• গল্প

    গল্প- বিউটিপার্লার

    বিউটিপার্লার
    -রাখী চক্রবর্তী

    ভেজানো ঘরের দরজা খুলে জয়তী ঘরের ভেতর ঢুকলো,
    দিশা বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।
    জয়তীকে দেখে দিশা বলল, কেমন আছিস বল, আমাকে দেখতে এলি ?
    জয়তী বলল, হ্যাঁ গতকালের ঘটনা পেপার, টিভি, খবরে সবখানে দেখাচ্ছে, রেখাদি নেই ভাবতেই পারছি না, তোমার এই অবস্থা হল কি করে ?, এক সপ্তাহ ছুটি নিয়েছি এর মধ্যে কতকিছু ঘটে গেল, তুমি সুস্থ আছো তো দিশা দি?
    -হ্যাঁ রে,
    -এবার বলো তো ঠিক কি হয়েছিল গতকাল রাতে পার্লারে?

    দিশা ঢোক গিলে বলল, শোন তবে, সকাল ন’টা, “আমি বিয়ে বাড়ি গেলাম দিশা, ব্রাইডাল এলে চালিয়ে নিও।”

    -রেখাদি, তুমি নিশ্চিন্তে যাও। আমি আর পিঙ্কি চালিয়ে নেব।

    রেখাদির বিউটিপার্লারে আমি দশ বছর ধরে কাজ করছি, খুব বিশ্বাস করে রেখাদি আমায়। আজ রেখাদির মাসতুতো বোনের বিয়ে, তাই সকাল আটটায় পার্লার খুলতে বলল রেখাদি, আমি তাই অন্য দিনের চেয়ে তাড়াতাড়ি চলে এলাম, রেখাদি সকাল ন’টার মধ্যে বেরিয়ে গেল, আমাদের হেল্পার পিঙ্কিও চলে এসেছে তাড়াতাড়ি, কিন্তু বিয়ের সিজনে পার্লার একদম ফাঁকা, ভাবাই যায় না।

    আমি আর পিঙ্কি সকাল থেকে পার্লারে আছি, একটাও কাস্টমার এলো না, আজ বিয়ের তারিখ, একটাও ব্রাইডাল এলো না।
    ব্রাইডাল এলে সামলাতে পারি না জানিসই তো, যাইহোক সকাল এগারোটা বেজে গেল। পিঙ্কিকে চা আনতে বললাম,
    পিঙ্কি চেয়ার মুছতে মুছতে বলল, দিশাদি হাতের কাজ করে নিয়ে আসছি।
    কিছুক্ষণ পর পিঙ্কি চা এনে বলল, “দিশাদি আমাকে বিকেল পাঁচটায় ‌ছুটি দেবে?”
    আমি চায়ের কাপে আরামের চুমুক দিয়ে বললাম, কেন ?
    পিঙ্কি মাথা চুলকে বলল, “বিয়ে বাড়ীতে যাব।”
    -আগে বলিস নি কেন? রেখা‌ ম্যাডাম নেই, জয়ীতা আসবে না।
    -দাও না, তেমন কাস্টমার তো নেই।
    আমি বেশ রেগেই বললাম, বিকেল থেকে শুরু হবে কাস্টমারদের আসা, না না তোকে ছুটি দিতে পারব না, রেখাদি শুনলে ভীষণ রেগে ‌যাবে।
    পিঙ্কি হাতজোড় করে বলল, “প্লিজদি, আমি আইব্রোশ এলে করে দেব, একটু দেরি হলেও ক্ষতি নেই।
    -ঠিক আছে যাবি, তবে ব্রাইডাল এলে‌ একটু সাহায্য করে দিস আমাকে কেমন।
    পিঙ্কি মাথা নাড়িয়ে দোকানে গেল দুপুরের খাবার আনতে।

    সন্ধ্যা বেলায় ঝড় বৃষ্টি শুরু হলো। পিঙ্কিকে বিকেল পাঁচটায় ‌ছুটি দিয়ে দিলাম, বাচ্চা মেয়ে আনন্দ করুক।
    আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছি, দু’চোখ জুড়ে ঘুম, শরীরটা এলিয়ে দিয়েছি বলেই ঘুম পাচ্ছে, কেউ নেই পার্লারে,
    রাস্তাটা ফাঁকা, তেমন জমজমাট নেই অন্য দিনের মতো। ঝড় বৃষ্টি খুব হচ্ছে তেমন কেউ বাইরে বের হচ্ছে না।
    হঠাৎই, ট্রিং ট্রিং করে ফোনের রিং বেজে উঠল । আমি চোখটা বন্ধ করে
    নানান কথা ভাবছিলাম, তাই ফোনের রিং শুনে চমকে উঠলাম, ফোন তুলে বললাম,
    হ্যালো কে বলছেন?
    -আমি সাজতে আসবো।
    -আমাদের পার্লার আটটায় বন্ধ হয়। এখন সাতটা।
    -এক মিনিটে আসছি।বলেই ফোনটা কেটে দিলো।

    “আমি আসবো তাই পার্লারের দরজা খুলে রেখেছেন”

    দরজার দিকে তাকিয়ে আমি হতভম্ভ হয়ে গেলাম মেয়েটি আলুথালু বেশে চলে এসেছে পার্লারে।
    আমি হেসে বললাম,আপনি ফোন করেছিলেন ?
    -হ্যাঁ
    -শাড়ি গয়না এখানে পড়বেন? না কি, শুধু সাজবেন.. বলতে বলতেই কারেন্ট চলে গেল মোমবাতি জ্বালিয়ে দিলাম।
    মেয়েটি বলল, বেনারসি শাড়ি পড়েই এসেছি।
    আমি বললাম, আপনি চুড়িদার পড়ে এসেছেন।
    মেয়েটি হেসে বলল, লাল বেনারসি, ভালো করে দেখো।
    আমি দেখলাম পুরো লাল দেখাচ্ছে মেয়েটিকে, মনে মনে ভাবলাম ‌ভুল তো দেখিনি, তবে বেনারসি শাড়ি কখন পড়লো
    -কি গো সাজাও
    আমি বললাম, হ্যাঁ এই তো।
    আমি মেয়েটিকে সাজাচ্ছি আর গল্প করছি।হঠাৎ একটা দমকা হাওয়াতে পার্লারের দরজা খুলে গেল। আমি অবাক হয়ে গেলাম রেখাদিকে দেখে, রেখাদি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
    আমি বললাম- রেখাদি তুমি!

    রেখাদি গম্ভীর গলায় বলল, কটা বাজে?
    পার্লার বন্ধ করবে না?

    আমি ঘড়ি দেখে বললাম- রাত আটটা বাজেনি তো রেখাদি, তুমি তো বলেছো রাত আটটার আগে যেন পার্লার বন্ধ না করি।
    রেখাদি কর্কশ স্বরে বলল, তাই ! দেখো রাত একটা বাজে…
    আমিও হেসে বললাম, দেখো রেখাদি
    ঐ তো ঘড়িতে আটটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। একটা ব্রাইডাল এল, ফোন করেই এল। সাজালাম, এই তো বসে আছে দেখো।
    -কোথায়?
    আমি দেখলাম চেয়ারে কেউ নেই!
    -সত্যি তো তুমি পার্লারে ঢুকতেই মেয়েটাকে আর দেখতে পেলাম না।
    রেখাদি বলল, ফোন করে এসেছিল মেয়েটি! ফোন তো ডেড, তা কত নিলে পাঁচ হাজার না সাত?
    আমি এখন বেশ ভয় পাচ্ছি, ফোন ডেড আমি তো জানতাম, তবে মেয়েটি ফোন করলো এটাও সত্যি, যাই হোক ভয় মাথায় নিয়ে রেখাদিকে বললাম, সাজানো কমপ্লিট হয় নি চলে গেল মেয়েটি…
    -কি নাম সেসব কিছু বলেছে?
    – পিউ সরকার মেয়েটির নাম। রামলাল বাজারে থাকে। ওর বিয়ে আজ। তাই সাজতে এসেছিল বেনারসি শাড়ি পড়ে এসেছিল আমি খোঁপা করে দিলাম, সাজালাম।
    রেখাদি আমার কথা শুনে খুব হাসছে, বিকট সে হাসি যেন মেঝে ফেটে যাচ্ছে।
    কি বললে পিউ সরকার? হা হা হা দেখো তো এই মেয়েটি কি না?
    আমি মেয়েটির ছবি দেখে বললাম, হ্যাঁ, এই মেয়েটি, তবে তুমি এতো হাসছো কেন?
    -আমার মাসতুতো বোন পিউ ,ওর বিয়ে আজ। গতকাল খবর আসে ওর হবু বর খুন হয়েছে। পিউ সেই দুঃসংবাদ শুনে গলায় দড়ি দিয়ে পাখায় ঝুলেছে।
    আমি রেখাদির কথা শুনে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলাম, রেখাদির‌ মুখটা‌ নিচে পা দুটো চেয়ারের ওপর, আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,
    রেখাদি তোমার মুখটা নিচে কেন তুমি নিমিষেই ফ্যানের ওপর উঠলে কিভাবে?

    -দিশা আমার পার্লার ফাঁকা করে দে।
    -রেখাদি ঝড় বৃষ্টিতে কোথায় যাব থেকে যাই রাতটুকু..

    -ঐ দেখ পিউ এসেছে। আয় বোন
    -পিউ তো মারা গেছে।
    -হা হা হা আমি তো বেঁচে আছি, তোর রেখাদি,হাহাহাহা
    আমি আর না ভেবে দৌড়ে রাস্তায় চলে এলাম। তারপর গাড়িতে চেপে বাড়ি ফিরলাম, তখন রাত তিনটে।
    পরের দিন টিভিতে খবরে দেখাচ্ছে মৃত বোনকে হসপিটাল থেকে দেখে ফেরার পথে পথ দুর্ঘটনায় মারা গেলেন বিউটিপার্লারের মালকিন রেখা সাউ।
    আমি খবর শুনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম।গায়ে তখন ধুম জ্বর।
    সেই থেকে আমি আমার শরীর চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছি। এখন জানতে চাস না কেন?

    জয়তী পুরো ঘটনা শুনে বলল, কিন্তু দিশাদি, তোমার মুখের আদল রেখাদির মতো হলো কি করে! সেটা বললে না তো?
    -থাক না, বাড়ি যা,
    -না বলো
    -কি রে জয়তী কখন এলি?

    জয়তী পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল, মাসীমা কেমন আছেন?
    – একমাত্র রোজগেরে মেয়েকে হারিয়ে আছি।

    -এমন কথা বলবেন না, দিশাদি ঠিক ভালো হয়ে যাবে।

    -কি বলছিস, মেয়ে আমার ভালো হয়ে যাবে, পাড়ার ছেলেরা শ্মশানে ‌পুড়িয়ে এল দিশার মৃতদেহকে। তুই দিশার ঘরে ঢূকলি আমি দেখলাম, তখন শ্মশান যাত্রীদের জন্য আমি আগুন, নিমপাতা মিষ্টি জায়গা মতো রাখছিলাম।

    জয়তী চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, আর ভালো করে খাটটা দেখলো না কেউ বিছানায় নেই তো‌।
    তারপর জয়তী দেখল, দিশা নিজের ঘরে কারোর চুল বাধছে, কাউকে সাজাচ্ছে, জয়তী এক মুহুর্ত দেরি না করে দৌড় লাগালো, রাস্তায় এসে ও হাঁপাতে হাঁপাতে হাঁটতে লাগলো, হাঁটতে হাঁটতে জয়তী
    বিউটি পার্লারের সামনে এসে দাঁড়ালো, হাল্কা আলো‌ জ্বলছে বন্ধ বিউটি পার্লারে,ওর মনে হলো কেউ আছে পার্লারে, তখন রাত আটটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি….

  • কবিতা

    কবিতা- বই

    বই
    -রাখী চক্রবর্তী

     

     

    সারাদিন একা থাকো, বোকা বাক্সে চোখ রাখো
    চলো, আজ না হয় উপায় একটা বের করি।

    বইয়ের তাকেতে গিয়ে, বইগুলো হাতড়িয়ে
    দু’একখান বই সযত্নে পড়ি।

    অনেক দুর গ্রন্থাগার, যেতে গিয়ে যাওয়া হয় না আর
    এই তো বলবে তড়িঘড়ি।

    তবে শোন মন দিয়ে, অহরহ খুশি নিয়ে
    বই পড়ে জ্বালাও জ্ঞানের ফুলঝড়ি।

    ঘোরাঘুরি সব করো, পরনিন্দা বন্ধ করো
    নানামুনির নানা মত শোনা কি খুব দরকারী।

    লালপরী নীলপরী, চাঁদ মামা চাঁদের বুড়ি
    জানো আরো কত আছে গল্পের ঝুড়ি।

    না না একদিন না, এটা হোক চিরকালের ভাবনা
    বইকে যেন চিরকাল ভালবেসে পড়ি।

    বই পড়ি হোক না সে গল্প, বা ভ্রমণ অল্পস্বল্প
    দুনিয়াটা চেনা যে খুব দরকারী।

    ঘর হোক বা গ্রন্থাগার, অধিকার আছে সবার
    বই পড়া হোক নেশার বয়ে চলুক টিকটিক ঘড়ি।

    ধীরে ধীরে অভ্যাস, হবে যে দাসের দাস
    এ বাণী যে আমার না স্বয়ং কৃষ্ণের-ই।

    সকাল হোক বা রাত্রি, মোরা একই পথের যাত্রী
    আজ থেকে হও বইয়ের পুজারী।।

    অঁজপাড়া গাঁয়ের মেয়েবধু, দিনরাত খাঁটে শুধু
    ওদের কাছে বই হল আলোর দিশারী।

    ইচ্ছে থাকে তো পড়ার, কিন্তু নেই কেউ বলবার
    সহে যেতে হয় লাঞ্ছনা গঞ্জনা ভারি।

    অট্টালিকায় থেকে, আলস্যকে ভালবেসে
    আমরা শরীরের ক্ষতি যারা করি।

    এইবেলা শুরু করি, বই পড়ে মন ভরি
    সুস্থ মন নিয়ে চললে উন্নতি হয় নিজের-ই।

    আগোছলা জীবনে, ধার করা সুখ কিনে
    জমিয়েছি শুধু একাকিত্ব ও টাকাকড়ি।

    চোখ খুলে দেখ, বই পড়ে দেখ
    মানুষ হয়েছে কত ছেড়ে ভেকধারী।

    হৃদয়ের অন্তঃস্থলে জমা, কতো পুণ্য, দয়া, ক্ষমা
    কারণ বইই উৎস সকল জ্ঞানেরই।

    আমি তুমি শেষ হব, চিতাতে জ্বলব
    বইয়ের তাকেতে বই থেকে যাবে সারি সারি।

  • কবিতা

    কবিতা- “বেনীমাধব”

    “বেনীমাধব”
    -রাখী চক্রবর্তী

     

     

    বেনীমাধব কবেই গেছে
    স্কুল ঘরটা ছেড়ে,
    কালো বোর্ডে আজও আবছা লেখা
    “বেনীমাধব কবে আসবি আমার ঘরে”

    সখী তোর প্রাণের সখী
    অবুঝ আজও আছে,
    রক্ত গোলাপ ফুটিয়ে ছেঁড়ে
    ভয় পাস তুই পাছে।

    বেনীমাধব বেনীমাধব,
    বুলবুলিদের ধান খাওয়া হয় না আর দেখা,
    আকাশ ফুঁড়ে রক্ত লাশ
    দেখি, ফিরছে একা একা।

    বেনীমাধব,
    বন্দি তোর স্বপ্নগুলো নীরবে কাঁদে,
    তারার ভিড়ে চাঁদের দেশে
    ওরা একলা একলা হাঁটে‌।

    বেনীমাধব,
    তোকে নিয়ে আজকাল লিখছে অনেক কবি,
    জ্যোৎস্না রাতে খাতা কলমে
    তুই আমার হোবি।

    বেনীমাধব,
    শিউলি ফুলের সুবাস এখনও কি তুই পাস,
    আমার খোঁপায় শিউলি গাঁথা
    বাড়িয়ে দে তোর দুহাত।

    বেনীমাধব,
    অল্পস্বল্প গাল গপ্পো কর
    নদীর মাঝে চর দেখে,
    এখনও কি তোর বুক করে ধড়ফড়।

    বেনীমাধব বেনীমাধব
    গণ্যমান্যরা মুখে এঁটেছে কুলুপ,
    নারী হত্যায় শত মিছিল
    পুরুষ হত্যায় সব চুপ।

    বেনীমাধব
    সুনামী আমার চোখে, সমুদ্রগুলো শান্ত
    আড়িভাবের খেলা সাঙ্গ হবে
    তা কি মন জানতো।

    বেনীমাধব
    আমার ঘরে আলো জ্বলে না
    আলোর বাতি নিভিয়ে দিল
    অঘোষিত চিতার কান্না।

    বেনীমাধব বেনীমাধব,
    ঐ আকাশে তুই সাজা বাসর ঘর
    আমি আসছি শিগগিরি
    আমার ভীষণ কালাজ্ব।

  • কবিতা

    কবিতা- “নতুন বছর”

    “নতুন বছর”
    -রাখী চক্রবর্তী

     

     

    নতুন বছর
    হাজার খুশির চাদর মুড়ে আসুক,
    নতুন বছর
    অভুক্তদের পেটটা ভরে রাখুক,
    নতুন বছর
    তীব্র দহন দুরে সরিয়ে রাখুক,
    নতুন বছর
    প্রকৃতিকে শস্য শ্যামলায় ঢাকুক,
    নতুন বছর
    ধমীর্য় বিভেদ গোড়া থেকে নির্মূল করুক
    নতুন বছর
    ধনী গরীবের প্রাচীরটুকু ভাঙুক,
    নতুন বছর
    আনন্দ উৎসবের দোলায় শুধু ভাসুক
    নতুন বছর
    সত্য মিথ্যার হিসাব শুধু রাখুক,
    নতুন বছর
    মুখোশধারীর মুখোশ টেনে খুলুক,
    নতুন বছর
    ভালবাসার পুস্প হয়ে ঝড়ুক
    নতুন বছর
    তোমার আমার বন্ধুত্ব আরো দৃঢ় করুক
    নতুন বছর
    সুখ সমৃদ্ধি সর্বজনীন করুক।

  • কবিতা

    কবিতা-স্মৃতি

    স্মৃতি
    -রাখী চক্রবর্তী

     

     

    হারিয়ে গেছে যে সব দিন
    তা কি ফিরে‌ পাওয়া যায়‌?
    মায়ের বকুনি, বাবার শাসন
    সেই সব দিন, মন ‌ফিরে পেতে চায়।
    লুকোচুরি খেলা, চু কিৎকিৎ, এক্কা দোক্কা
    সহচরীদের সাথে পুতুলের বিয়ের কুটনো কোটা
    ভোর হলেই গলা সাধার রেওয়াজ
    এক ছুটেতে পুজো মণ্ডপ শুনলে ঢাকের আওয়াজ
    স্মৃতি হাতড়ে বুঝি কত মূল্য ছিল সেই সময়টার।
    ইস্কুলে পড়া ছিল ছিল গল্প গান
    অল্প স্বল্প চাওয়া ছিল,ছিল না কোন অভিমান
    চাঁদের বুড়ির গল্পগাঁথা, মনে‌ পড়ে কত রুপকথা
    ডুব সাঁতারে পুকুর পার
    বাড়ি ফিরে মায়ের হাতের মার
    স্মৃতি হাতড়ে বুঝি কত মূল্য ছিল সেই সময়টার।
    বৈশেখ জোষ্ঠ্যতে আম পাড়ার ধুম
    কাক ভোরে বুড়োর বাগানে চোখ ঘুম ঘুম
    বাগদেবীর আরাধনায় ইস্কুলে যাওয়া
    নতুন শাড়ি পড়ে এদিক ওদিক চাওয়া
    আজও হয় শাড়ি পড়া আজও ঘোরাফেরা
    তবুও স্মৃতি হাতড়ে বুঝি কত মূল্য ছিল সেই সময়টার।
    ফাগুনের দোল উৎসবে আবিরে রাঙা মুখ
    আয়নায় ফিরে ফিরে দেখা, সে ছিল এক অন্য সুখ
    আজ দোলের দিনে মন খারাপের ঝুলি নিয়ে বসা
    দেয় না তো কেউ আবির ছুড়ে
    শুধু ফোনে চলে শুভেচ্ছা বার্তা
    আর একবার যদি পেতাম
    হারানো সেই সময়ের সেই দিন
    হিসেব নিকেশে চুকিয়ে দিতাম
    অবুঝ মনের স্মৃতির ঋণ।

  • কবিতা

    কবিতা- “আলো আঁধারি”

    “আলো আঁধারি”
    -রাখী চক্রবর্তী

     

     

    রাত নিঝুম, চোখে নাই ঘুম
    মন বলে কি হয় কি হয়!
    রাতের বেলায় আ্যম্বুলেন্সের হর্ন বাজে যখন,
    দুচোখে নেমে আসে ভয়।
    অশ্রু, সেটা কি কোনও আবেগে ঝড়ে পড়ে? জানিনা

    বছর চারেক হলো তার সাথে নেই পরিচয়।
    সারা রাত জেগে,
    হসপিটালের কড়িডরে
    রেখেছি সবে হাত
    বিলাপে প্রলাপে ডুকরে, মাথা
    ঠুকরে বিদায় নিল আলো আঁধারি রাত।
    না ফেরার দেশে চলে গেল কত
    কে রাখে এত কার হিসাব?
    যন্ত্রণা এত সস্তা, আমার ঘরে তার প্রতিনিয়ত যাওয়া আসা
    তাই দুঃখের সাথে হল মিতালি
    জানি, একদিন সুখ চিনে নেবে তার আপন রাস্তা।
    ঘর সংসার বিছানাপত্র সব
    সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছি
    প্রত্যাশার হাত ছেড়ে দিয়ে
    সময়ের থেকে সময় ধার চেয়ে নিয়েছি
    জানি, সব সুখ মেলে শুধু মরণে
    জমানো অভিমান বরফ থেকে একটু একটু করে জল‌ হচ্ছে,
    বিদ্রুপের দোলায় চেপে ঠিক চলে যাব
    আলো আঁধারির খেলা হয় যেখানে।

  • নাটক

    নাটক- “তিন কন্যা”

    তিন কন্যা”
    -রাখী চক্রবর্তী

    (চরিত্র:– অবন্তী চৌধুরি, শুভময় চৌধুরি, দোয়েল,
    টিয়া, ময়না, গৌতম নাগ, পুলিশ অফিসার এস রায়,চার্চের বাগানের মালি মধু,ফাদার ও কিছু লোকজন। একটি বিশেষ চরিত্রে পরমা ডিসুজা)

    প্রথম দৃশ্য
    ***********
    সময় সকাল সাতটা
    (আবহে পাখিদের কলতানে ভরে উঠবে।
    টিয়া, ময়না, দোয়েলের কিচির মিচির শুনে ঘুম ভেঙে যাবে অবন্তীর)

    অবন্তী- (বিছানায় বসে হাই তুলে) এতো ঝগড়া কিসের ওদের। সকাল হতে না হতেই কিচির মিচির শুরু করে দিয়েছে।

    শুভময়- (অবন্তীর গাল টিপে ) মনের কথা বলছে ওরা। ঝগড়া কেন করবে!সবাইকে নিজের মতো কেন ভাবো সোনা?

    অবন্তী- সকাল সকাল মাথা গরম করো না।
    মেয়েরা কি করছে দেখো। ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙে গেছে আমার। ওদের ঘরে গিয়ে দেখি, তিনটের একটাও ঘরে নেই। রবিবার বলে কি হাতির পাঁচ পা দেখেছে সব!

    শুভময়- হাতির পাঁচ পা, না কি সাপের পাঁচ পা?

    অবন্তী-ধুর, মুডটাই খারাপ হয়ে গেল। সাপের কথা আমার সামনে বলবে না, বলেছি তো অনেকবার। উঠি এখন। বাজার যাও ওঠো। কে কি খাবে তার লিস্ট জেনে নিও।

    অবন্তী ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় পাখিদের খাঁচার সামনে আসবে।

    অবন্তী- (পাখিদের খাঁচা ধরে) এতো ভালোবাসি তোদের, তবুও তোরা সকালে ঘুম ভাঙিয়ে দিস। কিসের শত্রুতা তোদের আমার সাথে?

    টিয়া- মা জল দে। এই মা জল দে
    ময়না- মা তোমাকে ছেড়ে কোনদিন যাব না

    অবন্তী- আচ্ছা, জলের জন্য এতো হাঁকডাক। দাঁড়া দিচ্ছি।
    ময়না- এত্তো ভালবাসি মা
    টিয়া- আই লাভ ইউ…

    অবন্তী- শোনো ওদের কথা, জল আনছি, কিচির মিচির ‌করিস না,
    (অবন্তী জল নিয়ে ‌প্রবেশ করে পাখিদের জল দিয়ে বারান্দা থেকে প্রস্থান করে।)

    দ্বিতীয় দৃশ্য
    **********
    সকাল ন’টা
    (শুভময় স্নান সেরে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে মঞ্চে প্রবেশ করবে)

    শুভময়- টিয়া, ময়লা, দোয়েল আয় তোরা। কোথায় রে সব। বাজারে যাব। লিস্টি দিবি না তো, আজ তাহলে চারাপোনার ঝোল ভাত খা সব। আমি চললাম।

    (টিয়া, ময়না,দোয়েল ছুটে মঞ্চে প্রবেশ করবে)
    টিয়া ,ময়লা, দোয়েল-(একসঙ্গে বলবে)
    চিকেন খাব আজ। বাজারে যাও তাড়াতাড়ি।

    শুভময়- ও এই ব্যাপার। চিকেন আনতেই হবে তাহলে।

    টিয়া- হ্যাঁ, যাও। ডিম টোস্ট খাব বাবা
    দোয়েল- আমি ঘুগনি খাবো বাবা।
    শুভময়- ময়না, তুমি বলে ফেলো কি খাবে?
    ময়না- যেটা খেতে দেবে তাই খাবো মামা।

    (শুভময় ময়নার গাল টিপে বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে মঞ্চ থেকে প্রস্থান করবে। টিয়া, ময়না, দোয়েল খেলতে থাকবে। দৃশ্যান্তসূচক আবহসংগীত বাজবে)

    তৃতীয় দৃশ্য
    **********
    বিকেল বেলার দৃশ্য- ময়না, টিয়া, দোয়েল ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখবে। অবন্তী, শুভময় ব্যালকনিতে বসে গল্প করবে।

    শুভময়- বোনের ছবিতে একটা মালাও দিতে পারলাম না। সদ্য মারা গেল। ভাবতেই পারি না, আমার একমাত্র বোন আর নেই। ভাবছি বোনের শ্রাদ্ধ গঙ্গার ঘাটে করে নেব।

    অবন্তী- ভাবাভাবির কিছু নেই। গঙ্গার ঘাটেই করতে হবে দিদিভাইয়ের কাজ। ময়নাকে কিছুতেই জানানো যাবে না যে ওর মা নেই।

    শুভময়- হ্যাঁ, সে তো ঠিক। ময়না তো জানলোই না ওর মা আর নেই। টিয়া, দোয়েলকে পেয়ে আনন্দে আছে। রোজ একবার করে জিজ্ঞাসা করে কিন্তু মা কেমন আছে মামা…

    অবন্তী- সে তো করবেই। কিন্তু কতদিন চেপে রাখবো কথাটা সেটাই ভাবি। টিয়া, দোয়েল ওদেরকে তো বলিনি। ওরাও জানে ওদের পিসি হসপিটালে ভর্তি আছে।

    শুভময়- আর বলবেও না। ওরাও ছোটো কখন মুখ ফসকে বলে দেবে। ঠাকুরের অশেষ দয়া যে তোমার মতো জীবন সঙ্গী পেয়েছি। তা না হলে কী অবস্থা হতো ময়নার ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

    অবন্তী- ময়নাকে কোনো না কোনো দিন জানাতে হবে তো। তখন কি হবে আমি সেটাই ভাবি। রোজ রাতে ওর মা’র ছবি নিয়ে ঘুমাতে যায় ময়না-
    খুব ভয় লাগে আমার।

    শুভময়-তু মি সব সময় বলতে মেয়ে ঘরের লক্ষ্মী। তোমার মেয়েই চাই। তাই ভগবান তোমাকে যমজ মেয়ে সন্তান দিল। আবার ময়না’কেও দিলো।

    অবন্তী- ময়না আমার ছোট মেয়ে। তিন কন্যার জননী আমি। ওদের ভালো রাখুক ভগবান। আমি তো ছেলে কোনোদিন চাইনি। কিন্তু ‌এখন ভয় লাগে, ওদের ‌মানুষ করতে পারব তো। একটা ছেলে যদি হতো বোনদের আগলে রাখতো, আমাদের জীবনের কোন ভরসা আছে, আজ আছি, কাল নেই, দিদিভাইয়ের মতো আমারও যদি এমন মৃত্যু হয়, তুমি কাউকে না কাউকে বিয়ে করবে তখন আমার তিন কন্যার কি হবে! জলে ভাসবে যে ওরা…

    শুভময়- পাগল না কি তুমি! আমার ঘরে একটা আস্ত পাগল আছে দেখে যাও সবাই…

    অবন্তী- হেলাফেলার কথা না এটা। ভাবো বসে বসে। আমি মেয়েদের কাছে যাচ্ছি।

    (অবন্তী প্রস্থান করবে, শুভময় ফোন করে কথা বলবে। দৃশ্যান্তসূচক আবহসংগীত বাজবে)

    চতুর্থ দৃশ্য
    ********
    (সময় রাত দুটো- বাড়ির সবাই ঘুমাবে। ময়না ওর মা’র ছবি নিয়ে দোতলার সিঁড়িতে বসে থাকবে।)

    ময়না-(মা’র ছবি কোলে রেখে) দু’দিন হয়ে গেল, এলে না তো মা। তোমার খুব দুঃখ তাই না মা। হসপিটালে তোমাকে বুঝি কেউ ভালোবাসে না!

    পরমা- এই তো এসেছি।

    ময়না- এই তো মা এসেছে। মা…মা

    পরমা- তোকে নিয়ে যাব আমি। আমারও তোকে ছেড়ে থাকতে ভালো লাগে না।

    ময়না- খুব ভালো হবে মা। তুমি কিছু খাবে?

    পরমা- এই খেলাম সোনা। তোকে সবাই খুব ভালোবাসে, তাই না ময়না?

    ময়না -হ্যাঁ মা, মামা মামাইয়া দিদিরা খুব ভালোবাসে আমাকে। কিন্তু তুমি নেই বলে আমার ভালো লাগে না। রাত্রি বেলা ছাড়া তুমি তো আসো না।

    পরমা- কাউকে বলবি না কিন্তু আমি রাত্রি বেলায় আসি।

    ময়না- না মা কাউকে বলি নি।

    পরমা- এবার ঘরে যা। ঘুমিয়ে পড় সোনা।

    ময়না- ঘুম আসে না মা।

    পরমা- আয় আমার কোলে আয়।

    (হাল্কা আলো জ্বলছে, পরমা ময়নাকে কোলে শুইয়ে গুনগুন করে গান গাইতে থাকে।)

    পঞ্চম দৃশ্য
    **********
    (তিন দিন পরের ঘটনা দৃশ্যায়িত হবে)

    দোয়েল- জানো মা, ময়না কেমন মনমরা হয়ে থাকে রাত্রি বেলায়। কিন্তু সকাল বিকেল কত হৈ হৈ করে আমাদের সাথে।

    অবন্তী- সে তো হবেই। রাতেই যে ওর মাকে চাই। এটুকু মেয়ে ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

    দোয়েল- পিসিমনি কবে বাড়ি ফিরবে মা?

    অবন্তী- ফিরবে খুব শিগগির। যাও ময়না কি করছে দেখো। বোনুকে একা রেখো না। বোনু যেন কোন কিছুতেই কষ্ট না পায় দেখো।

    (দোয়েল প্রস্থান করবে, শুভময় প্রবেশ করবে)

    শুভময়-গালে হাত দিয়ে কি ভাবছো?

    অবন্তী- দিদিভাইয়ের শেষ দেখাটা দেখতে পেলাম না। খুব খারাপ লাগছে।

    শুভময় –সে তো লাগবেই, তুমি যদি শ্মশানে যেতে তাহলে বাচ্চাদের কে দেখতো।

    অবন্তী- দিদিভাইয়ের ঘরটা খুলে দিও।পরিষ্কার করবো।

    শুভময়- বোনের ঘরে ঢোকার কোন দরকার নেই। ময়না শেষে বায়না ধরবে ঐ ঘরে ঢোকার।

    অবন্তী- তা কেন? ময়না বিকেলে খেলতে যায়, তখন করবো। তুমি ও সব নিয়ে ভেবো না।

    শুভময়- আমাদের ছোট্ট ভুলে ময়লা যেন কষ্ট না পায়। এখন ওসব পরিষ্কার টরিষ্কারের কোনো দরকার নেই ।

    (ময়না প্রবেশ করবে)

    ময়না- মামাইয়া আমি তোমার কাছে বসবো?

    অবন্তী- আয় (ময়নাকে আদর করে) কিছু বলবি?

    ময়না- (চুমু খেয়ে) তুমি খুব ভালো

    অবন্তী- ও এই কথা। কি খাবি দুপুরে বললি না তো

    (ময়না ছুটে পালাবে)

    অবন্তী- দেখো ময়নাকে আজ কতো হাসিখুশি দেখাচ্ছে। খুব ভালো লাগলো ওকে দেখে। তিন দিন পর মেয়েটা হাসলো।

    শুভময়- হ্যাঁ ওর যত্নের যেন কোনো ত্রুটি না হয়, সাবধানে রেখো, কিডন্যাপাররা কিন্তু সব জায়গায় হানা‌ দেয়, জানো আমার খুব ভয় হয়, ময়নাকে যদি কেউ তুলে নিয়ে যায়!

    অবন্তী- টিয়া,দোয়েল ময়না সব সময় একসঙ্গে থাকে, এ সব নিয়ে ‌ভেবো না।

    শুভময়- যদির কথা বলছি

    অবন্তী- যদির কথা তুমি বললে ঠিক, আমি বললে পাগল, ঠিক বললাম তো?
    শুভময়- হুম বুঝলাম, ম্যডাম, এবার বাজার যাই তাহলে।
    অবন্তী- যাও
    (শুভময় বাজারের ব্যাগ নিয়ে ‌প্রস্থান করবে)

    ষষ্ঠ দৃশ্য
    **********
    (সময় রাত এগারোটা- শুভময় ও অবন্তী শোওয়ার ঘরে প্রবেশ করবে)

    অবন্তী- তুমি একটু বসো। আমি বিছানাটা পরিষ্কার করে দিচ্ছি।

    শুভময়- হ্যাঁ, ঠিক আছে।
    ( স্বগতোক্তি: ময়না আজ এতো খুশি কিসের জন্য! কালও তো মন মরা হয়ে বসেছিল। আজ সব পাল্টে গেল। তিনদিন হলো ওর মা ওর কাছে নেই। না, না আজ নিয়ে চার দিন হল। খটকা লাগছে ভীষণ। ময়নাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করবো। না, না ওটা করা ঠিক হবে না। আমি বরঞ্চ আজ রাতে ঘুমাবো না। আর তা না হলে ময়নাকে আজ আমার কাছে শুতে বলবো)

    অবন্তী- (মশারি টাঙিয়ে ) কি গো, কি ভাবনা চিন্তা করছো। শুতে এসো। রাত হয়নি মনে হচ্ছে।

    শুভময়- যাচ্ছি যাচ্ছি। আমি ময়নাকে নিয়ে আসছি। ময়না আজ আমাদের সাথে শোবে

    অবন্তী- আমি কতবার বলেছি। এলো না। দেখ তুমি বলে, যদি আসে

    (শুভময় প্রস্থান করবে)

    (ময়না, টিয়া, দোয়েল বিছানায় শুয়ে থাকবে
    শুভময় প্রবেশ করে ওদের ঘরে)

    শুভময়- ময়না আমার কাছে শুবি সোনা। চল মামাইয়া ডাকছে তোকে।

    ময়না- (চোখ ডলতে ডলতে) আমি এখানে শোব। তুমি যাও মামা। আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছি।

    দোয়েল- গুড নাইট বাবা। তুমি যাও ঘুমিয়ে পড়ো।
    (শুভময় প্রস্থান করবে)

    সপ্তম দৃশ্য
    *********
    (রাত এক’টা: ময়না শোওয়ার ঘরে দরজা খুলে দোতলার সিঁড়ির চাতালে এসে বসবে, চারদিকে অন্ধকার)

    ময়না- মা আমি এসেছি(আস্তে আস্তে) তুমি কোথায়?

    পরমা- এই তো আমি।

    ময়না- তুমি সিঁড়ির ওখান দিয়ে আসো কেন মা? তুমি তো হসপিটালে আছো

    পরমা- কে বলেছে আমি হসপিটালে আছি?

    ময়না- মামাইয়া, মামা বলেছে।

    পরমা- আর নয় বেশি দিন। তোকে নিয়ে অনেক দুর চলে যাব। তোকে ছেড়ে থাকতে যে ভালো লাগে না।

    ময়না- তোমার কোলে শোবো মা।

    পরমা- আয় তোকে ঘুম পাড়িয়ে দি।

    (ময়না ঘুমিয়ে পড়বে ওর মায়ের কোলে।
    শুভময় সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে সবটা দেখবে)

    শুভময়- দরজা খুললি কিভাবে?

    পরমা- (চমকে উঠে) দাদা তোমার পায়ে পড়ি আমাকে ছেড়ে দাও। আমি ময়নাকে নিয়ে চলে যাব। কোনো দিন তোমার এখানে আসবো না। কেউ জানতে পারবে না আমি বেঁচে আছি।

    শুভময়- ঘরে চল। তোকে আবার তালা দিয়ে রাখবো। চল
    (শুভময় পরমাকে টানতে টানতে ওপরে নিয়ে যাবে।)

    শুভময়- ঘরে তো তালা দেওয়া। কি করে বের হলি? ও পেছনের দরজা দিয়ে। ঢোক ঘরের ভেতরে।

    (পরমাকে ঘরে ধাক্কা দিয়ে ঢোকাবে শুভময়।
    শুভময় পরমার গলা টিপবে)

    পরমা- দাদা লাগছে। ছাড়ো।

    শুভময়- ময়নাকেও শেষ করবো। পাঁচ বছরের জন্মদিনে ময়না থাকবে না পৃথিৱীত, কিছু দিন যেতে দে। ডিসুজাকে পিষে দিলাম কেউ টের পেলো না। তুই মৃত, সেটাও প্রমাণ হয়ে গেছে। তোর বডি ডিসুজার পাশেই কফন দেবো। সবাই তো জেনেছে তোকে দাহ করেছি। কিন্তু না, তুই আমাদের বাড়ির মান সম্মান নষ্ট করেছিস। তোর জন্য মা আত্মহত্যা করেছে। বাবা নিরুদ্দেশ, সব তোর জন্য। তুই সুখে থাকবি এটা আমি দেখতে পারবো না। তাই তোর বর ডিসুজাকে গাড়ি আ্যক্সিডেন্টে মরতে হলো। তোকেও তাই মরতে হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্য তোর সহায় ছিল, বেঁচে গেলি। তাই তোকে বাক্সতে করে এনে এই ঘরে রেখে দিয়েছিলাম। আজ আবার তোর ডেড বডি বাক্স করে নিয়ে তোকে পুঁতে দেবো।

    পরমা- গলা ছাড়ো দাদা। মা আত্মহত্যা করেছে তোমার জন্য। তুমি মেয়ে পাচারের লিডার ছিলে, মা সেটা জানতে পেরেছিল। বাবাকে তুমি খুন করে বাবার বডি লোপাট করে দিয়েছো। আমাকেও ছাড়নি। দুবাইয়ে আমাকে বেচতে গেছিলে। ডিসুজা আমাকে উদ্ধার করেছে। বৌদি যেদিন সব জানতে পারবে তোমাকে ঘেন্না করবে, তোমার মুখে থুতু দেবে বৌদি। ঠিক এমনি করে, আমি যেমন দিচ্ছি- থু থু

    শুভময়-তাই! আমাকে থুতু দিচ্ছিস। মর এবার।

    পরমা- দ ম বন্ধ হ য়ে আ স ছে ,গ লা ছা…

    (পরমা লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। শুভময় পরমার মৃতদেহ বাক্সতে রেখে দেবে। দৃশ্যান্তসূচক আবহসংগীত বাজবে)

    অষ্টম দৃশ্য
    ********
    (সকাল ছ’টা- শুভময় বাক্স নিয়ে বের হবে, টিয়া দোলনায় বসে দোল খাবে)

    টিয়া- বাবা কোথায় যাচ্ছ?

    শুভময়- আসছি সোনা।

    টিয়া- আমার জন্য চকলেট এনো কিন্তু

    (শুভময় প্রস্থান করে, সকাল সাতটা- অবন্তী ঘুম থেকে উঠে ঠাকুর নমস্কার করবে। শুভময়কে বিছানায় দেখতে পায় না)

    অবন্তী- শুভময় কোথায় গেল? বাজার তো আজ যাবে না। অফিসে বের হবে তো দশটায়। বাথরুমে বোধহয়। যাই চা করে আনি। রান্নার মাসি আর একটু পর চলে আসবে।

    (অবন্তী সকালের চা নিয়ে বারান্দায় বসবে। ময়না বারান্দায় পুতুল নিয়ে বসে থাকবে।)

    অবন্তী- ময়না, মামাকে ডাক তো চা খাবে।

    ময়না- মামা নেই, বাক্স নিয়ে বেরিয়ে গেল।

    অবন্তী- বাক্স! বাক্স কোথা থেকে এলো!

    ময়না- আমি জানি বাক্সতে কি আছে।

    পরমা- তুই জানিস কি আছে বাক্সতে, বল?

    ময়না- বলবো না, তুমি দেখতে চাইলে দেখাতে পারি।

    ময়না- ও মা এতো কথা শিখলি কখন! এখন দেখা, কি দেখাবি।

    ময়না- মামাইয়া চলো।

    অবন্তী- কোথায় যাব?

    ময়না- লর্ড-এর কাছে। চলো না।ঐ তো সামনেই চার্চ।

    অবন্তী- প্রভুর কাছে যাবি।

    ময়না- হ্যাঁ, চলো মামাইয়া। তুমি খুব ভালো। প্রে দা লর্ড

    অবন্তী- ও মা। কী সুইট সোনা মা। চল
    (অবন্তী ও ময়না প্রস্থান করবে)

    শেষ দৃশ্য
    *********
    (সকাল আটটা:- শুভময় চার্চে বাগানের মালির সঙ্গে কথা বলবে)

    শুভময়- বাক্সটা দিলাম। যেখানে পোঁতার পুঁতে দিবি। দু লাখ আছে। আর দুই কাজের শেষে পাবি। ফাদার যেন টের না পায়।

    মধু- একটাই তো?

    শুভময়- দুটো

    মধু- মানে।কথার খেলাপ করলেন কেন?

    শুভময়- বাচ্চাটা সব জেনে গেল। তাই

    মধু- আর একটু যোগ করে দেবেন।

    শুভময়- তাই দেবো। তিন দিয়ে দেবো।
    (ময়না ও অবন্তী চার্চের বাগানে প্রবেশ করবে)

    ময়না- মামাইয়া ওই বাক্সে আমি আর মা আছি।

    অবন্তী- কি বললি তুই তোর মা মানে! কোথায় গেলি ময়না, ময়না…

    অবন্তী- আমি ফাদারকে ডেকে আনি।
    (ফাদারকে নিয়ে অবন্তী বাগানে আসবে। শুভময় ফাদারকে দেখে পালাতে যাবে, চার্চের লোকজন মধু ও শুভময়কে ধরে ফেলবে)

    শুভময়- অবন্তী তুমি এখানে?

    অবন্তী- ময়না আমাকে নিয়ে এল এখানে।

    শুভময়- ময়না!
    অবন্তী- হ্যাঁ, ময়না। ফাদার বাক্সটা খুলতে বলুন।
    (ফাদারের ইশারায় চার্চের লোকজন বাক্স খুলবে)

    অবন্তী-(চিৎকার করে) এই তো ময়না, এই তো দিদিভাই। কি করে সম্ভব হলো, দিদিভাইয়ের মৃতদেহ তো দাহ করা হয়েছিল, ময়না তো আমার সঙ্গে এল, তবে কি!

    (পুলিশ ভ্যানের হর্ন বাজবে। পুলিশ অফিসার চার্চের বাগানে প্রবেশ করবে)

    পুলিশ অফিসার এস রায়- আমাদের টিম অনেক দিন ধরেই মেয়ে পাচারের লিডারকে খুঁজছে, তবে কাল মধ্য রাতে সিআইডি গৌতম নাগ পুরো‌ ব্যাপারটা সামনে আনেন, চার্চের বাগানের মালি মধু অনেকটাই সহয়তা করেছেন,গতকাল ‌রাত‌ তিনটের সময় শুভময় ‌ওরফে লাল্টু মধুকে ফোন করে। ফোন কল ট্যাপ করা হয়েছিল, তিন মাস ধরে‌ চার্চের ওপর নজর ছিল গৌতম নাগের।
    মধুকে সন্দেহ হয় ওনার, ঘনঘন আসেন‌ শুভময় মধুর সঙ্গে দেখা করতে। শুভময় ও মধুকে এ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে চলুন।

    অবন্তী- আমার ছোট মেয়ে ‌নেই, ভগবান তুমি এতো নিষ্ঠুর!

    ফাদার- আপনি বসুন মা,আমি আপনাকে বাড়ি দিয়ে আসবো।

    (পুলিশের ভ্যানে শুভময় উঠবে। অবন্তী থুতু ফেলবে শুভময়ের দিকে তাকিয়ে। অবন্তী সব শুনবে কিভাবে পরমা, ডিসুজা ও ময়নাকে খুন করেছে শুভময়)

    অবন্তী- ফাদার আমি বাড়ি যাব আমার ‌মেয়েরা একা আছে বাড়িতে।

    ফাদার- কয়টি কন্যা মা তোমার।
    অবন্তী- তিন কন্যা ফাদার। তিন কন্যার জননী আমি।

    ফাদার- তোমার তিন কন্যার জন্য অনেক আশীর্বাদ রইলো, ওরা অনেক বড় হবে, তোমার মুখ উজ্বল করবে।

    অবন্তী- (স্বগতোক্তি- আমি টিয়া, ময়না, দোয়েলের মা, ওদের কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না আমার কাছ থেকে। ময়না আমার অন্তরের আত্মা হয়ে আমার কাছে থাকবে।
    দৃশ্যান্তসূচক আবহসংগীত বাজবে।
    অবন্তী বাড়ি ফিরবে)

    টিয়া, দোয়েল ছুটে আসবে
    টিয়া দোয়েল-(মা’কে জড়িয়ে) মা তুমি কোথায় ছিলে, আমাদের ছেড়ে যাবে না তো মা?
    (ময়না বাড়ির মেইন দরজায় দাড়িয়ে থাকবে)
    অবন্তী-(দু’হাত বাড়িয়ে) আমার তিন কন্যার জন্য আমাকে বাঁচতে হবে, শত শত জনম ধরে বাঁচব, আমার প্রাণে তোদের বাস যে।
    (খাঁচা থেকে ‌ময়না, টিয়া, দোয়েল,কিচির মিচির শুরু কবে দেবে)

    ময়না- মা এসেছে খুব মজা
    অবন্তী- এই তো ময়না, ময়না আবার মা বলে ডাক।
    ময়না- মা, মা, মা..
    (অবন্তী মেয়েদের নিয়ে পাখিদের খাঁচার সামনে ‌যাবে)
    অবন্তী-(সবাইকে জড়িয়ে ধরে) আমি আছি তোদের সবার জন্য আমি আছি।
    (দৃশ্যান্তসূচক আবহসংগীত বাজবে
    মঞ্চের পর্দা ধীরে ধীরে পড়বে।)

  • গল্প

    গল্প- প্রেমলীলা কুঞ্জ

    প্রেমলীলা কুঞ্জ
    -রাখী চক্রবর্তী

     

     

    ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে পরিত্যক্ত ঘরের দরজাটা খুললো। না, না বাতাসে বা ভুতে খোলেনি, দরজাটা খুলল গোয়েন্দা পি লাল।পঙ্কজ লাল প্রসাদ।
    পাঁচ বছর হলো এই বাড়ির ত্রিসীমানায় কেউ ভুলেও আসেনি।
    কেন আসেনি তার পেছনে রহস্য রোমাঞ্চকর ঘটনা আছে ,বা গল্পও বলতে পারো।
    “প্রেমলীলা কুঞ্জ “
    বাড়ির ফলকে জ্বলজ্বল করে লেখা আছে। বাড়িটার দেওয়ালে হলুদ সবুজ রঙের মধ্যে
    বিস্তর ধুলো জমেছে। যা হলুদ ও সবুজ রঙকে ফ্যাকাসে করে দিয়েছে। যে কেউ এই ফ্যাকাসে রঙ দেখে বলে দিতে পারবে বাড়িটার আসল রঙ কি ছিল।
    সরকারি দপ্তর থেকে গোয়েন্দা পি লালের সহকারী হিসাবে আমার নাম রাখা হয়েছে ।ক্যামেরা ম্যান রঘুনাথ আর দুজন পুলিশ অফিসার প্রবাল দত্ত ও অর্নব দাস। ও হো আসল কথা তো বলাই হলো না আমার নাম বিশ্বরুপ দে।
    বেশ ভালোই চলছিল গোয়েন্দা ডিপার্টমেন্টে আমার কাজ। এর মধ্যে অর্ডার এলো, অগত্যা যেতেই হবে পুরীতে। পুরী আমার খুব প্রিয় তীর্থস্থান। সবসময় একটা ভালোলাগা কাজ করে আমার মধ্যে পুরী নামটা শুনলেই। মা বলে দিয়েছে কাজ শেষ হলে জগন্নাথ দেব দর্শন যেন করি।
    সাক্ষী গোপাল স্টেশনে নামলাম তখন ভোর,
    টাটা সুমো করে সরকারি হলি ডে রিসর্টে উঠলাম। মোট পাঁচ জনের টিম। যে যার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। দুপুর বারোটার সময় আমরা কাজের জন্য রওনা দিলাম। আকাশটা মেঘে ছেয়ে গেছে। পেঁজা তুলোর মতো মেঘ টুকরো টুকরো হয়ে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। কি অপরুপ দৃশ্য তা বলে বোঝানো যাবে না। পি লাল আমাকে বললেন, বিশ্ব রাতে কিন্তু ভুতুড়ে বাড়িতে থাকতে হতে পারে। আমি বললাম, ইয়েস স্যর।
    ক্যামেরা হাতে নিয়ে রঘুনাথ বললো, আমাকে কিন্তু একা ছেড়ে দিতে হবে। কিছু জবরদস্ত ফটো তুলবো। রাত দু’টো নাগাদ হলেই হবে। পুলিশ অফিসার প্রবাল দত্ত বললেন, আমরা তো পিকনিক করতে এসেছি। খুব মজা করবো পি লাল-এখনই মেজাজ বিগড়ে গেল অফিসার। ছেলে ছোকরারা যত মজা করবে তত দ্রুত কাজ এগোবে। বুঝলেন না।
    পুলিশ অফিসার অর্নব দাস- চুপ একদম চুপ কারা যেন আসছে এদিকে।
    প্রবাল দত্ত- হ্যাঁ এখখুনি রহস্য উদ্ঘাটন করে সন্ধ্যের মধ্যে রিসর্টে ফিরে যাব।
    পি লাল- শিসসস,থামের পেছনে লুকিয়ে পড়ুন সবাই। কুইক…

    আমি থামের পেছনে লুকোতে যাব সেই সময় আমার হাত ধরে কে যেন টানছে, আমি পেছন ফিরে তাকাতেই একটা বিদঘুটে চেহারার লোক আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বললো, শহুরে বাবু এখান থেকে চলে যান।জায়গাটা ভালো না।
    -কেন কি হয়েছে এখানে?
    -বাবু নারীর আত্মা লাফায় এই ভিলাতে
    -তাতে কি! আমরা ভয় পাই না এসবে।
    -চলে যান। আজ অমাবস্যা, সন্ধ্যা হতে চললো।
    -ঠিক আছে, যাব না। কিন্তু আপনি কে? আমাকে সাবধান করছেন কেন। ঐ দিকে থামের পেছনে আরও চারজন আছে। ওদের একটু সাবধান করে দিয়ে আসুন। কোথায় গেলেন? হ্যালো, এই তো এখানে ছিলেন।
    পাগল সব।
    আমি থামের পেছন থেকে বেরিয়ে পি লালের কাছে গেলাম। পি লাল তখন গোঙাচ্ছিল।
    আমি কিছু বলার আগেই প্রবাল দত্ত বললেন, বিশ্ব আর নয় এখুনি রওনা দেবো।স্যরকে বাঁচাতে হলে এখানে থাকা ঠিক হবে না।
    আমি বললাম “প্রেমলীলা কুঞ্জে”র কী হবে।স্যারের এই অবস্থা হল কি করে? এখনও সন্ধ্যা হল না।
    প্রবাল দত্ত- আমি থামের আড়াল থেকে দেখলাম ঘোমটা দেওয়া এক মহিলা পি লালের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হওয়ার চেষ্টা করছে।স্যরের একটু আদটু মেয়েদের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করার অভ্যাস আছে, সেটা আমি জানতাম। কিন্তু স্যর ঘোমটা দেওয়া মহিলার কোমর জাপটে ধরতেই মহিলা আঁচড় দিতে লাগলো গলায় হাতে। তখনই গোঙানি শব্দ শুরু করলেন পি লাল। তাই বলছি এখানে আর নয়। আমি অন্য একটা রিপোর্ট দিয়ে দেব।

    আমি- আমাকেও একজন শাসিয়ে দিয়ে গেল।
    অর্নব দাস- কে আবার শাসালো ?
    আমি- একটা ভয়ঙ্কর চেহারার লোক।
    প্রবাল দত্ত- কি বলল লোকটা?
    আমি- লোকটা বললো শহুরে বাবু চলে যান। অমাবস্যা আজ। নারীর আত্মা লাফায়। চলে যান বাবু। থামের পেছনে চারজন আছে সেটা কিন্তু বলেনি।
    আমাদের কথাবার্তার মধ্যে পি লালের জ্ঞান ফিরে এলো।
    পি লাল চোখ খুলে বললেন, মেয়েটার শরীরে শুধু হাড় তাও আবার খুব ঠান্ডা।
    আমি- আপনি মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলেন কেন?
    পি লাল- লোভ হলো আর কি করবো?
    প্রবাল দত্ত- সবই চরিত্রের দোষ। আপনার এখানে কোন দোষ দেখি না।
    পি লাল- বছরে একবার গ্রামে যাই। নিজের বিয়ে করা বৌকে নিয়ে একটু আদটু প্রেম করবো তার ব্যাবস্থা নেই ওখানে। অলটাইম নজরদারি।
    আমি- কার নজরদারি স্যর?
    পি লাল-শাশুড়ির আবার কার। জামাইয়ের পয়সায় খাচ্ছে আবার জামাইকেই বাঁশ দিচ্ছে।
    অর্নব দাস- স্যর, সন্ধ্যা হতেই চললো। একটু বিশ্রাম নিন। তারপর ভেতরে যাব, এসেছি যখন নিজের চোখে ভুতুড়ে রহস্য “প্রেম লীলা কুঞ্জ”কে দেখে যাই।
    প্রবাল দত্ত- না,এখনই ফিরে যাই, পি লাল স্যরের শরীর ভালো না, আমি রিপোর্ট তৈরি করে দেব।

    আমি দাঁড়িয়ে সব শুনছি। আমার মনে হচ্ছে প্রবাল দত্ত সাহসী না, নেহাতই বাপের চাকরিটা পেয়েছে তাই, যোগ্যতাসম্পন্ন পুলিশ অফিসার কখনই ওনাকে বলা চলে না, শুধু বলছে রিপোর্ট তৈরি করে দেব। আরে তোর বাপের সম্পত্তি না কি। কিছু দেখলো না জানলো না রিপোর্ট তৈরি করে দেবো…আমি খুব সাহসী, সিদ্ধান্ত শুধু প্রবাল দত্ত নেবে নাকি!

    পি লাল- বিশ্ব এতো কী চিন্তা করছো। আমি অসুস্থ তুমি কিছু ‌বলছো না।
    আমি চোখে মুখে হাত ভুলিয়ে বললাম, এবার ভেতরে চলুন স্যার। রঘুনাথ ক্যামেরা রেডি তো?
    রঘুনাথ- জামার বোতামে সেট করে নিয়েছি।আর একটা ব্যাগে রেখেছি।
    সন্ধ্যা ছটা বাজলো, একটু পরে ভেতরে যাই। রাত বারোটা একটা বাজলে অশরীরী আত্মাকে ধরতে পারবো, এখন তো আত্মাদের চেলারা ঘুরঘুর করবে।
    অর্নব স্যার, আপনি এতো চুপচাপ কেন, কিছু বলুন। আপনিও কি প্রবাল স্যরের মতো ভীতু না কি?

    প্রবাল- রঘুনাথ আমাকে চটালে কাজটা হারাবে মনে রেখো।
    অর্নব দাস- সবাই চুপ, চা পান করবো এখন আমরা, সুরা তো নেই।

    “কে বলল সুরা নেই” পেছন ফিরে দেখি সেই লোকটা যে আমাকে সাবধান করেছিল
    আমি চিৎকার করে বললাম, এই লোকটাই আমাকে সাবধান করে দিয়েছিল। ইনি আবার সুরা পান‌ করার কথা বলছে। আ্যই আপনি কে ? কী মতলব আছে আপনার বলুন? আমরা ভেতরে যাব।
    রঘুনাথ- বিশ্ব কেউ নেই এখানে, খামকা‌ ভুল বকিস না। কোনও লোক নেই এখানে।
    আমি চারদিক তাকালাম সত্যি তো আমরা পাঁচজন ছাড়া আর কেউ নেই এখানে, চারদিক অন্ধকার আচ্ছন্ন হয়ে আসছে।প্রবাল দত্ত ফ্লাক্স থেকে চা ঢালছে তার শব্দ কানে ভাসছে, কী ভয়ঙ্কর পরিবেশ, আমি প্রেমলীলা কুঞ্জের বারান্দায় বসে আছি
    চা বিস্কুট খেয়ে আমরা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে যাব ঠিক সেই সময় ঘুঙুর পড়ে কে যেন আমাদের সাথে সাথেই ওপরে উঠছে,আমরা সবাই পেছন ফিরে তাকালাম কিন্তু ‌কাউকে দেখতে পেলাম না,
    এরমধ্যে আমার পা কেউ শক্ত করে ধরে রেখেছে ওপরে উঠতে দিচ্ছে না, খুব কষ্ট করে আমি পা-টা একধাপ করে করে সিঁড়িতে রাখলাম, আমরা ওপরের একটা ঘরে ছিটকানি খোলা দেখে ঐ ঘরে প্রবেশ করলাম, ঘরটা খুলতেই গোটা দশ বাদুড় উড়ে চলে গেল।
    আবছা মতো দেখলাম খাটে কেউ একজন বসে আছে।
    প্রবাল দত্ত- ঘোমটা দেওয়া রমণী বসে আছে।
    পি লাল- মজা করা বন্ধ হোক। ঘুঙুরের শব্দ বেশ কম হতে লাগলো। আমি টর্চ জ্বালিয়ে ঘরটা দেখতে লাগলাম, ঘরের এক দিকে ইজি চেয়ার আছে, হঠাৎই ইজি চেয়ার দুলতে শুরু করলো, তিনটে টর্চ জ্বালাতেই ইজি চেয়ার থেমে গেল, টর্চের জোরালো আলোতে ঘরটা স্পষ্ট ‌দেখা যাচ্ছে এখন।
    খাটের কাছে গেলাম ‌বেল ফুলের গন্ধতে মো মো করছে। অর্নব স্যর ঘরের বাইরে পাহারা দিচ্ছেন। পি লাল আলমারি খুলতেই একটা‌ ব্যাগ ঝপ করে পড়ে গেল। আমি ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে রাখলাম,
    প্রবাল দত্ত ঘরের জানলা খোলার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে শীতল হাওয়া বয়ে গেল আমাদের সবার ওপর দিয়ে, রঘুনাথের ক্যমেরাতে কি ছবি উঠছে কে জানে, আমার চোখ গেল দেওয়ালে বাঁধানো ছবির দিকে।ছবিটা দেখেই আমি আঁৎকে উঠলাম, সেই লোকটা তো যে আমাকে সাবধান করে ছিল, গলায় মালাটা শুকিয়ে পাকিয়ে জালন‌ হয়ে গেছে। হঠাৎ দেখলাম ঘরটাতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আমরা ছুট লাগালাম।তারপর ঐ ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরে প্রবেশ করলাম, আমার পা খুব চুলকাচ্ছে, নিচে তাকিয়ে দেখি শ’য়ে শ’য়ে লাল পিঁপড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে, আমি পা চুলকাতে শুরু করলাম, হাঁটু পর্যন্ত পিঁপড়ে উঠে গেছে, আমি লাফাতে লাগলাম, আমার কাঁধ থেকে ব্যাগটা পড়ে গেল, আমি ব্যাগটা তুলেতে যাব তখন দেখি পিঁপড়ে আর নেই, যেন‌ পিঁপড়ে ছিল না।
    প্রবাল দত্ত- এই ব্যাগটা নেওয়ার দরকার নেই
    আমি- এই ব্যাগেই আছে আসল রহস্য, আমি মরতে মরতে হলেও দেখবো ব্যাগে কি আছে।
    পি লাল- ব্যাগটা আমি খুলবো, কেউ হাত দেবে না।
    এর মধ্যে “প্রেমলীলা কুঞ্জ” ভীষণরকম দুলছে ভুমিকম্পের মতো। আমরা একে অপরকে শক্ত করে ধরে রেখেছি।
    অর্নব দাস- এটা ভুতুড়ে বাড়ি, হানা বাড়ি, আমি আগেই বলেছি, এখানে স্মাগলিং হয় না বা মধুচক্রের ব্যবসা হয় না,অনুভব করুন ঘুঙুরের শব্দ, লাল পিঁপড়ে।ব্যাগ, মহিলা, ভুমিকম্প..

    প্রবাল দত্ত- রাত নটা বাজে, তেমন কিছুই তো পেলাম না
    রঘুনাথ- রাত বারোটার পর পাবেন, ধৈর্য্য ধরুন।
    আমরা সবাই ঐ ঘরে প্রবেশ করলাম।
    সুসজ্জিত ঘর। টেবিল চেয়ার দামী আসবাবপত্রে ভর্তি ঘরটা, হঠাৎ
    আমার চোখ গেল জানলার দিকে
    আমি চিৎকার করে বললাম, ঐ দেখুন
    সবাই জানলার দিকে তাকিয়ে আছে।
    রঘুনাথ জানলার রড ধরে দুলছে, যা অসম্ভব, রঘুনাথের অট্টহাসিতে ভরে গেছে ঐ ঘরটা। আমি দৌড়ে গিয়ে রঘুনাথকে ধরলাম,রঘুনাথ মাটিতে‌ পড়ে গেল, ওর পরনে জামা কাপড় কিছু নেই, সব মেঝেতে পড়ে আছে।
    পি লাল ব্যাগটা যতবার খূলতে যাচ্ছে পি লালের শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
    আমি ব্যাগটা কেড়ে নিলাম পি লালের কাছ থেকে, এক নিঃশ্বাসে ব্যাগটা খোলার চেষ্টা করলাম, এবং সফলও হলাম।
    অলঙ্কার সহ একটা চিঠি ব্যাগের মধ্যে রয়েছে। আমার হাত অবশ হয়ে আসছে শরীর ঝিমিয়ে পড়ছে। আমার প্যান্ট ছিঁড়ে যাচ্ছে আমি বুঝতে পারছি, আমার চোখ দুটো কেউ যেন খাবলাচ্ছে। আমি কোনো কিছু না ভেবে পকেট থেকে জগন্নাথ বাবার প্রসাদ হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলাম। আমার জামা প্যান্ট ছিঁড়ে গেল। আমি জগন্নাথ দেবের প্রসাদ ‌মুখে দিয়ে ‌বললাম‌, ভক্তি করে খেলাম বাবা তোমার প্রসাদ।
    জগন্নাথ দেবের প্রসাদ মুখে দিয়ে আমি ‌চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম।
    আমি সুচরিতা, গৃহবধূ, বেশ্যা নই, বাঈজী নই। আমার স্বামীকে পিটিয়ে মেরে ফেললো ওরা, আমার শরীর নিয়ে খেললো, তারপর আমার সারা শরীরে কেরোসিন তেল ঢেলে দিয়ে বললো, বেশ্যাদের বাঁচতে নেই, আমি ‌দাউ দাউ করে জ্বলছি , আর লিখছি, এই চিঠি, এই ব্যাগ আমার আর আমার স্বামীর আত্মার শেষ ঠিকানা, যতদিন এই ব্যাগ থাকবে ঐ বদমাশ পুলিশের দল সুশীল দে, রবি রায়, প্রমোটর মলয় পাল মধুচক্রের আসর বসাতে পারবে না, “প্রেম লীলা কুঞ্জ’তে আমাদের আত্মা থাকবে, কেউ বসবাস করতে পারবে না, এখানে যে আসবে সে‌ মরবে, কোনো ব্যবসা হবে না এখানে

    প্রবাল দত্ত- দোষীদের শাস্তি হবে, সূচরিতা ‌ন্যায় পাবে।
    আমি ব্যাগটাতে আগুন ধরিয়ে দিলাম, দাউ দাউ করে জ্বলছে ব্যাগটা,”প্রেমলীলা কুঞ্জ” ভীষণ কাঁপছে, রঘুনাথের জ্ঞান ফিরছে।
    অর্নব দাস-এই ঘটনার কথা শুনেছিলাম,
    সত্যতা যাচাই করি নি, তবে কেউ ছাড়া পাবে না, সবাই শাস্তি পাবে, যদিও সুচরিতা ও তার স্বামীর ডেডবডি পাওয়া যায় নি, ওরাই হয়তো বডি সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু চিঠিটা তো ‌পুড়ে গেল প্রমাণ তো রইলো না।
    পি লাল- ইস্,আমাদের মুখের কথা ‌বিশ্বাস করবে না কেউ।
    আমি রঘুনাথের কাছে বসে আছি। রাত তিনটে বাজে,ভোর হওয়ার অপেক্ষায় আছি।রঘুনাথকে জামা প্যান্ট কোমর থেকে জড়িয়ে দিলাম,আমি ছেঁড়া প্যান্ট পড়েই ছিলাম, রঘুনাথের ক্যামেরাটা বারান্দায় পড়ে ছিল, আমি ক্যামেরাটা রঘুনাথকে দিলাম,
    কিছুক্ষণ পর রঘুনাথ চিৎকার করে বললো, সব ছবি, ভিডিও আছে এই ক্যামেরায়, তখন ভোরের আলোর রশ্মিছটা বারান্দায় এসে   পড়েছে। পি লাল, প্রবাল দত্ত, অর্নব বাবু আমি পা ছড়িয়ে বসে আছি।
    রঘুনাথ ভিডিও ছবি দেখাচ্ছে,
    আমি সুচরিতা, গৃহবধূ, বেশ্যা নই পুরোটা উঠেছে ভিডিওতে, এমন কি সুচরিতা ‌আগুনে পুড়ছে সেটাও।
    আমরা দিনের আলোতে সব ঘরগুলো সার্চ করে দেখছি,যদি ওদের ডেডবডি মানে কঙ্কালও পাওয়া যায়।
    দোতলার ঘরে খাটের ওপরে একটা পুড়ে যাওয়া শরীরের দলা দেখতে পেলাম, ঐ ঘরটা পুলিশ সীল করে দিয়েছিল, আবার খোঁজা শুরু করলাম, আলমারির নিচে একটা কঙ্কাল পেলাম, এটা সুচরিতার স্বামীর মনে হয়।
    এতদিন কেউ ঢুকতে পারেনি প্রেমলীলা কুঞ্জতে,তাই ডেডবডিও উদ্ধার হয় নি, সুচরিতা ও তার স্বামীর ফটো অ্যালবাম নিয়ে নিলাম, ভিডিও তো আছেই।
    প্রেম লীলা কুঞ্জ ছেড়ে আসতে মন চাইছিল না, সুচরিতা ও তার স্বামীর মুখটা ভেসে উঠছে বারবার, স্বচক্ষে দেখেছি যে সুচরিতার স্বামীকে।
    আমরা রওনা দিলাম প্রেমলীলা কুঞ্জ থেকে তখন সকাল ‌নটা। আকাশ বেশ পরিষ্কার,
    গাড়িতে উঠে একবার শেষ বারের মতো তাকালাম “প্রেম লীলা কুঞ্জ” র দিকে, মনে হলো সুচরিতা ও তাঁর স্বামী ছাদে দাঁড়িয়ে হাত নাড়িয়ে আমাদের গুড বাই বলছে বা বিদায় জানাচ্ছে।
    আমাদের টাটা সুমো ‌চলতে শুরু করলো, প্রেমলীলা কুঞ্জকে পেছনে ফেলে আমরা এগোতে থাকলাম।

  • রম্য রচনা,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    রম্য- “বাংলা ভাষার হালচাল”

    ।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

     

    “বাংলা ভাষার হালচাল”
    -রাখী চক্রবর্তী

     

     

    মা জী দুধ লিজিয়ে,,

    –সুবহ্ সুবহ্ মা জী দুধ লিজিয়ে, ঘুমের বারোটা বাজাইয়ে।রূকো যাই,
    কি মনে করকে আজ জলদি জলদি আয়া,
    —কা হা জলদি মা জী,
    –চুপ রহো,কালসে দশ বাজে আনা।ঘুম পুরা নেহি হোতা তো গা‌ ম্যাজ ম্যাজ করতা হ্যায়
    –জী মা জী ।জো আপ বোলেঙ্গে
    ঘর থেকে লালমোহন বাবু বললেন, ভুতাই তুই রোজ এই সময়েই দুধ দিয়ে যাবি।দশটার সময় এলে আমি চা খাবো কি করে,অফিস যেতে হবে না‌ আমাকে।
    সীমা দেবী চিৎকার করে বললেন,
    ম্যায় যো বলুঙ্গা ওহি হোগা
    ভুতাই দশ বাজে আনা
    ভুতাই গোয়ালা জানে এখন কি কি হবে,হাঁ মা জী ঠিিক হ্যায়
    বলেই ভুতাই দে ছুট
    লালমোহন বাবুর স্ত্রী সীমা দেবীর হিন্দিতে কথা বলা শুরু হয় ভুতাই আসার সময় থেকেই।তারপর সেটা চলে বাজারে ,কাজের মেয়ের সাথে,পাড়া প্রতিবেশি ‌।লালমোহন বাবু কিছু বলতে গেলেই বাসন পড়ার ঝনঝন শব্দে কাঁপতে থাকে গোটা পাড়া।
    সীমা দেবী সকাল ন’টার সময় বাজারে যান, কর্তা অফিস চলে যায় তারপর।বাজারে গিয়ে উনি হিন্দিতে কথা বলেন।ওনার ধারণা হিন্দিতে কথা বললেই মান সম্মান বাড়ে।বাংলা ভাষার কোন দাম নেই ।মাথা নত করতে হয় না হিন্দি ইংরেজি ভাষাতে কথা বললে।এবার জেনে নি উনি আসলে কি ভাষায় কথা বলেন
    দোকানদার–আমার থেকে আলু ‌নিয়ে যান‌ ও দিদি, ও বৌদি,নিয়ে যান,,

    –আলু কত করে দেতা হ্যায় ?

    –পঁচিশ টাকা কিলো।কত দেব?

    –টুয়েন্টি ফাইব ! ও ঠিক হ্যায়
    দো কিলো দো।পটল কত করে দেতা হ্যায় ?ও ভী দো কিলো দো।
    তারপর মাছের বাজারে গিয়ে সীমা দেবী বলেন,
    আরে ভাই এ ফিস মরা হ্যায় তো।জিন্দা ফিস দো,লাফালাফি করতা‌ হ্যায় ও ফিস চাই

    —ইলিশ মাছ লাফালাফি করে না মা জননী,কৈ মাছ নিন খুব নড়েচড়ে,লাফালাফি করে

    –কৈ কত করকে দেতা হ্যায়?

    –হাজার টাকা কেজি

    –ঠিক হ্যায় দো‌ঠো ওজন করো

    বাজারের থলি নিয়ে বাড়ি ফিরে সীমা দেবী বারান্দায় বসে ভাবেন হিন্দি ইংরেজীতে কথা বলে বাজার মাত করে দিয়েছি।
    সন্ধ্যা বেলায় কর্তা বাড়ি ফিরলে আবার চলে হিন্দিতে কথাবার্তা ।এর একটা কারণ আছে লালমোহন বাবু সস্ত্রীক উত্তর ভারত যাবেন ঘুরতে ।ছেলে কলকাতায় থাকে ।ফোন করে মাকে বলে দিয়েছে হিন্দিটা ইংরেজিটা একটু চালু রেখো মা,
    কাজ দেবে।
    ব্যস ,আর থামেন নি উনি হিন্দি, ইংরেজি ,বাংলা ভাষার দফারফা করে ছেড়েছেন ।
    সীমা দেবী কলকাতার বাইরে বেড়াতে গেলে সবাইকে বলেন, বিদেশ যাতা হ্যায় হামলোগ ।
    লালমোহন বাবু মহা ঝামেলায় পড়েছেন।না হিন্দি না বাংলা আবার ইংরেজি ভাষাও আছে।
    –কত বার বলবো।উত্তর ভারত বিদেশ না। ,ভারত নাম শোননি ?

    –তোমার বেশি বেশি ।না হয় একটু বিদেশ বললাম।
    –ঠিক আছে যা বলার বলো ।উত্তর ভারতে গিয়ে আবার ভাষার প্রদর্শন করো না যেন।

    —বলবো ,হিন্দি ইংরেজি ভাষায় কথা বলবো,বাংলা ভাষায় আছে টা কি,
    –ঠিক আছে জগা খিচুড়ি ভাষায় কথা বলবে না,পুরো কথা ‌হিন্দি ও ইংরেজিতে বলবে তবেই বুঝবো দম আছে তোমার, বাংলা ভাষাকে অপমান ! কিছুতেই আমি সহ্য করবো না,এই আমি   বলে রেখে দিলাম
    –ঠিক আছে ঠিক আছে, রেস্টুরেন্টে গিয়ে এগরোল দিন বলো কেন? ময়দায় ডিম প্যাচানো খাবার দিন ,বলতে পারো তো,শুধু আমার বেলায় দোষ,সেদিনকে ফোনে কাকে যেন বললে‌,রবিবার হলি ডে মর্টন না‌ হলে ‌জমে না,আমি কতবার তোমার ‌কথা শুনে ‌হেসেছি বলো ?
    –সেটা অন্য ব্যাপার,ভুল তো কিছু বলছি না
    যাইহোক তিন চার দিন পর লালমোহন বাবু সস্ত্রীক উত্তর ভারত ঘুরতে গেলেন,দিল্লিতে লালমোহন বাবুর দিদি থাকেন ,ওখানে থেকেই সব জায়গায় ঘুরবেন।দিল্লিতে পৌছে
    ট্রেন থেকে ‌নেমে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন ওনারা,
    একটা টাটা সুমো আসতে দেখে সীমা দেবী চিৎকার করে উঠলেন
    গাড়ি স্টপ গাড়ি স্টপ ,
    — গাড়ি থামবে না।তুমি চিল্লে মরো
    –কেন থামবে না।আমি কি বাংলা ভাষায় কথা বলছি ?হিন্দি ,ইংরেজি তুমি একাই পারো ?
    রণ বাববার বলে দিয়েছে ,মা বাইরে যাচ্ছো হিন্দিতেই কথা বলবে,ছেলেকে তো আর ইনসালট করতে‌ পারিনা
    –একদমই না,। ঐ দেখো গাড়ি চলে এসেছে
    চলো ,গাড়িতে উঠে‌ বসো
    সুমোতে ‌বসলেন সীমা দেবী,বাব্বা বহুত গরমি,
    আজি শুনতে হো ড্রাইভার,হ্যালো
    জানলা কা কাঁচ নিচে নামা দো,নিশ্বাস নিতে কসট্ হোতা হ্যায়

    –“আজি শুনতে ‌হো”,এটা‌ পতিদেবকে সম্মোধন করে‌ বলতে হয়,বুঝলে
    ওই দেখো ড্রাইভার ছেলেটা তোমার কথা শুনে হাসছে
    –ভুল তো বলি নি।
    –না না ভুল কিসের ,বাংলা হিন্দি ইংরেজি ভাষার মিলন করে ছাড়ছো।ফুলশয্যার রাতে যেমন আমাদের মিলন হয়েছিল।মনে আছে কি বলেছিলে ? হা হা ,
    আমি গোলাপ ফুল বলতে তোমার কি হাসি
    –গোয়ালার সাথে রোজ হিন্দিতে কে কথা বলে তুমি না আমি।ও তো বাংলা বোঝেই না।
    হিন্দি আমার রক্তে আছে ।
    মুখ দিয়ে তো এক অক্ষর হিন্দি শব্দ বের হয় না।
    –আমার পূর্ব পুরুষদের একটা ঐতিহ্য আছে ,
    বাংলা ভাষাই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ ভাষা ।অহেতুক হিন্দি বলি না।যেখানে প্রয়োজন আছে সেখানে বলতেই হবে,বিমলদা’র ছেলে বিদেশ থেকে ফিরে আমাদের বাড়ি তে আসে তোমার সাথে কি‌ সুন্দর বাংলাতে কথা বলে তোমাকে প্রণাম করে,আর তুমি বলো জি তে রহো বেটা,আরে মন খুলে আশীর্বাদ করতে হয়,তুমি এমন ভান করো যেন বাংলা বলতেই পারো না,
    ওনাদের কথোপকথনের মধ্যে
    ড্রাইভারের ফোনে রিংটোন বাজবে
    “তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে” গানটা শুনে‌ লালমোহন বাবু বলেন,
    তোমার নাম কি ভাই?
    –আমি উদিত প্রসাদ
    –শোন ভালো করে উদিত ওর ফোনের রিংটোনে কি সুন্দর গান রেখেছে ।আর তুমি ফোন চালাতেই পারো না।আবার রিংটোন রেখেছো বেবি কো বেস পসন্দ হ্যায় ।
    –মুহু বনদ্ করো,প্রেসটিজ হ্যায় মেরা
    —সে তো‌ ভালোই জানি,বাংলাতে কথা বলো,লোকে সন্মান করবে।কখনও শুনেছো কোনও ইংরেজকে কথা বলার সময় মাঝে মাঝে কোন বাংলায় কিছু বলতে ।হিন্দি ভাষী যারা তারাও কিন্তু তাদের ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষাকে আনে না।কিন্তু আমরা বাঙালি হয়ে বাংলা ভাষার অপমান করছি।বাংলার মধ্যে হিন্দি ইংরেজি ভাষাকে টেনে আনছি।কেন ? এ প্রশ্ন শুধু আমার না।

    –স্টপ ।অনেক হয়েছে ,রোজ সকালে কে বলে গুড মর্নিং ।এক কাপ চা দাও ।পেয়ালা কি তুমি বলো ?আসলে কথা বলার সময় আমাদের খেয়াল থাকে না তাই বাংলা হিন্দি ইংরেজি ভাষা মিলিয়ে মিশিয়ে কথা বলি।তার মানে এটা না যে বাংলা ভাষাকে অপমান করছি
    –সব মানলাম ।কিন্তু তুমি জগাখিচুড়ি ভাষায় কথা বলবে না।
    বাংলাতে কথা বললে হিন্দি বলবে না।করেগা ,খায়েগা ,দেগা অসহ্য লাগে ।
    মনে রেখো ,”বাংলা ভাষা গর্বের ভাষা ,নয়তো অবহেলার।
    এই ভাষাতেই “ভারত ছাড়ো” হুঙ্কারে বৃটিশরা হয়ে ছিল জেরবার “

    –দাদা আপনারা এখানেই নামবেন তো?।আপনার কথা শুনে খুব ভালো লাগলো দাদা।বাংলা ভাষা গর্বের ভাষা নয়তো অবহেলার।যথার্থ বলেছেন দাদা।
    –থ্যাঙ্ক ইউ ভাই
    লালমোহন বাবুর ইংরেজি মেশানো বাংলা কথা শুনে
    সীমা দেবীর চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে । চোখ দিয়ে মা চন্ডীর রুদ্র রুপ বেরিয়ে পড়েছে ।
    লালমোহন বাবু মনে মনে ভাবছেন সব জ্ঞান মাটিতে মারা গেল।ধ্যাত তেরি,,কি দরকার ছিল থ্যাঙ্ক ইউ বলার ।অশেষ ধন্যবাদ ভাই বললে কি হতো।ঠিকই তো কথা বলার সময় খেয়ালই থাকে না কি বলছি।নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে লালমোহন বাবু হেসে বললেন,
    তুমি ঠিক বলেছো গো, কথা বলার সময় অনেকেরই খেয়াল থাকে না
    উদিত গাড়িটা থামিয়ে বলল, বৌদি খুব সুন্দর কথা বলেন ।বৌদির কথা শুনে একটু হাসলাম।এটাই বা কম কিসের । মানুষের দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দেয় কিছু কিছু কথা।সে বাংলা ভাষায় হোক বা জগাখিচুড়ি ভাষায় ।আমি তো খুব হাসলাম,আপনাদের মনে রাখতেই হবে, দাদা
    আমি আপনাদের ব্যাগগুলো নামিয়ে দিচ্ছি
    সীমা দেবী বললেন, অল রাইট।ঠিক আছে
    লালমোহন বাবু হেসে বললেন ,এই তো আগে ইংরেজি বলে তারপর না হয় বাংলায় বলে দিও।কোনও সমস্যা নেই।
    –লেটস গো।চলো

    লালমোহন বাবু স্ত্রীর হাত ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে ওনার কানে কানে বললেন ,আমি তোমাকে ভালবাসি,আই লাভ ইউ।
    সীমা দেবী মুচকি হেসে বললেন আই লাভ ইউ টু,তিন চার পাঁচ ছয় সাত,,,,

    উদিত হাসতে হাসতে গাড়ি চালাতে শুরু করলো, সূর্যটাও অস্ত যাওয়ার আগে শেষ হাসিটা হাসলো।

  • রম্য রচনা,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    রম্য- “ঘুম ঘুম চাঁদ”

    অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার”

    “ঘুম ঘুম চাঁদ”
    -রাখী চক্রবর্তী

    “দিনের শেষে ঘুমের দেশে”
    ক্লান্ত শরীর বিছানায় বসলেই চোখ জুড়ে ঘুম চলে আসে,কিন্তু পরিপাটি করে শোওয়ার‌ ব্যবস্থা করলেই ‌ঘুম উধাও হয়ে যায়।
    সারাদিনের কাজ,ব্যর্থতা, হাসি মজা সব মগজের এক প্রান্তে রেখে ঘুমকে প্রেমিক প্রেমিকার মতো জড়িয়ে ধরে ভালবাসতে হয় তবেই নিশ্চিন্তের ঘুম ঘুমানো যায়।
    ফুটপাথে যার শুয়ে থাকে তারা চাঁদকে দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে,চিন্তা ভাবনা নেই,হারিয়ে যাওয়ারও কিছু নেই ওদের,দুনিয়ার ‌সবচেয়ে সুখী ওরা, আমরা তাই ভাবি।
    ঘুম যে অনেক প্রকারের হয় সেটা ওরা জানলেও মাথা‌ঘামায় না ।
    যেমন ভাতঘুম, রুটি ঘুম, বিরিয়ানি ঘুম।
    কতো রকমের যে ঘুম হয়।আবার চোর ,ডাকাত ,প্রেমিক প্রেমিকা
    এনাদের ঘুম একটু অন্য রকমের।
    গেরস্থদের দুপুর বেলার ভাত ঘুম অনেকটা এই রকম গৃহকর্তা গৃহকর্ত্রী মুখে এক খিলি পান গুজে বিছানায় এলিয়ে পড়েন।তারপর ভাত ঘুম ।ঘুম থেকে ওঠার পর চোখ মুখ একটু ফোলা ফোলা লাগে ।বেশ লাগে দেখতে
    ,মানে ঐ বাড়ির কর্তা‌ গিন্নি এনাদের কথা বলছি আর কি।

    ছেলে ,বৌমা ,মেয়ে অফিসে টিফিন টাইমে চেয়ারে হেলান দিয়ে একটু রুটি ঘুম দিয়ে দেন।মানে দুটো কি তিনটে রুটির খাওয়ার জন্য ঘুম বরাদ্দ দশ মিনিট । অবশ্য অফিসের বসদের দিনে ঘুমানো বারণ আছে,টানটান উত্তেজনা ওনাদের মধ্যে কাজ করে কি দিন কি রাত,
    এরপর এক বিশেষ মুহুর্ত আসে বড়লোক বা মধ্য বিত্ত চাকুরিজীবি দের ছুটির দিনে ,মর্টন বা চিকেন বিরিয়ানি খেয়ে বিরিয়ানি ঘুম চলবে টানা চার ঘণ্টা ।
    চিন্তা ভাবনার কোন বালাই থাকে না এই ঘুমে ।ফলে স্বপ্নরাও আসে না ।লালপরী নীলপরীরা রাতের ঘুমে আসে ।দিন ওদের পছন্দ না।
    যে ছেলেটা বা মেয়েটা
    সারাদিন কাজের পর রাতের বেলায় খাতা পেন নিয়ে লিখতে বসে ছাদে বা বেড়ার ছাওনির এক চিলতে ঘরে মনে মনে কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখে ,
    ঘুম ঘুম চাঁদ তাদের কাছে খুব রোমান্টিক ।পেটে ক্ষুধার জ্বালা থাকে পরিবারের ভার থাকে সারা শরীর জুড়ে ।কিন্তু চোখে ঘুম নেই ।চাঁদকে নিয়ে কবিতা লিখে যায় ‌একটার পর একটা,যদি প্রকাশকের মনে ধরে,কবিতা যদি ছেপে বের হয়,তাহলে মা বাবা আর বলতে পারবে না ছাই কপালে কিছু ‌হবে না,ও সব লেখালেখি বাদ দে,

    একমাত্র চোর ডাকাতরা আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়।
    আমাদের ঘুম যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে হয় তার জন্য ওরা ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করে।চোর ডাকাত বলে কি ওরা মানুষ না ? ওদের প্রার্থনা কি ঠাকুর শুনবে না?নিশ্চই শোনে ঠাকুর ।নিজেদের চোখের ঘুম নষ্ট করে ওরা মা বাবা পরিবারের পেট ভরায় ।তাই ওদের কাছে ঘুম ঘুম চাঁদ বাতুলতা মাত্র ।

    “ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকমিকি তারা ঐ
    মাধবীরাত আসে নি কো বুঝি আর জীবনে আমার” বিখ্যাত গান
    প্রেমিক প্রেমিকার মনে ঝড় তোলে।ঘুমের দেশে ওরা পৌছে তো যায় ,কিন্তু ঘুম কতটা গাঢ় হয় সেটা ওরা নিজেরাও জানে না।ঘুমের মধ্যে ওরা ঘর সংসার করে পরিপাটি করে । প্রেমিকার খোঁপায় বেলফুলের মালা জড়িয়ে প্রেমিক বলে ,”সারাজীবন তোমার হয়ে থাকবো।সত্যি ,সত্যি, সত্যি তিন সত্যি “।ঐ চাঁদকে সাক্ষী রেখেই চলে ওদের কতো না অঙ্গীকার ।

    বৃদ্ধাশ্রমে বসে মা বাবারা চাঁদের দিকে তাকিয়ে হয়তো ভাবে,যে চাঁদকে জন্ম দিলাম, মানুষ করলাম সেই চাঁদই ঘুম কেড়ে নিল।রাত বাড়তে থাকে চাঁদেরও ঝিম আসে।ঘুম ঘুম চাঁদ প্রহর গোনে অপেক্ষা কিছু মিনিটের ।তারপর বিশ্রাম ।
    অবাঞ্ছিত মা বাবাদের বিশ্রাম নিতে নেই ,ভাবতেই হবে তাদের সন্তানের কথা।তাই নিজেদের অজান্তে ঘুম পাড়ানির গান গেয়ে ওঠে মায়েরা
    “ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি আমাদের আসল বাড়িতে এসো,
    আসার সময় আমার চাঁদের চোখের
    ঘুমটি নিয়ে এসো ”

    “খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশে,
    মা বাবা তোদের জেগে আজও
    তোদের প্রাণের পরশ পেতে”

    তারপর আরও‌ রাত বাড়ে আস্তে আস্তে ঘুম ঘুম চাঁদ মেঘের আড়ালে চলে যায়,
    রাতের শেষে ঘুমের দেশে বিশ্রাম
    নেয় চাঁদ,তারপর ভোর হয় শুরু হয় আমাদের জীবন সংগ্রাম,,দিনের শেষে ঘুমের দেশে

You cannot copy content of this page