• কবিতা

    কবিতা- আকর্ষণ

    আকর্ষণ
    – মৈত্রেয়ী ঘোষ

     

     

    অনেকেই স্বীকার করে না
    বিচ্ছেদের চরম আকর্ষণী শক্তির কথা,
    ক্যানভাস যতদিন রঙিন থাকে
    প্রিয়জনের স্পর্শ ততটা জোরালো হয় না,

    যতটা হলদে হয়ে আসা ফ্যাকাসে ক্যানভাসে হয়,
    ঠিক যখন‌ই বর্তমান ডানা মেলে উড়ে যায়
    অতীতের দেশে তখনই শুরু হয়
    বিচ্ছেদের গোপন অভিসার,
    সেখানে অভিমান থাকে, যন্ত্রণা থাকে
    আর‌ থাকে একবুক ভালোবাসা,
    শুধু থাকে না সেই প্রিয়জন
    যাকে ঘিরে গড়ে ওঠে বিচ্ছেদের
    ক্রমবর্ধমান আকর্ষণ।

  • কবিতা

    কবিতা- দেনা

    দেনা
    – মৈত্রেয়ী ঘোষ

     

     

    কবেকারের টকে যাওয়া জীবন
    খিল্লি করে গুঁজে রেখেছি ফাঁকে
    না চিবোচ্ছি, না গিলছি,
    একঘেয়েমী কাটাতে
    বায়োস্কোপের কোটরে নয়তো
    সস্তার সমুদ্র সৈকতে চক্কর মারি,
    প্রতি পদক্ষেপে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া জীবন
    অশুভের পদধ্বনি তে ভীত হয়ে পড়েছে,
    একটু একটু করে লালন করা ফুটফুটে স্বপ্নগুলো অজান্তেই জং ধরে গেছে,
    কয়েক ফালি মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে
    ফাটল ধরেছে হৃদয়ের দুর্বল ভিতে,
    এখন ভয় হয়, ভবিষ্যতের দেনা
    শোধ করার মতো রশদ আছে কি এ
    তুবড়ে যাওয়া মনের!!

  • কবিতা

    কবিতা- বিশ্বাসঘাতক

    বিশ্বাসঘাতক
    – মৈত্রেয়ী ঘোষ

     

     

    দিন যত এগোয়
    তোমার প্রতি আস্থা ততোই বাড়ে
    একসাথে পথ চলি
    মিটার স্কেলে কখনো মেপে
    দেখিনি দূরত্ব, কেমন যেন বশ
    হয়ে গিয়েছিলাম তোমার,
    সেই বশ্যতা আসলে বিশ্বাসেরই
    আর এক নাম,
    তারপর কিভাবে যেন হাত ছেড়ে গিয়েছিল
    অনেক দিন খবরই পাইনি
    কিছুদিন কেঁদেছি, খোঁজ করেছি
    একসময় সামলে নিয়েছি নিজেকে।
    সেদিন শুনলাম, চলার পথ বদলে নিয়েছো
    তুমি, অন্য সাথী অন্য কোনো গলি,
    আজ একাই আপন গৃহকোণে বসে
    জানি অন্ততঃ তোমার মতো বিশ্বাসঘাতকতা
    করবেনা এই পর্ণকুটিরটি।

  • কবিতা

    কবিতা- শীত পরী

    শীত পরী
    – মৈত্রেয়ী ঘোষ

    উত্তরের হাওয়া যখন
    একটু একটু করে শক্তি সঞ্চয় করে
    শীতের দুন্দুভি তখনই গমগম করে ওঠে!
    এ বড়ো বহুরুপী সময়,
    কখনো ভয়ংকর দাপাদাপিতে
    সারাদিন কোটরেই থাকি,
    কখনো শীতের পাতলা চাদর মুড়িয়েই
    বেড়িয়ে পড়ি উদর সন্তুষ্টির সন্ধানে,
    রূপ সর্বস্ব মেঘের দল–
    একটা ফুরফুরে মেজাজ এনে দিলেও
    তা দীর্ঘস্থায়ী হয়‌না।
    কৃষক শস্য দানায় আঁকে জীবনের সোনালী রং
    মহুয়ার বনে শোনা যায় শীতের গান
    খেন্তি বুড়ি খচর মচর করে চিবোতে থাকে
    কোঁচড় ভরা কড়াইশুটি।
    এসবের মধ্যেও দৃষ্টি আকর্ষণ করে–
    নবান্নের পৌষালী হাঁড়ির ভিতর থেকে
    ভেসে আসা ক্ষুধার্ত শিশুর
    কান্নার রোল,
    কিংবা রেলের প্ল্যাটফর্মে শুয়ে থাকা
    নগ্ন ভিখারীর শীতবস্ত্রের অভাবে মৃত্যু বরণ।
    সুখে অথবা দুঃখে এইসময় মুহূর্ত দল
    বড্ড কাছাকাছি ঘোরাফেরা করে
    পরষ্পরের অনুভূতিতে,
    অবশেষে ভালো মন্দের ঘুলঘুলিতে শায়িত
    শীত পরীর যাবতীয় নৈকট্যের গায়ে
    আচমকাই যতি চিহ্ন এঁকে দিয়ে
    আপন উপস্থিতি ঘোষণা করে
    ঋতুরাজ।

  • কবিতা

    কবিতা- শুদ্ধতা

    শুদ্ধতা
    – মৈত্রেয়ী ঘোষ

     

    শিবের জটা‌ থেকেই
    শুভারম্ভ, ক্রমশঃ প্রাণচঞ্চল
    জলরাশিকে সঙ্গী করে,
    পৃথিবীর একপ্রান্তের সুখ দুঃখ,
    হাসি কান্না, অপর প্রান্তের পিপাসার্ত
    অনুভবি হৃদয়ে স্থান করে দেওয়া
    সেতো সহজ কথা নয়!

    তাও সে চলেছে যুগ যুগ ধরে
    কতো পাপ, কতো কালিমা
    নিঃশব্দে ধারন ক’রে
    জগতকে করেছে শুদ্ধ।
    শত শত গ্লানি মুখ লুকিয়েছে
    তার আশ্রয়ে, আজ‌ও তার
    গর্ভে জুড়ে শবের মিছিল।

    এতো কলেবর, এত গ্লানি
    পুষ্প পাত্রে তবুও চাই তাকে
    চরণামৃত থেকে শান্তির জল
    সৃষ্টি যজ্ঞ থেকে পূণ্য স্নান
    সবেতেই পুণ্যতোয়ার স্পর্শ।
    শুধু আশ্চর্য এই যে,
    সারা জন্মের পূণ্য স্নানেও
    আমাদের শুদ্ধতা আজ‌ও বিচারাধীন।

  • কবিতা

    কবিতা- স্টাইলিস্ট

    স্টাইলিস্ট
    – মৈত্রেয়ী ঘোষ

     

    স্টাইলটা তোর বরাবরই একচেটিয়া
    কখনো ব্লু জিন্স আর ব্ল্যাক টি শার্ট পড়ে,
    আবার কখনো সানগ্লাসের উপর থেকে আড়চোখে উঁকি মেরে।
    সেদিন যখন বাইকে বসে সিটি মেরে ডাকলি, মাইরি বলছি– আমি পুরো ফিদা।

    একদিন কি হলো– তুই হঠাৎ বেপাত্তা
    সবাই তটস্থ শুধু আমি ছাড়া,
    জানতাম এভাবেই উধাও হবি
    আবার ফিরেও আসবি, এসেওছিলি
    যেন একটা দমকা হাওয়া, আসলে তুই চিরকালই খ্যাপাটে।
    তারপর একসাথে পথচলা, ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখা, অবশেষে মালা বদল– এইভাবেই রোজ নামচার শুরু।

    সেদিন বৃষ্টি এলো, ছাদে গেলাম কাপড় তুলতে, দেখি নিচে লোকে লোকারণ্য
    ভীড় ঠেলে এগিয়ে যেতেই–
    সে এক ভয়ংকর দৃশ্য
    রাস্তায় পড়ে আছে তোর নিষ্প্রাণ শরীর
    আর চারিদিক রক্তে ভেসে যাচ্ছে,
    কে যেন আচমকাই থাবা বসিয়ে দিয়েছে আমাদের এই স্বল্প দৈর্ঘ্যের কাহিনীর উপর।

    এই হঠাৎ চলে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি, তবু মনকে বুঝিয়ে ছিলাম
    হয়তো এটাই তোর শেষ——
    তুই যে আগাগোড়াই ভীষণ রকম স্টাইলিস্ট।
    ঘরে এসে ভেজা কাপড়গুলো নিঙরাতেই
    রঙ উঠে সাদা হয়ে গেল আমার সবকটা শাড়ি।

  • অণু কবিতা

    অণু কবিতা- মনসাগরে

    মনসাগরে
    – মৈত্রেয়ী ঘোষ

    জানিস্ ওরে মন–
    দুঃখ গুলো বড্ড টানে
    কারণ তারা একান্ত আপন
    ছায়া হয়ে থাকে পাশাপাশি।

    হঠাৎ সেদিন মন কাননে
    এক ফালি সুখের চাঁদ
    যেই না তাকে ছুঁতে গেছি–
    অমনি সে চঞ্চলা।

    আসলে তুই ভীষণ স্পর্শকাতর
    আঘাত পেলেই করিস স্মরণ,
    আর ক্ষণিকের সুখস্মৃতি
    হারিয়ে ফেলিস অতল মনসাগরে।

  • কবিতা

    শ্যাওলা

    শ্যাওলা
    -মৈত্রেয়ী ঘোষ

     

    বসবার ঘরের মেঝেটা
    বহুদিন কেউ পরিষ্কার করে নি,
    কেমন যেন একটা
    অযত্ন আর তাচ্ছিল্যের ছাপ সর্বত্র।
    একগাদা শ্যাওলা মেঝের সমস্ত সৌন্দর্যকে
    চাপা দিয়ে রেখেছে।

    আসলে মেঝেটাই হয়ে গেছে কমজোরি,
    তাই বেপরোয়া শ্যাওলা পুরু হতে থাকে,
    আর বাড়তে থাকে আয়তনে।
    তারপর একদিন মেঝে পেরিয়ে উঠোন,
    উঠোন পেরিয়ে রাস্তা, আর রাস্তা পেরিয়ে
    সমগ্র দেশে আধিপত্য বিস্তার করে ফেলে
    কুরুচিপূর্ণ, গা ঘিন ঘিন করা
    দাম্ভিকতার শ্যাওলা।

    আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছি
    যাবতীয় অপরিচ্ছন্নতাকে নির্মূল করার,
    কিন্তু না, কিছুতেই লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না।
    কৈশোরের সারল্য, যৌবনের উদ্দীপনা,
    মধ্য বয়সের সহনশীলতা, অথবা
    বার্ধক্যের নৈতিকতা– সব কিছুর উপরেই
    পড়েছে দশ ইন্চি পুরু অসংযমী শেওলা।

    সবাই নিজের খামখেয়ালিপনা
    নিয়েই ব্যস্ত সারাক্ষণ,
    এদিকে জাঁকজমক আর চটজলদি
    হাসিল করার প্রবল ঝড়ে
    প্রতি মুহূর্তে দিক হারাচ্ছি আমরা।
    মুখগুলো ঢাকা পরে গেছে মুখোসের আড়ালে।
    কখনো প্রলোভন, কখনো ধমকানি
    এইসব শক্তিশালী প্রতিপক্ষের আস্তরণে
    খুইয়ে ফেলেছি নিজস্বয়ানা।

    এবার সময় এসেছে,
    বিনাশ করতে হবে সমস্ত সামাজিক অবক্ষয়,
    বালতি বালতি মূল্যবোধ ঢালতে হবে
    অনাচার আর অত্যাচারের মুখে,
    তবেই স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবো
    আমি আর আমার সমাজ,
    সমস্ত শেওলাকে অপসারিত করে
    আনকোরা নতুন চেহারায় সেই চিরন্তন সৌন্দর্য
    আবার ফিরে পাবো আমরা।

  • অণু কবিতা

    অণু কবিতা- গাঁটছড়া

    গাঁটছড়া
    -মৈত্রেয়ী ঘোষ

     

    মনের মিলন,
    ভাবের সুজন
    বন্ধুত্বে হাতছানি,
    আমার স্মরণ
    তোমার বরন
    স্বার্থকতাই মানি।

     

    স্বপ্ন দেখেছি
    বাঁচতে চেয়েছি
    মনেতেই কথা বলা,
    ভরসা পেয়েছি
    হারিয়ে গিয়েছি
    এভাবেই পথ চলা।

     

    মোর অনুভূতি
    সরল আকুতি
    স্থান দিলে হৃদয়েতে,
    তব প্রশস্তি
    অনুপম দ্যুতি
    আছে মোর পরাণেতে।

     

    সমাজের দায়
    চাই পরিচয়
    স্বপ্ন রয়েছে সাধা,
    সুপ্ত আশায়
    শুভ পরিনয়
    তাই গাঁটছড়া বাঁধা।

  • কবিতা

    সীমানা

    সীমানা
    -মৈত্রেয়ী ঘোষ

     

    এপার ওপার অথৈ জল
    জানি না আদৌ মিলবে কি তল,
    মধ্যিখানে ছোট্ট আশা
    সীমান্তের নেশায় বেঁধেছি দল।

    “একে একে দুই” সেটাই মন্ত্র
    এমন করেই আপনারে খোঁজো,
    বিস্মৃতি হোক স্মৃতির স্তম্ভ
    বর্তমান লুকিয়ে অতীতেই আজও।

    মমতায় মোড়া কোমল স্পর্শে

    জনে জনে হবে শুভ যোগাযোগ,
    হীনমন্যতা দূর করো যদি
    মিটবেই তবে সব অভিযোগ।

    ছোটো আঙিনায় স্বপ্ন অধরা
    তাহারে খুঁজতে ব্যাপ্তি বাড়াও,
    কেউ কারো নয়, তবু আপন সবাই
    এমনই ভরসা জগতে যোগাও।

    অহং গন্ডি পার করো আগে
    তবেই বাড়বে আপন সীমানা,
    সোনা নয়, শুধু ধূলাতেই গড়ো
    সমগ্র পৃথিবীর প্রতিটি কণা।

You cannot copy content of this page