স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

  • কবিতা,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    কবিতা- নারী

    ।। অমরনাথ স্মৃতির সাহিত্য পুরস্কার।। 

     

    নারী
    – শ্যামল কুমার রায়

     

     

    নতুন কিরণ , শুভম লগন ,
    যেতে হবে নিশ্চিত জানে ;
    স্খলিত চরণ অশ্রু নয়ন
    বার বার চায় পিছন পানে ।

    নারীর জীবন ভেলার মতন ,
    এ ঘাট ও ঘাট ছুঁয়ে ভাসে ;
    কার অভিশাপে আজো নারী
    হলো না স্থিতু নিজ গৃহ বাসে ।

    জন্মদাত্রী মাতা আমাদের ,
    সৃষ্টি ধারিকা , গর্ভ উদরে ,
    পুরুষ কেন জাগে না এখনো
    নারীরে রাখে না সমাদরে ?

    সতীত্ব নারীর পরম ধন ,
    পতি প্রেমে নিষ্ঠা সযতনে ;
    জাগায় ভক্তি , পরম শক্তি ,
    নারী জীবনের পূণ্য সন্ধানে ।

  • কবিতা,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    কবিতা- অ-সমকামী

    ।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

     

    অ-সমকামী
    -কাজল দাস

     

     

    এইতো সবে দুঃখ জমেছে গাঢ়
    মেঘের মতো উড়নচণ্ডী বিষাদ
    এখনি যদি রাতের হিসেব কর
    নিখোঁজ হবে মধ্য রাতের চাঁদ।

    এইতো- সবে প্রেম হয়েছে গাঢ়
    বুকের ভেতর নিয়ম ভাঙা ঝড়
    ভেজা ঠোঁটে রাত কুড়াতে পার
    জল ছুঁয়ে যাক জলেরই ভিতর।

    এইতো- সবে রঙ ধরেছে গাঢ়
    সবুজ ডালে ফুল ফুটেছে লাল
    এখনই যদি আগুনে ভয় করো
    পোড়ার মানে খুঁজবে চিরকাল।

    এইতো- সবে মেঘ করেছে গাঢ়
    বৃষ্টিতে মন- প্রেমিক হয়ে যায়
    সময় দেখার সময় নেই কারও
    দুঃখ গুলো,- বৃষ্টি কিনতে চায়।

  • গল্প,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    গল্প- ঠাকুরানীর দোর

    ।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

     

    ঠাকুরানীর দোর
    -সুতপা মন্ডল

     

     

    কলেজের বন্ধু অমলের দৌলতে জীবনে প্রথম গ্রাম দেখা সুপ্রতিমের। স্টেশন থেকে নেমে বাস, আবার বাস থেকে নেমে রিকশায় প্রায় চল্লিশ মিনিট, কলকাতায় বড় হওয়া সুপ্রতিমের কাছে যোগাযোগের এমন অবস্থা সত্যি আশ্চর্যের।

    গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই চাষাবাদ করেন, যারা চাকরি করেন তারা কখনো সখনো গ্রামে আসলেও পূজা-পার্বণে, বেশিরভাগ বাইরেই থেকে গেছেন।

    মন ভালো করা আতিথিয়তা আর মানুষের সারল্যে একবারে মুগ্ধ সুপ্রতিম।

    ওর কাছে গ্রাম মানে ছিল শুধুমাত্র সিনেমায় দেখা, কিন্তু সত্যি যে গ্রামের রূপ এত সুন্দর হয় এখানে না এলে বুঝতে পারত না। সে যেন শুধু অমলের বাড়ির অথিতি নয় পুরো গ্রামের অতিথি।

    তাই গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ি থেকে তার জন্য আসে নিমন্ত্রণ, ” আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসো গো বন্ধু”, খুব ভালো লাগে সুপ্রতিম এর। এই কথা তো সে কলকাতাতে ভাবতেই পারেনা। গ্রামের সবার বাড়ি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে একটা বাড়ি ওর মনে কৌতূহল জাগায়। বাড়িটাতে কেউ আছে বলে মনে হয় না তবুও মড়াই বাঁধা আছে, রান্না চালা আছে, যদিও প্রতিদিন রান্না হচ্ছে না, বড় বড় গামলা ধুয়ে মুছে রাখা যেন ওতে খাবার ছিল এখনই কেউ ধুয়ে রেখে গেছে ।

    বাড়িটির বিশেষত্ব আলাদা, উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়িটির প্রবেশদ্বারে কোন দরজা নেই। একটা জায়গা রং করে তার উপরে অন্য রং দিয়ে লেখা আছে “ঠাকুরানীর দোর।” বাড়িটি যে খুব যত্নে আছে সেটা দেখলেই বোঝা যায়।

    সন্ধ্যেবেলা গল্প করতে করতে তমালকে বাড়িটির কথা জিজ্ঞাসা করতেই উঠে এল এক অভূতপূর্ব কাহিনী।

    ওই গ্রামেরই মেয়ে বাল্যবিধবা এক নারী শৈলজার কথা। আর তাও আজকের নয় প্রায় একশ বছর আগের একটি মেয়ে, স্বাধীনতার আগের একটি কাহিনী।

    মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল শৈলজার। মেয়ে বারো বছরের হলেই শ্বশুরবাড়ি পাঠানো হবে এরকমই ঠিক করেছিলেন বাবা-মা। কিন্তু শৈলজার আর শ্বশুর বাড়ি যাওয়া হলো না, মাত্র নয় বছর বয়সেই বাপের বাড়িতে বসেই হয়ে গেলেন বিধবা। স্বামীর কথা তার কিছুই মনে নেই। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ দের তত্ত্বাবধানে শৈলজার শুরু হলো নিয়ম-কানুন শিক্ষা।

    একটু বড় হতে না হতেই শৈলজা সাংসারিক বুদ্ধিতে নিপুন হয়ে উঠল, তাকে কেউ হারাতে পারত না।

    এই গ্রামেরই মেয়ে হওয়ায় সব বৌদিদের সে ঠাকুরঝি আদরের ঠাকুরানী। দিনে দিনে শৈলজা নামটাই সবাই ভুলে গেল। তার নতুন নামকরণ ঠাকুরানী।

    নিজের কোন সংসার ছিল না ঠিকই কিন্তু এই গ্রামের প্রতিটি সংসার ছিলো তার নিজের সংসার। মানুষের আপদে-বিপদে সবার আগে ছুটে আসতেন ঠাকুরানী। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে শলা-পরামর্শর জন্য সবার আগে ঠাকুরানীর কাছে আসতো সবাই। আবার তার শাসনও ছিল প্রচুর। আচার-বিচার নিয়ম-কানুন থেকে রক্ষা ছিলনা কারোর। সে যেমন মানুষকে ভালবাসতো তেমনি শাসন ও করত কড়া হাতে।

    বাবা মা চলে যাবার পর আরো একা হয়ে যায় শৈলজা। তখন আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরতে থাকে গ্রামের মানুষ গুলিকে।

    পুরো গ্রামের মানুষ যেমন ভালবাসতো তেমনই মান্য করত। গ্রামের প্রতিটি জিনিস ছিল ঠাকুরানীর নখদর্পণে। ঠাকুরানীর চোখ এড়িয়ে কোন কিছু সম্ভব ছিল না। এই গ্রামের মেয়ে হওয়ার সুবাদে পুরুষদের সাথে কথা বলতেও তার কোন ভয় ছিল না কখনো কখনো তারাও সাংসারিক বুদ্ধি ধার নিতো ঠাকুরানীর কাছে। ঠাকুরানী ছিল ন্যায়ের পক্ষে তার কথা মান্য করবে এই গ্রামের কারো সাহস ছিলনা। এক কথায় তিনি ছিলেন এই গ্রামের “রাজ্যহীন রাজকন্যা” ভালোবাসার শাসক।

    একবার বন্যায় আশেপাশের সব গ্রাম ডুবে যায় ক্ষতি হয় এই গ্রামের বেশ কিছু মানুষের। মানুষের আর্তনাদে মন কেঁদে ওঠে ঠাকুরানীর। তার ঘরের উঠোনে কাটা হয় বড় বড় উনুন । নিজের ঘরের ধানের গোলা খুলে দেন সর্বহারা মানুষগুলোর জন্য। মানুষগুলো ঠাকুরানীকে আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরে। বন্যার জল আস্তে আস্তে সরে যায়। স্বাভাবিক হতে থাকে জীবন কিন্তু ঠাকুরানীর মনের মধ্যে রয়ে যায় একটা বিরাট দাগ, এই বিপদ আবার আসতে পারে, তখন কি হবে সেই ভাবনায়।

    তার পরেই তিনি এই অভাবনীয় পরিকল্পনা নেন। এই গ্রামের প্রতিটি সচ্ছল পরিবার থেকে প্রতিদিন একজনের মত খাবার দিয়ে আসতে হবে ঠাকুরানীর ঘরে ওনার নিজের জন্য নয়, তাদের জন্য যাদের খাবার জোটেনি সেদিন।

    বিকেল হলেই ঠাকুরানী বেড়িয়ে পড়তেন লাঠি নিয়ে, সবার ঘরের দরজায় একটা হাঁক ” কিগো বউ কত দেরি সাঁঝ হয়ে এলো যে” ।

    ঠাকুরানীর ঘরে খাবার খেতে আসতো আশেপাশের বহু গরিব গরিব মানুষ, যতদিন ঠাকুরানী বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থাকতেন ওদের খাবার সময়।

    ঠাকুরানীর কথা ছিল “কেউ যেন না খেয়ে ঘুমায় না, তাতে যে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়” । এই গৃহস্থ বলতে তিনি তার গ্রাম বলতেন।

    ঠাকুরানীর জমি থেকে যা আয় হত তা খরচা হত গ্রামের কল্যাণের কাজে।

    গরিবের বাড়ির মেয়ের বিয়েতে আরো নানারকম সমাজকল্যাণমূলক কাজেতে।

    ঠাকুরানী তৈরি করিয়েছিলেন এই গ্রামের পাঠাগার। বিদ্যালয়ের বাড়িটিও তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।

    তিনি যতদিন ছিলেন তার সবকিছু দেখভাল তিনি নিজেই করতেন কিন্তু তিনি চলে যাবার পর গ্রামের মানুষরা নিজেরাই এর পরিচালনা করতে থাকেন।

    মানুষের মনে আজও বিশ্বাস ঠাকুরানী এখনো এই গ্রামে লাঠি ঠুকে ঠুকে ঘুরে বেড়ান, তার লাঠির আওয়াজ নাকি এখনো সন্ধ্যেবেলা পাওয়া যায়, সন্ধের আগেই সব বাড়ি থেকে খাবারের থালা আজও চলে আসে ঠাকুরানীর দোরে। কোন অভুক্ত যেন না খেয়ে ঠাকুরানীর ঘর থেকে যায়।

    রাতের আঁধারে এখনো অনেক মানুষ খেয়ে যান ঠাকুরানীর দোরে।

    গ্রামের ছেলেরা পাত পেরে খাওয়ায় তাদের।

    সুপ্রতিম স্তম্ভিত। মনে মনে প্রণাম করেন সেই মৃত্যুঞ্জয়ীকে।

    কি জানি তিনি হয়তো গ্রামের আনাচে-কানাচে সত্যিই ঘুরে বেড়ান।

    ……সমাপ্ত………

  • গল্প,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    গল্প- করুণা

    ।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

     

    করুণা
    -সঞ্জিত মণ্ডল

     

     

    এ কোনো মনগড়া অলীক কাহিনী নয়,বরং এ হল করুণার জীবন সংগ্রামের এক টুকরো করুণ চালচিত্র।
    করুণাকে চিনতাম সেই প্রথম যৌবনের প্রারম্ভে, যখন বাবা-মা,দাদা-দিদি,ভাই-বোন,ঠাকুমা-পিসীমাদের থেকেও আরো অন্য কাউকে ভাল লাগার অনুভূতিটা আস্তে আস্তে শরীরে একটা শিহরণ তুলছে।একটা নতুন ধরণের লজ্জা মিশ্রিত আবেগ মনটাকে ক্ষণে ক্ষণে দুলিয়ে দিচ্ছে। অনাস্বাদিত ঞ্জান বৃক্ষের ফলের স্বাদ ভক্ষণের ইচ্ছা করছে। একটা নতুন ধরণের শালীনতা বোধের সংগে উচিত অনুচিত এর চাবুকটাও আড়াল থেকে চোখ রাঙাচ্ছে। সেই সেদিনের স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে কলেজে ঢোকার প্রথম পর্বের প্রথম গোঁফ গজানোর লজ্জা মিশ্রিত বড় হয়ে যাওয়ার দেমাকের দিনে হঠাৎই একদিন করুণাকে সামনা সামনি দেখে চমকে উঠেছিলাম।
    চমকে উঠেছিলাম কেননা আমাদের এই অজ পাড়াগাঁয়ে এমন ডাগর চোখের ফুটফুটে সুন্দরীও আছে! কই আগে তো দেখিনি! নাকি আমারই দেখার কোনো অবসর ছিল না, নিজের ভবিষ্যৎ তৈরী করার তাড়নায়।
    করুণা সেদিন দীঘির পাড়ের সেই ছোট বটতলায় ঢলে পড়া সূর্যের পড়ন্ত বেলায়, নিরালা নির্জনে প্রমত্ত খেলায় অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল আমার সদ্য গজানো গোঁফ ছুঁয়ে দেখার বাসনায়। আমি সেই নিরালা নির্জনে ওর সেই নরম হাতের পেলব ছোঁয়ায় কেমন বিবশ হয়ে গেছিলাম।প্রথম যৌবনের সেই অবুঝ বেলায় ভালো লাগার এক অনাস্বাদিত মূহুর্তে হঠাৎ সম্বিত ফিরেছিল।
    আমাদের এই অজ গাঁয়ের নাম রাঙাবেলিয়া। সেই যে বৈষ্ণব কানন,বংশীবদন, শাসন ছাড়িয়ে কীর্তনখোলা, তারপরে কৃষ্ণমোহন। আর কৃষ্ণমোহনের বুক চিরে যে মেঠো পথটা চলে গেছে দুপাশের ধানক্ষেত চিরে গাছ গাছালীর মধ্য দিয়ে, আকাশ যেখানে মাটিকে ছুঁই ছুঁই করছে, ওটাই রাঙাবেলিয়া। এখানে যেমন ধু ধু ধান ক্ষেত আছে, তেমনি আছে আম-জাম,তেঁতুল-নারকেল, বাবলা- বকুল আর কয়েত বেলের গাছ। আর আছে বেলে- মৌরলা,সরপুঁটি- ট্যাংরা,কই- মাগুর আর রুই- কাতলার অনেক পুকুর।
    একটা ভাঙা শিবমন্দির আর একটা চন্ডীমন্ডপ ও আছে। আমাদের গাঁয়ের লোকের হাতে কাঁচা পয়সা বেশী নেই বটে তবে ঝালে- ঝোলে- অম্বলে আর ক্ষেতের ফসলে খাওয়ার কষ্ট প্রায় কারোরই নেই। সন্ধে বেলায় চণ্ডীমন্ডপে কীর্তনের আসর বসে।বড়রা বলে নদীয়া থেকে নদের চাঁদ নিমাই নাকি পুরাণো গঙ্গা বেয়ে এই পথেই এসেছিলেন নাম মাহাত্ম প্রচারে। তাই এ অঞ্চলের বেশীর ভাগ নাম বৈষ্ণব প্রধান, আর মানুষগুলোও বেশীর ভাগই বৈষ্ণবপ্রাণ।
    গাঁয়ে আমাদের কলেজ নেই, তাই স্কুলের গন্ডী ছাড়িয়েই গ্রাম ছেড়েছি।শহরের হোষ্টেলে থেকে পড়াশোনা তারপর সরকারী চাকরী জুটিয়ে শহরেই বাসা- বাড়িতে থেকে দিব্যি আছি। কচ্চিৎ কদাচিৎ গাঁয়ের বাড়িতে যাই বটে কিন্তু সে অতিথির মতো। গুরুতর প্রয়োজন ছাড়া গ্রামে আর ফেরাই হয় না। বুঝতে পারি গ্রামের সাথে নাড়ীর টানটা ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছে।
    এমনি এক ক্ষীয়মান টানেও অতি জরুরী প্রয়োজনে যেতে হচ্ছে রাঙাবেলিয়ায়। অফিস থেকে বেরুতে একটু দেরীই হয়েছে।শীতের বিকেল। কখন যে টুপ করে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়েছে টেরই পাইনি ট্রেনের মধ্যে। কৃষ্ণমোহনে যখন নামলাম তখন রাত আটটা বাজে।চারিদিক ঘুট ঘুট্টি অন্ধকার।কেবল ষ্টেশন মাষ্টারের ঘরে টিম টিম করে একটা ক্ষীণ আলো জ্বলছে। প্রচন্ড জোরে ঝড় উঠেছে। শন শনে হাওয়ার সাথে সাথে শুরু হল মুষল ধারে বৃষ্টি।ষ্টেশনে দু চার জন লোক ছুটোছুটি করে মাথা বাঁচানোর চেষ্টা করছে।আমিও জবুথবু হয়ে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছি।
    একটু ওধার থেকেই শুনলাম যেন কার ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ।ভয়ের চোটে আমার অজান্তেই গলা থেকে রাম রাম ধ্বনি বেরিয়ে এল।তবুও ভালো করে ঠাহর করার চেষ্টা করলাম।আবছা অন্ধকারে কিছুই প্রায় দৃষ্টিগোচর হয় না। তার মধ্যেও ছায়া ছায়া কাকে যেন নড়াচড়া করতে দেখলাম। গা ছম ছম করে উঠল। ভয়ের একটা হিমেল স্রোত শিরদাঁড়া কাঁপিয়ে দিল।মরিয়া হয়ে চেঁচিয়ে ভয়ার্ত গলায় বললাম, ক্কে ওখানে ক্কে। উত্তরের পরিবর্তে ফুঁপিয়ে কান্নাটা আরো প্রবল হল। মনে আমার এটুকু প্রত্যয় দৃঢ হল যে আর যাই হোক অন্তত পক্ষে ভূত- পেত্নী বা কোনো অশরীরী আত্মা নয়।এটা অবধারিত ভাবেই মানুষের বা বলা ভালো কনো মহিলার ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ।
    সেই ছেলে বেলা থেকেই কারো কান্না আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারিনা।বুকের ভেতরটা কেমন দুমড়ে মুচড়ে ওঠে।আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। ঝোড়ো হাওয়া আর অকাল বৃষ্টি উপেক্ষা করেই এগিয়ে গেলাম।
    আবছা অন্ধকারে ষ্টেশনের কোনার দেওয়ালে হেলান দিয়ে মলিন বসনের একটি মেয়ে অঝোরে কাঁদছে।
    আমার জিঞ্জাসার উত্তরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে মেয়েটি অতিকষ্টে যা জানাল তা হচ্ছে, কপাল দোষে আজ তাকে বাজারে বোঝা বেচে সংসার চালাতে হচ্ছে।মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, কত কষ্টকরে পয়সা জোগাড় করে হাট থেকে মাল গস্ত করেছে। মালগুলো বস্তায় বেঁধে একধারে রেখে আড়তদারকে কড়ায় গন্ডায় পয়সা মিটিয়ে দিয়ে পিছন ফিরে দেখে বস্তাসুদ্ধু মাল উধাও।চোখের জল মুছতে মুছতে সে আরো বলল,এই কেনা- বেচা,বোঝা- বেচার কাজে নতুন এসেছিগো দাদা,আড়তদারের হিসেব মেটাতে গিয়ে একটু আনমনা হয়েছিলাম এরই মধ্যে আমার এত কষ্টের পয়সায় কেনা মালগুলো কে নিয়ে পালিয়ে গেল! কাল কি করে যে ওদের মুখে দুমুঠো তুলে দেব সেই চিন্তায় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।
    মেয়েটি অঝোরে কাঁদতে লাগল। চকিতে অন্ধকারের বুক চিরে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল, সশব্দে বাজ পড়ল কাছাকাছি কোথাও।আমি চমকে উঠলাম, বিদ্যুতের চকিত আলোয় এ আমি কার মুখ দেখলাম! আমার নবীন বয়সের সেই সুচির বাঞ্ছিতা! এ যে করুণা! কী হয়েছে ওর? অমন ডাগর চোখের সুন্দরী মেয়েকে আজ বাজারে বোঝা বেচে অন্নসংস্থান করতে হচ্ছে!
    এই অন্ধকারে দুর্যোগের রাতে ও আমাকে চিনতে পারেনি।সেই নবীন যৌবনের অবুঝ বয়সেও আমি ওকে যতটা চিনতে পেরেছিলাম তাতে এটুকু আমার বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে এ মেয়ে হাজার দু:খে বুক ফাটলেও মুখ ফুটে কিছু বলবেনা।
    মনটা খারাপ হয়ে গেল- বড্ড বিষণ্ণ বোধ করলাম।সেই নবীন বয়সে সামান্য একটু অনুরাগের ছোঁয়ায় পুলকিত হতে না হতেই গ্রামের সঙ্গে আমার চির বিচ্ছেদ ঘটে যায়। বিচ্ছেদ ঘটে করুণার সঙ্গেও। করুণা হারিয়েই গেছিল, আমার জীবন থেকেই শুধু নয় আমার সমগ্র বিবেক এবং অনুভূতি থেকেও।সেদিনের ওর সেই নরম হাতের পেলব স্পর্শ, আমার মুখের উপর ওর গরম নিশ্বাস, ওর সেই মধুর সান্নিধ্য, আর আমার হাত ক্রমশই অবাধ্য হতেই ওর সেই ছুটে পালিয়ে যাওয়া—- কেমন যেন এক ঝটকায় আমাকে সেই পিছনের দিন গুলতে আছড়ে নিয়ে ফেলল।
    যথা সময়ে করুণার বিয়ে হয়েছিল এক সম্ভ্রান্ত পরিবারেই। স্কুলের গন্ডী ছাড়ানোর ঠিক পরেপরেই।তখনও আমি বেকার, পড়াশোনা শেষ হয়নি, ভবিষ্যতও গড়া হয়নি।করুণার বিয়ের খবর আমি পাইনি।কেউ আমাকে ওর বিয়ের খবর দেবার প্রয়োজন বোধ করেনি।আমার সাথে করুণার সামান্য স্পর্শ দোষ সেদিনের প্রদোষের আধো অন্ধকারে কিছু ঘটে যাওয়ার পূর্ব মূহুর্তেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। সে খবর কারোর জানার কথা নয়, আমারও বলার কথা নয়।
    কিন্তু করুণা অন্ততপক্ষে বিয়ের আগে মুখ ফুটে সাহস করে বলতেই পারতো। তাছাড়া গ্রামের সঙ্গে আমার যে চির বিচ্ছেদ হতে যাচ্ছে সে খবর আর কেউ না জানুক করুণা জানতই।ও কিছু প্রকাশ করলে আমারও অস্বীকার করার উপায় থাকতোনা।নিতান্তই কাঁচা বয়সের কৌতুহল বশেই ও আমার সদ্য গজানো নরম গোঁফ স্পর্শ করতে চেয়েছিল।কিন্তু আমিতো জানি যে আমি ওর দিকে লোভের হাত বাড়িয়েছিলাম।
    আজ এই দুর্যোগের রাতে করুণাকে কিছুতেই মুখ ফুটে আমার পরিচয় দিতে পারলাম না।কিন্তু ওর অত সম্ভ্রান্ত বংশে বিয়ের পরে কী করে এত বড় দুর্যোগ নেমে আসল ওর জীবনে সেটা জানার ভীষণ ইচ্ছাটাকে জোর করে চুপ করিয়ে রাখলাম।মুখ ফুটে শুধু বলতে পারলাম কত টাকার মাল কিনেছিলে?
    করুণা এখনও ফোঁপাচ্ছে। ওই অবস্থাতেই বলল, তা শ- পাঁচেক টাকার হবে।
    ভাবলাম বলি তুমি এই শ-পাঁচেক টাকা রাখো এই দুর্যোগের রাতে আর কেঁদনা বাড়ি ফিরে চলো।বলতে পারলাম না।করুণাকে যতদূর চিনি আমার অযাচিত দান সে গ্রহণ করবেনা। তাই বললাম,তুমি আমার সঙ্গে যাবে, আমি আড়তদারের সঙ্গে কথা বলবো।আমার মনে হচ্ছে, তুমি যখন মাল রেখে পিছন ফিরে দাম মেটাচ্ছিলে, সে সময়ে কে তোমার মালটা সরিয়ে নিল সেটা আড়তদার নিশ্চয় দেখেছে।
    বৃষ্টিতো কমে গেছে,তুমি যাবে আমার সঙ্গে?
    এখন গেলে আড়তদারের দেখা পাব তাই,করুণা বলল,মাল বেচা কেনা হয়ে গেলে সে ঝাঁপ ফেলে দিয়ে বাড়ি চলে যায়।
    বললাম, একবার গিয়ে দেখলে কি হয়?
    আমার কথায় এমন কিছু ছিল যে করুণা রাজী হয়ে গেল।অথবা এমন হতে পারে যে আমি যেমনটা ভাবছি যে আড়তদারই তার লোককে ঈশারা করে মালটা সরিয়ে দিয়েছে করুণাও সেই একই কথা ভেবে আমার সঙ্গী হতে রাজী হল।
    আড়তদারের কাছে যাওয়ার পথে আমার জিঞ্জাসার উত্তরে করুণা বলল তার স্বামীর অদ্ভূত ব্যামোর কথা। সে খায় দায় আর দিনরাত্তির শুধু পড়ে পড়ে ঘুমায়। ঘুম ভাঙিয়ে কাজের কথা বলতে গেলেই তেড়ে মারতে আসে।কাঁপতে কাঁপতে দড়াম করে পড়ে যায়।গোঁ গোঁ করতে থাকে। ধরা ধরি করে শুইয়ে দিলে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ডাক্তার রোগটার নাম দিয়েছে স্কিৎজোফ্রেনিয়া।
    চমকে উঠলাম।করুণা লেখা পড়া জানা মেয়ে।ডাক্তারের বলে দেওয়া অসুখটার নাম সঠিক উচ্চারণে বলেছে।করুণা বলে চলেছে এখন শুধু ঘুম থেকে ডেকে তুলে খাইয়ে দিতে হয় আর ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হয়।কপাল আমার এতো খারাপ যে একমাত্র ছেলেটাও নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারেনা।পাঁচ বছর বয়েস হল তাকে কোলে করে করে এখানে ওখানে নিয়ে যেতে হয়।ডাক্তার বলেছে পোলিও। ওর কডলিভার অয়েল আর ক্যালসিয়াম দরকার।
    ষ্টেশন থেকে বেশী দূরে নয়।এখানে হাট-বাজার-আড়ত সব একসঙ্গে একাকার।পরিবহনের সুবিধার জন্যে এখানে এভাবেই গড়ে ওঠে কেনাবেচার জায়গা।দুর্যোগ থেমে গেছে।আড়ত এখনও বন্ধ হয়নি। সেই আড়তদার সেখানেই বসে আছে। আরো অবাক কান্ড করুণার গস্ত করা মাল সমেত পুরো বস্তাটাই রয়েছে আড়তদারের সামনে।
    করুণা দেখামাত্রই চিনতে পেরে চেঁচিয়ে উঠে বলল, এইতো আমার মাল।আড়তদারকে ডেকে বলল, কিগো দাদা, আমার মালের বস্তা কোৎথেকে এল?
    আড়তদার আমতা আমতা করছে।একলা মেয়েমানুষ যে এই ঝড় বাদলের রাতে হারানো মালের খোঁজে আবার ফিরে আসতে পারে তা সে ভাবতেই পারেনি।
    করুণার সঙ্গে আমাকে দেখে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বলল, যে নিয়েছিল তার বোধহয় হজম হয়নি, তাই ফেলে রেখে পালিয়েছে।
    আমি থাকতেনা পেরে বললাম, তোমারই সামনে কেউ ওর মালটা সরিয়ে নিয়ে গেল আর ও চলে গেলে মালটা তোমার কাছেই ফেরৎ আনল, সে তোমার চেনা লোক নিশ্চয়ই? তেমনই দাঁত বের করে আড়তদার বলল,আমি চিনতে পারলে তার পিঠের চামড়া ছাড়িয়ে নিতাম না।
    যা বোঝার আমি বুঝে গেলাম।করুণাও বোধকরি বুঝতে পারল যে আড়তদারই যোগসাযোগ করে তাকে আতান্তরে ফেলেছিল।
    আমি করুণার দিকে ফিরে বললাম,এত মাল একা নিয়ে যাবে কি করে?
    করুণা আমার দিকে না ফিরে বস্তাটা সাইজ করতে করতে বলল, আপনি একটু দাঁড়ান, আমি একটা ভ্যান ডেকে আনছি।
    করুণা একটা ভ্যানরিক্সা ডেকে মালগুলো ভ্যানে তোলাল, তারপর সেই ভ্যানে চড়েই অন্ধকার গ্রামের পথে ছায়ার মতোই মিলিয়ে গেল।
    আমার মনে হলো, আজো যেন করুণা সেই সেদিনের মতোই অন্ধকারে ছুটে পালিয়ে গেল।অবাক হলাম,একবারের জন্যেও করুণা আমার নাম বা পরিচয় জানতে চায়নি। আমি চিনলেও করুণা কি আমাকে চিনতে পারেনি। নাকি ও আমাকে চিনতে চায়নি! তবে কি করুণা আমাকে করুণা করেই তাড়াতাড়ি অন্ধকারের পথে হারিয়ে গেল! ঠিক সেই সেদিনের মতো।

  • কবিতা,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    কবিতা- মৃত্যুভাব

    ।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

     

    মৃত্যুভাব
    -শৌভিক মন্ডল

     

     

    আর্তনাদে ভরে উঠেছে শিরা, কুন্ডলীতে যেন প্রাণের শিহরণ আন্দোলিত হচ্ছে…
    দেখতে দেখতে শিরাগুলো কেমন কলের পাইপ এর মত….
    বোধহয় নিয়নের বাতি, নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে কেমন বিলীন থেকে বিলীনতর হচ্ছে ,
    অজানা ভালোলাগায় তলিয়ে যাচ্ছে দেহ।

    কেউ যেন কানের কাছে বলছে- “আর একটু অপেক্ষা করো,
    আবার শৈশবের ভালোলাগায় নিয়ে যাব তোমায়।”
    কথকতা ভোরে ..স্নাত হয়ে, অবগাহন মায়ায় তুমি দেবে ডুব।
    দেখতে পাচ্ছ শুয়ে থাকা নিথর ,সেই সরষেখেতে , আন্দোলিত ঢেউয়ের শেষাংশ
    আর একটু …..একটু…

    সন্ধ্যা ছয়টায় গ্রীষ্ম গোধূলিতে রিয়ার বাবা হারিয়ে গিয়েছিল
    অবিনশ্বরে।
    হয়তো আর এক প্রজন্মের হাতছানিতে রেখে গিয়ে –
    কিছু প্রশ্ন কিছু প্রত্যাশা।

  • কবিতা,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    কবিতা- উদ্বাস্তু

    ।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

     

    উদ্বাস্তু
    -তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়

     

     

    পিছে পড়ে থাকে সাতপুরুষের ভিটে।
    পিছে পড়ে থাকে ঘর, ভাতের হাঁড়ি,সংসার টুকিটাকি।
    আর পড়ে থাকে স্মৃতি হাহাকার।
    নাড়ি ছেড়া ব্যথা।
    জীবনের টানে পার হয়ে চলে যায়
    মানচিত্রের সীমানা।

    ওরা উদ্বাস্তু।

    অনেক জখমী মন নিয়ে
    ফিরেফিরে দেখে,
    ফেলে আসা ভাঙা ঘরখানি।
    ডাঙায় যে বাঘ, জলেও কুমীর।
    কোথায় যে বাসা বাঁধবে আবার!
    কেউ যে চায়না নিতে ওদের এই দায়।

    ওদের এখন শুধু সম্বল ক্ষুধা,পুষ্টিহীনতা।
    আর ঘুণপোকা ধরা মনে টাটকা স্মৃতি।

    মাছি ভনভন ছোট্টো শরীর।
    খিদে পেটে সরল চোখদুটো
    শুধু খুঁজে চলে মাকে।।

  • কবিতা,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    কবিতা- বিবেকের ঘুম নেই

    ।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ।।

     

    বিবেকের ঘুম নেই
    -অমর দাস

     

     

    আমি বিবেক, হ্যাঁ আমার নাম বিবেক।
    সারা পৃথিবীর মানুষ আমাকে এই নামেই চেনে।
    আমি হাজার হাজার বছর ধরে ঘুমাতে পারি না।
    যখনি আমি চোখ বুজি, দেখতে পাই আমার দেশ,
    আমার পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের ভুখা মুখগুলি
    চিৎকার করে বলছে “আমাদের খেতে দাও,
    আমরা ক্ষুধার্ত,আমাদের পড়ণে বস্ত্র নেই, বস্ত্র দাও”।
    আমার ঘুম ভেঙে যায়, আমার আর ঘুম আসে না।
    কারণ আমার নাম যে বিবেক, হাজারো বছর ধরে
    আমি ঘুমাতে পারিনা। হয়তো আগামী হাজার বছরেও
    আমি ঘুমাতে পারবো না। আমি চোখ বুজলে দেখি,
    রাস্তার দুধারে, রেল লাইনের পাশে, নদীর কিনারে
    বনে জঙ্গলে আজো মানুষ ঝুপড়িতে বাস করছে।
    তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই।ঝড়,বৃষ্টি বন্যায়
    তারা ভেসে যায়, তাদের বাঁচাবার কেউ নেই। আছে
    এই অসহায় মানুষগুলোর জন্য বক্তৃতার ফুলঝুরি।
    আবার আমার ঘুম ভেঙে যায়।রাত প্রায় শেষের দিকে,
    না ঘুম আমার হলোনা, আমি যে অভিশপ্ত বিবেক।
    আবার চোখ বুজলাম, আমি দেখতে পাচ্ছি অসহায়
    কোটি কোটি বেকার শিক্ষিত যুবক পৃথিবীর একপ্রান্ত
    থেকে অন্নপ্রান্তে ছুটে চলেছে একটা চাকরীর আশায়।
    তারা চিৎকার করে বলছে “আমাদের চাকরী দাও”।
    আমি চোখবুজে দেখতে পাই চাকরীর জন্য ওরা
    বিক্ষোভ আন্দোলন করছে, পুলিশের লাঠির ঘায়ে
    ওরা রক্তাক্ত হচ্ছে, মরছে, তবুও ওদের চাকরী চাই।
    না কেউ এই কর্মহীন অসহায় বেকার যুবকদের দুঃখ
    যন্ত্রনা বুঝবে না, কেউ ওদের চাকরী দেবেনা,ওদের
    আছে যোজ্ঞতা কিন্তু নেই চাকরী নেই রোজগার,
    আমি চোক বুজলে দেখি , নেতারা ওদের কাছে
    ভাষন দিচ্ছে কিন্তু চাকরী দিচ্ছে না,মহামারীতে আমার
    দেশের কোটি কোটি যুবকের চাকরী গেছে। ওরা কেউ
    নিজের দেশের শ্রমিক কেউ বা পরিযায়ী শ্রমিক।
    মহামারীতে রেল বন্ধ, সড়ক বন্ধ,পায়ে হেঁটেই
    নিজের রাজ্যে পারি দিয়েছে,রেল লাইনের উপরেই
    ক্লান্ত হয়ে ওরা ঘুমিয়ে পড়লো। একটা ট্রেন ওদের
    সামনে এসে পড়লো, ক্লান্ত দেহগুলির ওপর দিয়েই
    ঐ জল্লাদ ট্রেনটা চলে গেলো। দেখলাম অনেক গুলো
    শ্রমিকের মৃত দেহ রেল লাইনে রক্তাক্ত ,বিভৎস
    অবস্থায় পড়ে আছে, একটা শ্মশানের নিস্তব্ধতা।
    এবার শেষবারের মতো আমার ঘুম ভেঙে গেলো।
    আমি বোধহয় আর কোনদিন ঘুমাতে পারবো না।
    কারণ নাম যে আমার বিবেক, জাগরুক বিবেক,
    যতদিন সারা বিশ্ব জুড়ে শোষন বঞ্চনা থাকবে,আমি
    ঘুমাতে পারবো না, কারণ আমি যে জাগ্রত বিবেক।

  • কবিতা,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    কবিতা- জীবনের রঙ্গ মঞ্চ

    ।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

     

    জীবনের রঙ্গ মঞ্চ
    -অনিমা দাস

     

     

    বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করার
    সুযোগ পেয়েছি ।
    কখনো কন্যা কখনো স্ত্রী কখনো বৌ মা
    কখনো মা আরো ভিন্ন চরিত্রে ।
    প্রতিটি চরিত্রে নিখুঁত পারফরমেন্স দেওয়ার
    চেষ্টা অবিরাম চালিয়ে যাচ্ছি।
    অভিনয় করতে গেলে তো বেষ্ট টা দিতে
    সকলেই চায়।
    টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে হয়।
    জীবনের এই রঙ্গ মঞ্চে কখনো হেসেছি
    কখনো কেঁদেছি আবার কখনো
    ভালোবাসার সাগরে ভেসেছি ।
    আর প্রিয় জন দের সুখী রাখার চেষ্টা চালিয়ে
    গেছি জীবন সংগ্রামে ।
    মায়ের ভূমিকায় পদার্পণ করা,
     জীবনের এক নতুন মোর ।
    মাতৃত্বের স্বাদ আধো আধো কন্ঠে মা ডাক শোনা।
     সন্তানের নরম হাতের শীতল স্পর্শ ,
    এক অনন্য অনুভূতি।
    তার পর তাকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে
    বড় হতে দেখা এটাই জীবনের  পরম প্রাপ্তি।
    ক্ষুদ্র এই জীবন ঘটনা বহুল রঙ বেরঙের
    কত কাহিনী জীবন পটে ধরা পড়ে ।
    রঙ্গ মঞ্চে অভিনয় করতে করতে কখনো
    ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে যায় এই শরীর মন ।
    সেই সময় এই একঘেয়েমি থেকে ছুটি চায়
    এই মন অনাবিল আনন্দের খোঁজে ।
    আকাশ বাতাসের সঙ্গে একাত্ম হতে চায়
    গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকা চঞ্চল হৃদয়।
    নীল সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে মিশতে মন
    ছুটে যায় দূর বহু দূরে ।
    প্রকৃতির সাথে কিছুটা সময় একাত্ম হতে ।
    আবার জীবনের রঙ্গ মঞ্চে ফিরে আসা ।
    এভাবেই চলে জীবন ।

  • কবিতা,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    কবিতা- একাকীত্ব

    ।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

     

    একাকীত্ব
    -তমাল হাইত

     

     

    একাকীত্ব ঘিরে ধরে কখনো,
    নলি ঠেলে উঠে আসতে চায় দলা পাকানো কষ্ট!
    ভিড়ের মাঝে থেকেও ঝাপসা সব মুখ!
    মুখ? নাকি মুখোশের ভিড়ে বাঙ্ময় ব্যঙ্গ!
    ছুটছি, অন্তহীন! তবু শেষ হয়না পথ।

    দিকভ্রান্ত পথিককে গ্রাস করে ক্লান্তি,
    ঐতো বিস্তীর্ণ ফাঁকা প্রান্তর, সুযোগ একটু প্রাণখুলে শ্বাস নেওয়ার!
    দলা পাকানো কষ্টটা কমছে, মিলিয়ে যাচ্ছে হারিয়ে যাচ্ছে গভীরে।

    নিঃশ্বাসের সাথেই প্রাণবায়ুর নিষ্কৃতি!
    ঝাপসা মুখ মুখোশ এর ভিড়ের ইতি।
    আহ্! লাভ হবে অপার শান্তি!

  • কবিতা,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    কবিতা- এমন শ্রাবণ দিনে

    ।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।

     

    এমন শ্রাবণ দিনে
    -পাপিয়া ঘোষ সিংহ

     

     

    শ্রাবণ আকাশ সেজেছে অনুরাগে,
    বাদল – রোদের চলছে লুকোচুরি,
    মনে জমছে মনখারাপি মেঘ,
    তুমি ক্রমে যাচ্ছো দূরে সরি।

    মনে পড়ে? এমন শ্রাবণ দিনে,
    বর্ষা সোহাগ ভিজিয়েছিল তোমায়,
    সিক্ত তোমায় দেখে লাজে রাঙা,
    মুখে আমার গোধূলি রঙ ছায়!

    সেদিন শ্রাবণ ছিল পাগলপারা,
    গন্ধরাজ আর কামিনীর সুবাসে,
    কালো মেঘের ছিল না তো দেখা,
    আমরা দু’জন চলেছিলাম ভেসে।

    হঠাৎ সেদিন শরৎ এসেছিল,
    ফুটেছিল হাজার শিউলি ফুল,
    আবার আজকে শ্রাবণ গরজনে
    বুক কাঁপিয়ে, ধরাচ্ছে সব ভুল।

    সত্যিই কি ভুল ছিল সবটুকু?
    প্রেমের বানে ভ্রমের স্রোতে ভাসা!
    বর্ষা- বাদল মিলবে না কখনও?
    আর নেই কি একটুখানি আশা?

    আজকে তুমি খেলছো রোদের সাথে,
    ঝলকানিতে যাচ্ছো আমায় ভুলে,
    মনের ব্যথা পড়ছে ঝরে ঝরে,
    এমন রোদন ঘুচবে কোন কালে?

    মাঝে মাঝে তোমার গরজনে,
    বিদ্যুতের ঐ আলোক দেখে বাঁচি,
    আমার বাদল ফিরবে আমার কাছে।
    বলবে আমায় এই তো আমি আছি।

    আবার তুমি আসবে শ্রাবণ দিনে,
    বর্ষা -বাদল মিলবে আবার দোঁহে,
    প্রেম-দরিয়ায় চলবো আমরা ভেসে
    ভালোবাসা থাকে না আটকে মোহে।

You cannot copy content of this page