-
গল্প- আগাম
আগাম
-সিদ্ধার্থ সিংহসামনে তাকিয়ে নাটুকে দেবু একেবারে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। তার ছেলে এখানে কী করছে! ওই মৃতদেহের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে ওভাবে কাঁদছে কেন ও! কে মারা গেছে! ওভাবে কাঁদছে মানে তো যে মারা গেছে, সে ওর অত্যন্ত কাছের কেউ। আর ওর কাছের মানে তো তারও কাছের! কিন্তু কে উনি!
খানিক আগে লেবু চা খেয়ে হেলতে দুলতে গুটিগুটি পায়ে কেওড়াতলা ইলেকট্রিক শ্মশানে ঢুকে পড়েছিল নাটুকে দেবু। না, ও কোনও দিন স্টেজে উঠে নাটক করেনি। কোনও নাটকের দলের সঙ্গেও ওর কোনও যোগাযোগ নেই। তবু সবাই ওকে নাটুকে দেবু বলেই ডাকে।
আসলে পাড়ায় দেবাশিস, দেবব্রত, দেবজিৎ, দেবাঞ্জন নামে অনেকেই আছে। আর তাদের প্রায় সবারই ডাক নাম দেবু। তাই সহজে চেনার জন্য কেউ যেমন শুধু লম্বা হওয়ার জন্য লম্বু দেবু, সারাক্ষণ সাইকেল নিয়ে ছোটে বলে কেউ যেমন সাইকেল দেবু, বাবা মিলিটারিতে কাজ করত বলে ছেলে হয়ে উঠেছে মিলিটারি দেবু, তেমনই যে কোনও ব্যাপার নিয়েই ও বড্ড বেশি নাটক করে বলে ওকে সবাই নাটুকে দেবু বলে ডাকে।
ইলেকট্রিক শ্মশানের ভিতরে ঢুকতেই ডান হাতে বাঁ হাতে দেওয়াল লাগোয়া লম্বা টানা সিমেন্টে বাঁধানো বেঞ্চ। তখন সেখানে কেউ পাশাপাশি বসে আছে। কেউ কেউ ক’হাত দূরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। কেউ আবার বুক চাপড়ে হাউহাউ করে কাঁদছে। তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে দু’-চার জন মেয়ে-বউ।
মাঝে মাঝেই নাটুকে দেবু এখানে আসে। এ সব দৃশ্য হামেশাই দেখে। একবার দেখেছিল, স্বামী মারা যাওয়াতে তাদের পাড়ার প্রায় চল্লিশোর্ধ্ব একটা বউ কাঁদতে কাঁদতে স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যাওয়ার জন্য প্রায় চুল্লির মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আর কী! তার সঙ্গে থাকা লোকেরা কোনও রকমে জোর করে তাকে প্রায় কোলপাঁজা করে এই চাতালে এনে বসিয়েছিল।
নাটুকে দেবুর মনে হয়েছিল, কেউ একটু শিথিল হলেই যে কোনও সময় এই বউটি ছুট্টে গিয়ে জলন্ত চুল্লিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। তাও বাঁচোয়া যে, এই ইলেকট্রিক চুল্লিগুলোর দরজা একমাত্র মরদেহ ঢোকানোর সময়ই কয়েক মুহূর্তের জন্য খোলে। বাকি সময়টা বন্ধই থাকে। ফলে সে ভয় নেই। তবে এমনও হতে পারে, পাশেই তো নদী, যদিও এখন আর নদী নেই, নালা হয়ে গেছে। তাই সবাই এখন ওটাকে টালি নালা বলে, তবু জোয়ার ভাঁটার সময় তো যথেষ্ট জল থাকে! আসার সময় ওর চোখে পড়েছিল টুপুটুপু জল। যদি যাওয়ার সময় এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপ দেয়! অবশ্য ঝাঁপ দিলেই যে ডুবে মরবে এমন নিশ্চয়তা নেই। সঙ্গে এত লোক রয়েছে, তারা নির্ঘাৎ লাফিয়ে পড়ে তার চুলের মুঠি ধরে উদ্ধার করে আনবে। আর স্বামীর শোকে দিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ঝাঁপ দিলেও সে যদি সাঁতার জেনে থাকে, তা হলে তো হয়েই গেল। তার আর মরা হবে না। শেষ পর্যন্ত ঠিকই হাত-পা ছুঁড়ে পাড়ে উঠে আসবে।
হ্যাঁ, তার বাড়ি যদি ছ’তলা আট তলা হতো, বাড়ি ফিরে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে যদি ঝট করে ছাদে গিয়ে মারতে পারতো এক লাফ, কিন্তু তার বাড়ি তো মোটে দোতলা! লাফ দিলে হয়তো খুব জোর হাত-পা ভাঙতে পারে, তার থেকে বেশি কিছু হওয়া একেবারেই অসম্ভব।
হ্যাঁ, মাঝরাতে সবাই যখন ঘুমে কাদা, সে চুপিচুপি উঠে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়তে পারে। কিংবা মুখে এক মুঠো ঘুমের ওষুধ পুরে এক গ্লাস জলের সঙ্গে ঢকঢক করে খেয়ে নিতে পারে। অথবা চুপিসাড়ে খেয়ে নিতে পারে মারাত্মক কোনও বিষ। নয়তো বাথরুমে গিয়ে ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলতে পারে হাতের শিরা।
সে দিন এই বউটির কান্নাকাটি দেখে নাটুকে দেবুর এ সবই মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, নাঃ, স্বামীর এমন শোক এর পক্ষে সহ্য করা সত্যিই অসম্ভব। হয়তো আজ কিংবা কাল, দুটো দিন কোনও রকমে কাটালেও তৃতীয় দিন বেঁচে থাকা এর পক্ষে সম্ভব নয়।
কিন্তু তৃতীয় দিন নয়, চতুর্থ দিন সে যা দেখেছিল এবং এর ওর ফিসফাস শুনে যা বুঝেছিল, তাতে সে একেবারে হতবাক। স্বামীর মৃত্যুর তৃতীয় দিনই পাড়ার অমলদা নাকি ওই বউটির জন্য তাঁর কাঁধ পেতে দিয়েছিলেন শোকার্ত মাথা রেখে হাপুস নয়নে কাঁদার জন্য। এবং সে দিনই ওই কাঁধে মাথা রেখে এই বউটি মুহূর্তের মধ্যে ভুলে গিয়েছিল স্বামীর যাবতীয় শোক।
শুধু শ্মশানেই নয়, নাটুকে দেবু মাঝে মাঝেই হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় কালীঘাটে। মায়ের মন্দিরে। পাঁঠা বলি দেখে। লোকজনের পুজো দেওয়ার ধুম দেখে। ভিখিরিদের নিশ্চিন্ত জীবন দেখে।
কখনও চলে যায় চেতলা ব্রিজের ওপরে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টালিনালার এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া দেখে। পাড় দখল করে গজিয়ে ওঠা এ মন্দির ও মন্দির দেখে। লালবাবা, নীলবাবার আখড়া দেখে। এই আশ্রম ওই আশ্রম দেখে। ঝুপড়ি দেখে।
কোনও দিন হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় যে দিকে দু’চোখ যায়। অন্যান্য দিনের মতো আজও সে এসেছিল কেওড়াতলা মহাশ্মশানে। না, সেই শ্মশান আর নেই। একেবারে আপাদমস্তক পালটে গেছে। একেবারে ঝাঁ-চকচকে। ছানাপোনা নিয়ে কোনও শুয়োরের ঘোরাঘুরি নেই। যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা নেই। এখানে এলে নাকে আর রুমাল চাপা দিতে হয় না। কাঠের চুল্লিগুলোরও আধুনিকীকরণ হয়েছে। ধুলো আর ছাই ফিল্টার হয়ে পরিবেশ এখন একেবারে পরিবেশ-বন্ধু। সামনের মনোরম বিশাল চাতালে ডোমদের ছেলেমেয়েরা ফ্লাড লাইটের আলোয় ফুটবল খেলে। প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে এটা এখন প্রেম করার নতুন জায়গা হয়ে উঠেছে। এখানে যেহেতু খুব কম মরা দাহ করা হয়, ফলে জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। শুধু কালীপুজোর ক’টা দিন ভিড় উপচে পড়ে এখানে। সামনের বেদিতে বিশাল করে পুজো হয়। দূর-দূরান্ত থেকে নেতা-মন্ত্রীরা এসে হাজির হন। সব কিছু পাল্টে গেলেও এখানে এখনও কালীপুজোর রাতে দু’-চার জন তান্ত্রিক লাল জোব্বাটোব্বা পরে, গলায় দশ-বিশটা রুদ্রাক্ষের মালা ঝুলিয়ে চিতার ওপরে বসে পড়েন। আর এখানে এলে নাটুকে দেবু বাড়ি যাওয়ার সময় মাত্র কয়েক হাত দূরের ইলেকট্রিক শ্মশানটাও ঘুরে যায়। কিন্তু এ কী!
সে তো খানিক আগেই তার ছেলেকে বাড়িতে দেখে এসেছে। হ্যাঁ, সে তো এই জামাপ্যান্ট পরেই ছিল! এটা পরে তো ও সচরাচর বাড়ি থেকে বেরোয় না। তা হলে! এইটুকু সময়ের মধ্যে এমন কী ঘটলো যে তার ছেলে ওই জামাপ্যান্ট পরেই এখানে চলে এল! তা হলে কি ওর কোনও বন্ধুবান্ধবের মা কিংবা বাবা মারা গেছে। ফোন পেয়েই তড়িঘড়ি এখানে ছুটে এসেছে! হতে পারে! কারণ, তার কোনও আত্মীয়স্বজন মারা গেলে, সে না জানলেও তার বাড়ির কেউ না কেউ তো ঠিকই খবর পেত। আর তার বাড়ির লোক জানলে, আর কেউ না হোক, অন্তত তার বউ তো এতক্ষণে তার মোবাইলে ফোন করে খবরটা জানাত। তা হলে কে মারা গেল! কে!
এক সময় মড়া পোড়ানোর খুব ধুম ছিল। পাড়ার বা বেপাড়ার, এমনকী অন্য গ্রামের কেউ মারা গেলেও পাড়ার ছেলেছোকরারা কোমরে গামছা বেঁধে সেখানে ছুটে যেত। নিজে থেকে যেচে চার বেয়ারার একজন হয়ে উঠত। যাতে পরে বুক ফুলিয়ে বলতে পারে, আমি একশোটা মড়া পুড়িয়েছি। আমি দুশোটা মড়া পুড়িয়েছি। তখন অনেকেই মনে করতো, মড়া দাহ করাটা বড় পুণ্যির কাজ।
শবযাত্রার সঙ্গী হলে যে শুধু শ্রাদ্ধর নিমন্ত্রণই পাওয়া যেত, তা-ই নয়, মড়া চিতায় তুলে সামান্য খাওয়াদাওয়া, মিষ্টিমুখের ব্যাপারও ছিল। শহরতলি বা গ্রামের দিকে ছিল জোর জুলুম। এক দিকে মড়া পুড়তো, আর অন্য দিকে শোক ভোলার নাম করে শবযাত্রীরা গলায় দেশি পানীয় ঢালত।
কিন্তু না। শহরে তো এ সব হয় না। এখন পাড়ায় পাড়ায় শুধু এম এল এ, এম পি-রাই নন, স্থানীয় কাউন্সিলর পর্যন্ত তাঁদের তহবিল থেকে স্থানীয় ক্লাবের নামে কিনে দেন অ্যাম্বুলেন্সের মতো অন্তত একটা শববাহী-গাড়ি। আর সত্যি বলতে কি, কাঁধে বয়ে মড়া নিয়ে যাওয়াটাও এখন প্রায় উঠে গেছে। কেন নিয়ে যাবে? একটা ফোন করলেই যখন দোরগোড়ায় এসে হাজির হয়ে যাচ্ছে— শববাহী গাড়ি।
আর দল বেঁধে হইহই করে মড়া নিয়ে যাওয়ার চার্মটাই নেই দেখে, পাড়ার ছেলেরাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। এখন শবযাত্রী হয় শুধু বাড়ির লোকজন এবং হাতে গোনা অত্যন্ত নিকট কিছু আত্মীয়স্বজন।
তাদের আলোচনার বিষয় হয়, নার্সিংহোমে কত টাকার বিল হয়েছে। কারা রোজ দেখতে যেত। আর কার চোখের সামনে সে নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। সঙ্গে চলে এর-তার নানা পরামর্শ- যত তাড়াতাড়ি পারিস, মানে কাজ মিটে গেলেই কিন্তু এল আই সি-টা কী ভাবে পাওয়া যাবে সেটা নিয়ে তদ্বির করিস। আচ্ছা, গ্যাসটা কি ওর নামে ছিল? তা হলে কিন্তু ওটার নাম চেঞ্জ করতে হবে। ব্যাঙ্কের দিকটাও খেয়াল রাখিস। কোনও দেনাটেনা নেই তো? ইত্যাদি ইত্যাদি।
এখানে খানিকক্ষণ থাকলেই বোঝা যায় মানুষ কত বিচিত্র জীব। আজ সকালেও যারা একান্নবর্তী পরিবার ছিল, একজনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিবার কী রকম টুকরো টুকরো হয়ে যায়! এক বিঘত জমি নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে কেমন লাঠালাঠি শুরু হয়ে যায়! চলে চোরাগোপ্তা আক্রমণ!
কিন্তু তার ছেলে কাকে দেখে কাঁদছে! কে মারা গেছে! কয়েকটা সিঁড়ির ধাপ ভেঙে ওই বেদিটার ওপরে উঠলেই দেখা যায় কে মারা গেছে। এ রকম জায়গায় চিৎকার করে ছেলেকে ডেকে ‘কে মারা গেছে’ জানতে চাওয়াটা ভাল দেখায় না। কিন্তু সে যে যাবে, তার উপায় নেই। আজ মড়ার একেবারে লাইন পড়ে গেছে। তেমনই শবযাত্রীদের ভিড়। সেই ভিড় ঠেলে যেতে গেলে আর গা বাঁচিয়ে যাওয়া যাবে না। ছোঁয়াছুঁয়ি হবেই। তখন আজই পাট ভেঙে পরা এই জামাপ্যান্টগুলো ধোওয়ার জন্য খুলে দিতে হবে। স্নান না করে ঘরে ঢোকা যাবে না। তার চেয়ে বরং বউকে ফোন করে জেনে নেওয়া অনেক সহজ, কে মারা গেছে!
এটা ভাবামাত্রই নাটুকে দেবু সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলো বউকে, কে মারা গেছে গো?
বউ আকাশ থেকে পড়ল, কে মারা যাবে?
ও বলল, না, ছেলেকে শ্মশানে দেখছি তো, তাই…
বউ বললো, তুমি ডাক্তার দেখাও। তোমার চোখটা গেছে।
– মানে?
– ছেলে তো বাড়িতে।
নাটুকে দেবু অবাক। বাড়িতে? কী বলছো!
– এই তো আমার সামনে।
– মানে? বলেই, যেখানে ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল, ও সেখানে তাকালো। দেখলো, কোথায় তার ছেলে! তার ছেলে তো ওখানে নেই। তা হলে কি ও অন্য কোথাও গেল! গেলেও এত ভিড় ঠেলে বেরোতেও তো সময় লাগে! এই এক মুহূর্তের মধ্যে ও কোথায় গেল! তা হলে কি সে ভুল দেখেছিল! তার এত ভুল হওয়ার তো কথা নয়! তা হলে!
যা হয় হবে। লাগুক ছোঁয়াছুঁয়ি। সে ফোন কেটে দিয়ে ঝটপট সিঁড়ি ভেঙে ঠেলেঠুলে ওপরে উঠলো। আর তখনই… যে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ছেলে কাঁদছিল, নীচে শোয়ানো সেই দেহটার দিকে তাকাতেই শিউরে উঠল ও। দেখলো, মৃতদেহটা আর কারও নয়, তার নিজেরই!
ওটা দেখেই সে পড়ি কি মড়ি করে সবাইকে ধাক্কাটাক্কা দিয়ে সরিয়ে বাড়ির দিকে ছুটতে লাগলো। না, সে মরেনি। সে ভূতও নয়। তা হলে ওটা কে! তার কোনও যমজ ভাইটাই ছিল কি! যে ছোটবেলাতেই রথের মেলায় হারিয়ে গিয়েছিল!
নাটুকে দেবু ছুটতে ছুটতে বাসরাস্তায় এসে দাঁড়ালো। আসতেই দেখলো, একটা এ সি বাস আসছে। সে পারতপক্ষে কখনও এ সি বাসে ওঠে না। তবু তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওয়ার জন্য বাসটা চলতে শুরু করে দিলেও ও লাফ মেরে বাসটায় উঠতে গেল। কিন্তু ও এত টেনশনে ছিল যে ওর পা-টা আর পাদানিতে পড়লো না। ফসকে গেল নীচে। একেবারে মুখ থুবড়ে পড়লো নাটুকে দেবু। না, ওই এ সি বাসটা নয়, এ সি বাসটাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ছুটে আসা একটা মাল বোঝাই ম্যাটাডর এমন ভাবে তার ওপর দিয়ে চলে গেল… আশপাশ থেকে সবাই চিৎকার করে উঠলো। কেউ কেউ বললো, গেল গেল…
হ্যাঁ, সে সত্যিই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় তার চোখে পড়ল, সে শুয়ে আছে। আর তার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে তার ছেলে। যে ভাবে একটু আগে ইলেকট্রিক শ্মশানে সে তার ছেলেকে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখেছিল, ঠিক সেই ভাবে। ঠিক সেই ভাবে। -
কবিতা- ধুত
ধুত
-সিদ্ধার্থ সিংহ
ছেলে মাধ্যমিক দিচ্ছে
তাকে বললাম, তুই যদি নাইন্টি পার্সেন্টের বেশি পাস
তোকে একটা ল্যাপটপ কিনে দেব, ছেলে পেয়েছিল।বাঁক ঘুরতেই আলো-আঁধারিতে ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে।
কানাঘুষোয় শুনেছিলাম, বাড়িওয়ালা লোক ফিট করেছে
আমি বললাম, তোমাকে উনি যা দিয়েছেন, তার থেকে বেশি দেব
তুমি শুধু ওঁকে একবার কড়কে দাও
আমার পিছনে যেন কোনও দিন না লাগে।
পর দিন রাস্তায় দেখা হতেই বাড়িওয়ালা গদগদ হয়ে
আমার দিকে সিগারেট এগিয়ে দিলেন, কেমন আছেন?দিঘায় বেড়াতে গিয়েছিলাম
আচমকা একটা স্রোত আমাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল দূরে
নাকানি-চোবানি খেতে খেতে মা মনসাকে ডাকলাম
রক্ষা করো মা, রয়ানি দিয়ে তোমার পুজো দেব।
লোক নেই, জন নেই
হঠাৎ কোত্থেকে একটা নুলিয়া এসে আমার চুলের মুঠি ধরল।শুধু মানব নয়, দানব নয়, ঈশ্বরও
ঠিক ঠিক প্রণামী পেলে
যা চান, তাই দিয়ে দেবে।
শুধু জানতে হবে কার প্রণামী কী।আর, আপনাকে সুন্দরবনে ট্রান্সফার করে দিচ্ছে শুনেই
আপনি নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন,
ধুত। -
কবিতা- আর এক হরিশ্চন্দ্র
আর এক হরিশচন্দ্র
-সিদ্ধার্থ সিংহ
আগেই ঘোষণা করেছিলেন
ফের জিতলেই স্থাবর-অস্থাবর যা আছে
তিনি সব বিলিয়ে দেবেন।
দিন-ক্ষণ সব ঠিক
সমস্ত মিডিয়া হাজির
আলোকচিত্রীরা তাক করে আছেন ক্যামেরা
প্রাসাদের বাইরে হাজার-হাজার লোক।যে লোকটা একদম শূন্য থেকে
আজ এতগুলো শূন্যের আগে একটা ৯ বসিয়েছেন
তিনি তা কী ভাবে বিলিয়ে দেন, তা দেখার জন্য।
আগেই ঘোষণা করেছিলেন
এ বার জিতলেই তিনি সব বিলিয়ে দেবেন।
সব নয়, যদি তার সামান্য কয়েক শতাংশও বিলোন
তা হলেও, এ দেশের সব ক’টা গণ্ডগ্রামে
গভীর নলকূপ বসানো যাবে
অন্তত পঞ্চাশ হাজার স্কুলবাড়ি পাকা হবে
সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না
অনেক ব্যাপারেই।ওঁর বাড়ির সামনে হাজার-হাজার উৎসুক লোক
ক্যামেরায় ক্যামেরায় ঠোকাঠুকি
এই তিনি দরজা খুললেন বলে…সে দিন ভিড়ের চাপে অনেকেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন
পরে জেনেছিলেন, সে দিন তিনি সব উজাড় করে দিয়েছেন
বাড়িঘরদোর থেকে ঘরের আসবাব
এমনকী নীলাখচিত আংটি, মানিব্যাগের খুচরো পয়সাও
সব, সব হরির লুঠের মতো তিনি বিলিয়েছেন
বিলিয়েছেন অন্দরমহলে
আর সেগুলো টপাটপ কুড়িয়ে নিয়েছেন তাঁর বউ
ছেলে-মেয়ে-নাতি-নাতনি।সে দিন সমস্ত মিডিয়ার সামনে তিনি আবার কথা দিয়েছেন
এর থেকেও অনেক অনেক বেশি আবার তিনি বিলোবেন
তবে আজ নয়, ঠিক পাঁচ বছর পরে। -
কবিতা- কী করে বলি
কী করে বলি
-সিদ্ধার্থ সিংহ
হাইকম্যান্ডকে কী করে বলি!
ও রকম দু’-চারটে খুন সবাই করতে পারে
কিন্তু এক কোপে কারও মাথা নামিয়ে
সেই মুণ্ডু নিয়ে কখনও কি ফুটবল খেলেছেন প্রকাশ্য রাস্তায়?
তবে?ও রকম দশ-বিশটা ধর্ষণ সবাই করতে পারে
কিন্তু আপনার নাম শুনলেই
মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে যাবে মেয়েদের স্কুল, পাপড়ি গুটিয়ে নেবে ফুল
সে রকম বিভীষিকা কি ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন চারিদিকে?
তবে?আপনাকে আসতে দেখলে
আশপাশের বাজার, চৌরাস্তার মোড়
কিংবা অফিসপাড়া
খরগোশ হয়ে যেতেই পারে
কিন্তু ওদের ভিতরের বাঘটাও যে মাথা নুইয়ে কোণে গিয়ে লুকোবে
সে রকম কুচকুচে কালো মেঘে কি ঢেকে দিতে পেরেছেন গোটা আকাশ?
তবে?হাইকম্যান্ডকে আমি কী করে বলি
এ বার অন্তত ভোটে দাঁড়ানোর জন্য আপনাকে একটা টিকিট দিক! -
কবিতা- জানালা
জানালা
-সিদ্ধার্থ সিংহ
ঘর বানাচ্ছ, বানাও
মনে করে দুটো জানালা বানাতে ভুলো না।একটা জানালা দিয়ে ছেলে যাতে উড়ে যেতে পারে
রামধনুর রং মাখতে পারে সারা গায়ে
মেঘের ভেলায় চেপে ভেসে যেতে পারে যেখানে খুশি,
আর অন্য জানালা দিয়ে পা টিপে টিপে এসে
যাতে শুয়ে পড়তে পারে বিছানায়।ঘর বানাচ্ছ, বানাও
মনে করে দুটো জানালা বানিও।একটা জানালা দিয়ে এসে
ছেলেকে যাতে বকাঝকা করতে পারো
কষাতে পারো দু’-একটা চড়চাপড়,
আর অন্য জানালা দিয়ে এসে
ঘুমন্ত ছেলের কপালে যাতে চুমু খেতে পারো।ঘর বানাচ্ছ, বানাও
মনে করে দুটো জানালা বানাতে ভুলো না
আর হ্যাঁ, সেই জানালায় যেন গরাদের কোনও
ছায়া না থাকে… -
গল্প- বুকের ভিতর অচিন পাখি
বুকের ভিতর অচিন পাখি
-সিদ্ধার্থ সিংহ
অমৃত দাঁড়িয়ে পড়ল। সন্ধের শিয়ালদহ স্টেশন তখন জনসমুদ্র। চার দিক থেকে লোকের ঢল এসে নেমেছে। ছুটছে ট্রেন ধরতে। অমৃতও যাচ্ছিল। দক্ষিণ শাখার দিকে। ও কাজ করে একটা কাপড় ছাপার কারখানায়। তাদের কারখানা সরকারি বেসরকারি নামী-দামি নানা সংস্থার অর্ডার সাপ্লাই করে। তবে তাদের নিজস্ব কিছু ডিজাইনও আছে। সেটাই ধরে রেখেছে ওই কারখানার সহযোগী সংস্থা ‘রূপসী’ শো-রুমের আভিজাত্য।
অমৃত সেখানকার রং-মাস্টার। শেড মিলিয়ে মিলিয়ে রং বানায়। মাইনে পায় সাত হাজার দুশো টাকা। এ ছাড়া ডিউটি আওয়ার্সের মধ্যেই যখন তার কোনও কাজ থাকে না, তখন ধরে ধরে কাপড় ছাপে। তাতেও সাত-আটশো টাকা হয়ে যায়। কিন্তু ওর চালচলন দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না যে, ও এতগুলো টাকা রোজগার করে। চলাফেরা থেকে খাওয়াদাওয়া, সব মিলিয়ে অমৃতের খরচ মাসে বড় জোর হাজার পাঁচেক টাকা। আসলে ও প্রতি মাসে কিছু না-হলেও অন্তত হাজার তিনেক করে জমায়। জমিয়ে জমিয়ে তা দিয়ে কেনে এক-একটা সাবেকি জিনিস। এর কোনওটা বাঁকুড়ার বড় ঘোড়া, কোনওটা চোঙওয়ালা গ্রামাফোন, আবার কোনওটা কুচকুটে কালো রঙের মাঝারি আলমারি অথবা ড্রেসিং টেবিল কিংবা নকশা-করা বড় ফুলদানি, নয়তো এক মানুষ সমান লম্বা ল্যাম্পস্ট্যান্ড।
অমৃত হেলতে দুলতে যেতে যেতে দেখল, একটা ঠেলাগাড়ির ওপরে কানা-উঁচু থালার আদলে বড় বড় তিন-তিনটে ঝুড়ি। পর পর রাখা। গোটা ঠেলাগাড়ি জুড়ে। কয়েক জন সেটা থেকে কী যেন বাছাবাছি করছে।
অমৃত সে দিকে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল। পায়ের প্লাস্টিকের চটিটা কোলাপুরির মতো দেখতে। হাঁটতে হাঁটতে গোড়ালির ভারে থেঁতলে ধারগুলো ফেটে ফেটে গেছে। প্যান্টের রং ধূসর। কোনও দিন ইস্ত্রি করা হয়েছে বলে মনে হয় না। আকাশি রঙের জামাটায় ঘাড় থেকে নীচ অবধি টানা একটা রঙের দাগ। হয়তো জামাকাপড় মেলার তারে শুকোতে দিয়ে হয়েছে। পাঁচটা বোতামের তিনটেরই তিন রকম রং। আদলেও তিন রকমের। তাও আবার যখন যে সুতো হাতের কাছে পেয়েছে, সেই সুতো দিয়েই সেলাই করা। গালে খোঁচা খোঁচা দাঁডি, ছিপছিপে গরন। লম্বা। হাঁটলে হাত দুটো বেশি দোলে।
কাছে গিয়ে অমৃত দেখল সোনালি বর্ডার-টর্ডার দেওয়া ঝাউপাতা, ফুল-টুল আঁকা চিনে মাটির কাপ ডিশ। কারুকার্য করা ফুলদালি, দুধ সাদা টি-পট, নানা নকশার অ্যাশট্রে। বেশ পাতলা। যেন বেঙ্গল পটারির তৈরি। তবে নিখুঁত নয়। কোনওটার গায়ে চুলের মতো সরু কালো রঙের ফাটল। কোনওটা আবার একটু-আধটু চলটা ওঠা। এ জন্যই দামটা এত কম।
অমৃত ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগল। ওর মধ্যেই যেগুলো সব চেয়ে ভাল, বেছে বেছে সেগুলোকে একটা জায়গায় জড়ো করতে লাগল। একটা টি-পট বেশ পছন্দ, কিন্তু ঢাকনাটা একেবারে যাচ্ছেতাই। দোকানদার একটু অন্যমনস্ক হতেই চোখের পলকে অমৃত ঝট করে সেই টি-পটের ঢাকনাটা অন্য একটা টি-পটের ওপর লাগিয়ে, ওই টি-পটের ঢাকনাটা এটার উপর বসিয়ে ওর বেছে রাখা জিনিসগুলোর মধ্যে রাখল।
দোকানদার ডিশ ক’টা কাগজে মুড়ে, কাপগুলো দড়িতে মালার মতো গেঁথে তুলে দিল ওর হাতে। ও কাঁধের ঝোলায় ডিশগুলো আর পটটা রেখে কাপগুলো ঝুলিয়ে নিল হাতে, তার পরে পা রাখল শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার চত্বরে।
ও বারুইপুর যাবে। শিয়ালদহ থেকে এগারো-বারোটা স্টেশন। শুধু একজনেরই যেতে আসতে লাগে পাঁচ-পাঁচ দশ টাকা। অমৃত যখন বারুইপুরে ঘর নেয়, তখন ট্রেনের মান্থলি টিকিট ছিল বিয়াল্লিশ টাকা। তার পর ধাপে ধাপে এ ক’বছরে সেটা বেড়ে যে কতয় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, দুম করে জিজ্ঞেস করলে ও ঠিক মতো বলতে পারবে না। তবে যাতায়াতের পথে কাউকে কাউকে আক্ষেপের সঙ্গে বলতে শোনে, এ বার যা বেড়েছে আর মান্থলি করা যাবে না। বিনা টিকিটেই যেতে হবে।
মান্থলির দাম যত দিন ছেচল্লিশ ছিল ও অবশ্য তত দিন করেছে। দামটা বাহান্ন হতেই মান্থলি করা ছেড়েছে। এখন তো একশো কত টাকা যেন! প্রথম প্রথম মৌলালি পর্যন্ত হেঁটে দুশো আঠারো নম্বর বাস ধরত। তাতে পয়সা একটু সাশ্রয় হত ঠিকই, তবে সময় লাগত ডবলেরও বেশি। তাই বাসে করে পার্কসার্কাসে গিয়ে ট্রেন ধরত। আসতও সেই ভাবে। ওই স্টেশনটা বেশ নিরাপদ। কোনও চেকার-টেকারের বালাই নেই। কিন্তু সব ট্রেনই তো আর ওই স্টেশন ধরে না। তাই…
চেকিং গেটের ও পারের দিকে এক ঝলক তাকিয়েই ও বুঝতে পারল, আজ আর গলে যাওয়া যাবে না। এ সময় প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরোনো যাত্রীদের চেয়ে ট্রেন ধরতে ঢোকা যাত্রীদের টিকিট বেশি চেক করা হয়। তাই টিকিট কাউন্টারের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল অমৃত। পাঁচ টাকার একটা কয়েন গলিয়ে দিয়ে বলল, বারুইপুর।
আগে টিকিটের দাম ছিল ছ’টাকা। কিন্তু সারা দেশে যখন এক টাকা, দু’টাকা খুচরোর আকাল শুরু হল, তখন তার হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য রেল কর্তৃপক্ষ তিন থেকে সাত টাকা দামের টিকিটগুলোকে পাঁচ টাকা করে দিয়েছিল। আট থেকে বারো টাকা দামের টিকিটগুলোকে দশ টাকা। পাঁচ, দশ, পনেরো— এই ভাবে পাঁচ টাকার গুণিতকে সর্বত্র টিকিটের দাম ধার্য করেছিল। বাজারের সব কিছুর দাম যখন আকাশ-মুখী, সে সময় অমৃত দেখেছিল,ছ’টাকার টিকিট কী ভাবে পাঁচ টাকা হয়ে গেল।
তখন শিয়ালদা থেকে বাঘাযতীন পর্যন্ত লাগত দু’টাকা। বেশির ভাগ লোকই তখন দু’টাকা দিয়ে বাঘাযতীন অবধি টিকিট কেটে পাড়ি দিত ডায়মন্ড হারবার, ক্যানিং কিংবা বজবজে। কারণ বালিগঞ্জের পরে রাতের দিকে আর কোনও স্টেশনে চেকার থাকে না। যা একটু-আধটু থাকে, সেটা ওই সোনারপুরে।
তাই বেশির ভাগ লোকেরাই শিয়ালদা থেকে সব চেয়ে কম দামের, ওই দু’টাকার টিকিটই কাটত। সেটা টিকিট কাউন্টারে বসা ওই লোকগুলোও জানত। তাই যে দিন বাধ্য হয়ে টিকিট কাটতে হত, সে দিন অন্যদের মতো অমৃত সাধারণত বাঘাযতীন বলত না, বলত ঢাকুরিয়া বা যাদবপুর।
টিকিটটা হাতে নিয়ে ও কোলাপসিবল গেট পেরোল। মনে মনে চাইল, অন্তত একজন চেকার তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিক। একবার ট্রেনে উঠে গেলে এই টিকিটটার তো আর কোনও দামই নেই। ধীরে ধীরে ও এগোতে লাগল। কিন্তু ওর দিকে কোনও চেকার ফিরেও তাকাল না। কী করে যে ওরা বোঝে কে টিকিট কেটেছে আর কে কাটেনি! জানতে পারলে, সেই রকম অভিনয় করে বেরিয়ে যাওয়া যেত। টিকিট কাটতেই হত না।
প্ল্যাটফর্মে ঢোকার আগের চাতালে তখন রমরম করে সিনেমা হচ্ছে। ওপরে বসানো ক্লোজ সার্কিট টিভি-তে। কিছু লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। স্টেশনের নানা বয়সের কিছু ভিখারি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শুয়ে বসে রয়েছে। তাদেরও কারও কারও চোখ টিভির দিতে। অমৃতও দাঁড়িয়ে পড়ল টিভি দেখতে। একটা বাংলা ছবি হচ্ছে। উত্তম-সুচিত্রার। একটু দেখার পরেই ওর মনে হল, ছবিটা ওর দেখা। আগে কখনও কোথাও দেখেছে। কী যেন নাম সিনেমাটার! কী নাম যেন!
নাম মনে না পড়লেও ছবিটার গল্প ওর মনে পড়ে গেল। ছোট থেকেই নায়ক-নায়িকার প্রেম। হঠাৎ ওদের মধ্যে আর এক পুরুষ এসে হাজির। সেই পুরুষটি যেমন সুন্দর দেখতে, তেমনই পয়সাওয়ালা। মেয়েটি ভালবেসে ফেলল তাকে। বিয়েও হয়ে গেল। কিন্তু এক মাস কাটতে না-কাটতেই মেয়েটি বুঝতে পারল, সে ভুল করে ফেলেছে। তার স্বামী আসলে মাতাল, লম্পট, অত্যাচারী। রাতের পর রাত বাড়ি ফেরে না। বড় একা হয়ে পড়ে মেয়েটি। সে সময় আচমকা একদিন পথে দেখা হয়ে যায় তার পুরোনো প্রেমিকের সঙ্গে। এড়িয়ে যেতে গিয়েও সে পারে না। কথা বলে জানতে পারে, ও তার এই অবস্থার কথা সব জানে। এবং সেই আগের মতোই একই রকম ভাবে তাকে এখনও ভালবাসে। প্রেমিকটি আরও বলে, আমার দরজা তোমার জন্য চিরকাল খোলা থাকবে। যে দিন তোমার মনে হবে, চলো এসো।
মেয়েটি সত্যিই একদিন সেই প্রেমিকের কাছে ফিরে এল। কিন্তু সেখানকার সংসারও তার সুখের হল না। প্রেমিকের বাড়ির লোকেরা তাকে মেনে নিল না। এর ফলে মেয়েটি শেষে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ল। আর সেই দৃশ্য দেখে প্রেমিকটা উন্মাদের মতো বেরিয়ে পড়ল পথে।
প্রেমিকা আসা মাত্র ছেলেটি যদি তাকে নিয়ে অন্য কোথাও সরে যেত, তা হলে নিশ্চয়ই গল্পটার পরিণতি এ রকম হত না। অমৃত ভাবল, তার প্রেমিকাও তো বলেছে, সে ফিরে আসবে। সে এলে, তার বাড়ির লোকেরাও যদি এই সিনেমাটির মতোই তাকে মেনে না নেয়, যদি এই সিনেমাটির মতো তারও ওই একই দশা হয়… তখন? আগে অত কিছু ভাবতে পারেনি অমৃত। ঘরবাড়ি-বন্ধুবান্ধব সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে এসেছিল। মনে হয়, এই তো সে দিনের কথা।
তখন ক্যানিংয়ে থাকত অমৃত। পাক্কা সাড়ে আট বছর মেলামেশার পর তার প্রেমিকা লক্ষ্মী হঠাৎ ওখানকার বর্ধিষ্ণু পরিবার, চৌধুরীদের বাড়ি নিয়ে মাতামাতি শুরু করল খুব। মেঠো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বা কখনও পুকুরের বাঁধানো ঘাটে বসে লক্ষ্মী বলত, জানো তো, ও বাড়ির মাসিমা বাঘের ছালে বসে পুজো করেন। ওদের বসার ঘরে না… কী বিশাল একটা পিয়ানো। দেয়ালে ঝোলানো ইয়া বড় বড় দু’খানা তলোয়ার। কতগুলো হরিণের মাথা। শুনলাম, ওদের কলকাতার বাড়িটা নাকি সারানো হচ্ছে। ছোট ছেলেটা, ওই যে গো কার্তিকদা, ও তো গত সপ্তাহে এসেছে। ক’টা দিন বোধহয় এখানেই থাকবে। কী দারুণ দারুণ গল্প বলে, ভাবতে পারবে না। কেউ বলবেই না যে, ও ওই বাড়ির ছেলে। কোনও অহংকার নেই। কী মিশুকে জানো…
সে সময় জানতে পারেনি অমৃত। যখন জেনেছিল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ক্যানিং ছেড়ে পালিয়েছে ওরা দু’জন। কিছু দিন পর অবশ্য চৌধুরীদের সেই ছেলেটাকে দেখা গিয়েছিল। মাত্র ক’টা দিন। তার পরেই যে কোথায় গেল! তবে লোকে বলে, ও নাকি এখন কলকাতার বাড়িতে থাকে। নতুন বিয়ে করেছে। সে বউ দেখতে কেমন, কোথাকার মেয়ে, সবই কানাঘুষোয় জানতে পারে অমৃত। শুধু জানতে পারে না তার প্রেমিকার কথা। লক্ষ্মীর কথা। না জানলেও ও বিশ্বাস করে, লক্ষ্মী যখন কথা দিয়েছে, যে কোনও দিন, যে কোনও সময় ও ঠিক আসবে।
লক্ষ্মী কথা দিয়েছিল। ত্রিমাতৃ মন্দিরের লাগোয়া পুকুরের বাঁধানো ঘাটে বসেছিল ওরা। ভরসন্ধ্যাবেলায়। পাশাপাশি একেবারে গায়ে গা লাগিয়ে। সে দিন মাঝে মাঝেই লক্ষ্মী বলছিল, ‘এই, এ বার তা হলে উঠি।’ আর প্রতিবারই অমৃত ওকে আটকাচ্ছিল, ‘আর দশ মিনিট’, ‘আর পাঁচ মিনিট’, ‘আর একটু, এই বলে। এক সময় লক্ষ্মী উঠে দাঁড়াল— আর নয়, হাট থেকে বাবার ফেরার সময় হয়ে গেছে। বাড়িতে এসে যদি দেখে… কথা শেষ হবার আগেই ওর হাত টেনে বসিয়ে দিয়েছিল অমৃত। আর একটু থাকো না… দিন দিন তুমি যেন কেমন দূরে সরে যাচ্ছ। অনেক দূরে…
কথাটা শুনে অমৃতের মুখের দিকে খানিকক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে ছিল লক্ষ্মী। তার পর পুকুরের জলে পা দোলাতে দোলাতে বলেছিল, দূরে সরে যাচ্ছি? তোমাকে ছেড়ে আমি কোথায় যাব? আমি তো তোমারই।
— সত্যি?
— সত্যি, সত্যি, সত্যি, এই তিন সত্যি করলাম।
সে দিনের ঘটনাটা অমৃতের বারবার মনে পড়ে। তাই ও বিশ্বাস করে, লক্ষ্মী আছে। যে কোনও সময় ও চলে আসবে। তাই ও যেগুলোর কথা বলত, যেগুলো ওকে মুগ্ধ করেছিল, সে সব জিনিস একে একে খুঁজে নিয়ে আসে সে।
আজ যেমন বেছে বেছে কাপ ডিশ নিয়ে যাচ্ছে। নতুন কেনার সামর্থ্য নেই তার, তাই অফিস ফেরতা পথে ঢু মারে পুরোনো বাজারগুলোতে। কখনও যায় শিয়ালদার বৈঠকখানা বাজারে, আবার কখনও যায় রফি আহমেদ কিদোয়াই রোড আর মার্কুইস স্ট্রিটের ক্রসিংয়ে। ছুটিছাটার দিনে চলে যায় ভবানীপুরের ঘোড়ার আড্ডায়। যায় গোপালনগরের চোরা-বাজারে। বেছে বেছে তুলে আনে কাঁটাচামচ, শীতে পরার দস্তানা, বেতের টুপি, ঝকঝকে তকতকে বই, সে যে কোনও বিষয়েরই হোক না কেন, পড়ার জন্য তো নয়, তাক সাজানোর জন্য।
একটা হুইসল বেজে উঠতেই অমৃত তাকাল প্ল্যাটফর্মের দিকে। দশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে একটা ট্রেন তখন ছেড়ে যাচ্ছে। কিছু লোক ট্রেনের পিছু পিছু ছুটছে। লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। ও-ও ছুটতে যাচ্ছিল, কিন্তু হাতের ঝোলানো কাপগুলো একটার সঙ্গে আর একটার ধাক্কা লেগে টুং-টাং শব্দ হতেই ও থেমে গেল। টিভি-তে তখন জমাটি সিন। দেখতে গেলে ফের এই একই অবস্থা হবে। তাও ও আর না-দাঁড়িয়ে বারো নম্বর প্ল্যাটফর্মে গিয়ে ঢুকল। ট্রেনটায় লোক উঠছে। প্রথম কামরার প্রথম জানালায় উঁকি মেরে ও জিজ্ঞেস করল, কোন ট্রেন?
লোকটা কোনও উত্তর দিল না। দ্বিতীয় বার ওই একই প্রশ্নে নিরুত্তর দেখে তৃতীয় বার অমায়িক ভঙ্গিতে অমৃত জিজ্ঞেস করল, দাদা, এটা কোন ট্রেন?
— জানি না। শব্দ দুটো বলেই লোকটা নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে রইল অন্য দিকে। অমৃত এগোতে লাগল। লোকটাকে নিশ্চয়ই আরও কয়েক জন এই একই প্রশ্ন করেছে। বারবার একই উত্তর দিতে দিতে লোকটা বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তাই হয়তো ওর প্রশ্নটা শুনেও শুনছিলেন না।
এমনটা অমৃতেরও হয়। জানালার ধারে বসার এই হল একটা ঝামেলা। হাজার লোকের হাজার রকম প্রশ্নের উত্তর দাও। কী ট্রেন, কখন ছাড়বে, অমুক স্টেশন ধরবে কি না, তমুক স্টেশন যেতে কতক্ষণ লাগবে, এর আগে কোন ট্রেন আছে— এত প্রশ্ন, শেষে আর ধৈর্য থাকে না। হয়তো তেমনই কিছু একটা ঘটেছে লোকটার সঙ্গে। কিন্তু… তবে যে বলল, জানি না। তার মানে এমনও হতে পারে, উনি বালিগঞ্জে নামবেন। তাই কোন ট্রেন না জানলেও চলে। যে কোনও একটায় চেপে বসলেই হল। কিন্তু তা হলে তো গেটের কাছাকাছি থাকা উচিত। মাত্র সাত-আট মিনিটের তো পথ। অমৃত আরেকটা জানালায় উঁকি মারল। সেই একই ভাবে জিজ্ঞেস করল, দাদা, এটা কোন ট্রেন?
— লক্ষ্মী ছাড়া।
কথাটা শুনেই অমৃত পা বাড়াল সামনের দিকে। উঁকি মারতে লাগল একটার পর একটা জানালায়। ‘লক্ষ্মী ছাড়া’ মানে লক্ষ্মীকান্তপুর। বারুইপুর হয়ে যাবে। কামরাগুলো ফাঁকা ফাঁকা। সিটও রয়েছে প্রচুর। তবে জানালার ধারগুলো সব ভরা। যে ক’টা খালি, সে ক’টাই উল্টোমুখো। কয়েকটা কামরার পর ও দেখল, ও দিককার একটা জানালার ধার ফাঁকা। ও সোজা উঠে গিয়ে ওই রো-টা আর জানালাটা ভাল করে দেখল। এ রকম মনের মতো সিট পেলে কেন জানি ওর মনে হয়, জায়গাটা নিশ্চয়ই নোংরা। কেউ বমি-টমি করে গেছে। অথবা জানারায় কাচ নেই কিংবা খোলে না, বন্ধ হয় না। কোনও না কোনও একটা গণ্ডগোল আছেই। কিন্তু তেমন কিছু ওর নজরে পড়ল না। ও জানালা ঘেঁষে বসে পড়ল।
দেখতে দেখতে কামরা ভরে উঠল। ভিতরে হাত-পা ছড়িয়ে থাকা যায় তবু দরজাটা একেবারে ঠাসা। ওদের ভিতরে ঢুকতে বললেই বলবে, সামনে নামব। এই ‘সামনে’টা কারও কাছে যে শেষ স্টেশন, সেটা মাত্র দিনকতক ট্রেনে চড়েই এ বুঝে গিয়েছিল। ঠেলে-ঠুলে দু’-একজন মাঝে মধ্যে উঠছে। ট্রেনটা ছেড়ে দিয়েছে। জানালা দিয়ে হু হু করে আসা বাতাসের তোড়ে অমৃতের চুলগুলো পিছন দিকে প্রায় শুণ্যে তিরতির করে কাঁপতে লাগল। চোখ পিটপিট করতে লাগল ও। এক সময় জানালা থেকে মুখ সরিয়ে কামরার ভিতরে তাকাল। দেখল, ভিড় ঠেলে ঠেলে এগিয়ে আসছেন তার পাড়ার হরিহরবাবু। আসতে আসতে তার একদম রো ঘেঁষে দাঁড়ালেন। অমৃতের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই এক গাল হেসে বললেন, আইজও কিছু কিনলেন নাকি?
— তেমন কিছু না। ওই ক’টা কাপ।
— বাড়ি পাইলেন?
— খুঁজছি তো…
— সে তো অনেক দিন ধইরাই খুঁজতাছেন। তা কেমন বাড়ি চান?
কথাটা উনি এমন ভাবে বললেন, যেন বলামাত্রই তেমন একটা বাড়ি উনি জোগাড় করে দেবেন।
অমৃত বলল, মোটামুটি, থাকার মতো। কথা ক’টা মুখে বললেও মনে মনে বলল, আমি চাই এমন একটা বাড়ি, যেখানে ঘরে বসেই বোঝা যাবে সকাল হয়েছে, এমন আলো এসে ঢোকে। যেখানে বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যায়। যেখান থেকে ওপরে তাকালে, যত কমই হোক, একটু আকাশ দেখা যায়। যেখানে দু’-একটা বন্ধুকে অনায়াসে আসতে বলা যায়। ইচ্ছে করলে, দরজা খোলা রেখে জ্যোৎস্না-রাতে হেঁটে যাওয়া যায় অন্তত বেশ খানিকটা পথ।
— মনে রাইখেন কিন্তু আমার কথাটা। মাইয়ারে নিয়া তো জামাই আলাদা হইব। ঘরের লাইগা পারতাছে না। যদি আপনের ঘরখান দেন তো… হাড় জিরজিরে লোকটার মুখে অদ্ভুত আকুতি।
— হ্যাঁ, মনে আছে। অমৃত বলল।
— শুনলাম কালিও নাকি আপনারে ধরসে…
— হ্যাঁ, ও বলছিল…
— আপনে কিন্তু আমারে দেইখেন। মাইয়াটা আমার আধখান হইয়া গ্যাসে। আপনে নিজের বুন মনে কইরা…
— ঠিক আছে, বললাম তো…
হঠাৎ অন্ধকার। নরেন্দ্রপুর থেকে সোনারপুর স্টেশনের মাঝখানে এইটুকু অংশে পাওয়ার থাকে না। দিনের বেলায় বোঝা যায় না। সন্ধ্যা হলেই মালুম হয়। মাত্র মিনিটখানেক। তারই মধ্যে ও দিক থেকে এক মহিলার গলা শোনা গেল, ঠিক হয়ে দাঁড়ান। অসভ্যের মতো…
ততক্ষণাৎ কে যেন একটা টর্চ জ্বালিয়ে কামরার সিলিঙে আলোটা ফেলল। ঠিকরে আসা আলোয় জ্যোৎস্না-জ্যোৎস্না মনে হতে না হতেই আবার আলো জ্বলে উঠল। বারুইপুর স্টেশনের দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মে নেমে হরিহরবাবু অমৃতকে বললেন, আপনে আগান, আমি আইতাছি।
অমৃত দু’নম্বর থেকে নেমে রেললাইন পেরিয়ে এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁটতে লাগল। গেট থেকে বেরোবার মুখে একটা গুমটি। সোডার জল বিক্রি হয়। খোলার সময় ফটাস করে আওয়াজ হয় বলে মুখে মুখে ওটার নাম হয়ে গেছে— ফটাস জল। আগে দু’রকমের হত। জিনজার ষাট পয়সা আর এমনি সোডার জলের দাম ছিল পঞ্চাশ পয়সা। নামী-দামি বিভিন্ন সফট ড্রিংসের বোতলে ভরা থাকত। একমাত্র সাউথ সেকশনেই এই জল পাওয়া যায়। বরফ-ঠান্ডা হলে তখন দশ পয়সা করে বেশি নিত। নুন-লেবু দিয়ে গ্লাসে সরবত করে দিলে আর একটু বেশি। এখন এমনি এক বোতল ফটাস জলের দাম চার টাকা। পকেট হাতড়ে দু’টাকার দুটো কয়েন এগিয়ে দিয়ে অমৃত বলল, একদম ঠান্ডা দেখে, আওয়াজ হয় যেন।
কেউ কেউ বলে জোরে শব্দ না হলে নাকি জলটা ভাল হয় না। এ কথা শুনে কাঁধের ব্যাগে বোতল নিয়ে ফেরি করতে থাকা এক জলওয়ালা একদিন বলেছিল, আওয়াজ শুনবেন, না জল খাবেন? এটা সূর্যপুরের জল…
চাবি দিয়ে ফটাস করে খুলে দোকানদার বোতলটা এগিয়ে দিল অমৃতর দিকে। বেশির ভাগ লোকই বোতলের মুখটা মুখে পুরে ঢক-ঢক করে খায়। না হলে নাকি ঠিক তৃপ্তি হয় না। অমৃত দোকানদারকে বলল, একটা পাইপ দিন না…
দোকানদার ওর দিকে একটা সবুজ রঙের স্ট্র বাড়িয়ে দিল। জল খেতে খেতে অমৃতর চোখ পড়ল ও পারের দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মে। এ রকমই একটা গুমটির সামনে দাঁড়িয়ে জল খাচ্ছেন হরিহরবাবু। গুমটির বড় বাল্বটার আলো তাঁর উপর এমন ভাবে পড়েছে, এত দূর থেকেও তাঁকে স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে।
তা হলে কি এই জন্যই উনি ‘আসছি’ বলে কেটে গেলেন। ভেবেছেন নিজে খেলে যদি আমাকেও খাওয়াতে হয়! সত্যিই কী ছোট মন এঁদের! অমৃত পা বাড়াল বাড়ির দিকে। বাড়িটা মল্লিকপুর আর বারুইপুরের মাঝামাঝি জায়গায়।
যখন ও ঘর নেয়, তখন শুনেছিল, কিছু দিনের মধ্যেই একটা স্টেশন হচ্ছে এখানে। সামনেই ভারতিয়া কোম্পানি। রেলের চাকা-টাকা বানায়। তিন শিফটে প্রায় হাজার তিনেক লোক কাজ করে। ওই ভারতিয়াই অনেকটা জমি ছেড়ে দিচ্ছে। এখন বাকি শুধু নির্ধারিত কিছু মান্থলি টিকিট হোল্ডার শো করা। ক্রসিংয়ের জন্য অবশ্য মাঝে মাঝে এখানে গাড়ি দাঁড়ায়। ফেরার সময় হলে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে অমৃত। নামতে দেখে আরও দু’দশ জনকে।
‘খাড়ান’। পিছনে হরিহরবাবুর গলা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল অমৃত। ও পিছন ফিরতেই উনি বললেন, এক লগে যাই। আমার টর্চটা আবার… ব্যাটারিগুলান কালকাই রোদে না দিলে… বলতে বলতে এগিয়ে এলেন হরিহরবাবু। অমৃত অমনিই হাঁটছিল। দু’পাশে গাছের ঝাঁকড়া মাথাগুলোতে এতক্ষণ ঘাপটি মেরে ছিল অন্ধকার। উনি টর্চের কথা বললেই, ঝুপ করে তা যেন পথের ওপরে নেমে এল। অমৃত ব্যাগ হাতড়ে পেনসিল টর্চটা বের করল। আলো-বৃত্তের পিছু পিছু এগোতে লাগল ওরা দু’জন।
বাড়ি যাওয়ার পথে বাঁ হাতে একটা মুদিখানা দোকান। সেটার দাওয়ায় একটা বস্তা পেতে কতকগুলো ছেলে-ছোকরা তাস খেলছে। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্ট আছে। কিন্তু আলো জ্বলে না। ওদের আসতে দেখে ওই ছেলেগুলোর কেউ কেউ মাথা তুলে দেখার চেষ্টা করল, কারা আসছে।
অমৃত মুড়ি কেনার জন্য দাওয়ায় উঠল। ওর রাতের খাবার বলতে, হয়-পাউরুটি, নয়-মুড়ি। একটু চিনি বা চিনি গোলা জল হলেই হল। হরিহরবাবু অপেক্ষা করতে লাগলেন। মুড়ির ঠোঙাটা ব্যাগে পুরে নীচে নেমে এল। আবার হাঁটতে লাগল সে। সঙ্গে হরিহরবাবুও।
অমৃতের দুটো বাড়ির পরেই হরিহরবাবুর বাড়ি। উনি বললেন, আলোটা এট্টু দেহান দেহি, ঢুইক্যা পড়ি।
অমৃত ওখানে দাঁড়িয়েই টর্চটা তুলে ধরল। আলোটা অত দূর পৌঁছল না। তার আগেই মিলিয়ে গেল। কিন্তু উনি না ঢোকা পর্যন্ত ও টর্চটা ধরেই রইল। দুটো বাড়ির মাঝখানে হাতখানেক চওড়া মেঠো পথ। সেটা ধরে কিছুটা এগোলেই পর পর বেশ কয়েকটা ঘর। টালির ছাউনি। প্রত্যেকটার সামনে একটু করে বারান্দা। রান্নার জন্য। সেখানে দরজা নেই। তার পরে ঘর। এ রকমই একটা ঘরের ভাড়াটে অমৃত।
কোনও ঘরেই কোনও সাড়াশব্দ নেই। বেশি রাত অবধি জাগলে শুধু শুধু কেরোসিন পোড়ে। তাই এখানকার লোকেরা সন্ধ্যার পরেই শুয়ে পড়ে। ওঠে খুব সকালে। কারখানারই এক বন্ধু তাকে এই বাড়ির হদিশ দিয়েছিল। দেখেই পছন্দ হয়েছিল অমৃতের। বারুইপুর তো নিউ ক্যালকাটা। মানুষ এ ভাবেই এগোয়। এর পরে খোদ কলকাতা।
কাপগুলো পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে ঘরের তালা খুলল অমৃত। হাতড়ে হাতড়ে চিমনি-বাতিটা জ্বালাল। দেওয়ালগুলো যেন দাঁত বার করে হাসছে। ইটের ফাঁকে ফাঁকে জমাট পুরু সুরকি ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। ঘরময় স্তূপ করা জিনিসপত্র। এ দেয়ালে ঠেস দেওয়া খুলে রাখা পালঙ্ক, তো ও দেয়ালে লটকানো শিংওয়ালা ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া হরিণের মাথা। দেয়াল ঘেঁষে টাল করে রাখা বড় বড় বেশ কয়েকটা বোঁচকা। আচমকা এলে মনে হবে থিয়েটারে ভাড়া খাটানোর সাজ-সরঞ্জামের কোনও গো-ডাউন। ও দিকটায় শুধু বই আর বই। দরজার বাঁ হাতেই একটা সাবেকি ড্রেসিং টেবিল। নতুন কেউ এলে ঠিক মতো পা ফেলতে পারবে না। চলাফেরা করতে গেলে পাঞ্জাবির পকেটে আটকে যাবে খোঁচা হয়ে বেরিয়ে থাকা লম্বা কোনও কিছুতে অথবা কনুইতে ধাক্কা লেগে মাটিতে পড়ে চুরমার হবে দারুণ নকশা করা বড় ফুলদানিটা কিংবা কাত খেয়ে পড়ে যাবে এক মানুষ লম্বা ল্যাম্পস্ট্যান্ড।
নিজেকে নিংড়ে ও এগুলো কিনেছে। শুধু কেনাই তো নয়, নিয়ে আসাটাও যে কত হ্যাপার, সেটা কেবল ও-ই জানে। কখনও চেকারের হাতে দু’-পাঁচ টাকা গুঁজে দিয়ে ট্রেনে তুলেছে, কখনও ম্যাটাডরে চাপিয়েছে কারও সঙ্গে শেয়ারে। কখনও আবার পেয়ারা বা লিচুর সিজনে বারুইপুর-শিয়ালদহ যাতায়াত করা জানাশোনা ট্রাক বা টেম্পোয় তুলে নিয়ে এসেছে সামান্য খরচে। যাতে চোট না লাগে, কী ভাবেই না বুকে আগলে এনেছে এ সব। এই কান ছাড়া বড় ঘোড়া, ও দিককার ওই চোঙওয়ালা গ্রামাফোন কিংবা কুচকুচে কালো রঙের ওই মাঝারি আলমারিটা। আনতে কত কষ্টই না হয়েছে… যত কষ্টই হোক, ঘরে একবার ঢুকিয়ে দেওয়ার পর সে যে কী আনন্দ, কী তৃপ্তি! কেবলই থেকে থেকে মনে হয়, কী যেন একটা পেয়েছি। কী যেন একটা পেয়েছি।
কাপগুলো একটা কোণে রেখে ব্যাগ থেকে বের করল মুড়ির ঠোঙাটা। নামিয়ে রাখল টি-পট আর প্লেটগুলো। তার পর আলনা থেকে একটা লুঙ্গি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। ওর এক বন্ধু মাঝে মাঝেই স্নান না করে কাজে আসে। তার মুখেই ও শুনেছে, কলকাতায় তাদের জলের কষ্টের কথা। এখানে সে বালাই নেই। কী শীত, কী গ্রীষ্ম, বারো মাসই ও গা ধোয়। সে যত রাতই হোক না কেন।
অমৃত গা-টা মুছে ড্রেসিং টেবিলটার সামনে এসে দাঁড়াল। ড্রয়ার থেকে দাঁত ভাঙা চিরুনি বের করে চুলে বসিয়ে সামনে টানতে লাগল।
আঁচড়াতে আঁচড়াতে হঠাৎ ভ্রু কুঁচকে গেল ওর। কপালে দু’-তিনটে ভাঁজ দেখা দিল। চিরুনি নামিয়ে পেতে আঁচড়ানো চুল থেকে কয়েকটা চিমটি কেটে তুলে ধরল। আয়নায় দেখে দেখে খুঁজতে লাগল,এইমাত্র এক ঝলক দেখা সাদা রঙের চুলটা। একটা দুটো করে বাদ দিয়ে দিয়েও আলাদা করতে পারল না সেটাকে। আয়নায় ভাল করে তাকিয়ে দেখল, সব ক’টার রংই কেমন যেন ধূসর ধূসর। ছাই ছাই। গাল একদম ভেঙে গেছে। চোখ দুটো ঢুকে গেছে কোটরে। চামড়াগুলো কেমন যেন কুঁচকে কুঁচকে গেছে। হঠাৎ ওর মনে হল, ভুল দেখছি না তো! কী দেখছি আজ! বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল ওর। গলার কাছটায় কী যেন একটা দলা পাকিয়ে আটকে গেল। এরই মধ্যে এই! তা হলে আর নতুন জীবন শুরু করব কবে! এখনও তো কিছুই জোগাড়যন্ত্র হল না।
দরজা জানালা বন্ধ করে একটা বোঁচকা টেনে বের করল অমৃত। একে একে বের করতে লাগল জামা, প্যান্ট, রাতের পোশাক। একটা একটা করে পরে আয়নার সামনে দাঁড়াতে লাগল। নিজেকে ভারী অদ্ভুত লাগল ওর। সেই কবে যে এ সব বানিয়েছিল! ঠিক ছিল, নতুুন বাড়িতে উঠে গিয়ে পরবে। কিন্তু এ কী! সেই বুক, সেই দেহ তার কই! আর এ কী কাটছাঁট! আজ এগুলো পরে বেরোলে লোকে তাকিয়ে থাকবে। ভাববে, পুরোনো পোশাকের ফ্যাশন শো-য়ে যোগ দিতে যাচ্ছে।
হাঁটুর কাছটা অসাড় হয়ে আসতে লাগল ওর। গায়ে আর জোর নেই। যেন এক্ষুনি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে শরীরটা। তা হলে কি অনেক দিন হয়ে গেল? অনেক দিন! লক্ষ্মী আর আসবে না! কিন্তু ও যে এই সে দিন কথা দিল! পুকুরের জলে পা দোলাতে দোলাতে বাঁধানো ঘাটে বসে বলল, আমি তো তোমারই।
বলেছে যখন, তখন আসবেই। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লে যদি ডাক শুনতে না পাই! এসে যদি ফিরে যায়! তড়িঘড়ি উঠে ঝটপট করে ঘরের সব ক’টা জানালা দরজা হাট করে খুলে দিল অমৃত। ঘরের এক কোণে গুটিয়ে দাঁড় করানো ছিল মাদুর। ও সেটা ডাই করা বোঁচকাটার পাশে, এক চিলতে জায়গাটায় বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। ব্যাগ থেকে বের করে রাখা মুড়ির ঠোঙাটা হাতের কাছে টেনে নিল। অন্যান্য দিনের মতোই খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়বে। দু’-এক মুঠো মুখেও দিল।
কোমরটা যেন ভেঙে যাচ্ছে। বুকের ভিতরটা কেমন করতে লাগল। বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিল অমৃত। ঘরের মধ্যে ঢুকতে লাগল এলোপাতাড়ি বাতাস। চোখ বুজে এল অমৃতের। দেখল, তিরতির করে সেই বাতাস বয়ে যাচ্ছে একটা ধান খেতের ওপর দিয়ে। ও পারে দাঁড়িয়ে আছে লক্ষ্মী। দু’হাত বাড়িয়ে তাকে ডাকছে। ঘোরের মধ্যেই ও চেঁচিয়ে উঠল, দাঁড়াও দাঁড়াও, আমি যাচ্ছি। আমি যাচ্ছি।
হঠাৎ ডানা ঝাপটানোর শব্দে ওর তন্দ্রা কেটে গেল। মনে হল, একটা বিশাল বড় পাখি বেরোনোর জন্য ঘরময় ছটফট করছে। চোখ মেলে তাকাল ও। চিমনিটায় ততক্ষণে কালি পড়েছে। শিখাটা তেরচা ভাবে উঠে দপদপ করছে। পাখিটা কোথায়! ওপরে চোখ তুলে দেখল, বাতাসের দাপটে দেয়ালে অনবরত আছাড় খাচ্ছে বহু বছরের পুরোনো একটা ক্যালেন্ডার। আর হাতের কাছে থাকা মুড়ির ঠোঙাটা কখন কাত হয়ে পড়ে সারা ঘর ছড়িয়ে পড়েছে। এলোপাতাড়ি দমকা বাতাসে তারই কিছু কিছু উড়ছে। ওগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অমৃতের মনে হল, ওগুলো মুড়ি নয়, সাদা খই। শুধু সাদা খই। -
গল্প- ঋ-তানিয়া
ঋ-তানিয়া
-সিদ্ধার্থ সিংহ
না। তানিয়া কিছুতেই কথা বলছে না। ওকে কথা বলানোর জন্য গত দু’দিন ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে ঋ। তবুও একটা বর্ণও উচ্চারণ করছে না ও।
কথা বলছে না মানে যে কোনও কাজ করছে না, তা নয়। সেই অষ্টমঙ্গলার গিঁট খুলে এ বাড়িতে আসার পর থেকে ও যা যা করে, মুখ বুজে তা-ই করে যাচ্ছে।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগেই ও যেমন প্রতিদিন তার খাট-লাগোয়া টেবিলে চা দিয়ে ওকে ডেকে দিয়ে যায়, পরশু দিন তেমনই চা দিয়ে গিয়েছিল। শুধু ডেকে দিয়ে যায়নি। তাই ঋও আর ওঠেনি। যেমনকার চা তেমনই পড়ে ছিল। খানিক পরে কাপ নিতে এসে তানিয়া যখন দেখল, চা-টা ঠান্ডা জল হয়ে গেছে। তখন চা-টা ফের গরম করে যেখানে রাখার সেখানে রেখে লক্ষ্মীর আসন থেকে ছোট ঘণ্টাটা এনে ঢং ঢং করে নাড়াতে শুরু করেছিল।
এত সকালে ঘণ্টা বাজাচ্ছে কে! বিরক্তির সঙ্গে চোখ খুলে ঋ দেখে, সামনে তানিয়া। বিয়ে হয়েছে আট মাসও হয়নি। চাকরিসূত্রে এখানে একটা ঘরভাড়া নিয়ে ঋ থাকত। প্রথম ক’টা দিন মা এসে এখানে ছিলেন। রান্নাবান্না করে দিতেন। কিন্তু দক্ষিণ দিনাজপুরের বুনিয়াদপুরে তাঁর ভরা সংসার। তিনি না থাকলে সব অন্ধকার। তাই ওখানটা ফেলে রেখে এই ছেলের কাছে আর কত দিন থাকা যায়! কিন্তু তা বলে তার রান্নাবান্না কিংবা ঘরের কাজের জন্য কোনও মেয়েকে রাখার ব্যাপারে তিনি ছিলেন একেবারে ঘোর বিরোধী। তার বয়স যা-ই হোক না কেন। যা দিন কাল পড়েছে! কী থেকে কী হয়, কিচ্ছু বলা যায় না। আর কোনও ছেলেকে যে ভরসা করে রেখে যাবেন, তাও পারেননি। মনের মধ্যে বারবার খচখচ করেছে, তাঁর ছেলে যে রকমটা খেতে ভালবাসে, তাকে দেখিয়ে দিয়ে গেলেও, কোনও ছেলে কি ঠিক সেই ভাবে আদৌ রান্না করে দিতে পারবে! তার থেকেও বড় কথা, সেই ছেলেটা যে ভাল, তার গ্যারান্টি কে দেবে!
তাই ছেলেকেই শিখিয়ে-পড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, কী ভাবে সহজে পুষ্টিকর, সুস্বাদু খাবার রান্না করা যায়। বলে গিয়েছিলেন, ঘরে চিঁড়ে-মুড়ি-চানাচুর এনে রেখে দিবি। যে দিন রান্নাবান্না করতে ইচ্ছে করবে না, সে দিন ওটা দিয়েই চালিয়ে নিবি। তবু বাইরের খাবার খাস না।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। মা চলে যাওয়ার পরেই সে বাইরে খেতে শুরু করেছিল। আর ক’দিনের মধ্যেই দেখা দিয়েছিল পেটের সমস্যা।
তখন বাড়ি থেকে শুধু মা-ই নন, বাবা আর বড়দাও ছুটে এসেছিলেন। বাবা ওর মাকে বলেছিলেন, ও যখন রান্না করে খাবেই না ঠিক করেছে, তখন ওর রান্না করার জন্য কোনও মেয়ে নয়, বিশ্বস্ত মেয়ে, মানে একটা বউয়ের ব্যবস্থা করি। কী বলো?
ঋর মা সঙ্গে সঙ্গে একেবারে লাফিয়ে উঠেছিলেন, এত বড় একটা সমস্যার সমাধান যে এত সহজে করে ফেলা যাবে, তাঁর মাথাতেই আসেনি। তিনি বলেছিলেন, খুব ভাল কথা বলেছ। এত দিনে সত্যিকারের একটা কথার মতো কথা বলেছ। করো করো। ব্যবস্থা করো।
ঋও আপত্তি করেনি। ফলে তিন মাসের মাথায় বিয়ে হয়ে গিয়েছিল ওদের। মা ক’দিন থেকে গুছিয়ে-গাছিয়ে সংসারটা নতুন বউয়ের হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন। মা যে ক’দিন ছিলেন, কোনও অসুবিধে হয়নি। মা চলে যাওয়ার পরেও সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু গত পরশু দিন যে কী হল, পরশু দিন! না তার আগের দিন রাত্রে! কে জানে, ও ঠিক বুঝতে পারছে না। পরশু সকাল থেকে ও যখন এ রকম করছে, তার মানে আগের দিন রাত্রেই সে কিছু একটা করেছে। কিন্তু সে যে কী করেছে! কিছুই বুঝতে পারছে না।
ছোটখাটো কোনও ব্যাপার হলে ও নিশ্চয়ই কিছু বলত। কোনও কথাই বলছে না মানে, সে বড়সড় কোনও একটা গণ্ডগোল করে ফেলেছে। কিন্তু কী!
না। কোনও কাজের লোক রাখার ব্যাপারে তার মায়ের যেমন একটাই কথা— না। তেমনি তার বউ তানিয়ারও। দু’জনের সংসার। ওই তো একটু রান্না। তার জন্য আবার লোক রাখা! না। একদম না। কোনও লোক রাখতে হবে না।
এখন ঋর মনে হচ্ছে, মা না থাক, একটা কাজের লোক না থাক, অন্তত একটা ঠিকে কাজের লোক রাখলেও হত। তা হলে আর কিছু না হোক অন্তত লোকচক্ষুর জন্য তার সামনে ও কথা বলতে বাধ্য হত। কিন্তু সে ব্যবস্থা যখন নেই, তখন উপায়!
সে ওকে কথা বলানোর জন্য কম চেষ্টা করেনি। সকালে ও তাকে যে চা দিয়ে যায়, সে সেটা বলতে গেলে প্রায় শেষ বিন্দুটাও চেটেপুটে খায়। একটু তলানি পড়ে থাকলেই তার বউ ডাক নেয়, কী গো। চা-টা কি ভাল হয়নি?
গত কাল যখন ওর ‘কি গো। চা-টা কি ভাল হয়নি?’ শোনার জন্য ইচ্ছে না থাকলেও অর্ধেকটার উপরে চা ফেলে রেখে আবার ঘাপটি মেরে শুয়ে পড়েছিল। এবং চোখ পিটপিট করে দেখছিল, ও আসছে কি না। ও যখন এল, তার মনে হল, এ বার নির্ঘাত ও মুখ খুলবে।
কিন্তু না। কিচ্ছু বলল না। অর্ধেক চা-সমেত কাপটা নিয়ে চলে গেল। টোস্ট খেতে গিয়ে দেখল, কম মাখন দেয় দেখে, যে বউকে প্রায়ই তাকে বলতে হয়, মাখন কি ফুরিয়ে গেছে? সে বউই স্লাইজ পাউরুটির উপরে এত পুরু করে মাখন লাগিয়ে দিয়েছে যে, বলার আর কোনও মুখই নেই।
অফিস যাওয়ার আগে মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মেখে প্রথম গ্রাস মুখে তুলে মাঝেমধ্যেই যাকে বলতে হয়, ‘বাবা, আবার সেই ঝাল?’ সে কিনা আজ ঝাল এত কম দেখে কোনও ট্যাঁ ফু-ই করতে পারল না।
বেরোবার সময় হাতে তুলে দেওয়ার জন্য যে তানিয়া হয়-পার্স, নয়-রুমাল কিংবা চশমা— একটা না একটা দেওয়ার কথা ঠিক ভুলে যায়, সেই তানিয়া আজ শুধু ওগুলোই নয়, ঋ দেখল, তার দিকে এক জোড়া ধোয়া মোজাও এগিয়ে দিয়েছে। জুতো পরতে গিয়ে আরও একবার চমকে গেল সে। দেখল, সেটাও পালিশ করা। একেবারে ঝকঝকে তকতকে।
ঋ অফিসে পৌঁছে তানিয়াকে ফোন করল। ভেবেছিল, ফোন করলে কথা না বলে তো আর পারবে না। কিন্তু একবার নয়, খানিকক্ষণ পর পর বেশ কয়েক বার ফোন করে সে দেখেছে, রিং হয়েই যাচ্ছে। তানিয়া ফোন ধরছে না। তাই বাধ্য হয়ে বেলার দিকে আর মোবাইলে নয়, বাড়ির ল্যান্ডফোনে ফোন করেছিল সে। যেহেতু তার বাড়িতে সিএলআই লাগানো নেই, ফলে কোন নম্বর থেকে ফোন করছে তা বোঝারও কোনও উপায় নেই। ফোন বাজলে ওকে ফোন তুলতেই হবে এবং আর কিছু না বলুক, অন্তত ‘হ্যালো’টা তো বলবে। আর একবার কথা বললেই ওর এই মৌনব্রতটা ভঙ্গ হয়ে যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হল না।
তানিয়া ফোনটা ধরেছিল ঠিকই। কিন্তু ‘হ্যালো’ তো দূরের কথা, একটা ‘হ্যাঁ’ ‘হুঁ’ও বলেনি। বাধ্য হয়ে ঋ নিজেই বলেছিল— হ্যালো। আর যে-ই সে ‘হ্যালো’ বলেছে, অমনি ঝপ করে রিসিভার নামিয়ে রেখেছে ও। দু’-তিন বার করার পর আর রিং হচ্ছিল না। শুধু কুক কুক কুক কুক হচ্ছিল। তখনই ঋ বুঝেছিল, ও ক্রেডেল থেকে রিসিভারটা নামিয়ে রেখেছে।
বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে ঝুল-বারান্দায় গিয়ে একটু দাঁড়িয়েছিল ঋ। হঠাৎই ঢং ঢং ঢং ঢং। এ দু’দিনেই সে বুঝে গেছে, ঘণ্টার ধ্বনি মানেই তানিয়ার তলব।
তড়িঘড়ি গিয়ে দেখে টেবিলে গরম গরম লুচি, আলুর দম আর বেগুন ভাজা। যেগুলি তার ভীষণ প্রিয়। তার পরেই, না। চা নয়, কফি।
সবই করছে ও। শুধু কথা বলছে না। কিন্তু কেন? ওর হঠাৎ মনে হল, বিচারক ফাঁসির হুকুম দিয়ে দিল, অথচ অপরাধী জানতেই পারল না, তার অপরাধটা কী।
না। তাকে জানতেই হবে সে কী দোষ করেছে। কিন্তু সেটা জানতে গেলে তো তার মুখ খোলাতে হবে। মুখ খোলাতে গেলে কী করতে হবে! অনেক ভেবেচিন্তে অবশেষে সে একটা পথ বার করল।
গা গা করে টিভি চালালেই ও বলে, কী হচ্ছে কী, আস্তে করো। আস্তে। কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। আর ওর যখন ঘুম পায়, যতক্ষণ না ও ঘুমে ঢলে পড়ে, ততক্ষণ একটাই ভাঙা রেকর্ড ক’মিনিট পরে পরেই বাজিয়ে যায়— এ বার বন্ধ করো। চোখের সামনে এত আলো থাকলে ঘুমোনো যায়! কাল আবার সকালে উঠতে হবে তো…
শুধু গা গা করে কেন, একেবারে ফুল ভলিউমে টিভি চালিয়ে ঋ দেখল, তার বউ ঝট করে তার দিকে বিরক্তির সঙ্গে এক ঝলক তাকিয়েই, দু’কানে দুটো বালিশ চাপা দিয়ে পাশ ফিরে শুল। তাই ‘চোখের সামনে এত আলো থাকলে ঘুমোনো যায়!’ বউয়ের মুখ থেকে অন্তত একবার শোনার জন্য, নিজের ঘুম পেলেও বড় বড় চোখ করে ঋ তাকিয়ে রইল টিভির দিকে। তবু তানিয়ার দিক থেকে কোনও উচ্চবাচ্য শোনা গেল না।
এ রকম পরিস্থিতিতে আদর করতে গেলে নিশ্চয়ই ও বেঁকে বসবে। জোড়াজুড়ি করতে গেলে অন্তত একবার তো বলবে, ‘ছাড়ো তো’ কিংবা ‘ভাল লাগছে না, যাও’ অথবা ‘আমার ঘুম পাচ্ছে’।
কিন্তু না। আদর করতে গিয়ে সে দেখল, ও কোনও আপত্তি করল না। তবে সেই আদরে কোনও সাড়াও দিল না। শুধু মড়ার মতো পড়ে রইল।
কেন? কেন? কেন? কেন ও এ রকম করছে? কেন? যে দিন থেকে ও কথা বলা বন্ধ করেছে, তার আগের দিন থেকে সে কী কী করেছে, তার কোনটা ওর খারাপ লাগতে পারে, ওকে আহত করতে পারে, ওর মনে লাগতে পারে, সারাক্ষণ ধরে মনে করার চেষ্টা করতে লাগল ঋ। কিন্তু না। সে রকম কিছুই তার মনে পড়ল না।
যখন বারবার ব্যর্থ হল ঋ, তখন অফিসে তার সবচেয়ে যে কাছের, যাকে অনায়াসে ভরসা করতে পারে সে, তার থেকে বয়সে একটু বড় হলেও, সেই বুদ্ধদার কাছে গিয়েই সব খুলে বলল সে।
বুদ্ধদা সব শুনে বলল, কথা বলছে না? অথচ সব কাজ মুখ বুজে করে যাচ্ছে?
— হ্যাঁ। সব সব। সব কাজ করে যাচ্ছে। অথচ…
— তুই কী করেছিস রে! একবার বল ভাই। একবার বল। যে ভাবেই হোক তুই ওটা খুঁজে বার কর।
— কী?
— কেন ও কথা বলছে না…
— চেষ্টা তো করছি। কিন্তু পারছি কই!
— পারছি না বললে হবে না বস্। খুঁজে বার করতেই হবে। আমার লাগবে।
— আমার লাগবে মানে? কী লাগবে?
— তুই কী করেছিস, যার জন্য তোর বউ তোর সঙ্গে কথা বলছে না, সেটা…
— আমার বউ আমার সঙ্গে কেন কথা বলছে না, সেটা জেনে তুমি কী করবে?
— অ্যাপ্লাই করব ভাই। অ্যাপ্লাই । শুধু আমি না। ওই ওষুধে সত্যিই যদি কাজ হয়, তা হলে দেখবি, গোটা পৃথিবীর সব বিবাহিত পুরুষই তোর নামে ধন্য ধন্য করবে…
— ধন্য ধন্য করবে! কেন?
— আরে, বউ যদি চুপ থাকে, তা হলে তো সংসারে আর কোনও অশান্তিই থাকবে না। শুধু শান্তি আর শান্তি। শান্তির সংসার কে না চায় বল? আর তার উপরে সে যদি নিশব্দে কাজ করে যায়, তা হলে তো কোনও কথাই নেই। একেবারে সোনায় সোহাগা।না। বউ কথা বলবে না, সে রকম শান্তির সংসার আমার দরকার নেই। আমি চাই ও কথা বলুক। কথা না বললেও গজগজ করে অন্তত একটু বিরক্তি প্রকাশ করুক। সেটুকুও তো করছে না। তা হলে উপায়!
হ্যাঁ। উপায় একটা আছে। কথা না বলাতে পারি, হাসাতে তো পারি। সামান্য হাসির কথা শুনলেই যে হো হো করে হেসে ওঠে, হাসি থামলেও ঘণ্টাখানেক ধরে চলে দমকে দমকে হাসি। থামতেই চায় না। তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে যদি একটা পর একটা জোকস পড়ে যাই, তা হলেও কি ও হাসবে না!
রাত্রে খাটে উঠে ও আর টিভি চালাল না। মোবাইল থেকে একটার পর একটা চুটকি পড়ে যেতে লাগল। আর এক-একটা চুটকি শেষ হতে না-হতেই আড়চোখে তাকাতে লাগল তানিয়ার দিকে।
না। ও হাসছে না। বেশ কয়েকটা পড়ার পর ঋ যখন আবার ওর দিকে তাকাল, দেখল, তার বউ আঁচলের কোণ দিয়ে চোখ মুছছে। ও কাঁদছে! ঝট করে তানিয়ার দিকে ফিরল সে— কী হয়েছে? কাঁদছ কেন? আমি কী করেছি? আরে বাবা, আমাকে তো বলবে আমার দোষটা কোথায়? না জানলে আমি নিজেকে শোধরাব কী করে? আবার তো ওই একই ভুল করব…
— তুমি জানো না, তুমি কী করেছ? তিন দিনের মাথায় এই প্রথম মুখ খুলল তানিয়া।
ঋ বলল, জানলে কি জিজ্ঞেস করতাম? বলো, কী করেছি?
— পরশুর আগের দিন রাতে যখন তোমাকে বললাম, টিভিটা অফ করে দাও। দিয়েছ? একবার দু’বার না, কত বার করে বললাম। তুমি শুনেছ? তু়মি যখন আমার কোনও কথা শোনো না। তখন আমিও তোমার কোনও কথা শুনব না। শুধু শুনব না, না। তোমার সঙ্গে আমি আর কখনও কোনও কথা বলব না।
— ও… এই কথা? সেটা আগে বলবে তো… বালিশের পাশ থেকে রিমোটটা নিয়ে বউয়ের দিকে এগিয়ে দিল ঋ, এই নাও। এ বার থেকে তোমার যখন যে চ্যানেল দেখতে ইচ্ছে করবে, দেখবে। যখন ইচ্ছে করবে না, বন্ধ করে দেবে। আমি আর এটায় হাতই দেব না। নাও।
তানিয়ে বলল, থাক। লাগবে না।
— কেন?
— তোমার টিভি… তোমার রিমোট…
— আমি কি সে কথা একবারও অস্বীকার করেছি? হ্যাঁ, এটা আমার টিভি… আমার রিমোট…
এত কিছুর পরেও আবার ‘আমার’ ‘আমার’! ঋর মুখের দিকে ঝট করে তাকাল তানিয়া। ওকে ও ভাবে তাকাতে দেখে ঋ বলল, সব আমার ঠিকই, কিন্তু আমিই তো তোমার। আর আমি যখন তোমার, তখন আমার সঙ্গে সঙ্গে আমার সব কিছুই তো তোমার, তাই না? তা হলে? এই নাও, ধরো।
ঋর হাত থেকে রিমোটটা নিয়ে যে চ্যানেল দেখতে ও ভালবাসে, না। সেটা নয়, বরং যেটা চালালে ও নিজেই রেগে যায়, যেটা ওর দু’চক্ষের বিষ, অথচ ঋর খুব প্রিয়, সেই চ্যানেলটা চালিয়ে দিল তানিয়া।
তানিয়ার হাত থেকে রিমোটটা নিয়ে, তানিয়া যে চ্যানেলটা দেখতে ভালবাসে, ঋ সেটায় দিয়ে দিল।
তানিয়া ফের রিমোটটা নিয়ে আগেরটা চালিয়ে দিল।
তানিয়া মুঠো করে ধরে রাখলেও, ঋ প্রায় জোর করেই তানিয়ার হাত থেকে রিমোটটা নিয়ে আবার তানিয়ার প্রিয় চ্যানেলটা চালিয়ে দিল।
তানিয়া বলল, এটা কী হচ্ছে? রিমোটটা দাও।
— তুমি তো এই চ্যানেলটাই দেখতে ভালবাসো।
— এখন আমার এটা দেখতে ভাল লাগছে না। আমি ওটাই দেখব।
— কিন্তু তুমি তো ওটা ভালবাসো না…
— সেটা আমার ইচ্ছে। এই তো একটু আগেই বললে, এ বার থেকে তোমার যখন যে চ্যানেল দেখতে ইচ্ছে করবে, দেখবে…
আর কোনও কথা বলল না ঋ। তানিয়ার দিকে রিমোটটা এগিয়ে দিল। তানিয়া সেটা নিয়ে চ্যানেলটা পাল্টে দিতেই ঋ ওর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে টিভির দিকে চোখ রাখল। শুধু ঋ নয়, তানিয়াও দু’চোখ ভরে দেখতে লাগল, এই ক’দিন আগেও যেটা চালালে ও বরক্ত হত, সেই চ্যানেল। দেখতে লাগল। দেখতেই লাগল। -
গল্প- ঘুমকাতুরে
ঘুমকাতুরে
– সিদ্ধার্থ সিংহশময়িতার সন্দেহটা এখন আর সন্দেহের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সে বুঝে গেছে, তার কপাল পুড়তে চলেছে। না-হলে যে শ্রয়ন সন্ধে গড়াবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমে ঢলে পড়ত। বিছানাটা পর্যন্ত ঝাড়তে দিত না। একটু উঠতে বললে কোনো ঘরে গিয়ে যে শুয়ে পড়তো বোঝা যেত না। খুঁজতে খুঁজতে ওর দম বেরিয়ে যেত। সেই শ্রয়নই কিনা এখন রাত এগারোটাতেও বাড়ি ঢোকে না! কোথায় যায়! নিশ্চয়ই কোনও মেয়ের পাল্লায় পড়েছে!
নাকি আমি যাতে ওর ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটাই, সে জন্য অফিস থেকে চুপিচুপি বাড়ি ঢুকে অন্য কোনো ঘরে গিয়ে একচোট ঘুমিয়ে নেয়! তার পর পেটের মধ্যে যখন ছুঁচোয় ডন মারে, তখন আর থাকতে না পেরে খাওয়ার জন্য জামাটামা গুঁজে বুটটুট পরে এমন ভাবে ঘরে ঢোকে যেন এক্ষুনি অফিস থেকে ফিরল!
কিন্তু না। সেটাও যে না, তাও প্রমাণ হয়ে গেল। ক’দিন ধরে তন্ন তন্ন করে গোটা বাড়ি খুঁজেও সে তার স্বামীকে কোত্থাও পায়নি। তা হলে কি এই বাড়ির মধ্যে এমন ঘরও আছে, যার হদিশ সে জানে না!
হতেই পারে। এখন অবস্থা অনেকটা পড়ে গেলেও এক সময় তো সবই ছিল। লোক-লস্কর। লেঠেল-বাহিনী। এমনকী বিশ্বস্ত গুপ্তচরও। ছিল প্রচুর জমিজমাও। ওদের জমিদারি নাকি বহু দূর অবধি বিস্তৃত ছিল। এখন অবশ্য সেই অর্থে বলতে গেলে কিছুই নেই। থাকার মধ্যে শুধু আছে ওর বাপ-ঠাকুর্দার তৈরি করে যাওয়া এই বাড়ি। কেন যে এত বড় বাড়ি বানিয়েছিলেন কে জানে! এক একটা ঘর তিন তলার সমান উঁচু উঁচু। কড়িবরগার ছাদ। সেখান থেকে লম্বা লম্বা রড দিয়ে আদ্যিকালের সিলিং ফ্যান ঝোলানো। চালালেই ঘটাং ঘটাং আওয়াজ হয়। যত না হাওয়া লাগে, তার চেয়ে বিরক্ত লাগে বেশি। ওগুলো খুলে ফেলে নতুন ফ্যান লাগানোর কথা বলতে গেলেই শ্রয়ন একেবারে রে রে করে ওঠে। বলে, না না না। ওগুলো খোলা যাবে না। ওগুলো আমাদের পূর্বপুরুষের স্মৃতি।
গোটা বাড়িতে লোক বলতে সাকুল্যে তিন জন। সে, তার স্বামী আর তাদের একমাত্র ছেলে। অথচ দোতলাতেই বিশাল বিশাল এগারোখানা ঘর। ঘর তো নয়, এক-একটা ফুটবল খেলার মাঠ। কেউ হুট করে ঢুকলে ডবল বেডের খাটটাকেও তার মনে হবে ঘরের কোণে যেন একটা ছোট্ট জলচৌকি পড়ে আছে।
এ ছাড়া, এ দিকে ও দিকে ছোট ছোট ঘর তো আছেই। কিছু তালা দেওয়া, কিছু হাট করে খোলা। এখান সেখান থেকে নেমে গেছে চোরাগোপ্তা সরু সরু সিঁড়ি। উপরেও উঠে গেছে বেশ কয়েকটা। বাইরে থেকেও আছে খানকয়েক লোহার ঘোরানো সিঁড়ি। কোনওটা দোতলা, কোনওটা তিনতলা অবধি। সেগুলি আর ব্যবহার হয় না। বেশির ভাগ পা-দানিই উধাও হয়ে গেছে। কারা যে নিয়ে গেছে!
বিয়ের পর এতগুলো বছর কেটে গেলেও এ বাড়ির সব ক’টা ঘর এখনও তার খুলে দেখা হয়নি। নীচে ক’টা ঘর আছে কে জানে! উপরের কয়েকটা ঘর তো পায়রাদের দখলে চলে গেছে। তাদের বকম বকমে প্রথম দিকে ওর ঘুমই হত না। এখন অবশ্য অভ্যাস হয়ে গেছে।
কত লোক এসে ওদের ধরে। থাকার জন্য তো বটেই, কেউ কেউ বন্ধ ঘরগুলো গো-ডাউন হিসেবেও ভাড়া নিতে চায়। তার উপরে আছে নতুন নতুন গজিয়ে ওঠা প্রমোটারদের নানা প্রলোভন। শুধু সে ভাবে চাপ দিতে পারে না শময়িতার মামাতো ভাইয়ের জন্য।
শময়িতা বহু বার তার স্বামীকে বলেছে, নীচের ঘরগুলো তো খোলাও হয় না। পড়ে থেকে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পয়-পরিষ্কার করে ভাড়া দিয়ে দাও না… টাকার টাকাও আসবে। ঘরগুলোতেও আলো-বাতাস ঢুকবে।
কিন্তু শ্রয়নের সেই এক কথা— না। আমাদের বংশের কেউ কখনও বাড়িঘর ভাড়া দেয়নি। আমিও দেবো না। না খেতে পেয়ে মরে গেলেও দেবো না। এটা আমাদের ঐতিহ্য।
শময়িতা বহু বার চেষ্টা করেও ওকে বোঝাতে পারেনি, দিন বদলে গেছে। সময়ও পাল্টে গেছে। সময়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে না পারলেই পিছিয়ে প়ড়বে। বিপদে পড়বে। তোমাদের খুড়তুতো ভাইদের দেখো…
ওদের খুড়তুতো ভাইদের বাড়িটাও ওদের মতোই বিশাল। ওদের বাড়ির লাগোয়াই। খুড়তুতোরা চার ভাই। কেউই কিছু করে না। ওদের গায়ের রং এত ফর্সা যে, যে-পাড়ার লোকেরা দু’পুরুষ আগেও ওদের দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস পেত না, ওদের প্রজা ছিল, অবস্থা পড়ে গেছে দেখে তারাও ওদের পিছনে লাগে। দেখলেই, সাদা পাটালি বলে খেপায়।
আর ওদের বাবা? মানে শ্রয়নের কাকা? প্রত্যেক দিন সকালে বাজার যাওয়ার আগে ব্যবহারে-ব্যবহারে শতচ্ছিন্ন ময়লা একটা ফর্দ পাড়ারই একটা মুদিখানা দোকানে জমা দিয়ে যান। ফেরার সময় সেই ফর্দ মিলিয়ে মুদিওয়ালার রেডি করে রাখা প্রতিদিনকার তেল, নুন, মশলা নিয়ে বাড়ি আসেন।
শ্রয়ন নাকি একবার তার কাকাকে জি়জ্ঞেস করেছিল, এক মাসের না হোক, অন্তত সারা সপ্তাহেরটা তো একসঙ্গে কিনে রাখতে পারেন।
উনি বলেছিলেন, সে তো পারিই। কিন্তু কাল যদি মরে যাই?
কাকার কথা শুনে শ্রয়ন থ হয়ে গিয়েছিল। শ্রয়নদের অবস্থা অবশ্য তার কাকাদের মতো নয়। কাকারা কোনও কিছুই ধরে রাখতে পারেননি। বহু আগেই সব বেচেবুচে দিয়েছেন। এখনও এই বাড়িটা ছাড়াও শ্রয়নদের আরও একটা বাড়ি আছে। দেশের বাড়ি। সেই বাড়িটা আরও বড়। সাত ভূতে খাচ্ছে। শময়িতা ওই বাড়ির কথা জানার পরে ছ’মাসে ন’মাসে অন্তত একবার কোনও রকমে ঠেলেঠুলে শ্রয়নকে পাঠাত। যারা ওদের জমি ভাগে চাষ করে তাদের কাছ থেকে টাকা তুলে আনার জন্য। কিন্তু যেহেতু জমিগুলো একলপ্তে নয়, ভিন্ন ভিন্ন লোকে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় চাষ করে এবং এখন নতুন নতুন নিয়মকানুন যা হচ্ছে, আর যে ভাবে রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনীতি ঢুকে পড়ছে, তাতে জমিতে থেকেই জমি রক্ষা করা যাচ্ছে না। আর তারা তো গ্রাম থেকে পাঁচশো মাইল দূরে বসে আছে। সুতরাং ছড়ানো-ছেটানো চাষের জমিগুলো সব দখল হয়ে যাবার জোগাড়়।
শময়িতা কত বার বলেছে, জমি কখনও কারও বাপের হয় না। দাপের। আমরা ওখানে থাকিই না, তো দাপট দেখাব কী! তা ছাড়া, আমরা তো আর ওখানে থাকতে যাব না। শুধু শুধু অত জমি ওখানে ফেলে রেখে কী হবে? একদিন দেখবে সব দখল হয়ে গেছে। এ বার আস্তে আস্তে জমিজমাগুলো বিক্রি করার চেষ্টা করো। দরকার হলে ক’টা দিন ওখানে গিয়ে থাকো। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ঘুম পেলে ও আর কিচ্ছু চায় না।
এই ঘুমের জন্যই শ্রয়ন কোনও দিন চাকরি বাকরি করেনি। খুড়তুতো ভাইদের মতোই পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া টাকাতেই বসে বসে খেত। বিয়ের পর শময়িতাই বলেছিল, জানো তো, রাজার ধনও ঝিনুক মাপতে ফুরিয়ে যায়। শুধু পড়ে পড়ে ঘুমোলে চলবে? এত ভাল রেজাল্ট তোমার, কিছু একটা করো। না। তোমাকে টাকার জন্য চাকরি করতে বলছি না। আসলে, কাজের মধ্যে থাকলে তোমার মনটাও ভাল থাকবে, তাই…
সে হ্যাঁ-ও বলেনি, না-ও বলেনি। তার পর এমপ্লয়মেন্ট গ্রেজেট দেখে শময়িতাই একটা চাকরির সন্ধান দিয়েছিল। ওকে দিয়ে শময়িতাই দরখাস্ত লিখিয়েছিল। এবং শময়িতা নিজে গিয়েই সেটা পোস্ট করে এসেছিল। ইন্টারভিউয়ের দিন শময়িতাই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল। এবং ইন্টারভিউয়ে ঢোকার ঠিক আগের মুহূর্তে শ্রয়নের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিল, তুমি যদি খুব ভাল করে ইন্টারভিউ দাও, তা হলে টানা তিন দিন তোমার ছুটি। যত ইচ্ছে ঘুমিয়ো। আমি তোমাকে একবারও ডাকব না।
ওই কথা শুনে চকচক করে উঠেছিল শ্রয়নের চোখ। সত্যি?
শময়িতা বলেছিল, সত্যি। আর তাতেই কাজ হয়েছিল। কিন্তু এই ঘুমের জন্য ও কম দিন অফিস কামাই করেছে? গেলেও, অফিসে বসে বসেই ও ঘুমোত। সেই জন্য ওর সহকর্মীরা পর্যন্ত ওর নাম দিয়ে দিয়েছিল— ঘুমকাতুরে। সেই বদনাম ঘোচানোর জন্যই শময়িতা রোজ সকালে তাকে জোর করে ঘুম থেকে তুলে দিত।
ক’দিন আগে হঠাৎ কী হল, শ্রয়ন অফিস থেকে ফিরেই চা খেতে খেতে শময়িতাকে বলল, জানো তো, আমাদের অফিসের কলিঙ্গদা, যে সব থেকে বেশি সিগারেট খেত, একেবারে চেনস্মোকার, গত কাল থেকে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন।
শময়িতা জানতে চাইল, কেন?
— কেন আবার? ওর বউ খেতে বারণ করেছে, তাই।
— বাঃ, তোমাদের কলিঙ্গদাকে তো বেশ ভাল বলতে হবে।
— কেন? আমি ভাল না?
— তোমাকে যে ভাল বলব, তুমি কি তোমার বউয়ের কথা শোনো?
— শুনি না বুঝি? এক বড় অপবাদ? ঠিক আছে, কাল থেকে তুমি যেটা বারণ করো, আমি আর সেটা কিছুতেই কবর না।
— কী?
— পড়ে পড়ে আর ঘুমোব না।
— তুমি? ঘুমোবে না? তা হলেই হয়েছিল।
— এই তো? চ্যালে়ঞ্জ। কাল থেকে তোমাকে আর ডাকতে হবে না। আমি নিজে তেকেই সক্কালবেলায় উঠে যাব। দেখে নিয়ো।
শময়িতা একটু হেসে বলল, তার সঙ্গে তা হলে এটাও দেখতে হবে, সূর্য পশ্চিম দিকে উঠেছে কি না…
— সুর্যের কথা আমি বলতে পারব না। আমি আমার কথা বলছি।
— ঠিক আছে, দেখা যাবে।
সত্যি সত্যিই শ্রয়ন যে এটা করতে পারবে শময়িতা তা কল্পনাও করতে পারেনি। হ্যাঁ, এখন ক’দিন ধরে ওকে আর ডাকতে হচ্ছে না। শ্রয়ন নিজে থেকেই সকাল সকাল উঠে পড়ছে। অফিসেও বেরিয়ে পড়ছে ঠিক সময়ে। এই সব দেখে শময়িতার মনে হঠাৎ খটকা লাগল, আচ্ছা, অফিসে গিয়ে ও আবার ঘুমোচ্ছে না তো! একটা ফোন করে দেখব! মনে হতেই মোবাইলটা হাতে তুলে নিয়েছিল শময়িতা। তার পর বেশ কয়েক বার পর পর চেষ্টা করে গেল শ্রয়নকে মোবাইলে ধরতে। কিন্তু না। ওর ফোনে নট রিচেবল। অগত্যা শময়িতা ফোন করল, অফিসের ল্যান্ড নম্বরে। দুটো রিং হতে না-হতেই ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল, হ্যালো?
— শ্রয়ন আছে?
— না। ও তো আজ আসেনি।
— আসেনি?
— না। ও তো দু’-তিন দিন ধরে আসছে না।
— মানে?
— আপনি কে বলছেন?
কথাটা শুনে শময়িতা বলতে যাচ্ছিল, আমি ওর ওয়াইফ বলছি। কিন্তু না। ও আর একটা কথাও বলল না। সঙ্গে সঙ্গে লাইন কেটে দিল।
এ রকম উত্তর শোনার জন্য শময়িতা একদম প্রস্তুত ছিল না। ভাবতে লাগল, দু’-তিন দিন ধরে ও অফিসে যাচ্ছে না! কিন্তু রোজই তো খেয়েদেয়ে অফিসের নাম করে বেরোচ্ছে। তা হলে যাচ্ছে কোথায়! তবে কী… হ্যাঁ, হতেই পারে। রাইয়ের হাজব্যান্ড হীমবন্তদা তো স্কুল টিচার। যথেষ্ট সচ্ছল অবস্থা। তবু বউ-ছেলেমেয়েকে আরও একটু ভাল রাখার জন্য একটা কোচিং সেন্টার খুলেছিলেন। পাশের পাড়ায় একটা গ্যারেজ ঘর ভাড়াও নিয়েছিলেন। শুধু সকালেই নয়, বিকেলেও দফায় দফায় ইলেভেন-টুয়েলভের ছেলেমেয়েরা সেখানে টিউশন নিতে যেত। শনি-রবিবারও বাদ যেত না।
সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু তার মধ্যেই ঘটে গেল একটা অঘটন। ওই পাড়ার ছেলেরা হঠাৎ একদিন তাঁকে শুধু বেধড়ক পেটালই না, মারতে মারতে প্রায় আধমড়া করে দিল। এবং বলে দিল, এ অঞ্চলের ত্রিসীমানার মধ্যে যেন আর না দেখি…
রাই অবাক। তার স্বামীর মতো স্বামী হয় না। একেবারে মাটির মানুষ। কোনও সাতেপাঁচে থাকেন না। আর তাঁকে কিনা এ ভাবে মারধর? পা়ড়ার দু’জনকে নিয়ে দৌড়ে গিয়েছিল সে। থানায় গিয়ে শুনেছিল তাঁর স্বামীর কেলোরকীর্তির কথা। লাস্ট ব্যাচ চলে যাওয়ার পরেও, অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়া সদ্য কোচিংয়ে আসা ক্লাস ইলেভেনের একটি মেয়েকে উনি স্পেশাল ক্লাস নেওয়ার জন্য থাকতে বলেছিলেন। কয়েকটি অঙ্ক দেখিয়ে দেওয়ার পরেই উনি নাকি আচমকা মেয়েটিকে জাপটে ধরে পাগলের মতো অসভ্যতা শুরু করে দেন।
প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও পর মুহূর্তেই মেয়েটি চিৎকার করে ওঠে। আশপাশের লোক জড়ো হয়ে যায়। তারা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখে মাস্টারমশাই ঘরের কোণে সিঁটিয়ে আছেন আর মেয়েটি ভয়ে-আতঙ্কে হাউহাউ করে কাঁদছে। খবর পেয়ে দৌড়ে আসে গলির মুখে ক্যারামবোর্ড খেলতে থাকা পাড়ার ছেলেরা। তাদের বুঝতে অসুবিধে হয় না কী ঘটেছে। ওরা তার স্বামীকে কলার ধরে টেনে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে ঘর থেকে বার করে এনে রাস্তার উপরে ফেলে এলোপাথাড়ি কিল-চড়়-লাথি মারতে থাকে।
মার সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যান তিনি। খবর যায় লোকাল থানায়। পুলিশ এসে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
শুধু ওই মেয়েটিই নয়, ওই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরে নাকি একে একে আরও অনেক মেয়েই মুখ খুলেছিল। বলেছিল, তাদের সঙ্গেও নাকি উনি অসভ্যতা করেছেন। কিন্তু ভয়ে, লজ্জায়, কে কী বলবে ভেবে তারা চেপে গেছে। কেউ কেউ বাড়িতেও জানিয়েছিল ব্যাপারটা। কিন্তু বেশির ভাগ বাড়ি থেকেই নাকি বলেছিল, যা হবার হয়ে গেছে। কাউকে কিছু বলতে যাস না। এ সব জানাজানি হলে মানসম্মান নিয়ে টানাটানি হবে। থানা পুলিশ হবে। আজেবাজে প্রশ্ন করবে। বিয়ে দিতে গেলে সমস্যা হবে। তার চেয়ে বরং চুপ করে থাকাই ভাল। দরকার হলে ওখানে আর পড়তে যাস না।
এই সব শুনে হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল রাই কেমন যেন গুটিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। কারও সঙ্গেই সে ভাবে আর মিশত না। শময়িতার সঙ্গেও না। যেন স্বামী নয়, দোষটা সে-ই করেছে। এটা দেখে রাইয়ের জন্য সমবেদনা হলেও মনে মনে বেশ খুশিই হয়েছিল সে, আর যাই হোক, তার স্বামী অন্তত ও রকম নয়।
কিন্তু অফিসে ফোন করে এ কী শুনল সে! ও দু’-তিন দিন ধরে অফিসে যাচ্ছে না! ভাগ্যিস ওর মোবাইলে নট রিচেবল আসছিল। তাই বাধ্য হয়ে অফিসের ল্যান্ড নম্বরে ফোন করেছিল। না হলে তো সে জানতেই পারত না, তার বিশ্বাসটাকে ঘুণপোকারা ভিতরে থেকে কী ভাবে কুরে কুরে ফোঁপরা করে দিয়েছে।
তখনই তার সন্দেহ দানা বেঁধে উঠেছিল। মনে মনে বলেছিল, না। ও ঠিক করেনি। তার বিশ্বাসে আঘাত করেছে। এ জন্যই কি যখন তখন হুটহাট করে ও বেরিয়ে যাচ্ছে! রাত করে ফিরছে! তার মাইনের কোনও হিসেব পাচ্ছে না সে! কানাঘুষোয় জানতে পারছে, তার স্বামী একটু একটু করে দেশের জমিজমা বেচে দিচ্ছে! তার মানে সে যা সন্দেহ করছে সেটা সত্যি! ও অন্য কোনও মেয়ের পাল্লায় পড়েছে! তার পিছনেই ঢালছে সব টাকা! ছিঃ ছিঃ ছিঃ। আমার কথা না হয় বাদই দিলাম। এ সব করার আগে কি ছেলের মুখটাও ওর একবার মনে পড়ল না! জানাজানি হলে লোকের কাছে আমি মুখ দেখাব কী করে! মা-বাবাই বা কী ভাববেন! আচ্ছা, ক’দিন আগে কতগুলো কাগজে আমাকে দিয়ে ও সই করিয়েছিল না! টিক দেওয়া জায়গাগুলো দেখিয়ে বলেছিল, সই করতে। ও বলেছিল দেখে সে সই করে দিয়েছিল। একবার চোখ বুলিয়ে দেখারও প্রয়োজন মনে করেনি। ওগুলো কীসের কাগজ ছিল! ও আবার কায়দা করে ডিভোর্সের কাগজে সই করিয়ে নেয়নি তো! চার দিকে যা শুনছি, আমার তো এখন সন্দেহ হচ্ছে…
না। আমি ওকে ছাড়ব না। এর একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়ব। ওর সত্যিই যদি কাউকে মনে ধরে থাকে, তা হলে তাকে নিয়েই থাকুক। আমার কাছে আসতে হবে না। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে আমি। তাঁদের অবর্তমানে গোটা বাড়িটাই আমার। আর বাবার যা ফিক্সড ডিপোজিট করা আছে, সে সব তো আমিই পাব। তার সুদে আমার আর আমার ছেলের বাকি জীবনটা খুব ভাল ভাবেই চলে যাবে। দরকার নেই তাকে। ঠিক আছে, দেখি… বলেই, ফোন করেছিল তার মামাতো ভাইকে। সে থাকে পাশের পাড়ায়। ওই এলাকার বেশ হোমড়াচোমড়া। পার্টি করে। সব শুনে সে বলল, কিচ্ছু ভাবিস না, আমি তো আছি। তোকে পরে ফোন করছি।
শময়িতা জানে, ও এই রকমই। পরে ফোন করছি বলেছে মানে ও আর ফোন করবে না। নানা নক্কাছক্কা করে বেড়ায়।
কিন্তু না। তার কিছুক্ষণ পরেই সে ফোন করল। এবং শময়িতাকে কিছু বলতে না দিয়েই বলল, শোন, তুই যে ওর অফিসে ফোন করেছিলি, ওখানে তোর পরিচয় দিসনি তো?
— না।
— ঠিক আছে। ও এলেও ওকে একদম কিচ্ছু বলবি না। ওকে বুঝতেই দিবি না যে, তুই টের পেয়েছিস। বুঝেছিস? ও যখন কাল অফিসে বেরোবে, তার আগে তুই শুধু আমাকে একটা মিস কল করবি, বুঝেছিস? তোকে আর কিচ্ছু করতে হবে না। যা করার আমিই করব। দেখি ওর ক’টা পাখনা গজিয়েছে…মামাতো ভাইয়ের কথা মতোই কাজ করেছিল শময়িতা। সমস্ত যন্ত্রণা চেপে রেখে রোজকার মতোই ডাইনিং টেবিলে খাবার বেড়ে দিয়েছিল সে। হাজার চেষ্টা করেও নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারছিল না। এই লোকটাই সে? যে তাকে একদিন ভালবেসে বিয়ে করেছিল! এই-ই সে! বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল শ্রয়নের চোখের দিকে।
শ্রয়ন যখন এঁঠো হাত বেসিনে ধুয়ে জামাপ্যান্ট পরার জন্য শোবার ঘরে ঢুকল, শময়িতা তখন পাশের ঘরে গিয়ে রোজকার মতো স্বামীর হাতে তুলে দেবার জন্য রুমাল, পার্স আর চশমাটা নিয়ে, না, মিস কল নয়, চুপিচুপি ফোন করে তার মামাতো ভাইকে খুব চাপা গলায় জানিয়ে দিল, ও এক্ষুনি বেরোচ্ছে।
শ্রয়ন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গলির মুখে এসে টপাটপ বোতাম টিপল মোবাইলের। তার পর দাঁড়িয়ে রইল। সামনে দিয়ে একটা বাস চলে গেল। যেটা ওর অফিসের সামনে দিয়ে যায়। কিন্তু ও তাতে উঠল না। ও ইচ্ছে করলেই একটা কেন, একসঙ্গে দু’-চার-পাঁচটা নতুন গাড়ি কিনতে পারে। কিন্তু মৃত্যুর আগে যেহেতু ওর বাবা বলে গিয়েছিলেন, দ্যাখ, আমাদের তো বাপ-ঠাকুর্দার রেখে যাওয়া টাকার সুদে সংসার চলে। সেই সুদ কিন্তু দিনকে দিন কমছে। ফলে যতটা সুদ আসছে, তার চেয়ে কম খরচ করতে হবে। কিছু কিছু করে সুদের টাকা জমিয়ে মূল টাকার সঙ্গে ফিক্সড করতে হবে। না হলে মহাবিপদ। কারণ, আমার তো মনে হয়, যে হারে সুদ কমছে, সেই দিন আর বেশি দূরে নেই, যে দিন সুদ দেওয়া তো দূরের কথা, নিরাপদে টাকা গচ্ছিত রাখছে বলে ব্যাঙ্কগুলি উল্টে টাকা চাইবে। সুতরাং এখন থেকে সতর্ক হতে হবে। খরচের বহর কমাতে হবে। এক্ষুনি রাশ টানতে না পারলে আর দেখতে হবে না…
সেই কথা মাথায় রেখেই বাবার মৃত্যুর পরে ও খরচ কমাতে শুরু করেছিল। বাড়িতে দু’-দুটো গাড়ি থাকলেও ও ট্রামে বাসেই যাতায়াত করত। যখন চাকরি পেল তত দিনে গাড়ি দু’টো পড়ে থেকে থেকে লড়ঝড়ে হয়ে গেছে। কেজি দরেও বিক্রি করা যাবে না। ও আর গাড়ি কেনেনি।
দু’মিনিটও হল না, ওর সামনে একটা ওলা এসে দাঁড়াল। ও সেটায় উঠে পড়ল।
ট্যাক্সিটা স্টার্ট দিতেই ওর পিছু নিল একটা নয়, গলির এ মুখে এবং ও মুখে অপেক্ষা করতে থাকা দু’-দুটো ঝাক্কাস বাইক। দু’টো বাইকেই চালক ছাড়াও পিছনে একজন করে ছেলে।
টিভি সেন্টারের সামনে দিয়ে এসে ট্যাক্সিটা লর্ডস বেকারির মোড় থেকে বাঁ দিকে বাঁক নিল। আনোয়ার শাহ রোড ধরে খানিকটা গিয়ে, ডান হাতের লেক গার্ডেন্সের ব্রিজে উঠল। তার পর লেকের ভিতর দিয়ে শরৎ বসু রোড হয়ে এ গলি ও গলির ভিতর দিয়ে একেবারে ভবানীপুরে। আইকোর বিল্ডিংয়ের পিছনে একটা ঝাঁ-চকচকে নতুন আটতলা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তার পর সেই বাড়িটার কারুকাজ করা বিশাল লোহার ফটক দিয়ে সোজা ঢুকে গেল ভিতরে।
এই বাড়িটার নীচেই কার পার্কিং প্লেসের সামনের বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে পার্টি অফিস। সকাল-সন্ধে ভিড় লেগেই থাকে। যত না পাড়ার ছেলে থাকে, তার চেয়ে বেশি থাকে অন্যান্য এলাকার ছেলেরা। এত ভিড় হয়ে যায় যে, কার পার্কিং প্লেসে আর কুলোয় না। ফুটপাতে চেয়ার বিছিয়ে বসে পড়ে। এই সকালবেলাতেই বসে রয়েছে পার্টির তিন-চার জন ছোকরা।
বাইকবাহিনীর কাছ থেকে ফোন মারফত সেই খবর পৌঁছে গেল শময়িতার মামাতো ভাইয়ের কাছে। পৌঁছতেই সে মনে মনে বলল, পেয়েছি ব্যাটাকে। পালাবে কোথায়! আমার হাত থেকে ওর আর নিস্তার নেই। ওকে একেবারে হাতেনাতে ধরব। ভেবেই, বাইকের চার জনকে ওখানে পাহাড়ায় থাকতে বলে শময়িতার বাড়ি থেকে শময়িতাকে তার সদ্য কেনা অল্টোয় তুলে সোজা হাজির হল সেখানে।
পার্টি অফিসের সামনে যে ছোকরাগুলো বসে ছিল, তাদের প্রায় সকলেই শময়িতার মামাতো ভাইকে চেনে। তাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখেই তারা এগিয়ে গেল। উনি তখন শময়িতার মোবাইলে তোলা শ্রয়নের ছবিটা দেখিয়ে ওদের কাছে জানতে চাইল, এই লোকটাকে কি তোমরা চেনো?
ওরা ‘চিনি’ বলতেই শময়িতার মামাতো ভাই বলল, এই লোকটা কি এখানে রোজই আসে?
ওদের মধ্যে থেকে একজন বলল, রোজ নয়, তবে প্রায়ই আসে। কেন বলুন তো? কোনও লাফড়া হয়েছে নাকি?
সে কথায় উত্তর না দিয়ে মামাতো ভাই উল্টে প্রশ্ন করল, কার কাছে আসে?
ওদের মধ্যে থেকে অন্য জন বলল, কার কাছে আবার? উনি ওনার নিজের ফ্ল্যাটে আসেন।
— নিজের ফ্ল্যাট! চমকে উঠল শময়িতা। তার পরেই কী মনে হতে, নিজের মনেই বলল, বুঝেছি, তার মানে নতুন কোনও সংসার পেতেছে এখানে! ঠিক আছে, দেখাচ্ছি মজা…
মামাতো ভাই ওদের কাছে ফের জানতে চাইল, উনি কি এখানে ফ্ল্যাট কিনেছেন নাকি ভাড়া নিয়েছেন?
— না না। ভাড়া না। ভাড়া নিলে তো আমরা জানতাম। উনি কিনেছেন। তাও তো প্রায় পাঁচ-ছ’মাস হয়ে গেছে। তবে যত দূর জানি উনি রাতে থাকেন না। ওনার নাকি অন্য জায়গাতেও বাড়ি আছে।
উদ্বিঘ্ন হয়ে শময়িতা জিজ্ঞেস করল, সঙ্গে কে থাকে?
ছেলেগুলো কিছু বলতে যাবার আগেই মামাতো ভাই বলল, সে যে-ই থাকুক না কেন, অফিসে না গিয়ে ও যখন এখানে এসেছে, তখন নিশ্চয়ই সে আছে। তোমরা জানো ও কোন ফ্লোরে থাকে?
— হ্যাঁ হ্যাঁ, ফাস্ট ফ্লোরে।
— চলো তো…ওরা যখন বাড়ির ভিতরে ঢুকে লিফটের জন্য অপেক্ষা না করেই সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে উঠছে, তখন নিজের মনেই বিড়বিড় করতে লাগল শময়িতা, এই জন্যই কিছু দিন ধরে দেখছি, ও আমাকে এড়িয়ে চলছে। রাত করে বাড়ি ফিরছে। তার মানে…
দোতলায় উঠে কলিংবেল টিপছে তো টিপছেই। বারবার টেপাতেও না খোলায় মামাতো ভাইয়ের নির্দেশে ওই ছোকরাগুলো দরজা ধাক্কানো শুরু করল। শুরু করল হাঁক পেড়ে ডাকাডাকি। চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে এ ফ্ল্যাটের ও ফ্ল্যাটের লোকেরা দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। জানতে চাইলেন, কী হয়েছে?
অনেকক্ষণ পরে অবশেষে যে লোকটা লুঙ্গি পরে ঘুম-জড়ানো চোখে দরজা খুলে বেরিয়ে এল, সে আর কেউ নয়, শময়িতার স্বামী— শ্রয়ন। ঘুমের ঘোরেই সে জিজ্ঞৈস করল, কে?
শময়িতা বলল, আমি।
শময়িতার গলা শুনে যেন চারশো চল্লিশ ভোল্টের শক খেল সে। মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল তার ঘুম। কেন? কী হয়েছে? প্রশ্ন করতে যাওয়ার আগেই প্রায় ধাক্কা মেরে শ্রয়নকে সরিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল ও। এ ঘর ও ঘর সে ঘর দেখল। না। তিনটে বড়় ঘরের একটাতেও কেউ নেই। কেউ কেন, ঘরে কোনও আসবাবও নেই।
থাকার মধ্যে আছে শুধু একটা ঘরে ব়়ড় একটা আনকোরা খাট। তাতে আরও আনকোরা নরম তুলতুলে বিছানা। পলিথিনের মোড়ক অবধি খোলা হয়নি। এক পাশে গুটিয়ে রাখা তোষক। আর দু’দিকে ছড়িয়ে আছে মাথায় দেওয়ার দুটো বালিশ। একটা কোল বালিশও।
খাটের নীচ-টিচ ভাল করে দেখে, কাউকে না পেয়ে ও দিকের করিডরে গিয়ে উঁকি মেরে শময়িতা দেখার চেষ্টা করল, কলিংবেল আর চিৎকার চেঁচামেচি শুনে কেউ ও দিক থেকে পালিয়েছে কি না। না। সে সুযোগ নেই। কাউকে কেন, অন্য কারও কোনও চিহ্নই যখন ও খুঁজে পেল না, তখন শ্রয়নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ও জিজ্ঞেস করল, সে কোথায়?
শ্রয়ন অবাক হয়ে জানতে চাইল, কে?
— কে বুঝতে পারছ না? যাকে নিয়ে এখানে সংসার পেতেছ, সে।
— সংসার!
— আকাশ থেকে পড়ছ, না? এই তো এরা আছে… বলেই, ওই বাড়ির নীচ থেকে যে ছোকরাগুলো তাদের সঙ্গে গিয়েছিল, তাদের দিকে তাকিয়ে শময়িতা বলল, এই, তোমরা বলো তো এর সঙ্গে কে থাকে…
ছোকরাগুলো এ ওর মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। সেটা দেখে শময়িতা বলল, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তোমরা বলো।
ওরা একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল, কই, কেউ না তো…
— তা হলে কি উনি এখানে একা থাকেন?
— হ্যাঁ, তাই-ই তো দেখি।
— এটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? যার অত বড় বাড়ি। বাড়িতে অতগুলো ঘর। একটু খড়কুটো পর্যন্ত নাড়তে হয় না। চাওয়ামাত্র হাতের সামনে সব কিছু পেয়ে যায়। ও সব ছেড়েছুড়ে সে এখানে একা থাকার জন্য আসে?
এতক্ষণ চুপচাপ ছিল শ্রয়ন। এ বার মুখ খুলল সে— আসে। তোমার মতো বউয়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য আসে।
— আমার মতো বউ মানে? আমি কী করেছি?
— কী করেছ জানো না? কোনও দিন শান্তিতে একটু ঘুমোতে দিয়েছ?
মামাতো ভাই বলল, ঘুমের সঙ্গে এখানে থাকার সম্পর্ক কী?
— আমি এখানে ঘুমোতে আসি।
— ঘুমোতে!
শ্রয়ন বলল, হ্যাঁ, ঘুমোতে।
— কিন্তু ওরা যে বলল, এটা তোমার ফ্ল্যাট?
— না। আমার না।
মামাতো ভাই জিজ্ঞেস করল, তা হলে কার?
— আমার ছেলের।
শময়িতা যেন আকাশ থেকে পড়ল। ছেলের? মানে? বাবাই জানে?
— না।
মামাতো ভাই ফ্ল্যাটের চার দিকে তাকিয়ে বলল, এটার দাম তো মনে হয় কোটি টাকার নীচে হবে না…
— আমি কি একবারও বলেছি কোটি টাকার কম?
শময়িতা বলল, এত টাকা তুমি কোথায় পেলে?
— দেশের ওই চাষের জমিগুলো আর রাখা যাচ্ছিল না। যে কোনও সময় দখল হয়ে যেত। তাই তুমি বারবার করে বলেছিলে দেখে ওগুলো বিক্রি করে দিয়েছি।
শময়িতা বলল, অতখানি জমি বিক্রি করে দিয়েছে? সেটা দিয়ে তুমি মাত্র তিন কামরার এইটুকু একটা ফ্ল্যাট কিনেছ?
— না। সব টাকা দিয়ে কিনিনি। বাকি টাকা ছেলে আর তোমার নামে ফিক্সড করে দিয়েছি। মনে নেই, তোমাকে দিয়ে সে দিন কতগুলো কাগজে সই করালাম? তুমি তো উল্টেও দেখলে না কীসে সই করছ। অন্ধের মতো সই করে দিলে। ওগুলো ছিল ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিটের কাগজ।
এটা শুনে শময়িতার দিকে তাকাল মামাতো ভাই। শময়িতা বলল, সেটা তো আমাকে আগে বলতে পারতে। ঠিক আছে, চলো।
— কোথায়?
— বাড়িতে।
— না। আমি যাব না।
— কেন?
— ঠিক আছে, আমি যেতে পারি। তবে একটা শর্তে।
— কী শর্ত?
— ঘুমোবার সময় আমাকে আর কখনও বিরক্ত করবে না…
— আর? মাথা খারাপ? একদম বিরক্ত করব না।
মামাতো ভাই বলল, তা হলে এই ফ্ল্যাটটা?
এই বাড়ির নীচ থেকে যে ছোকরাগুলো তাদের সঙ্গে এসেছিল, তাদের একজন বলে উঠল, এটা ছেড়ে দিলে আমাদের বলবেন দাদা, যে দামে কিনেছেন, তার থেকে অন্তত দশ লাখ টাকা বেশিতে বিক্রি করিয়ে দেব।
শময়িতা মুচকি হেসে বলল, সে তো বলবই। তবে মনে হয় না, আমাদের বিক্রি করার কোনও দরকার হবে। বলেই, ফ্ল্যাটের দরজায় তালা লাগিয়ে সবার সঙ্গে শময়িতাও নীচে নেমে এল। মনে মনে বলল, সত্যি, ঘুমোনোর জন্য যে কেউ এ রকম একটা ফ্ল্যাট কিনতে পারে, বাপের জন্মে শুনিনি। সত্যি কার পাল্লায় পড়েছি আমি। রক্ষে করো ঠাকুর। রক্ষে করো।