-
কবিতা- বনভোজন বনাম পিকনিক
বনভোজন বনাম পিকনিক
-রেহানা দেবনাথএই লাল্টু,সোনা,ছোট্টু,বুড়ি,মানু আর রাজ
চল না সবাই বনভোজন খেলা খেলি আজ,
পোড়ো বাগানের কিছুটা জায়গা করে পরিস্কার
লাঠি পুতে পাতা দিয়ে বানাবো মোদের রান্না ঘর।
সবাই আনবি দুমুঠো চাল আর একটা বড় আলু
নুন,তেল আর কলাপাতা আনবি নেপু আর লালু
রানু,বুড়ি আর কালু কুড়িয়ে আনবি শুকনো কাঠ
মৌ আর রানী জল আনবি পেরিয়ে খেলার মাঠ।
রহিম তুই একটু বেশি করে আনিস মুসুর ডাল
আমি আনবো আচার,পেঁয়াজ আর কাচা ঝাল।
চল চল এখন সবাই যে যার কাজে বেরিয়ে পড়ি
সব কিছু নিয়ে চলে আসবি বাগানে তাড়াতাড়ি
রাম আর সেলিম খবর দিয়ে দে বাকি বন্ধুদের
বন ভোজন করবো সবাই আনন্দ হুল্লোড় করে।হঠাত্ কিসের শব্দে ভেঙে গেল ঘুম
দেখি লেগেছে ঘরেবন ভোজনের ধুম!
চলছে বুকিং রিসর্ট,গাড়ী আর ক্যাটারিং
হারিয়ে গেছে সেই শৈশবের বন ভোজনের দিন!
সরলতা ভুলে আমরা হয়েছি বড্ড আধুনিক
তাই তো বনভোজন এখন হয়েছে পিকনিক
সামান্য খাবার খেয়ে করতাম অনেক আনন্দ
এখন খাদ্যের তালিকায় থাকে ভালোমন্দ!
তার সাথে থাকে দুর্ভেদ্য শব্দদূষণকারি গান
বড়দের মাংস আর মদেতে চলে কম্পিটিশন । -
অণু গল্প- নিজের সাথে দ্বন্দ্ব
নিজের সাথে দ্বন্দ্ব
– রেহানা দেবনাথসমাজসেবী সুমিতা দেবী আজ নিজের ঘর অন্ধকার করে বসে আছেন। আজ তার নিজের সঙ্গে নিজের সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলছে।পাশের বাড়িতে ষোলো বছরের ঝুমার বিয়ে চলছে চুপিসারে! সে কিছুক্ষণ আগে জানতে পেরে ঝুমার মা মালতীকে ডেকে জিগ্যেস করতেই সে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে বলে “দিদিমণি আমাকে ক্ষমা করবে এত কম বয়সে মেয়েটার বিয়ে দিতে চাই নি কিন্তু আমি নিরুপায়। জানোতো আমার স্বামী বদ্ধ মাতাল তাই সে যখন তখন আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শরীরের খিদে মেটানোর জন্য।তখন দেখে না একটাই ঘরের মধ্যে আরো চারটে বাচ্ছা রয়েছে যারা এগুলো দেখতে পাচ্ছে। মেয়েটার শরীরে যৌবন আসতেই ও এগুলো দেখে বাইরে কোথাও কিছু করছে বলে আমার সন্দেহ হয় কারণ ওর মধ্যে মনের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের পরিবর্তন ও আমি লক্ষ্য করেছি। তার জন্য ওকে বুঝিয়ে, বকে, মারধোর করেছি তবুও কোনো কিছু জানতে পারিনি। এমন কি ও স্কুলেও যায় না। তার উপর সপ্তাহ খানেক আগে দুপুরে আমি হঠাৎ লোকের বাড়ি থেকে কাজ করে ফিরে দেখি ঝুমার সঙ্গে ওর বাবা খারাপ কাজ করছে।কি করবো বুঝতে পারছিলাম না! স্বামীকে যে তাড়িয়ে দেব সেটাও উপায় নেই কারণ একা মেয়ে থাকলে শেয়াল কুকুরে আমাদের ছিঁড়ে খাবে!
তিনদিন আগে জগা গুন্ডার ছেলে এসে বলে গেছে সে ঝুমাকে পছন্দ করে তাই ওর সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করতে না হলে তুলে নিয়ে যাবে! তাই বাধ্য হয়ে আমার দাদার বন্ধুর ছেলের সাথে চুপিসারে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছি!”সুমিতা দেবী চুপ করে সব শুনে অবাক হয়ে বললো “ওর আঠেরো এখনো হয় নি, শিশু বিবাহ আইনত অপরাধ। পুলিশকে জানিয়ে দিলে তোমরা সবাই জেলে যাবে তাই এই বিয়ে বন্ধ করো মালতী”।
মালতী সুমিতা দেবীর পা দু’টি জড়িয়ে ধরে বলে এমন কাজ করবেন না দিদি “ওকে ঘরে রাখলে যে হয় ওর বাবার ভোগ্য হবে না হলে গুন্ডাদের দ্বারা ধর্ষিত হবে তার চেয়ে এটা ভালো নয় কি?”
সুমিতাদেবী বললো “কোথাও খাওয়া পরার কাজে অথবা সরকারী হোমে ওকে রাখার ব্যবস্থা করলেই হয়!’
মালতী উঠে দাঁড়িয়ে বলে “দিদি আপনি যে জায়গাগুলোর কথা বলছেন সে জায়গায় আমার সুন্দরী মেয়ে যদি নিরাপদ থাকবে বলে আপনি যদি দায়িত্ব নেন,তাহলে এই বিয়ে আমি বন্ধ করে দিতে পারি। কথাটা বলে মালতী চলে যায়।সেই থেকে সুমিতাদেবী নিজের সঙ্গে নিজে লড়াই করছে একবার ভাবছে পুলিশকে খবর দিয়ে বিয়েটা বন্ধ করে তার কাজের দায়িত্ব পালন করবে আরেকবার ভাবছে তারপর ভাবছে বিয়েটা বন্ধ করে দিলে সে কিভাবে অন্য আর সবার থেকে মেয়েটাকে বাঁচাবে!
-
গল্প- নদীর জীবনে জোয়ার ভাঁটা
নদীর জীবনে জোয়ার ভাঁটা
-রেহানা দেবনাথনদী খুব গরীব পরিবারের মেয়ে ছোটো থেকে খুব অভাব অনটনের মধ্যেই মানুষ হয়েছে। লেখাপড়া শিখে পাঁচ ভাইবোন যখন বিভিন্ন কাজ করে আয় করতে থাকে তখন তাদের পরিবারে স্বচ্ছলতা দেখা দেয়। মাটির বাড়ি ধীরে ধীরে পাকা বাড়িতে পরিণত হয়। সংসারে অর্থে যখন ভাটা পড়ে ছিল তখন আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্কেও ভাটা পড়ে গিয়েছিল। কেউ আসতো না! কোনো অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পর্যন্ত করতো না! নদীর মনে আছে ছোটো বেলায় যখন ওর বাবা চাকরি করতো, দোতলা পাকা বাড়িতে থাকত তখন প্রতিদিন বাড়িতে লোকজনের জোয়ার বইতো। বাবার বন্ধুদের এই বাড়িতেই আড্ডা ছিল। ওর বাবার একসিডেন্টর পরে চাকরি চলে যায়। আর তখন থেকেই বন্ধু বান্ধব আত্মীয়স্বজনদের এ বাড়িতে আসায় ভাটা পড়ে।
আবার যেই ধীরে ধীরে অর্থের জোয়ার ওদের সংসারের ঢুকতে লাগলো তখন থেকে আবার বন্ধুবান্ধব, চেনা অচেনা আত্মীয়স্বজনদেরও জোয়ার বইতে লাগলো!
সময়ের বয়ে যাওয়ার সাথে সাথে নদীরও শরীরে যৌবনের জোয়ার এল। সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়ে গেল এক ধনী পরিবারে।স্বামী সাগর খুব ভালো গায়ক ও প্রকৃতি প্রেমিক মানুষ।তার ব্যবসায়ের দিকে মন নেই। সবসময় বন্ধুদের সঙ্গে পাহাড়,জঙ্গল,সমুদ্রে ঘুরতে বেরিয়ে যায়। খুব কম বাড়িতে থাকে।
একান্নবর্তী স্বচ্ছল পরিবারে কিছু অসুবিধা থাকলেও খুব ভালোভাবেই নদীর জীবন কাটছিল। তিন বছর পর নদী মা হতে চলেছে শুনে দুই বাড়িতেই খুশির জোয়ার বইতে লাগলো। সাগরও কথা দিলো এবারের হিমালয় অভিযান সেরে এসে আর অন্তত বছর পাঁচেক আর কোথাও বেরোবে না। সন্তানের সঙ্গে কাটাবে।
নদীর সুখের জোয়ার ভরা সংসারে ভাটার টান পড়লো সাগরের মৃত্যুর খবর আসার পরই। একমাত্র পুত্রের মৃত্যুর শোক নদীর শ্বশুর সহ্য করতে পারেনি হার্টফেল করে মারা যায়। শাশুড়ি অসুস্থ হয়ে পড়ে।সেই সুযোগে খুড়তুতো শ্বশুরের ছেলেরা সব সম্পত্তি হস্তগত করে ওদের বার করে দেয়।
নদী শাশুড়ীকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে কিন্তু সেখানেও কিছুদিন পর অশান্তি শুরু হয়ে যায়! দাদারা সবাই বিবাহিত প্রত্যেকের আলাদা সংসার কেউ আর ওদের দায়িত্ব বেশিদিন নিতে চায় না।দু’জনের খাওয়ার খরচ, ডাক্তারের খরচ তার উপর সম্পত্তির জন্য কেস করার খরচ!
বোনের দায়িত্ব নিলেও শাশুড়ির নিতে চায় না। নদী বয়স্ক শাশুড়িকে ছেড়ে দেবে না। তার উপর দাদাদের বক্তব্য বাচ্চাটা এবরশন করিয়ে দিয়ে পরে আবার ভালো ঘরে নদীর বিয়ে দেবে।
নদী কিছুতেই তাদের প্রস্তাবে রাজি হয় না।শুরু হয়ে যায় মনমালিন্য। নদী সম্পত্তির ভাগ চায় তাতে আরও সমস্যা বেড়ে যায়।
অবশেষে কিছু টাকার বিনিময়ে নিজের অংশীদারীত্ব দাদাদের হস্তান্তর করে দিয়ে নদী শাশুড়িকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে চলে যায়।
সেখানে গিয়ে বাচ্ছাদের পড়ানো ও একটা ছোট ঘরোয়া খাবারের দোকান খোলে। রান্নার হাত ভালো হওয়ায় কাস্টমার বাড়তে থাকে। কিছু অফিসের লোকজন খেতে এসে তাদের পার্সলের অর্ডার দিতে শুরু করে এইভাবেই ব্যবসায় উন্নতির জোয়ার লাগে। তারমধ্যে শাশুড়ি শোক কাটিয়ে অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠে। সারাদিন নাতনীকে আদর যত্ন ও তার সাথে খেলা করেই সারাদিন কাটিয়ে দেন।
নদী পাঁচজন কর্মচারী নিয়েও রেস্টুরেন্টে সামলাতে হিমসিম খায় তার সাথে হোম ডেলিভারীর অর্ডার দিন দিন বাড়ছে তাই সে রাস্তার ধারে জমি কিনে তাতে একটা বড় হোটেল তৈরী করেছে।
এখন নদীর জীবনে দুঃখ, কষ্ট আর অর্থের ভাটায় আনন্দ ও উন্নতির জোয়ার ঢুকেছে।
সে তার ছোট্ট মেয়ে আর শাশুড়িকে নিয়ে সুখের জোয়ারে ভেসে চলেছে। -
গল্প- মুখোশ
মুখোশ
– রেহানা দেবনাথসমাজসেবী রথীন্দ্রনাথ রাযের এলাকায় খুব সুনাম। সবাই বলে খুব ভালো মানুষ গরীব দুঃখীদের সাহায্য করে,বস্তি উন্নয়নের জন্য মিটিং মিছিল করেন। নারীনির্যাতন, ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। তার জন্য জনৈক রাজনৈতিক দল থেকে স্থানীয় কাউন্সিলর হবার প্রস্তাবও পেয়েছেন।
পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ও আশেপাশের সবাই খুব খুশি। একমাত্র তার স্ত্রী সুমিত্রা ছাড়া!
সুমিত্রাই একমাত্ৰ জানে যে লোকটি কত ভয়ঙ্কর আর হিংস্র!তার ভালো মানুষির মুখোশের পিছনে কি কুৎসিত চেহারা লুকিয়ে আছে।বিয়ের পর থেকেই বন্ধ দরজার ভিতরে যে হিংস্রতার শিকার সুমিত্রাকে হতে হতো তা অনেকের কল্পনার বাইরে! মাঝে মাঝে যেদিন ছাড় পেত সেদিন সুমিত্রাকে রাতে একা ঘরে রেখে বাইরে থেকে আটকে দিত।
এরকম ব্যবহারের উত্তর সুমিত্রা পেয়ে যেত সর্বক্ষণের ঝি মালতীর চোখের জল ও শারীরিক জড়তা দেখে।
মালতীকে সোজাসুজি না হলেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে কিন্তু তার দু’চোখে আতঙ্কের ছবি ছাড়া মুখে কোনো উত্তর পায়নি।মাঝে মাঝে বস্তির কিছু মেয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়! সুমিত্রার সন্দেহ এর পিছনেও তার স্বামীর হাত আছে।
সুমিত্রা ভয়ে কিছু বলতে পারে না। তার কোথাও যাবার কেউ নেই। তাই এত বছর সব সহ্য করে এসেছে!
হঠাৎ একদিন ছোট দেওরের বিধবা স্ত্রী রাহী সকালে খুব চেঁচাতে থাকে আর বলতে থাকে যে রথীন্দ্রনাথ এর মুখোশ আমি টেনে খুলে দেব। আমার সর্বনাশ যে করেছে তাকে ছাড়বো না। কিছুক্ষণ পর পুলিশ নিয়ে আসে। ধর্ষণের কেসে রথীন্দ্রনাথকে পুলিশ নিয়ে গেলেও কয়েক ঘন্টার মধ্যে ছেড়ে দেয় সাধারণ লোকেদের প্রতিবাদে। সবাই ছোটো বউকে ছি!ছি! করতে থাকে।
রথীন্দ্রনাথ বাড়ি ফিরে সবার সামনে ছোট বউয়ের হয়ে ক্ষমা চায় আর এও ইনিয়ে বিনিয়ে বলে যে আমি চাইনি যে মাত্র দু’মাস আগে যে ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে তার স্ত্রী রাহী দুশচারিত্রা সেটা সবার সামনে আসুক। তাই কাল রাতে অন্য পুরুষকে তার ঘর থেকে বেরোতে দেখলে তাকে সাবধান করে দিই।
এলাকার সব লোক তখন ছোট বউকে বার করে দিতে চাইলো শুধুমাত্র সুমিত্রা তাকে সন্তানের মত আঁকড়ে ধরে বাঁচায় অনেক কষ্টে।
গভীর রাতে রথীন্দ্রনাথ ঘরে ঢুকে সুমিত্রার সামনে এসে চেঁচিয়ে রাহীকে বলে আমাকে বদনাম করা এবার দেখ তোর কি অবস্থা করি। একটা রাতের জন্য এত কিছু এবার তোর প্রতিটি রাত আরো ভয়ানক বানাবো। কথাটা বলতে বলতেই আট দশ জন লোক ঢুকে রাহীর মুখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায়। সুমিত্রা আটকাতে গেলে মাথার উপর জোরে একটা চোট পেয়ে জ্ঞান হারায়।
সকালে যখন সুমিত্রার জ্ঞান ফিরলো তখন দেখলো একটা অন্ধকার ঘরে রয়েছে। রাহীর কথা ভাবতে থাকলো। তার দুরাবস্থার কথা ভেবে কাঁদতে থাকে।
কিছুক্ষণ পরে ঘরের দরজা খুলে রথীন্দ্রনাথ ঢুকে সুমিত্রাকে ধমক দিয়ে বলে কালকের ঘটনা নিয়ে যদি টু শব্দ করো তাহলে তখনই তোমাকে শেষ করে দেব। সুমিত্রা ভয়ে চুপ করে থেকে সম্মতির মাথা নাড়ে।
পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় রথীন্দ্রনাথ তার বন্ধু ও অনুরাগীদের সাথে বসে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে ‘”ছোটো বউ রাহী আমার মান সম্মান সব ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। কারোর কাছে মুখ দেখাতে পারছি না! অন্য পুরুষের সঙ্গে যদি যাওয়ারই ছিল তবে বিয়ের আগেই যেতে পারতো!” আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল সুমিত্রার চোখে চোখ পড়তে চুপ করে যায়।তারপর সুমিত্রাকে উদ্যেশ্য করে বলে আজ রাতে আমি একা থাকবো।
পরের দিন সকালে রথীন্দ্রনাথ আর ঘুম থেকে ওঠে না। পাশে বিষের শিশি পড়ে থাকতে সবাই বলে রথীন্দ্রনাথ আত্মহত্যা করেছে। রাহীর জন্য লজ্জ্বায় এই কান্ড ঘটিয়েছে। খুব ভালো মনের মানুষ ছিল তাই এই অনাচার মানতে পারেন নি।
সুমিত্রা অঝোরে কাঁদতে থাকে। সবাই তাকে সান্ত্বনা দিতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর সুমিত্রা বাথরুমে ঢুকে চোখে মুখে জল দিয়ে একটু জয়ের হাসি হেসে নেয়। তারপর শোকাহতের মুখোশ পরে নিয়ে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে।
-
রম্য- তোর জন্য
তোর জন্য
– রেহানা দেবনাথসেদিন ক্লান্ত শরীরটাকে যখন বিছানায় এলিয়ে দিলাম তখন বৈশাখের তপ্ততা ফ্যানের হাওয়াতেও শীতল হতে দিচ্ছিল না। বাধ্য হয়ে শরীর থেকে কিছুটা বসন খুলে অর্ধ নগ্ন হয়ে নিদ্রার দেশে পাড়ি দিলাম।
তুই তখন সুযোগ বুঝে মশারীর ভিতর ঢুকে প্রথমে স্পর্শ করলি আমার কপালে আর গুন গুন করে গান গাইতে লাগলি। আমি বিরক্ত হয়ে হাত দিয়ে সরিয়ে দিলাম। কিন্তু তুই নাছোড় বান্দা! সারা শরীরে চুম্বন করলি আর নিজের চাহিদা পূরণে ব্যস্ত হয়ে পড়লি! আমি নিদ্রার কবলে পড়ে বাধা দিতে পারলাম না।শুধু কিছুক্ষণ ছটফট করলাম তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম।সকালে উঠে দেখলাম শরীরের কয়েকটি স্থানে এঁকে দিয়েছিস তোর লোলুপতার চিহ্ন!খুব রাগ হলো তোর উপর! তোর জন্য নরম গাল দু’টো লাল হয়ে গেছে।
বেশ কয়েকদিন পর তোর নৃশংসতার কারন স্বরূপ সারা শরীরে যন্ত্রণা আর বমি হতে লাগলো সেই সঙ্গে জ্বর। প্রাণ যায় যায়!
হাসপাতালে যাবার পর ডাক্তার চিকিৎসা শুরু করলো। তারপর রিপোর্ট দেখে বললো ডেঙ্গু হয়েছে তোর কামড়ের জন্য। রেস্ট নিন আর ওষুধ খান সব ঠিক হয়ে যাবে।আমি তখন অসহায় ভাবে শুধু মাথা নাড়লাম।আর মনে মনে তোকে ঘর থেকে তাড়ানোর উপায় ভাবতে লাগলাম।
-
কবিতা- ফুটপাথের ধারাপাত
ফুটপাথের ধারাপাত
– রেহানা দেবনাথএক: ওরে সভ্য সমাজ একবার তো মোদের পানে চেয়ে দেখ,
দুই: মোরা খোলা আকাশের নীচে ছেঁড়া কাঁথায়,ফুটপাথে শুই।
তিন: কেউ করি পরিশ্রম তো কেউ বেকার হয়ে কাটাই দিন!
চার: কারণে অকারণে কখনো পুলিশ তো কখনো দাদাদের হাতে খাই মার!
পাঁচ: নেতারা সবসময় আমাদের নিয়ে ইচ্ছেমতো নাচায় বাঁদর নাচ!
ছয়: ভদ্র মানুষেরা আমাদের দেখে মুখ ফেরায় নয়তো পায় ভয়!
সাত: প্রশ্ন জাগে মনে কেন কেউ দেয় না বাড়িয়ে ভালোবাসা বন্ধুত্বের হাত?
আট: আমাদের ঘর বলো আর ভিটেমাটি সবই এই পথ ঘাট।
নয়: জানো কি তোমরা মোদের উপর কত অমানবিক নির্যাতন হয়?
দশ: তবে অভাব অনটন,কষ্ট যতই হোক,মোরা অল্পতেই আনন্দে থাকি বস!!!
-
কবিতা- হঠাৎ তোমার আমার
হঠাৎ তোমার আমার
– রেহানা দেবনাথহঠাই তোমায় দেখতে পেলাম জোৎস্নার আলোতে
হৃদয় আমার হারিয়ে গেল সেই স্বপ্নময় রাতে!হঠাৎ তোমার সাথে দেখা শিশির ভেজা সকালে
মন আমার নেচে উঠলো হাত নেড়ে যখন ডাকলে!হঠাৎ তোমার সাথে গেলাম একটু আলাপ জমাতে
সন্মান আমার ক্ষুন্ন হলো অপ্রত্যাশিত আঘাতে!হঠাৎ তোমার চঞ্চল হয়ে বৃষ্টিতে ছুটে যাওয়া
ইচ্ছে আমার বারিধারা হয়ে তোমায় ছুঁতে চাওয়া!হঠাৎ তোমার ভালোবাসার হাত পড়লো অন্য হাতে
আঁখি আমার ভরলো যন্ত্রণার অশ্রু ধারাতে!হঠাৎ তোমায় বাঁধলো সে প্রেমের বাহুডোরে
জগৎ আমার ঢেকে গেল অমাবস্যার অন্ধকারে!! -
অণু গল্প- মা’ এর তুলনা হয় না
‘
মা’ এর তুলনা হয় না
– রেহানা দেবনাথসুমনার আজ মেয়ে হয়েছে, সে প্রথম ‘মা’ হয়েছে তাই শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ির সবাই দেখতে এসেছে। সবাই খুব খুশি।তাদের দেখে সুমনাও খুব খুশি কিন্তু মাকে দেখতে না পেয়ে তার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। তার মায়ের উপর অভিমানও হলো।মনে মনে ভাবলো না হয় মায়ের অপছন্দের ছেলেকে বিয়ে করেছি আর বছর খানেকের মধ্যে বাচ্ছাও নিয়ে নিয়েছি, এতে মা অসন্তুষ্ট হয়েছে। তাই বলে আমার জীবনের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিনে মা পাশে থাকলো না!
পাঁচদিন ধরে সুমনা মায়ের জন্য খুব কষ্ট পেয়েছে তাকে একবারও দেখতে এলো না, ফোন করলো না!!
ছুটির সময় তার দাদা যখন ডিসচার্জ করে বাড়ি নিয়ে যেতে এলো তখন সুমনা পরিষ্কার জানিয়ে দিল ওই বাড়িতে সে যাবে না! শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে। আর রাগে মায়ের নামে যা নয় তাই কথা বলতে থাকে!
তখন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ওর বাবা বলে এভাবে বলিস না মা!তোর মায়ের তুলনা হয় না। সে তোকে জন্ম দেবার সময় নিজের প্রাণের বাজি রেখেছিল সবার কথা অগ্রাহ্য করে আবার সেই একই কাজ করেছে তোর ডেলিভারির দিন তোকে রক্ত দিয়ে! তোর ও তোর মেয়ের জীবন বাঁচিয়ে।
আজ সে বিছানায় অসুস্থ। তোদের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।
সুমনা দু’চোখে জলের ধারা নিয়ে বলে আমায় এখুনি মায়ের কাছে নিয়ে চলো।আমি তার পা ধরে ক্ষমা চাইবো আর প্রশ্ন করবো। যে মেয়ে প্রতিপদে তাকে নীচু করেছে,তার কথা অমান্য করেছে তার জন্য কেন নিজের জীবন নিয়ে খেলে!!! -
গল্প- সম্পর্কের টানাপোড়ন
সম্পর্কের টানাপোড়ন
-রেহানা দেবনাথঅনিমা আর রাতুল সব বয়সী বন্ধু একই বস্তিতে থাকে। তার জন্য ছোট্ট থেকেই খুব সহজে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত একই স্কুলে পড়ে। পঞ্চম শ্রেণী থেকে রাতুলের দুপুরে স্কুল হয়ে যায়। তবুও তাদের বন্ধুত্বের ঘাটতি দেখা যায় না।
শৈশবে তাদের বন্ধুত্ব সকলে মেনে নিলেও কিশোর বয়সের বন্ধুত্ব নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়ে যায়।
প্রতিবেশী,বন্ধু বান্ধব,আত্মীয় স্বজনেরা সবাই তাদের মেলামেশাকে প্রেমের রূপ দেয়। তারা অস্বীকার করে ভালো বন্ধু বলে।
রাতুলের বাবা মায়ের একটাই কথা এই বস্তির মেয়ের সঙ্গে আমাদের একমাত্র ছেলের বিয়ে দেব না। গ্রামে আমাদের বিশাল সম্পত্তি ও নাম আছে। আর ওই হাড় হাভাতে অনিমাকে তো বউ হিসেবে কোনোদিনই মেনে নেব না।
এই কথা লোকের মুখে মুখে অনিমার মায়ের কানেও পৌঁছে যায়। দুই পরিবারের মধ্যে বিশাল গণ্ডগোল হয়। তাতেও দু’জনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক অটুট থাকে।সময় পেরিয়ে যায় যুবতী অনিমার বিয়ে ঠিক হয় তখন দু’জনে উপলব্ধি করে দু’জনে দু’জনকে ছাড়া থাকতে পারবে না। ফলস্বরূপ বিয়ে ভেস্তে যায়।
অনিমার কপালে বাড়ির লোকের অত্যাচার আর প্রতিবেশীদের তিরস্কার জুটল।
রাতুলের মা বাবা প্রথমে কিছু বলে নি। দু’দিন পর দাদু অসুস্থ এই অজুহাতে তাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যায় ।
রাতুলের মা আত্মহত্যার ভয় দেখিয়ে তার বিয়ে গ্রামের এক মেয়ের সঙ্গে দিয়ে দেয়।মাস খানেক হয়ে গেলে যখন রাতুলের পরিবার ফিরে আসে কিন্তু রাতুল ফেরে না তখন অনিমা ওর বাড়িতে খোঁজ নিতে গেলে ওরা অপমান করে তাড়িয়ে দেয়!
অনিমা রাতুলের খোঁজ না পেয়ে পাগলের মত হয়ে যায় !
এরপর সত্যি খবর এলাকায় জানাজানি হয়ে যায় যে রাতুলের বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ের ছবিও সবাই দেখেছে, এমনকি অনিমাও দেখে, সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না!
অনিমা কি করবে বুঝতে পারে না। নিজেকে ঘরবন্দি করে নেয়,ৎরাগে দুঃখে পাথর হয়ে যায়।এইভাবে একটা বছর পার হয়ে যায়………….
হঠাৎ একদিন একটি ছেলে এসে অনিমাকে চিরকুট দিয়ে যায়। তাতে রাতুল দেখা করার জায়গা ও সময় লিখে দিয়েছে।
এতদিন পর রাতুলের চিঠি পেয়ে নিস্তেজ অনিমা অনেকটা সতেজ হয়ে ওঠে।
তারপর নিদির্ষ্ট সময়মতো অনিমা রাতুলের সঙ্গে দেখা করে।
শীর্ণ শরীর দু’চোখের তলায় কালি পড়া অনিমাকে দেখেই রাতুল জড়িয়ে ধরে বলে একি চেহারা বানিয়েছিস! অনিমা কাঁদতে কাঁদতে বলে তোকে ছাড়া বেঁচে আছি সেটাই আশ্চর্য্যের ব্যাপার! আমি জানতাম তুই একদিন ফিরে আসবি তাই মরি নি!
এরপর রাতুল সমস্ত ঘটনা জানায়। তারসঙ্গে এও জানায় যে বিয়ে সে মায়ের চাপে করলেও ছয় মাসের মাথায় সে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। কারণ বউয়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক তৈরি করে নি সেই কারণে অশান্তি শুরু হয়। আজও রাতুল শুধু অনিমাকে ভালোবাসে তাই কাজ খুঁজে আয় করে ভাড়ার ঘর ও তাতে সংসারের সমস্ত জিনিস কিনে সাজিয়েছে। আজ সে অনিমাকে নিয়ে যেতে এসেছে।
অনিমা রাতুলকে ফেরাতে পারে না তাই তার সাথে চলে যায়।
নতুন সংসার পাতলো দু’জনে। ভালো ভাবেই দিন কাটছিল।
এরপর একদিন খোঁজ পেয়ে রাতুলের মা হাজির হয়। বাবা অসুস্থ রাতুলকে দেখতে যেতে বলে কিন্তু অনিমার যাওয়া বারণ!প্রথম প্রথম রাতুল বাবাকে দেখতে গেলে সেই দিনই চলে আসতো কিন্তু পরে পরে দু’ একদিন পরে ফিরত!
এরপর রাতুলের বাবা মারা গেলে,রাতুল মায়ের কাছে গিয়ে দু’ তিনদিন করে সপ্তাহে কাটিয়ে আসতে লাগলো।অনিমার মা অসুস্থ তাকে দেখতে যায় অনিমা। সেখানে গিয়ে জানতে পারে রাতুলের আগের বউকে ওর মা এখানে এনে রেখেছে!
অনিমার রাতুলের উপর থেকে বিশ্বাস কমতে থাকে কারণ যখনই ও রাতুলকে আগের বউয়ের কথা জিজ্ঞেস করে বলে বাপের বাড়ি চলে গেছে।
ওদিকে রাতুলের মা বৌমা শিমুলকে শেখাতে থাকে কিভাবে অন্য মেয়ের কাছ থেকে নিজের স্বামীকে ঘরে ফেরাতে হয় ।
শিমুল গ্রামের সাধাসিধে মেয়ে স্বামীকে দেবতা মনে করে তাই সবরকম চেষ্টা চালাতে থাকে। এই কাজে সাহায্য করার জন্য রাতুলকে ওর মা বিভিন্ন অজুহাতে দু’দিন ছাড়া ডেকে নিত আর সহজে যেতে দিত না।রাতুল আর অনিমার সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করে!রাতুল অনিমা, মা ও শিমুলের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়নে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে মদ খেতে শুরু করে!অনিমা রাতুলকে তার প্ৰথম বউকে ডিভোর্স দেবার কথা বললে সে জানায় মা অসুস্থ এখন এইসব কথা বলা যাবে না।
এইভাবে আরো একটি বছর কেটে যাবার পর একদিন অনিমা বাপের বাড়ি গিয়ে জানতে পারে রাতুলের মা সবাইকে বলছে তার বৌমা গর্ভবতী।অনিমা বাড়ি ফিরে রাতুলের সঙ্গে ঝগড়া করলে রাতুল জানায় জ্ঞানত অবস্থায় তার সঙ্গে শিমুলের কোনো শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয় নি। কিন্তু মনে মনে ভীত হয়ে পড়ে কারণ ওই বাড়িতে থাকলে মাঝে মাঝে ঘুম থেকে উঠে দেখেছে তার পাশে শিমুলকে শুয়ে থাকতে!
একদিন অনিমা ডাক্তার দেখিয়ে জানতে পারে মা হওয়ার জন্য তার সব মেডিকেল রিপোর্ট ওকে। তারপর জোর করে রাতুলকে নিয়ে গিয়ে চেকআপ করায়। রাতুলের স্পার্ম কাউন্ট রিপোর্টে দশ হাজারের নীচে আছে, যার কারণে সে কোনোদিন বাবা হতে পারবে না বলে ডাক্তারবাবু জানিয়ে দেন।অনিমা রাতুলকে কিছু জানায় না। লুকিয়ে চোখের জল ফেলে।
এদিকে একজন আত্মীয়র সঙ্গে দেখা হলে জানতে পারে রাতুলের মা সবাইকে বলেছে রাতুল প্রথম বউকেই ভালোবাসে তাই তার বাচ্ছা হবে আর ওকে রক্ষিতা করে রেখেছে।
অনিমার মাথা গরম হয়ে যায়। সে সমস্ত রিপোর্ট নিয়ে শ্বশুর বাড়ী উপস্থিত হয়।চেঁচামেচিতে অনেক লোকজন রাতুলদের বাড়িতে জমা হয়ে যায় তখন অনিমা রাতুলের সমস্ত রিপোর্ট সবাইকে দেখিয়ে দেয়।প্রতিবেশীরা সবাই অবাক হয়ে যায়।সবার তির্যক প্রশ্নে শিমুল হতভম্ব হয়ে যায়। গর্ভবতী হওয়া নিয়ে তাকে সবাই চরিত্রহীন বলতে থাকে! তখন রাতুলের মা বলে যে শিমুল গর্ভবতী নয়, এমনি তিনি বলেছিলেন। শিমুল লজ্জায় দুঃখে সেদিনই বাপের বাড়ি চলে যায়।
রাতুল সমস্ত কথা জানার পর অনিমার সঙ্গে ঝগড়া করে এমনকি গায়ে হাত তোলে! তুই আমার মান সম্মানের কথা ভাবলি না সমাজের কাছে আমাকে নপুংসক প্রমাণ করলি।অনিমা জানায় ও মা হতে পারুক আর না পারুক সরাজীবন এইভাবেই রাতুলকে ভালোবেসে যাবে।
রাতুল কিন্তু সহজে তা মেনে নিতে পারে না।নিজেকে অপরাধী মনে করতে থাকে। মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকে। মদ খাওয়া বেড়ে যায়। কাজ ছেড়ে দেয়।
ওদিকে রাতুলের মাও ছেলের শোকে বিছানা নেয়।কিছুদিন পর রাতুল নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।অনিমা তখন সব ছেড়ে অসুস্থ শাশুড়ির কাছে চলে যায়। লোকের বাড়ি রান্নার কাজ করে নিজের ও অসুস্থ শাশুড়ির খরচ চালায়। সেই সঙ্গে রাতুলের খোঁজও চালায়।
এইভাবে পাঁচটি বছর কেটে যায় ….
রাতুল আবার ফিরে আসে। এবারে আর অনিমা তাকে মেনে নিতে পারে না!
রাতুলের প্রতি অভিমান রাগ এতটা জমাট বেঁধে গিয়েছিল যে অনিমার হৃদয়ে বন্ধুত্ব ভালোবাসা কোনো কিছুই আর রাতুলের প্রতি তার আগের অনুভূতিগুলোকে ফেরৎ আনতে পারলো না!!রাতুলের মা সুস্থ হয়ে যাবার পর ছেলেকে পেয়ে অনিমাকে অপমান করতে থাকে।ছেলেকে জানায় এতদিন ধরে তার উপর অনিমা অত্যাচার করত, খেতে দিত না ইত্যাদি ইত্যাদি…
সেই শুনে রাতুল আবার অনিমাকে যা নয় তাই বলতে থাকে….দুঃখে কষ্টে অনিমা সেই মুহূর্তেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পরে ওই এলাকায় একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করে আর দিনরাত কাজ করতে থাকে। সেই সঙ্গে পাড়া প্রতিবেশীদের দায় বিপদে ছুটে বেড়ায়।স্বার্থহীন ভাবে মানুষের উপকার করতে থাকে।
সব ভুল ভেঙে গেলে রাতুল অনেকবার অনিমার কাছে ক্ষমা চায়। স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে চায়।
অনিমা কিন্তু তাকে মন থেকে আর মেনে নিতে পারে না।
রাতুল আর অনিমার সম্পর্ক এখন অতিথির মত। সেখানে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা মৃত!!
রাতুল বছরে দু’এক বার অনিমার কাছে আসে কয়েকদিন কাটিয়ে আবার চলে যায় গ্রামের বাড়িতে।
অনিমা মন থেকে না হলেও ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিল………সমাজের কথা….নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে!! -
গল্প- অভিনয়ের খেলাঘর
অভিনয়ের খেলাঘর
– রেহানা দেবনাথসুকন্যার আজ এক মুহূর্ত বিশ্রাম নেবার সময় নেই! সেই ভোর পাঁচটা থেকে উঠে ঘর পরিষ্কার করা সাজানো সব করেছে! তারপর একহাতে জল খাবার করছে। সৌমিত্রকে অনেকবার বলেও একটা কাজের মাসি রাখতে পারেনি।
সৌমিত্রর একটাই কথা- সারাদিন ঘরে বসে করো কি! বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে আসা নিয়ে আসা আর রান্না করা, ব্যস তারপর সারাদিন আরাম! আর আমাকে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয় তারপর দু’টো পয়সায় মুখ দেখতে পাই।
সুকন্যা কথার উত্তর দেয় না। মনে মনে ভাবে অফিসের ম্যানেজাার, থাকো তো সারাদিন এ.সি. ঘরে ল্যাপটপের সামনে! আর আমি সকালে কাজের মাসি, রান্নার ঠাকুর, বাচ্ছার আয়া, ঘরের কেয়ার টেকার, অসুস্থ শ্বশুর শাশুড়ির নার্স, আর সন্ধ্যাবেলা বাচ্চার দিদিমণি আর রাতে তোমার জন্য রম্ভা শয্যা সঙ্গিনী…তাহলে হাড়ভাঙা খাটুনি কে খাটে বাপু!সৌমিত্র বাজার থেকে ফিরেই চিল চিৎকার- কি হলো জল খাবার রেডি হয়েছে তো? ওরা সবাই রাস্তায় আছে আধ ঘন্টার মধ্যেই ঢুকে পড়বে।
সুকন্যা ঠান্ডা জলের বোতলটা এগিয়ে দিতে দিতে বলে- সব রেডি, শুধু ওনারা এলেই লুচি ভাজবো।
সৌমিত্র আপাদমস্তক সুকন্যাকে দেখে বলে- নিজের চেহারার কি ছিরি করে রেখেছো! ওদের সামনে একদম এভাবে আসবে না। তোমার মত গেঁয়োটাকে বিয়ে করে আমার মান সম্মান তো গেছে! তার উপর কি চাও ওরা এসে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করুক!
সুকন্যার দু’চোখে জল চলে আসে সে কোনো রকমে আঁচল দিয়ে মুছে নেয়।
সৌমিত্র মুখ বেঁকিয়ে বলে- আর নাটক করতে হবে না, গিয়ে রেডি হও। বাপের বাড়ি থেকে একটা জিনিস তো ভালোই শিখেছো, ন্যাকা কান্না! যাও যাও মাথাটা গরম করিও না।
সুকন্যা রান্না ঘরে এসে বেসিনের কল খুলে দিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে আর মনে মনে বাবাকে দোষারোপ করে। ‘কেন বাবা তুমি আমার গ্রাজুয়েশনটা শেষ করতে না দিয়ে বন্ধুর কথায় রাজি হয়ে বিয়েটা দিয়ে দিলে? ওরা আমার গান, নাচ সব ছাড়িয়ে দিয়ে এমনকি ফাইনাল পরীক্ষাতেও বসতে দিল না শ্বশুরের অসুস্থতার কারণে। আমার সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল! শুধুমাত্র তোমার জেদের জন্য! তোমাকে আমি কোনদিন ক্ষমা করবো না।’
বাইরে হৈ চৈ শুনে সুকন্যার সম্বিৎ ফেরে। সে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে শাড়ী পরে, মুখে ক্রিম মেখে বসার ঘরে এসে দেখে সৌমিত্রর পাশে একজন সুন্দরী মহিলা বসে আছে, পরনে হালকা কমলা রঙের শাড়ি আর স্লিপলেস ব্লাউজ অন্য প্রান্তে সোফায় আরো ছয় জন পুরুষ মিলে ঠাট্টা তামাশা করছে।
সৌমিত্র রেগে বলে- ওরা কখন এসেছে আর তোমার এখন আসার সময় হলো! সুকন্যা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর সৌমিত্র সবার সঙ্গে সুকন্যার পরিচয় করিয়ে দেবার সময় বলে- শুধুমাত্র বাবার জোরাজুরিতে ওই সুদূর গাঁ থেকে এই মাকাল ফলটাকে বিয়ে করে এনেছি না হলে কত সুন্দরী শিক্ষিত স্মার্ট মেয়ে আমার আশেপাশে ঘুর ঘুর করতো!
এমন কেন বলছো সৌমিত্র! বৌদিকে তো দেখতে যেমন খাসা তেমন গুণও আছে নিশ্চয়! পাশ থেকে একজন সুকন্যার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে বলে।
তার দিকে তাকিয়ে সুকন্যার গা জ্বলে ওঠে! কি বিচ্ছিরি ভাবে তাকিয়ে আছে!
জলখাবার রেডি করে আনছি, তোমরা কথা বলো। কথাটি বলে সুকন্যা একটু হেসে রান্না ঘরে চলে আসে।
কিছুক্ষণ পর সৌমিত্র এসে বলে- ভালোই তো ঢং শিখেছো!
সুকন্যা অবাক হয়ে বলে আমতা আমতা করে বলে-আমি আবার কি করলাম?
কি করেছ কিছুই বুঝতে পারছো না! ন্যাকা। কথা বলতে বলতেই সুকন্যার বাঁ হাতটা মুচড়ে ধরে।
আহ! আহ! ছাড়ো, লাগছে….গোঙাতে গোঙাতে সুকন্যা বলে।
সৌমিত্র তত জোরে চাপ দিয়ে বলেে- চিৎকার করলে হাত ভেঙে দেব, পরপুরুষ দেখলেই পাতলা শাড়ি, পিঠ কাটা ব্লাউজ পরার ইচ্ছে হয়! দুশ্চরিত্রা কোথাকার।
সুকন্যা কাঁদতে কাঁদতে বলে- তুমিই তো বলেছিলে গেঁয়োদের মত না সাজতে তাই…..
মুখে মুখে আবার কথা বলা হচ্ছে যাও চেঞ্জ করে জলখাবার নিয়ে এস তাড়াতাড়ি, কথাটা বলে সৌমিত্র ফ্রীজ থেকে একটা ঠান্ডা জলের বোতল নিয়ে বেরিয়ে যায়।
সুকন্যা জলখাবার নিয়ে বসার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে দেখে সৌমিত্র সেই মহিলার কাঁধে হাত দিয়ে বসে আছে। সুকন্যাকে ঢুকতে দেখে হাতটা নামিয়ে নিয়ে বলে শব্দ করে আসতে পারো না, ভুতের মত হাঁটাচলা কেন? বলে হাসিতে ফেটে পড়ে সৌমিত্র।
সুকন্যা চুপ করে খাবার দিয়ে চলে যাওয়ার সময় শুনতে পায় তখনো তাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা হচ্ছে।সুকন্যা ঘরে ঢুকে রাগে দুঃখে দিশেহারা হয়ে পড়ে। বিছানায় শুয়ে কাঁদতে থাকে। তারপর উঠে চোখের জল মুছে ভাবে গত পাঁচ বছর ধরে অনেক সহ্য করেছি, আর নয়!
বিয়ের কয়েক মাস পর এই অপমান অত্যাচার সহ্য না করতে পেরে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল কিন্তু বাবা তাকে ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়েছে! বাবা বলেছে ‘বিয়ের পর মেয়েদের শ্বশুর বাড়িই হলো নিজেদের ঘর, তখন তারা বাপের বাড়িতে অতিথি!’ তারপর থেকে আর সুকন্যা বাপের বাড়ি যায় না বললেই চলে। বাবা মা’কে তার কষ্টের কথাও বলে না।
হঠাৎ পিঠে হাত পড়তেই সুকন্যা চমকে দেখে পিছনে সেই সুন্দরী মহিলা দাঁড়িয়ে আছে! পরিচয় করার সময় জেনেছিল ওনার নাম মিলি।সুকন্যা তাড়াতাড়ি উঠে বলে- আপনার কি কিছু চাই?
মিলি একটু হেসে বলে- হ্যাঁ, একটু বরফ আর ব্যথার মলম।
সুকন্যা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে- কার চোট লাগলো? আপনার? বলতে বলতে নিমেষের মধ্যে ফ্রীজ থেকে এক টুকরো বরফ ও ব্যথার মলম নিয়ে হাজির। দেখি কোথায় লেগেছে?
মিলি সুকন্যার হাত থেকে বরফ নিয়ে ওর বাঁ হাতের কনুই থেকে লাগাতে শুরু করে। তারপর সযত্নে হাতে মলম লাগিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করেে- কি করে এমন হলো?
সুকন্যা কালসিটে পড়া হাতের দিকে তাকিয়ে বলে-পড়ে গিয়েছিলাম সকালে।
মিলি বিস্ময়ের সুরে বলে- প্রথম যখন তোমার সঙ্গে পরিচয় হলো তখন তো ওই দাগ ছিল না, পরে জলখাবার নিয়ে গেলে তখন দেখতে পেলাম!
সুকন্যা হাত সরিয়ে নিয়ে বলে- না না আগেই ছিল আপনি দেখতে পান নি।
মিলি মুচকি হেসে বলে- ঠিক বলেছ আমরা মেয়েরা সব এক! স্বামীর অন্যায় কাজগুলোকে ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত থাকি আর এই সুযোগেই ওরা একটার পর একটা অন্যায় করে যায়। বলেই মিলি শাড়ি তুলে থাইয়ের মধ্যে কাটা দাগগুলো দেখায়।
সুকন্যা সেই ক্ষত দেখে আঁতকে উঠে বলে- কি করে হলো!
মিলি ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলে- স্বামীর ম্যানেজার বন্ধুর পার্টিতে আসতে না চাওয়ার প্রতিদান! আমার স্বামী প্রদ্যুৎ, অফিসের সুপারভাইজার। প্রোমোশনের লোভে সব বন্ধুদের সঙ্গে বউকে ঘনিষ্ঠ করতে ওর লজ্জা করে না। কিন্তু আমি সবসময় পারি না। যখন প্রতিবাদ করি তখন ওর হিংসার ছবি সারা শরীরের এঁকে দেয়!
সুকন্যার চোখের সামনে প্রদ্যুৎ-এর ছবি ভেসে উঠলো। বসার ঘরে মিষ্টি নম্র ভাষী লোকটি যাকে তার সবচেয়ে ভদ্র মনে হয়েছিল!
সুকন্যা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে- কিছু মনে করবেন না, আপনি ওনাকে ছেড়ে দেননি কেন বা অন্য কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন?
মিলি হো হো করে হেসে ওঠে বলে- এ দেখি এক অন্ধ আরেক অন্ধকে পথ দেখায়!
কিছুটা ধাতস্থ হয়ে মিলি বলে- কিছু মনে করো না বোন, তুমি আমি সবাই এক মায়ার বাঁধনে আটকে আছি! যার নাম সংসার। তিন তিনটি ছেলে মেয়ে তাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আটকে পড়েছি। প্রথম প্রথম ভেবেছি অভাব শেষ হয়ে গেলে ও ঠিক হয়ে যাবে! কিন্তু না, আমি ভুল ওর লোভ দিন দিন বেড়ে চলেছে! আর আমার এই বাঁধন ছেড়ার ক্ষমতা বা উপায় নেই। যতদিন যায় এই বাঁধন আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে তাই সময় থাকতে বাঁচার সঠিক পথ খুঁজে নিতে হয় বোন। কথাটা বলে চোখ মুছতে মুছতে মিলি বেরিয়ে যায়।
সুকন্যা ধপাস করে বসে পড়ে। ভাবতে থাকে মানুষ কত বড় অভিনেতা। একজন মানুষ বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার করে, তাকে দেখে বোঝাই যায় না কোনটা তার আসল রূপ।
সুকন্যা উঠে দাঁড়ায় আর চুপ করে অপমান,অন্যায় অত্যাচার সহ্য করা চলবে না… এর যোগ্য জবাব তাকে দিতেই হবে…