• অণু গল্প

    অণুগল্প- বেকার কবি

    বেকার কবি
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

    এবারের ঝগড়াটা ভীষণ রকমের সিরিয়াস হয়ে উঠেছে। নীরা সম্পর্ক শেষ করে দিতে চেয়েছে। আঁতে লেগেছে রূপকেরও। এতদিনের আলাপ, এভাবে শেষ!
    কিন্তু মন মানছে কই? বারবার রূপকের চোখের সামনে ভেসে উঠছে কলেজের দিনগুলোতে নীরার বিস্মিত চোখের ভাষা। অফ পিরিয়ডে কলেজ ক্যান্টিনে রূপক উচ্চারণ করত তার দরাজ কন্ঠে স্বরচিত কবিতার লাইন। ওর রোমান্টিক কবিতা শুনে বন্ধু বা বান্ধবীরা ইয়ার্কি জুড়ে দিলেও নীরা কিন্তু মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে নিষ্পলক চাহনিতে অনুভব করতে চাইত রূপকের কবিতার প্রতিটি লাইন। নীরার এই আ্যাটেনশন কিছুদিনের মধ্যেই টের পায় রূপক। ধীরে ধীরে নীরা হয়ে ওঠে রূপকের কল্পলোকের মানসী। তিন বছরে প্রায় শ’খানেক কবিতা লিখে ফেলে নীরাকে নিয়ে। নীরাও ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে রূপকের প্রতি। থার্ড ইয়ারের শেষ দিকে একটা চিঠি লিখে নীরা জানায় তার মনের কথা। নীরার ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারে না রূপকও। ক্লাস অফ করে গ্রীষ্মের ভরদুপুরে ছাতা মাথায় দিয়ে পার্কের জ্বলে যাওয়া ঘাসের ওপর বসে দুটিতে কত না স্বপ্নের বীজ বুনেছিল। নীরা বলত, ‘রূপক তুমি অনেক অনেক বড় কবি হবে। তোমার প্রতিটা প্রেমের কবিতা প্রেমিক প্রেমিকাদের হৃদয় স্পর্শ করে যাবে অহরহ। প্লিজ তুমি কিন্তু কখনো কবিতা লেখা ছেড়ে দিও না। তোমার সৃষ্টির মাঝেই লুকিয়ে আছে তোমার আসল অস্তিত্ব।’
    গ্রাজুয়েশনে দূর্দান্ত রেজাল্ট করে নীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে। আর রূপক মাঝারি মানের রেজাল্ট করে পড়াশোনাতে ইতি টেনে রোজগারের চেষ্টায় নেমে পড়ে চাকরির ময়দানে। দুটো বছর বিভিন্ন রকমের চাকরি ধরা ছাড়া করতে গিয়ে সে ক্রমশ কবিতার থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো। নীরা কিন্তু সবসময় পাশে থেকে কবিতা লেখার উৎসাহ বাড়িয়ে এসেছে ।
    অন্য দিকে মাস্টার্স পাশ করে চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে নীরা। এক বছরের মধ্যে একটা সরকারি চাকরি জুটিয়ে ফেলে সে। আর নীরার চাকরি পাওয়ার পর থেকেই ওদের মিষ্টি সম্পর্কটা হঠাৎ তিতো হয়ে উঠতে লাগল।
    মান অভিমানের পালা যেন আজকাল অত্যাধিক লম্বা হয়ে গেছে। কথায় কথায় নীরা সম্পর্ক শেষ করার ধমকি দেয়। তবে রূপক এতদিন সিরিয়াসলি নেয় নি । কিন্তু আজ যেভাবে নীরা তাদের পুরানো বন্ধু বান্ধবদের সামনে রূপককে ‘বেকার কবি’ বলে সম্বোধন করল তাতে ভীষণ রকমের আঁতে লেগেছে রূপকের। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয তাদের সম্পর্কের ইতি টানার। কারণ যে সম্পর্কের মধ্যে অসম্মান, অপমান মিশে থাকে সেই সম্পর্কের পরিণতি কখনো ভালো হতে পারে না।
    সমাপ্ত

  • গল্প

    গল্প- জেন জি

    জেন জি

    লোপামুদ্রা ব্যানার্জি

    ও বাবা এতদিন বাদে বুঝি বুড়ি জেঠিমাকে মনে পড়ল! গত বছরের চরকের মেলায় এসেছিলি মেয়েকে নিয়ে। তারপর একটা বছর পর মনে পড়ল?

    কৃষ্ণা কোলাপুরি চপ্পলগুলো দরজার বাইরে খুলে ঘরের ভিতরে ঢুকেই ওর জেঠিমার পদ স্পর্শ করল। তারপর পায়ের ধুলোটা যত্ন ভরে মাথায় বুলিয়ে নিয়ে বলল, ও জেঠিমা তোমার কাছে আসতে তো মাঝে মধ্যেই বড্ড ইচ্ছে করে। কিন্তু সংসারের কাজের চাপে হয়ে ওঠে না।

    কৃষ্ণার জেঠিমা মালতি দেবী ইতিমধ্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন লেবুর শরবত করার জন্য। কাঁচের একটা সুদৃশ্য গ্লাসে আধ গ্লাস নরমাল জল আর আধ গ্লাস চিলড ওয়াটার দিয়ে নুন চিনিটা ভালো করে গুলে একটা মাঝারি মাপের পাতি লেবুর অর্ধেক কেটে বীজ গুলো ছুরির ডাগা দিয়ে ফেলে গ্লাসের জলে রসটা চিপতে চিপতে বলল, হ্যাঁ রে কৃষ্ণা তোদের তো মাত্র তিনটে লোকের সংসার। তাতেই দম ফেলার সময় পাস না তোরা। আর আমাদের ছিল ত্রিশটা লোকের সংসার। তার মধ্যেই সংসার সামলেও স্কুলের চাকরিটাও বজায় রাখতে হয়েছে হাসি মুখে।

    কৃষ্ণা সোফায় বসে শরবতের গ্লাসে কিছুটা তৃপ্তির চুমুক দিয়ে বলে,

    হ্যাঁ গো জেঠিমা তোমরা কি করে পারতে?

    মালতি দেবী কিচেনের দরজাটা বন্ধ করে এসে কৃষ্ণার পাশে বসল। তারপর কৃষ্ণার থুতনিতে হাত বাড়িয়ে চুমু খেয়ে বলল, দেখ কৃষ্ণা আমাদের কাল আর তোদের কালের মধ্যে বিস্তর ফারাক। আমরা ছেলে মানুষ করেছি অতি সাধারণ ভাবে। মোটা ভাত মোটা কাপড় আর বই খাতার জোগানটা দিতে পারলেই মোটামুটি কর্তব্য পালন করা হয়ে যেত। ছেলে মেয়েদেরও তেমন কোনো চাহিদা ছিল না। তারই মধ্যে কেউ একটু বায়না করলেই বাবা জেঠু দাদুর ভয় দেখালেই সবাই চুপ হয়ে যেত।

    তা যা বলেছো জেঠিমা। আর এখন তো পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। ছেলে মেয়েদের বায়না তে বাড়ির গার্জেন রা ভয়ে ভীত। এই তো আগের বছর জন্মদিনে আমার মেয়ের সে কি বায়না! তার সব বন্ধুদের কাছে দামী দামী মোবাইল আছে। তাকেও দিতে হবে। বোতাম টেপা মোবাইল নিয়ে আর টিউশন কলেজে যাওয়া যাচ্ছে না।

    মালতি দেবী চোখ গুলো কপালে সামান্য তুলে বলে, বলিস কি রে? তারপর কি করলি তুই?

    কি আর করব! অগত্যা বাইশ হাজার টাকা দিয়ে একটা স্মার্ট ফোন দিতেই হলো। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে না!

    তারপর শোনো এখন আবার কেবল কানেকশন থাকলেই হবে না। নেট ফ্লিক্স, অ্যামাজন আরো কত সব এ্যাপ বেরিয়েছে। সেইসব সাবসক্রিপশন না হলে চলবে না।

    বলিস কি রে? এতসব নিয়ে মেতে থাকলে লেখাপড়া করে কখন?

    আর লেখাপড়া। ও তো চোখে দেখতে পাওয়া যায় না।

    সে কি রে! তাহলে রেজাল্ট কেমন করছে?

    ওখানেই তো আশ্চর্য হয়ে যাই। রেজাল্ট তো যথেষ্ট ভালো করে। আসলে ওর যত লেখাপড়া শুরু হয় আমরা রাতে শুয়ে পড়লে। সারারাত পড়াশোনা। ভোর বেলায় শুতে যাওয়া।ক্যারিয়ার নিয়ে কিছু বলতে গেলেই বলে, ডোন্ট ওরি ম্মামা। কিছু একটা তো করেই নেবো।

    হ্যাঁ রে কৃষ্ণা এরা কোন প্রজন্ম? এরা তো স্বাভাবিকতা থেকে সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

    তবে শোন তোকে বলি এই গত সপ্তাহের ঘটনা। আমি পেনশন তুলে ফিরছি। বিরাটী স্টেশনে নেমে অটো ধরবো বলে রেল লাইনটা পার হচ্ছি। আমার পাশে পাশে দুটি অল্প বয়সী মেয়েও হাঁটছিল। ওদের মধ্যেই একটি মেয়ে কোল্ড-ড্রিঙ্কস খেয়ে বোতলটা রেল লাইনেই ছুঁড়ে ফেলল। আর একজন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, অ্যাই অসভ্য রেল লাইনের ওপর কেউ বোতল ছোঁড়ে? তোর কি কোনো বোধ বুদ্ধি নেই?

    তখন যে মেয়েটি বোতল টা ফেলেছিল সে তৎক্ষণাৎ উত্তর দেয় হাসতে হাসতে, না আমার বোধ বুদ্ধি নেই।কারন আমি পশ্চিমবঙ্গ বাসী।

    কৃষ্ণা ওই মেয়েটির প্রত্যুত্তর শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই কিছু ক্ষনের জন্য।প্রথমেই ভাবি নিজের রাজ্য সম্বন্ধে কি ধারণা হয়েছে আমাদের ভাবি উত্তরাধিকারীদের। তারপর ভাবি এরা হচ্ছে জেন জি। কত সহজে বাস্তব কে মেনে নিতে শিখছে এরা।

    একদম ঠিক বলেছো জেঠিমা। তাই এই প্রজন্মকে নিয়ে গেল গেল রব না তুলে বরং কবি গুরুর কথায় বলতে হয়, ‘মনেরে আজ কহ যে, ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে।’

    সমাপ্ত

  • কবিতা

    কবিতা- ওদের কান্না

    ওদের কান্না
    অজয় বিশ্বাস

    পাহাড়ের চোখে জল ঝরছিল আগে থেকেই,
    যখন ঘাতক বন্দুকের নল
    তাক করেছিল সদ্য বিবাহিত ক্রৌঞ্চের দিকে..

    পাহাড়ের কোলে বরফ
    বরফের স্নেহে আচ্ছাদিত বৃক্ষ কেঁপে উঠেছিল রোদের চাদর সরিয়ে,
    মাটির রোমকূপের মত তৃণসকল শিউরে উঠে বলেছিল-
    ‘থামাও মৃত্যু খেলা’

    আমরা শুনতে পাইনি
    কারণ আমরা তো এখন বধির…
    বিভেদের আবরণে অন্ধ

    তাই দেখতে পাই না
    সব রক্তের রঙই যে লাল…

  • মুক্ত গদ্য

    মুক্তগদ্য- ঝিনুকের বুকে মুক্ত

    ঝিনুকের বুকে মুক্ত
    -পারমিতা চ্যাটার্জী

    মাঝে মাঝে মনে হয় হারিয়ে গেছি
    বিস্মৃতির অন্ধকারে অতল গহ্বরে
    কে যেন ডাক দিয়ে যায় শুনছ কোথায় তুমি
    মন জেগে ওঠে বাস্তবের মাটিতে
    আবার শুনি অব্যক্ত কণ্ঠস্বর
    এখনও সবুজ আছে সব ধূসর হয়ে যায়নি
    মরুভূমির রুক্ষ উত্তপ্ত বালিতেও আছে গভীর কুয়ো
    সে একটু হলেও তৃষ্ণার জল দেয়
    এখনও আকাশ সোনালী রোদে ঝলমল করে
    এখনও বসন্তের কোকিল ডাকে
    তুমি কেন দেখতে পাওনা উন্মুক্ত সন্ধ্যা আকাশে লক্ষ কোটি তারাদের মালা
    যারা আলো দিয়ে যায় তোমার নীরবতার কোণে
    কেন তুমি পূর্ণিমা রাতকে ভয় পাও
    কেন শুনতে চাও না আর ভালোবাসার কথা
    সাগরের ঢেউ কি ডাকে না তোমায় আর
    সবই যদি দূরে সরে যায় একলা পথে হেঁটে যেতে পারবে তো
    একদিকে সাগর অন্যদিকে মরুভূমি এটাই তো বাস্তব
    নাই বা হাঁটলে আর মরুভূমির কাঁটা গাছের আগাছার জঙ্গলে
    ছুটে যাও সাগরের বুকে আছড়ে পড়ছে ঢেউ বালুকাময় বেলাভূমিতে
    হলই বা এখন অবেলা তবুও তো ডেকেছে সমুদ্র
    বিস্তারিত অন্ধকার থেকে বেড়িয়ে এবার কুড়িয়ে নিতে হবে সাগরপারের ঝিনুক
    হয়তো কোন ঝিনুকের বুকে মুক্ত লুকিয়ে আছে এই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত জীবনের দরজায়।

  • কবিতা

    কবিতা- হিন্দু এক সংস্কৃতি

    হিন্দু এক সংস্কৃতি
    -সুমিত মোদক

    রক্তাক্ত মৃত বাবার বুকের উপর বসে
    কান্নার শব্দ গুলি পাথর হয়ে গিয়ে ছিল শিশুটির;
    কেবল ফুপিয়ে ফুপিয়ে উঠছিল;
    সে জানে না হিন্দু কি!
    ধর্ম কি!
    সে কেবল জেনেছে বাবা আর বেঁচে নেই;
    সে দেখেছে “হিন্দু” বলার পর কি ভাবে
    বাবার শরীরটাকে রাইফেলের গুলিতে গুলিতে
    ঝাঁচড়া করে দিলো ওরা;
    ওরা কারা! তাও সে জানে না;
    ওরা শিশুটিকে জোর করে বসিয়ে দিলো
    মৃত রক্তাক্ত বাবার বুকের উপর;

    পহেলগাঁও;
    পহেলা গাঁও;
    ভারতভূমির প্রথম গ্রাম পহেলগাঁও রক্তাক্ত;
    ঠিক যেন মৃত বাবার মতো;
    আর শিশুটি ভবিষ্যতের ভারতবর্ষ!
    নাকি ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ!

    জেহাদি জঙ্গিদের গুলিতে নিহত স্বামীর পাশে
    অসহায় হয়ে বসে পড়া স্ত্রী
    বুঝতেই পারলো না হিন্দু হওয়ার অপরাধ কোথায়!
    কেবল মাত্র হিন্দু হওয়ার জন্য তার কপালের সিঁদুর
    মুছে গেলো ;
    ভেঙে গেলো হাতের শাঁখা-পলা, জীবনের সকল স্বপ্ন;
    সে তো জানতো না জেহাদ কাকে বলে!
    কাকে বলে জেহাদি, হিন্দু বিদ্বেষ!
    কেবল জেনে ছিল ভালবাসার অর্থ কি!
    তার অসহায় দুটি চোখ সে যেন কৃষ্ণগহ্বর;
    এক এক করে গিলে নেবে সকল অন্ধকার!

    যে যুবক কোনও দিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে
    পোশাক ছাড়েনি,
    তাকেও বেড়াতে গিয়ে অসহায় হয়ে নিম্নাঙ্গের
    পোশাক খুলতে হলো;
    কেবল মাত্র হিন্দু ধর্মের মানুষ বলে;
    তার পর বুলেটে বুলেটে ঝরে গেল প্রাণ;
    এ এক নগ্ন হিন্দু বিদ্বেষী জেহাদ;
    এ এক প্রতিমা উপাসক নিধন কর্মসূচি ঘোষণা!

    ভারতবর্ষের প্রথম গ্রাম রক্তাক্ত;
    ভারতবর্ষের অনেক গ্রাম, শহরও রক্তাক্ত;
    অথচ, হিন্দুরা জানে হিন্দু কোনও ধর্ম নয়,
    হিন্দু এক সংস্কৃতি … প্রাচীন এক সভ্যতার নাম;
    হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতি কি ভাবে
    বাঁচিয়ে রাখতে হয় তারা জানে;
    জানে কি ভাবে রক্ষা করতে হয় পরম্পরা;
    এও জানে কি ভাবে জাগিয়ে রাখতে হয় বিশ্বকে।

  • গল্প

    গল্প- মহানুভবতা 

    মহানুভবতা 
    -শচীদুলাল পাল

    স্টেশন শ্রীরামপুর । প্রায় ছুটতে ছুটতে ট্রেনে উঠে পড়লো ফিজিক্সের দ্বিতীয়  বর্ষের ছাত্রী  মনীষা। আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে। এই ট্রেনটি ধরতে না  পারলে তার সঠিক সময়ে ফিজিক্স স্যারের কাছে লিলুয়ায় টিউটোরিয়ালে ঠিক সময়ে  উপস্থিত হওয়া সম্ভব ছিলো না। অন্যদিন লেডিসে ওঠে।লেডিস কম্পার্টমেন্ট দূরে ছিল তাই আজ সামনেই   জেনারেল কম্পার্টমেন্টের ভীড়ে ঠাসা লোকালে উঠতে বাধ্য হলো সে।
    উনিশ বছরের ফর্সা সুন্দরী ছিপছিপে গড়ন, আকর্ষণীয় বুদ্ধিদীপ্ত চোখ।সে ট্রেনের রড ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে এক রুক্ষ শুষ্ক চুল,মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, আধ ময়লা পাঞ্জাবি পরা এক বৃদ্ধ।সে অনেকটা কাছে এসে তার হাত চেপে ধরল।মুখে যেন কি সব বলছে।মনীষা রেগে চীৎকার করে উঠলো। 
    — অসভ্য!  জানোয়ার! 
    লোকটা আরও জোরে হাত চেপে ধরলো। মনীষা বললো 
    — ছাড়ুন। হাত ছাড়ুন। 
    সাথে সাথে ট্রেনের লোকজন বুড়োটাকে মারতে মারতে বললো 
    –বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে। কামুক বুড়ো! মার শালাকে।
    বুড়োকে মেরে তারা বীরত্ব প্রকাশ করতে লাগলো। মেরে তার পাঞ্জাবি ছিঁড়ে দিল।মুখে এমন ভাবে মারলো কপাল কেটে ঝরঝর রক্ত ঝরতে লাগলো। ঠোঁট ফেটে রক্তের ধারা বইতে লাগলো। 
    আরও যাদের হাত নিসপিস করছিল তারাও এসে মারতে মারতে পরের স্টেশনে ট্রেন থামতেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল।মনীষা ট্রেনের জানালায় এক ঝলক দেখলো  রক্তাক্ত  বৃদ্ধটি গোঁগাচ্ছে।
    পুরো কম্পার্টমেন্ট বুড়োটার বিরুদ্ধে নানান কটুক্তি ও আদিম রসের রসদ পেয়ে কুৎসায় মসগুল হয়ে গেলো।
    একজন বুদ্ধিজীবী বলছিল
    –এক রকমের পুরুষ আছে এই পৃথিবীতে। কামনার আগুনে জ্বলছে। মেয়ে দেখলে তাদের স্পর্শ পেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
    এইসব বিকৃত মস্তিষ্ক পুরুষ জাতি দেশ ও সমাজের শত্রু।
    সপ্তাহে একদিন সে টিউশন পড়তে আসে লিলুয়ায়। লিলুয়ায় নেমে আজ সে একটা রিক্সা নিল। অন্যদিন পায়ে হেঁটেই যায়। সারা শরীর কাঁপছে। 
    তার মনে হলো আজ তারই জন্য  বৃদ্ধটির  এই হাল  হলো। সে নিজেকে ভীষণ অপরাধী ভাবতে লাগলো। বুড়োটা কি যেন তাকে বলছিল!
    টিউটোরিয়াল কক্ষে সে আজ সব শেষ বেঞ্চে বসলো। আনমনা।কিছুই তার ভালো লাগছে না।৯৫% মার্কস পেয়ে সে ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে পড়ছে।টিউটোরিয়াল হোমে ও কলেজের ক্লাসের সেরা স্টুডেন্ট। 
    স্যার তাকে গতকালের পড়ানো থেকে প্রশ্ন করলেন। মনীষা থতমত হয়ে  বলতে পারলো না। ভাবতে ভাবতে সে বাড়ি ফিরে আসবার জন্য তাড়াতাড়ি ট্রেন ধরলো। জানালা দিকে তাকিয়ে দেখছিল। হঠাৎ তার নজরে এলো উল্টো দিকের সেই প্লাটফর্মে সেই বৃদ্ধটি পড়ে আছে। সে তড়িঘড়ি করে নেমে বৃদ্ধটির কাছে গিয়ে দেখলো শীতে জুবিথুবি হয়ে  প্লাটফর্মেই পড়ে আছে। বৃদ্ধটির কপাল ও ঠোঁট দিয়ে রক্তটা জমাট বেঁধে আছে।  উস্কোখুস্কো চুল, শতছিন্ন পাঞ্জাবি ।কেউ ভিখারি ভেবে কিছু রুটি দিয়েছিল। সেগুলো কুকুরে টানাটানি করছে। মনীষা  ব্যাগ থেকে চাদর বের করে বৃদ্ধটির গায়ে জড়িয়ে দিল।
     রুমাল দিয়ে বৃদ্ধর  রক্ত মুছে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো আপনার নাম কি?
    বৃদ্ধটি বললো — জানি না
    বাড়ি কোথায়? 
    — জানিনা, ভুলে গেছি। 
    আপনার বাড়িতে কে কে আছে? 
    — মনে নেই। 
    এবার সে মনীষাকে বললো 
    — আমি বাড়ি যাবো। 
    এবার মনীষার মনে হলো এই কথাটাই সে হাত ধরে ক্ষীণ ও অস্পষ্ট স্বরে বারবার বলতে চাইছিল কিন্তু চলন্ত ট্রেনের শব্দে ও পাবলিকের চেঁচামেচিতে সে শুনতে বা বুঝতে পারেনি।
     এবার মনীষা বৃদ্ধটিকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো।এবার সে নিজেই শক্ত করে তার হাত ধরলো। আপ ট্রেনের প্লাটফর্মে নিয়ে গিয়ে ট্রেনে উঠালো। তার নিজের স্টেশন শ্রীরামপুর আসলে বৃদ্ধটিকে নিয়ে হাত ধরে নামিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে ঘরে এলো। 
    মা বাবাকে সব কথা বর্ণনা করে শুনালো।আদর্শবাদী পিতা তার বর্ণনা শুনে মেয়ের প্রশংসা করে বললো 
    — উপযুক্ত কাজ করেছিস মা। 
    — বাবা, আমিতো তোমার কাছ থেকে আদর্শ মানবিকতা ও শিষ্ঠতার জ্ঞান লাভ করেছি। 
    — কিন্তু ঘরে রাখলে কোনো সমস্যা হবেনা তো?
    — না বাবা। আমি দেখবো বৃদ্ধকে।
    মাকে বললো জল গরম করতে।
    নিজে হাতে দুধ সুজির হালুয়া বানালো। জল গরম হয়ে গেলে বৃদ্ধটিকে স্নান করালো। ঘসে ঘসে শরীরের নোংরা উঠিয়ে দিল।বাবাকে বললো একটা তোমার পাজামা পাঞ্জাবি পরিয়ে দাও।ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে দিল।
    লক্ষ করলো বৃদ্ধটির চোখমুখে এক আভিজাত্যের ছাপ।
     ডাইনিং টেবিলে নিয়ে গিয়ে চামচে  করে খাওয়াতে গেলো। 
    –খান। 
    বৃদ্ধটি ঘাড় নেড়ে বললো “খাবেনা। “
    এবার মনীষা আপনি থেকে তুমিতে নামিয়ে আনলো। ধমক দিয়ে বললো 
    — খাও। তোমাকে খেতেই হবে।
    এবার ধমক খেয়ে বাচ্চা ছেলের মতো এক চামচ খেলো। 
    দ্বিতীয় চামচের বেলায় আবার ধমক। এভাবে তাকে পেট পুরে সবটাই খাওয়ালো। 
    মুখ মুছিয়ে দিয়ে  সিঙ্গল বেডের ঘরটিতে  নিয়ে শুইয়ে দিল। মশারী খাটিয়ে চারিদিক গুঁজে দিল।
    কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো। এভাবে দিন তিনেক কেটে গেলো। মনীষার আদরে যত্নে বৃদ্ধটি বহাল তবিয়েতে থাকতে লাগলো।
    একদিন মনীষা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বৃদ্ধটির ঘরে গিয়ে দেখলো, অকাতরে ঘুমাচ্ছে।
    সে তাকে বিরক্ত না করে পড়তে বসলো। ফিজিক্সের  একটা অঙ্ক সে কিছুতেই পারছে না। অন্যদিন ঝটপট করে ফেলে। আজ তার মনে বিরক্তির ভাব। পিছনে একটা শব্দে হঠাৎ তাকিয়ে দেখলে গুটি গুটি পায়ে কখন এসে পিছনে দাঁড়িয়ে আছে বৃদ্ধটি। সে  খাতাটি টেনে নিল। পেন নিয়ে অবশিষ্ট অঙ্কটি কাঁপা কাঁপা হাতে করে দিল।
    মনীষা হতবম্ব হয়ে গেলো।  এটা কি অলৌকিক! এ কিভাবে সম্ভব। ইনি কে? কি তার পরিচয়?  ইনি তো সাধারণ মানুষ নন। ছুটে গেলো বাবা মার কাছে। সমস্ত ঘটনাটি খুলে বললো। তারা এসে  জিজ্ঞেস করলো। 
    –কি নাম আপনার?  কোথায় থাকেন?  বাড়িতে কে কে আছে? বৃদ্ধ লোকটি বললো 
    — ভুলে গেছি। মনে করতে পারছিনা। 
    আপনার বাড়ির ফোন নম্বর বলুন। 
    এবার সে কষ্ট করে স্মৃতি হাতড়ে মনে করে একটা নম্বর বললেন। 
    মনীষা সামনে ফিজিক্স খাতাতেই লিখে নিলে।
    অমিত মিত্র কল করলেন। রিং হচ্ছে। 
    একবার দুবার কিন্তু কেউ উঠাচ্ছে না। 
    কিছুক্ষণ পর তৃতীয় বার চেষ্টা করতেই অপরপ্রান্ত থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো 
    — আমি  প্রফেসর সম্বুদ্ধ রায়ের ছেলে ডাঃ হিমাদ্রি রায় বলছি। অমিত বাবু ভাবলো, যে ছেলে নিজের নামের আগে পিতার নাম আগে বলে সে নিশ্চয়ই কোনো আদর্শ পুত্র।
    — কাল থেকে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমার ঘরে রয়েছেন। উনি নাম বাড়ির ঠিকানা কিছুই বলতে পারছেন না। মনে হয় স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়েছে। কিন্তু বহু চেষ্টা করে এই নাম্বারটা উনি বলতে পেরেছেন। 
    — আপনি লোকটার বিবরণ বলুন। 
    অমিতবাবু সংক্ষেপে বর্ননা করলেন। 
    ডাঃ হিমাদ্রি অপরপ্রান্ত থেকে বললেন 
    — হ্যাঁ। আমার বাবা।প্রফেসার সমুব্ধ রায়।আমি তার পুত্র ডাঃ হিমাদ্রি রায়। বাবা আজ দিন কয়েক থেকে নিখোঁজ। খুঁজেছি নানাভাবে অনেক। কিন্তু পাইনি।আপনার ফোন পেয়ে অনেক আনন্দিত। আমি মাকে নিয়ে এখনই আসছি। 
    মনীষা ধীর পায়ে ঘরে গিয়ে বললো 
    —এই যে স্যার। আপনার নাম কি  প্রফেসর সম্বুদ্ধ রায়?
    ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। 
    আপনার ছেলের নাম কি ডাঃ হিমাদ্রি রায়?
    — কিছুই মনে পড়ছে না। 
    মনীষা স্নান করিয়ে ধোপদুরস্ত পাজামা পাঞ্জাবি পরিয়ে, চুল আঁচড়ে  ব্রেকফাস্ট খাইয়ে দিয়ে বললো 
    —এখুনি আপনার ছেলে আসবে আপনাকে নিতে।
    বাধ্য শিশু যেমন মায়ের দিকে নির্ভয়তায় চেয়ে থাকে তেমনি ভাবে অপলকে চেয়ে রইলো বৃদ্ধটি।
    অনেকক্ষণ পর এক দামী গাড়ি এসে থামলো বাড়ির গেটের সামনে। নেমে এলেন ডাঃ হিমাদ্রি  রায় ও তার মা।
    ঘরে এসে অমিত বাবুকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালেন। 
    অমিতবাবু বললেন 
    — এ সব সম্ভব হয়েছে আমার কন্যার জন্য। 
    এবার সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাবার হাত ধরে গাড়ীতে উঠাতে যাবেন তখন প্রফেসর সম্বুদ্ধ রায়  হাত ছাড়িয়ে পিছন ফিরে দেখলেন মনীষাকে।তার চোখ দিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়লো,বললেন 
    — আমি বাড়ি যাবো। 

    এরপর একবছর কেটে গেছে।

    প্রফেসর সম্বুদ্ধ রায়, একদিন স্ত্রী মনোরমা, পুত্র ডাঃ হিমাদ্রিকে নিয়ে এক বিশাল গাড়ি নিজে ড্রাইভ করে মনীষাদের বাড়িতে এলেন। সেদিন ছিলো ছুটির দিন।মনীষা ও তার বাবা মা  বাড়িতেই ছিলো। 
    মনোরমা বললেন 
    — আজ আমার স্বামীকে ফিরে পেয়েছি আপনাদের মহানুভবতার জন্য। 
    অমিত বাবু বললেন 
    — সব কৃতিত্ব আমার কন্যার।
    ডাঃ হিমাদ্রি বললেন 
    — বাবার সর্ট টার্ম মেমোরি লস হয়েছিলো। এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
    এবার প্রফেসর সম্বুদ্ধ রায় এগিয়ে এসে বললেন 
    — আমি একটা ভিক্ষা চাইছি।
    আপনারা রাজি থাকলে দেবেন।
    –বলুন। কি চাইছেন? 
    — আমি আপনার মেয়ে মনীষাকে আমার পুত্রবধূ করে নিয়ে যেতে চাই।আর আমার সাথী করে রাখতে চাই।কি মনীষা!  তুমি আমার সাথী হবে?
    মনীষার বাবামা বললেন 
    — এতো আমাদের সৌভাগ্য। 
    আনন্দে মনীষার দুচোখে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়লো। 
    প্রফেসর সম্বুদ্ধ স্যার ও মনোরমাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলো।সম্বুদ্ধ স্যারের হাত শক্ত করে ধরে বললো
    ” আমি বাড়ি যাবো “।

    নির্দিষ্ট দিনে মনীষা ও হিমাদ্রীর মহা ধূমধামে বিয়ে হয়ে গেল।

  • গল্প

    গল্প- সোপান

    সোপান
    – শিলাবৃষ্টি

    মাঝে মাঝেই দাদুর বলা সেই কথাগুলো মনে পড়ে যায় আমার। আজ দাদু নেই, সেই কবে পাড়ি দিয়েছে অন্যলোকে। তাকে ডাকতো দাদু রাজা বলে। ভীষণ ভালো বাসতো। বলতো অনেক কথা, কিন্তু কিছু কিছু কথা মনে এমন ভাবে গাঁথা হয়ে যায় যে….
    ” রাজা! তোর সামনে একটা কাল্পনিক আকাশ ছোয়ার সিঁড়ি রাখবি, সেই সিঁড়িটাতে খুব ধীরে ধীরে উঠবি দাদুভাই। তাড়াহুড়ো করলেই হাঁপিয়ে যাবি। আর হাঁপিয়ে গেলে উঠবি কি করে শেষ অব্দি? তোকে যে আকাশ ছুৃঁতেই হবে ভাই।”
    পরে বুঝেছিলাম এই সিঁড়িটার নামই বোধহয় উন্নতির সোপান।
    অদ্ভুত ব্যাপার হলো দাদুর বয়েস হয়েছিল পঁচাত্তর বছর ঠিক ই কিন্ত দাদুর মৃত্যুর কারণ আবার এই সিঁড়িই হলো। দাদু সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার কারণেই মারা যান। সিঁড়ি দিয়েই দাদু স্বর্গে গেছে।
    তখন আমার ক্লাস ইলেভেন। দাদুর মৃত্যুতে খুব ভেঙে পড়েছিলাম।তবু মন শক্ত করে উঠে দাঁড়ালাম। দাদুর ইচ্ছা ছিল আমি ডাক্তার হই, তাই আর কোনোদিকে না তাকিয়ে আদা নুন জল খেয়ে লেগে পড়লাম। জয়েন্টে খুব ভালো র‍্যাংক হলো। আবার শুরু সিঁড়ি ভাঙা। আমাকে উঠতেই হবে একটা একটা করে অনেক সিঁড়ি। আকাশ ছোঁয়ার সেই সিঁড়িটাকে স্বপ্নেও আমি দেখতে পেলাম একদিন। খুব যত্ন করে অনেকগুলো ধাপ মুছলাম, যেন ধুলোতে না ঢেকে যায় আমার সোপান।
    আমি ডাক্তার হয়েছি। দাদুর ইচ্ছে পূরণ করতে পেরেছি। দাদুর গ্রামের বাড়ি মুকুন্দপুরে গরীব মানুষগুলোর কাছে সপ্তাহে একদিন পৌঁছে যাই আমি। তাদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করার মধ্যে আমি স্বর্গীয় সুখ লাভ করি।
    সেই মাটিতে আমি অনুভবে দাদুকে পাই। ঝড় বৃষ্টিতে একদিন ফিরতে পারিনি। সেদিন সেই চারশ’ বছরের পুরাতন বাড়িতে রাতে যেন আমি স্পষ্ট দাদুকে দেখলাম। আমায় দাদু আশীর্বাদ করে, বলে গেল ” রাজা তোমার সামনে যে এখনো অনেকগুলো সিঁড়ি… ” সেটা স্বপ্ন ছিল না অন্যকিছু ডাক্তারি পরিভাষায় তার ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। শুধু বুঝেছিলাম সেদিন দাদুর ইঙ্গিতটা। তাই…
    শুরু করলাম লণ্ডণ যাওয়ার প্রস্তুতি।
    …..
    আজ আমি এফ আর সি এস চেষ্ট স্পেলালিস্ট। মানুষ বলে ” ডাক্তার নয়, এ যেন ভগবান।”
    আজ যা কিছু আমি তা আমার দাদুর জন্য। খুব মিস করি তোমায় দাদু। আমি বাবা হয়েছি দাদু। আর তোমার সেই সোপান এখন আমার ছেলের জন্য অনেক যত্নে রোজ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রাখি আমি। তোমার দেখানো সোপান… আমি ভালোবাসা দিয়ে সাজাবো।

  • কবিতা

    কবিতা- সাধের জীবন

    সাধের জীবন

    তমালী বন্দ্যোপাধ্যায় 

    সেইদিন  নির্দিষ্ট কিছুটা মাপা সময়…

    নির্দিষ্ট কিছু মাপা সুখ-দুঃখকে নিয়ে প্রথমবার পা দেওয়া এই অবাক করা পৃথিবীতে।

    বড় হতে হতে মনে আশা…

    সুখ-শান্তি,আয়াসে কাটিয়ে দেওয়া যাবে সারাটা জীবন। 

    জীবনে থাকবেনা কোনো দুঃখ,কষ্ট, দায়িত্বের বোঝা।

    শুধু পানসি তরীতে চেপে সুখের সমুদ্রে ভেসে বেড়ানো।

    আহা সত্যিই যদি এমন হ’তো!

    কোথা থেকে হিংসের ঝড়,দামাল দ্বন্দ্বের অতর্কিত হানা, মিথ্যা রেষারেষি, লোভের প্রতিযোগিতায়…বেসামাল সাধের জীবন।

    জীবন কবে বুঝতে শিখেছে…

    সুখের থেকে স্বস্তি ভালো।

    কিন্তু সেটুকু পাবার অবকাশও দেয়না সময়। ছুটিয়ে নিয়ে চলে দুরন্ত ঘূর্ণির  বেগে।

    যা পেতে চেয়েছিলে…হয়নি পাওয়া,যা করতে চেয়েছিলে তাও করা হয়নি। এমনকি সুখ,দুঃখগুলোও সেই মেপে আনা,কিছুমাত্র বেশী-কম নয়।

    থাক ‘না ওসব মিথ্যে হিসেব…তার চেয়ে ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধে বেঁধে থেকো একটা জীবন।

  • গল্প

    গল্প- একজোড়া চায়ের কাপ

    একজোড়া চায়ের কাপ
    সুনির্মল বসু

    ওয়েলিংটন স্টীটে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে বহু বছর ধরে চাকরি করছি। সাজানো সুন্দর অফিস। চারদিক ঝকঝকে তকতকে। মাইনে কম। কিন্তু অফিসে ঠাট বাট আছে। নামে তাল-পুকুর, ঘটি ডোবে না।

    পাঁচ বছর আগে বাটা কোম্পানি থেকে একজোড়া বুট জুতো কিনেছিলাম, বহু ব্যবহারের ফলে বর্তমানে তার শুকতলা খুলে পড়েছে। চিফ অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার এ নিয়ে কথা শুনিয়েছেন। সেদিন ছুটির পর চিনা পাড়ায় জুতো কিনতে গেলাম।

    জুতোর দোকানের একটু আগে কাঁচের শোকেসের মধ্যে একজোড়া ভারী সুন্দর চায়ের কাপ ও প্লেট দেখতে পেলাম। কাপ এবং প্লেটের গায়ে নীল কারুকার্য করা ড্রাগনের ছবি। তিনশো কুড়ি টাকা দাম চাইলো। তিনশো টাকা দিয়ে কিনে ফেললাম। জুতো কেনা হলো না, সামনের মাসে মাইনে পেলে দেখা যাবে।

    বাড়িতে কাপ দুটি দেখে আমার গিন্নী মিলি তো আনন্দে আটখানা। বাড়িতে অনেক কাপ‌ প্লেট থাকলেও, বিশেষ অতিথিদের জন্য এই কাপ দুটি ব্যবহার করা হোত।

    অফিসের বস মিস্টার বিভাস চৌধুরী অনেক দিন আমার বাড়িতে আসতে চেয়েছিলেন। এবার আমার ইচ্ছে হলো, ওনাকে একদিন বাড়িতে ডেকে চায়ের নেমন্তন্ন করে খাওয়াই। মিলিও এক কথায় রাজি।
    পরের রোববার ওরা সস্ত্রীক এলেন। আমাদের ছোট্ট সাজানো ফ্ল্যাট। এই চায়ের কাপের জন্য আমার আজকে মান মর্যাদা বেড়ে গেল। চৌধুরী সাহেব এবং ওনার স্ত্রী বারবার কাপের প্রশংসা করলেন।

    মিলি আরো সতর্ক। বিশেষ অতিথি ছাড়া ঐ কাপ কখনো বাইরে বের করত না। কেউ বাড়িতে এসে চলে গেলে, অল্প বয়সী কাজের মেয়ে তিলোত্তমা
    কাপ দুটিকে ভালো করে মেজে ঘষে, কাঁচের আলমারিতে তুলে রাখতো।

    তিলোত্তমা মাস ছয়েক ধরে আমাদের বাড়িতে কাজ করছে। মেয়েটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। শুনেছি, রমেন বলে একটি যুবকের সে প্রেমে পড়েছে। রমেন বাপের পয়সায় মোটরসাইকেল কিনে রাস্তায় রেলা দিয়ে বেড়ায়। মাঝে মাঝে হাত সাফাইয়ের কাজও করে। ওর বাবা ভবেশ বাবু বলেন, ছেলে আমার টেকনিকেলে কাজ করে। রাতে ডিউটি। যায় আর একটা ঘটি নিয়ে আসে, যায় আর একটা বাটি নিয়ে আসে। অবশ্য তাতে আমার কি। আমার অফিসের কলিগ শোভনাকে আমার খুব ভালো লাগে। ও আমাকে বিশেষ পছন্দ করে। মনে মনে ভালোবাসা তৈরি হচ্ছিল। একদিন ও বাড়ি এলো। মিলি চিনা কাপে ওকে চা করে এনে দিল।
    শোভনা কাপের প্রশংসা করতে দ্বিধা করলো না।
    আমার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। মিলি অবশ্য এই সম্পর্কের ব্যাপারে কিছুই জানতো না।

    যাবার সময় শোভনা টেবিলের পাশ গিয়ে বের হতে গিয়ে সামান্য ধাক্কায় একটি চায়ের কাপ ভেঙে গেল।

    মিলির খুব মন খারাপ হয়ে গেল। আমারও। তবু যেহেতু ওর প্রতি আমার একটু দুর্বলতা আছে, তাই আমি মেনে নিলেও, ও চলে যাবার পর মিলি বলল,
    কিরকম চলাফেরা দেখেছো, এতদিনের ভালবাসার জিনিসটা টুকরো টুকরো করে দিয়ে গেল।

    একটি চায়ের কাপ ভেঙ্গে যাবার পর, শোভনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ধীরে ধীরে ভেঙে যেতে লাগলো। অফিসের ইঞ্জিনিয়ার সুজিত মল্লিককে শোভনা ভালোবেসে ফেললো।

    অফিস থেকে ফেরার পথে বাসের জানালায় বসে আমি ভাবছিলাম, একটা কাপের ভেঙ্গে যাওয়া এবং শোভনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে কিনা। নাকি ব্যাপারটা সম্পূর্ণ কাকতালীয়।

    এখন থেকে অন্য কাপে সকাল সন্ধ্যায় আমি চা খাই। সেদিন অফিস থেকে ফিরছি, ফ্ল্যাটের সামনে কেউ একজন মুখে সিটি বাজালো। তিলোত্তমা তাড়াতাড়ি করে কাজ সেরে বেরিয়ে গেল। পরদিন সকালে চা খেতে গিয়ে দ্বিতীয় কাপটার দেখা পাওয়া গেল না। বোঝা গেল, তিলোত্তমা তার হাতসাফাই প্রেমিকের জন্য কাপটা চুরি করে নিয়ে গেছে।

    পার্কে ওরা যখন কথা বলছিল, থানার ডিউটি অফিসার রমেনকে তাড়া করে। ওর নামে নানা এলিগেশন আছে। রমেন গলিপথে পালিয়ে যায়। এমনকি তিলোত্তমাও চটি খুলে দৌড়ায়।

    বেজায় মন খারাপ হয়ে যায় আমার। কতদিনের শখের কাপ। শুনেছি, কাপটা ওখানে পড়েই ছিল।
    বীথির মা দেখেছেন।

    দুই ভদ্রলোক পার্কে এসেছিলেন। ওরা দুজনেই কাপটা ওদের বলে দাবি করেছেন। একজন বললেন, আমি গড়িয়াহাট থেকে একজোড়া কাপ কিনেছিলাম, একটা বাড়িতে রয়েছে, অন্যটা এটি। অন্যজন বললেন, গুল মারবেন না তো, দু’বছর আগে পার্ক স্ট্রিট থেকে বড়দিনের দিন আমি এই কাপ কিনেছিলাম।

    এরিয়ার টাফ রংবাজ হাত কাটা শ্যামল এসে বলল- কাপ তোদেরও না, তোদের বাপেদের না, এ কাপ হল আমার। তে’ মাথার মোড়ে বসে আমি এই কাপে চা খাবো, আর আমার ফিয়াসে বুলবুলির সঙ্গে প্রেম করবো।

    শ্যামল কাপটা নিয়ে চলে গেল। ওর অপনেন্ট পার্টি তখন গলির মোড়ে পেটো চার্জ শুরু করেছে। শ্যামল পথ চলতি রামনিধি বাবুকে কাপটা দিয়ে দিল। দ্রুত রিভলবার বের করে বিপক্ষ দলের ল্যাংড়া হাবুকে তাড়া করলো।

    পরদিন সকালে রামনিধি বাবু আমাদের বাড়িতে মিলির কাছে এলেন। বললেন, এই কাপটা শ্যামল আমাকে কালকে রাখতে দিয়েছিল। মারামারির জন্য আর ফেরত নিতে পারে নি। বৌমা, কাপটা তুমি রেখে দাও।

    কাপের প্রতি খুব বিরক্ত এখন আমি।

    বললাম, আপনি নিয়ে যান, ওই কাপ আমাদের চাই না।

    রামনিধি বাবু বললেন, আমি তো শচীনের দোকানে গিয়ে চা খাই। বৌমা আমাকে চা দেয় না। এই কাপ নিয়ে আমি কি করবো।

    কথাটা সত্যি, ভাবতে লাগলাম, তিলোত্তমা কাপটা চুরি করে ওর হাত সাফাই প্রেমিক রমেনকে দিয়েছিল। পুলিশের তাড়া খেয়ে রমেন এবং তিলোত্তমা পালালে, দুই ভদ্রলোক এই কাপের দাবিদার হয়ে যান। যদিও তারা এই কাপের মালিক নন। মানুষের লোভ কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে।

    গায়ের জোরে শ্যামল কাপটা কেড়ে নিয়েছিল। কিন্তু ও কাপটা ব্যবহার করতে পারেনি। রামনিধি বাবু কাপটা পেলেন। কিন্তু তাঁকে শচীনের দোকানে গিয়ে চা খেতে হয়, বৌমা চা দেয় না।

    আমি হেসে মিলিকে বললাম, ভাগ্যিস, অফিস ফেরত আমি সেদিন কাপ জোড়া এনেছিলাম, নইলে মানুষের এত বিচিত্র চরিত্র দেখতে পেতাম না।

    অতিরিক্ত খুশিতে আমি মৌজ করে একটা সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিলাম, মিলি বলল, এখন সিগারেট ধরিও না। এই কাপে এখনই তোমাকে চা করে দিচ্ছি।

  • কবিতা

    কবিতা- মুক ও বধির

    মুক ও বধির

    -সুমিত মোদক 

    ন-দশ বছরের ছেলেটাকে পিটিয়ে পিটিয়ে 

    মেরে দিল ওরা ;

    সেটাও আবার ঘটা করে ছড়িয়ে দিল

    সমাজ মাধ্যমে;

    ছড়িয়ে দিতে চাইলো নতুন আরেক ভয়…

    এই অন্ধকার বাতাবরণে;

    ছেলেটির নাকি অপরাধ, খিদের জ্বালায়

    খাবার চুরি করে ছিল;

    আরও নাকি বড় অপরাধ, সে অন্য ধর্মের;

    সে বুঝলো না ধর্ম কি! বিদ্বেষ কি!

    কাকে বলে স্বদেশ!

    আট-ন বছরের মেয়েটির মুখে কাপড় গুঁজে

    কাঁধে নিয়ে দৌড় দিল, ওরা …

    নদীর পাড়ে, ঝোপের আড়ালে;

    মেয়েটি চিৎকার করতে চাইলো,

    পারলো না;

    দু-এক জনের লক্ষ্য পড়ল;

    তারাও পিছু নিলো, ভাগ নিতে ;

    শরীরের ভাগ, কিশোরীর শরীরের ভাগ ;

    বিধর্মী নাবালিকা মেয়ের শরীরের স্বাদ …

    সে কি উল্লাস, সে কি উচ্ছ্বাস;

    মেয়েটি জানলো না ধর্ম কাকে বলে!

    কাকে বলে বিধর্মী!

    ওরা বাদ দিল না মৃত্যুর পরেও!

    একের পর এক মৃত দেহগুলি

    কেবল মাত্র ছবি হয়ে ঘুরছে 

    এক ভূখণ্ড থেকে আরেক ভূখণ্ডে;

    এক সমাজ থেকে আরেক সমাজে ,

    সমাজ মাধ্যমে;

    কিসের বার্তা দিতে!

    এতো কিসের উল্লাস!

    যারা এতো দিন মানবতার গল্প শোনাতো 

    তার হঠাৎ করে  দু চোখে কিছুই দেখা পেলো না;

    চারি দিকে যে ভীষণ অন্ধকার;

    যারা এতো দিন সম্প্রীতির বুলি আওড়াতো

    তারা হঠাৎ করেই  কথা বলা বন্ধ করে দিল ষ;

    চারি দিকে যে বাতাস ভীষণ ভারী 

    অসহায় মানুষের বুক ফাটা কান্নার শব্দে;

    যারা এতো দিন এপার… ওপার… করতো 

    উৎসবে মেতে উঠতো,

    তারা এখনও অপেক্ষা করছে 

    রক্তাক্ত মৃতদেহগুলির উপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে

    গলায় আত্ম অহংকারের উত্তরীয় পরে 

    বাড়ি সাজানোর স্মারক ও মানপত্র 

    মাথায় তুলে নেওয়ার;

    যারা চির নিন্দুক তারা 

    এদের বা ওদের কাজকর্মগুলিকে

    কোনও ভাবেই প্রশংসায় ভরিয়ে দিতে পারলো না ;

    এটাই দুঃখ থেকে গেল এ মুক ও বধির সমাজের।

You cannot copy content of this page