• গল্প

    গল্প- পূর্বাশ্রম

    পূর্বাশ্রম

    -সঞ্চিতা রায় (ঝুমকোলতা)

    লেখা রান্না করতে করতে ছুটে গিয়ে ল্যান্ডফোনটা ধরল , ‘হ্যালো কেমন আছিস’? ওপারের গলাটা লেখা চিনতে পারল না। তুই তো অনেকেই বলতে পারে, সম্বোধন টা কি করবে ভাবছিল ‘ঠিক চিনতে পারছি না তো’! ‘হুম না চেনার। ই কথা’। কিন্তু বচনভঙ্গিটা যেন বড় চেনা চেনা লাগছিল লেখার ।কে হতে পারে ? ‘বর আর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে দারুণ সংসার করছিস তাই তো ?এখনো চিনতে পারলি না আমি কুশল রে কুশাল’ ’কুশল’?’ তুই এতদিন পর আমার নাম্বার কোথায় পেলি’? ‘কোথায় থাকিস তুই এখন? কাকিমা কাকু কেমন আছে’? ‘ওরে বাবারে এতগুলো প্রশ্ন একসাথে’? দাঁড়া, এক এক করে উত্তর দিচ্ছি কিন্তু ফোনে সব শুনে নিবি? একবার বাড়িতে আসতে বলবি না? নাকি তোর পতিদেবের আপত্তি আছে ,ছেলে বন্ধুকে বাড়িতে আসতে দিতে’! ‘ নারে সে মানুষটা অমন নয় আমার সব বন্ধুদের সাথে ওর আলাপ আছে’ । ‘তবে একদিন আসি তোর বাড়িতে কেমন? কিরে তোর আপত্তি আছ নাকি? ‘ একেবারেই না ,সেই ছোট্টবেলার বন্ধু তুই তোকে সত্যিই খুব দেখতে ইচ্ছে করছে!’ ‘তাহলে আজ রাখি রে, দেখা হচ্ছে তাড়াতাড়ি ‘ ।’ আমার ঠিকানাটা লিখবি না?’ ‘ আরে এতদিন পর যখন ল্যান্ড ফোন নাম্বারটা জোগাড় করতে পেরেছি তখন ঠিকানাটাও নিশ্চয়ই পেয়ে যাব রে, বা পেয়ে গেছি ধর” ” কবে আসতে চাস বল ?” ‘তুই যেদিন ডাকবি !’ ‘এই রবিবার নয় এর পরের রবিবার চলে আসিস’। ‘ বেশ তবে তাই কথা রইল আজ রাখি রে ভালো থাকিস ‘।
    ছোটবেলার বন্ধুর কথা ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরে এসে দেখে রান্নাটা তলা থেকে ধরে গেছে। কি করবে এখন ছেলেমেয়েরা যে সন্ধ্যেবেলা কাশ্মীরি আলুর দম দিয়ে লুচি খাবে বলে খুশি খুশি মনে আছে ।বর ও খুব খুশি। মা ঠাকুমার ছোটবেলা শেখানোর টিপসগুলো কাজে লাগালো লেখা। হ্যাঁ ঠিকই তো অনেকটা সামলে নেওয়া গেছে। একটু টেস্ট করে দেখলো ভালোই হয়েছে খেতে। নুন মিষ্টি ঝাল একদম ঠিকঠাক। নিজের রান্নার তারিফ নিজেই করল মনে মনে।

    হাতের ইঙ্গিতে খাবার দুর্দান্ত হয়েছে বোঝালো লেখার মেয়ে ঈশিতা। ছেলে বলল ‘মা আর দুটো লুচি দাও তো ‘বাহ! তাহলে তো রান্না করাটা স্বার্থক। ভালো হয়েছে। রান্নার লোক আছে কিন্তু ছেলে মেয়েদের জন্য এসব রান্না সে নিজে করতেই ভালোবাসে । আর নিজে হাতে লুচি ভেজে খাওয়াতে ভালবাসে ছেলেমেয়েদের । কোনো কোনো সন্ধ্যেবেলা তারা এরকম লুচি আলুর দম বা অন্য কোন পদ খায়। বর বলল ‘ গ্র্যান্ড হোটেলের কুক করে দিমু’। সবাই হেসে উঠলো। কাল রবিবার। কালকে চারজন কোথাও বেরাবে না ঠিক করেছে। ইচ্ছে করে কোনো কোনো রবিবার কোথাও বেরোয় না কেউই। একসাথে থাকাটা এনজয় করে। কাল তেমনি একটা রবিবার। তাইতো কালকে আসতে বলেনি সে কুশল কে। কিন্তু কুশালের আসার কথাটা কি এখনই বলবে? এক সপ্তাহ দেরি আছে তো পরে বললেই হবে। ‘মা ম্যাটটা লাগিয়ে দাও তো, বড্ড মশা হয়েছে’ ‘দেখিস তোর আবার শ্বাসকষ্ট না হয়! তোর তো আবার এগুলো সহ্য হয় না।’ ‘ না মা একটুখানি লাগাও আমি বন্ধ করে দেব ডিনারটা তেমন জমবে না, অনেকগুলো লুচি খেয়ে ফেলেছে কিনা সবাই মিলে। যাইহোক এত বড় রাত্রি কিছু তো খেতেই হবে। অল্প সল্প খেয়ে তারা ঘুমোতে গেল।

    রবিবারের সকালটা একটু মেঘলা। মেঘলা দিন বড্ড ভালোবাসে লেখা খুব মিষ্টি মিষ্টি লাগে এই ওয়েদারটাকে তার। বৃষ্টি পড়ছে না তবে রোদের তেজ একেবারেই নেই । একসঙ্গে থাকা রবিবার গুলো তারা খুব আনন্দে কাটায় একসঙ্গে জল খাবার খায়। একেক রবিবার একেক জনের পছন্দের খাবার হয়। এই রবিবার মেয়ে ইশিকার পছন্দের খাবার হয়েছে। ঘরোয়া করে ধোসা তৈরি করেছে লেখা। আজকে রান্নার মেয়েকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে নিজেদের মতন করে কাটাবে বলে দুপুরবেলা মুড়িঘন্ট আছে মেয়ের পছন্দের। আর ফ্রাইড রাইস নয়, ভাতটাকে একটু বিশেষ কায়দায় ভেজে নিয়েছে। খাবারটা মেয়ে খেতে খুব ভালোবাসে । দুপুরে খেতে বসে লেখা বলল ‘তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি তোমার সঙ্গে পরামর্শ না করেই আমি সামনের রবিবার আমার এক বন্ধুকে আসতে বলে দিয়েছি ’।‘আমার সঙ্গে পরামর্শ করার কি আছে তোমার বন্ধুরা তো মাঝে মধ্যেই আসে। ‘এ বন্ধুটা পুরুষ কিন্তু !’ ‘কেন তোমার কোনো পুরুষ বন্ধু আগে বাড়িতে আসেনি বুঝি’ ? আমাদের তো বন্ধু বান্ধবীদের জন্য দরজা খোলা। আমরা তো এসব নিয়ে কখনো কোন আলাদা করে কথা বলি না। বাই দ্যা ওয়ে নাম কি তোমার বন্ধুর?’ ’কুশল’ ‘ও বাবা এর নামটা শুনেছি বলে মনে হচ্ছে না! কি স্মৃতিরতলে তলিয়ে গেছিল নাকি?’ না গো, এ আমার স্কুল বেলার বন্ধু। খুব ভালো বন্ধু উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছি তারপর ওর বাবার বদলি হলো প্রথম কিছুদিন যোগাযোগ ছিল পরে কেমন করে আস্তে আস্তে যোগাযোগ কেটে গেল। তারপরেই এত বছর পর কালকে হঠাৎ ফোন করলো। জানিনা কিভাবে নাম্বার পেয়েছে তবে ছোটবেলার বন্ধু তো আসবে শুনে ভালো লাগছে গো ‘। ‘কোন বিশেষ ব্যাপার আছে নাকি ? ‘ধুর্ তুমি না সবসময় ইয়ার্কি কর’ ‘ না তাই বলছিলাম আরকি। মুখটা যেন কেমন রা রাঙ্গা রাঙ্গা হয়ে যাচ্ছে’ ‘ মা, তোমার বয়ফ্রেন্ড না কি গো? ছেলে ফুট কাটলো। ‘মারবো ‘ ‘দেখো বাবা তাহলে তো বেশ হয় মায়ের বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে আলাপ হবে’ মেয়ে বলে উঠলো ।’এই তোরা কি আরম্ভ করেছিস রে? আমি কিন্তু না করে দেব আসতে’। ‘আমরা একটা নতুন আনন্দ করবো রবিবার দিন ,কবে যে দিনটা আসবে মা তোমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে আলাপ করব কি মজা কি মজা! ঈশিতা বলছে। ’মারবো কিন্তু একদম ইয়ার্কি মারবি না’। ‘তোমার বন্ধুকে খুব গম্ভীর প্রকৃতির নাকি’?‘ না রে ও ভীষণ আলাপি। খুব মজা করতে ভালোবাসে অবশ্য এতদিন পরে সে কেমন হয়েছে সেটা ঠিক বলতে পারবো না’।

    একটা গাড়ি এসে থামলো বাড়ির সামনে। একি কুশলের সঙ্গে লেখার মেয়ে নামছে। কি করে হলো? ও আচ্ছা, আমি একটা ছোট্ট কাগজের মোবাইল নাম্বারটা লিখে রেখেছিলাম সেখান থেকে দুষ্টু মেয়েটা যোগাযোগ করেছে আর কোথাও থেকে ঠিক ধরে নিয়ে গাড়িতে উঠে পরেছে। ‘কি রে? চিনতে পারছিস দেখ তো ভালো করে’ ’হ্যাঁ রে, তোর মুখটা তো একই রকম আছে। শুধু বয়সের ছাপটা পড়েছে !’ ’বলছিস আমাকে তো সবাই এখনো ইয়াং বলে, এই যে তোর মেয়ে বলল একটু আগে বাহ তুমি কি ইয়াং আছো গো?’ তুমি মায়ের বয়সী মনে হচ্ছে না আমার মা টা বুড়ি গেলো’ । ‘ব্যাস আমার মেয়ের পাকামো শুরু হয়ে গেছে’। ‘আরে নারে ওর সঙ্গ টা খুব এনজয় করতে করতে এলাম যেটুকু সময় একসঙ্গে এলাম। খুব ভালো মেয়ে তোর। আরে বাবা দরজা দাঁড়িয়ে সব কথা বলবি নাকি ভিতরে যাব’? ‘ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসি, হ্যাঁ আমার আবার কোথাও থেকে এসে স্নান না করলে হয় না আমি টুক করে স্নান করে আসি ’ কি সুন্দর একটা গন্ধ বের হচ্ছে ‘কুশল মামা তুমি কি সাবান মেখেছো গো ’?সেই ছোট্টবেলা থেকে এখনো ছেলেটা একই সাবান ব্যবহার করে, এই গন্ধটা খুব ভালবাসতো লেখা। মা-বাবাকে বলতো ওই সাবানটায় কিনে এনে দিতে। মাঝেমধ্যে চুপচাপ নিজের জমানো পয়সা থেকে কুশল সাবানটা কিনে দিত লেখাকে। হঠাৎ করে ছোট্টবেলাটা মনে উঁকি দিল লেখার । ‘পুরানো সেই দিনের কথা সে কি ভোলা যায়’? ‘হ্যাঁ এবার একটু চট করে খেয়ে নে, জল খাবারটা খেয়ে তাড়াতাড়ি চল আমরা আড্ডা মারবো’। ‘রান্নার লোক রান্না করছে? তুই আমাকে রান্না করে খাওয়াবি না’? ‘হ্যাঁ রে খাওয়াবো’। কয়েকটা পদ আমি রান্না করবো। তোর প্রিয় খাবার গুলো এখন ও আমার মনে আছে। ’। ‘তোর বর কোথায় ’?‘ওর কথা আর বলিস না! তোর পছন্দের জিনিসগুলো জেনে নিয়ে ছুটেছে বাজারে’। ‘বাবা তোর বড তো বিশাল উদার লোক রে’। ‘তা বলতে পারিস এই ব্যাপারে আমি খুব লাকি রে ওকে পেয়ে সত্যিই আমি খুশি’। হালকা একটা বিষাদ কি উঁকি দিল কুশালের মুখে? ঠিক বুঝতে পারল না লেখা। ‘এই বাজারটা ধরো, এসে গেছি আরে কুশল বাবু এসে গেছেন ’ ‘আবার বাবু টাবু কেন নাম ধরে বলো, আর আপনি নয় তুই তুমি যা খুশি বলো ’। বেশতো! তুমি বলেই না হয় বললাম তুই এ নামার মত জায়গাতে এখনো পৌঁছাযইনি ,কখনো যদি পৌঁছাই তখন তুই বলব। আমার বউটি দেখছি খুব খুশি খুশি, পুরনো বন্ধুকে পেয়ে’।

    ‘চল চল তোর বাগানটা দেখে আসি বাহ!খুব সুন্দর ফুল ফুটিয়েছিস তো! বেগুন গুলোর সাইজ তো হেবি নিয়ে যাব যাওয়ার সময় দুখানা। জানিস তো আমি বেগুন পোড়া খেতে খুব ভালবাসি । মনে পড়ে আমরা কেমন বাগানের ফসল নিয়ে প্রতিযোগিতা করতাম। কার বেগুন গাছে কত বেশি বেগুন আসে কারটা কত বড় হয়! জৈব সার, ইউরিয়া ,নানা রকম সার কম্পিটিশন করে দিতাম দুজনে বল!‘তুই এখনো বাগান করিস’? ‘নারে!কোথায় বাগান করবো? আমার তো দু কামরার এক চিলতে ফ্ল্যাট আর আমি তো ঘুরে ঘুরে বেড়াই’। ‘কাকিমা কাকু কোথায় আছেন ’?‘ মা বাবা ফ্ল্যাটে থাকতে চাননা। তারা আমাদের দেশের বাড়িতে চলে গেছেন। ওখানে বাগান নিয়ে ফুল নিয়ে গাছ নিয়ে বেশ ভালো আছেন। কাকু কাকিমা মানে তোর মা বাবা কেমন আছেন? ‘ওরাও ভালোই আছেন। কখনো আমার কাছে এসে কিছুদিন থাকেন, কখনো ভাইয়ের কাছে থাকেন। আবার বেশিরভাগ সময় নিজেদের মতো নিজেদের বাড়িতেই কাটান।’ ওই বাড়িতে ওরা আছে রে যে বাড়িতে আমি ছোট থেকে বড় হয়েছি ’। ‘ও নাইস! ওই বাড়িটা এখনো আছে নারে? আমি তাহলে যাব আমাদের বাড়িটা তো বিক্রি হয়ে গিয়েছিল, এখন ওখানে একজন মাড়োয়ারী ব্যবসায়ী কিনেছেন বাড়িটা অনেক বড় করেছেন বাড়িটাকে বিশাল টাকা ওয়ালা লোক রে !মনে পড়ে, ছোটবেলায় আমরা টাকা নয় টাকওয়ালা লোকেদের টাকা ওয়ালা লোক বলতাম’। ইশিকা বলল , ‘মা তোমরা তো বেশ মজা করতে তো! । ‘তোর ছেলেটা একটু কম কথা বলে তাই না?’। ‘ হ্যাঁরে ও একটু শান্ত’ । ‘তোর বরটা আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়ল কেন রে’? ‘ওইটাই তো মুশকিল রে !বাড়িতে থাকলেও অফিসের কাজ করতে থাকে ওই জন্যই তো কিছু কিছু রবিবার আমরা ঠিক করি , একদম নিজেদের মত করে কাটাবো। ওকে অফিসের কাজ করতে দিই না সেদিন। এই আগের রবিবারেই আমরা চারজন ওইভাবে কাটিয়েছি। এর পরেরটা আবার কাটাব’। ‘ও এটা আমি এসে নষ্ট করে দিলাম না তো? নারে এটা একটা নতুন সুন্দর অভিজ্ঞতা হল। খুব ভালো লাগছে রে আচ্ছা তোর বউয়ের কথা বল । তোর পরিবারের কথা বল । ফোনে তো কিছুই বললি না সেসব’। ‘থাকলে তো বলব! ‘আমি আর ঐসব বন্ধনের মধ্যে নেই ’ ‘আর মানে? কোন সময় বন্ধনে বাঁধা পড়েছিলি নাকি’? ‘হয়তো বা পড়েছিলাম’। কি বলতে চাইছে কুশল ?লেখার মনের মধ্যে প্রশ্ন আসছে। ‘চল তোর বরের সাথে একটু গল্প করি, আরে বাবা তুই তো বিশাল রান্না বিশারদ হয়েছিস রে, রান্নার লোককে বাড়ি চলে যেতে বললি, আমি তোর রান্না খাবো বলে। আরে এত রান্না করলি কখন তুই তো গল্প করছিলি? ও আচ্ছা তোর মেয়ে বরকে নিয়ে যখন গল্প করছিলাম সেই ফাঁকে টুকটুক করে করে ফেলেছিস খুব ভালো হয়েছে রে খেতে, কাকিমার রান্নার কথা মনে মনে পড়ছে। তোদের বাড়ি গিয়ে যখন তখন ডিনার লাঞ্চ করে ফেলতাম। তোদের বাড়ির ছেলে হয়ে গিয়েছিলাম’। ‘ মা তোমরা মারামারি করতে না’? ‘হ্যাঁরে মারামারি করতাম খেলতাম ,নাটক করতাম । বেশ ছিলাম। ’ ঈশিকা আরিশান একটু বেরালো, তারা তাদের কুশল মামার জন্য গিফট কিনতে যাচ্ছে ।
    লেখা, কুশল কে টিফিন গুছিয়ে দিচ্ছে। লেখার বর একটু বেরিয়েছে। কুশল লেখার আলমারির বইগুলো দেখছে। শরৎ রচনাবলীর র দিকে চোখ পড়লো। সেই কবেকার সেই ছোট্টবেলা খেলা করছিল দুজনে খেলতে খেলতে কোন খেয়ালে লেখা হঠাৎ একটা সাদা পুতির মালা পরিয়ে দিল কুশলকে। লেখা পালিয়ে যাচ্ছিল ,কুশল ওর হাতটা চেপে ধরলো, হঠাৎ বলে বসলো,ললিতা যাস না,তুই অর্ধেক করেছিস আমি পুরোটা করে দিলাম বলে মালাটা লেখাকে পরিয়ে দিল। ললিতা! কুশল কি নিজেকে শেখর ভাবছে। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো লেখা। । তখন তো দুজনেই বইয়ের তলায় লুকিয়ে লুকিয়ে শরৎ রচনাবলী পড়তো। পরিণীতা গল্পের শেখর ললিতাকে নিয়ে আলোচনা করতো। মালাটা ছুড়ে দিয়ে পালিয়ে গেল লেখা। উচ্চমাধ্যমিকের পর কুশলের বাবা বদলী হওয়ায় কুশলরা দূরে চলে গিয়েছিল । প্রথম কিছু দিন চিঠিতে যোগাযোগ ছিল। কুশলের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল ঘটনাটা। লেখা ব্যাপারটাকে অত গভীর ভাবে নেয় নি। তবুও তার মনে একটু প্রভাব ছিল ঘটনাটার।

    নিতান্ত যখন তার জীবনে আসে তখন নিতান্ত কে তার খুব ভালো লেগে যায়। ছোট্টবেলার কবে কি ঘটনা ঘটেছিল আস্তে আস্তে মন থেকে বোধহয় একটু একটু করে দূরে সরে যায় । অনেকটা আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ডের মতো। কিন্তু কুশল লেখাকে ভুলতে পারেনি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও দীর্ঘ আদর্শন হলেও সে লেখাকে ভোলেনি।দীর্ঘ অদর্শন ও বিনা পত্রালাপেও কুশলের মনে লেখার প্রতি ভালোবাসা সদা জাগরুক ছিল। । মনের কোণে কোথায় যেন প্রেমিকার ছবি হিসেবে, স্ত্রীর ছবি হিসাবে লেখার ছবিই আঁকা ছিল। না সে প্রেমও করতে পারেনি ,বিয়েও করতে পারেনি।মনের কোণে কোথাও আশা ছিল হয়তো পরিণীতার ললিতার মত তার লেখাও তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। কিন্তু লেখার বিয়ের খবর তার কাছে গোপন থাকেনি। কষ্ট পেলেও মেনে নিয়েছিল। এই মালাটা সর্বক্ষণের সাথী ছিল তার । যেন মালাটাই তার জীবনসাথী। অদ্ভুত এক বন্ধন । বন্ধনে ধরা না দিয়েও বন্ধনে থাকা। কিন্তু না সে আর কোন বন্ধনে আটকে থাকতে চায় না। কি সুন্দর একটা সংসার লেখার। তা দেখে তার মনে হল তার ভালোবাসার জন সুখে আছে এটাই তার জন্য পরম আনন্দের। শেষের কবিতার অমিত লাবণ্যকে মনে পড়লো। মনে মনে ভাবলো, লেখার সঙ্গে তার যে ভালোবাসা সেতো দিঘি; সে ঘরে আনবার নয়, তার মন তাতে সাঁতার দেবে। না না আর তার মনও আর সেই দিঘিতে সাঁতার দেবে না। ভালবাসার ওইদিগিতে সাঁতার দিয়ে তার মন শান্ত স্নিগ্ধ হয়ে গিয়েছে। এবার তার মন যেন বলছে,‘এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলো ’। মুক্তি মুক্তি বড় আনন্দের মুক্তি। সে তো পাহাড়ে, পাহাড়ে এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ায় । জীবনধারণের জন্য বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু রোজগার করার প্রয়োজন সেটুকু করে নেয় আর বাকি সময়টা বাইক রাইড। । কখন ও বা চার চাকায় পাহাড়ে চলে যায় । বাইকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। অনেক বাইকারদের সঙ্গে তার বিশাল বন্ধুত্ব এসব নিয়ে বেশ আছে। প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে যেতে ভালোই লাগে। কিন্তু মালাটা কেন সে যেন ছাড়তে পারে নি এতদিন? এ কোন অদৃশ্য বন্ধন । ‘এবার যে আমার যেতে হবে লেখা আজকের দিনটা আমার জীবনের বড় প্রাপ্তি’। একটা দিন থেকে গেলে হতো না ’ ‘নারে আজ আমার যেতেই হবে কালকে আবার শুরু হবে ছুট, পাহাড়ের টানে বাইক রাইডে। চল তোকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসি। ঈশিকা, তুই যাবি আমাদের সাথে’? ‘না মা এটুকু সময় তুমি তোমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে একটু আনন্দে কাটাও ’ । গাড়ি করে স্টেশনের পর্যন্ত যাও এর মধ্যে তোমাদের গোপন কথাটা সেরে নাও’ । লেখার বর হাহা করে হেসে বলে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকই তো যাও যাও’। ‘ধুর তুমি না !আমি যাবই না তাহলে’। ‘ না না যাও ওনার ভালো লাগবে গাড়ি থেকে স্টেশন খুব বেশি কথা হলো না। কেমন যেন একটা অদ্ভুত নীরবতা বজায় রয়েছে । একটু দেরি আছে ট্রেন আসতে। দুজনে স্টেশনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টুকটাক কথা বলছে। ‘ চারিদিকে দৃশ্যগুলো দেখ ,তোর জন্য একটা উপহার আছে একটা ভালো উপহার আছে আর একটা অন্যরকম জিনিসও আছে বাক্সে। এখন খুলবি না। গিয়ে খুলিস। ট্রেন ছুটছে জানলা দিয়ে হাত দেখাতে দেখাতে চলে যাচ্ছে কুশল ক্রমাগত দূরে দূরে দূরে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে । কৌতূহল খুব কৌতূহল হচ্ছে লেখার। বাড়ি গিয়েই দেখব। বাড়ি এসে চুপচাপ রেখে দিলে বাক্সটা। লুকিয়ে গভীর রাতে বর ঘুমিয়ে পড়েছে ছেলে আর মেয়ে নিজেদের ঘরে। বাক্সটা নিয়ে ধীরে ধীরে ডাইনিং রুমে এলো একটা খুব সুন্দর শোপিস দুটো পায়রার। সাদা তলায় লেখা ‘ভালো থাকিস’। আর এটা কি? একটা মালা, সাদা পুতির মালা। সেই মালাটা স্মৃতিতে ডুব দিল লেখা। হ্যাঁ, সেই মালাটাই মালাটা সে একদিন পরিয়ে দিয়েছিল। তারপর বেশ কিছুদিন খুব লজ্জা পেতো কুশালের কাছাকাছি যেতে। তারপর ওরা দূরে চলে গেল। সঙ্গে একটা চিঠি।
    লেখা,
    হয়তো তোর মনের কোথাও আমি নেই, ছিলামও না ,তবুও যদি বিন্দুমাত্র থেকে থাকি সেটুকু বন্ধন থেকেও তোকে মুক্ত করলাম। আর হ্যাঁ আমিও বন্ধন থেকে মুক্ত হলাম, এই মালা যতক্ষণ আমার কাছে থাকবে সব সময় মনে হবে আমি যেন বাঁধা পড়ে আছি তোর কাছে। একটা দিনের জন্যেও মালাটাকে কাছছাড়া করিনি। কিন্তু এই বন্ধন থেকে আমি মুক্তি চাই রে!আমার ভালোবাসা ভালো আছে ,এইটাই আমার জন্য অনেক রে! মন একটা সুন্দর প্রশান্তিতে ভরে যাচ্ছে। আর কোন বন্ধন ,আর কোন পিছুটান আমি রাখতে চাই না। তোকে দেখতে ইচ্ছে করেছিল, দেখা হয়ে গেছে । হারটা রেখে গেলাম, আর কোনদিন সেই দিনটারর কথা ভাববো না । আমি সন্ন্যাসী নই ,সন্নাস নেবো ও না,নিজের মত করে নিজের ছন্দে বাঁচবো। তবু এটা যেন অনেকটা পূর্বাশ্রমের মতোই । সন্যাসীরা একটা পর্যায়ে পৌঁছে পূর্বাশ্রমকে আর মনে রাখে না। পূর্বাশ্রমের কথা মনে করে না। আমি তেমন ই এই ঘটনাটাকে আমার জীবনের পূর্বাশ্রম মনে করব। আর পিছনে ফিরে তাকাবো না । তাই মালাটা আর কাছে রাখলাম না । এতদিন প্রাণের থেকে প্রিয় বলে যাকে আগলে রেখেছি ,আজ তা ফেরত দিয়ে গেলাম। ভালো থাকিস। আমি চললাম পাহাড়ে। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরবো, সমুদ্র সমুদ্রে ঘুরবো আমি আমার মত করে খুব ভালো থাকবো রে, আর এই বন্ধন মুক্তি আমাকে আরো ভালো রাখবে।
    অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে লেখার। একদিকে মনে হচ্ছে সেও বন্ধন মুক্ত হলো,অবশ্য সে কি এই বন্ধনে কখন ও বাঁধা ছিল?সে তার বরকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। সাজানো গোছানো সংসার আছে তার। কিন্তু তবুও ভিতরে একটা কষ্টের অনুভূতিও হচ্ছে। তবে কি তার ও অবচেতনে কোনো হালকা বন্ধন ছিল?মালাটা ফেলে দেবে ভেবেও ফেলতে পারলো না। বাক্সে ভরে আলমারিতে রেখে দিল। কুশল বন্ধনমুক্ত ।লেখাও বরকে খুবই ভালোবাসে, তবুও লেখার মনে বোধহয় একটা হালকা অদৃশ্য বন্ধন থেকে গেলো,নাহলে এত কষ্ট হচ্ছে কেন?

  • গল্প

    গল্প- আদর্শ

    আদর্শ
    – সঞ্চিতা রায় (ঝুমকোলতা)

     

    আজ ছোট্ট রাইমাকে নার্সিংহোম থেকে বাড়িতে নিয়ে যাবে তার বাবা মা। এই কয়েকদিন যমে মানুষে টানাটানি হয়েছিল ওকে নিয়ে। ডাক্তার আদর্শ সেনের তত্বাবধানে একটা অপারেশান হয়েছে। বেশ বড় অপারেশান। ওইটুকু মেয়ের পক্ষে বেশ ভয়েরই ছিল। অপারেশন সফল। জয়ীর হাসি ডাক্তার আদর্শের মুখে। একজন চিকিৎসক যখন মানুষকে নতুন জীবন দেন, তাঁর মনে যে অপূর্ব অনুভূতি হয়, সেই অপূর্ব অনুভূতিতে আদর্শ র মন ভরে যাচ্ছে। সত্যি কথা বলতে বাচ্চাটির ওষুধ, অন্যান্য দরকারী জিনিস অনেকটাই আদর্শ সেনকে কিনে দিতে হয়েছে। কারণ রাইমাদের আর্থিক অবস্থা খুবই সাধারণ। অবশ্য ‘মানবিক’ নামক এই নার্সিংহোমের এইটাই রীতি । যতটা কম খরচে রোগীর চিকিৎসা করা যায়,ততটা কম খরচেই চিকিৎসা করা হয়।
    আদর্শ সেন একজন বিখ্যাত চিকিৎসক। সবাই তাঁকে ধন্বন্তরি বলে। তাঁর চেম্বারে সব সময় রোগীদের ভীড়। তাঁর সাম্মানিক বা পারিশ্রমিক অত্যন্ত কম। করোনার সময় ও তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তিনি একজন সমাজসেবক। অভাবী মেধাবীদের জন্য তিনি একটি সংস্থা গড়ে তুলেছেন। মেধাবীই বা বলি কেন সব রকম মেধার মানুষকেই তিনি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেন। যার যা প্রতিভা আছে তিনি সেই প্রতিভা বিকশিত হতে সাহায্য করেন। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা তাঁর কাছে এলে তিনি তাদের কথা শোনেন ঠিকই, কিন্তু তাদের থেকে কোনো রকম উপহার গ্রহণ করেন না। রোগীর প্রয়োজন অনুয়ায়ী একদম কম দামের ওষুধ তিনি ব্যবস্থা পত্রে লেখেন। এ ক্ষেত্রে তিনি কোনো রকম ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি দ্বারা প্রভাবিত হন না। তাঁদের কথা তিনি শোনেন শুধুমাত্র জ্ঞান বৃদ্ধি বা বাজারে রোগীর জন্য উপকারী কি ওষুধ আছে, কি কি নতুন ওষুধ এল শুধুমাত্র সেইটুকু জানার জন্য। একবার তিনি অতি সামান্য ভিসিট বাড়ানোর কথা ভেবেছিলেন, তাঁর মা তাঁকে বলেন,জীবিকার প্রয়োজনে, জীবনের ন্যুনতম চাহিদা পূরণের জন্য তোর যা দরকার সেইটুকুই ব্যাস,তার বেশী বাড়াবি না, তুই মানুষের ডাক্তার মানবিকতার প্রতিভূ। না,ভিসিট বাড়ানো হয়নি তার। – ডাক্তারবাবু আমাদের কাগজের জন্য একটা সক্ষাৎকার চাই যদি একটু সময় দেন।
    – আমার রোগী দেখার পরে আসুন।

    -শুভ দুপুর ডাক্তারবাবু
    -শুভ দুপুর
    – অভিনন্দন ডাক্তার বাবু, আদর্শ চিকিৎসক হিসাবে সরকার আপনাকে পুরস্কৃত করতে চলেছে। – ধন্যবাদ
    – এটা কি ঠিক, আপনি খুব অল্প দামী ওষুধ দেন আর তাতেই আপনার রোগীরা সুস্থ হয়ে যায়।
    – চেষ্টা করি
    – আপনার মনে হয় না এতে ওষুধ কোম্পানিগুলোর লোকসান হতে পারে?
    – একজন চিকিৎসক হিসাবে আমার তো মানুষের কথা ভাবার কথা, রোগীদের ভালো করার কথা ভাবার কথা, তাদের সামর্থের কথা ভাবার কথা, কোনো কোম্পানির সুবিদার্থের কাজ করার কথা তো নয়।
    – তাহলে বাজারে একই কম্পোজিশনে একই রকম কর্যকরী কম দামী ও বেশীদামী দুইরকমই ওষুধ থাকে, এই কথা কি ঠিক?
    – আমি এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না। রোগীকে সুস্থ করার জন্য আমার যা করণীয় আমি তাই করি এবং তাই করবো।
    – আচ্ছা ডাক্তারবাবু আপনার মেয়ে ইতিহাস নিয়ে পড়ছে, আপনার মনে হয় না বিজ্ঞান শাখায় পড়লে জীবনে উন্নতি করতে পারতো, হয়তো বা ডাক্তার হতে পারতো।
    – না আমি তা মনে করিনা, আমি মনে করি প্রতিটি মানুষের সেই কাজই করা উচিৎ,যা সে ভালোবেসে করতে পারবে, ছোট থেকে ইতিহাসের প্রতি ওর অগাধ ভালোবাসা। আমি মনে করি, ইতিহাস নিয়ে কাজ করেই ও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে।
    – তাহলে আপনার একমাত্র সন্তান ডাক্তার হল না বলে আপনার কোনো আপসোস নেই, যেখানে আপনি ও আপনার স্ত্রী দুজনেই ডাক্তার।
    – একেবারেই না, আর ও যদি ডাক্তারিতে আগ্রহীও হত, তাহলেও ওর যোগ্যতা থাকলে তবেই আমি পড়াতাম । ডোনেশান দিয়ে কখনই পড়াতাম না। আমি যোগ্যতায় বিশ্বাসী। ওর যোগ্যতা অনুযায়ী ও কাজ ঠিক খুঁজে নেবে।
    – আপনাকে সরকার একজন আদর্শ ডাক্তার হিসাবে পুরস্কৃত করতে চলেছে, আপনি খুশি? -পুরস্কারের জন্য তো কিছু করি না, মানুষ হিসাবে যা করণীয় তাই করি, তবে হ্যাঁ পুরস্কার মূল্যের ওই টাকাটা আমি মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করবো।

    -পরীক্ষা করানোর ব্যাপারে আপনার মতামত?
    – প্রয়োজন হলে করাব, কিন্তু অকারণে নয়। সবাই বলে আপনার ক্লিনিকাল আই ভীষণ ভালো, অপ্রয়োজনে পরীক্ষা করান না। মৃদু হাসি, কোনো মন্তব্য নেই।
    -আপনি কি কোনো চিকিৎসক দ্বারা অনুপ্রাণিত?
    – বলতে পারেন বোলপুরের একজন ডাক্তার, যাকে মানুষ ‘একটাকার ডাক্তার’ বলতেন তাঁর দ্বারা। তাছাড়া শ্যামনগরের একজন ডাক্তার, যিনি করোনায় চলে গেলেন, আপনারা নিশ্চয় সংবাদে মানুষের তাঁর প্রতি ভালোবাসা দেখেছেন। ওই করোনাকালেও তার শেষযাত্রায় মানুষের চোখের জল নিয়ে নীরবে তার সাথে সাথে চলেছিল। বাড়িগুলো থেকে ফুল বর্ষণ হচ্ছিল । এছাড়াও আরো অনেক ডাক্তার আজও আছেন, যারা মানুষের জন্য নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করেন, ডাক্তারীর স্বীকৃতি র সময় নেওয়া পণের মান রাখতে পারেন, বয়স নির্বিশেষে তারাই আমার আদর্শ।
    – আপনি কি মনে করেন এখনও এইরকম ভালো ডাক্তার অনেক আছেন?
    – নিশ্চয়, এই তো আজকের খবরের কাগজেই দেখলাম ,ট্রাফিক জ্যামে আটকে যাওয়া একজন ডাক্তার সঠিক সময়ে অপারেশন থিয়েটারে পৌঁছাবার জন্য গাড়ি থেকে নেমে ছুটে নার্সিং হোমে পৌঁছেছেন। কদিন আগে দেখলাম একজন ডাক্তার নিজে রক্ত দিয়ে একজন প্রসূতিকে বাঁচিয়েছেন। আমার প্রিয় লেখক বনফুল, যিনি নিজেও ডাক্তর ছিলেন। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র ‘অগ্নিশ্বর’-রা বাস্তবেও আছেন।
    – যারা ডাক্তার হতে চলেছে তাদের প্রতি আপনার বার্তা!
    – মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াক, সাম্মানিক বা পারিশ্রমিকটা মানুষের সাধ্যের মধ্যে রাখুক,অনেক মানুষ শুধু অর্থের কারণে আজও ওঝা, ঝাড়ফুঁক, হাতুরড়দের কাছে যেতে বাধ্য হয়, তাদের কথা ভাবুক। চিকিৎসা ব্যবস্থাকে মানুষের সাধ্যের মধ্যে রাখার চেষ্টা করুক। সৎ ভাবে কাজ করুক।

    – সম্প্রতি আপনার মেয়েকে বোধ হয় লোভনীয় কিছু উপহার দিতে চেয়েছিল কোনো কোম্পানি, আপনার মেয়ে প্রত্যাখান করেছে একথা কি সত্যি?
    – হ্যাঁ আমি গর্বিত, ওকে আমি ছোট থেকেই শিখিয়েছিলাম স্বার্থসিদ্ধির জন্য কেউ কিছু দিতে গেলে সেটা গ্রহণ না করতে, ও আমার মান রেখেছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। তা সে যেভাবেই হোক। রক্ত বা জিন সত্যিই বোধ হয় কথা বলে। উচ্চ মাধ্যমিকে মেধা তালিকায় আছে আদর্শ সেন। ডাক্তারির জয়েন্টে এন্ট্রাস পরীক্ষাতেও প্রথম পাঁচজনের মধ্যে। কিন্তু চরম দারিদ্র্য তাদের পরিবারের। কিভাবে পড়াবে মুকুল সেন ছেলেকে ডাক্তারি! পুরো পরিবার চিন্তায়। এতদিন তো স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা খুব সাহায্য করেছেন তাকে। বাড়িতে এসে পর্যন্ত পড়া দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। না কোনো গৃহশিক্ষক বা গৃহশিক্ষিকা তার ছিল না। কোনো নামী কোচিং সেন্টারেও তার পক্ষে পড়া সম্ভব হয়নি। সম্পূর্ণ নিজের ক্ষমতায় সে আজ সফল। বাতাস কোচিং সেন্টার থেকে তাকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তাকে শুধু বলতে হবে, যে সে বাতাস কোচিং এ পড়ে সফল, অনেক অনেক টাকা ডাক্তারী র বই সব দেবে তারা। মানিনি প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে,তাকে শুধু বলতে হবে তাদের বই পড়েই তার এই সাফল্য। বাড়ি সারিয়ে দেবে। ডাক্তারী পড়ায় আর্থিক ভাবে সাহায্য করবে। আত্মীয়দের অনেকে, পাড়া প্রতিবেশীদের অনেকেই এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে বলছে। তা নাহলে পড়বে কি করে। ছাদ ফেটে গেছে। জল পড়ছে মাথায়। দেওয়ালের জীর্ণ দশা। সামনে বিরাট অনিশ্চয়তা। কি করবে আদর্শ? বাবা মা তোমরা কি বলো?
    – তোর নাম আদর্শ রেখেছিলাম,অনেক আশা নিয়ে, জানি আমি তোকে হয়তো পড়াতে পারবো না, তবুও বলি অনেক আশায় তোর নাম আদর্শ রেখেছিলাম, বাবা বললেন। বাবার ইঙ্গিতবাহী কথা বুঝতে আদর্শর কোনো অসুবিধা হয় নি সেদিন। আর সত্যি তো সে নিজেও সততা ও সত্যের আদর্শে বিশ্বাসী । পরের দিন বাড়িতে আসা সাংবাদিকদের সে দৃঢ় কণ্ঠে জানিয়ে দিল,বাবা,মা আর স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা তাকে সাহায্য করেছে, আর যে বইগুলো সে সত্যি করে পড়েছে, সেই বই গুলোর নাম বললো। আরো বললো পাঠ্যবই খুঁটিয়ে পড়া তাকে স্কুল শিক্ষক শিক্ষিকারাই শিখিয়েছে। আর স্পষ্ট জানিয়ে দিল কোনো কোচিং সেন্টারের সাহায্য সে নেয়নি। হ্যাঁ, সেদিন তার শুরুটা খুব কঠিন হয়েছিল, অনেক প্রতিকূল অবস্থার সাথে লড়াই করে আজ তিনি সফল ডাক্তার। সেদিন যে আদর্শকে তিনি জীবনের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন, আজও সেই আদর্শ তাঁর সাথে আছে। থাকবে চিরকাল। হ্যাঁ বাবার মায়ের দেওয়া আদর্শ নাম সার্থক ।
    ( সঞ্চিতার ছোট্ট বক্তব্য- এই গল্পে ব্যবহৃত চরিত্রের নাম বা সংস্থার নাম সম্পূর্ণ কাল্পনিক । বাস্তবের সংস্থা বা চরিত্রর নামের সাথে মিল থাকলে তা অনিচ্ছাকৃত। তবে এই রকম আদর্শরা, এই রকম ভালো চিকিৎসকরা আছেন, ছিলেন ,থাকবেন আমাদের সমাজে। আর হ্যাঁ আদর্শের আদর্শ হিসাবে যে চিকিৎসকদের কথা বলা হয়েছে, তাঁরা প্রকৃতই আছেন বা ছিলেন। আর সে জন্যই সমাজটা পৃথিবীটা আজও এত সুন্দর।)

  • গল্প

    গল্প- ভূমিকার ভুমিকায়

    ভূমিকার ভুমিকায়
    – সঞ্চিতা রায়(ঝুমকোলতা)

     

     

    ভূমিকা রায়ের আজকে খবরের কাগজে অনেক বড় একটা সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর গানের শ্রোতা আজ সারা পৃথিবী জুড়ে। আর তাঁর গানের ছাত্রীরা কেউবা রিয়েলিটি শো তে প্রথম, কেউবা সঙ্গীত শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর কাছে গান শিখে অনেকেই আজ জীবনে নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত।
    সাংবাদিক- আপনার ছোট বেলার কথা বলুন ভূমিকা- যৌথ পরিবারে ভীষণ আদরের মেয়ে ছিলাম। অনেক ভাইবোনের সাথে ঠাকুমা, দাদু, জেঠিমা-জেঠু, বাবা-মা পিসিদের স্নেহ আদরে বেশ কেটেছে ছোটবেলা।
    ‘গান শিখেছিলেন ছোটবেলায়?’
    ‘আমার জেঠু, কাকু, বাবা সবাই ভালো গাইতেন, মা’ও গান জানতেন। তাই সঙ্গীত মুখর পরিবেশেই আমার বড় হওয়া।’
    সাংবাদিকরা চলে গেছেন অনেকক্ষণ। বাংলায় অনার্স করার পর বড়ির সবাই চাইলো, বিয়েটা দিয়ে দিতে ,আপত্তি করেনি ভূমিকা। নির্মাল্যকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগেছিল ভূমিকার। হ্যাঁ, খুব সুখী হয়েছিল তারা। দু’বছর পর সৌজন্য এল। ভীষণ খুশী ভূমিকা ও নির্মাল্য। ভীষণ যত্নে বড় করতে লাগলো ছেলেকে। কিন্তু হঠাৎই ছন্দপতন। নির্মাল্যর কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেল হঠাৎ। আর কোনো চাকরি পেল না নির্মাল্য। আর্থিক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হতে হতাশা গ্রাস করলো নির্মাল্যকে। একটা বেসরকারী স্কুলে যোগ দিল ভূমিকা। কিন্তু সৌজন্য যে বড়ই ছোট তখন। বাধ্য হয়ে ছোট ব্যবসা করার কথা ভাবতে শুরু করলো ভূমিকা। দু’বছর পর নির্মাল্যর আকস্মিক মৃত্যুতে ছেলেকে নিয়ে ভীষণ অসুবিধায় পরে গেল ভূমিকা। নিজের গয়নাগুলো বিক্রি করে ছোট করে ব্যবসা শুরু করলো ভূমিকা। স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে ব্যবসায় মন দিল। বেসরকারী স্কুল তো, বড়ই কম মাইনে ছিল। বাবা-মা, জেঠু আরো সবাই আর্থিক দিক থেকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ভূমিকার ছিল প্রবল আত্মসম্মান । কারুর সাহায্য ছাড়াই নিজে কিছু করার চেষ্টা করতো সব সময়। ব্যবসার পাশাপাশি ছেলেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত সেই পড়িয়েছে। গৃহশিক্ষকতাও করেছে পাশাপাশি । তার ভাল৬লাগার জগৎ গান করা, আঁকা সব হারিয়ে গেল জীবন থেকে। একা মা হিসাবে একমাত্র ছেলেকে সবটুকু দিয়ে দিল। নিজে কম খেয়ে ছেলেকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়াত। হ্যাঁ, সেই অর্থে ছেলে তাকে নিরাশ করেনি। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। বড় অঙ্কের মাইনে তার। কিন্তু !

    ‘বাবু আমার জন্য একটা পেঁপে আনবি আজ? মাংস দিয়ে খুব পেঁপে খেতে ইচ্ছা করছে রে’
    ‘তুমি জানো পেঁপের এখন কত দাম? আমাকে ফ্ল্যাটের ইএমআই দিতে হয়, অত পারবো না! পাশ থেকে বৌমার গলা ‘বাবা তো একটা বাড়িও রেখে যায়নি, সবই আমাদের করতে হচ্ছে অথচ লোলা দেখ’
    ‘কিন্তু বাড়িটাতো আমি তোকে পড়ানোর জন্যই বিক্রি…’ কথাটা শেষ করতে দিল না ছেলে।
    ‘ছাড় তো ওসব সব বাবা-মা’ই সন্তানের জন্য করে, নতুন কি করেছো তুমি? চোখের জল আসে ভূমিকার। বাড়িটা থাকলেও হয়তো নিজের মত করে যেভাবে হোক জীবনটা কাটিয়ে দিত। ছেলে একই কোম্পানিতে চাকরিরতা বান্ধবীকে বিয়ে করেছে। তিয়াসা বোস। তিয়াসা আর সৌজন্য একসঙ্গে গাড়ি করে অফিস যায়, একসঙ্গেই ফেরে। রাতে খেতে বসে, ‘এ কী খাবার বানিয়েছে তোমার মা? এত কম তরকারী!’
    ‘সারাদিন কী করো বসে বসে? আমার বউ সারাদিন খেটে আসার পর কি রান্নাও করবে?’
    ‘বাবু আমার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না একটা রান্নার লোক রাখ না!’
    ‘আমার কি টাকার গাছ দেখেছো?’ এইরকম নানা ঘটনায় জর্জরিত হতে হতে ভূমিকা খবরের কাগজ পড়তে গিয়ে দেখলো কোনো একটা ছোট পরিবারে বাচ্চা দেখা আর রান্নার জন্য লোক লাগবে। ভূমিকার মনে হল এই ভাবে অসম্মানিত হওয়ার চেয়ে খেটে খাওয়া ভাল। ফোন করলো। দেখা করতে গেল এবং কাজটা নিল। ‘তুমি কি আমার মান সম্মান সব নষ্ট করে দেবে? শেষে এই কাজ! কোনো দরকার নেই।’
    ‘আমাকে যে তোর কথা শুনতেই হবে এমন তো কথা নেই। তুই যদি রোজ আমার অসম্মান করতে পারিস, তোর সম্মান নিয়ে ভাবার দায়িত্ব আমার নয়। পারলে আমায় আটকা, আমারও কিন্তু মহিলামহল আছে।’ দৃঢ় কণ্ঠ ভূমিকার। ফোনটা বাজছে… অতীতে হারিয়ে যাচ্ছিল ভূমিকা। “ঠাম্মি আজ আমার একটু দেরী হবে, চিন্তা কোরো না কিন্তু।’
    সাজির ফোন। হ্যাঁ, এই সাজিকেই ছোটবেলা থেকে দেখাশোনা করে বড় করে তুলেছে। আজ সে সাজির নিজের ঠাম্মি হয়ে উঠেছে।

    দরজার বেলটা বাজালো ভূমিকা- ‘আপনারা কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, তাই এসেছি। ‘ছোট্ট সাজি ভূমিকার কোলে পিঠে মানুষ হচ্ছে। সাজির বাবা, মা, সাজি সবাই ভূমিকাকে খুব ভালোবাসে। সাজির বাবা মা ভূমিকাকে নিজের মায়ের মতই দেখে। সাজি ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে। একদিন সাজির বায়না সে গানের রিয়েলিটি শো তে যাবে। অডিশান দেবে। ‘কিন্তু তুই তো সেই ছোটবেলা কিছুদিন গান শেখার পর আর শিখিস নি কি করতে যাবি?’
    ‘আমাকে যেতে দাও।’
    সে কী! সাজি অডিশানে সফল হয়েছে। তার চেয়েও আশ্চর্য রিয়েলিটি শো তে সে প্রথম হয়েছে। মঞ্চে সবাই যখন হাততালি দিচ্ছে, সাজি তার গুরু মা’কে সামনে আনে। হ্যাঁ, ভূমিকাই তার গুরু মা। অনেক অনেক অভিনন্দন শুভেচ্ছা আর পুরস্কার পায় তারা।

    হারমোনিয়ামটা অনেক দিন কোনো কাজে লাগছিল না। একদিন ভূমিকা সাজিকে বলে,’আমাকে একটু বাজাতে দেবে? আমার জীবন থেকে তো বহুদিন গান হারিয়ে গিয়েছে, দেখি পারি কিনা! এত দিন চর্চা না থাকা সত্বেও ধীরে ধীরে গলা খুলে যায় ভূমিকার। ‘আমায় শেখাবে ঠাম্মি?’ গোপনে চলতে থাকে সঙ্গীত চর্চা। তারপরটা ইতিহাস। আজ অনেক অনেক বাবা, মা তাদের ছেলে মেয়েদের গান শেখাতে চান ভূমিকার কাছে। ভূমিকার আজ অনেক অনেক সফল ছাত্র ছাত্রী। ভূমিকা নিজেও আজ বড় সঙ্গীত শিল্পী। সাজির বাবা-মায়ের কাছে ভূমিকা মায়ের মত। আর সাজি তো তার নয়ন মণি। নিজের নাতনী । শিল্প যে শিল্পীর কাছ থেকে হারিয়ে যায় না, তার বড় প্রমাণ ভূমিকা। তবে সাজিই তার অনুপ্রেরণা। তার গানের স্কুলের নাম সাজি। বিনা পারিশ্রমিকেও অনেককে শেখায় ভূমিকা। আর্থিক দিক থেকে যারা পিছিয়ে তাদের জন্য বেশ কিছু ব্যবস্থা করেছে সে।

    আজ ভূমিকাকে বিশেষ সম্মান জ্ঞাপন করা হবে সমাজে তার অবদান ও তার সঙ্গীত প্রতিভার জন্য। সৌজন্য অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। না, সাড়া দেয়নি ভূমিকা।

    অনুষ্ঠান চলছে। সামনের সারিতে সৌজন্য আর তিয়াসা। একে ওকে বলছে ‘ইনি আমার মা।’ অনুষ্ঠানে যখন পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা চলছে, ভূমিকা বলে- ‘এক মিনিট, আজ আমার সব কিছু আমার নাতনী আর আমার ছেলে আর বউয়ের কল্যাণে। আমি তাদের মঞ্চে ডাকতে চাই। লোভে চোখ চিকচিক করে ওঠে সৌজন্য তিয়াসার।

    কিন্তু এ কাদের নাম বলছে ভূমিকা! অর্পণ রায়, দিব্যা রায়(সাজির বাবা মা) ও সাজি। আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন তাদের। মঞ্চ আলো করে ভূমিকা ও সাজিরা।
    ‘শুধু রক্তের সম্পর্কে কিছু হয় না, আত্মিক সম্পর্কটাই আসল। আজ এই তিন জনের ভালোবাসা আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। এরাই আমার ছেলে, মেয়ে(বৌমা)ও নাতনী। সব মা বাবাকেই বলছি, অবশ্যই সন্তানকে সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করুন, কিন্তু নিজের জন্যেও সময় রাখুন, নিজের ভবিষ্যতের কথাও একটু ভাবুন, তা না হলে সন্তান যদি পেশাগত সফল হয় কিন্তু প্রকৃত মানুষ না হয় বাবা মা পরবর্তী তে বড় অসহায় হয়ে যায়। যেমনটা আমি হয়েছিলাম। আমার ভাগ্য ভালো আমি সত্যি করে প্রকৃত মানুষ সন্তানকে কাছে পেয়েছি। নাই বা হলাম তার গর্ভধারণী তবু সে, তারা আমার জীবনের চলার পথের আলো। আমি যখন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিলাম ঈশ্বর এই আলো আমায় পাইয়ে দেন। হ্যাঁ, সবাই নিজের আত্মপরিচয় গড়ে তুলুক। আবার বলছি, বাবা মায়েরা সন্তানের সাথে সাথে নিজের ভবিষ্যতের কথাও একটু ভাবুন। হারিয়ে যেতে দেবেন না নিজের প্রতিভা। সারাদিনে একটু সময় নিজের জন্যেও রাখুন। একটু হলেও নিজের কথা ভাবুন। সবাই খুব খুব ভাল থাকুন। সারা প্রেক্ষাগৃহ হাততালিতে ভরে উঠলো।

  • গল্প

    গল্প- মুদ্রার অপর পিঠ

    মুদ্রার অপর পিঠ
    -সঞ্চিতা রায় (ঝুমকোলতা)

     

     

     

    “কাকিমা এই নাও তোমার আর কাকুর ওষুধ। তোমাদের একটা কথা বলবো সেন্টার থেকে একটা ভালো সারাদিনের বাড়ি সহকারী রাখো। অত দূর থেকে এসে আমার পক্ষে তোমাদের সব কাজ করে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, তাছাড়া আজকাল সবই অনলাইন হয়। তোমার ছেলেদের বোলো বিদেশ থেকে অনলাইন সব ব্যবস্থা করে দিতে।”
    অনুরূপার মোবাইলটা বাজছে। অনিন্দিতা ফোন করেছে। “তোর ছেলে তোদের কাজ করে দিতে পারে আর আমাদের বেলায় লোক রাখতে বলছে, কি এমন রে! তোরা থাকিস কল্যাণীতে আর আমরা কাঁচড়াপাড়া একটা তো স্টেশান। নিজের নাইবা হলাম আমরাও তো কাকু কাকিমা। আমার ছেলে আর তোর ছেলে তো এক স্কুলে আর এক ক্লাসেই পড়তো। “শোন অনিন্দিতা আমার সুনয় এখন খুবই ব্যস্ত। ওর মেয়েকে পড়া, নাচ এদিক ওদিক নিয়ে যাওয়া, নিজের কোচিং সেন্টার আবার আমাদের দুই বুড়োবুড়িকে নিয়ে বিভিন্ন টেস্ট করানো, ওষুধ আনা, ওর বাবাকে নিয়ে চিকিৎসার কারণে কলকাতা নেওয়া আরো অনেক ব্যস্ততা রে! ওর পক্ষে তোদের দায়িত্ব আর নেওয়া সম্ভব নয়, এটা অপ্রিয় হলেও সত্যি কথা। তাছাড়া তুই একবার মনে করে দেখ তো যখন এরা দুজন একই স্কুলে পড়তো তুই কি তোর ছেলে আর আমার ছেলেকে সমান চোখে দেখতিস?”

    স্কুলের পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে স্বপ্ননীল। প্রায় প্রতিটা বিষয়েই পুরোয় পুরো নম্বর। স্কুলে সবাই ধন্য ধন্য করছে। অনিন্দিতা নাকি রত্নগর্ভা। এ ছেলে অনেক বড় হবে জীবনে। অনিন্দিতাও গর্বিত মুখে সবার সাথে কথা বলছে। সুনয়(অনুরূপার ছেলে) মোটামুটি রেজাল্ট করেছে। এক থেকে দশের মধ্যে নেই। সুনয় স্বপ্ননীলের সাথে কথা বলতে এলে অনিন্দিতা কেমন যেন ছেলেকে সরিয়ে নিচ্ছে। অনুরূপা শুনতে পায় অনিন্দিতা একজনকে বলছে, “এসব ফালতু রেজাল্ট করা ছেলের সাথে আমি বাবা ছেলেকে মিশতে দিই না, ভালোদের সাথে মিশলে ওর মধ্যে আরো ভা৬ল করার মানসিকতা আসবে।” অনুরূপার ছেলের অপমানে চোখে জল আসে। ধীরে ধীরে উচ্চমাধ্যমিক। হ্যাঁ এখানেই বিশাল ভালো রেজাল্ট স্বপ্ননীলের। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে, বিশাল ভালো চাকরি, তারপর বিদেশে যাত্রা। গর্বিত অনিন্দিতা অনুরূপা আর ওর বরের সাথে দেখা হলে বলে তোরা ছেলেকে ঠিকঠাক মানুষ করতে পারিসনি। তাই তোর ছেলে সামান্য একটা কোচিং সেন্টার চালায়। আমার ছেলে দেখ্ কতো রোজগার করে। অনুরূপার বর বলে “মাফ করবেন আপনার কাছে মানুষ বা সফলের যে সংজ্ঞা আমার কাছে তা নয়। আমার ছেলে সৎভাবে রোজগার করে। কিছু কিছু দরিদ্র ছেলেমেয়েকে বই খাতাও দেয়। আর আমাদের ভীষণ যত্নে রাখে। আমার নাতনীটাও ঠাম্মি দিদা অন্ত প্রাণ। আমি মনে করি আমার ছেলে একজন সফল মানুষ।” ব্যঙ্গাত্মক হাসি হাসে অনিন্দিতা আর অনিন্দিতার বর।
    -“যতই বল আমরা ছেলে বউকে নিয়ে গর্ব করে যা বলতে পারি, বলতে পারি আমার ছেলে আমেরিকায় বড় ইঞ্জিনিয়ার বউ ও ইঞ্জিনিয়ার আর তোরা..!”
    আবার ফোনটা বাজছে। আবারও অনিন্দিতা, “তোর ছেলেটাকে একটু পাঠিয়ে দে না। আমাদের কিছু দরকারী জিনিস লাগবে!”
    “কেন তোর রত্ন ছেলেকে অনলাইন করতে বল। না রে ও খুব ব্যস্ত, ওর বউও খুব ব্যস্ত। আজকাল ফোন করারও সময় পায় না।” “কিছু মনে করিস না, যে ছেলে নিজের বাবা মায়ের খোঁজ নেওয়ার সময় পায় না তাকে আমরা সফল মানুষ মনে করি না রে! আমার ছেলে যতই ব্যস্ত থাক আমাদের জন্য তার সময় আছে। তাই আমরা মনে করি আমরাই ছেলেকে মানুষ করতে পেরেছি। তাছাড়া ওর লকডাউনের জন্য বেশ কিছুদিন ছাত্রছাত্রী কমে গিয়েছিল, আবার সবে বাড়তে শুরু করেছে, এখন ও আর সময় দিতে পারবে না। তাছাড়া ওর বাবার একটা ছোটখাটো বেড়াতে যাওয়া দরকার। আমরা সবাই তাই দীঘা যাচ্ছি। জানিস আমরা সবাই যখন কোথাও যাই, খুব আনন্দ করি। আমি তো নিশ্চিত আমাদের কোনো অসুবিধা হলে সুনয় পাশে থাকবে। আর হ্যাঁ, ও বেড়াতে যাবে বলে একস্ট্রা ক্লাস ওকে করাতে হচ্ছে রে! ওর একদম সময় নেই।
    -“আর এখন যদি তোর কিছু লাগতো সময় দিত না?”
    -“হ্যাঁ দিতো, বাস্তব সত্য নিজের মা বাবার ক্ষেত্রে যে সময়টা বার করা যায় সেটা অন্যের জন্য সবসময় বার করা যায় না রে!তোরাই তো বলতিস আমরা নাকি ছেলেকে মানুষ করতে পারিনি তা আজকে কেন এই সাধারণ ছেলেকে নিয়ে টানাটানি করছিস। তোর সফল মানুষ ছেলেকে বল, বিদেশের আয়েশ ছেড়ে তোদের দরকারে পাশে এসে দাঁড়াতে। অনেক কথা আগে শুনিয়েছিস!শোন তবে মুদ্রার একপিঠ দেখেছিস! মূদ্রার অন্য পিঠটাও দেখ। রাখি রে আমাকে আবার নাতনীর সঙ্গে লুডো খেলতে হবে মজা করে। তোদের মত নাতনীকে ভার্চুয়াল জগতে পেতে আমার আবার ভালো লাগে না। ওর নরম গাল গালে ঘষে যখন ঠাম্মি বলে আমায় আদর করে মনে হয় আমি পৃথিবীর সেরা মানুষ। রাখলাম রে!”

  • গল্প

    গল্প- জীবনের জয়গান

    জীবনের জয়গান
    -সঞ্চিতা রায় (ঝুমকোলতা)

    আজ বিশ্বকর্মা পুজো। আমাদের অফিসের সাংস্কৃতিক মঞ্চে কিছু ছোট ছোট ছাত্রছাত্রীরা তাদের নিজেদের জীবনের কথা, পরিবারের কথা, প্রতিবেশীদের কথা বলছে। না কোনো শ্রুতি নাটক, নাটিকা বা মঞ্চনাটক নয়, বাস্তব জীবনের গল্প আজ ওরা বলছে। ওদের বলা শেষ হলে করতালিতে মুখরিত প্রেক্ষাগৃহ। প্রতিবছর নাটক হয়, এবছর নাটক হয়নি বলে কারুর কোনো আপসোস নেই। এ যেন এক নতুন অভিজ্ঞতা।
    ঘটনাবহুল জীবন, জীবনের প্রতিটি বাঁকে মানুষ কতরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়, যা তার পরবর্তী জীবনের পাথেয় হয়। বাসস্ট্যাণ্ডে অফিস যাব বলে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। পরপর দুটো বাস ব্রেকডাউন। আজ বোধহয় টোটো আর ম্যাজিকে করেই অফিস যেতে হবে। “দিদি একটা ফুলের মালা নাও না! বেশী দাম নেব না” রোজই ছেলেটাকে দেখি। “আজ এখন ও একটাও বিক্রি হয়নি দিদি, নাও না একটা”। কেমন যেন মায়া হলো। বেশ অনেকটাই ছোটো ও আমার চেয়ে। তাই তুইই বললাম। বললাম “আচ্ছা দে একটা” মালা নিয়ে দাম দিতে যাচ্ছি, বললো, “দিদি আর একটা মালা তোমার খোঁপায় লাগিয়ে দিই, দেখো ভাল লাগবে”। আরেকটা মালার দাম দিতে যাচ্ছি, “না না দিদি, ওটা তোমায় আমার দিতে ইচ্ছা করলো, আমার এক মাসতুতো দিদিকে আমি একসময় এই রকম মালা গেঁথে লাগিয়ে দিতাম, খুব খুশি হতো। ওই দিদি এখন কাজে খুব ব্যস্ত, আর দেখা হয় না,তাই তোমায় লাগিয়ে দিয়ে আমি আনন্দ পাবো।” এমন সরল আব্দার না মেনে না নিয়ে পারলাম না। লাগিয়ে দিল খোঁপায়।
    “আরে ম্যাডাম, কি ব্যাপার আজ কোনো অকেশান আছে নাকি?” “এই নীলা কি ব্যাপার রে! সকাল সকাল সেজেগুজে?“ নানা গুঞ্জনে মুখরিত আমার অফিস।
    আমার ঠাকুরদাদা বেশ অনেকটা জমির উপর বড় বাড়ি করেছিলেন। বাগান করার জন্য অনেকটা জায়গা ছিল। ঠাকুমা নানা রকম গাছ লাগাতেন। ঘুম ভাঙতো ফুলের মিষ্টি গন্ধে। কত পাখি পতঙ্গ আসতো। ঠাকুমা সকাল সকাল স্নান করে সাজি ভরে ফুল নিয়ে এসে যখন সামনে দাঁড়াতেন, পবিত্র এক অনুভূতি হতো। ঠাকুমা তাঁর রাধাগোবিন্দর জন্য মালা গাঁথতেন, গোপালের জন্য মালা গাঁথতেন। আমাকে গোপালি বলতেন, আর আমার গলাতেও মালা পরিয়ে দিতেন। আমিও গাছ লাগাতাম। ভীষণ সুন্দর ছিল দিনগুলো। ঠাকুমা দাদু চলে যাওয়ার পর আমার দুই কাকু বাড়িটা প্রোমোটরকে দেওয়ার প্রস্তাব করে। বাবা রাজী ছিল না, শেষ পর্যন্ত রাজী হয়। এখন সে বাড়ি নেই। ফ্ল্যাটে থাকি আমরা। যে জমিতে শুধু আমাদের অধিকার ছিল, সে জমিতে এখন অধিকার অনেকের। এক চিলতে বারান্দায় টবে কিছু গাছ আছে মাত্র।

    বেশ কয়েকদিন তরুছায়া (আগে ওর নাম বলা হয়নি,ওর নাম তরুছায়া) আসছে না ফুল বিক্রি করতে। কেমন যেন মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছি, বারবার মনে হচ্ছে ও আসছে না কেন? সাতদিন পরে ও এলো। “কিরে আসিস নি কেন এই কয় দিন?” -”আমার দিদির পরীক্ষা চলছিল গো, আমি তাই ওর কাজটা করছিলাম, ও তো ডিম সবজি বিক্রি করে, ডিম সবজির সাথেই মালা নিয়ে বসছিলাম গো, আবার আমার যখন পরীক্ষা হবে ও আমার কাজ, ওর কাজ দুটোই করে দেবে, পড়াশোনার সাথে সাথে পেট চালাবার ব্যবস্থাও তো করতে হবে তাই না গো।”

    অফিসের প্রোগ্রামের জন্য বাল্যশ্রম বিরোধী শ্রুতি নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখছি আমি। শর্মীর উপর পরেছে বাল্যবিবাহ বিরোধী কিছু লেখার দায়িত্ব । নানারকম ভাবনা দিয়ে সাজাচ্ছি লেখাকে। এটা অফিসের প্রতিযোগিতা। যে গ্রুপ সবচেয়ে ভালো করে, তারা প্রথম পুরস্কার পায়। সবাই বেশ ব্যস্ত।
    “দিদি একদিন আমাদের বাড়ি যাবে?আমি মা, বাবা আর দিদিকে তোমার কথা বলেছি, ওরা তোমায় দেখতে চায়।”
    -“বেশ তো নিয়ে যাস কোনো এক রবিবার” -“যাবে দিদি?” আনন্দে চকচক করে উঠলো চোখ দুটো। রবিবারের সকাল। ওর সাথে গেলাম ওর বাড়িতে।

    ওর বাবা আমাকে বিনা দ্বিধায় মামনি বলে সম্বোধন করলো। কি আন্তরিকতা সেই ডাকে। ঘরে বানানো মুড়ি আমাকে খেতে দিল, লঙ্কা পেঁয়াজ দিয়ে মেখে। সঙ্গে বাগানের ধনেপাতা। সামান্য খাবার কে যে কত অসামান্য করে তোলা যায়, তা এই মুড়ি না খেলে বোঝা যেত না। ঘর সংলগ্ন ছোট্ট বাগানে কত কিছু ফলিয়েছে। এখান থেকে টাটকা সবজি নিয়ে ওর দিদি বাজারে বিক্রি করে। মুরগি পালে আর ডিম বিক্রি করে। বস্তিতে পরপর বাড়ি, সবগুলোতেই নানা সবজী, ফুল কত কি। এরা একের ফলানো সবজি অন্যকে দেয়। এভাবেই অনেকটা চলে যায়। কি অদ্ভূত একতা। আমাকে দেখতে আরো কিছু স্কুলের ছেলে মেয়ে এল। এরা সবাই কাজ করে, আবার পড়াশোনাও করে।
    গাছের তলায় একটা বোর্ড। জানতে পারলাম, এখানে তো বেশীর ভাগই প্রথম প্রজন্ম পড়াশোনা করছে, তাই এরা বাবা মায়েদের পড়ায়। বয়স্ক শিক্ষার একটা ছোট কেন্দ্র যেন। শুধু পড়ায় না, বাল্যবিবাহ, পড়াশোনা ছেড়ে বাল্যশ্রম করার কুফলও এরা বোঝায় বড়দের। ছোটদের সংসার চালাতে কিছুটা কাজ করতে হলেও এরা স্বকর্মী মানে সেল্ফ এমপ্লয়েড। নিজেরাই ফুল সংগ্রহ করে, গাঁথে বিক্রি করে। সবজি ফলায় বিক্রি করে। মুরগি, হাঁস পালে ডিম বিক্রি করে। তাদের মতে নিজেদের মত করে কাজ করলে, তারা নিজেদের জন্য সময় বার করে পড়াশোনা করতে পারবে, একে অন্যের কাজে সহায়তা করে পরীক্ষার সময়ও যাতে অসুবিধা না হয় সেই ব্যবস্থা করে। উঁচু ক্লাশের ছাত্রছাত্রীরা নীচু ক্লাশের ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়ে দেয়। প্রিন্ট আউট বার করার মত অর্থ তো তাদের নেই, তাই কাগজে বাল্যবিবাহ, বাল্যশ্রমের বিরূদ্ধে লিখে গ্রামে গ্রামে বস্তিতে বস্তিতে প্রচার করে। কি অপূর্ব একতা। এই বস্তির ছেলেমেয়েরা নিজেরা নিজেদের মত করে অর্থ রোজগার করে কারোর উপর নির্ভরশীল না হয়ে। এক এক জন মা যেন সবার মা, যারা সেলাই এর কাজ জানে, নিজের ছেলেমেয়ের সাথে সাথে আশেপাশের সব ছেলেমেয়েকেই সেলাই শিখিয়ে দেয়। এরা তাই স্কুলবেলা থেকেই সেলাই করে নিজেদের পড়ার খরচ চালিয়ে নেয়। না, কোনো দোকান নেই। বাড়িতে নিয়ে এসে সেলাই করে, আবার দিয়ে আসে। সবার একটাই প্রতিজ্ঞা স্বাবলম্বী না হয়ে বিয়ে করবে না। বাল্যবিবাহ তো মোটেই নয়। যতই ঘুরে ঘুরে দেখি, ততই অবাক হই। গাছের গাছের কলম করে কেমন নতুন গাছের প্রজাতি তৈরী করেছে কেউ কেউ। কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে এরা তো পড়েনি। বাগান করে, গাছ ঘাঁটাঘাটি করে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই এরা শিখে গিয়েছে এই সব। চারা বিক্রি করেও রোজগার করে। তবে নিজেরা যা শেখে বা জানে অন্যদের শিখিয়ে দেয়, কোনো হিংসা নেই। বাগানে হওয়া সবজী বিনিময় করে। তাদের স্বপ্ন ছেলেমেয়েরা অনেক পড়াশোনা করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে। নিজের যা ক্ষমতা তা দিয়ে সৎভাবে রোজগার করে নিজের পরিবার শুধু নয় সমাজের মানুষের পাশে থাকবে।

    তরুছায়ার মা থালায় ভাত আলুসেদ্ধ, ঘি, বাড়ির ডিমের অমলেট, ডাল, বাড়ির বেগুন ভাজা কি সুন্দর করে সাজিয়ে এনেছে। কখন যে বেলা গড়িয়ে গিয়েছে। আমার কাছে অমৃতের স্বাদ এনেদিল এই খাবার। খাবার পরিবেশনের সঙ্গে যে অনন্ত ভালোবাসা। না বিরিয়ানি খেয়েও বোধহয় এত আনন্দ আর তৃপ্তি পাইনি, যা এই গরম গরম ঘি ভাতে পেলাম। ফ্রিজের নয়, মেটো কলসির ঠাণ্ডা জল তৃষ্ণার তৃপ্তি। সন্ধ্যা বেলায় লেবুর সরবত খেয়ে অনন্য এক অনুভূতি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। না, বাল্যবিবাহ, বাল্যশ্রম কোনো কিছু নিয়েই আর লিখে পাঠ করবো না। আমার সহকর্মীদেরও একই মত। সেই তো গুগুল টুগুল ঘেঁটে কতগুলো শুকনো জ্ঞানের কথা লিখতাম, বাস্তবের ঘটনা, প্রকৃত জীবনের আসল গল্প এরাই সামনে আনুক। স্টেজে ওরাই বলুক নিজেদের কথা। সবাই মিলে খিঁচুড়ি খাচ্ছি। শিশুদল খুব খুশি। আমাদের বাৎসরিক প্রাইজ দেওয়ার টাকায় ওদের বই খাতা পড়াশোনার সামগ্রী কিনে দেওয়া হলো অফিস থেকে- সমাজে ওদের অবদানের জন্য। ওদের নির্মল পবিত্র ও হাসিতে আমরা এক অনবদ্য আনন্দ পেলাম। সফল হোক ওদের প্রচেষ্টা। এমনি করে ওরা জীবনের জয়গান গাইতে গাইতে গাইতে জীবনের সব বাধা পেরিয়ে এগিয়ে চলুক।

  • গল্প

    অণুগল্প- ব্যাগের জন্মদিন

    ব্যাগের জন্মদিন
    -সঞ্চিতা রায় (ঝুমকোলতা)

     

     

    “মিস্ তোমার জন্য বাদামের প্যাকেট আর বিস্কুটের প্যাকেট এনেছি।”
    “কেন তুই নিজে না খেয়ে আমার জন্য আনলি?”

    মিমিতা মিস জানে সায়কের বাবা রোজ তাকে জলখাবার খাওয়ার জন্য কুড়ি টাকা করে দেয়। সেই কুড়ি টাকা থেকে বাঁচিয়ে সায়ক তার নানা রকম ইচ্ছা পূরণ করে। কিন্তু সায়কের তো পুষ্টি দরকার। তাই মিমিতা মৃদু ধমকের সুরে বললেন, “তুই কিন্তু খাবি ঠিক করে”।

    ব্যাগে স্টিকার দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে। মিমিতা যখন বিস্কুট আর বাদাম নিজে খেলো আর ভাইঝি মোনালিকে দিল, অপূর্ব এক আনন্দে সায়কের মুখ ভরে উঠলো। মিস ভাবছেন সত্যি কত ছোট ছোট কিছুর মধ্যে দিয়ে আনন্দ খুঁজে নিতে পারে এরা। “মিস একদিন আমাদের বাড়ি যাবে?”
    “মিস্ তুমি এসেছো,দেখো বাগানে কত ফুল গাছ করেছি”। ছোট্ট ছোট্ট টবকে ভালবাসা দিয়ে কি সুন্দর করে সাজিয়েছে সায়ক। অবাক দৃষ্টিতে দেখছেন মিমিতা।
    “এই রোদে কোথায় যাচ্ছিস?”একদিন মিমিতার বাড়ির সামনে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল সায়ক।
    “দুপুরের খাবার আনতে যাচ্ছি মিস, মা তো আমাদের সাথে থাকে না, তাই দুপুরের খাবারটা কিনে আনি। জানো মিস মাঝেমধ্যে বাজার করে রান্নাও করি আমি।” মিমিতা জানতে পারেন, হ্যাঁ সত্যিই সায়কের মা ওর বাবাকে ছেড়ে অন্য একজনের সাথে চলে গেছে। সঙ্গে নিয়ে গেছে সায়কের একমাত্র বোনকে। এই বোন সায়কের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই একটা শূণ্যতা সৃষ্টি হয়েছে। ও পাশের বাড়ির ছোট্ট মেয়েটার মধ্যে হয়তো বোনকে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। সায়কের অষ্টম শ্রেণী আর পাশের বাড়ির মেয়ে বৃষ্টির ষষ্ঠ শ্রণী। কাজে কাজেই সমাজ ভাই-বোনের একটা পবিত্র সম্পর্ক নিয়ে গল্প তৈরী করতে ছাড়েনি। এটা যে আমাদের সমাজের পরিচিত চিত্র। সায়কের বাবাও তার প্রথম স্ত্রী (সায়কের মায়ের আগে যাকে বিয়ে করেছিল) তার কাছে আবার যাতায়ত শুরু করেছে। মাঝে মধ্যেই ঘরে ফেরে না। এ হেন অবস্থায় সায়ক সঙ্গ দোষে পরে কিছু খারাপ গালাগালি শেখে। মিমিতার অন্য ছাত্রছাত্রীরা ওর সঙ্গে পড়তে চায় না। বলে, মিস্ ও খারাপ কথা বলে ওকে আমাদের ব্যাচে নেবে না। এটা তো স্বাভাবিক। অভিভাবক অভিভাবিকারাও তাদের ছেলে মেয়েদের এই ব্যাচে রাখতে চান না। পরিবেশের প্রভাবে একজন ছেলের কি পরিণতি হতে পারে ওকে দেখে মিমিতা বোঝেন। তবু নিজেও মাঝে মধ্যে ধৈর্য্য হারিয়ে সায়ককে প্রচণ্ড বকেন। এভাবেই এসে পড়ে সরস্বতী পুজো। মিমিতা বাড়িতে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে পুজো করেন। অবাক বিস্ময়ে মিমিতা ছোট্ট সায়কের ফল কাটা দেখে। ঠাকুর ঘরটা অবশ্য সবাই মিলে সাজায়। সায়কের সৃজনক্ষম মনটা সবাইকে আকৃষ্ট করে। খিচুড়ি রান্নাটা অনেকটা সায়কই করে। মিমিতা ভাবেন পরিবেশ পরিস্থিতি যেমন মানুষকে খারাপ গুণ দেয় তেমনই অনেক অনেক কিছু শিখিয়ে নেয়, যা নাকি ব্যবহারিক জীবনের অনুকূল। “মিস আমার কাছে কিছু পুরানো বই আছে তুমি একটু নেটে দিয়ে দেবে, যদি কেউ কেনে। আমি তাহলে প্রশ্নবিচিত্রাটা কিনবো ওই টাকায়।” মিমিতা দেখেন নীচু ক্লাশের কিছু বই। সে সায়কের কাছে কটা দিন সময় চায়। কিন্তু বই কেনার কাউকে জোগাড় করতে না পেরে অর্দ্ধেক দামে নিজেই তিনটে বই কিনে রাখে। সায়ক এলে বলেন “তোর বই বিক্রি হয়ে গিয়েছে নে টাকা” সায়ক তার পরের দিন প্রশ্নবিচিত্রা কিনে এনে হাসি মুখে বলে, “মিস এই দেখো কিনেছি,আমি একটু একটু উত্তর করার চেষ্টা করবো।” না, সায়ক পড়াশোনায় একেবারেই ভালো নয়। হয়তো ওকে কোনোদিনও সেভাবে পড়াশোনায় মনোযোগী করা যাবে না। তবুও প্রশ্নবিচিত্রা হাতে তার মুখের হাসি মিমিতার মনকে ভীষণ ভীষণ খুশি আর ভালোলাগায় ভরিয়ে দিল।ওর হাতে একটা ড্রইং খাতা আর পেন্সিল দিয়ে বললো “এটা তোর ব্যাগের জন্মদিনের উপহার তোর ব্যাগের হয়ে তুই এতে আঁকিস এবার।” সায়কের মুখে খুশির হাসি। মিমিতা ঈশ্বরের কাছে কামনা করে বললেন, “হে ঈশ্বর তুমি ওর মধ্যে যে গুণগুলো আছে সেগুলোকে পূর্ণতা দিও।

  • কবিতা

    কবিতা- অন্যরকম

    অন্যরকম
    -সঞ্চিতা রায় (ঝুমকোলতা)

     

     

    তুমি আমার জীবনে দখিনা বাতাস
    হয়েই থেকো, যেমনটি ছিলে এতকাল,
    তোমার সথে হওয়া
    ছোট ছোট কথাগুলোও এখনও
    আমার জন্য আনন্দের বার্তা বয়ে আনে,
    যতই হোক না তা ভার্চুয়াল।

    একটা সময় ছিল, যখন তোমার সাথে
    কিছুক্ষণ কাটালে মনটা ভীষণ
    ভীষণ ভালো হয়ে যেত, তাই কারণে
    অকারণে ছুটে যেতাম তোমার কাছে
    কাটাতে কিছুটা সময়।

    যদিও সম্পর্কটা ছিল নামবিহীন।
    আমি অবশ্য এর নাম দিয়েছিলাম
    মিষ্টি মিষ্টি বন্ধুত্ব..
    যে বন্ধুত্বে স্বার্থে কোনো রঙ নেই।
    কখনও বা মনে হতো, এটা বোধ হয়
    বন্ধুত্বের চেয়েও কিছু বেশী।
    না একে আমি প্রেম নাম দিতে নারাজ।
    নারী পুরুষের কাছাকাছি আসা মানেই
    তাকে একটা নামে বা সম্পর্কে বাধতেই হবে
    এ কেমন বিধান সমাজ তোমার?
    কোনো অধিকার বোধে বাঁধতে চাইনি,
    বাঁধতে চাইনা তোমায়।
    তোমার মনের যতটুকু অংশ আলোকিত
    করে আমি আছি, তা নিয়েই খুশি আমার স্বত্বা।
    আমার সবটুকুও তো আমি দিইনি তোমায়।
    তবু আছে ভালোলাগা, তবু আছে কিছুটা প্রেম।
    তাই হয়তো মন তোমার বার্তার প্রতীক্ষায় থাকে,
    তোমার বার্তা, তোমার সম্পর্শ নিয়ে আসে আমার জন্য, আমার মুহূর্তগুলোকে রঙিন করে।
    জানো, যেদিন প্রথম তোমার দূরে যাওয়ার কথা শুনেছিলাম, অদ্ভূত এক দলাপাকানো কষ্টে
    মন ভরে গিয়েছিল, ভাবছিলাম মন খারাপের
    মুহূর্তগুলোতে, আমি যে একা হয়ে যাব।
    কিন্তু আজ দেখো, সব অনুভুতিগুলো আমার
    বশ্যতা স্বীকার করেছে।
    দূরের তুমি আরো আরো কাছের হয়ে আছ,
    ছোট ছোট দেখা হওয়া, ছোট ছোট বার্তার বিনিময়ে।
    তুমি না হয়, গরমে এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া, শীতে একটু
    উষ্ণতার পরশ হয়েই থাকলে আমার জীবনে।

  • গল্প

    গল্প- মাটির টান

    মাটির টান
    – সঞ্চিতা রায় (ঝুমকোলতা)

    আর দু’দিন পর অনবদ্য-র পঞ্চাশতম জন্মদিন। বিরাট বড় করে পালিত হবে। আত্মীয় বন্ধু সবাই খুব উৎসাহী এই ব্যাপারে। কিছু কিছু আত্মীয় এসেও পরেছেন। তার শ্বশুর শাশুড়ী তো এক সপ্তাহ আগের থেকেই এসে গিয়েছেন। শালা শালীরাও আজ চলে এসেছে। ঘরবাড়ি বেলুন, রকমারি জিনিস দিয়ে সাজাচ্ছে তারা।ডেকোরেটরের লোকও আসবে। সারা বাড়িতে খুশির হাওয়া। কিন্তু অনবদ্যর মনে তেমন খুশি নেই কেন? তাকে কেমন যেন উদাস উদাস লাগছে। তার মনটা ফিরে যাচ্ছে ছোট্টোবেলায়।
    আসনটা পাত রে তিন্নি। ধান দুব্বাগুলো ঠিক করে রেখেছিস তো? প্রদীপটাতে ঠিক ঠাক করে তেল দে। তিন্নি এ বাড়িতে মায়ের সহকারী। পায়েসের গন্ধে সারা বাড়ি ম ম করছে। দুপুরে আনন্দ করে মায়ের রান্না করা মাংস ভাত, পাঁচ ভাজা, মাছের মুড়ো, পায়েস, মায়ের হাতের কিছু বিশেষ মিষ্টি এইভাবেই কাটতো ছোটবেলার জন্মদিনগুলো। “জাম্বো, (ছোট শালী এই নামেই ডাকে) বারান্দাটা কেমন সাজানো হয়েছে একবার দেখে যাও। ও জাম্বো কি এত ভাবছো?”
    “ওহ যাচ্ছি।”
    “খুব সুন্দর করে বারান্দা সাজানো হয়েছে। রাত্রে আলো জ্বললে আরো ভালো লাগবে।”সানিরিটা (অনবদ্যর স্ত্রী)বললো। কিন্তু অনবদ্যর মন কি যেন খুঁজে বেরাচ্ছে। খুব ছোটবেলায় জন্মদিনগুলো খুবই উপভোগ করতো অনবদ্য, সকলের আদরের অনি। কিন্তু যত উচু ক্লাশে উঠতে লাগলো অনবদ্য ততই তার এই জন্মদিনের কর্মকাণ্ডগুলোকে অনর্থক মনে হতে লাগলো। তার বন্ধুদের জন্মদিনে কত বড় বড় কেক কাটা হয়, আর তার জন্মদিনে পুরানপন্থী সব ব্যাপার। জন্মদিনের দিনগুলো মায়ের তৈরী পায়েস পর্যন্ত সে খেতে চাইতো না। বাবাকে দিয়ে জোর করে কেক আনাতো। বিরিয়ানি, চিলি চিকেন খেতে বাবাকে জোর করে তাকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে বাধ্য করতো। তবুও তার মা প্রতিবছর তার মঙ্গল কামনায় পায়েস, পাঁচভাজা সবই করতো। মুখে ছোঁয়াতেও চাইতো না এইসব।
    ধীরে ধীরে দিন কাটে। অনবদ্য ইঞ্জিনিয়ার হয়। নামী কোম্পানিতে চাকরি পায়। একই কোম্পানিতে কাজ করা আধুনিকা সানিরিটাকে তার ভালোলাগে। ভালোবাসার বাঁধনে ধরা পরে। পরিণতিতে বিবাহ হয়। আধুনিকা সানিরিটা প্রথম থেকেই এ বাড়িতে মানাতে পারে নি। যদিও তার কোনো স্বাধীনতায় কোনোদিন হস্তক্ষেপ করেনি অনবদ্যর মা। পোষাক থেকে খাবার দাবার সব কিছুতেই নিজের ইচ্ছামত চলতো সানিরিটা। তবুও আলাদা বাড়ি কেনালো অনবদ্যকে দিয়ে। অনবদ্যরও তখন মনে হলো, সে তার নিজের মত করে থাকতে পারবে। মুক্তি মুক্তি বড় আনন্দের মুক্তি।
    কয়েকবছর কেটে গেল। তাদের একটা পুত্র সন্তানও এসে গেছে এর মধ্যে। কিন্তু এই লাগামছাড়া জীবন, দিনরাত এই দোকান থেকে আনা খাবার আজকাল যেন আর তার ভালো লাগছে না।
    “পাপা চলো দেখবে পুরো বাড়িটা কি সুন্দর লাগছে।”
    “হ্যাঁ বাবু আসছি।” সত্যিই বাড়িটা সুন্দর লাগছে। কিন্তু অনবদ্যর মন কেন যেন বারবার পুরানো সেই মিষ্টি চন্দনের গন্ধ, পায়েসের গন্ধ পেতে চাইছে। একদিন নিতান্তই যা ছিল তার কাছে অপ্রয়োজনীয় আজ যেন তার দিকেই মন ফিরে যেতে চাইছে। জন্মদিনে খুব ভোরে তার ঘুম ভেঙে গেল, সবাই তখন আরাম নিদ্রায়। সব ব্যাবস্থাই তো করবে বাইরের লোক, বাড়ির মানুষের তো বিশেষ কাজ নেই। ধীরে ধীরে বাইরে এল অনবদ্য। মা বলতেন ভোরবেলা উঠলে মনে এক অকৃত্তিম ভালোলাগার সৃষ্টি হয়। ভোরের আকাশের দিকে তাকালে মনে এক পবিত্রতা অনুভব হয়। সদ্য উদিত সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে আকাশ। সারা আকাশে দিনমণির রাঙা আভা ছড়াচ্ছে। মনে পড়ছে সকালে উঠে তার মা বাবার সূর্য প্রণাম করার দৃশ্য। সেই সুন্দর সূর্য স্তোত্র কানে বাজছে। খুব ইচ্ছা করছে বাবার গুরুগম্ভীর গলায় ওই স্তোত্র শুনতে। মা প্রতিদিনই সকালে উঠে স্নান করে তুলসী মঞ্চে জল দান করে, সূর্য প্রণাম করে, ঠাকুর ঘরে ঠাকুর পুজো করে তারপর ঘরের কাজ করতেন নিপুণ হাতে। মিষ্টি ধূপ ধুনোর গন্ধে ঘর ভরে উঠতো। আর জন্মদিনের সকালে ঠাকুর ঘরে আসন পাতা, ধান দুব্বোতে আশীর্বাদ। “কিগো এত ভোরে বাইরে বেরিয়েছো কেন?” অনবদ্যকে পাশে না দেখে,উঠে বাইরে এসে বললো সানিরিটা। “আর একটু ঘুমিয়ে নাও, ক্যাটারার, ডেকোরেটার তো বাকি কাজগুলো করবে। আমদের তো বিশেষ কাজ নেই। কেকও দিয়ে যাবে নামী কোম্পানি। জলখাবারেও নামী নামী জায়গার দামী দামী খাবার আসবে।” সাজানো ডাইনিং রুমে বড় টেবিলে নামী জলখাবারের সম্ভার। অনবদ্য দেখছে। কদিন আগে অফিস ফেরত এক পুরানো বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছিল অনবদ্যর। ছোট্ট বেলার পাড়ার বন্ধু রীতম। তারপর একদিন হঠাৎই সকালে তার বাড়িতে গিয়েছিল অনবদ্য। আজকাল পিছনের দিনগুলো বড় বেশী টানছে তাকে। রীতমের মা, বাবা,স্ত্রী এবং মেয়েকে নিয়ে ছোট্ট সংসার। রীতমের মা অনবদ্যকে দেখে খুব আনন্দিত। জলখাবারে তারা আলুসেদ্ধ ভাত খাচ্ছিল। অনবদ্যর জন্য লুচি করতে চাইলে সে বললো, “কাকিমা আলুসেদ্ধ ভাতই আমি খাব তুমি মেখে দাও।” দুপুরে কাকিমা ও রীতমের স্ত্রীর তৈরী শুক্তো, মুসুর ডাল,মোচার ঘণ্ট, আলুভাজা, পুঁই শাক, চাটনি, রুইমাছের ঝোল খেল। অনেকদিন পর তার যেন মনে হলো অমৃত খেলো। আর হ্যাঁ রীতমের মা বাবা আর রীতমের পরিবার বিরাট প্রাচুর্যের মধ্যে না থাকলেও ভীষণ ভীষণ আনন্দে আছে বুঝতে পারলো।
    “ওয়াহ্” খাবার দেখে অনবদ্যর ছেলে খুব খুশি। জলখাবার খাওয়ার সময় হলো। কিন্তু কোথায় অনবদ্য!
    জন্মদিনের সকালে জলখাবার খাওয়ার সময় অনবদ্যকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ছোট্ট একটা মেসেজ এল সানিরিটার মোবাইলে। অনবদ্য জানিয়েছে খুব দরকারী কাজে তাকে বেরিয়ে যেতে হচ্ছে। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানের আগে সে ঠিক এসে যাবে। ফোন বন্ধ তার। বাড়ির গেট দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। গাড়ি নিজেই চালাচ্ছে অনবদ্য। মনে হচ্ছে কতক্ষণে বাড়িতে পৌঁছাবে। হ্যাঁ সেই বাড়ি যেখানে অনবদ্যর শৈশব, কৈশোর, যৌবন লালিত। স্নেহ ভালোবাসার মূর্তপ্রতীক সেই ঘর সেই বাড়ি। অনেক পুরানো স্মৃতি বিজরিত সেই বাড়ি। গেট দিয়ে ঢুকছে সে। একি পায়েসের গন্ধ ভেসে আসছে। কিন্তু মা তো জানতো না অনি তার আদরের অনি আসবে। তবে কেন মা পায়েস তৈরী করবে?
    “মা… মা“
    এ কার গলা শুনছেন অনিন্দিতা(অনবদ্যর মা)?নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না অনিন্দিতা। হ্যাঁ তার খোকাই তো। ঠিক দেখছেন তো? বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। দুজনের পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো অনি। ঠিক যেমন করে ছোটবেলায় করতো।
    “মা মাগো তুমি তো জানতে না আমি আসবো, তবে কেন পায়েস করেছো মা?”
    “আমি প্রতি বছরই পায়েস করি, আসন সাজিয়ে ধান দুব্বো নিয়ে অপেক্ষা করি, ভাবি যদি আসিস। প্রতিবছরই পায়েস গোপালকে নিবেদন করি আর পাশের বস্তির বাচ্চাদের পায়েস খাওয়াই। ওদের খুশি মুখ আমার মনকে ভরিয়ে দেয়। আর ধান দুর্বা গোপালের সামনে রেখে তোর মঙ্গল কামনা করি।” অনবদ্যর চোখে জল।
    “মাগো খুব ক্ষিদে পেয়েছে। আমি জলখাবার না খেয়েই আমি বেরিয়ে এসেছি। ওই পিৎজা, কাটলেট আমার আর ভালো লাগছে না মাগো। ”তাহলে একটু লুচি ভাজি।”
    “না মা তোমার হাতে মাখা আলুসেদ্ধ ভাত খেতে চাই সেই ছোট্টবেলার মত।” মার চোখে জল। ভাত মেখে নিজের হাতে খাওয়ালেন ছেলেকে।
    “কিন্তু তোর বাড়িতে তো প্রচুর লোকজন”
    “হ্যাঁ, অনুষ্ঠান সন্ধ্যাবেলা। আমি সময় মত ফিরে যাব, কিন্তু মাগো আজকের দুপুরটাকে ছোটবেলার মত করে দাও। দুপুরেও বিরিয়ানি চিলি চিকেনের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু মা আমি যে আজ দুপুরে তোমার হাতের রান্নাই খেতে চাই। বড় ক্লান্ত লাগে আজকাল ওইসব ভারী ভারী খাবার খেতে। দেবে না আমায় পাঁচভাজা সাজিয়ে খেতে?”
    “পাঁচ ভাজা আমি করেছি। ওই যে বললাম প্রতি বছরই ঈশ্বরের কাছে চাই, তুই যেন একবারটি আসিস, আর অপেক্ষা করি। ঈশ্বর আমার কথা শুনেছেন রে!” আবেগে বারবার চোখে জল আসছে অনিন্দিতার।
    না, ডেকোরেটার দিয়ে সাজানো টেবিল নয়, নিতান্তই সাধারণ টেবিল, আর নিজের বাগানের ফুল দিয়ে টেবিলটাকে সুন্দর ভাবে সাজিয়েছেন তিনি। ঐতিহ্যপূর্ণ বাঙালি রান্না আর পাঁচ ভাজা তার সামনে। মা পায়েস তুলে দিলেন ছেলের মুখে। কত কত দিন পর আবার সেই আগের মত। কী অসাধারণ তৃপ্তি এই খাবারে। যা একদিন ছিল একান্তই অপছন্দের তাই যেন আজ অনবদ্যের কাছে ভীষণ ভীষণ কাম্য হয়ে উঠেছে। ওই সুবিশাল কেক আজ মায়ের হাতের পায়েসের কাছে হেরে গেছে। হেরে গেছে বিরিয়ানি, পিৎজারা পাঁচ ভাজা সুশোভিত বাংলা মায়ের রান্না, বাংলা মায়ের স্নেহ ভালোবাসার কাছে।

  • গল্প

    গল্প- নৃত্যজা  

    নৃত্যজা
    – সঞ্চিতা রায় (ঝুমকোলতা) 

     

       

       আমি নৃত্যজা। বড়দের প্রণাম জানাই, সমবয়সীদের শুভেচ্ছা, ছোটদের এবং সবাইকে মুঠো মুঠো ভালবাসা জানিয়ে এখন আমি একটা রবীন্দ্র নৃত্য পরিবেশন করতে চলেছি।

    রবীন্দ্র নৃত্যের একটা প্রতিযোগিতা  চলছিল শিলিগুড়ির একটা বিখ্যাত মঞ্চে। মঞ্চের সামনে উপস্থিত আছেন পাঁচজন বিচারক। সৃজন সেন বিচারকদের অন্যতম একজন, এসেছেন কলকাতা থেকে। মুগ্ধ চোখে নৃত্যজার নাচ দেখছেন তিনি। তার কথা বলার ভঙ্গীমা থেকে শুরু করে নৃত্যভঙ্গীমা সবই খুব পরিচিত লাগছে সৃজনের। মনে হচ্ছে এই মেয়ে যেন তার কতদিনের পরিচিত। বিচারকগণ এবার তাকে অন্য আরো দু’টো রবীন্দ্র নৃত্য পরিবেশন করতে বললেন। পারদর্শীতার সাথে প্রতিটি নৃত্য পরিবেশন করলো নৃত্যজা। কিন্তু নৃত্যজার নাচ দেখতে দেখতে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছেন সৃজন। সৃজন ও সঙ্গীতা তখন কলেজের প্রথম বর্ষে। দুজনেই খুব ভালো নাচ করে। কলেজ সোস্যালে নৃত্যনাট্যগুলোতে তারা নিয়মিত অংশগ্রহণ করে। বিশেষত রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যে তারা সবসময়ই নায়ক নায়িকা। কলেজে সকলে তাদের ‘জুটি জুটি’ বলে ক্ষেপাত। সৃজন একদিন সঙ্গীতাকে বলে- কবে কেমন করে তুই আমার হৃদয় জুড়ে বসে গিয়েছিস, আমি জানিনা রে! শুধু জানি তোকে ছাড়া আমার কোনো অস্তিত্ব নেই।

    সঙ্গীতাও মনে মনে সৃজনকে ভালবেসে ফেলেছিল। তাই বন্ধুত্বের পথ ধরে চলতে চলতে ভালবাসার নিবিড় বন্ধনে তারা বাঁধা পড়লো। এরপর নৃত্য নিয়ে মাস্টার ডিগ্রী করলো দুজনে। নৃত্যজা এবং সৃজন দুজনেই নৃত্যকে পেশা হিসাবে নিল।  নৃত্যকলাকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সঙ্গীতা অনেক প্রতিভাময়, প্রতিভাময়ী ছেলে মেয়েদের বিনা বেতনে নাচ শেখাতে শুরু করলো। নৃত্য জগতে বিচরণ করতে এক অপূর্ব স্বর্গীয় আনন্দ পেত সে। নাচ ছাড়া তার জীবনকে ভাবতেই পারত না সে। সৃজনের বাড়িতে তার নিত্য যাতায়ত ছিল তার । ওই পরিবারের সবাই জানতেন সৃজন সঙ্গীতার সম্পর্কের কথা। জানতেন সঙ্গীতার পরিবারও। তাই প্রেম পরিণতি পেতে সময় লাগলো না। শুরু হলো তাদের যুগল চলা। সব কিছু সামলেও সঙ্গীতার নাচের জগতের সাথে সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ছিল। নাচ ছিল তার মুক্তির জায়গা। প্রাণ ভরে অক্সিজেন নেওয়ার জায়গা। ধীরে ধীরে বাড়ির পরিস্থিতি পরিবর্তিত হতে শুরু করলো। শাশুড়ি আরো সময় দাবী করতে লাগলো সঙ্গীতার কাছ থেকে। সব কাজ সেরেই তো সে কাজে যেত। তবুও বাঁকা মন্তব্য আসতে লাগলো।
    বিচারক বর্গ একটা ব্যাপারে সৃজনের মতামত চাইলো। এক ঝটকায় বর্তমানে ফিরলেন সৃজন।               বিচারকবর্গ  নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নৃত্যজাকে প্রথম স্থান দিলেন। সার্টিফিকেট লেখার সময় নৃত্যজার পদবী জানতে চাওয়া হলে সে বলে, “আমি পদবী ব্যবহার করি না, আমার মাও পদবী ব্যবহার করেন না। আপনারা সার্টিফিকেটে শুধু নামই লিখে দিন, তা নাহলে এই পুরস্কার আমি গ্রহণে অপারগ।” শেষ পর্যন্ত বিচারকগণ সম্মত হলেন। কারণ এটা এখন আইনসিদ্ধ। এই দৃঢ়তা, এই কথা বলার ভঙ্গীমা ভীষণ ভীষণ চেনা লাগছে সৃজনের। নাচ সম্পর্কে নৃত্যজার মতামত চাওয়া হলে নৃত্যজা বললো, নাচ তার জীবন, নাচ ছাড়া জীবন তার অপূর্ণ। তাই নাচ ছেড়ে সে জীবনকে কল্পনাও করতে পারবে না কোনোদিন। কোনোকিছুর বিনিময়ে সে নাচ ছাড়বে না।   

     “রোজ রোজ মায়ের সাথে তোমার এই অশান্তি আমার ভালো লাগে না। নাও না একটু মানিয়ে।”
    – ”মানিয়ে নেওয়া মানে নাচ ছেড়ে পুরোপুরি  সংসার করা তাই তো! আমি পারবো না।

    ”সন্তান এলে?”
    -“আমাদের দেশে অনেক নৃত্যশিল্পী আছেন, যারা সন্তান জন্ম দিয়েছেন, প্রয়োজনীয় বিশ্রাম নিয়ে, নাচের জগতে প্রত্যাবর্তন করেছেন, এটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়।”
    -“তাহলে তুমি মায়ের কথা শুনবে না।”
    -“না”!দৃঢ় কণ্ঠে জানালো সঙ্গীতা। “তোমার সঙ্গে আর তোমার সঙ্গে কেন তোমার পরিবারের সবার সঙ্গে আমার এই নিয়ে বিয়ের আগে কথা হয়ে গিয়েছে, কথা ছিল আমি নাচ কোনোদিন ছাড়বো না।”
    -“পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী আমার পরিবার চাইছে না তুমি নাচের জগতে থাকো! আমার নাচের মধ্যে তুমি নিজেকে খুঁজে নিও! অর্ধাঙ্গিনী তো!”  কথা কাটাকাটি, তিক্ততা বাড়তেই লাগলো।
    -“আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান,তাদের উপর আমি কথা বলতে পারবো না, হয় নাচ নয় আমি যে কোনো একটা তোমায় বেছে নিতে হবে।” সৃজন ভেবেছিল হয়তো সঙ্গীতা সংসার আর তাকে ছাড়তে পারবে না। কিন্তু সঙ্গীতা দৃঢ় ভাবে উত্তর দিল, “তবে আমি নাচকেই বেচে নিলাম”।                              নৃত্যজার কাছে এসে তার সাথে আলাপ করলো সৃজন। জানতে চাইলো কোথায় থাকে সে। কার কাছে নাচ শিখেছে সে।

    “আমার মা-ই আমার নৃত্যগুরু। তাঁর কাছেই আমার নৃত্যশিক্ষা।” ”তোমার বাবা কি করেন?” আমার মা এবং বাবা দুজনের নামই সঙ্গীতা। আমার মা একক মা হিসাবেই আমাকে মানুষ করেছেন।” নামটা শুনে চমকে উঠলো সৃজন তবে কি! তবে কি সঙ্গীত! “আমাকে তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাবে?”
    -“কিন্তু কেন?”
    “আমিও একজন নৃত্যশিল্পী তাই, আর একজন নৃত্যশিল্পীর সাথে পরিচিত হতে চাই।”
    “আমার মা একটু পরে এখানে আসবেন, তাঁর অনুষ্ঠান আছে আজ এখানে।”
    “আমি অপেক্ষা করছি।”                                   

    – “মা ইনি তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চান।” দুজনে দুজনকে অপলকে দেখলেন কিছুক্ষণ।   নৃত্যজা তাঁদের লক্ষ করতে লাগলো।
    – “নৃত্যজা কে?”
    -“আমার আত্মজা ,আমিই ওর মা, আমিই ওর বাবা।”
    -“কিন্তু ওর জৈবিক বাবা।”
    -“তার কোনো প্রয়োজন নেই আমার কাছে।” এবার দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল নৃত্যজা।                       আলাদা থাকা যখন তারা শুরু করে, তখন সবে মাত্র গর্ভে সন্তানের অস্তিত্ব টের পায় সঙ্গীতা। মনে মনে ভাবে মেয়ে হলে নৃত্যজা আর ছেলে হলে নৃত্যজ। যেই আসুক নাচ শিখিয়ে নিজের মনের মত করে গড়বে তাকে। না গর্ভে সন্তানের অস্তিত্বের কথা সৃজনকে জানায় নি সে। হয়তো তীব্র অভিমানে। তার পর শিলিগুড়িতে নৃত্য শিক্ষিকার চাকরি নিয়ে চলে আসে সঙ্গীতা। ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠে নৃত্যজা। হ্যাঁ, সঙ্গীতার স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে। নাচের জগতে প্রতিষ্ঠা পেতে  চলেছে নৃত্যজা।
    – “জৈবিক বাবা  তুমিই, বেশ আজ আমি স্বীকার করছি, মেয়ের সিদ্ধান্ত সে তোমায় মেনে নেবে কিনা? সে বড় হয়েছে এখন তার নিজস্ব মতামত আছে।”                                  

    -“আমাকে কিন্তু মা সব কিছু জানিয়েছিল আগেই, তোমার বাড়িতে নৃত্যকলার যে অপমান হয়েছিল, তা মা মানতে পারে নি, আমিও পারবো না”। নৃত্যজা বললো।                       

    -“কিন্তু আমি যদি তোমাকে নৃত্যকলার কিছু প্রশিক্ষণ দিতে চাই তুমি নেবে না? বাবা হিসাবে নাই বা হলো একজন নৃত্যজগতের মানুষ হিসাবে আমার শিক্ষাটাও তোমাকে দিতে চাই, এইটুকু সুযোগ আমায় দেবে না?”
    – “নৃত্যকলাকে ভালবাসি, তাই হ্যাঁ আপনার কাছে শিক্ষা গ্রহণ আমি করবো। গুরুজি নামেই আপনাকে ডাকবো, গুরুজি হিসাবেই আপনাকে দেখবো। কখনও কোনোদিন বাবার দাবী নিয়ে আপনি আমার কাছে আসবেন না।”

    – “বেশ তাই হবে…সঙ্গীতা  তোমার কোনো আপত্তি?”
    – “আমি তো বলেইছি মেয়ে বড় হয়েছে তার মতকে আমি গুরুত্ব দিই।”                                     বাবার বাড়িতে নয়, হস্টেলে থেকেই শিক্ষা শুরু হলো তার। নিজের সমস্ত বিদ্যাকে উজার করে দিলেন মেয়ের মধ্যে।                                         

    না আর বিয়ে করেননি সৃজনও। নাচের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দেন সৃজন। একসময় নিজের ভুল বুঝতে পেরে সম্ভবনাময় শিল্পীদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতেন তিনি। অসংখ্য হারিয়ে যাওয়া প্রতিভাকেও তিনি সামনে আনতে লাগলেন। এমনকি সংসারের চাপে যে গৃহবধূরা নাচের জগৎ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন, তাদের অনেককেও নৃত্যজগৎ ফিরিয়ে দিলেন তিনি। হ্যাঁ, এটাই তার প্রায়শ্চিত্ত। কাছ থেকে সব দেখলো নৃত্যজা।     

    -“বাবা” চমকে তাকালো সৃজন। আরো বেশ কয়েকটা বছর অতিবাহিত।
    -“আমাকে!” অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সৃজন।
    -“হ্যাঁ তোমাকেই!” পাশে সঙ্গীতা।
    – “তুমি এতদিন ধরে এত মানুষের প্রতিভা বিকাশে সাহায্য করেছো। তোমার প্রায়শ্চিত্ত  হয়ে গিয়েছে। বাবা বলে মেনে নিলাম তোমায়।”

    – ’আর তুমি সঙ্গীতা! পারবে আবার আমাকে মেনে নিতে?”
    -“না আমি বাকি জীবনটা আমার মত করেই কাটাতে চাই, এক ছাদের তলে এলে আবার হয়তো স্বকীয়তা নিয়ে সংঘাত হবে। বাকি জীবনটা আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বই থাক। নৃত্যজা থাক আমাদের সংযোগ সূত্র হয়ে।”

  • কবিতা

    কবিতা- তুই

    তুই
    -সঞ্চিতা রায় 

     

     

    তোর পাঠানো বার্তাগুলো
    এখন আমার মনে তুফান আনে।
    এখনো তোর লেখার একনিষ্ঠ পাঠিকা আমি।
    হারিয়ে যাই তোর কলমের যাদুতে।
    আমার মনের ঘরে এখনো তুই
    সেই ছোট্ট তুই হয়েই রয়ে গেলি।
    কল্পরাজ্যে তাই এখনো তোর সাথে
    খেলি, গল্প করি, আবার পড়াও শুনি।
    স্কুলের সারা মাঠ ছুটে বেড়াই তোকে তাড়া করে।
    ফিরতে চায় না মন বড় বেলায়!
    আজও ওই ছোট্ট তুইটাকেই ভালবাসি।
    আমার কৈশরের সেই প্রথম ভালবাসা
    আজও সবুজ হয়ে আছে মনের বাগে।
    এই তুই-টাকে নিয়েই আমি কাটাতে পারি
    জীবনের বাকি চলার পথটুকু।
    কল্পনা জগতের এই তুইটুকু
    থাকুক না হয় আমার শুধু আমারই হয়ে।

You cannot copy content of this page