-
কবিতা- অচেনা
অচেনা
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়কতো কতো চেনা মুখ,
চেনা কতো কতো নাম,
ভুলে যাওয়া নাম হয়ে,
ভুলে যাওয়া মুখ হয়ে,
অচেনার মত স্মৃতিতে হারায়।
কেউ আর খোঁজ রাখে না তাদের…
মনে আর পড়ে না তারা।সময় ব্যস্ততা দিয়ে মুছে দেয় অতীতকে।
হয়তো বা অতীত নিজেই নিজেকে দেয় মুছে।ভেবে দেখি,কতকাল নিজেরই নিজেকে হয়নি যে খোঁজা।
ডাকনামগুলো আজ অচেনা।
এলোমেলো হাওয়া,
ঝরে যাওয়া পাতা,
শুধু জুড়ে থাকে মনে…অচেনার মত।কখনও অলস সময় ছায়াময় মায়াতে জড়ায়।
স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে আবছা আলোয় হারানো সে মুখ।
মনে পড়া কথাদের ভিড়ে ব্যথারা ছোঁয়াচে।স্মৃতির মিনারে স্বপ্ন আটক।
উথাল-পাথাল মন সুখের আশায়,
সাজায় রঙীন ছবি…ছেঁড়া মাস্তুলে।
সময় ফুরোলে, ফেরার সময় হ’লে,
একা মন হিসেব মেটায়।
লিখে রেখে যায় নতুন দিনের গান।
জল থইথই চোখে, ধুলোমাখা পথে
হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত চরণ,
বিশ্রাম চায়।
অনন্ত বিশ্রাম।। -
অণুকবিতা- কথাগুলো
কথাগুলো
-তীর্থঙ্কর সুমিতকথাগুলো…
ভালো থাকার অভ্যেস
সব বদলে বদলে এখন
নতুন হয়ে উঠেছে নদীপাড়
কত না জানা ব্যর্থতা খুঁটে খায় চড়ুইয়ের দল
অনন্ত বিকেলে আঁকা
শকুন্তলার চোখ ভেজানো এক ছবি
যে ছবি
জল ছুঁয়ে, মাঠ ছুঁয়ে
দূর দিগন্তে _আজ বৃষ্টির প্রয়োজন।
-
গল্প- অপেক্ষা
অপেক্ষা
-অঞ্জনা গোড়িয়া সাউ“আমার একটা ভালো শাড়ি দিতে হবে। সেই সঙ্গে দুজোড়া বালা। সামনেই দূর্গা পুজো। মনে থাকে যেন আমার স– ব চাই। অনেক দিন থেকে বলে যাচ্ছো,দেবে দেবে।এবছর কিন্তু চাই “এমনি করে প্রতি বছর মল্লিকার আবদার মেটাতে মেটাতে রোহন হিমসিম।রোহন যখন প্রথম বউ নিয়ে বাড়ি আসে। বাড়িসুদ্ধ সবাই বলেছিল,কি লক্ষ্মী বউ এনেছিস। ঘর আলো করে রাখবে।
দুটিতে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। বাড়ির কারোর আপত্তি ছিল না। আপত্তি করেই বা লাভ কি! এখন নাকি ভালো মেয়ে পাওয়া যায় না। যা দিন কাল। আর ঘটকদের তো তেমন দেখায় যায় না। তাই রোহন যখন নতুনবউ নিয়ে এল। সবাই কত খুশি।কিন্তু তারপর শুধু চাই আর চাই। রোহনের যতই কষ্ট হোক, সে ভালোবাসার মানুষকে বিমুখ করবে না। তাই দিন রাত পরিশ্রম করে চলেছে। তাতেও মল্লিকার কিছু এসে যায় না। বিয়ে যখন করেছে, সমস্ত দায়-দায়িত্ব স্বামীকেই নিতে হবে।
রোহনের একটা অটো রিকশা আছে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই একটা মেয়ে হলো। আরও খরচ।কোনো ক্রমে খেয়ে পরে চলে সংসার। তেমন ভাবে সঞ্চয় করতে পারে না কিছু। তাই বাড়িতে দিন রাত অশান্তি। মেয়ের খরচ, বউয়ের হাতখরচ মিটিয়ে মায়ের হাতে বেশী টাকা দিতে পারে না। মা সব বোঝে। ছেলের কষ্ট। তাই কিছুই বলে না।তবু বউকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। একদিন বলেই দিল, এভাবে থাকতে পারব না। শিল্পীর মা রোজ কত দামী দামী শাড়ি পরে আসে। নতুন নতুন গয়না পরে । আর আমি সেই একই শাড়ি গয়না। হাতে দামী ফোন। ভাল্লাগে না এভাবে থাকতে। আমার বুঝি ইচ্ছে হয় না, রোজ নতুন নতুন শাড়ি গয়না পরতে? মেয়েকে সরকারি স্কুলে পড়াবে না। এতে নাকি মান থাকবে না। তাই কেজি স্কুলে ভর্তি করেছে। মেয়েকে নিয়ে রোজ স্কুলে গিয়ে বসে থাকে। সারাবেলা আড্ডা দিয়ে ছুটির পর বাড়ি ফেরে বউ। আজকাল এটাই বাড়ির বউয়ের ডিউটি। বাড়ির কাজের জন্য তো শাশুড়ি মা আছে। রোহনের মা ভাত বেড়ে, নাতনি বৌমাকে খাইয়ে তারপর নিজে খায়।
রোহনের খুব মন খারাপ লাগে, মায়ের কষ্ট দেখে। তবু কিচ্ছু বলতে পারে না বউকে সে খুব ভালোবাসে। নিজের যতই কষ্ট হোক, ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট দেবে না। তাই আরও রোজকার করতে হবে। নইলে বউয়ের চাহিদা মিটবে না। আরও একটা পার্টটাইম কাজ খুঁজতে লাগলো।একদিন রোহনের বউ বেশ সাজুগুজু করে মেয়েকে নিয়ে স্কুলে গেল । কিন্তু আর ফিরল না।প্রতিদিনের মতো ছুটি হলে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরত মল্লিকা । স্কুল থেকে ফোন এল, “আপনাদের মেয়েকে নিয়ে যান। বাড়ি থেকে এখনো কেউ আনতে আসে নি”।
রোহন অটোরিকশা চালাতে চালাতে ফোনটা ধরে ছিল। হঠাৎ থেমে গেল গাড়ি। হাতটা কেঁপে উঠল। তবে কোথায় গেল মল্লিকা? মেয়েকে এখনো স্কুল থেকে আনে নি। নিশ্চয় কোনো বিপদে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বউকে একটা ফোন করল। ফোনের সুইচ অফ। আরও চিন্তায় প্যাসেঞ্জারদের মাঝরাস্তায় থামিয়ে গাড়ি নিয়ে সোজা চলল স্কুলে। মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আর মল্লিকার খোঁজ পেল না। মল্লিকার বাপেরবড়ি, যেখানে যত আত্মীয় বন্ধু সবার কাছে খোঁজ নিল। কোথাও নেই মল্লিকা। পাড়ায় কানাঘুষো হতে লাগলো, এ বউ নিশ্চয় পালিয়েছে। রোহন বিশ্বাস করে নি। বিপদ বুঝে রোহন থানায় ডাইরি করল। ছোট্ট মেয়েটা মায়ের জন্য কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ে। রোহনের দুশ্চিন্তায় ঘুম আসে না চোখে।
অবশেষে একটা ফোন এল।মল্লিকার ফোন।” আমি আর ফিরব না। নিজের মেয়ে নিজের কাছে রাখো। আমার সাথে আর যোগাযোগ করবে না। আমি, তোমার বন্ধু রোহিতের কাছে আছি। এর সাথেই থাকব। যে বউয়ের আবদার মেটাতে পারে না। মেয়ের পড়ার খরচ যোগাতে হিমসিম খায়। তার কাছে আর ফিরব না।বাই।”ফোনটা কেটে দিল।রোহন বিশ্বাস করতে পারছে না প্রাণের চেয়ে প্রিয়মানুষ, নিজের প্রাণের বন্ধুর সাথে চলে গেল!অস্থির হয়ে বারবার রিং করতে লাগলো। আবারও ফোনের সুইচ অফ। আর ফোন আসে না। দেখতে দেখতে কেটে গেল বেশ কয়েকমাস। মেয়ে এখন পাড়ার প্রাইমারি স্কুলে যায়। রোহন আরও পরিশ্রম করে। অনেক টাকা রোজকার করতে হবে। দুজোড়া বালা গড়তে হবে মল্লিকার জন্য। মেয়েকে জড়িয়ে আদর করে হাসতে হাসতে বলে, তোর মা ঠিক ফিরে আসবে। দুজোড়া সোনার বালা চেয়েছিল। আমি দিতে পারিনি। তাই অভিমানে চলে গেল। দূর্গাপুজোয় ঠিক ফিরে আসবে।
ওই শোনা যায় আগমনী সুর পাড়ার ক্লাব প্রাঙ্গণে।সামনেই মহালয়া। রোহন অপেক্ষায়।
-
গল্প- মহুলের মা
মহুলের মা
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
সুবলা দেবী বেশ বিরক্তি সহকারে বলল, হ্যাঁ রে অভয় তুই যে এতো বড় স্ত্রৈণ হয়ে গিয়েছিস তা আজ টের পেলাম।
মলি, মলয় বলতো বটে, মা বড়দা আর আগের মতো নেই। সবসময় বৌদির কথাতেই সায় দেয়। সেদিন বরং আমিই বকে ছিলাম ওদের দুজনকে। এখন তো দেখছি ওরাই ঠিক চিনেছে বড় বৌকে।
অভয়ের অফিস যাওয়ার তাড়া আছে। তবুও সে শান্ত স্বরে বলল- মা মহুল যেমন তোমার নাতনি ঠিক তেমনি আমার আর হৈমন্তীর মেয়ে। তাই মহুলের জীবনের ব্যাপারে হৈমন্তীর মতামত খুব দামী অন্ততঃ আমার কাছে।
সুবলা দেবীর রাগের আগুনে খানিকটা ঘি-এর মতো যোগ হলো অভয়ের কথাগুলো। দাউ দাউ করে যজ্ঞের শিখার মতো জ্বলে উঠে বললেন, তুমি তো বাবা অফিস আর ঘর করো। পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন নিয়ে আমাকে থাকতে হয়।
এর মধ্যেই তোমার বউ-এর কীর্তি পাড়াতে বেশ আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে।
হৈমন্তী কিচেনে খাবার রেডি করার জন্য দোতলা থেকে নেমে আসতেই সুবলা দেবীর মুখে এমন কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলো।
হাসি থামিয়ে বলল- মা আপনার তো তাহলে খুব নিন্দা মন্দ হচ্ছে পাড়াতে। তাহলে কিন্তু আজ থেকে আর পাড়া বেড়ানোটা বন্ধ করুন।
সুবলা দেবী মুখটা গম্ভীর করে বলল- তোমার মতো মুর্খ মেয়েমানুষ আমি তো এই প্রথম দেখলাম। নিজে সাধ করে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনো। তুমি আবার এম এ পাশ দিয়েছো!
সুবলা দেবীর এই একটা অস্ত্র আছে। যখন নিজে আর যুক্তি তর্কে পেরে ওঠে না তখন হৈমন্তীকে ধরাশায়ী করতে হৈমন্তীর শিক্ষা, বংশ এইসব নিয়ে টানাটানি করতে শুরু করে।
হৈমন্তী ও তার ক্ষুরধার বুদ্ধির প্রয়োগ করে খুব মিষ্টি ও সংযত ভাবে।
-মা ভাগ্যিস ইউনিভার্সিটির চৌকাঠ পেরিয়ে ছিলাম। তাই তো উচ্চ শিক্ষার কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হন আপনারা। না হলে আমাকে কি আর মানুষ ভাবতেন? আপনাদের উচ্চ বনেদী বংশ। আপনারা ছিলেন গাঁয়ের বড়লোক। আর সেখানে আমার বাবা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক মাত্র। আপনাদের উদার মানসিকতা। তাই তো আপনার স্বামী আমাকে আপনাদের ঘরের বউ করে এনেছিলেন। মনে আছে মা উনি আমাকে কি দিয়ে মুখ দেখেছিলেন? উনি ওনার বই আলমারির চাবিটা আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, বড় বৌমা এখন মরেও সুখ আমার। এতকাল শুধু ভাবতাম আমি মরে গেলে আমার বইগুলোর কি হবে? আমার সহধর্মিণী পুরানো খাতা-বই বিক্রির দোকানে গিয়ে হাফ দামে বিক্রি করে টাকাগুলো বগলদাবা করে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে এসে বই-এর খালি আলমারিটার মধ্যে ওনার মহামূল্য শাড়ি কাপড় রাখতে রাখতে বলবেন, কতবার বলেছিলাম একটা আলমারিতে আমার আর হচ্ছে না। আরেকটা আলমারি কিনে দাও। সে তো দিলে না। অগত্যা তোমার সাধের বই আলমারিটাই আমাকে বুদ্ধি করে কাজে লাগাতে হলো।
শ্বশুর মশাই এর এমন বুদ্ধি দীপ্ত রসিকতা শুনে সেদিন নতুন বউ এর ‘বউ বউ’ লজ্জা ভুলে বেশ হা হা আওয়াজ তুলে হেসেছিল হৈমন্তী।
হৈমন্তীর বিয়ের বছর দশেক পর মারা গিয়েছিলেন সুবলা দেবীর স্বামী। স্বামীর বিয়োগে সুবলা দেবী যত না ভেঙে পড়ে ছিলে তার থেকে অনেক বেশি ভিতর ভিতর ভেঙে গিয়েছিল হৈমন্তী।
নতুন এই ঠিকানায় তার তো একমাত্র মনের সঙ্গী ছিল তার শ্বশুর মশাই। বিকাল বেলা হলেই অভয়ের বাবা গল্পের বই বের করে হৈমন্তীকে ডাক দিতেন। বলতেন, বৌমা আমার চোখের জোড় তো আগের মতো নেই। তাই টানা অনেকক্ষণ ধরে বই পড়তে পারি না। তার চেয়ে ভালো এখন থেকে তুমি বই পড়বে আর আমি শুনবো।
এমন প্রস্তাবে হৈমন্তী যেন মনে মনে ধেই ধেই করে নেচে উঠেছিল সেদিন। তারপর দীর্ঘ দশটা বছরের ছয়টা মাস বাদ দিলে একশো চোদ্দো মাস বিকাল বেলার এই গল্পের আসর বসেছে হৈমন্তীর শ্বশুরবাড়িতে। শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে স্মরণজীৎ চক্রবর্তী, আশাপূর্না দেবী থেকে বানী বসু এমন নতুন পুরাতন লেখক লেখিকা কবি সাহিত্যিকদের সৃষ্টির ঝড় বয়ে যেতো সুবলা দেবীর তিনতলা বাড়িতে।
তবে সুবলা দেবী সাধারণত এড়িয়ে চলতো এই গল্পের আসরকে। মাঝে মাঝে স্বামীর অনুরোধে এসে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেন নি। কারণ পাড়ার মহিলাদের মুখরোচক টাটকা গল্পের আসর থেকে ডাক আসতে থাকে বারংবার।
এইসব পুরানো কথা উঠলে কিছুতেই হৈমন্তী নিজের আবেগকে সংযত রাখতে পারে না। আসলে একটা চাপা যন্ত্রণা বড্ড টনটন করে ওঠে বুকের ভিতরটা। তার বড় ইচ্ছে ছিল নিজের লেখাপড়াটাকে কোনো সামাজিক কাজে লাগানোর। তাই সে ভেবেছিল গাঁয়ের নীচু পাড়াতে গিয়ে একটা অবৈতনিক নাইট স্কুল খোলার। স্বামী শ্বশুরকে পাশে পেলেও শাশুড়ি, ননদ, দেওর কাউকেই পাশে পায় নি। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করা সম্ভব নয়। তাই সে পিছু হঠতে বাধ্য হয়ে ছিল।
তাই হয়তো এই কারণেই মহুলের পাকা কথার দিন ভরা সভাতে ছেলের বাড়ির পাকা মাথাদের সামনে হৈমন্তী বলে ওঠে- আমি মেয়ের মা হয়ে একটা কথা স্পষ্ট ভাবে বলতে চাই আপনাদের কাছে। আমার মেয়ে সরকারি অফিসের একটি দায়িত্বপূর্ণ পদে আসীন। এই চাকরিটা পাওয়ার জন্য দিন রাত এক করে মেহনত করেছে সে। পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের দৈনন্দিন কাজকর্ম জানে কেবলমাত্র চালিয়ে নেওয়ার জন্য। বিয়ের পরও এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে আশা করি না আমি। আর তখন যদি আপনারা ঘরের কাজকর্মের জন্য বাড়িতে অশান্তির পরিবেশ তৈরি করেন তাহলে কিন্তু সমস্ত চাপটা এসে পড়বে আমার মেয়ের ওপর। তাই জানতে চাইছিলাম আপনাদের ছেলে কি দৈনন্দিন জীবনের জরুরী কাজ কর্মগুলো যেমন ধরুন রান্না করা, বাসন ধোয়া, ঘর মোছা জানে তো?
হৈমন্তীর এই প্রশ্নে পাত্রের ঠাকুমা, মা, কাকীমা, দাদু, বাবা, কাকা সবাই একে অপরের মুখের দিকে চেয়ে রইলো মাত্র।
পাত্রের দাদু গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন- আমার পরিবারে মেয়েদের গৃহকাজে সাহায্য করার জন্য কাজের লোক রেখে দিয়েছি। আমাদের পরিবারের পুরুষরা বাইরের কাজেই পারদর্শী বেশি। তবে একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি অভয় বাবু, আপনার সহধর্মিণী কিন্তু ভীষণ স্ট্রেট ফরওয়ার্ড। আমাদের পরিবারের মেয়ে বউরা কিন্তু অনেক ভদ্র ও লাজুক। আজ আমরা আসি। বাড়িতে গিয়ে অর্ক দাদুভাই-এর সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবো আমরা। তারপর জানাবো।
এরপর কেটে গেছে আরো দু তিনটে মাস। ভ্যাপসা গরমের জায়গা নিয়েছে ঠান্ডা আমেজ। আশ্বিন শেষ করে কার্তিক আগত। দু’ দুটো মল মাস পেরিয়ে অগ্রহায়ণ আসবে। সুবলা দেবীর খুব ইচ্ছা ছিল মহুলের বিয়েটা এই অগ্রহায়ণে হবে। কিন্তু হৈমন্তীর অদ্ভুত সব জিজ্ঞাসাবাদের দৌলতে মহুলের বিয়েটাই ঝুলে গেল। পাত্রপক্ষ চুপচাপ দেখেই চলে গেল। সুবলা দেবী এইসব কথা ভাবে আর আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে হৈমন্তীর সেই দিনের বক্তব্যগুলো যত দিন যাচ্ছে চানাচুর তেলেভাজা সহযোগে পরিবেশন করতে থাকে।
অনেকেই অবশ্যই সুবলা দেবীকে উদ্দেশ্য করে বলে, আপনার নাতনির বিয়ের জন্য পাত্রের অভাব হবে না। এমন মোটা টাকার মাইনের চাকরি যার।
আবার অনেকই বলে তাই বলে পাত্রকে ঘর-গৃহস্থালির কাজকর্ম জানতে হবে তবেই মা বিয়ে দেবে। এমন আবদার থাকলে পাত্র পেতে তো বেগ পেতেই হবে। যতই হোক আজও আমাদের সমাজ পুরুষ তন্ত্রের অনুশাসন মেনে চলে।
দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেল। একদিন ডিনার টেবিলে অভয় বলে- হৈমন্তী তোমার ঐ অসম্ভব জেদটা এবার ছাড়ো। আমি আমাদের মুখার্জী ঘটককে আসতে বলেছি আগামী কাল।
হৈমন্তীও গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- হ্যাঁ গো আমাদের সমাজের মেয়েদের মানসিকতার পরিবর্তন হলেও পুরুষরা কিন্তু এখনও মধ্য যুগেই পড়ে আছে। নারী তুমি যতই বিদূষী হও, যত বড় পদেই আসীন হও না কেন বাড়ি ফিরে ক্লান্তি ভুলে খুন্তি তুলে নিতেই হবে পরিশ্রান্ত হাতে।
রাতে শুয়ে শুয়েও এই বিষয় নিয়ে স্বামী স্ত্রীর আলাপচারিতার মধ্যে অভয়ের মোবাইলটা বেজে উঠল। অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো, কেমন আছেন অভয় বাবু? আমি অর্কর দাদু বলছি।
অভয় তাড়াতাড়ি বালিশ ছেড়ে সোজা হয়ে বিছানায় উঠে বসে। হৈমন্তী চোখের ইশারায় ফোনটা স্পিকারে দিতে বলে।
অর্কের দাদু বলেন, আমাদের বাড়ির মেয়ে, বৌমারা অর্ককে একটা বছর ধরে ঘষে মেজে প্রাত্যহিক ঘরোয়া কাজকর্ম শিখিয়ে ফেলেছে মোটামুটি। এখন আমার দাদুভাই ডাক্তারির পাশাপাশি ভাত, ডাল রান্না করতে শিখে গেছে। সত্যি বলছি অভয় বাবু, সেদিন আপনার মিসেস এর কথা আমার প্রথমে একদমই পছন্দ হয়নি। কিন্তু বাড়ি ফিরে গিয়ে আমাদের বাড়ির মেয়ে বৌমারা বোঝালো যে পুরুষ মানুষ টুকটাক রান্না বান্না ঘরের কাজ না জানলে তাদের কি কি অসুবিধা হয়। সেদিন বুঝলাম আপনার মিসেস এর কথাগুলো ওর একার কথা নয়। আজকালকার বেশিরভাগ মেয়েদেরই কথা।
তাদের অসুবিধার লিস্ট শুনে তো আমরা পুরুষরা খুবই লজ্জিত হয়ে পড়ি। কিন্তু আমার পক্ষে তো আর এই বয়সে এসে রান্নাবান্না শেখা সম্ভব নয়। তাই অর্কর বাবা আর অর্ককে বললাম, তোদের তো এখনও শেখার বয়স আছে। তোরা ই না হয় রান্না শিখে দেখিয়ে দে পুরুষ মানুষও বাইরে ও ঘর দুটোই সামলে নিতে পারে। কথাগুলো শেষ করে হো হো করে হাসি দিয়ে মোবাইলটা ভরিয়ে তুললেন।
হাসি থামিয়ে বললেন- তাহলে আপনারা কবে আসছেন আমাদের বাড়িতে মহুল ও অর্কর বিয়ের দিনটা ঠিক করতে?
অভয় কিছুক্ষণের জন্য একদম চুপ হয়ে যায়। হৈমন্তীর ঠেলা খেয়ে স্তম্ভিত ফিরে আসে। শান্ত ভাবে বলে, মায়ের সাথে আলোচনা করে আপনাকে দিনটা জানাচ্ছি।
ফোনটা কেটে দেওয়ার পরই অভয় হৈমন্তীর হাত দুটো নিজের কোলের কাছে টেনে এনে বলে, প্রথাগত আচার আচরণের বাইরে যাওয়ার জন্য অনেক সাহস লাগে। আমার তো সে সাহস কোনোদিন হলো না। কিন্তু তুমি চার দেওয়ালের মধ্যে থেকেও সেই সাহসটুকু দেখিয়ে নিজের মেয়ের ভবিষ্যত জীবনটা কিছুটা হলেও সুনিশ্চিত ও শান্তি পূর্ণ করে তুলতে পেরেছো।
হৈমন্তী জিতে যাওয়ার আনন্দে প্রায় কেঁদেই ফেলে। চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, আমরা গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে চলি বলেই তো সমাজের চলার পথে এতো আবর্জনা জমে যাচ্ছে। নারীদের উন্নতি চাইছি কিন্তু উন্নতির জন্য যে পরিবেশ দরকার তা আমরা তৈরি করতে রাজি নই। যাক গে সমগ্র সমাজ পাল্টানোর ক্ষমতা তো আমার নেই। কিন্তু আমি আমার মেয়ের জীবনে তো পরিবর্তনের হাওয়া আনতে পেরেছি।
এখন শুয়ে পড়ো। কাল সকালে মা’কে জানিও অর্কের দাদুর কথাগুলো। অভয় এল.ই.ডি. টিউবটা বন্ধ করে নাইট ল্যাম্পটা জ্বেলে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অভয় নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেও হৈমন্তী সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারল না। মনের মধ্যে উঠে আসতে লাগল মহুলের মা হওয়ার পর থেকেই মেয়ের জন্য আজ অবধি কত লড়াই না সে করেছে। -
কবিতা- জীবন-কথা
জীবন-কথা
-সুমিত মোদককেউ কাউকে সে ভাবে মনে রাখে না;
প্রয়োজন ছাড়া কেউ কাউকে মনে রাখে না;গ্রামের পূর্ব দিক দিয়ে একটা মাটির পথ
মাঠের মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছিল
দূরের আরেক গ্রামে়;
দিনের পর দিন সে ভাবে কেউ
হাঁটাচলা না করতে করতে
এক সময় সেটি যেন কোথায় হারিয়ে গেল;
কত সহজেই ভুলে গেল সে কথা;পথ হারায়, কথারা হারায়, হারায় নিজেদের;
কেবল মাত্র পড়ে থাকে মৌনতা;
বাবা চলে যাওয়ার পর বাড়ির বারান্দাও
ছোট হয়ে গেছে খুবই তাড়াতাড়ি;
কাটা পড়েছে বাবার হাতে বসানো গাছগুলো,
সম্পর্ক সকল;আকাশ পথ ধরে উড়তে উড়তে উড়তে উড়তে
প্রচণ্ড গরমে এসে হাজির চাতক পাখি;
বার বার ডেকে যায় …
বৃষ্টির জল চায় …
ঠিক যে ভাবে আমি বা আমরা চেয়ে থাকি
আরও অনেক কিছুর পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে;কেউ কাউকে নিঃস্বার্থ ভালবাসে না;
দেয়াও না কিছু;
সবটুকুই রঙ মেখে অভিনয় …
বাহবা পাওয়া যায়, হাততালি পাওয়া যায়;
পাওয়া যায় মিথ্যা প্রশংসা;একটা কালবৈশাখী ঝড় ছুটে আসছে;
হয় তো এসব কিছু ওলোটপালট করে দেবে;
মুছে যাবে পায়ের চিহ্নগুলি;
তারপর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে …ইতিহাস একটু একটু করে তুলে নিয়ে রাখবে
আকর-জীবন-কথা, অস্পষ্ট হৃদয় যাপন। -
গল্প- চিরদিনের
চিরদিনের
-শিলাবৃষ্টিএকটা একটা করে দিন কেটে যাচ্ছে, কিন্তু মানুষটার কোনো হদিসই পাওয়া যাচ্ছেনা। দুই ছেলে, দুই বৌমা প্রথম প্রথম তৎপর হয়ে খোঁজার চেষ্টা করলেও আবার নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে! প্রতিভা দেবী আর কত বলবেন! ছেলেরাও বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে হয়তো! পেপারে দেওয়া হয়েছে,এখন সময়ের অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় কি!
চল্লিশ বছর এক ছাদের তলায় দুজনে কাটিয়েছেন, কিন্তু এই বয়সে এসে এরকম ভাবে একা ফেলে চলে গেলেন অনাদি বাবু!
আসলে কিছুদিন ধরেই একটু অন্যমনস্ক ছিলেন তিনি। প্রতিভা দেবী অনেকবার প্রশ্ন করেছেন। একটাই উত্তর দিয়েছেন মাঝে মাঝে- আমাকে আর কেউ গ্রাহ্য করেনা। তুমিও ছেলেদের দলে ভিড়ে গেছ!
আসলে পুরোনো ধ্যান ধারণা ছেলেরা বউরা মানতে চায় না। প্রতিভা দেবীও অশান্তি এড়াতে ছেলেদের কথায় সাপোর্ট করতেন বেশী। গুম হয়ে যেতেন অনাদি বাবু। হঠাৎ একদিন ভোর বেলায় সেই যে হাঁটতে গেলেন। আর বাড়ি ফিরলেন না।
কত খোঁজাখোঁজি করেও কোনো ফল হয়নি।
কত স্মৃতি আজ ভিড় করে আসে প্রতিভা দেবীর মনে। রাতে ঘুম আসেনা। তাহলে কি! না না আর কিছু ভাবতে চান না তিনি।
সকালে অফিস বেরোনোর সময় ছেলেদের কাছে
বলতে যান প্রতিভা- কিরে তোরা কিছুই আর করবি না? তোদের বাবা চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল?
-দেখো মা! আমরা কি চাকরি বাকরি ছেড়ে দিয়ে শুধু এই করবো! বড় ছেলের উত্তর।
ছোট ছেলে বলে- দেখো মা, কেউ ইচ্ছে করে হারিয়ে গেলে আমরা কি করতে পারি!
চোখের জল আঁচল দিয়ে মুছে নিয়ে রান্না ঘরে ঢুকে যান প্রতিভা।
সংসারে কত জিনিস ফুরিয়ে গেছে! একে তাকে দিয়ে কত আনাবেন? চলে যাওয়ার পরে প্রতি মুহূর্তে মানুষটার অভাব তিনি বুঝতে পারছেন!সেদিন অনেক রাত তখন… আজকাল ঘুম আসতে চায় না। একতলার বড় ঘরটাই তাঁদের।ছেলেরা উপরে থাকে।
হঠাৎ জানালায় কার যেন ছায়া!
-কে কে? কে ওখানে?
ফিসফিসিয়ে বলে- চুপ! দরজা খোলো।
এসেছে, এসেছে সে। ছুটে যান প্রতিভা দেবী।
দরজা খুলে ঘরে নিয়ে আসেন স্বামীকে।
-কোথায় ছিলে? কোথায় ছিলে এতদিন?”
-আবার চলে যাবো এখনি।
-না আর যাবে না তুমি. বড় খোকা….
অনাদি প্রতিভার মুখ চেপে ধরেন- ওদের ডেকো না। আমার অনুপস্থিতিতে ওদের কারো কিছু যায় আসে না গিন্নী! আমি জানি তুমি কষ্ট পাচ্ছো। তাই তোমাকে নিতে এসেছি! চলো। কটা শাড়ি নিয়ে নাও ব্যাগে!
-কি বলছো এ সব? না আমি যাবো না। আমি চলে গেলে এদের….
-কিসসু হবে না এদের। রান্নার অসুবিধে হবে? রান্নার লোক রাখবে। নাতি নাতনিদের জন্য আয়া রাখবে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে প্রতিভা।
-হ্যাঁ গো গিন্নী। একটু ভেবে দেখো। ওদের মানুষ করার জন্য নিজের পায়ে দাঁড় করানোর জন্য কি না করেছি আমরা। আজ প্রচুর পয়সা রোজগার করছে ওরা। কোনো অসুবিধা হবে না। তাছাড়া সবই তো রেখে যাচ্ছি। চলো না প্রতিভা আমরা যে কটা দিন বাঁচবো, একটু নিজেদের মতো করে বাঁচি।
-কিন্তু
-কোনো কিন্তু নয়। তুমি তো দেখলে এ কদিন। আমার জন্য কোনো মাথা ব্যথা আছে ওদের?
-কোথায় যাবো?
-আমার এক ছাত্রের একটা বাড়ি খালি পড়ে ছিল
এই শহরেই। সেই নীলেন্দ্র! মনে আছে তোমার? আমাকে এখনো এত শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে যে বলার নয়! সে আমেরিকায় থাকে পরিবার নিয়ে।
আমার সিদ্ধান্ত তাকে বলেছিলাম একদিন। সে বলেছে যতদিন খুশী আমি যেন তার বাড়িটায় বাস করি। তাহলে সে নিশ্চিন্ত হবে। কেয়ার টেকার থাকে সারাদিন। চলো গিন্নি, আমরা যেমন খুশী তেমন ভাবে বাঁচি।
….
ভোরের আলো ফোটার আগেই অনাদি আর প্রতিভা বেরিয়ে আসে সদর দরজা খুলে। দুজনেই
একবার পেছন ফিরে তাকায় নিজের বাড়িটার দিকে। পূব আকাশে রক্তিম আভা দেখা দেয়। অনাদি প্রতিভার হাতটা নিজের ডান হাত দিয়ে ধরে নেয়। তারপর গন্তব্যের দিকে হাঁটতে শুরু করে। -
গল্প- মানুষ মানুষের জন্য
মানুষ মানুষের জন্য
-সুনির্মল বসুসেদিন কলেজের ছুটি ছিল। তাই অন্য একটা কাজ নিয়ে সুধাময় সান্যাল সীমান্ত শহর বনগাঁয় গিয়েছিলেন। অনেক ঘোরাঘুরি করেছেন। ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল। খিদেও পেয়েছিল খুব। ব্যাগের মধ্যে কিছু শুকনো মুড়ি ছিল। খেয়ে জল খেয়ে কোথাও একটু বিশ্রাম নেবার কথা ভাবছিলেন।
তাঁকে এই অঞ্চলের পথের কুকুরগুলোও চেনে। তারা এসে ঘিরে ধরেছিল। তিনি স্টল থেকে বিস্কুট কিনে ওদের খেতে দিলেন।
তারপর স্টেশনে এসে পেতে রাখা টানা বেঞ্চিতে টানটান হয়ে শুয়ে পড়লেন।
মাথার কাছে ব্যাগ ছিল। ব্যাগে বেশ কিছু টাকা পয়সা ছিল। তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম থেকে উঠতেই, স্টেশনের উলঙ্গ বাচ্চাগুলো এসে বলল- জেঠু, তুমি ঘুমাচ্ছিলে তো, আমরা তোমার ব্যাগ পাহারা দিয়েছি।
সুধাময় বাবু ওদের খুব পরিচিত। ওই বাচ্চাদেরও তিনি বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে সাহায্য করেন।
বর্ধমান জেলার কালনা অঞ্চলে ওদের বিশাল জমিদারি ছিল একসময়। সুধাময় সব গরীব মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন।
ওর স্ত্রী মালবিকা একজন স্কুল শিক্ষিকা। বিয়ের পর এক বছরের মাথায় ওদের একটা পুত্র সন্তান জন্মেছিল। কিন্তু সে দীর্ঘায়ু হয়নি।
বাচ্চাটা মারা যাবার পর, মালবিকা স্বামীকে বলেছিলেন, এবার আমাদের একটা বাচ্চা এডাপ্ট নিতে হবে।
সুধাময় বলেছিলেন, একটা বাচ্চা ভাবছো কেন, আমি একশো বাচ্চা এডাপ্ট নিতে চাই।
মালবিকা একথা শুনে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন।
সুধাময় বলেছিলেন, আমি আমাদের জমিতে ছোটদের জন্য একটা স্কুল বানাবো।
ওনাদের বাড়ির মূল ফটকের পাশে পুরুষানুক্রমে রয়েছে একটি শিব মন্দির। প্রতিদিন সকালে সন্ধ্যে এখানে ভক্তদের সমাগম ঘটে।
স্কুল করবার কথা জানাজানি হতে, ভক্তদের মধ্যে, প্রতিবেশীদের মধ্যে বিশেষ গুঞ্জন শুরু হলো।
একজন এসে বললেন, স্কুল বসালে, মুসলমান বাড়ির বাচ্চারা এখানে পড়তে আসবে, পাশে শিব মন্দির, এটা করা মনে হয় উচিত হবে না।
একদল এসে বলল- এ হলো গণ্ডমূর্খ গ্রাম। শুধু শুধু এদের পড়াবার জন্য চেষ্টা করলে, কোন লাভ হবেনা। ওরা কি বড় হয়ে জজ ম্যাজিস্ট্রেট হবে।
সুধাময় শুনলেন। কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি বুঝতে পারলেন, এখানে ছোটদের জন্য স্কুল গড়তে গেলে, চারিদিক থেকে তার উপর চাপ আসবে।
তিনি বললেন, আমি তো ব্রাহ্মণ বাড়ির ছেলে। কিন্তু মুসলমান বাড়ির ছেলেরা এখানে পড়তে আসলে আমার কোন অসুবিধা নেই। ওরা এক সময় আমাদের প্রজা ছিল। সুখে দুঃখে বংশ পরম্পরায় আমরা এখানে রয়েছি। কেউ জাতপাতের প্রশ্ন তোলেনি। বিপদে-আপদে ওরা সব সময় আমাদের পাশে থেকেছে।
অন্য একজন রগচটা তরুণ এসে বলল, দাদা, কাজটা তুমি মোটেই ভালো করছ না। এর ফল তোমাকে ভুগতে হবে।
বিভিন্ন দিক থেকে তাঁর উপর নানারকম চাপ এসেছিল। তিনি গ্রাহ্য করেন নি।
মনে মনে বলেছিলেন, একটাই তো জীবন। খালি হাতে এসেছি, খালি হাতে চলে যাবো। কিছু নিয়ে আসিনি, সঙ্গে করে কিছু নিয়েও যাবো না।
সুধাময় ততদিনে শিক্ষা দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্কুল প্রতিষ্ঠার অনুমতি হাতে পেয়ে গিয়েছেন। কর্তা গিন্নীর উপার্জনের সিংহভাগ এই স্কুলের বাচ্চাদের জন্য ব্যয় হয়।
স্কুলের জন্য কম্পিউটার কিনেছেন, নিজে ভাঙ্গা কম্পিউটার নিয়ে বাড়িতে নিজের কাজ করেন।
মালবিকা স্কুলের নাম দিয়েছেন, সহজ পাঠ। দূর দূর গ্রাম থেকে ছোট ছোট বাচ্চারা এখানে প্রতিদিন পড়তে আসে। বই খাতা পত্র সবই পেয়ে যায়।
সুধাময় বাবু বরাবর একটু অন্যরকম।
নিজেদের জমিদারি একদিন যেমন সকলের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন, এভাবেই শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে,
আজ সহজপাঠ শিশু নিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছেন।
ওই অঞ্চলের মানুষ বলে, উনি মানুষ নন। বিলকুল দেবতা আছেন।প্রতিপক্ষেরা বলে, লোকটাকে কিছুতেই দমানো গেলো না।
একটা কাজ শেষ হয়েছে। আবার একটা কাজ শুরু করছেন তিনি। শিক্ষার আলো জ্বেলে দিতে হবে তাঁকে। বয়স বাড়ছে। সময় কমে আসছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়ান আজও তিনি।
মানুষকে ভালোবাসার কথা তিনি মুখে কখনো বলেননি, করে দেখিয়েছেন।
গতকাল রাতে সন্ধের টিভির খবরে জানা গিয়েছে আগামী ২৬শে জানুয়ারী তাঁকে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার দেয়া হবে, তাঁর রাষ্ট্রপতি ভবনে যাবার ডাক এসেছে।
সেদিন কলকাতায় সুধাময় বাবুর সঙ্গে একটি সাহিত্যের বাসরে আমার দেখা হয়েছিল। ওনার কাজের সঙ্গে আমার আগেই পরিচয় ছিল। এত বড় মনের মানুষ সংসারে সচরাচর চোখে পড়ে না।
আমি ওনার হাত ধরে কেঁদে ফেলেছিলাম। বললাম- ও দাদা, কি করে পারলে, এত মনের জোর তুমি কোথায় পাও?
উনি হেসে বললেন- রামকৃষ্ণ বলেছিলেন না, কিছু করতে হবে না, শুধু শিকড়টা ছুঁয়ে থাকবি। আমার একটা ছেলে যেদিন মারা গেল, সেদিন আমি আমার গিন্নীকে একশো ছেলের দায়িত্ব নেব বলেছিলাম। আজ সহজ পাঠ শিশু নিকেতনে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়ে। ভালো আছি ভাই। এর চেয়ে বেশি কখনো তো কিছু চাইনি। লিও টলস্টয় এর গল্প মনে পড়ে, একটা মানুষের কতটুকু জমি দরকার।
‘হাউ মাচ ল্যান্ড ডাস এ ম্যান রিকোয়ার্ড?’ফিরে এলাম।
মনে মনে বললাম, ভালোবাসার মানুষ থাকলে, ভালোবাসার বাড়ি হয়। মনে ভালোবাসা থাকলে, ছোটদের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বেলে দেবার ইচ্ছে জাগে। সহজ পাঠ শিশু নিকেতন তৈরি হয়।
দাদা তুমি পেরেছো, দাদা, তোমার মতো করে ভাবতে পারলে, দেশে শত শত হাজার হাজার দীপাবলীর রাতের মতো কত আলোর রোশনাই জ্বালিয়ে দেওয়া যেত।
সংসারের ক্ষেত্রে এমন পবিত্র আলোর মতো মনের মানুষ দেখতে পেলে, গভীর আবেগে হৃদয়ে ভালোবাসার ঢেউ ওঠে।
আমি কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি না। শুধু মুগ্ধতার আবেশ নিয়ে ভাবনার গভীর ডুবে যাই। দু’চোখ জলে ভরে যায়।
পৃথিবীতে অনেক কিছুই মনের মতো নয় হয়তো, কিন্তু কেউ কেউ আছেন, এত আলো জ্বালিয়ে দেন, তখন ওদের মানুষ মনে হয় না।
আমি কখনো ঈশ্বরকে দেখিনি। এদেরকে দেখলে মনে হয়, আমি ঈশ্বরকে দেখতে চাই না।
ছোটখাটো চেহারার মানুষগুলোকে তখন আকাশের সমান লম্বা মনে হয়। মনে হয়, এই তো! আমি ঈশ্বর দেখতে পাচ্ছি।এদের জন্য বড় শ্রদ্ধা জাগে মনে। কত কত দিন রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যায়, চোখের সামনে বারবার একই দৃশ্য ঘুরেফিরে আসে।
তখন মনে হয়, জীবন আমার ভালবাসায় ভরে গেছে। ঈশ্বর আমাকে ঈশ্বর প্রতিম মানুষ দেখিয়েছেন।
চোখে জল আসে। ঘুরেফিরে বারবার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, আপনারা এত ভালো কেন বলুন তো?
মনে মনে আমি ওনাকে বললাম, তোমাকে আনত প্রণাম, দাদা।
সেই সঙ্গে মনে হল, আমার এই দীর্ঘ জীবনে চলার পথে অন্তত দু-একজন ঈশ্বর ঈশ্বরীর দেখা পেয়েছি।
যাওয়া আসার পথের ধারে কত মনিমানিক্য পড়ে থাকে, দেখার চোখ থাকলে, জীবনের কোনো বাঁকে ঠিক একদিন ঈশ্বর এদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দেন।
-
গল্প- নিরঞ্জন
নিরঞ্জন
-শচী দুলাল পালবিজয়া দশমীর রাত্রি,বিসর্জনের পথে মা দূর্গা। আবালবৃদ্ধবনিতার শোভাযাত্রা চলেছে শহরের প্রধান রাস্তা দিয়ে গঙ্গার ঘাটে। ব্যান্ড পার্টি, আলোক সজ্জায় ধুনুচি হাতে যুবক যুবতীরা নৃত্য করছে। কেউ ভাং, কেউবা কোল্ড ড্রিংকস এর সাথে মদ মিশ্রিত পানীয় খেয়েছে। রাস্তার দুপাশে জনতার সারি। ঘরদোর ছেড়ে সবাই আজ রাস্তায়। অর্ঘ্য নামে একটি মেধাবী ছেলে সেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে শোভাযাত্রার আনন্দ উপভোগ করছিলো। হঠাৎ নাচের দল থেকে কয়েকজন বন্ধু অর্ঘ্যকে হাত ধরে টেনে নাচের দলে ঢুকিয়ে নিলো। সে নাচ জানেনা, অনিচ্ছাকৃত ভাবে তাদের সাথে পা মিলাতে লাগলো।
সেই নাচের দলে ছিল ভীরা নামে একটি ছেলে- তার সহপাঠী। ভীরা হিংসুটে ও দুষ্টু প্রকৃতির ছিল। অর্ঘের উন্নতিতে তার জ্বলন হতো। গঙ্গার ঘাটে পৌঁছে যথারীতি মা’কে বিসর্জনের জন্য প্রতিমার জলে ভাসানের উদ্যোগ চলছে । অর্ঘ্য তীরে এক কোনায় দাঁড়িয়ে দেখছে। হঠাৎ দেখলো পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ভীরা। ভীরা তাকে এক ধাক্কা দিতেই জলে পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগলো। ভীরা তাকে বাঁচাবার ছল করে কিছু একটা দিয়ে তাকে আঘাত করলো। কপাল ফেটে রক্ত ঝরতে লাগলো। সবাই চোখের সামনে দেখলো একটা ছেলে স্রোতে ভেসে যাচ্ছে । কিছুক্ষণ পর সে জ্ঞান হারালো। বিসর্জনের যাত্রীরা কেউ তাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে গেলো না। কে নিজের জীবন বিপন্ন করে ডুবন্তকে বাঁচাতে যাবে? তারা সবাই ধরে নিলো বিসর্জনের রাতে অর্ঘ্য ভেসে গিয়ে মরে গেছে।
জলের স্রোতে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ভাসতে ভাসতে সবার চোখের আড়ালে চলে গেলো দূরে, বহূদুরে। শহরের এ প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে দ্রুতগতিতে সংবাদ সম্প্রচারিত হলো। অর্ঘ্য নামে একটি যুবক প্রতিমা বিসর্জন করতে গিয়ে ভেসে গেছে। অর্ঘ্যের মা-বাবা ও পরিবারের বুক ফাটা আর্তনাদে গঙ্গার ঘাটে ঘাটে হাহাকার ছড়িয়ে পড়লো।
কোনো এক গঙ্গা তীরে বড়ো বড়ো বট অশ্বত্থ গাছের সমারোহ। বেশ ছায়া সুশীতল গাছ গাছালীতে ভরা এই স্থানটি। গঙ্গাধারে পর্ণকুটিরে জোনাই নামে একটি বছর পনেরোর কিশোরী তার মা বাবার সাথে থাকে। অন্যদিন বেশ বেলায় ঘুম থেকে ওঠে। আজ অজানা কারণে সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গেছে। পুব আকাশে সূর্য উদয় হচ্ছে। তার রক্তিম রশ্মিতে জল লালে লাল। গঙ্গা তীরে গিয়ে নির্মল বাতাসে জলের দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ দেখলো প্রতিমার কাঠের কাঠামোর টুকরোর উপর কি একটা ভেসে আসছে। রক্তাক্ত দেহ। ভাসতে ভাসতে দেহটি এক্কেবারে তার সামনে এসে থামলো। দূর থেকে মৃতদেহ মনে হলেও সামনে এলে সে অনুভব করলো দেহ থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, ছটফট করছে। জোনাই দেখলো বিসর্জিত দূর্গাকাঠামোর টুকরোর উপর ভাসমান যুবকটির প্রাণ আছে। সে যুবকটিকে জল থেকে তুলে নিজের যথাশক্তি দিয়ে ডাঙ্গায় তুললো। পেটে চাপ দিয়ে জল বার করলো।ধীরে ধীরে ছেলেটি প্রাণ ফিরে পেলো। অবসন্ন শরীর। কথা বলার ক্ষমতা নেই। জলে সাঁতার, মাছ ধরা, নিজের এক টুকরো বাগানে কাজ করা শক্তিশালী জোনাই নিজের শরীরে ভর নিয়ে যুবকটিকে ধীরে ধীরে নিজের কুটিরে নিয়ে এলো। গরম দুধ খেতে দিলো। সেবা পথ্য দিয়ে শরীরে প্রাণসঞ্চার করলো। যুবকটি চোখ মেলে চেয়ে দেখলো সেবারতা এক কিশোরীর হাত তার কপালে। ধড়ফড় করে উঠে বসতে গিয়ে অবসন্ন দূর্বল শরীরে অক্ষম হয়ে পড়ে গেলো। জোনাই যুবকটিকে বলল- তুমি দূর্বল। মাথায় চোট লেগে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। তোমাকে এখুনি হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন। তোমার নাম কি? বাড়ি কোথায়? তোমাকে এক দেবীপ্রতিমার কাঠের কাঠামোর টুকরোর উপর গঙ্গা জল থেকে উদ্ধার করেছি।
ছেলেটি তার স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়েছে। কিছুই মনে করতে পারছে না। বলল- আমি কিছু মনে করতে পারছি না?
হাসপাতালে দিন কয়েক থেকে যুবকটি সুস্থ হলে জোনাই তাকে ঘরে নিয়ে এলো। জোনাই-এর বাপ দিনমজুর। সবদিন কাজ থাকে না। চুল্লু খেয়ে ঘুমায়। মা অন্যের বাড়িতে বাসন মাজে। ঝিয়ের কাজ করে।
গরীবের সংসার। বাপটা একদিন চুল্লু খেয়ে মেয়ের উপর চড়াও হলো- আর কতদিন গলগ্রহটাকে পুষবি? ওর মাথার ঠিক নেই। নিজের নাম ঠিকানা বলতে পারছে না।-না পারুক। একদিন না একদিন সে নিজেকে চিনতে পারবে।
-তাতে তোর কি লাভ?
-লাভ ক্ষতি আমি কিছু বুঝিনা। একজন মুমূর্ষুকে প্রাণ ফিরে পেতে সাহায্য করেছি তাই নিজেকে ধন্য বলে মনে করছি। আমি ওকে আমাদের ঘরেই রাখবো। ওকে এখনি ছেড়ে দিলে ক্ষিদে তৃষ্ণায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে।
-আমরাই বা কোথা থেকে যোগাবো তার ভরণপোষণ?-আমার খাবারের আর্ধেক আমি ছেলেটিকে খাওয়াবো।
-তার মানে তুই ছেলেটিকে এখানেই রাখবি? সেটা আমি কিছুতেই হতে দেব না। লোকে কি বলবে?
-যে যাই বলুক আমার কিছু যায় আসে না। যতদিন না তার পূর্বস্মৃতি মনে করতে পারছে ততদিন আমি তাকে দেখবো। সংসার চালাতে তোমাদের যদি কষ্ট হয় আমি কাজ করব। উপার্জন করব।
মা রান্না করতে করতে এসে বললো- তোদের বাপ বেটির সব কথা শুনেছি। ঠিক আছে কাল থেকে তুই কাজে লাগ। সামনের উর্বর জমিটায় সবজি লাগা। গতর খেটে উপার্জন কর।
সবজি বেচে দু’ টাকা আয়ও হবে। আমিও না হয় দু’বাড়ি বেশি ঠিকে ঝির কাজ করব।
এভাবেই থাকতে লাগলো ছেলেটি। তারা নাম দিল দূর্গাপদ।
কয়েক বছর এভাবে কাটলো। জোনাই এখন অষ্টাদশী। দূর্গাপদ শহরে এক প্রোমোটারের অধীনে নির্মিয়মান ফ্ল্যাটে কর্মীর কাজ করে। জোনাইএর মা’কে সে মা বলে। বেতনের সব টাকা মায়ের হাতে দিয়ে দেয়। একদিন তাদের অবস্থা সচ্ছল হলো। কাজকর্মে নিষ্টা, সততা, সরলতা দেখে প্রমোটার তাকে সুপারভাইজার পদে প্রমোশন দিলেন। দূর্গাপদ এখন উচ্চ আয়ের প্রমোটারের শ্রেষ্ঠ সেবক হলো। বেতনের টাকায় পাকা বাড়ি তৈরি করে দিল।
জোনাই, দূর্গাপদ একে অপরকে ভালোলাগা থেকে ভালোবাসায় পরিণত হলো। তারা দিনান্তে প্রায়ই গঙ্গাতীরে শানবাঁধানো ঘাটে বসে গঙ্গার অপূর্ব শোভার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা দুজনে নিজেদের ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে।কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না।
একদিন খবরের কাগজের চপ ভাজা সহযোগে ঠোঙায় ঝালমুড়ি খাচ্ছে। বহুবছর আগে এক ছবি সহ বিজ্ঞাপন দেখে জোনাই চমকে উঠলো। “অর্ঘ্য নামে এক যুবক দূর্গা বিসর্জনের রাতে হুগলির ঘাট থেকে জলে ভেসে গেছে। তার মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া যায়নি। কোনো সহৃদয় ব্যাক্তি সন্ধান পেলে নীচের ফোন নম্বরে যোগাযোগ করলে বাধিত হবো।”
ঝালমুড়ি খাওয়া হয়ে গেলে জোনাই ঠোঙাটি সযত্নে লুকিয়ে রেখে দিল।
সে ভাবতে লাগলো এ তো সাধারণ ছেলে নয়। যদি সে এখনই তার পরিবারের হাতে তুলে দেয় দূর্গাপদকে তাহলে সে হাতছাড়া হয়ে যাবে। আশংকায় তার দিন কাটতে লাগলো।
সারারাত তার ঘুম আসে না। একদিন মধ্যরাতে জোনাই দূর্গাপদর রুমে গিয়ে
ইতস্তত করতে করতে দূর্গাপদর কপালে এক গভীর চুম্বন করলো। দূর্গাপদ প্রথম নারী স্পর্শ পেয়ে ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠে চোখ মেলে দেখলো জোনাই তার সামনে দাঁড়িয়ে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
-এ কি!জোনাই তুমি কাঁদছো কেন?
কি হয়েছে?
জোনাই দূর্গাপদকে জড়িয়ে ধরে বললো- আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।
-সে তো আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি। কথাটা এতদিন মুখফুটে বলতে পারিনি।-কথা দাও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না!
-তিন সত্যি করে বলছি আমি তোমায় ভালোবাসি। তোমাকে আমি বিয়ে করবো। আমার হৃদয়ের মনিকোঠায় তোমায় স্থান দিয়েছি। সে স্থান চিরস্থায়ী থাকবে।
একে অপরকে জড়িয়ে ধরে রাত্রি অবসান হলো দূরে কোথাও ভোরের পূজার ঘন্টা ও শঙ্খ ধ্বনি হলো।
আজ বিজয়া দশমী। গঙ্গার ঘাটে ঘাটে বিসর্জনের বাদ্যি বাজছে। গঙ্গাতীরে উপচে পড়া ভীড়।
দূর্গাপদ – জোনাই সুন্দর পোশাকে বিসর্জন দেখতে গেছে। তারা দুজনে হাত ধরাধরি করে একপাশে দাঁড়িয়ে দূর্গা মায়ের বিসর্জন দেখছে। হঠাৎ পা পিছলে দুজনেই মায়ের কাঠামোর উপর পড়ে গেলো। শক্ত কাঠামোয় দূর্গাপদর কপাল ফেটে রক্ত ঝরতে লাগলো। কে বা কারা যেন তাদের ডাঙায় নিয়ে এলো। জোনাই বললো- তোমার নাম “অর্ঘ্য”।
সাথে সাথে দুর্গাপদর পূর্বস্মৃতি মনে পড়তে লাগলো।
হ্যাঁ। আমি অর্ঘ্য। আমিই দূর্গাপদ। তুমি আমার বাকদত্তা স্ত্রী।
এসো বিসর্জনের এই পুণ্য লগ্নে তোমাকে বরণ করি। অর্ঘ্য তার রক্তাক্ত কপালের রক্ত দিয়ে সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিলো।
ঢাক ঢোল কাঁসরঘণ্টা শঙ্খ ধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত হলো।
জোনাই মোবাইলে সেভ করা ফোন নম্বরটিতে ফোন কল করে বললো- এই নাও তোমার নিজের মা বাবার সাথে কথা বলো।
অপর প্রান্ত থেকে নারী কন্ঠ ভেসে আসলো।-মা! আমি তোমার ছেলে অর্ঘ্য বলছি। আমি বেঁচে আছি মা। আজ রাতেই আমি আমার সদ্য পরিণীতা নববধূকে সাথে নিয়ে বাড়ি আসছি। তোমরা বরণডালা সাজিয়ে রেখো।
-
কবিতা- মেয়েটা
মেয়েটা
-অঞ্জনা গোড়িয়া (সাউ)
মেয়েটা ভালো হতে চেয়েছিল।
মেয়েটা স্বপ্ন দেখেছিল,
মেয়েটা ভাবতে শিখেছিল।
মেয়েটা কিছু করতে চেয়েছিল।
মেয়েটা বাঁচতে চেয়েছিল,
মানুষের সেবা করতে চেয়েছিল।
মেয়েটা শতশত পুরুষের মাঝে
মাথা উঁচু করে লড়তে চেয়েছিল।
তবু মেয়েটা কেন হেরে গেল?
কতগুলো নোংরা হাত তাকে ভালো হতে দিল না।
মেয়েটার স্বপ্নগুলোকে ভেঙে মুচড়ে দিল।
মেয়েটার দিকে এগিয়ে আসছে অসংখ্য বিষধর সাপ।
না না হেরে গেলে হবে না।
রুখে দাঁড়াতে হবে।
একা মেয়েটা, বড্ড একা।
তবু সে লড়তে চেয়েছিল।
তবু সে কষ্ট ভুলে জিততে চেয়েছিল।
তবু-মেয়েটা কেন হেরে গেল?
এ হার মেয়েটার একার নয়।
এ লজ্জা মেয়েটার একার নয়।
মেয়েটা আর পাবে না ভয়।
সে জিতবে, করবেই জয়।
মেয়েটা আর কাঁদবে না
মেয়েটা লড়বে নিজের জন্য।
লড়তেই হবে আর সবার জন্য।
হোক সে বড়ো ক্লান্ত।
হোক সে একা-
তবু মেয়েটা লড়বে।
এগিয়ে যাবে সূর্যালোকের দিকে।
আগামী ভবিষ্যতের অপেক্ষায়। -
অণু কবিতা-হেঁটে যাচ্ছি
হেঁটে যাচ্ছি
-তীর্থঙ্কর সুমিতকত সকাল এভাবে নষ্ট হতে হতে
মুছে গেছে আলোর বিকেলে
অনন্ত যাত্রার পদাবলী
লেখা আছে তোমার ইচ্ছে কথায়
তুমি ডানা মেললে
অভূত প্রাণশক্তি ফিরে পায়
আমার ভালোবাসার কথন
মনে না রাখা তোর্সার বুকে
সবুজ খামে ভেসে গিয়েছিলো
কত অজানার আত্মহননএখন শুধুই মেঘ বৃষ্টি আর কালিন্দীর জল…
আমি হেঁটে যাচ্ছি ক্রমশঃ