৃণা মেশানো কন্ঠে আমিও তাকে বললাম- ‘অন্য জায়গায় যান। আমার কাছে নেই কিছু।’
    কথা শেষে করে আর এক সেকেন্ডও সেখানে দাঁড়ায়নি আমি। রিয়ার হাত ধরে হনহনিয়ে পার্কের দিকে ছুটলাম। ভিখারীটা কিছুক্ষণ আমাদের পেছনে এলো। তার মুখ দিয়ে ক্রমাগত একই কথা বেরোচ্ছে- ‘কিছু দে বাবা। খাইনি, কিছু দে।’

    পার্কে গঙ্গার ধারে বসে বেশ অনেকক্ষণ আমরা একে অপরের হাতে হাত রেখে গল্প করলাম। প্রায় দেড় ঘন্টা। আইসক্রিম থেকে আরম্ভ করে চিপস, ঝালমুড়ি, কোল্ডড্রিংক্স সব কিছুই গলাদ্ধকরণ করলাম আমরা। এটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি যে আমি রিয়ার জন্য এক চলমান এ.টি.এম. কার্ড। কিন্তু তাও নির্দ্বিধায় খরচা করে যাচ্ছি আমি। মনে তখন থেকেই কিসের যেন এক খটকা লাগতে শুরু করলো। নিজের মায়ের বলা একটা কথা বারবার মনে পড়ছিল আমার। আমার মা বলতো- ‘প্রকৃত নারায়ণ তো দীন দুঃখীর মধ্যেই থাকে রে। তাদের কোনো দিন দুঃখ দিস না। তাদের দুঃখ দেওয়া মানে নারায়ণকে দুঃখ দেওয়া।’
    আমি আজ কী করলাম? যা করলাম সেটা ঠিক করলাম না ভুল? অফুরন্ত অর্থ ব্যয় করে চলেছি আমি। যদি দশ টাকা সেই গরীবকে দিয়েই দিতাম, তো কি এমন অনর্থ হয়ে যেত? সেই দশ টাকাটাই তার জন্য হয়তো মূল্যবান হতো। তার জন্য হয়তো রিয়ার নজরে আমি ছোটো হয়ে যেতাম। কিন্তু সে সময় রিয়ার নজরে আমি ছোটো হতে চাইনি। যে প্রিয়তমাকে নিয়ে নানাবিধ স্বপ্ন নিজের মনের ক্যানভাসে এঁকেছি, তার সামনে ছোটো হয়ে যাওয়া মানে নিজের পায়ে কুড়ুল মারা। কিন্তু হৃদয়হীন প্রিয়তমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাতেও কী লাভ? যার দুঃখীদের প্রতি কোনো মায়া নেই, সে কি আদৌ মানুষ হওয়ার যোগ্য? তাহলে কি আমি নিজেও মানুষ, না মানুষের রূপে পশু তে পরিণত হয়েছি? মায়ের দেওয়া শিক্ষাকে মাটিতে মিশিয়ে তার ওপর অট্টালিকা গড়তে চেয়েছি আমি। রিয়াকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। দোষ আছে আমার মধ্যেই। এক রমণীর রমণীয়তাতে মুগ্ধ হয়ে আমি পথভ্রষ্ট হয়েছি, আমি হয়েছি ধর্মচ্যুত।

    সিনেমা দেখে, রেস্তোরাঁতে ডিনার সের, রিয়াকে তার হোস্টেল পৌঁছে আমার নিজের ফিরতে প্রায় রাত বারোটা বাজলো। আনন্দ ফুর্তি মেশানো এক সুন্দর পরিবেশেও আমার মন কেমন যেন বিষাদের এক কালো মেঘে ঢেকে রইল। নিজের মনের ভাবনাকে আমি প্রকাশ্যে আনতে চাইলাম না। বলতে গেলে সারা রাত ঘুম হলো না আমার। দেয়ালে ঝুলছিল আমার মৃত মায়ের ছবি। সে দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারলাম না আমি। ঠিক মনে হলো, আমি যেন এই পৃথিবীর সব থেকে নিকৃষ্ট প্রাণী। টাকার অহংকার করা এবং নিম্নশ্রেণীর লোকেদের ওপর পাশবিক ব্যবহার করা, এটাই কি আমি শিক্ষা পেয়েছি? শুয়ে-শুয়ে ভাবলাম, আগামী সকালেই আমি পুনরায় যাবো সেই স্থানে যেখানে দেখা হয়েছিল সেই ভিখারীটার সাথে। কিন্তু এবার যাবো একলা। নিয়ে যাবো কিছু খাবার, কিছু টাকা, হয়তো তার লজ্জা নিবারণ হেতু দু’টো সাদা ধুতিও নিয়ে যাবো। কিন্তু সেখানে আর পাবো কি আমি তাকে? তাদের তো নেই কোনো ঠিকানা। এক ধরনের যাযাবর তারা। আজ এখানে তো কাল অন্যত্র। যদি সেখানে তাকে না পাই, তাহলে এই বৃহৎ শহরে কোথায় খুঁজবো তাকে? তাহলে কোনো অন্য দরিদ্রকে সে সব জিনিস দিয়ে শান্ত করবো নিজের মনের জ্বালা ।

    পর দিন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েই এক কাপড়ের দোকানে গিয়ে কিনলাম দু’টো ধুতি। খাবারের দোকানে গিয়ে কিছু খাবার কিনলাম। অফিসে আগেই ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে পৌঁছাতে কিছু দেরি হবে আজকে। সব জিনিস নিয়ে আমি রওনা দিলাম প্রিন্সেপ ঘাটের দিকে। ট্যাক্সি থেকে নেমে সেখানেই দাঁড়ালাম যেখানে গতকাল বিকেলে দেখা হয়েছিল সেই বুড়ি ভিখারির সাথে। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলাম, কিন্তু দেখা পেলাম না তার। অচিরেই চঞ্চল হয়ে উঠল মনটা । পাশে দাঁড়ানো সাদা উর্দি পরা এক পুলিশকে জিজ্ঞেস করলাম তার বিষয়। ফুটপাথের এক প্রান্তে আঙ্গুলের ইশারা করে সে আমায় বলল – ‘ওদিকে দেখুন গিয়ে।’
    আমি ছুট দিলাম সে দিকে। যেখানে ফুটপাথ শেষ হয়েছে সেখানে বেশ কিছু লোকের ভিড় দেখলাম, সাথে দু’টো পুলিশের লোক। ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতেই দেখলাম মাটিতে পড়ে আছে এক জনের মৃতদেহ। চাদর দিয়ে সেই দেহটাকে ঢাকবার পূর্বে দেখতে পেলাম তার মুখ। অজান্তেই দু’পা পেছনে সরে গেলাম আমি। হৃদয়ে যে ধাক্কাটা পেলাম, সেটা বর্ণনার ঊর্ধ্বে। সেই মৃত ভিখারীটার মুখে নিজের মায়ের মুখ দেখতে পেলাম আমি। মা যেন চোখ বন্ধ করে মৃদু হাসছে। আমি করতে পারলাম না প্রায়শ্চিত্ত। আমি চাইলে হয়তো সেই ভিখারীর প্রাণ বাঁচাতে পারতাম। তার ক্ষুধার্ত প্রাণকে আমি চাইলে শান্তি দিতে পারতাম। তার মৃত্যুর কারণ হলাম আমি । এই পাপবোধ, এই গ্লানি নিয়ে এবার সারা জীবন আমায় বেঁচে থাকতে হবে। এটাই আমার প্রকৃত শাস্তি ।

    সমাপ্ত ।

  • কবিতা

    কবিতা-কলমের কান্না

    কলমের কান্না
    – বিশ্বদীপ মুখার্জী

     

    আমার কষ্টের পরিধি মাপার
    ফিতে নেই তোমার কাছে,
    তিল তিল করে গড়ে তোলা মূর্তিকে
    কিছু লোকেরা নিমেষে করে দেয় নষ্ট,
    কেউ কি তখন বোঝে মূর্তিকারের কষ্ট?
    আমি কি সেই মূর্তিকার নই?
    দিবারাত্রি একটু একটু গড়েছি,
    রূপহীন ছায়াকে দিয়েছি রূপের বাহার,
    সাজিয়েছি তোমায় নিজের মত করে,
    হাতে দিয়েছি সরস্বতীর উপহার।
    ছড়িয়েছো কিছু প্রেমের সুগন্ধ,
    কিছু আগুন বেরিয়েছে সে উপহার দিয়ে….
    আনন্দে আত্মহারা হয়েছি আমি,
    প্রতিক্ষণ করেছ অপরূপ সৃষ্টি।
    কিন্তু এখন?
    বিষাদে ভরা গাথা পাই শুধু,
    ডুবে যাই আমিও তার গভীরে….
    তোমার কলমের অশ্রুর আজ
    না জানি দাম দেবে কে কে?
    এক শক্ত মুঠোও যেমন অক্ষম বালি কে ধরে রাখতে,
    আমিও কি তাহলে পারবো না তোমার সৃষ্টি কে বাঁচাতে?
    কষ্টে যখন বুক ফাটে জল আসে না চোখে,
    কষ্ট মনের গভীরে তে বাসা বাঁধে মুখ গুঁজে।
    আশায় আছি আর পাবো না কলমের সে ক্রন্দন,
    ফিরে পাবো আবার আমি আগুনের বর্ষণ।
    প্রেমের গন্ধ ছড়াবে চারিদিকে হবে বিষাদের মরণ,
    তোমার সৃষ্টিতে সাজবে জগৎ হবে নতুন সভ্যতার গড়ন।

     

  • কবিতা

    কবিতা- স্বপ্নের দেশে পাড়ি

    স্বপ্নের দেশে পাড়ি
    – বিশ্বদীপ মুখার্জী

     

    যে দিন এক গুচ্ছ বকুল দিয়েছিলাম উপহার….
    সে দিন থেকে শুরু
    তোমার নিষ্পাপ হৃদয়ে আমার আনাগোনা,
    এখন ভাবি সে কি ছিল নিছকই এক কল্পনা?
    না, কল্পনা নয়….
    বাস্তবের মাটিতে রেখেছিলাম পা।
    রুক্ষ এক ভূমিতে বইয়ে দিতে চেয়েছিলাম
    অফুরান জলের স্রোত,
    অসংখ্য ফুল ফোটার আশায়।
    হাত ধরে টেনে আনতে চেয়েছিলাম
    অন্ধকার গর্ত থেকে,
    দেখাতে চেয়েছিলাম জগতের অপরূপ আলো।
    বহু বসন্ত পেরিয়েও যা কিছু পাওনি
    সে সব উজাড় করে দিতে চেয়েছিলাম তোমায়।
    তোমার প্রাণ ভরা নিষ্পাপ হাসি দিয়েছি ফিরিয়ে,
    তোমার স্বপ্নের দেশ হয়েছিল শ্মশান….
    তাকে পুর্নজীবিত করেছি, ঢেলেছি তাতে প্রাণ।
    তবুও আজ আমি অপরাধী….
    নিজের লাশকে কাঁধে বয়ে বেড়াচ্ছি যত্রতত্র,
    খুঁজে চলেছি সেই প্রাণে ভরা দুটি আঁখি
    এখানে ওখানে, সর্বত্র।
    সূর্যের প্রথম রশ্মিতে
    যে পথ দেখিয়েছিলাম আমি,
    সহযাত্রী আর কেউ না….
    শুধুই আমি, সেটা মানি।
    যে আঙ্গুল উঠেছে আমার উপর তুচ্ছ জানি সেটা,
    শীর্ষে নিয়ে যাবো তোমায় আমি, জানি শুধু এটা।

     

  • কবিতা

    কবিতা- মৃতপ্রায় একটি গাছ

    মৃতপ্রায় একটি গাছ
    – বিশ্বদীপ মুখার্জী

     

    কোনও এক বাগানে
    এক প্রায় মূর্ছিত গাছে….
    জলের দু বিন্দু দিয়ে
    প্রাণের সঞ্চার করা কি অপরাধ?
    যদি সেটা অপরাধ হয়,
    আমি করেছি সেই অপরাধ।
    জলের ফোঁটা পেয়ে যখন
    সে ফিরে পায় নিজের নিঃশ্বাস….
    সেই নিঃশ্বাসের স্পর্শ কে
    উপভোগ করেছি আমি।
    ধীরে ধীরে সে গাছ
    খুঁজে পেয়েছে নিজের অস্তিত্ব,
    শ্রীবৃদ্ধি পেয়েছে নিজের আকারে….
    ফুটেছে বহু পুষ্প গাছের প্রতিটি ডালে।
    এক মৃতপ্রায় গাছ কে নতুন জীবন দিয়ে
    আমি ফেলেছি তৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস।
    আজ আমি আর সে যখন একাত্ম,
    বিভেদ করতে চায় সেই বাগানের মালি?
    কোনও দিন সে দেখেছে
    সেই গাছের ছটফটানি?
    কোনও দিন সে শুনেছে
    সেই গাছের আর্ত কাহিনী?
    অধিকার সাবস্ত করার আগে
    কর্তব্যের বৃহৎ নদী যেতে হয় পেরিয়ে।
    আজ যখন সে গাছ
    এক মহীরুহ হতে চলেছে….
    তাতে অবদান কার?
    এ প্রশ্ন জাগে বারংবার।
    আগাছা ভেবে মাটি তে ফেলে দেওয়া
    সেই মালির?
    না যে করেছে তাতে প্রাণের সঞ্চার?
    এ প্রশ্ন জনগণের সম্মুখে
    তারাই করুক বিচার,
    সে গাছটি ছড়াবে সুগন্ধ চারিদিকে
    না হবে সে কালের শিকার?

     

  • কবিতা

    গল্প- ভাগ্যান্বেষণ

    ভাগ্যান্বেষণ
    বিশ্বদীপ মুখার্জী

     

    সকাল হতে না হতেই হাতে এক থলি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন নিখিলেশ দাসগুপ্ত। তাঁর গন্তব্য স্টেশন। বেরোবার আগে স্ত্রী শান্তা দেবীকে এক কাপ চা করে দিলেন তিনি। চা খেয়ে পুনরায় বিছানায় শুয়ে শান্তা দেবী নিজের স্বামীকে বললেন – ‘কিছু খেয়ে যেতে পারতে তো।’
    ‘না গো। দেরি হয়ে গেলে মুশকিল। দুয়েকটা বাবু আছেন যারা রোজ সকালে আমার কাছে আসেন। তারা চলে গেলে অসুবিধে হবে। আমি ঠিক দশটায় চলে আসবো।’
    টিটাগড় স্টেশনটা খুব বড় না হলেও সকাল থেকে লোকেদের প্রাচুর্য থাকে। শিয়ালদা যাওয়ার লোকাল ট্রেনগুলোতে ভিড় দেখবার মতো। এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের এক কোণায় ছোট্ট আসন পেতে বসলেন নিখিলেশ বাবু। তখন ঘড়ি তে সকাল প্রায় সাড়ে ছ’টা বাজে। পাশের চায়ের দোকানের দোকানিটা একবার আড়চোখে নিখিলেশ বাবুকে দেখে বিড়বিড় করে বলল – ‘কত বার বলেছি যে এই রোদে ছাতা নিয়ে আসতে। বুড়ো মানুষ, রোদ লেগে কিছু হয়ে গেলে আমাদেরই বিপদ। দোকান ছেড়ে হাসপাতাল নিয়ে দৌড়াতে হবে।’
    দোকানির কথা হয়তো নিখিলেশ বাবুর কানে গেল। তিনি হাসি মুখে বললেন – ‘চিন্তা নেই শ্যামল। এই বুড়োর এখন কিছু হবে না। বয়স আশির ওপরে হলে কি হবে, শরীরে এখনও ক্ষমতা তোমাদের থেকে অনেক বেশি।’
    বুড়োর কথার সত্যতা প্রমাণের প্রয়োজন নেই সেটা শ্যামল খুব ভালোই বোঝে। জীবনে ঝড় জল কম গেল না নিখিলেশ বাবুর। নিজের সর্বস্ব দিয়ে ছেলেকে মানুষ করলেন। একটি ছেলে। ভালো সরকারি চাকরিও পেল। রোজ সকালে টিটাগড় থেকে লোকাল ট্রেনে চড়ে শিয়ালদা যেত। কিছু দিন চাকরি করার পর এক দিন অফিস যাওয়ার সময় ভিড় ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে নিজের প্রাণ হারায়। বজ্রাঘাত হয়েছিল নিখিলেশ বাবুর মাথায়। বছর দুয়েক আগে নিখিলেশ বাবুর স্ত্রী শান্তা দেবীর সেরিব্রাল অ্যাটাক করে। দীর্ঘ দিনের চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন ঠিকই, কিন্তু ডক্টর ফিজিও থেরাপি করতে বলে দেন। প্রতিদিনের মোটা খরচ ফিজিও থেরাপির পিছনে। সেই খরচ করতেও দ্বিধা বোধ করলেন না তিনি। স্ত্রীকে সুস্থ করে তোলা প্রয়োজন। প্রত্যেক বিষম পরিস্থিতিতে একমাত্র স্ত্রীই তাঁর সাথে থেকেছেন। কিন্তু এখন আর পারছেন না নিখিলেশ বাবু। ফিজিও থেরাপির কারণে তাঁর জমানো পুঁজি আসতে আসতে হয়ে যাচ্ছে শেষ। কিন্তু স্ত্রীর চিকিৎসাও তিনি বন্ধ করতে পারেন না। অবশেষে অনেক ভেবে একটি উপায় বের করলেন তিনি।সারা জীবন শাড়ির দোকানে সেলসম্যানের কাজ করেছেন তিনি। লেখাপড়ার দিকে ঝোঁক ছোট থেকেই। কম বয়সে পিতৃহারা হওয়ার কারণে সংসারের হাল সামলাতে শাড়ির দোকানে কাজে ঢুকেছিলেন নিখিলেশ বাবু। তিনি যে সারাটা জীবন কষ্ট করেছেন সেটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু হাজারও প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও তিনি ছাড়েননি নিজের সাধনা। হ্যাঁ সাধনা, সাহিত্য সাধনা, কবিতার সাধনা। ষোলো বছর বয়স থেকে তিনি কবিতা লেখেন। দুর্ভাগ্যবশত কোনও দিন কোনও পত্রিকায় তিনি কবিতা পাঠাতে পারেননি। মাঝে – মাঝে কবিতা লেখা কাগজগুলো মনে হয়েছে জঞ্জাল। ইচ্ছে করেছে ছিঁড়ে ফেলে দিতে। নিখিলেশ বাবুর সংযম সব থেকে বড় গুণ। এই সংযমের কারণেই তাঁর লেখা কবিতা এখনও তাঁর কাছেই আছে।

    রোদের তাপ বাড়তে শুরু করেছে আসতে আসতে। মাটিতে বসে আছেন নিখিলেশ বাবু। তাঁকে গোল করে ঘিরে বেশ কিছু লোকের ভিড়।
    নিখিলেশ বাবুর সামনে ছড়ানো আছে কাগজের মেলা। এই কাগজের টুকরোই তিনি নিয়ে আসেন রোজ সকালে থলি করে। এতেই আছে নিখিলেশ বাবুর স্বরচিত বহু সংখ্যক কবিতা।
    একটা কাগজের টুকরো হাতে নিয়ে কবিতা পাঠ করতে শুরু করলেন তিনি –

    “বয়স ভারে ন্যুব্জ হতেই পারি
    কিন্তু তবু থামেনি কলম আমার,
    ভাগ্য আমাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখাতেই পারে
    তবু ঘুরে দাঁড়িয়েছি বারবার।।

    সমস্যারা গিঁট খুলে লুটিয়ে পড়েছে পায়ে
    আর নিঃসীম অন্ধকারে ডুবে গেছি আমি,
    তবুও হার মানিনি কখনোই,নিজেকে কতটা
    গ্রহণযোগ্য করেছি,
    তা জানে অন্তর্যামী।।”

    কবিতা পাঠ করে আমদানি হয় করতালি এবং কিছু অর্থ। সকাল দশটা পর্যন্ত বেশ অনেক গুলোই কবিতা পাঠ করলেন তিনি। তার পর সব গুছিয়ে, আমদানি করা অর্থ নিজের পাঞ্জাবির পকেটে রেখে বাড়ির দিকে দ্রুত বেগে এগিয়ে গেলেন তিনি। ফিজিও থেরাপিস্ট আসার সময় হয়ে গেছে যে।

     

    #বিশেষ_দ্রষ্টব্য :- গল্পে উল্লেখিত কবিতা কবি শ্রীমতী পারমিতা ভট্টাচার্যর লেখা। কবি পারমিতা ভট্টাচার্য কে অসংখ্য ধন্যবাদ।

  • মুক্ত গদ্য

    অবাক পৃথিবী

    অবাক পৃথিবী
    -বিশ্বদীপ মুখার্জী

     

    স্বচ্ছ নীল আকাশের নিচে চারিদিকে সবুজে সবুজ মন্দ লাগছিল না দেখতে। সময়টা বিকেল, তাই সূর্যের কাজ শেষের দিকে। ইতি মধ্যেই সোনালী রং মেখে সে অস্তের পথযাত্রী। খোলা মাঠে বেছনো সবুজ ঘাসের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য গাছ। কোনও গাছ পাতায় ভরা তো কোনও গাছ নিঃশব্দে নিজের দুর্দশার কথা বলছে। কোনও কোনও জায়গায় ঘাস প্রায় তিন থেকে চার ফুটের মতো উঁচু হয় গাছে। শহরের বাইরের এই প্রান্তকে লোকেরা জঙ্গল বলেই চেনে। জঙ্গলের পাশ দিয়ে চলে গেছে রাস্তা। সারা দিন অজস্র গাড়ির যাওয়া আসা সেটা দিয়ে। রাস্তা দিয়ে পরিস্কার শোনা যায় জঙ্গলে বাস করা অসংখ্য পাখির কলরব। পাখিরা আসতে আসতে নিজের ঠিকানার দিকে ফেরত আসতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু আজ তাদের কলরব অন্য দিনের তুলনায় একটু বেশি মনে হচ্ছে। কিছু পাখি তো নিজের বাসাতেও যায়নি। বাসার আশেপাশে উড়ে চলেছে এবং নিজেদের ভাষায় কী সব যেন বলছে। সেই নীল রঙের ছোট্ট পাখিটা এখনও নিজের বাসার ভেতরে ঢোকেনি। এক বার গাছের ডালে বসছে, পরক্ষণেই গাছের আশেপাশে উড়তে শুরু করে দিচ্ছে। গাছের নিচের দৃশ্যটা দেখে সে হয়তো ভয় পেয়ে গেছে। গাছের নিচে কেউ যেন শুয়ে আছে। এক নজর দেখে নির্জীব বলেই মনে হয়। গায়ের কাপড় এলোমেলো …. অর্ধনগ্ন বললেই বেশি ভালো হয়। গাল, ঠোঁট, গলা, স্তন এবং শরীরের নিম্নভাগে গভীর এবং টাটকা ক্ষতচিহ্নর দাগ। ছেঁড়া কাপড়ের ফাঁক দিকে রক্ত গড়িয়ে এক স্থানে জমা হয়ে গেছে। জমা রক্ত এবং নিথর শরীরের চারিপাশে ভনভন করছে অজস্র মাছি। দেহে বুকের ওপর শুয়ে আছে এক ছোট্ট শিশু। নিষ্প্রাণ দেহের উন্মুক্ত স্তন থেকে চুষে নিতে চাইছে অদৃশ্য দুধ। অদৃশ্য দুধ বলা কি ঠিক হবে? তার ছোট্ট-ছোট্ট দুটি ঠোঁট পাচ্ছে দুধের স্পর্শ। কিন্তু এ দুধের স্বাদ ও রং ভিন্ন। আঁশটে স্বাদ এবং রং গাঢ় লাল।
    হঠাৎ পাশের রাস্তা দিয়ে লোকের দল দেখা গেল। অনেকের হাতে একটা করে পতাকা। প্রত্যেকেই প্রায় চিৎকার করে বলছেন – ‘চলবে না, চলবে না। নারী নির্যাতন চলবে না।’

     

  • মুক্ত গদ্য

    কালো মেঘের আড়ালে

    কালো মেঘের আড়ালে
    -বিশ্বদীপ মুখার্জী

     

    আমি কবি নয়। শব্দের সাথে খেলতে পারি না। চিন্তা- ভাবনা সীমিত। কল্পনা শক্তির অভাব বোধ করি। হঠাৎ আকাশে কালো মেঘ, সাথে প্রলয়ংকরী ঝড়, তার পর বৃষ্টি। এই দৃশ্য কবি অথবা লেখক- এর চিন্তা – ভাবনাকে নিয়ে যায় বহু দূর। তাঁদের কলম থেকে বেরিয়ে আসে অসংখ্য অনবদ্য সৃষ্টি। কিন্তু আমার মধ্যে সেই গুণ কোথায় ? এখনও আকাশে কালো মেঘ দেখলে বুকটা ধড়াস করে ওঠে। সাথে যদি ঝড় ওঠে তাহলে তো কথাই নেই। মাথা ঝিমঝিম করে। চোখের সামনে অন্ধকার দেখি।
    মনে পড়ে যায় দু’বছর আগেকার সেই কাল- বৈশাখী । “কাল” নামটা চরিতার্থ করে, কাল হয়ে এসেছিল আমার জীবনে। অপয়া প্রমাণ করে দিয়েছিল আমার মেয়েকে? আমার মেয়ের চোখের জল কি কালবৈশাখীর সেই তুমুল বৃষ্টির থেকে কম ছিল? কাল বৈশাখীর কালো, বীভৎস মেঘের মত আমাদের শীর্ষে নেমে এসেছিল সংকটের কালো মেঘ। তছনছ হয়ে গিয়েছিল সব আয়োজন। কে জানতো, সকালের রৌদ্র দুপুর হতে না হতেই এমন পরিহাস করবে আমার সাথে? মেঘের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে দেখবে প্রকৃতির তাণ্ডব। অনেক কষ্টে উপার্জন করা অর্থ চকিতে মিশে যায় মাটিতে। একটি মাত্র মেয়ে, ভেবেছিলাম বিয়েটা ভাল করেই দেবো। কতই বা ক্ষমতা আমাদের? তাও কিছু অর্থ সঞ্চয় করে, কিছু ধার-দেনা করে বিয়ের আয়োজনটা মন্দ হয়নি।
    হঠাৎ দেখলাম, পরিবর্তন হতে শুরু হল আকাশের রং। কোথা থেকে অল্প-অল্প মেঘ এসে বাঁধলো জমাট। সব ঠিক ছিল। কী আর হত? খুব বেশি হলে বৃষ্টি। আমি ভুলে গিয়েছিলাম এটা কালবৈশাখী। নিজের আসল রূপে এলে , এর থেকে সাংঘাতিক কিছু হয় কী? আকাশ হয়ে গেল কালো। যে হাওয়া এতক্ষণ দেহে স্ফূর্তি দিচ্ছিল, সেটা নিল নিষ্ঠুর রূপ ।
    এক দীনের স্বপ্ন- এর ইতি হতে এর থেকে বেশি কী প্রয়োজন ?
    নিজের ভগ্ন স্বপ্নের অবশেষ কুড়াবার সময় খবর পেলাম, বিকট ঝড়ে দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে বরযাত্রীর বাহন । ঝড় যেন একটু শান্ত হল । খানিক পর কালো মেঘের আড়ালে সূর্য যেন উঁকি মারলো । মিটি-মিটি হাসছে সে ।
    গ্রাম-গঞ্জে এহেন ঘটনার পর আজেকের দিনেও মেয়ের ওপর দিয়ে বিকট ঝড় যায় । সেই ঝড় কালবৈশাখীর থেকেও বেশি যন্ত্রণাদায়ক। কিছু দিন আগে নিজের মেয়ের দেহকে অগ্নি দেবতার ক্ষুধার্তে সমর্পণ করি। ফেরার পথে আবার সেই কালবৈশাখী। কে জানতো, এই কালো মেঘের আড়ালে লুকিয়ে ছিল আমার সর্বনাশ ।
    কালবৈশাখী কে নিজের কলমের ডগায় রেখে যে যাই অসাধারণ সৃষ্টি করুক না কেন, আমার জন্য কাল বৈশাখী শুধু মাত্র অভিশাপ ভিন্ন আর কিছুই না ।

     

     

  • গল্প

    ইচ্ছেপূরণ

    ইচ্ছেপূরণ
    -বিশ্বদীপ মুখার্জী

    ব্যাগ গোছানোর পর্ব শেষের দিকে। এখন শুধু মাত্র একটি ব্যাগ বাকি আছে। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে একটা ট্রাক। প্যাকার্স অ্যান্ড মুভার্সের লোকেরা বাড়ির যাবতীয় আসবাব পত্র সেই ট্রাকে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ করছে। অর্ণব বেরিয়েছে, গেছে বাজার। পথের জন্য কিছু খাবার কিনতে। নীলাঞ্জনা গত রাত থেকেই ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত। এবার মেদিনীপুর। বিগত ষোলো বছরে এই নিয়ে পাঁচ বার বদলী হলো অর্ণবের। এর আগে কৃষ্ণনগর, দুর্গাপুর, মালদা ঘোরা হয় গেছে নীলাঞ্জনার, অর্ণবের বদলীর সুবাদে। মালদা থেকে যখন অর্ণবের বদলী হয়, তখন নীলাঞ্জনার মনটা একটু ভালো হয়েছিল। হয়তো নতুন শহরের নামটা শুনে। নীলাঞ্জনা বহু দিন আগে গিয়েছিল মিরিক। কতো বয়স ছিলো তখন তার? খুব বেশি হলেও ষোলো কিম্বা সতেরো। প্রায় কুড়ি বছর পর আবার সে যাচ্ছিল মিরিক। ভেবেছিল, পুরনো স্মৃতি ফিরে পাবে। কিন্তু ফিরে পেলো কি?
    বাইশ বছর বয়স ছিল নীলাঞ্জনার যখন তার বিয়ে হয় অর্ণবের সাথে। অনিচ্ছা সত্বেও তাকে করতে হয়েছিল বিয়ে। তার বাবা বলেছিলেন- ‘ভালো পাত্রের অভাব। এই অভাবের বাজারে ভালো পাত্র পেয়েছি। হাতছাড়া কি করা যায়? ছেলে ভালো পরিবারের। ব্যাংকে কাজ করে। অসম্ভব, এই পাত্রকে হাতছাড়া করা অসম্ভব!’
    নীলাঞ্জনার জিদ প্রবল। কিন্তু নিজের বাবার অসুস্থতার সামনে নিজের জিদকে ধরে রাখতে পারলো না সে। জীবনের পথে এগোতে-এগোতে সে ভুলে গিয়েছিল নিজের ইচ্ছা, আকাঙ্খার কথা। পারিবারিক ঝামেলা, অশান্তির মাঝে নীলাঞ্জনা হারিয়ে ফেলেছিল নিজেকে। আজ শেষ ব্যাগটা গোছাতে গিয়ে আবার থেকে নিজেকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করলো সে। শেষ ব্যাগে আছে শুধু ডায়েরি। ডায়রির প্রতিটা পৃষ্ঠা নীলাঞ্জনার হাতের লেখায় সুসজ্জিত। মোট দশটা ডায়রি ছিলো, এখন বেঁচে আছে মাত্র ছ’টা। লেখা ছেড়ে দিয়েছিল নীলাঞ্জনা। লেখার মতো পরিস্থিতি ছিলো কি তার জীবনে? বিয়ের পর অর্ণব কোনও দিন শুনতে চায়নি তার লেখা কবিতা। যখনই নীলাঞ্জনা কবিতা শোনাতে গেছে, অর্ণবের একটি কথা সে শুনেছে – ‘ঘুম পাচ্ছে। পরে শুনবো।’
    বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোলে ছেলে এলো নীলাঞ্জনার। নিজের শখ, আহ্লাদ, ইচ্ছে সব বিসর্জন দিয়ে লেগে পড়লো সংসার ধর্মকে নিখুঁত ভাবে পালন করতে। তার একটি মাত্র স্বপ্ন ছিলো, ছেলেকে নিজের মতো করে মানুষ করা। ছেলেকে আঁকড়ে ধরে রাখতে অদ্ভুত তৃপ্তি পেতো সে। ভুলে যেত নিজের যাবতীয় যন্ত্রণার কথা। কিন্তু বেশি দিন ছেলেকে আঁকড়ে রাখতে পারলো কই নীলাঞ্জনা? তখন তারা দুর্গাপুরে ছিলো। এক রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে অর্ণব নীলাঞ্জনাকে বলল- ‘নীলা, আমাদের ছেলের ভবিষ্যৎটা এবার ভাবতে হবে। আমার বদলীর চাকরী সে তো তুমি দেখছই। আজ এখানে তো কাল ওখানে। বারবার ছেলের স্কুল যদি চেঞ্জ হয়, তাহলে ক্ষতি হবে ওর।’
    ‘তাহলে?’ ভয়ার্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো নীলাঞ্জনা।
    ‘আমি একটা উপায় ভেবেছি। ছেলেকে বোর্ডিংএ দিয়ে দিই। ছেলের মধ্যে ট্যালেন্ট আছে। মানুষ হয়ে বেরোবে সেখান থেকে।’ অর্ণব বলল।
    অজান্তেই দু’ চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়েছিল নীলাঞ্জনার। সে জল হয়তো দেখতে পারেনি অর্ণব। নীলাঞ্জনাও বলতে পারেনি নিজের মনের কথা। সে বলতে পারেনি, যে তার জন্য বেঁচে থাকা দুস্কর হয়ে যাবে পাশে ছেলে না থাকলে।

    বলতে চেয়েছিল অনেক কিছুই সে। কিন্তু যদি কেউ শোনার না থাকে, তাহলে মুখ থেকে বেরোনো বাক্য শূন্যে ভেসে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। সেটাই হয়েছিল নীলাঞ্জনার সাথে। মিরিকে দু’টো ঘরের ছোট্ট একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল অর্ণব। বিয়ের পর এই ‘ছোট্ট’ বাড়ি যেন কাল হয়ে উঠেছিল নীলাঞ্জনার জন্য। প্রতি মুহূর্তে মনে হতো কেউ যেন তার গলা টিপছে, শ্বাসরোধ হয়ে যাচ্ছে তার। নীলাঞ্জনার বাবার বাড়ি বিরাট। তার বাবা বলতেন – ‘আজকালকার এই সব ফ্ল্যাট হলো দেশলাইয়ের ডিবে। সেখানে আবার থাকা যায় নাকি?’
    বিশাল বাড়ি থেকে অবশেষে ‘দেশলাইয়ের ডিবে’ তেই থাকতে হলো নীলাঞ্জনাকে।

    মিরিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা কলমের মাধ্যমে করা অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব নয়। চারিদিক দিয়ে পাহাড়ে ঘেরা অদ্ভুত সুন্দর এক শহর মিরিক। অর্ণব যেখানে ভাড়া বাড়ি নিয়েছিল সেখান থেকে অল্প একটু দূরেই ছিল বেশ বড় দু’তলা এক বাড়ি। অর্ণবের ব্যাংক বেরিয়ে যাওয়ার পর নীলাঞ্জনা প্রায় বাজার যেত। বাজার যাওয়ার পথেই পড়তো সেই বড় বাড়িটা। বাড়িটার দিকে খানিক হাঁ করে তাকিয়ে থাকতো সে। দেখতো, দু’তলার বিশাল বারান্দাটাকে। হ্যাঁ, বারান্দা…. নীলাঞ্জনার বহু সুপ্ত ইচ্ছের মধ্যে একটা হলো, নিজের বাড়িতে যেন এক বড় বারান্দা হয়। বারান্দা চিরকাল তার প্রিয়। তার বাপের বাড়িতে ছিল বারান্দা। সেই বারান্দাতে বসেই নিজের প্রথম কবিতা লিখেছিল সে। সালটা ছিল ১৯৯২। সত্যজিৎ রায়ের অস্কার পাওয়ার উপলক্ষ্যে নিজের প্রথম কবিতা লিখেছিল নীলাঞ্জনা। সে সব ঘটনা এখন অতীত। এখন কোথায় বারান্দা আর কোথায়ই বা কবিতা? রোজ সেই বাড়িটার দিকে তাকিয়ে, হৃদয়ে ব্যাথার পাহাড় নিয়ে নিজের ছোট্ট বাসায় ফিরে আসে সে।

    দিনটা ছিল সোমবার। অর্ণবের নিজের কাজে বেরিয়ে যাওয়ার পর নীলাঞ্জনা নিয়ম মতো যথাসময় বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে রওনা দিলো। সেই বড় বাড়িটার কাছে আসতেই সে দেখলো একটা অল্প বয়সী মেয়ে সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাজারের রাস্তা ধরে এগিয়ে চললো। তার হাতেও বাজারের ব্যাগ। হয়তো নীলাঞ্জনা নিজেও জানে না কেন তার সেই অপরিচিতার সাথে আলাপ করার ইচ্ছে হলো। বাজারে কিছু কেনাকাটা করার পর ফেরার পথে সেই অপরিচিতার সাথে আলাপ করলো নীলাঞ্জনা। মেয়েটির নাম – তিয়াসা।
    ‘কিছু দিন ধরেই আপনাকে দেখছি। রোজ আপনি এই সময়ই বাজার আসেন। নতুন এসেছেন নাকি?’ নীলাঞ্জনাকে জিজ্ঞেস করলো তিয়াসা।
    ‘প্রায় দশ দিন হলো। আমার বর ট্রান্সফার হয়ে এখানে এসেছে। ব্যাংকে কাজ করে।’ নীলাঞ্জনা জবাব দিলো।
    বেশি সময় লাগলো না তাদের মধ্যে আলাপটা জমে উঠতে।
    অনেক ভাবনাচিন্তা করার পর সে রাতে নীলাঞ্জনা জানতে পারলো তিয়াসার সাথে যেচে আলাপ করার কারণ। সেই বারান্দা। হয়তো এতো দিন পর বারান্দা দেখে নীলাঞ্জনার সেখানে যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু কাকে বলবে নিজের ইচ্ছের কথা সে? অকারণ তিয়াসার বাড়ি সে যেতে পারে না। তিয়াসা যত দিন না নিজে থেকে তাকে নিয়ে যায়, নীলাঞ্জনাকে অপেক্ষা করতেই হবে।

    তিয়াসা যাওয়া আসা শুরু করলো নীলাঞ্জনার বাড়ি। কথায়-কথায় সে জানতে পারলো নীলাঞ্জনার কবিতা লেখার কথা। লাফিয়ে উঠল সে।
    ‘তুমি কবিতা লেখো নীলাঞ্জনা দি?’ কবিতার একটা ডায়েরি নীলাঞ্জনার উরুর ওপরে রাখা ছিল। সেটাকে নিজের হাতে নিয়ে তিয়াসা জিজ্ঞেস করলো।
    ‘লিখি না রে। লিখতাম এক সময়। জীবনটা নদীর স্রোতের মতো তিয়াসা। যেটা ফেলে দিবি, সেটাই ভেসে কোথায় চলে যাবে। কবিতাকে আমি জীবনের স্রোতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। সেটা এখন ভেসে বহু দূর চলে গেছে। এতো দূর যে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়।’
    দু’ একটা কবিতা পড়ে নিজের মনেই পাঠ করতে লাগলো তিয়াসা। তার কবিতা পাঠ এক মনে নীলাঞ্জনা শুনছিল। হঠাৎ নিজের কবিতা পাঠ থামিয়ে নীলাঞ্জনার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে তিয়াসা বলল- ‘আমার কবিতা পাঠ শুনছো? ওই যে তুমি বললে, জীবনের স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া। আমি তো তাই করেছি নীলাঞ্জনা দি। তুমি যেমন কবিতা লিখতে, আমি আবৃত্তি করতাম। আমার এক আবৃত্তি শুনবে?’
    ‘শুনবো।’
    নীলাঞ্জনার লেখা কবিতার ডায়েরি থেকে একটা কবিতা বের করে আবৃত্তি করতে শুরু করলো তিয়াসা-

    “এমন করে সব কিছু উজাড় করে দেবো
    ভাবিনি কখনও….
    বুকের ভিতর শব্দরা এমন প্রজাপতির মত
    পাখা মেলে দেবে স্বপ্নেও দেখিনি কখনও,
    আমার যা দেওয়ার সব করেছি সম্পন্ন।
    এবার তোমার পালা….
    কেমন করে মিশে যাবে আমার সাথে,
    কেমন করে ভালোবাসার মোহনা গড়বে….
    যে সময় কখনও থমকে যায় না, সেও কি ভাবে
    থমকাবে, চমকাবে, অবাক চোখে দেখবে….
    তার হিসেব না হয় তুমি রাখো।
    আমি শুধু এ সবের ঊর্ধ্বে যেতে চাই….
    তোমার মনের ঈশান কোণের সব মেঘ
    দূরীভূত হোক,
    ফুটে উঠুক নতুন সূর্য হৃদয়ের সাগরের তীরে।”

    তিয়াসার আবৃত্তি শেষ হওয়ার পরেও নীলাঞ্জনা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল তার দিকে।

    তিয়াসা এক দিন নীলাঞ্জনাকে বলেছিল নিজের কাহিনী।
    ‘চার বছর হয়ে গেল আমাদের বিয়ের। গত দু’ বছর ধরে আমি নিজের বাপের বাড়িতে। মাঝে মাঝে ভাবি, আমি কোনও ভুল করে ফেললাম না তো? সত্যিই কি শুভ্রকে চিনতে ভুল করলাম আমি? বিয়ের আগে কি সব ছেলেরাই বড়-বড় কথা বলে? আমি কোনও দিন শুভ্রকে বলিনি যে নিজের মায়ের বিরুদ্ধে যেতে। তুমি বিশ্বাস করবে না নীলাঞ্জনাদি, শুভ্রর মা বোধহয় পৃথিবীর এক মাত্র মহিলা যে মেয়ে পছন্দ করে না। নিজের এক ছেলে, তাই তার ছেলেরও যেন ছেলেই হয়। আমার গর্ভে মেয়ে সন্তান থাকার কারণে যে দিন জোর করে আমার গর্ভপাত করানো হলো, সে দিন আমি আর সহ্য করিনি। সব ছেড়ে চলে এলাম এখানে।’
    ‘কিন্তু তারা বুঝলো কী করে যে তোমার গর্ভে কন্যা সন্তান আছে? এটা তো ইল্লিগাল।’ বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলো নীলাঞ্জনা।
    কটাক্ষের মৃদু হাসি হেসে তিয়াসা বলল- ‘ওদের টাকার জোর আছে দি। টাকা দিয়ে সব হয়। আমার দুঃখ এখানেই যে আমাকে চলে আসতে দেখেও শুভ্র কিছু বলল না। আমি রোজ তার অপেক্ষা করি। আমার বিশ্বাস সে এক না এক দিন নিশ্চয়ই আসবে।’

    নিজের মনের কথা কোনও দিন কাউকে খুলে বলতে পারেনি নীলাঞ্জনা। এই কিছু দিনে তিয়াসার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠা সত্বেও সে এটা বলতে পারেনি যে, তিয়াসার বারান্দাতে সে এক বার হলেও যেতে চায়। সে বারান্দায় গিয়ে দেখতে চায় সূর্যোদয় অথবা সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য। পাহাড় যে ওর বড় প্রিয়। পাহাড়ের পিছন থেকে উদয়ের ও অস্তের সূর্য দেখতে যে ওর ভীষণ ভালো লাগে। অচিরেই মনের ভিতর কিছু শব্দরা দাপাদাপি করে সৃষ্টি করে ফেলে এক নতুন কবিতার। যখনই নীলাঞ্জনা তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যায়, সেই বারান্দাটা যেন হাত ছানি দিয়ে ডাকে তাকে।
    হঠাৎ এক দিন তিয়াসার বাড়ি যাওয়ার সুযোগ হলো নীলাঞ্জনার। তিয়াসা এসে নীলাঞ্জনাকে বলল – ‘সামনের বুধবার আমার জন্মদিন নীলাঞ্জনা দি। যবে থেকে জীবনে এমন ঘটনা ঘটেছে, জন্মদিন পালন করা ছেড়ে দিয়েছি। এবারও কাউকে ডাকছি না। শুধু তুমি। তোমার সাথে মনের মিল পেয়েছি নীলাঞ্জনাদি।’

    নীলাঞ্জনার উৎসাহের অন্ত নেই। অর্ণবের ব্যাংক বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই মনের ভেতর যেন অদ্ভুত ব্যাকুলতার সৃষ্টি হয়েছে। আজ বহু দিন, বহু বছর পর সে কোনও এক বারান্দায় পা রাখবে। তাহলে কি আজ দীর্ঘদিন পর নতুন কবিতার সৃজন করতে পারবে সে? সূর্যোদয়টা আর দেখা হলো না, কিন্তু সূর্যাস্ত দেখার প্রবল ইচ্ছে আছে তার মনে। মনের খুশিতে গুনগুন করে গান গাইতে-গাইতে সে তৈরি হচ্ছিল ঠিক সে সময় তিয়াসার গলার আওয়াজ শুনতে পেলো সে। তিয়াসা দরজা পেটাচ্ছে আর বলছে – ‘নীলাঞ্জনাদি, দরজা খোলো। এক ভালো খবর আছে।’
    নীলাঞ্জনা দৌড়ে গিয়ে তৎক্ষণাৎ দরজা খুলতেই তিয়াসা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল- ‘সে এসেছে নীলাঞ্জনাদি, সে এসেছে। আজ সকালেই এসেছে আমাকে নিতে। আমি তোমায় বলেছিলাম না, যে আমার বিশ্বাস সে এক না এক দিন ফিরে আসবেই। আমার বিশ্বাসে কোনও ভুল ছিল না দি, কোনও ভুল ছিল না। কিছুক্ষণ পরেই আমি বেরিয়ে যাবো দি।’
    খবরটা সত্যি খুব আনন্দের। কিন্তু নীলাঞ্জনার মনের আনন্দ হলো কি? হলো। সে ভালোবাসত তিয়াসাকে। তিয়াসার খুশি তে সে আনন্দিত হবে না সেটা কি হয়? কিন্তু মনের ভেতর কোথাও না কোথাও বিষাদের কালো রেখা নিজের দাগ কেটেই দিলো। আর হয়তো এ জীবনকালে কোনও দিন কোনও বারান্দায় যাওয়া হবে না। কোনও দিন হয়তো আর কবিতার সৃষ্টি হবে না।

    জানালার দিকে এক দৃষ্টে চেয়েছিল নীলাঞ্জনা। হঠাৎ নিজের কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে সংবিৎ ফিরে পেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল পিছনে দাঁড়িয়ে আছে অর্নব। নীলাঞ্জনার কানের কাছে নিজের মুখ নিয়ে গিয়ে বলল – ‘তোমাকে একটা কথা তো বলাই হয়নি। এবার যে ভাড়া বাড়িতে আমরা যাবো, সেটা দু’তলায়। আর সেখানে বারান্দা আছে।’

    সমাপ্ত।

    গল্পে উল্লেখিত কবিতাটির জন্য কবি পারমিতা ভট্টাচার্য কে অসংখ্য ধন্যবাদ।

You cannot copy content of this page