-
প্রবন্ধ- বিবাহ- সম্পর্ক? নাকি আত্মিকতা
বিবাহ- সম্পর্ক? নাকি আত্মিকতা
– সঙ্কর্ষণপ্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্র অনুসারে বৈবাহিক সম্পর্ক কখনোই কেবল একটি পুরুষ ও নারীর হ’তে পারেনা, দুটি পরিবারের হয়। দুটি মানব-মানবীর প্রেম হ’তেই পারে, কিন্তু পরিণতি সম্পর্কে দুই পরিবারের নিশ্চয়তা তাতে অবশ্যম্ভাবী। মননের গহীন থেকে গহীনতর অংশের অন্বেষণ মূলতঃ নব্যতার পরিচায়ক… এ শাস্ত্র যে সময়ে রচিত বা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত, সমাজ সে সময় ততোখানি আধুনিকমনস্ক আদৌ ছিলোনা। বিবাহের পূর্বে আত্মীয়স্বজনের অজ্ঞাতে অন্তরঙ্গতা সংখ্যায় নগণ্য তো ছিলোই, উপরন্তু পরিণতি অসবর্ণ বিবাহমুখী যাতে না হয় তার পূর্ণ প্রচেষ্টা চালানো হ’তো। সত্যি ব’লতে কী, এই পর্যন্ত সমাজের অনমনীয়তার পরিচয় পাওয়া গেলেও তাতে পুরুষতান্ত্রিকতা প্রকট হ’য়ে ওঠার লক্ষণ খুব বেশী দেখা যায়না।
সমস্যা দেখা দেয় বয়সের পার্থক্যে, দেখা দেয় নারী সম্পর্কে সমাজের বিচারে। দশমবর্ষীয়া বালিকা যখন একুশ থেকে পঁচিশ বছরের তরুণের ঘরণী হ’য়ে আসতে বাধ্য হয়, তখন এই নৈতিক ব্যাখ্যাগুলিই আমাদের পক্ষে চরমভাবে বিরক্তি-উৎপাদক ও হাস্যোদ্রেককারী হ’য়ে ওঠে। দশোর্ধ্ব বালিকা কোনোমতেই বিবাহযোগ্যা নয়, যেহেতু ঋতুমতি আর ‘যমমুখী’ শব্দদ্বয় আপাতদৃষ্টিতে সমার্থক। যে মেয়েটি অত্যন্ত ছোটো বয়সে নিজের ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে অপরিচিত একটি মানুষের সান্নিধ্য পেতে চিরকালের মতো চ’লে যাবে, সে যাতে কোনোভাবেই ‘অচলায়তন’ ভাঙবার দুঃসাহস না দেখাতে পারে সেজন্য শ্বশুরবাড়ির প্রায় প্রতিটি সদস্যই নিজস্ব তাগিদে সচেষ্ট হন। নারীত্বের বিকাশ সম্পর্কে এহেন ঔদাসীন্য সম্ভবতঃ আমাদের পক্ষেই সম্ভব। সামগ্রিকের তুলনায় ব্যক্তিগত স্বার্থ বড়ো হ’য়ে ওঠে ব’লেই হয়তো এককালে স্বয়ং নতিস্বীকৃত হ’য়েও নবাগতাকে সেই একইরকম চাপে ফেলে দিতে পুরবাসিনীরাও দ্বিধা করেননা কোনোদিন, করেনওনি।
জ্ঞানদানন্দিনী সাহেবি কেতায় শাড়ি, জুতো পরার সাহসটুকু দেখাতে পেরেছিলেন কি স্বেচ্ছায়? উত্তর হ’লো ‘না’। তৎকালীন সরকারি আমলা হ’য়ে বয়সে যথেষ্ট বড়ো স্বামী সত্যেন্দ্রনাথও নিজের বাবার সম্মতি পেয়েই সেই অনুমতি দিয়েছিলেন মাত্র। প্রতিপত্তি জনমতের চিৎকার থামাতে পারলেও ফিসফাস সে বন্ধ ক’রতে পারেনি কোনোদিনই আর সেইজন্যই প্রাপ্ত অধিকারটুকুর কারণে ঠাকুরবাড়ির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনে জ্ঞানদানন্দিনীর কোনো কার্পণ্য ছিলোনা। যতোই স্বামীর পাশে ব’সে নাটক দেখার অভ্যাস থাকুক, অধিকাংশ সময়টুকু রান্নাঘর আর দাসদাসীর তদারকিতেই তাঁর কাটতো বইকি।
এখন বিষয় হ’লো, মনস্তত্ত্ব নিয়মের তোয়াক্কা কোনোকালেই না করায় বয়সে সামান্য ছোটো আত্মভোলা দেবরটির ওপর তার আর পাঁচজনের তুলনায় কিছু বেশীই অধিকার ছিলো। তাই বাজার করা ভৃত্যের কন্যাটিকে তার বউ ক’রে ঘরে আনার সিদ্ধান্তকেও তিনি পছন্দ করেননি একেবারেই। পীরালি ব্রাহ্মণ হিসাবে দেবেন্দ্রনাথের পক্ষে এর চাইতে ভালো মেয়ে খোঁজা আর সম্ভবও ছিলোনা। কারণ একে আধা-বামুন তায় ব্রাহ্ম এমন পরিবারকে কন্যাদানে সম্মত হবে তেমন ঘর জোগাড় করাও কঠিন, সে যতো শিক্ষিতই হোকনা কেন। তো যা’ই হোক, তাঁর তরফে তেমন কিছু বাধা আসেনি।
খটকা তখনই দেখা দিলো, যখন কাদম্বরীর অন্তঃস্থিত শিল্পীসত্ত্বাটি জ্ঞানদানন্দিনীর এতোদিনের চর্চাকে ছাড়িয়ে লোকসমক্ষে উঁকি দেওয়া আরম্ভ ক’রলো। বাড়িতে সাহিত্য-আলোচনার আসর হ’লেই তাঁর আগে এই ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ মেয়েটির ডাক প’ড়তে লাগলো। মানবমনের স্বাভাবিকতা অনুসারে জ্যোতিরিন্দ্রনাথেরও একটি কিশোরীর প্রতি নজর দেওয়ার অবকাশ তেমন র’ইলোনা। এদিকে ঠাকুরবাড়ি প্রকাশিত পত্রিকার সম্পাদনারও মূল দায়িত্ব সর্বসম্মতিক্রমে কাদম্বরীই লাভ ক’রলেন। শিক্ষিতা ও বনেদী বাড়ির মেয়ে হিসেবে নিজের ক্রমবর্ধমান অভিমানে গুরুত্ব না দেওয়ার চেষ্টা ক’রেছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী। কিন্তু ঐ যে, দিনের শেষে তো আমরা মানুষই তাইনা?
সদ্য তারুণ্যে উত্তীর্ণ যে দেবরটি কাদম্বরীর থেকে মাত্র বছর দুয়েকের ছোটো ছিলো, সে কিন্তু বুঝেছিলো যে সব পাওয়ার মধ্যেও নারীর একটু হ’লেও না পাওয়া থেকেই যায়। প্রভূত সম্পদের অধিকারিণী, স্বামীর প্রেমিকা না হ’লেও স্নেহের পাত্রী, সীমিত গণ্ডীর মধ্যেও অনেকখানি যশ এসবের বাইরেও পিতৃগৃহের অদর্শন, সন্তানের অপ্রাপ্তি, নিজস্ব গুণাবলীর প্রতি স্বামীর ঔদাসীন্য যাঁকে ক্রমাগতঃ বিঁধেছিলো, তিনি কিন্তু তাঁর চিন্তার সমস্ত বিস্তৃতি ঢেলে দিয়েছিলেন নিত্যদিন নতুনতর সাহিত্যের সন্ধানে দুর্নিবার ছুটে চলা এই দেবরটির ওপর। রবি স্বয়ং এই নির্ভরশীলতা উপভোগ ক’রেছিলো, কিন্তু ব্যবহার করেনি। হয়তো শিল্পীরা এমনই হয়। নিজের সৃষ্টির তুলনায় তারা দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দিতেই জানেনা।
জ্ঞানদানন্দিনী রবির গুরুজন ছিলেন। কিন্তু কাদম্বরী ছিলেন পরমাত্মীয়া। প্রতিভার কিরণ যখন বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে অতি দূর সম্পর্কের আত্মীয়তাও তখন নিকটবর্তী হ’তে সচেষ্ট হয়। স্রষ্টা স্বয়ং যখন আলাদাভাবে কাউকে ‘জীবনের ধ্রুবতারা’ ব’লে উল্লেখ করেন, অপরেরও যে অমরত্ব প্রাপ্তির ক্ষুধা জ্ব’লে ওঠে তা বলাই বাহুল্য। অতএব কথায় কথা বাড়তে থাকে। কাদম্বরী ঘরের কোনো কাজ করেননা, পতি, শ্বশুর বা ভাসুরের সেবা করেননা, সন্তানলাভ না হওয়ায় তেমন লজ্জিতও নন। কনিষ্ঠ দেবরটির সারস্বত সাধনায় এতোখানি অংশগ্রহণ তাঁর পক্ষে আদৌ শোভন কি, যেখানে জ্ঞানদানন্দিনীর দুই ছেলে মেয়ে রবিকাকে এতো ভালোবাসা সত্ত্বেও একটি বারও সেই ঘরে যাওয়ার সময় হয়না রবির? অথচ কাদম্বরীর কাছে ফিরতে মাঝসমুদ্রে জাহাজ থামিয়ে হঠাৎ বাড়ি চ’লে আসে সে (তা সে সঙ্গীর যতো অসুবিধাই যুক্তি হোকনা কেন)।
ইংলিশ একটি বিশেষ শব্দের ব্যবহার বর্তমানে আমাদের মধ্যেও ঘ’টছে, সেটি হ’লো ‘স্যাপিওসেক্সুয়াল’। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির দৈহিক অভিব্যক্তি বা উপস্থাপনা নয়, তার ‘বৌদ্ধিক প্রকাশের যে সান্নিধ্য, তার প্রতি তীব্র আকর্ষণ’। সাদা বাংলায় ব্যক্তির মননের বিস্তৃতিতে চমৎকৃত হ’য়ে জেনে বা অজান্তে কেবলমাত্র সেইটুকুর প্রতি ধাবিত হওয়া। বিভিন্ন বিষয় থেকেই এর উৎপত্তি হ’তে পারে, কিন্তু মূলতঃ আসে জনৈকের ‘চিন্তার নতুনত্ব’ থেকে। উভয়পক্ষ পরস্পরের বিপরীত লিঙ্গের মানুষ হ’লে এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয় মাত্র। কাদম্বরী ও তাঁর দেবর মূলতঃ পরস্পরের এই অংশটুকু সমানভাবে উপভোগ ক’রতেন। এই বিষয় বুঝতে গেলে সমাজের চিন্তনে যতোখানি বিস্তৃতি প্রয়োজন তা এখনও আসেনি, সে সময় তো তা আরোই দুর্লভ।
কিন্তু রবি আর কাদম্বরীর এই সম্পর্কের ভেতরে একটি ছোটো পার্থক্য ছিলো, তার নাম ‘অবহেলা’। সম্ভবতঃ তার বিরূদ্ধে অন্তঃস্থিত বিদ্রোহ থেকেই নিজের আপাত-সর্বনাশের দিকে ধাবিত হন কাদম্বরী। ‘নতুন বৌঠান’ শব্দটি ব’ললেই যে অত্যন্ত ইতর চিন্তাভাবনাগুলি তাঁর দেবর সম্পর্কে আমাদের মাথায় আসে সেগুলির কোনোটির সাথেই উপরোক্তর সম্পর্ক নেই। কাদম্বরী ঠিক কী কী পেয়েছিলেন তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে? নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসার গঞ্জনা, ব্যস্ত এবং পরবর্তীকালে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জ’ড়িয়ে পড়া স্বামী, স্নেহের পুত্তলী ঊর্মিলার মৃত্যুর দায়, অকারণে প্রতিযোগিতা ক’রে চলা জনৈকা শিক্ষিতা ভাজ এবং ঠাকুরবাড়ির পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিপ্রদত্ত কিছু বেড়ি। একটিই মাত্র মানুষকে তিনি অকৃত্রিম বন্ধু হিসাবে পেয়েছিলেন, দুর্ভাগ্যক্রমে সে পুরুষ। জীবিতাবস্থায় যাঁর কোনো স্বীকৃতি ছিলোনা, ভারতীতে প্রকাশিত পত্রসাহিত্য কোন উপকার ক’রবে তাঁর? অমরত্ব মরণের পরেই প্রাপ্ত হয়, তার জন্য এতোদিনের ক্লেশের দায় কাকে দেবেন তিনি? সমাজ না স্বামী?
তাই “হেথা হ’তে যাও, পুরাতন। হেথায় নূতন খেলা আরম্ভ হ’য়েছে”র ধাক্কা কাদম্বরীকে একাই স’ইতে হ’য়েছিলো, জ্ঞানদানন্দিনী সেই স্থান পানওনি, অনুভবও করেননি। রবিও সম্ভবতঃ সেই নিষ্প্রাণ দেহ দেখার মুহূর্তেই কোনো এক ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে’ রূপান্তরিত হ’য়েছিলেন, যিনি জীবন দিয়ে বুঝেছিলেন, যে অমরত্ব চিরকালীন হ’তে পারে কিন্তু অমরত্ব লাভ ক’রতে কিছু করার মতো সময় নেহাতই কম। আমি কি তবে এই প্রমাণ ক’রতে চাইছি যে কাদম্বরী যা ক’রেছিলেন তা একেবারেই ঠিক? তা কখনোই নয়, কিন্তু সে দোষ তাঁর একারও নয়। তিনি কি তবে ব্যভিচারিণী? একরকম তাইই, তবে সে ব্যভিচার আমাদের পরিচিত ঘৃণ্য চারিত্রিক বিশ্বাসঘাত নয়, বিদ্রোহ তাঁকে পতিব্রতা থেকে আপামর পৃথিবীর নারীজাতির দুঃখকষ্টের প্রতিভূ ক’রে তুলেছিলো মাত্র। জ্ঞানদানন্দিনীও তাঁর নিজস্ব প্রেক্ষিতে একশো শতাংশ ঠিক ছিলেন, শুধু বুঝতে চাননি মননের জন্য নিয়মের সৃষ্টি নয়, নিয়ম স্বয়ং এককালীন মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন। রবীন্দ্রসাহিত্যে নারীমননের দুই প্রকারেরই উল্লেখ আছে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ শুধু নিজের প্রথম প্রত্যক্ষ শিক্ষাগুরুকেই আজীবন স্মরণে রেখেছেন। ‘কাদম্বরী মরিয়া প্রমাণ করিয়াছিলেন, তিনি জীবিত ছিলেননা’। কিন্তু তিনি আমাদের যে উপহারটি দিয়ে গেলেন, কোনো নারী দিবসই তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাতে যথেষ্ট হয় কি?
ধন্যবাদ।
-
প্রবন্ধ- বিভাজনের বিবর্তন
বিভাজনের বিবর্তন
– সঙ্কর্ষণ“সমাজে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার” এই বক্তব্যকে ঠিক ২টি দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। ১। উচ্চস্তরীয় ব্যক্তিবর্গের সামগ্রিক অধিকার নিম্নস্তরে এসে পৌঁছেছে। ২। নিম্নস্তরীয় ব্যক্তিবর্গের সামগ্রিক অধিকার উচ্চস্তরে গিয়ে পৌঁছোবে। লক্ষ্যণীয়, প্রথম সম্ভাবনার প্রকাশক বাক্যবন্ধে আমি ‘বর্তমান কালের’ অবতারণা ক’রেছি এবং দ্বিতীয় সম্ভাবনার ক্ষেত্রে বাক্যটি ‘ভবিষ্যৎ সূচক’।
নৈতিক বিভাজনের মাপকাঠি খুঁজলে পৃথিবীতে তা অসংখ্য পাওয়া যাবে, যেমন- আর্থসামাজিক, সাম্প্রদায়িক, লৈঙ্গিক, বার্ণিক ইত্যাদি। সত্যি ব’লতে কী, দ্বন্দ্ব ব্যতীত জীবন একপ্রকার অচল ব’লে প্রতিনিয়তই বিভাজকের তালিকা দীর্ঘ হ’তে থাকে। তাও এসবের মধ্যে যদি একান্ত একটিই মাত্র বিষয়কে বিচারের জন্য প্রাথমিকভাবে বেছে নিতে হয়, সবার আগে আসবে আর্থসামাজিক প্রেক্ষিত। সহজ ভাষায় বিভাজন ব’ললেই সর্বপ্রথম যে দুটি পক্ষের উদ্ভব হয় তারা হ’লো ধনী আর দরিদ্র। এক পক্ষ বাহু বা বুদ্ধিবলে দ্বিতীয় পক্ষের ‘প্রাপ্য’ সম্পত্তিটুকু আত্মসাৎ করে এবং দ্বিতীয় পক্ষ নিজস্ব ন্যূনতম চাহিদা পূরণের চেষ্টায় প্রথম পক্ষের স্বার্থে অনিচ্ছাকৃত শ্রম বিলিয়ে চলে। এই মেরুকরণ কেবল আজ বা কালকের নয়, এ ঘটনার প্রবাহ চিরকালীন।
এখন প্রশ্ন হ’লো, আপামর পৃথিবীই হোক বা একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্র, প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই উপরোক্ত ঘটনা নেহাত সমধর্মী হওয়া সত্ত্বেও দুই পক্ষের ভেতরে সংখ্যার বৈষম্য চিরকাল একই থাকে কেন? আরো ভালোভাবে ব’ললে এমন একপেশে থাকে কেন? বরাবর ধনিক শ্রেণী সংখ্যায় কম এবং দরিদ্র সেই অনুপাতে প্রচুর হয় কী ক’রে? কোথাও ধনী আর দরিদ্র সংখ্যায় সমানও হয়না, ধনীর আধিক্যও কোনোভাবে লক্ষ্য করা যায়না। এ কথা সর্বজনবিদিত, যে উৎপন্ন সম্পদের সবটুকু একান্ত দরিদ্রের স্বার্থবিরোধী কায়িক শ্রমেরই ফলাফল। তাও আশ্চর্যভাবে উভয়ের চরিত্র বিপরীতমুখী হয়না কখনোই।
আসলে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ অঞ্চলে উৎপাদনযোগ্য সম্পদের পরিমাণ সবসময়ই স্থির। যে ব্যক্তি আপন শ্রমেই হোক বা পরের শ্রমেই হোক, সেই সম্পদের অধিকাংশকে কুক্ষিগত ক’রে রাখতে পেরেছে সে দ্বিতীয় পক্ষ অর্থাৎ নিম্নস্তরীয়ের আপন উচ্চতায় পৌঁছোবার রাস্তা আগেভাগেই বন্ধ ক’রে দিয়েছে। দ্বিতীয় পক্ষও ক্রমাগতঃ সম্পদ হারাতে হারাতে এমন একটি জায়গাতে এসে পৌঁছেছে যেখানে তার আর হারাবার কিছুই নেই। সে ত’লিয়ে যাচ্ছে, পূর্বোক্ত অবস্থার আরোও গভীরে ত’লিয়ে যাচ্ছে। অপরের শ্রমকে ব্যবহার করার মতো বুদ্ধি বা বল কোনোকালেই সংখ্যায় অধিক লোকের থাকেনা। তাই একপেশে বৈষম্য চিরকাল থেকেই যাচ্ছে।
এমতাবস্থায়, এমন একদল লোকের উদ্ভব হ’লো যারা এই নিম্নস্তরীয়দের বোঝাতে পারলো যে সব হারালেও তারা তাদের সংখ্যাধিক্য হারাতে পারবেনা কোনোদিন। এই সংখ্যাধিক্যকে সুশৃঙ্খলভাবে সংখ্যালঘুর বিরূদ্ধে ব্যবহার ক’রলেই তারা তাদের প্রাপ্য অধিকারটুকু ফিরে পাবে। আগেই বলে রাখি মানুষ কিন্তু প্রাপ্য ব’লতে মূলতঃ তার অধিকারই খোঁজে, অর্থ বা আর্থিক সম্পত্তি নয়। প্রাপ্য বুঝে নেওয়ার মতো বোধ তার মধ্যে আসে প্রধানতঃ কায়িক শ্রমের বিচারে। ঐ যে ব’লছিলাম ‘অনিচ্ছাকৃত শ্রমের’ কথা। মাথায় ঠিক এই চিন্তাই বারংবার চলে, যে কৃষক গা ঘামালে ফসলের অধিকারী জমির মালিক কীভাবে হয়? শ্রমিক পাথরে গাঁইতি চালালে খনিজ সম্পদ মালিকের হয় কী ক’রে? জনৈক কৃষক বা শ্রমিকের আসলে ফসল নয়, তাদের শ্রমের বিনিময়ে মূল্য চাই। তা যখন হারিয়েছো, অতএব “ওয়ার্কার্স অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইউনাইট, কজ ইউ হ্যাভ নাথিং টু লুজ বাট ইওর চেইনস”।
ঠিক এইবারে আমি ঢুকবো আমার প্রথমদিকে বলা বর্তমান আর ভবিষ্যতের গল্পে। এতোক্ষণের আলোচনা থেকে এইটুকু তো স্পষ্ট, যে নিম্নস্তরীয় মানুষ কেবল একতার বলকে কাজে লাগিয়ে উচ্চস্তরীয়ের সমান অধিকার লাভ ক’রতে পারে। এখন দেখার, যে সে আপন ক্ষমতায় উচ্চস্তরে পৌছোবার প্রচেষ্টা শুরু ক’রছে কিনা? এ কাজে কিন্তু কেবল বাহুবল নয়, চাই ক্ষুরধার বুদ্ধি ও ব্যবহারিক জ্ঞানের প্রাচুর্য। একমাত্র নির্দিষ্ট দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়াই কিন্তু এর সম্পূর্ণ ফলাফল মানবজাতিকে দিতে পারে, অতএব এর সাফল্যের বিচার নিতান্তই ভবিষ্যতের গর্ভে। বরং কেবল বাহুবলের দ্বারা জনৈককে নিম্নস্তরীয়ের সমান হ’তে বাধ্য করা অনেক বেশী সহজ, প্রক্রিয়া হিসাবে অধিকতর দ্রুত এবং সাফল্যের মেয়াদও মহাকালের বিচারে অতিরিক্ত দীর্ঘ কিছু নয়। সর্বোপরি এই পথ কায়িক ব্যতীত মানসিক শ্রমকে আদৌ কোনো গুরুত্বই দেয়না।
সমস্যাও ঠিক এইখানে এসেই দেখা দেয়। নিজে ওপরে না উঠে অপরকে টেনে নামানো খুব খারাপ, এহেন সরলীকরণ ক’রে বিষয়কে ছোটো করা নেহাতই ভুল, কিন্তু আত্মিক উন্নতি না ক’রে নিয়মের নিগড়ে গোটা সমাজব্যবস্থাকে একটি না সম্পূর্ণ নিম্ন, না সম্পূর্ণ উচ্চস্তরে বেঁধে ফেললে ব্যক্তিগত পরিসরে ‘মানবাধিকারের’ নতুন প্রশ্ন উঠে আসে। আচ্ছা এ’ও কি সম্ভব, যেখানে রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষ আর্থিকভাবে স্বচ্ছল? যদি তা হয়, তবে কী হবে? কিছুই না, তখন মূল যে সমস্যার উদ্ভব হবে তা হ’লো কায়িক পরিশ্রম দেওয়ার মতো মানুষের অভাব। হিসেবমতো নিম্নস্তর অবলুপ্ত হ’য়ে যাবে। তা আমরাও তো তা’ই চাইছি। হ্যাঁ চাইছি ঠিকই, কিন্তু ব্যক্তিপরিসরে মানুষের হাতে প্রভূত অর্থ থাকলে সম্পত্তি কুক্ষিগত করার চিন্তা প্রত্যেকে নতুন ক’রে শুরু ক’রবে আর শুরু হ’লেই বৈষম্য দূরীকরণের এতোদিনের প্রচেষ্টা একেবারে ব্যর্থ হ’য়ে যাবে।
যেকোনো গঠনমূলক চিন্তা প্রধানতঃ ২টি অবস্থা থেকে জন্ম নেয়, ১। সংগ্রাম, ২। অবসর। সংগ্রাম থেকে যে চিন্তার উৎপত্তি তা মূলতঃ কারণ, কার্যপদ্ধতি ও কাল এই ৩টি অলিখিত সীমানা দ্বারা আবদ্ধ থাকে এবং ফলাফল মূলতঃ একমুখী হয়। অবসর থেকে যে চিন্তা আসে তা একটি নির্দিষ্ট কারণে উৎপন্ন হ’লেও সেই ‘কারণ’ কিন্তু একান্ত স্বতঃস্ফূর্ত। এক্ষেত্রে নিজস্ব বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গী জনৈক চিন্তককে যুগপৎ বাধা ও উৎসাহ দুইই দিয়ে দীর্ঘ সময় পর তার অভীষ্টে পৌঁছোতে সাহায্য করে। সমাজে বা রাষ্ট্রে কিন্তু উপরোক্ত ২ প্রকারেরই আশু প্রয়োজন। নিয়মের নিগড়ে সবটুকু বেঁধে একটি মানুষের মূল্য কেবল কায়িক শ্রম দ্বারা বিচার করা একান্ত নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের জন্য চিন্তা ক’রছে সে আপাতদৃষ্টিতে হাত গুটিয়ে ব’সে থাকলেও তার দায়িত্ব অবশ্যই রাষ্ট্রের। একটি রাষ্ট্র সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার চিন্তককে পৌঁছে দিতে বাধ্য, তাতে শ্রমিক বা কৃষকের যতোই আপত্তি থাকুকনা কেন। অবসর থেকে উৎপন্ন চিন্তা ন্যূনতম চাহিদা পূরণের প্রচেষ্টা বজায় থাকলে আসেনা কখনও। যে ব্যক্তি ন্যূনতম চাহিদা পূরণের পাশাপাশি চিন্তা করে, তার চিন্তা সংগ্রামের। বৃহত্তর ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে সংগ্রাম মূলতঃ তত্ত্ব আর অবসর স্বয়ং বৃহত্তর ক্ষেত্রের বিস্তৃতি।
‘সাম্যবাদ’ আর ‘মার্ক্সবাদ’ কি এক? উত্তর হ’চ্ছে “না”। সাম্যবাদ বা বৈষম্য অপনয়নের বিজ্ঞানসম্মত প্রচেষ্টা সারা পৃথিবীতে বহুকাল যাবত হ’য়ে এসেছে, এমনকি ভারতেও হ’য়েছে। শ্রী সুভাষচন্দ্র বোস তাঁর একটি রচনায় জানিয়েওছিলেন, লেনিন বা মার্ক্স নয়, ভারতবর্ষ সাম্যবাদ শিখবে তার নিজস্ব দর্শন থেকে। আসলে লেনিন রুশ বিপ্লব আনতে পেরেছিলেন মার্ক্সীয় সাম্যবাদের ব্যাখ্যাকে হাতিয়ার ক’রে। তাই তাঁর হাত ধ’রেই সারা পৃথিবীতে সাম্যবাদ আর মার্ক্সবাদ সমার্থক হ’য়ে উঠেছিলো আর সেই রাষ্ট্রব্যবস্থায় নান্দনিকতার মূলতঃ কোনো স্থানই ছিলোনা। অনেকে ব’লতেই পারেন, রাশিয়া কলাবিদ্যায়ও তো পারদর্শী ছিলো। হ্যাঁ তা ছিলো, কিন্তু সে বিদ্যা নেহাত একমুখী। সে শিক্ষা গৃহীত রাষ্ট্রনীতিকে মজ্জাগত করার প্রাথমিক স্তর মাত্র।
মার্ক্স ব্যতীত বিশ্বব্যাপী যে সাম্যবাদী দর্শন, সেখানে কিন্তু এমন জোড়াতালি দেওয়া মুখোশ পরিহিত স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থা আদৌ অভীষ্ট ছিলোনা। সাম্যবাদ আসলে আদর্শ গণতন্ত্রেরই একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা মাত্র। সে উভয় শ্রেণীর ভেতর একতা আনতে গিয়ে একটির সম্পূর্ণ বিলুপ্তি চেয়েছে, অহেতুক বিলোপের দ্বারা একতা চায়নি। উভয় শ্রেণীতে ভারসাম্যই তার লক্ষ্য, আজও হয়তো সেই বিষয় গবেষণাধীন।
এই চিরকালীন প্রশ্নেরই সম্ভবতঃ সহজতম উত্তর হ’লো, বিভাজনের বিলুপ্তি সামাজিকতায় ঘটানো, সমাজব্যবস্থায় নয়। দার্শনিককে মজুরের পর্যায়ে নামিয়ে আনায় মজুরের সম্মান আদৌ বাড়েনা, বাড়ে তাকে দার্শনিকের সমান গুরুত্ব দিলে। নিম্নস্তরীয়কে বোঝানো প্রয়োজন, যে সমাজে তার অবস্থান অনুসারে সে আসলে ব্যবস্থার একটি সুদৃঢ় স্তম্ভ মাত্র। একদিন নিম্নস্তরীয়ই স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চস্তরের খামতি ভরাট করে, স্তম্ভকে পুনরায় দৃঢ় ক’রতে এগিয়ে আসে নতুন লোক এবং এই প্রক্রিয়া চ’লতে থাকে চক্রাকারে। সুস্থ পরিবেশ কখনও বাহ্যিকভাবে সৃষ্টি করা যায়না, একাধিক সুস্থ মানসিকতাই একত্রে তার জন্ম দেয়। যে সময়ে দাঁড়িয়ে অন্যান্য দার্শনিকেরা বৈষম্যের অপসারণ দেখে কেবল চমৎকৃতই হ’য়েছেন, উপরোক্ত প্রেক্ষিত আলোচনা ক’রেছেন জনৈক ভারতীয় দার্শনিক, যাঁর প্রতিটি চিন্তন আজও বিশ্বময় প্রাসঙ্গিক…
আর ঠিক সেইজন্যই শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাদের চোখে ‘বুর্জোয়া কবি’ তারা হয় সাম্যবাদ পড়েনি, নয় সাহিত্য। প’ড়েছে শুধু মার্ক্স… আদপে তাও পড়েনি, এদিক ওদিক থেকে সে ব্যাপারে ভুলভাল শুনেছে মাত্র। কিন্ত জ্যোতিবাবুর সরকারী দপ্তর এদের থেকে একটু আলাদা। বামপন্থার মুখোশ প’রতেও যৎসামান্য ঘাঁটাঘাঁটি করা প্রয়োজন আছে যে। অতএব তাঁরা প’ড়লেন, বুঝলেন এবং ‘রাশিয়ার চিঠি’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা ক’রলেন। দুঃখের বিষয়, বাঙালি জানলোনা সাম্যবাদের গভীরতম সমস্যার সহজতম সমাধান যিনি দিয়ে গেলেন বিশ্বকবি আর নোবেলজয়ীর বাইরে তাঁর পরিচয় বেরোলোই না কোনোদিন। কিশোর কবি শ্রী সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটি স্বীকারোক্তি এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে, যে এক জীবনে একটি মানুষের যতো জিজ্ঞাস্য আসতে পারে বিশ্বকবির কলম সেই সীমানা ছাড়িয়েও বহুদূর বিস্তৃত হ’য়েছে বহুদিন হ’লো। এরপরেও কি বলা যায়, রবীন্দ্র-সাহিত্য সকলের জন্য নয়? অন্ততঃ সাম্যবাদী আদর্শের জন্য অনেকখানি তো বটেই। মনে রাখবেন, আদর্শ মানুষের জন্য, মানুষ কিন্তু আদর্শের জন্য নয়। তেমনই ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকের কলমও মানুষের জন্য, কোনো তত্ত্বের অন্ধভাবে অনুগত নয়।
ধন্যবাদ।
-
প্রবন্ধ- সাহিত্যিক- প্রকাশক- পাঠক.. কিছু প্রশ্ন
সাহিত্যিক- প্রকাশক- পাঠক.. কিছু প্রশ্ন
– সঙ্কর্ষণস্রেফ ঔপন্যাসিক হবেন ব’লে ব্যাঙ্কের মোটা অঙ্কের চাকরি এককথায় ছেড়ে দিয়েছিলেন জনৈক রাজারাম বৈষ্ণব। আত্মীয়স্বজন থেকে বন্ধুবৃত্ত সকলেই এ সিদ্ধান্তের বিপক্ষে থাকলেও তাঁকে মূলতঃ সাহস যুগিয়েছিলেন ঠিক সেই ব্যক্তিই যিনি স্বয়ং সর্বাধিক নির্ভরশীল ছিলেন তাঁর ওপর। ষাটের দশকের শেষার্ধেও শ্রীমতি রেণু বৈষ্ণবের সম্পূর্ণ ভরসা ছিলো যে সাহিত্যও অবশ্যই অর্থকরী হ’তে পারে। কিন্তু প্রথমবার এই পৃথিবীতে পা রেখেই রাজারাম বুঝেছিলেন যে সাহিত্যমনষ্কতার দেখনদারি আর আসল সাহিত্যমনষ্কতার মধ্যে দূরত্ব বড্ডই বেশী। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ ‘আবেগ’ চায়না, তারা ‘রোমাঞ্চ’ চায়। অতএব কলমে জোর নয়, চাই ‘মশলা’… আর লোকের চাহিদা সেই মশলা এবং নিজের পেটের ভাত জোগাতেই আপাদমস্তক সভ্য, ভদ্র, লাজুক রাজারামের কলমে আত্মপ্রকাশ করে ‘মাস্তরাম’… ভারতবর্ষের প্রথম ইতিহাস-স্বীকৃত ‘পর্ন রাইটার’ বা ‘অশ্লীল-সাহিত্যিক’। সেই সময় টানা প্রায় বছর দেড়েক এই চটি বইগুলি প্রতি মাসে প্রকাশিত হ’তো এবং মাত্র পঁচিশ পয়সা দামের এই বইগুলি সারা দেশেই প্রবল জনপ্রিয় হয়। ফলস্বরূপ রাজারাম নিজে প্রভূত অর্থের মালিক হওয়া সত্ত্বেও সেই পরিচয় জানাজানি হ’তেই পরিবার এবং সমাজের দ্বারা বহিষ্কৃত হন। এরপরে তাঁর কোনো সংবাদ তেমনভাবে কোথাও পাওয়া যায়না।
ভারতীয় উপমহাদেশ, তার অন্তর্গত ভারতবর্ষ, তার একটি নির্দিষ্ট জাতি, যাকে ‘বাঙালি’ ব’লে অভিহিত করা হয়, উৎপত্তিগতভাবেই তার একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আছে, যার নাম ‘ট্যাবু’ অর্থাৎ ‘আরোপিত সামাজিক নিয়মাবলী’। আপনারা ভাবতে পারেন, যে হঠাৎ এসব ব’লছিই বা কেন আমি? ব’লবো, তবে তার আগে জানিয়ে রাখি এই ট্যাবুর পেছনে মনস্তত্ত্বের একটি গভীরতর অংশের অবদান থাকে যার নাম ‘পিয়ার প্রেশার’ বা ‘আরোপিত পারিপার্শ্বিক চাপ’। উপরোক্ত পরস্পর সম্পর্কিত বিষয়দু’টি মিলে আমাদের যে দৈনন্দিন অভ্যাস তৈরী করে ঠিক তাকেই আমরা ‘কালচার’ বা ‘নিজস্ব সংস্কৃতি’ ব’লে পরিচয় দিই (যদিও সংস্কৃতির সংজ্ঞা আদৌ তা নয়) এবং যেকোনো নান্দনিকতার চর্চা (বই পড়া, গান শোনা ইত্যাদি) কোনো কারণে এই তথাকথিত সংস্কৃতির বাইরে যাওয়ার চেষ্টা ক’রলেই তাকে ‘অপসংস্কৃতি’ ব’লে দাগিয়ে দেওয়া হয়। অতএব সংস্কৃতির দেখনদারি এবং ইচ্ছার গোপনীয়তা যেখানে প্রবল, সেখানে সাহিত্য আর অসাহিত্য উভয়ের ভেতরেই সামান্য হ’লেও পরস্পরবিরোধী সত্ত্বা উপস্থিত থাকা স্বাভাবিক বইকি।
এখন প্রশ্ন জাগে বই পড়ার অভ্যাসের ওপর। যেকোনো বিষয়ই যখন বিপণনের যোগ্য হ’য়ে দাঁড়ায় তখন দু’টি পক্ষের উদ্ভব হয়, যথা- বিক্রেতা এবং উপভোক্তা। বইয়ের ক্ষেত্রে এই দুই পক্ষই ‘প্রকাশক’ এবং ‘পাঠক’ ব’লে পরিচিত হন। অর্থনীতির সাম্প্রতিকতম সংজ্ঞা বারবার এই কথাই বলে যে আমরা যখন কোনো পণ্য অর্থের বিনিময়ে ক্রয় ক’রি, আমরা কিন্তু আসলে পণ্যটির উপযোগিতাই ক্রয় ক’রি। এই উপযোগিতার জন্ম দেয় ‘ক্রেতার চাহিদা’ আর চাহিদা ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়পক্ষই তৈরী ক’রতে পারেন। যেই মুহূর্তে বিক্রেতা এই কাজ ক’রছেন, যোগ্য প্রক্রিয়ায় তা ক’রলে আরোপিত পারিপার্শ্বিক চাপই ‘একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর’ ক্রেতার চাহিদা বৃদ্ধিতে অণুঘটকের কাজ করে, কিন্তু ক্রেতার চাহিদার এক এবং একমাত্র উৎপত্তি হয় তাঁর ‘নিজস্ব প্রয়োজনীয়তা’ থেকেই। ভাবের আদানপ্রদানের মাধ্যমে সেই প্রয়োজনীয়তা এক থেকে অপরের ভেতর সঞ্চারিত হয় এবং তদোদ্ভূত চাপ ‘তৎক্ষণাৎ’ অণুঘটকের কাজ করে। বই যদি দেখনদারিতে এগিয়ে থেকে উপযোগিতায় পিছিয়ে থাকে সেটি যেমন একপ্রকার প্রতারণা, তেমনই ক্রেতার কৃত্রিম উৎসাহবশতঃ কিছু ভালো পাণ্ডুলিপি প্রচুর পরিমাণে বাজারে এসে অবিক্রীত থাকাও ভালোভাবেই দ্রষ্টব্য হয়।
এইবারে আমরা যদি বইমেলা-পরবর্তী সময়ের প্রেক্ষিতে হিসেব রাখি, আমরা কিন্তু বিক্রেতার মনস্তত্ত্ব আদৌ সেভাবে অনুধাবন ক’রবোনা। বরং খুঁজবো বিগত বছরের বইমেলা থেকে এই বছরের বইমেলা পর্যন্ত একটি বছর পাঠকের চরিত্র কী ছিলো? যদি গণমাধ্যম এবং প্রযুক্তির আগমনে পাঠকের সংখ্যা ক্রমশঃ বিলুপ্তির পথে এগিয়েই থাকে, তবে কি এই বছর তেইশ কোটি টাকার বই বিক্রী হ’তো? আর যদি তা হ’য়েও থাকে তবে মানসিকতার উন্নয়ন বা অবনমনটুকু কোথায়? প্রথমেই জানিয়ে রাখি বই বিক্রীর পরিসংখ্যানের ওপর কিন্তু আদর্শ পাঠকের পরিসংখ্যান আদৌ নির্ভর করেনা, উপরন্তু বেশ কিছু বইয়ের চাহিদা বৃদ্ধিই মানুষের পাঠাভ্যাসের পতন সূচিত করে। সময়ের সাথে সাথে বই কেনার কারণের ভিন্নতা বাড়তে বাড়তে মূলতঃ যেক’টিতে এসে দাঁড়িয়েছে সেগুলি হ’লো- ১। পড়া, ২। প’ড়ি তা দেখানো (সংস্কৃতিবান হওয়ার দেখনদারি), ৩। অর্থনৈতিকভাবে জনৈকের শক্তি প্রদর্শনের উচ্চস্তরীয় উপায় (পয়সা এতো বেশী যে জ্ঞানের চাহিদাও তার সমানুপাতিক)। যাঁরা কেবলমাত্র পড়ার জন্যই বই কেনেন তাঁদেরও ২ ভাগে ভাগ করা যায়, ১। তথাকথিত উপভোক্তা, ২। অনুসন্ধিৎসু। তথাকথিত উপভোক্তা অর্থাৎ যাঁরা বইকে আর পাঁচটি বিনোদনের উৎসের মতোই একটি হিসেবে দেখেন, তাঁরা হ’চ্ছেন সংখ্যাগুরু… প্রকাশক ব্যবসার পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ ক’রেন মূলতঃ এঁদেরই হুজুগের ভিত্তিতে। দ্বিতীয় পক্ষের মূল উদ্দেশ্য হ’লো জ্ঞানের পথ ধ’রে বৃহত্তর পরিসরে চিন্তার বিস্তৃতি… ব্যবসার সুনাম বজায় রাখতে জনৈক প্রকাশক এঁদের গঠনমূলক চিন্তাধারার ওপর নির্ভরশীল হন। এখন এই টানাপোড়েনের ভেতরেই লেখক নিজস্ব কর্তব্য স্থির করেন। লেখক যদি কেবল ‘নিজেকে খাইয়ে-প’রিয়ে বাঁচাতে চান’ তিনি বাজারচলতি হাওয়া বুঝে কারখানার ‘শ্রমিকের’ ন্যায় পণ্য তৈরী ক’রে জনৈক ব্যবসাদারকে সরবরাহ করেন। কিন্তু তিনি যদি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসাবে ভাষার ব্যবহারে ‘নিজের কলমকে সমাজের প্রতিবিম্ব হিসাবে তুলে ধ’রতে চান’ সেক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর বাজার স্বয়ং তাঁর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। দ্বিতীয় জাতের লেখকেরাই মূলতঃ একটি কৃষ্টিকে বহন করেন এবং স্বীকৃতি দিয়ে তাঁর নয়, তাঁকে দিয়ে স্বীকৃতির মর্যাদা বর্ধন করা হয়।
ঠিক এইবারে আমরা ঢুকবো বর্তমান পাঠকের মনস্তত্ত্বে। এখন মূলতঃ বই প’ড়ছে কারা? নব্বইয়ের দশকে জন্ম যাদের তারা। তারা কি রবিঠাকুর প’ড়েছে? না। শরৎবাবু? না। বিভূতিভূষণ? না। কেন পড়েনি? কঠিন বাংলা তারা বুঝতে পারেনা। তারা বাংলা মাধ্যমে প’ড়েও বাংলা বোঝেনা কেন? কারণ ইশকুলের বাংলা ক্লাসের ৪০ মিনিট ব্যতীত বাংলা নিয়ে তারা কখনও ভাবেইনি। তার ফলে কী হ’য়েছে? তার ফলে তারা আমাদের চিরাচরিত সাহিত্য এবং তার প্রাণপুরুষ যে ‘আবেগ’ তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বিদেশী ভাষার রঙিন বইয়ের ছবির দিকে ঝুঁকেছে। তাতে কী যায় আসে? ভাষাকে উন্নততর ক’রে প্রকাশের প্রচেষ্টায় অবহেলা দিনকে দিন দৃশ্যমান হয়। বিদেশী সাহিত্যে কি তবে আবেগ বা কল্পনার স্থান নেই? না, কারণ পাশ্চাত্য মানসিক বিকাশের প্রাথমিক স্তরেও ‘আবেগ মিশ্রিত পরাবাস্তববাদে’ বিশ্বাস করে। আমরাও তো বিনা ছবিতে অমন বইই প’ড়েছি, তবে এদের অসুবিধা কীসে? কারণ উপায়ান্তর না থাকায় তখন বইয়ের সাথে ল’ড়ে কথিত ঘটনার ছবি নিজেদেরই মাথার ভেতর এঁকে নিতে হ’তো, এখন অন্তর্জাল সরাসরি ছবির জোগান দিচ্ছে। তবে কি কেউই বই প’ড়তে বা পড়াতে চায়না? নিশ্চয়ই চায়, কিন্তু যে তৃতীয় বিশ্বের দেশে কোটিতে একজনের অন্নসংস্থান হয় সেখানে মানুষের সাহস, সময় বা ধৈর্য কোনোটিই অবশিষ্ট নেই। ইংলিশ বইয়ে কি তবে সবই পড়া খুব সোজা? কখনোই নয়, কিন্তু যে ভাতের যোগান দেয় সে’ই আপন যে দেয়না, সে পর… সে মানুষ হোক বা ভাষা। বই যে শুধু আনন্দ ক’রতে পড়া যাবেনা, তা কোথায় বলা আছে? কোথাওই বলা নেই, ফলস্বরূপ আমাদের তরুণতর প্রজন্মের কোনো দর্শন নেই, আদর্শ নেই, জ্ঞান নেই, প্রশ্ন নেই, চিন্তা নেই। আমরা বই প’ড়বো, কিন্তু আত্মস্থ ক’রবোনা। রোমাঞ্চিত হবো, কিন্তু শিখবোনা। মনে দাগ কাটবে, কিন্তু মনে রাখবোনা। তবে কি শিশু-কিশোর সাহিত্য প’ড়বো? নাহ্ ঐ ‘চাঁদের বুড়ি’, ‘মামদো ভূত’ বা ‘ফেলুদা-ব্যোমকেশের’ মতো অতো বালখিল্য জিনিস তো সংগ্রহের শোভা বাড়াবেনা।
অতএব এমন কিছু ক’রতে হবে যাতে সাপও ম’রবে, কিন্তু লাঠিও ভাঙবেনা। অবাস্তবের ভিত্তিতে অলৌকিকের রোমাঞ্চ যখন শেষ, তবে ‘বাস্তবের’ ভিত্তিতে অলৌকিকের রোমাঞ্চ উপভোগ করা কেন নয়? লেখকরাও তো আগে পাঠকই, তাঁরাও তো বোঝেন ঠিক কোন বিষয়টি পুরোনো হ’তে কতোদিন সময় লাগতে পারে? অতএব পরপর ইতিহাসভিত্তিক, তন্ত্রভিত্তিক, বিজ্ঞানভিত্তিক, জীবনীভিত্তিক ঔপন্যাসিকে ছেয়ে গেলো বইমেলা। পাঠকের একবারে দ্বিমুখী সাধ মিটে গেলো, মনোগ্রাহী ক’রে লেখা ব’লে পড়ার খাটনি তো হ’লো না’ই, উপরন্তু মাদকের নেশার মতো “শেষে কী হ’লো”র রোগ দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেলো, তা আবার সত্যি ঘটনায়। বাংলার ‘অলৌকিক সাহিত্য’ তার সহজাত সারল্য হারিয়ে উন্নীত হ’লো ‘হরর অকাল্ট জঁনরে’ (আধিভৌতিক মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণী সাহিত্য) এবং ‘ডার্ক ফ্যান্টাসি জঁনরে’তে (যৌনতাভিত্তিক আধিভৌতিক মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণী সাহিত্য)। সত্যি ব’লতে কী, উপরোক্ত বিষয়গুলির যাঁরা লেখক তাঁদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ থাকবো শুধু এই কারণে, যে তাঁরা তাঁদের গবেষণালব্ধ ফলাফলের অসামান্য প্রয়োগে আমাদের অজস্র অজ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে অবহিত ক’রেছেন। অপরদিকে এঁরাই পরোক্ষে একটি প্রজন্মকে লালন ক’রে এইখানে এনেছেন যেখানে আট বছরের ছেলে থেকে ত্রিশ বছরের যুবক প্রত্যেকের জ্ঞান সম্পর্কে অন্বেষণ ঐ উপন্যাসটুকুতেই সীমাবদ্ধ। বিনয় মজুমদারের জীবনভিত্তিক উপন্যাস কিনতে যতোখানি উৎসাহ বর্তমান, তা যদি বিনয়বাবুর স্বরচিত জীবনদর্শন সম্পর্কে থাকতো, কবিতীর্থ, গাঙচিল, অনুষ্টুপের বইগুলির এতো অযত্নও হ’তোনা, মেরুদণ্ডহীন এই জাতিটিরও হয়তো প্রাপ্তির ঝুলি আয়তনে খানিক বৃদ্ধি পেতো।
সবশেষে ব’লি, এই বইমেলায় সবথেকে বেশী অপমানিত যদি কেউ হ’য়ে থাকে তা হ’লো কবিতা। শুনতে একটু খারাপ লাগলেও ব’লবো, সাহিত্যের আধুনিকতর ও গভীরতম এই শাখাটিকে অনুধাবন করার মতো এই মুহূর্তে বাংলায় কোনো পাঠকই নেই, কবি অনেক দূরের কথা। সাহিত্য, বিশেষতঃ কবিতার যেহেতু নির্দিষ্ট কোনো মাপকাঠি নেই, সেজন্য অযোগ্য লোকের সংখ্যা এখানে অত্যন্ত ব্যাপক হারে ক্রমবর্ধমান, আবার একই কারণে যোগ্য মানুষের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমানও বটে। একটি গোটা শতকে যেখানে সর্বাধিক ৪ থেকে ৫জন ‘লিখিয়ে’ সময়ের প্রতিচ্ছবি হিসেবে কবিত্বের শিরোপা ধারণ ক’রতে পারেন, সেখানে ‘১৫০ কবির ১৫০ বই’য়ের মতো একটি প্রকল্প একত্রে অত্যন্ত হাস্যোদ্রেককারী এবং বিরক্তিকর। জানিনা, শক্তিবাবু বেঁচে থাকলে আজ ঠিক কী প্রতিক্রিয়া দিতেন, যখন তিনি দেখতেন যে রাম-শ্যাম-যদু-মধু প্রত্যেকেই মোটা অঙ্কের বিনিময়ে নিজেদের জঘন্য রচনাগুলিকে বুক চিতিয়ে জনসমক্ষে কবিতা ব’লে চালিয়ে দিতে পারে। প্রকাশকেরা যেহেতু নিজে আর্থিক ঝুঁকি আদৌ নিচ্ছেননা, নির্বাচনে শৈথিল্য দেখিয়ে পাণ্ডুলিপির যোগ্যতা পরীক্ষা ক’রছেননা তাঁরাও। ফলস্বরূপ কবিতার প্রেক্ষিতে পাঠক পুরোনোর পাশাপাশি উৎসাহ হারাচ্ছেন নতুন কলমেও আর এই তথাকথিত কবিদের বিপণন (যা সোজা কথায় ভিক্ষাবৃত্তি) কবিতা থেকে মানুষকে দূরে ঠেলে চ’লেছে ক্রমাগত। তো কবিতা, গল্প ইত্যাদির অবস্থা যা’ই হোকনা কেন, বেশ কিছু ভালো গবেষণামূলক বই ও পরিচিতদের উপহারে বইমেলার সুস্মৃতিটুকুই বজায় থাকবে। অব্যবস্থা যেটুকু ছিলো, তার দায়িত্ব তো আর আমার নয়। এটুকুই বলার যে লেখক, পাঠক, সম্পাদক ও প্রকাশক প্রত্যেকেই পরস্পরকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেন। বই প’ড়ুন শুধু আনন্দ ক’রতে নয়। বইকে সংগ্রহ করার মতো বইয়ের থেকেও সংগ্রহ করা যায়। চিন্তার বিস্তৃতি না থাকলে জাতি এগোবে কী ক’রে? আসুন এবারে সাবালক হ’ই। আরেকজন রাজারামের অন্তর্গত সাহিত্যিকটিকে মশলার খোঁজে আমরা মেরে ফেলতে পারিনা, তাই না?
ধন্যবাদ।
-
প্রবন্ধ- যে পথে দাঁড়িয়ে
যে পথে দাঁড়িয়ে
-সঙ্কর্ষণ১৯৫৩ সাল নাগাদ সোভিয়েত রাশিয়াতে প্রতিষ্ঠিত শিল্পী ও একটি বিশেষ শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসাবে সম্মানিত হ’য়েছিলেন জনৈক আমেরিকান। ভালোবেসে ফেলেছিলেন অবিভক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসনব্যবস্থাকে। রাজনৈতিক নেতৃস্থানীয়দের সে কী আন্তরিকতা, কতো রাজকীয় আতিথেয়তা তাঁর প্রতি। আপন দেশের ‘একুশে আইনের’ গেরোয় তো তাঁর চলাফেরার স্বাধীনতাটুকুই কেড়ে নেওয়া হ’য়েছিলো, এখানে এসে একঝলক টাটকা বাতাস পেয়েছিলেন তিনি। সারাজীবন থেকেই যাবেন ব’লে ঠিক ক’রেছিলেন। টানাপোড়েনটুকু জেগে উঠলো তখনই, যখন তিনি বেশ কিছুদিন সেই দেশে থেকে নিজেকে সামান্য গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেলেন। বিভিন্ন মানুষের বিশেষতঃ শিল্পীর সাথে আলাপচারিতার সুযোগ পেলেন, বই পড়ার সুযোগ পেলেন। ইতিহাস সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ চিরকালীন। তিনি আরো সমস্যায় প’ড়লেন, যখন দেখলেন যে ঠিক ক’রে খুঁজলে নিজের জাতিটি সম্পর্কেও এমন মেলাই তথ্য পাওয়া যায়, যা তিনি জীবনে ভাবেনইনি।
‘বাক্যালাপ’ আর ‘বার্তালাপ’ দুইয়ের ভেতর কিন্তু যথেষ্ট পার্থক্য বর্তমান। প্রথমটিতে যেখানে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির ‘মৌখিক হৃদ্যতার’ পরিচয়টুকুই পাওয়া যায়, সেখানে দ্বিতীয়টি কিন্তু ‘ভাবের আদানপ্রদান’ সূচিত করে। ন্যূনতম দুটি লোক যদি পরস্পরের সাথে মনের ভাব বিনিময় করে, উভয়পক্ষেরই পূর্বে পোষিত মতামতে বিপক্ষ চিন্তার অতি সামান্য স্পর্শ হ’তে বাধ্য। তাই উপরোক্ত ব্যক্তিও যখন প্রাচ্যের এক সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ ক’রলেন, স্বাভাবিকভাবেই মনোভাব খানিক পাল্টে গেলো তাঁরও। সোভিয়েতের আসল উদ্দেশ্য ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হ’লো তাঁর কাছে। এটুকু খুবই সাধারণ চিন্তাধারা যে প্রয়োজনীয়তাই আবিষ্কারের জন্ম দেয়। তো ‘সাম্যবাদের’ প্রয়োজনীয়তা কী? সাম্য। সাম্য কোথায় প্রয়োজন হয়? অসাম্য। অসাম্য মাত্রেই কি সাম্যের জন্ম দেয়? একেবারেই নয়, অসাম্য তখনই অসহ্য হ’য়ে ওঠে যখন তা বৈষম্যের জন্ম দেয়। বৈষম্যকে কে সূচিত করে? বিপাক্ষিক বিদ্বেষ। তাহ’লে বিদ্বেষ আর বৈষম্যে পার্থক্য কোথায়? যখন বিদ্বেষ অত্যন্ত গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছে যায় সে বিপক্ষকে ‘নিপীড়কে’ রূপান্তরিত করে, বৈষম্য বিপক্ষের ব্যক্তিগত পরিসরেই সীমাবদ্ধ থাকে। নিপীড়কের হাত ধ’রে কার উত্থান হয়? নিপীড়িত। নিপীড়িত কারা হয়? যারা নিপীড়ক দ্বারা শোষিত। আর যারা শোষিত তারা কারা? ‘দরিদ্র’, ‘সর্বহারা’, ‘মেহনতী’ মানুষজন।
অতএব সোভিয়েত ইউনিয়ন তাঁকে ‘আপামর পৃথিবীর মেহনতী মানুষের স্বার্থে’ নিজেদের অনুসৃত মতানুযায়ী ‘পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বর্ণবৈষম্যের জনৈক শিকার’ হিসাবে তুলে ধ’রতে চাইছে এবং সামগ্রিক স্বার্থেই সেই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছেন পল রোবসন। তিনি সত্যিই মনেপ্রাণে পৃথিবীর সমস্ত আর্ত মানুষের প্রতিভূ (স্বজাত, স্বদেশ নির্বিশেষে), কিন্তু ‘মার্কিন-সোভিয়েত ঠাণ্ডা লড়াইয়ে সোভিয়েতের অ্যাফ্রো-আমেরিকান টোপ’ নন। স্বদেশের সরকার কেবল কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ায় তাঁদের সাথে প্রবল অন্যায় ক’রেছে, তাঁর নিজের চলাচলের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে, ‘জিম ক্রো দর্শনের’ (কৃষ্ণাঙ্গ দ্বারাই বর্ণবিদ্বেষে সমর্থন) ভিত্তিতে শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য সমস্ত নাগরিক অধিকার খর্ব ক’রেছে, কিন্তু তাঁদের অবস্থার কথা শুনতে সোভিয়েত তাঁকে আদৌ ডেকে পাঠায়নি যতোখানি সে ক’রেছে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ সমাজে ‘কমিউনিজমের’ ধারণাকে ছ’ড়িয়ে দিতে। অন্যদিকে তাঁর নিজের দেশে যখন “রোবসন একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার” এহেন সংবাদ প্রকাশ হ’চ্ছে, সোভিয়েতের গ্রন্থাগার তাঁকে জানিয়ে দিয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের প্রাচীন সংস্কৃতি কতো বৃহৎ, তার দর্শন কতো গভীর।
সত্যকে স্বীকার ক’রতে কখনও ভয় পাননি মিস্টার রোবসন। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে তিনি মাত্র এক স্থানে মৌখিক স্বীকারোক্তি দিয়েছেন ‘তিনি সাম্যবাদে বিশ্বাসী’ আর কোথাও লিখিত বা মৌলিক কোনো মুচলেকাই তিনি দেননি। কিন্তু তিনি সেই মানুষগুলির সাথে আমৃত্যু ছিলেন, যাদের শ্বেতাঙ্গরা মানুষের পর্যায়েও ফেলেনি কোনোদিনও। তাদের তিনি নিজেদের শক্তি চিনিয়েছেন আর আমাদের চিনিয়েছেন যে বিলেত মানেই শুধু ‘সাগরপাড়ের সাদা চামড়ার স্বর্গরাজ্য’ নয়। এমনও মানুষ সেখানে আছে, যারা সংখ্যায় প্রচুর অথচ অর্থাভাবে আমাদের মতোই এককামরার বাড়িতে, এক বস্ত্রে, অভুক্ত দিন কাটায়। তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য শ্বেতাঙ্গদের সমান অধিকার চেয়েছিলেন মাত্র, তার বেশী আর কিছুই নয়। গৃহীত সাম্যবাদ, লিখিত সাম্যবাদের তুলনায় ঢক্কানিনাদে পিছিয়ে থাকলেও আসলে তার পরিসর যে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে বিস্তৃত তা তিনি নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে গিয়েছিলেন। ভারতীয় হিসাবে আমাদের প্রাপ্তি এটুকুই যে যে লোকটিকে আমরা ২বেলা গালাগাল ক’রি যে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের সমস্ত সমস্যার জন্য ইনিই দায়ী, সেই পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু কিন্তু তৎকালীন পরিস্থিতিতেও পল রোবসনের মতো একজন মানুষকে ‘মধ্যপন্থী অবস্থান’ (পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের মাঝামাঝি) সম্পর্কে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখতেন এবং সম্ভবতঃ সেই কারণেই তিনি নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণীভুক্ত করেননি। ব্যক্তিগত প্রেক্ষিতে রাজনীতি একটি দর্শন মাত্র, সামগ্রিক পরিসরে এসে তা পূর্বোক্তর ছাঁচে ফেলা পথ ধ’রে অগ্রসর হয়।
একটি বর্ণবিদ্বেষবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন দেশ, সমাজ, নেতৃত্ব ও মানুষের অবস্থা। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ঠিক কীভাবে সময় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং একটি মানুষ কীভাবে তার পরিবারের প্রভাবে ‘সমগ্র মনুষ্যত্বের প্রতিনিধি’ হ’য়ে ওঠে একটি আত্মজীবনী তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। ‘আঙ্কল টমস কেবিনের’ বীভৎসতা নয়, একটি জনজাতির সযত্নলালিত যন্ত্রণার আলেখ্য মাত্র। কল্পনা ছাড়িয়ে বাস্তবের দিকে তাকানোই তো বড়ো হ’য়ে ওঠা।
তথ্যসূত্র:- পুস্তক- পল রবসন যে পথে দাঁড়িয়ে
অনুবাদ- দীপেন্দু চক্রবর্তী -
কবিতা- ‘দ্বে-শ’
দ্বে-শ
-সঙ্কর্ষণতুমি তো কেবলই চোখে যেচে প’ড়ে বেঁধে রাখো কালো
অথচ অরুণজ্যোতি মূর্ত আঁধার জুড়ে ভ’রে দিতে আলো
জেগে থাকে… শুনেও সে চিল চিৎকার
বজ্রমুষ্টে ধ’রে পাল্লা অসার;
পরনে কাপড় দাও, এইটুকু ঢেকে আমি দূরে চ’লে যাবো।ও’পারে যাচঞা ত্রাণ
দু’হাতে জ’ড়িয়ে যারা হাসিমুখে দিলো তাতে ফেলে
বিনা দোষে জেনেশুনে মাটি নিলো আরো কতো ছেলে,
ছিলো যে আমার চোখে অন্যায়কারী…
সেসবও কথার কথা; তোমার ও আঁচলই নাকি
দিনশেষে আমাদের বাড়ি, আমি কী বিষয় পাল্টাবো?পিছিয়ে যাওয়ার আগে নির্মম থ্যাঁতলানো ঘাসে
এক মা নীরবে কাঁদে অন্যে বিলাপে ভেসে আসে।
তার চেয়ে এসো নিয়তি আলোতে ধাঁধিয়ে দিতে চোখ…এ বোবা রাষ্ট্রে সবই জিভ ছিঁড়ে অজর, অশোক।
-
কবিতা- দোষী
দোষী
-সঙ্কর্ষণযাকে বলো পাদপ্রদীপ আর যাকে তুমি বলো আলো
অন্তর থেকে দুর্বার বেগে বিদ্যুৎ চমকালো…উঠেছে যেটুকু ঝড়, হারে চেঁচিয়ে ব’লেছো “ধিক”
কখনো ভাবোনি তোমারই চিন্তা ভুল ওরা সবই ঠিক।গর্জায় কালো মেঘ আর বিজয়ীর চেরে বুক
বিবেকের ডাকে উত্তাল হাওয়া খুলে দিলো ক্ষতমুখ।আগুনের চোখে জল, জ্ব’লেপুড়ে যায় মাঠে ঘাস
অস্ত্রের সার রক্তের বীজে পৃথিবীর দেহ চাষ…যুদ্ধের অবশেষ, রাজারাজড়ার হাহা রব
এই দুঃখ আর মৃত্যু নিশ্চিহ্ন বাকি সব।পুরুষের মৃতদেহ, তাই নারীটির বাড়ি চিতা
অশ্রু মোছাতে কারা লিখেছিলো যেন মনুসংহিতা…সবারই হিসেবে ভুল আর তোমারও গোনা বেঠিক
তোমাকে দুষেছে তাকিয়ে দেখো হে যেদিকে চা’বে সেদিক।তুমি নাকি নারায়ণ আর আমি তো নেহাতই নর
ক্ষমা ক’রে দেবে নিজগুণে জানি বিঁধেছি পায়েতে শর…লীলাসম্বরে ঈশ্বর সেই তুমিও হ’লে বেঘর।
-
কবিতা- পাল্লায়
পাল্লায়
-সঙ্কর্ষণআমি জানি… এখন একটিও কথা না ব’লে
গম্ভীর মুখে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসবেন আমার বাবা।
আমাকে তিনি দেখেও যেন দেখবেননা।
আসলে তিনি চোখে দেখতে পাননা
তাই কাঁচেই কাঠিন্য ধ’রে রাখেন, আসলে ভীষণ ভঙ্গুর।এই যে আমার হাতে পায়ে এতো ধুলো কাদা
মা নীরবে ঘরে নিয়ে যাবেন আমায়…
সারা সন্ধ্যে কথা না ব’লতে ব’লতে আমি যখন
কুঁকড়ে বিছানায় শুয়ে থাকবো, মা মাথায় হাত
বুলিয়ে দিয়ে ব’লবেন, “এমনটি আর না হয় যেন”।সকাল হ’লেই দুধের গ্লাস হাতে মালীকাকার
আগাছা-নিধন দেখতে যাবো, হাঁ ক’রে দেখবো
সুন্দর ঘাসফুলগুলো নিড়ানির পানে চেয়ে
অপেক্ষা ক’রছে নিশ্চিহ্ন হওয়ার… কাকা ব’লবে
“ইয়ে দুনিয়া ইতনা বোঝ্ ক্যায়সে উঠায়েগি বেটা? “চিলেকোঠার সিঁড়িগুলো ক্যাঁচকোঁচ ক’রে ওঠে
আমি মুখ নীচু ক’রে দরজায় দাঁড়িয়েছি আজও।
ওগুলি আগে পোক্ত ছিলো বড়ো…
বাবা, তুমি কি দেখতে পাচ্ছোনা আমায়?
মা, আমি তো আজ মজা পুকুরে ডুব দিয়ে এসেছি।ভার সহ্য ক’রতে না পেরে আমি যে কুয়াশা দেখছি
সেই কুয়াশা আরেকটু থাকলে একবার জিজ্ঞাসা ক’রতাম,
“ইয়ে সিঁড়িয়া কিসকা বোঝ্ উঠা রহে হ্যায় কাকা? “অজস্র ঘাসফুল অবাক বিস্ময়ে দেখছে
মাকড়সার ঝুল স’রিয়ে
ভেতরে ঢুকে প’ড়লো এক বৃহত্তর আগাছা…“আর হবেনা, আর হবেনা” ব’লতে ব’লতে।
-
কবিতা- পাল্লায়
পাল্লায়
-সঙ্কর্ষণআমি জানি… এখন একটিও কথা না ব’লে
গম্ভীর মুখে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসবেন আমার বাবা।
আমাকে তিনি দেখেও যেন দেখবেননা।
আসলে তিনি চোখে দেখতে পাননা
তাই কাঁচেই কাঠিন্য ধ’রে রাখেন, আসলে ভীষণ ভঙ্গুর।এই যে আমার হাতে পায়ে এতো ধুলো কাদা
মা নীরবে ঘরে নিয়ে যাবেন আমায়…
সারা সন্ধ্যে কথা না ব’লতে ব’লতে আমি যখন
কুঁকড়ে বিছানায় শুয়ে থাকবো, মা মাথায় হাত
বুলিয়ে দিয়ে ব’লবেন, “এমনটি আর না হয় যেন”।সকাল হ’লেই দুধের গ্লাস হাতে মালীকাকার
আগাছা-নিধন দেখতে যাবো, হাঁ ক’রে দেখবো
সুন্দর ঘাসফুলগুলো নিড়ানির পানে চেয়ে
অপেক্ষা ক’রছে নিশ্চিহ্ন হওয়ার… কাকা ব’লবে
“ইয়ে দুনিয়া ইতনা বোঝ্ ক্যায়সে উঠায়েগি বেটা? “চিলেকোঠার সিঁড়িগুলো ক্যাঁচকোঁচ ক’রে ওঠে
আমি মুখ নীচু ক’রে দরজায় দাঁড়িয়েছি আজও।
ওগুলি আগে পোক্ত ছিলো বড়ো…
বাবা, তুমি কি দেখতে পাচ্ছোনা আমায়?
মা, আমি তো আজ মজা পুকুরে ডুব দিয়ে এসেছি।ভার সহ্য ক’রতে না পেরে আমি যে কুয়াশা দেখছি
সেই কুয়াশা আরেকটু থাকলে একবার জিজ্ঞাসা ক’রতাম,
“ইয়ে সিঁড়িয়া কিসকা বোঝ্ উঠা রহে হ্যায় কাকা? “অজস্র ঘাসফুল অবাক বিস্ময়ে দেখছে
মাকড়সার ঝুল স’রিয়ে
ভেতরে ঢুকে প’ড়লো এক বৃহত্তর আগাছা…“আর হবেনা, আর হবেনা” ব’লতে ব’লতে।
-
কবিতা- এ’পার থেকে ব’লছি
এ’পার থেকে ব’লছি
-সঙ্কর্ষণকেউ লেখা না প’ড়লে ছবি জোড়া হ’য়ে যায়।
ছেলেমেয়েগুলো বড়ো তুখোড় হ’য়ে গেছে…
রাস্তা জুড়ে ন’ড়ছে-চ’ড়ছে ওদের ভবিষ্যতের ছবি
দীর্ঘ কবিতাটিকে কখনোই পড়ানো হ’লোনা।যাকে তুমি বর্তমান বলো তেমন সময়ে
নিষ্প্রভ চোখদুটি বুজে দেখি ঘাটে ব’সে আছি।
কাজ থেকে তার বাবা ফেরেনি কখনো, প্রেমিকার
চোখে জল, মুঠো করা হাত… ভেঙে ফিরে আসি।সুকঠিন দৃষ্টিকে তোমাদের মাঝখানে ছুঁড়ে দেবো ব’লে
যে ছবি মুছেছি এঁকে, শেষে কী লিখেছি…
জাগতিক রঙ-তুলি দূরে রেখে দিয়ে
রক্তের সন্ধানে খুঁজে খুঁজে জমিয়েছি মাঠেরই সবুজ।যা কিছু দেখার কথা, আমার প্রেমিকাটিকে
কেড়ে নিয়েছিলো, ছবি রেখে গেছে।
কৈশোরে কাহিনীতে তোমাদের পা’ই পড়েনি তো,
আমারও বলার ছিলো, দরকারী কথা…কাঁচঘরে চশমা বা জামা আর ধুতি… এসবের
টান ছেড়ে জংধরা অস্ত্রটা কী দেখছো বলো,
এখনও এলোনা বলো তেমন একজন
সে অন্ততঃ একবার শুনবে, তাকাবে, বুঝবে।ছোটো এক ভোঁতা মুখ আমার নীরবতাকে
দেওয়ালে টাঙিয়ে শরীরের ওপারে চ’লে গেলো,
এই বিস্মিত বিস্মৃতি… -
কবিতা- মৃতপত্রিকা
মৃত পত্রিকা
-সঙ্কর্ষণরাত্রি নেমেছে গভীর
এ কার ষড় বুঝিনা… একই তো স্বপ্ন দেখি রোজ।
জ’ড়িয়ে রেখেছে যেন বিস্মৃত হাওয়া
জ্যোৎস্না মেখেছে দূরে আঁধার-কবিতা
একে ছেড়ে কেমনে বা জেগে জেগে উঠি?চোখের পাতায় মিঠে নেমে আসে দিন।
মাথার ওপরে গাছে ছাতা ধ’রে থাকে।
সদ্য পীড়িত কোনো উপহার এক,
যেন এখনও কিছুটা প্রাণ বাকী আছে তার…
সবুজে সবুজে এই বর্ণহীনতা বলো ভালো লাগে কেন?নীচু হ’য়ে পাতাটিকে তুলে নিতে গেলে
স্বপ্নের পর্দাটি খুলে যেন নীচে প’ড়ে যায়।
শোনো তবে সদ্যমৃত
শোনো শোনো আনমনা প্রকৃতির বিবর্ণ চিঠি,
স্পর্ধার ডাক শুনে ঘুম ভেঙে একা উঠে ব’সি।নেই সেই ফুরফুরে দিন
সাথে সাথে মিলিয়েছে চাঁদভাঙা জোনাকির আলো।
আঁধারি-কবিকে দেখে কেঁদে উঠে ভাবি
রঙ ফিরে দিতে পারি মনে ক’রি কেন…পাহাড়ে জমেছে বহুদিন ধ’রে কতো কতো মৃত পাতা।