-
কবিতা- কোথায় খুঁজছো সুখ
কোথায় খুঁজছো সুখ
– মানিক দাক্ষিতকোথায় খুঁজছো সুখ ?
চারদিকে শুধু দুখ।
আগে হও আত্মমুখ,
পাবে তাহলে স্বর্গসুখ।জন্ম থেকে শুধু চাই,
থাকলেও আরও চাই।
বলো শুধু কোথায় পাই,
চাহিদার শেষ নাই।বিষয়ের বিষয় বিষে
জড়িয়েছো অক্টোপাসে,
শুধু খোঁজো সুখ কিসে;
নেশা তাই হাড়ে-মাসে।কামনার আগুনে পুড়ে
যেদিন তুমি হবে ছাই,
সে-দিন দেখবে তুমি
ত্যাগ আছে, ভোগ নাই।সব তখন হবে মিথ্যা
সত্য শুধু আমার আমি,
জ্ঞান-চক্ষু খুলে গিয়ে
তখন তুমি অন্তর্যামী। -
কবিতা- আত্মজ্ঞানী
আত্মজ্ঞানী
-মাণিক দাক্ষিতদেহ মন দু’জনেই ভাল বন্ধু
কেউ কাউকে ছাড়ে না।
একের ব্যথায় অন্যের ব্যথা
সহ্য করতে পারে না।
দেহ-সুখে চিত্ত-সুখ
ফুলে ফুলে ভরা।
দেহ-রোগে চিত্ত ভোগে
তাজা যায় মারা।
দেহ আমার চিত্ত আমার
কিন্তু ওরা আমার নয়।
‘আমি’ হলেম আমার আমি
‘আমি’ হলেম ব্রহ্মময়।
আমার দেহ,আমার চিত্ত
নয়তো আমার বশীভূত।
তবে কেন ‘আমার’ বলে
গলা ফাটাও অবিরত!
আমার শুধু ‘আমি’ আছি
নিষ্ঠা নিয়ে জানি এসো।
জানলে হবে আত্মজ্ঞানী
বলবে, জীবে ভালবাসো। -
কবিতা- তোমার সাথে আমিও বন্দী
তোমার সাথে আমিও বন্দী
– মানিক দাক্ষিততোমার সাথে আমিও বন্দী
শৃঙ্খলিত লৌহ কারাগারে কালের অধীনে।
দিনের শেষে রাত যায়—কাল কাটে
বিষয়ের আসক্তি ও বিরক্তিতে।
ডানা মেলা শকুনের কড়া দৃষ্টি বাড়ে
স্থূল দেহের চাহিদার তীব্রতায়।শিমুলের কুঁড়ি থেকে শিমুলই ফোটে;
কাকের বাসায় কোকিলের ডিম ফোটে
পূর্ব সংস্কারের ঐতিহ্য মহিমায়।
অনুকূল রাগে অনুরাগ বাড়ে,
প্রতিকূলতায় ক্রোধ ফাটে…
বাস্তবের অসার সংসারে।সূর্যের চারদিকে মোহপ্রাপ্তি পৃথিবী ঘোরে
সুখের আবেশে।
দেহসুখ বাড়তে থাকে ক্রমে,
চিন্তা নামে পরিজনের অসুখে বিসুখে।
স্বচ্ছ চোখে পর্দা নামে
মোহমুগ্ধ স্বার্থের পরশে।কতদিন আর কাটানো যায় অন্ধকার কারায়
শৃঙ্খলিত বন্দী জীবন।
তিলে তিলে সত্ত্বার চরম ক্ষতি
যদি না সত্ত্বার চৈতন্য ফোটাও। -
কবিতা- আশাদেবী
আশাদেবী
– মানিক দাক্ষিততুমি আছ বলে আনন্দ সুখ
আছে একটা আগামীকাল,
তুমি আছ বলে ঘুম থেকে উঠে
দেখছি একটা নতুন সকাল।
তুমি আছ বলে ক্লান্ত দেহটা
পাচ্ছে প্রতিদিন নতুন জীবন,
তুমি আছ বলে শরীর সতেজ
ডানা মেলে ওড়ে বিহঙ্গ-মন।
তুমি আছ বলে বখাটে চিন্তা
পারে নাকো এসে আড্ডা দিতে,
তুমি আছ বলে দুঃখ শোকেরা
পারে না ভয়ে মিছিল করতে।
তুমি আছ বলেই রঙীন স্বপ্ন
ভিড় করে কত লক্ষ কোটি,
তুমি আছ বলেই আশা ভরসায়
পাহাড়ে চড়ি, চাঁদেতে হাঁটি।
তুমি আছ বলেই পৃথিবী সুন্দর
কত সাধ জাগে ফাগুন মনে,
তুমি আছ বলেই চাই না মরতে
বাঁচতে চাই এই মুগ্ধ ভুবনে। -
কবিতা- সভ্যতা শব্দ লেখা……
সভ্যতা শব্দ লেখা…
– মানিক দাক্ষিতবসন্তের অনুকূলে শীতের জড়তা বাড়ে—
আশ্বিনে বাদল নামে ফুলের কুঁড়িতে।
অন্ধকার হাসির বিষণ্নতা কাড়ে
সবটুকু বিতৃষ্ণা মুড়কি আর মুড়িতে।শঙ্করের গভীর আক্ষেপ-রাশি —
গেঁয়ো যোগীর ভিক্ষাভাব তাই প্রবাসী।জীবাণুমাখা ধূলিকণা বিষাক্ত বায়ুতে,
চলমান গতি স্তব্ধ চাকার অভাবে।
মেদহীন পিঞ্জরের বাঁধন অল্পায়ুতে
কাটে নিয়মের আপন স্বভাবে।চোখের দৃষ্টিগুলো গণ্ডিতে আবদ্ধ;
রোদের আলোয় শিশির তাই অনর্থক শব্দ।ঋতুর অনিয়মে কেশের পক্কতা আসে…
স্নায়ুর অস্থিরতা চিন্তার মগজে।
ক্ষুধার নিবৃত্তি শুধু হাড়ে আর মাসে—
‘সভ্যতা’ শব্দ লেখা ধবধবে সাদা কাগজে। -
অণু কবিতা- পরমানন্দ হৃদয়ে
পরমানন্দ হৃদয়ে
– মানিক দাক্ষিতপ্রকৃতির স্পর্শসুখে আবদ্ধ শিখণ্ডী
উল্লসিত সৃষ্টির অশুদ্ধবেলায়।
অস্তমিত জ্ঞানের অখণ্ডতার বিলোপ ঘটে
খণ্ডতার অশুভ জ্বালায়।জ্ঞানের সঞ্জিবনী শঙ্খ স্তব্ধ
পঞ্চজনা অসুরের মাঝে।
হৃষিকেশ নীরব দর্শক
যতদিন না পাঞ্চজন্য শঙ্খ বাজে।অখণ্ড প্রাণে ক্রিয়ার স্ফূরণ ঘটে
জ্ঞানের উদয়ে।
চৈতন্যস্বরূপের অনুভূতি আলোড়ন তোলে
পরমানন্দ হৃদয়ে। -
ভৌতিক গল্প- ভূতের সন্ধানে
ভূতের সন্ধানে
-মানিক দাক্ষিতজঙ্গলের দীর্ঘ নিঃস্তব্ধতা ভঙ্গ করে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে বাদুডের ডানার ঝটপটানি শব্দ। মুগ্ধ আবেশে অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছি রহস্যে ঘেরা ক্রমে ক্রমে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হওয়া জঙ্গলটার দিকে।
জঙ্গলটার বুক চিড়ে রওনা দেবো আজই সেই ভয়াবহ রোমাঞ্চকর জায়গাটিতে। ঠিক রাত বারোটায়। ভারী পায়ের শব্দে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি নন্দন।দুহাতে দুটো কফির পেয়ালা। মুখে তার একমুঠো অনাবিল জ্যোৎস্না হাসি।
—দেখছি প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিস। নে, ধর্। কফি খা। খেয়ে ভেতরে চল। তোর সাথে জ্যেঠু কথা বলবে। এখানে বেশীক্ষণ বসে থাকলে বুনো ডেঁশো মাছির দল রক্ত চুষে ছিবড়ে করে ফেলবে!নন্দন শুধু আমার বাল্যবন্ধু নয়, কলেজের বন্ধুও। হরিহর আত্মা। কলেজে পড়তে পড়তে মামার দৌলতে নন্দন পেয়ে গেল পুরসভায় ক্লার্কের চাকরী আর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে এখন একটা কলেজে অধ্যাপনায় রত। সাথে চলছে একটা বিষয়ের ওপর গবেষণা। গবেষণার বিষয়? ভাবছিলাম এই মূহুর্তে বলবো না। ঝেড়েই কাশি। গবেষণার বিষয় আমার ভূত। তারই খোঁজে সুদূর কলকাতা থেকে শতাধিক প্রাচীন বর্ধমানের গোপভূমির এই পুরোনো বাংলোয় নন্দনের সাথে আসা। যদি কিছু হাতে গরম তথ্য খুঁজে পাই। নন্দন ছাড়া এখানে আসা আমার মোটেই সম্ভব হতো না। কারণ বাংলোটির মালিক নন্দনের জ্যাঠামশাই দীনবন্ধু রায়ের। বেশ বিত্তশালী। পূর্বপুরুষ জমিদার ছিলেন। এলাকায় বেশ নামডাক। সকলেই সমীহ করে। বিপত্নীক। একটি মাত্র মেয়ে। নাম মল্লিকা। শুনেছি রূপসী ও বিদুষী। এখনও চোখে দেখিনি।
জ্যাঠামশায়ের জরুরী তলব। সন্ধ্যায় রাজকীয় জলযোগ সেরে নন্দনের সাথে জ্যাঠামশায়ের ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। আরাম কেদারায় আধশোয়া অবস্থায় উনি কি যেন একটা পড়ছিলেন। আমাদের
দেখামাত্র বইটা বন্ধ করে ভারী গলায় বললেন, “বসো, কথা আছে।” গভীর দৃষ্টিতে উনি আমার দিকে
তাকালেন।
–নাম কি?
–শিবেশ মল্লিক
–কি করো?
–আজ্ঞে অধ্যাপনা।
–লেখাপড়া?
–ট্রিপল এম.এ., বি.টি.
–কি কি বিষয়ে?
–বাংলা, ইতিহাস আর ইংরাজী।
–গুড। কলকাতার কোন জায়গায় থাকো?
–আজ্ঞে টালিগঞ্জ।
–বাড়ীতে কে কে আছেন?
–শুধু মা। বাবা খুব ছোটবেলাতেই মারা গেছেন।
–তা লেখাপড়া নিয়ে থাকলেই তো হতো। এ-সব
ভূত-প্রেত নিয়ে মাতামাতি কেন?আমি আমতা আমতা করতেই একগাল হেসে নন্দন বললো, “জ্যেঠু, শিবেশ আজ বছর তিনেক হলো
‘অশরীরী আত্মা’র ওপর গবেষণা চালাচ্ছে। তাই—“জাঁদরেল রাশভারী দীনবন্ধু রায় এবার খাড়া হয়ে বসলেন। ভরাট গলায় একটু উপদেশের সুরে বললেন, “তোমরা ভয়ানক দুঃসাহসিক এই অভিযানটা না করলেই মনে হয় ভাল করতে। লালগড় বড় ভয়ানক
খতরনক জায়গা। ওখান থেকে বেঁচে ফিরে আসাই মুস্কিল! আজ আবার ঘোর অমাবস্যা। পথ বড় দুর্গম। পদে পদে বিপদ। দুর্ভেদ্য গভীর জঙ্গলে কিভাবে কেমন করে তোমরা পৌঁছাবে, সেটাই বড় দুশ্চিন্তা!”আমি অবাক চোখে প্রশ্ন করলাম, “রাস্তা নাই?”
চোখ বন্ধ করে ভদ্রলোক বলতে শুরু করলেন– “আছে, দড়ির মত সরু লম্বা পথ। কাঁটা ঝোপ-ঝাড়ে ঢাকা। দশ মিনিটের পথ ঘণ্টাখানেক লেগে যায়। একবার জঙ্গলে ঢুকলে আবোড় লোকেদের পক্ষে ঐ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা বড়ই কঠিন। বিষাক্ত পোকা-মাকড়, বিষধর সাপেদের অবাধ চলাফেরা। কখন কোনসময় কাকে কামড়াবে, ছোবল মারবে, কেউ জানে না। তাই বলছিলাম–ভাবনা চিন্তা করো।ঘণ্টাখানেক সময় দিলাম। সিদ্ধান্ত জানিও। যাও, ঘরে যাও।”
নন্দনের মুখ পাংশুবর্ণ। আমার হাতদুটো নিজের বুকে চেপে কাকুতি মিনতি করে–“গিয়ে কাজ নাই গুরু। বেঘোরে প্রাণটা যাবে। চল, ভালোয় ভালোয় বাড়ী ফিরে যাই! “
চোয়াল শক্ত হয়। নন্দনকে বলি, “ঠিক আছে, তোকে যেতে হবে না। আমি একাই যাবো।”
বিষ্ময়ে আকাশ থেকে পড়ে নন্দন। ম্লান মুখে বলে, “তুই ভাবলি কি করে, তোকে আমি একা ছেড়ে দেবো? চল, যা হবার হবে। মরলে দুজন একসাথেই মরবো।”
সিদ্ধান্তের কথা নন্দন তার জ্যাঠামশাইকে জানালে তিনি একটু মন:ক্ষুন্ন হলেন। বললেন, “তোমার বন্ধুটা বড্ড জেদী আর একরোখা। আচ্ছা, ঠিক আছে।”ঠিক রাত বারোটা। অকুস্থল লালগড়ে যাবার জন্য আমরা তৈরী। দায়িত্ববান জ্যাঠামশাই দীননাথ রায় আমাদের একা ছেড়ে দিতে মোটেই রাজী নন। আমাদের যতরকম নিরাপদ ব্যবস্থা দেওয়া যায়, দিয়েছেন। পায়ে আমাদের গামবুট, গায়ে কমফোর্ট মোটা ওভারকোট, হাতে দস্তানা, মাথায় টুপি। সঙ্গে দুজন কাঠুরে। হাতে তাদের কাটারি আর কুড়ুল। কাঁটার ঝোপ-ঝাড়ে ঢাকা সরু রাস্তা পরিস্কার করতে করতে ওরা আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে। আর আছে দৈত্যের ন্যায় বিশাল চেহারার চার লাঠিয়াল। তাদের প্রত্যেকের হাতে তেলচুকচুকে একটা করে পাকা লাঠি আর জোরালো টর্চ। নন্দনের পিঠব্যাগে জলের বোতল, দুফুটি মোটা লাঠি। আর আমার কোমরে পিস্তল, হাতে জোরালো চার্জার টর্চ। অনেকটা নিশ্চিন্ত। মনে হলো বেশ নিরাপদ। নন্দনের মুখ দেখে মনে হলো তার ভীতু মনটা অনেকটা সাহস পেয়েছে।
জঙ্গলের ভেতরে ঢুকতেই ঝিঁ ঝিঁ পোকার আওয়াজের সাথে বহু নিশাচর প্রাণীর উদ্ভট শব্দের মেলবন্ধনে একটা গা ছমছমে ভাব। দু-পা এগোতেই পায়ের কাছে ধপাস করে ভারী কি একটা পড়ে নিমেষে মিলিয়ে গেল। কাঠুরে বললো, “বনবিড়াল”। বেশ কিছুটা এগিয়েছি। হঠাৎ মড়মড় শব্দ করে একটা গাছের মস্ত বড় ডাল আমাদের সামনে পড়ে রাস্তাটাকে আটকে দিলো। উপরের দিকে টর্চের আলো ফেলতেই দেখি একদল অদ্ভুত বিকটাকার প্রাণী গাছের ডালে মানুষের মত দাঁড়িয়ে দুপাটি দাঁত বার করে খ্যাক খ্যাক করে হাসছে। নন্দন ভয়ে আমাকে জাপটে ধরেছে। কোমর থেকে পিস্তল বার করতেই এক কাঠুরে সাবধান করলো–“খবরদার, গুলি চালাবেন না। রেগে গেলে ওরা আমাদের আস্ত রাখবে না। সব কটাকে হাত-পা ভেঙে ঘাড় মটকে এখানে ফেলে রাখবে। গায়ে ওদের ভীষণ জোর্। মৃদুস্বরে প্রশ্ন করলাম, “ওরা কারা?”
চাপা গলায় উত্তর এলো –“ওরাং ওটাং”
কাঠুরিয়াদের নির্দেশমতো চুপচাপ আমরা পাশ কাটিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম।রাত প্রায় একটা। আমরা শুকনো পরিখাঘেরা লালগড়ে পৌঁছালাম। বড় বড় গাছ ঘন ঝোপ- ঝাড়ে পরিবেষ্টিত দুর্গটির সেরকম কোন অস্তিত্বই নাই। শুধুই ধ্বংসস্তুপ। চারদিকে অসংখ্য নিম, বেল, অশ্বত্থ আর ঝুরিনামা বটগাছ। লোভ সামলাতে পারলাম না। নন্দনকে বললাম, চ, একটু ভেতরে যাই। অতি সন্তর্পণে পা ফেলে এগোতেই ‘ফোঁস’ শব্দে চমকে উঠলাম। টর্চের আলো ফেলতেই দেখি লেজের ওপর ভর করে প্রায় দু’ফুট মাটির ওপর ফণা তুলে প্রকাণ্ড দুটো বিষধর সাপ। নন্দন ভয়ে কাঠ। বলে, আর গিয়ে কাজ নাই।”
নন্দনকে নিয়ে ফিরে এসে সঙ্গীদের কাছে রাখি। ওদের নিষেধসত্ত্বেও আমি একা টর্চ জ্বেলে পরিত্যক্ত ভাঙা দুর্গের মধ্যে প্রবেশ করি। ঘুটঘুটে অন্ধকার। শোনা যায় থেকে থেকে একটা হাল্কা গোঙানির শব্দ। উপরে টর্চের আলো ফেলতেই মনে হলো বিশাল দীর্ঘকায় একটা ছায়ামূর্তি যেন সরে গেল। কোমর থেকে পিস্তলটা বার করতে যাবো হঠাৎ করে হাত ফসকে টর্চটা গেল পড়ে। জমাটবাঁধা ঘন অন্ধকারে উপুড় হয়ে টর্চটা খুঁজতে গিয়ে টের পাই ঘাড়ের ওপর কাদের যেন গরম নিঃশ্বাস। মনে হচ্ছে সাঁড়াশীর মত গলা টিপে এখুনি আমার দম বন্ধ করে মেরে দেবে। ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো। আমার পিস্তল থেকে গুড়ুম–গুড়ুম–গুড়ুম শব্দে বেরুলো তিনটে গুলি।নিমেষে আমার দলবল দৌড়ে এসে আমাকে এখান থেকে বার করে আনলো। লেঠেল সর্দার ভয়ানক উত্তেজিত। বললো, “বরাত জোরে বেঁচে গেছেন। অনেক হয়েছে। আর নয়। চলুন, বাড়ী ফিরি। আপনাদের মত ছেলে ছোকরাদের একটাই দোষ—নিজের চোখে না দেখলে আপনারা কোনো কিছুই বিশ্বাস করেন না। অথচ, তেনারা আছেন। বিশেষ খ্যানে অখ্যানে, তিথি নক্ষত্রে ওনাদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। আসুন। লেঠেল সর্দার দীঘির পাড়ে এক বিশাল বাঁশঝাড়ের কাছে নিয়ে এসে থমকে দাঁড়ালো। টর্চ জ্বেলে দেখালো —“দেখতে পাচ্ছেন বাঁশগুলো কেমন ঝাড় থেকে দীঘির জলে নুইয়ে পড়েছে। ব্যাপারটাকে আমি সহজভাবে নিয়ে বললাম, “পড়তেই পারে। গোড়া ভেঙে গেলে বাঁশগুলোর তো এমনিভাবেই পড়ে থাকার কথা! সর্দার এবার রেগে আমার দিকে কটকট করে তাকালো। নীচে থেকে একমুঠো মাটি হাতের মুঠোয় নিয়ে মন্ত্রের মত কি যেন বিড়বিড় করে পড়ে বাঁশগুলোর ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বললো, “দেখুন এবার কাণ্ডটা!” অবাক কাণ্ড! দীঘির জলে পড়ে থাকা বাঁশগুলো নিমেষে ‘হুশ’ করে উঠে দাঁড়িয়ে ঝাড়ের মধ্যে মিশে গেল। অজানা ভয়ে আমাদের বুকগুলো এবার সত্যিই কেঁপে উঠলো। লেঠেল সর্দার গুটি গুটি পায়ে আমাদের সকলকে বিশাল একটা নিমগাছের তলায় দাঁড় করিয়ে জিগ্যেস করলো, দেখুন তো, নাকে কোনো গন্ধ পাচ্ছেন কি-না?”
আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম , “ধূপ ধূনোর গন্ধ!” সর্দার বড় বড় চোখ করে তাকালো আমার দিকে।
—“এই জঙ্গলের পাঁচ সাত মাইলের মধ্যে কোনো জনবসতি নাই। এবার বলুন আমাকে, এই ধূপ-
ধূনোর গন্ধটা কোথা থেকে আসছে ?”
সত্যিই ভয়ে গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠলো। কথা বলার মত অবস্থা এখন আর কারোর নাই। কিছুদূর এগোতেই সর্দার থমকে দাঁড়ালো। চাপাস্বরে বললো, “এদিকে যাওয়া ঠিক হবে না। চলুন,আমরা দীঘির ও-পাড় দিয়ে ঘুরে যাই।”
আমি বিস্ময়ে ‘কেন’ প্রশ্ন করতেই সর্দার বললো, “টর্চ জ্বালাবেন না। ভাল করে লক্ষ্য করুন। অন্ধকারেও দেখতে পাবেন। ঐ দূরের বেলগাছটার নীচে ধবধবে সাদা কাপড় পড়া একজন বামুন ঠাকুর বসে। বিস্ময়ে হতবাক হই।
–“বামুনঠাকুর!” টর্চটা বগলে ঢুকিয়ে পাকা লম্বা লাঠিটা বুকের সামনে মাটিতে দাঁড় করিয়ে হাতজোড় করে অবনতমস্তকে সর্দার বললো, “হ্যাঁ, বামুনঠাকুর, আপনারা যাকে বলেন বেহ্মদত্যি!’
এই দৃশ্য দেখে নন্দন ভিরমি খেয়ে বু-বু করতে করতে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। মহা বিপদ! চোখে মুখে জল দিয়ে নন্দনের জ্ঞান ফিরলে আমরা সোজা বাড়ীর দিকে রওনা দিই।গভীর রাতে ক্লান্ত হয়ে বাংলোয় ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নাই। হঠাৎ একটা তীব্র তীক্ষ্ণ আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। কানটা খাড়া করি। শুনতে পাই ঘরের মধ্যে কার যেন পায়চারির শব্দ। আজ পাশে নন্দন নাই। অসুস্থতার জন্যে তার আজ বিছানা জ্যাঠামশায়ের ঘরে। নিওন বাতির মৃদু আলোয় সব কিছু স্পষ্ট নয়, আবছা দেখা যাচ্ছে। উঠে বসতেই দেখি মাথার দক্ষিণদিকের গাড়ী বারান্দার দরজাটা হাট করে খোলা। হু হু করে বসন্তের মাতাল বাতাস তীরবেগে ঘরে ঢুকছে। অবাক হলাম। বেশ ভাল মনে আছে শোবার সময় সামনের এবং পিছনের দুটো দরজাই ভাল করে এঁটে শুয়েছিলাম। মশারীটা ফাঁক করে নীচে নেমে দরজাটা বন্ধ করতেই অমনি ঘরের আলোটা গেল নিভে। হয়তো লোড শেডিং। আবার শুনতে পাচ্ছি ঘরে কার চলাফেরার শব্দ। অন্ধকারে হাতড়ে বালিশের তলা থেকে টর্চটা বার করে জ্বেলে ঘরের চারদিক খাটের নীচটা ভাল করে দেখলাম। না, কোথাও কিছু নাই। নজর পড়লো দেয়ালে টাঙানো মস্ত বড় বাঁধানো ছবিটার ওপর। মধ্যবয়সী রূপবতী মহিলা। যেন জীবন্ত! ঠিক করলাম আর ঘুমাবো না। বাকী রাতটা জেগে কাটিয়ে দেবো। টেবিলে রাখা জগের জলটা ঢকঢক করে খেয়ে অনেকটা শেষ করলাম। পাওয়ার আসায় নিওন বাতিটা জ্বলে উঠলো। চুপ করে বিছানায় বসে থাকতে থাকতে চোখ দুটো ঘুমে জড়িয়ে আসছিল। শুয়ে পড়লাম। নানা উদ্ভট চিন্তায় ঘুম আসছে না। চোখ দুটো লেগেছে। একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব কিন্তু সজাগ। মশারীর একটা খসখস আওয়াজ–মনে হলো কে যেন মশারীটা তুলছে। চোখদুটো মেলতেই দেখি মশারী তুলে আমার মুখের কাছে মুখ এনে এক মহিলা একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে প্রাণপণে চিৎকার করে উঠলাম “বাঁচাও আমাকে।”
ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ। গলা থেকে কোন আওয়াজ বেরুলো না। দরদর করে গা দিয়ে ঘাম ঝরতে লাগলো। দেয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে তাকালাম। অবিকল ঐ মুখ! খাট থেকে নামতে যাবো– দেখি সারা শরীর অবশ। বহু কষ্টে দেয়াল ধরে দরজায় ছিটকিনি খুলে ভাঙা গলায় চিৎকার করে উঠলাম–“কে আছো, আমায় বাঁচাও! “
দড়াম করে একটা শব্দ হয়ে পুনরায় দখিনের দরজাটা খুলে গেল। খোলা দরজা দিয়ে উন্মত্ত একদল হাতির মত অনেকখানি ঝোড়ো বাতাস হুড়মুড়িয়ে ঢুকে গোটা ঘরটাকে লণ্ডভণ্ড করে দিলো।বাড়ীর কেয়ারটেকার ভজনলাল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে আমার চোখে মুখে জল দিতেই ধড়ে প্রাণ
এলো। প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলি, “তোমরা আমায় কোথায় শুতে দিয়েছো? “
উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ভজনলাল জিগ্যেস করে, “কি হয়েছে দাদাবাবু ?” সবিস্তারে ঘটনাটা বললে ভজনলাল
হো- হো করে হেসে উঠলো। খুব সহজভাবে বললো, “এতে ভয়ের কি আছে! যাকে দেখেছেন, উনি আমাদের গিন্নিমা। এ-বাড়ীর এই ঘরেতেই থাকেন। আজ পর্যন্ত উনি কারোর ক্ষতি করেননি।”
ভজনলালের কথা শুনে মনে হলো আমি এবার নির্ঘাত মূর্চ্ছা যাবো। সারা দুনিয়া ঘুরছে।
–বলো কি! শুনেছি গিন্নিমা–
—হ্যাঁ, মারা গেছেন। প্রায় চব্বিশ বছর আগে।
মল্লিকা দিদিমণিকে হতে গিয়েই। গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। সারা রাত ঐ অশরীরীআত্মার সাথে আমি একা এই ঘরে ছিলাম ! মনে মনে ভীষণভাবে রুষ্ট হলাম ওদের এই অবিমৃষ্যকারীতায়। আবার খুশীতে রোমাঞ্চে শিহরিতও হলাম এক অশরীরী আত্মার অবয়কে চাক্ষুষ দেখতে পেয়ে।একটু সকাল হতেই বাংলোর পরিবেশটা মনে হলো আজ যেন একটু অন্যরকম। পরিচারক পরিচারিকা থেকে শুরু করে পরিবারের প্রতিটি মানুষের চোখে মুখে যেন একটা খুশীর হিল্লোল। মাঝে মাঝে শাঁখের আওয়াজ। মনে হলো আমাকে নিয়ে আজ যেন একটু বেশী আদিখ্যেতা শুরু হয়েছে। কি কারণ বোঝা গেল না। কারণটা নন্দনকে জিগ্যেস করলে ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বুঝিয়ে দিলো সে এ-ব্যাপারে বিন্দুমাত্র জানে না।
সাতসকালে এখন আমি আর নন্দন জ্যাঠামশাই দীনবন্ধু রায়ের ড্রয়িংরুমে। তিনি আমাদের সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবেন এবং একটা সুখবর দেবেন। অধীর প্রতীক্ষায়। গতকাল রাতে লালগড়ের জঙ্গলে আমাদের অভিযানের কথা আদ্যপান্ত শুনলেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “তোমরা ভয়ংকর ঐ জায়গা থেকে নিজেদের জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছো, তাতে আমি কল্যাণময় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই।”
কথাপ্রসঙ্গে গতকাল রাতের ঘটনা সম্পর্কে জিগ্যেস করলেন, “শুনলাম তুমি নাকি গতকাল রাতে আতঙ্কে ঘুমোতে পারোনি। বাস্তবিক কি ঘটেছিল বলোতো? “
—“জ্যেঠুমণি, গতকাল সারা রাত জুড়ে অনেক ভুতুড়ে ব্যাপার একটার পর একটা ঘটেছে। সবথেকে ভয়ংকর ব্যাপার ভোররাতে যখন এক মহিলা মশারী তুলে মুখের কাছে মুখ এনে আমায় পর্য্যবেক্ষণ করছেন। আমি হলপ করে বলছি –আমি যা দেখেছি তা সঠিক। এতটুকু ভুল অথবা স্বপ্ন নয়।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় জ্যেঠুমণি বললেন, “তুমি ঠিকই বলছো, এতটুকু মিথ্যে বলোনি। শোনো তাহলে বলি—গতকাল যে মহিলাকে দেখেছো, উনি আমার স্ত্রী রাজলক্ষ্মী দেবী। চব্বিশ বছর আগে আমার কন্যা মল্লিকাকে জন্ম দিতে গিয়ে হার্ট আট্যাকে মারা যান। সেই থেকে আজ অবধি তাঁর এই বাড়ীতেই অবস্থান। বলতে পারো তাঁর কন্যার প্রতি পরম মমত্ববোধে এ-বাড়ী ছাড়তে পারেনি। বাড়ীর লোক কখনও দেখতে পেলেও আমি এবং আমার কন্যা নিয়মিত তাঁকে দেখতে পাই। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় তাঁর কথা আমরা শুনতে পাই। হয়তো এখানেও উনি আছেন। আমাদের কথা শুনছেন। সময়কালে ওনার অস্তিত্ব আমরা টের পাবো।”
চেয়ারটা টেনে নন্দন এবার আমার কাছে একটু ঘন হয়ে বসলো। মুখটা শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গেছে। জ্যাঠামশাই দীনবন্ধু রায় বলতে আরম্ভ করলেন–কাজের কথায় আসি বাবা শিবেশ। কথাটা আমার মেয়ে মল্লিকাকে নিয়ে। মল্লিকা আমার একমাত্র মেয়ে। ভবিষ্যতে আমার স্থাবর এবং অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তির সেই-ই মালিক। মামণির বিয়ের ব্যাপারে আমরা ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিলাম। প্রায় শতাধিক পাত্র দেখা হয়েছে। তাদের প্রায় সবার আমার মেয়েকে পছন্দ এবং তাদের মধ্যে অধিকাংশ আমার পছন্দ হলেও আমার স্বর্গীয়া স্ত্রীর কোনটাকেই পছন্দ হয়নি। আর আসল কথা, তাঁর পছন্দ না হলে এ-বিয়ে সম্পন্ন হবার নয়।
বড় সুখবর, আমার স্ত্রীর তোমাকে ভীষণভাবে পছন্দ হয়েছে। এতদিনে ঠাকুর মুখ তুলে চেয়েছেন। আমার পরিবারে সকাল থেকেই তাই আজ খুশীর হাওয়া। তোমারও একটা পছন্দের ব্যাপার আছে বাবা। আশা করি আমার মেয়েকে তোমার অপছন্দ হবে না। আমার মেয়ে বলে বলছি না। মেয়ে আমার অসামান্যা সুন্দরী, শিক্ষিতা, সংগীতজ্ঞা, মৃদুভাষী এবং সুরুচিসম্পন্না।”
জ্যাঠামশাই চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। আন্তরিকতার সুরে বললেন, তোমরা ব্রেকফাস্ট করে নাও। একটু
বাদেই আমার মল্লিকা মামণি এখানে আসবে। আমরা সকলে মিলে তার গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনবো।দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। এই সমস্ত কথা শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমি নন্দনের হাত দুটো ধরে বললাম, “ভাই, আর দেরী নয়। তল্পিতল্পা গোছানোই আছে। চ, এইবেলাতেই কেটে পড়ি। এই ভূতের বাড়ীতে আর এক মূহুর্ত থাকতে আমি রাজী নই।”
নন্দনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো! কপাল চাপড়িয়ে অবাক চোখে বলল, বলিস কি রে! তোর তো এখন আঙুল ফুলে কলাগাছ! রাজকন্যার সাথে অর্দ্ধেক নয়, একেবারে গোটা রাজত্ব। বোনটাকে আমার একবার চোখের দেখাই দেখ না! দেখবি, চোখ ফেরাতে পারবি না!আমরা সকলে মিলে শুনছি মল্লিকার গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত। কি সুরেলা কণ্ঠ! শুধু কণ্ঠ! কি অপরূপ রূপ! রূপের বহ্নি! রূপের আগুনে মনে হচ্ছে যেন চোখ দুটো ঝলসে যাচ্ছে। কি করে একটা নারীর এত রূপ হয়! ভাবতেই পারছি না। এ-যে শিল্পীর রং তুলি দিয়ে আঁকা ছবিকেও হার মানাবে! পোষাকে মার্জিত রুচি। চোখে-মুখে সারা শরীরে যেন একটা লক্ষ্মীশ্রী ছাপ ফুটে উঠেছে। অবাক বিস্ময়ে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি লক্ষ্মী প্রতিমা মল্লিকার দিকে। আমি খেয়ালই করিনি ঘরভর্তি কতজোড়া চোখ আমার মুখের দিকে
কতক্ষণ আমার এই বেহায়াপনার দৃশ্য উপভোগ করেছে। খেয়াল হতেই ভীষণ লজ্জিত এবং নিজেকে বিব্রতবোধ করলাম।ইতিমধ্যে সকাল গড়িয়ে দুপুর্। স্নান খাওয়া-দাওয়া সারা। আজ দুপুরেই বাড়ীর পথে আমরা রওনা দেবো। নন্দন নিজের ব্যাগ-পত্তর গোচাচ্ছে। গুটি গুটি পায়ে জ্যাঠামশায়ের ঘরের দরজায় দাঁড়াই। দেখি উনি অস্থিরভাবে পদচারণা করছেন।
–জ্যেঠুমণি!
–বাবা শিবেশ! এসো এসো। তোমরা কি বেরিয়ে পড়েছো? বলছিলাম কি, এই ভরদুপুরে না বেরিয়ে
কাল সকাল সকাল বেরুলে তো ভাল করতে! “
–আসলে আগামীকাল ইউনিভার্সিটিতে একটু জরুরী কাজ আছে, তাই—
–তাহলে তো যেতেই হবে।
পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই জ্যাঠামশাই দু’হাত তুলে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। একটু ইতস্তত: করে বিনয়ের সুরে বললেন, “বাবা শিবেশ, তোমার মতামতের ব্যাপারটা জানতে পারলাম না। যদি একটু জানাতে—“
আমি নতমস্তকে দাঁড়িয়ে থাকলে তিনি হতাশার সুরে বলে উঠলেন, “আমার মেয়েকে কি তোমার পছন্দ
হয়নি বাবা? “
আমি ভীষণভাবে অস্বস্তিতে পড়লাম। বললাম,”এ-কি বলছেন আপনি! আপনার মেয়ে সর্বগুণে গুণান্বিতা। আমি আপনার মেয়ের যোগ্য কি-না সেটা নিয়েই আমি দ্বিধায় আছি। আপনাদের স্নেহে আমি ধন্য, আপ্লুত। এই মূহুর্তে আমি নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান বলে মনে করছি। আমার এ-ব্যাপারে কোনো অমত নাই। তবে আমার মায়ের মতামতের প্রয়োজন আছে। “
আমাকে বুকে জড়িয়ে আনন্দে জ্যাঠামশাই হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন। বললেন, “বড় শান্তি পেলাম বাবা। তুমি হীরের টুকরো! তোমাকে চিনতে আমার স্ত্রীর এতটুকু ভুল হয়নি বাবা। পছন্দের ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে পেরে মনে হয় এবার আমার স্ত্রীর আত্মাও চিরশান্তি পাবে। শুভস্য শীঘ্রম। আর দেরী নয়। আমি সামনের সপ্তাহের প্রথমদিকেই কলকাতায় তোমাদের টালিগঞ্জের বাড়ীতে তোমার মায়ের সাথে দেখা করে বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করবো।”বর্ধমান স্টেশনে আমাদের পৌঁছে দেবার জন্যে গেটের সামনে গাড়ী দাঁড়িয়ে। গাড়ীতে উঠবার আগে ভেতর থেকে কিসের যেন একটা তাগিদে নন্দনকে বললাম,চ, জ্যেঠিমার ঘরে গিয়ে জ্যেঠিমার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে একটু শ্রদ্ধা জানিয়ে আসি। ঘরে ঢুকে দেয়ালে টাঙানো প্রতিকৃতির দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। যেন জীবন্ত! মায়াময়ী প্রসন্নাদৃষ্টি! ভক্তিভরে প্রণাম করতেই গোটা শরীরে আনন্দ-ভয়ে একটা শিহরণ জাগলো। মনে হলো মাথায় কার যেন মমতা-মাখানো একটা স্পর্শ, কপালে স্নেহবিগলিত স্নিগ্ধ- শীতল ছোঁয়া পেলাম। নিমেষে এক অনির্বচনীয় আনন্দে গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠলো।
গাড়ীতে উঠতেই লক্ষ্য করলাম অদূরে পরিবারের সমস্ত মানুষ একজায়গায় দাঁড়িয়ে পরম আন্তরিকতায় হাত নেড়ে জানাচ্ছে আমাদের বিদায় অভিনন্দন। মন ছুঁয়ে গেল। বড় হৃদয়গ্রাহী মনোরম দৃশ্য। সম্পূর্ণ অচেনা অজানা একটা পরিবারে কোথাকার এক অচেনা অজানা মানুষ ভূতের সন্ধানে এসে কেমন করে ঘটনাচক্রে সেই পরিবারের অত্যন্ত কাছের মানুষ–একান্ত আপন হয়ে উঠলো, তা ভাবলে সত্যিই অবাক লাগে।
গাড়ী ছুটছে স্টেশনের দিকে। হঠাৎ নন্দন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের সুরে চিৎকার করে ওঠে, “আ-রে, তোর কপালে চন্দনের ফোঁটা!”
নন্দনের দিকে মুখ ফেরাই। দেখি ওর কপালেও চন্দনের ফোঁটা। বললাম, “তোর কপালেও তো চন্দনের ফোঁটা!
নন্দন অবাক হলেও আমি বিন্দুমাত্র অবাক হলাম না। বুঝতে পারি কখন কোন সময় মঙ্গলকামিনী
মা তাঁর সন্তানদের শুভ কামনায় মস্তক স্পর্শ করে কপালে চন্দনফোঁটা পরিয়ে তাদের যাত্রাপথকে মসৃন ও নিরাপদ করেছেন। চোখ বন্ধ করে দু-হাত বুকে রাখলাম। মন থেকে মুখ দিয়ে দু’টি শব্দ বেরিয়ে এলো—মা মা-ই-ই। -
কবিতা- তনুমানসা
তনুমানসা
-মানিক দাক্ষিতঅন্ধকার অতল সমুদ্রে
আবছা কালো মেঘলা রৌদ্রে
যদিও একটা অস্পষ্ট কায়া ঘোরে;
তবুও সেটা চৈতন্যরসে সিক্ত,
তৃষ্ণার্ত চিত্তের তনুমানসা।যযাতির উপভোগে বাড়ে স্পৃহা,
অমাবস্যা নামে ক্রমে ক্রমে।
ঘূর্ণায়মান চাকায় বাঁধা জীব
অবশ্যই শিবের নীচে মুহ্যমান
নিরন্তর সুখের আশায়।দুরন্ত ভ্রমর হুমড়ি খেয়ে ওঠে;
ঠিক সেই ক্ষণে ঘি-টা তরল
আগুনের সামান্য তাপে।
তনুমানসার অস্তিত্ব বিপন্ন
চৈতন্যসত্ত্বার বিলোপের সম্ভাবনায়।ভোগের আসক্তিতে কর্মদৈত্য প্রকট;
স্বপ্নের শ্বেতহস্তী আকাশে ঘোরে।
কর্মের আলাদা সত্ত্বা পরিষ্কার দেখি
নোংরা বাতাসে বয়–
খুঁজে কি পাবো আমরা তনুমানসায়?শীর্ণতার পরিবেশে
ভোগের স্পর্শ খুঁজি হাতড়িয়ে।
সম্মুখে গভীর খাদ–
হুমড়িয়ে পড়ে যাই কিন্তু।
কী সাংঘাতিক প্রখর দৃষ্টি!প্রশান্তির প্রলেপের লোভে
রাতের অন্ধকারে অন্বেষণ চালাই
স্নিগ্ধ তনুমানসার।
চাতকটা কাঠফাটা রৌদ্রে
তাকিয়ে থাকে ঠায় আকাশপানে।কী অপরূপ দৈন্যতার বিরূপ প্রকাশ।
ভোরের আলোয় আমরা বিস্মৃত
চাহিদার আসল বিষয়।
ক্ষণিকের সুখভোগে
মত্তহস্তী শৃঙ্খলিত
বিষয়ের রঙীন কারায়।তনুমানসা অদৃশ্য
আসক্তির কুমীর দৃষ্টিতে।
বৈরাগ্য সাহস বীর্য সহজলভ্য?
কামনার আনাগোনা অবিরত–
কোথায় চেতনার পুষ্প সৌরভ?পর্বতসমান ক্রোধের মুক্তি
শরীরের রক্ত হঠাত্ মস্তকে ওঠা।
বিশাল ধূমে আবৃত অগ্নিশিখা
আচ্ছন্ন কামনার চেতনায়।
আলো তাই স্বচ্ছন্দে বাঁধা পড়ে
অন্ধকারের শক্ত গোঁজে।কি সাংঘাতিক যন্ত্রণা
জীবনের অস্থিতে পোকার কামড়ে।
নরম স্পর্শে, ঠাণ্ডা জলে
কিংবা দৈত্যের পাওয়ায়
শান্তি কি এসে যায় হাতের মুঠোয়।তনুমানসার প্রশান্তি দৃষ্টি
সাত তাড়াতাড়ি না পড়লে দক্ষযজ্ঞ।
রক্ত-মাংসাদির বিকার
আর কতদিন সওয়া যায়।
সৃষ্টির প্রয়াসে মন কিন্তু মুখর।বিষয়সম্ভোগে বিষয়প্রাপ্তি দুর্লভ।
অন্ধকারে কাল কাটা
সংখ্যার মৃত্যুই।
জীবনের আসল প্রকাশ
সূর্যের উষ্ণ তেজে।আসক্তির মৃত্যুতে শিবের মুক্তি।
ভোরের আলোতে প্রশান্তি নামে
সারা দেহ-মনে।
তনুমানসা এখন দাঁড়িয়ে
একেবারে শিবের মুখোমুখি। -
কবিতা- এবার জাগাও
এবারে জাগাও
– মানিক দাক্ষিতআবেগে মজবুত শক্ত পাথর
এখন বরফের চাঁই। সত্ত্বর
গলে হবে জল। অস্তিত্ব বিপন্ন,
শোধরাও নিজেকে, না হলে শূণ্য।ঘুমন্ত বিবেককে এবারে জাগাও..
ঠেলা দিয়ে বলো–বন্ধু, তাকাও!
নয়তো দখল নেবে মহাতস্কর,
বাঁচাটা তখন হবে নিরর্থক, দুষ্কর।প্রাণে আনন্দ এনে মুখে ফোটাও
হাসি। দু:খ হতাশাকে ওড়াও
ফুত্কারে। তখন দেখবে মনে প্রাণে
শুনতে পাবে জীবনের মানে।আঙুল ফুলে কলাগাছ? অত নয়
সোজা। ধৈর্য্য ধরো। পথ দুর্গমময়।
মগজাস্ত্রে এগিয়ে চলো সম্মুখপানে–
ঠিক উঠে যাবে উন্নতির সোপানে। -
অণু কবিতা- আমার কবিতা
আমার কবিতা
– মানিক দাক্ষিতকবিতা আমার সাতসকালের
সূর্য ওঠা ভোর।
কবিতা আমার সুষম শব্দে
বলবে কথা তোর।
কবিতা আমার ভালবাসার
মনের যাদুধন।
কবিতা আমার সুখ দু:খের
খুশীর বৃন্দাবন।
কবিতা আমার ঘোর প্রতিবাদ
বারুদ ভরা বোম।
কবিতা আমার সলতে দেওয়া
আলো জ্বালার মোম।কবিতা আমায় বাঁচিয়ে রাখে
সকাল থেকে সাঁঝ।
কবিতা আমায় বিবেক দিয়ে
করায় সকল কাজ।