• গল্প

    যে খুশি গুলো এখনও হারায়নি

    যে খুশি গুলো এখনও হারায়নি
    -শম্পা দেবনাথ 

     

    দড়িটা আঙ্গুলে পেঁচিয়ে চলেছে অন্তরা।খুব মন দিয়ে একবার বাঁ হাতে ,একবার ডানহাতে‌।মৃনাল চা নিয়ে বারান্দায় আসতেই দড়িটা লুকিয়ে ফেলে অন্তরা।মৃনালের চোখ এড়ায় না সেটা।
    “নাও,অনু চা খেয়ে নাও। আমি পুষ্প এলেই বাজারে যাব।তুমি ততক্ষণে চা খেয়ে স্নান সেরে নাও।” চায়ের কাপটা অন্তরার হাতে তুলে দেয় মৃনাল।নিজেও কাপ নিয়ে সামনের বেতের চেয়ারটায় বসে।
    পুষ্প না এলে অন্তরাকে একা রেখে বেরোনো যায় না।কখন কি করে ফেলে।আজ অন্তরা বেশি চুপ হয়ে আছে।মানসিক ব্যাধিটা বেড়েছে মনে হয়।ডাক্তারকে ফোন করতে হবে।অন্তরাকে দেখতে দেখতে ভাবে মৃনাল।এই দু বছরে কতটা বুড়িয়ে গেছে।পয়তাল্লিশের অন্তরাকে দেখলে পঞ্চান্ন মনে হয়।চুলগুলো রূপোলি রেখায় ভরে গেছে।মুখের চামড়ায় কাটাকুটি।তাতানের চলে যাওয়া ওকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে মনে ও শরীরে। অবশ্য করবে নাই বা কেন?বাইশ বছরের জলজ্যান্ত একমাত্র ছেলে যদি এভাবে চলে যায়, যেকোন মায়ের পক্ষেই তা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

    তাতান ওরফে ঋষভ রায় ক্রিকেটার হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছিল সবে।ক্রিকেটই ছিল একমাত্র ধ্যান জ্ঞান।পড়াশোনায় মাঝারি তাতান ছোট থেকেই ছটফটে, প্রাঞ্জল, হাসিখুশি।যেখানে থাকত মাতিয়ে রাখত।ঘন কালো কোকড়ানো চুলের, উজ্জ্বল ,মায়াবী চোখদুটোতে পৃথিবী জয়ের স্বপ্ন মেখে থাকত।অন্তরা,মৃনাল কোনদিনই ওর কোনও ইচ্ছের বিরোধিতা করে নি।কলেজের প্রথম বর্ষে তাতান যখন ঘোষনা করল যে ,সে ক্রিকেটটাই মন দিয়ে খেলতে চায়, তখন অন্তরা একটু মৃদু আপত্তি করেছিল শুধু।অন্ততঃ পড়াটা শেষ করুক এটা চেয়েছিল অন্তরা।মৃনাল কিন্তু ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।ছেলের দীপ্ত ,প্রতিজ্ঞাবদ্ধ চোখের দিকে মনের অদম্য ইচ্ছেটাকে উৎসাহ দিয়ে বলেছিল, “সাথে আছি, তুই এটাই কর।অন্য কিছু ভাবতে হবে না”।ধীরে ধীরে তাতানের স্বপ্ন সফল হতে শুরু করেছিল।রঞ্জিতে যেদিন সিলেক্ট হয়েছিল তাতান ,সেদিন রায় বাড়িতে উৎসবের আমেজ।পাড়ার সবাইকে মিস্টি খাইয়েছিল মৃনাল।
    নিয়তি বোধহয় অলক্ষ্যে হেসেছিল।এত সুখ সহ‍্য হল না কারোই।রঞ্জিতে খেলতে যাওয়ার পাঁচদিন আগে কিছু বন্ধুদের সাথে আ্যকোয়াটিকা যাবার পথে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ডিভাইডারে ধাক্কা মারে।সবাই কম বেশি চোট পায়।তাতান দরজা খুলে ছিটকে ল্যাম্পপোস্টের ওপর আছড়ে পড়ে।বা পা টুকরো টুকরো হয়ে যায়।একমাস হাসপাতালে থেকে ক্ল্যাচ নিয়ে যখন ঘরে ফেরে তখন আগের সেই তাতান আর নেই।রোগা,কালশিটে পড়া চোখে আলো নেই।অন্তরা ছেলে বেচেঁ ফিরেছে তাতেই খুশি।তাতানকে সবাই খুব উৎসাহ দিতে থাকে।কিছুদিন পর সমস্যা শুরু হয় আবার।তাতানের ওই পা আবার ফুলতে শুরু করে।আবার ডাক্তার, অন্য হাসপাতাল।মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে যখন ডাক্তাররা বলে দেন,তাতানের পা মারাত্মক ভাবে জখম হয়েছে।সারাজীবন ওকে স্টিকের সাহায্যে হাঁটতে হবে।আরও একমাস হাসপাতালে থেকে ফিরে তাতানের কথা বলাই কম হয়ে যায়।ও বুঝতে পারে, যে জীবনে আর কখনও ক্রিকেট ব্যাট হাতে ধরা যাবে না।স্বপ্ন ও বাস্তব অর্থহীন হয়ে যায় ওর কাছে।এর ঠিক তিনমাসের মাথায় এক অসমাপ্ত রাতে সিলিং ফ্যানে দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়ে তাতান।

    বাঘাযতীনের এই ফ্ল্যাটে মৃনালরা অনেক দিনের বাসিন্দা।তাতানের যখন চার বছর তখন থেকেই এখানে বসবাস।যাদবপুর বিদ্যাপীঠে তাতানকে পৌঁছে একটু হেঁটে সেলিমপুর ব্রিজের নীচে মৃনাল ও তার বন্ধুরা বুধুয়ার চায়ের দোকানে মর্নিং ওয়াক সেরে জমা হত।ছাপড়া থেকে সেই কিশোর বয়সে বুধুয়া তার দেশোয়ালি চাচার সাথে এই শহরে এসেছিল ভাগ্য অন্বেষণে।নানান জায়গা ,নানা রুজির পথ পেরিয়ে শেষে এই চায়ের দোকান খোলে বুধুয়ার চাচা।বুধুয়া দেখতে দেখতে মৃনালদের সামনেই যুবক হল।বিয়ে করল।এখন সে দুই সন্তানের পিতা।একটি দশ বছরের মেয়ে ও একটি দুবছরের ছেলে।বেশ ভালো চলে বুধুয়ার দোকান।চা,ডিমটোস্ট এর পাশাপাশি সিগারেট, গুটখা,চিপস,টুকটাক স্টেশনারি জিনিস সবই তার ছোট্ট দোকানে ঠাঁই পেয়েছে।বিকেলে চাএর সাথে হাতরুটি,তড়কা,ডিমকষা,ঘুঘনিও বিক্রি করে।মৃনালরা টানা তের -চোদ্দ বছর এই দোকানে আড্ডা দেয়।আগে সকালে দিত।এখন বিকেলে বসে।বুধুয়ার বৌ পদ্মা ,বুধুয়াকে দোকানের কাজে সাহায্য করে। ছেলে,মেয়ে দুটোও বিকেলে দোকানেই থাকে।মৃনালদের সাথে ওদের সম্পর্কটাও বেশ সহজ।তাতান চলে যাবার পর ছমাস পর বুধুয়ার ছেলেটা হল।মৃনালের একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয় বাচ্চাটাকে দেখলে।মৃনাল ওকে তোজো বলে ডাকে।ওর দেওয়া নামটাই রয়ে যায়।

    তোজোর খুব জ্বর।পিজিতে ভর্তি।পদ্মা ছেলের সাথেই আছে।সাতদিন হল।একটু ভালোর দিকে তোজো। বুধুয়া হাসপাতালের দিকে রওয়ানা দেয়।আজ ছুটি দেবে তোজোকে।হাসপাতালের সামনের রাস্তাটা পার হতে যাবে বুধুয়া এমন সময় একটা বাস হাজরার দিকে দূ্রন্ত গতিতে ছুটে যায়।পিষে দিয়ে যায় বুধূয়াকে।তোজোকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে একাকী পদ্মা,কিন্তু জীবন্মৃত।জীবনের গতি থেমে যায় সহসাই‌।অবস্থা চরমে ওঠেকিছুদিন পর, যখন পদ্মা ব্রেইন স্ট্রোক এ আক্রান্ত হয়।দুটো ছেলে মেয়ে অথই জলে পড়ে।বুধুয়ার ভাই ,ভাইয়ের বৌ আসে পরিস্থিতি সামাল দিতে।চায়ের দোকান বন্ধ।পদ্মার চিকিৎসা সামাল দিতে নাজেহাল অবস্থা।মৃনাল ও তার বন্ধুরা এই সময় খুব সাহায্য করে।পাড়ার ক্লাব থেকে চাঁদা তুলে কোনরকমে চলছিল।বুধুয়ার মেয়ে পূজা ইস্কুল বন্ধ করে ছোট ভাই ,মায়ের দেখাশুনা করতে লাগল। পদ্মা বেচেঁ ছিল ছমাস।

    মৃনাল আজ নতুন উদ্যমে ঘর সাজাচ্ছে। ভাবছে,ঈশ্বর বুঝি তাদের আবার জড়ভরত জীবন থেকে মুক্তি দিতে চলেছেন।অন্তরা কিছুই বুঝতে পারছে না মৃনালের এই উৎসাহ ,উদ্দীপনা কেন।অন্তরাকে মৃনাল জোর করে রান্নাঘরে ঢুকিয়েছে।সামনে দাঁড়িয়ে রান্না করিয়েছে।”পুষ্প,বৌদিকে দেখো,আমি একঘন্টার মধ্যে আসব” বলে বেরিয়ে গেল মৃনাল।
    ঠিক একঘন্টা পড়ে পূজা আর তোজোকে নিয়ে ঘরে ঢোকে মৃনাল।তোজোকে অন্তরার কোলে দিয়ে বলে, ” অন্তরা এই নাও তোমার তাতান।ও ফিরে এসেছে দেখ।”

    আজ তোজোর পাঁচ বছরের জন্মদিন।অন্তরা নিজে হাতে সব রান্না করেছে। পূজা এবার সেভেনে উঠবে।সামনের মাসেই ফাইনাল।সেও খুব ব্যস্ত ভাইকে নিয়ে।যদিও মামনি খালি পড়তে বলছে।আজকের দিনটা পূজা অন্তরাকে বলে ম্যানেজ করেছে। বলেছে,”মামনি, কাল দশ ঘন্টা পড়ব।আজ একটু মজা করতে দাও।” অন্তরা ছদ্মপ্রশ্রয়ে মৃদু বকুনি লাগায়। বিকেলে অতিথিরা আসবেন। অন্তরার ছোটাছুটির অন্ত নেই।
    মৃনাল পূজা ও তোজোকে দত্তক নিয়েছিল।বুধুয়ার ভাই সানন্দে রাজি হয়ে গিয়েছিল এই প্রস্তাবে।অন্তরাকে বাঁচাতে এবং নিজেদের ভাঙাচোরা জীবনটাকে ঠিক করতে বন্ধুদের পরামর্শ মেনে নিয়েছিল মৃনাল।বাচ্চা দুটিও সঠিক আস্তানা খুঁজে পেয়েছিল।

    একফাঁকে মৃনাল ডাকে অন্তরাকে।
    “ছেলে,মেয়ের জন্য তো আমাকে ভুলেই গেছ।ওদের জন্য নতুন এত জামাকাপড় কিনলে। নিজের জন্য কিছু কিনেছ?” মৃনাল অন্তরার হাতে একটা প্যাকেট তুলে দেয়।
    “এটা কি”? অন্তরা অবাক হয়।কপালে লেগে থাকা সুখ বিন্দু গুলো আঁচলে মেখে রাখে।
    প্যাকেট থেকে মৃনাল নীল জামদানিটা বার করে অন্তরাকে জড়িয়ে দেয়।
    “এটা আজ পরবে। এই রঙটা তোমায় খুব মানায়।”
    অন্তরা মৃনালের হাতটা আকড়েঁ ধরে।খুশি ছড়িয়ে পড়ে বাঘাযতীনের তিন কামরার ফ্ল্যাটে।

  • কবিতা

    বাবা

    বাবা
    -শম্পা দেবনাথ

     

    তোমায় খুঁজি চায়ের টেবিলে,
    তোমায় খুঁজি ঘরের কোণে,
    বারান্দার একলা ইজিচেয়ারটায়,
    বাগানে রঙ্গীন ফুলের জলসায়।

     

    বাজারে মাছ কেনার ছলে-
    জ্যান্ত একটা মাগুর নিয়ে এলে,
    কাঁচের জারটা আজও তেমনিই আছে-
    শুধু তুমি নেই কোথাও ধারে কাছে।

     

    রবিবারের গল্প বলা দুপুর,
    কাটে আজ একান্ত সংগোপনে,
    হয়ত কোথাও ছোট্টটি হয়ে,
    গল্প শুনছো অবাক চোখে চেয়ে।

     

    সন্ধ্যাতারা তুমিই তো চিনিয়েছিলে,
    রূপকথারা ওখানেই জন্মেছিল,
    আমার জানালা ভরা অসীম আকাশ,
    তোমার সাথেই ছুটিতে গেল।

     

    খুব ইচ্ছে করে আবার তোমায় দেখি,
    ঘোড়া তুমি, সওয়ারী হয়েছি আমি,
    অভিমান ভরা আমার চোখের তারায়,
    হাত বাড়িয়ে বলছ,আয় খুকু আয়।

  • গল্প

    বঙ্কুবাবুর বিয়ে

    বঙ্কুবাবুর বিয়ে
    -শম্পা দেবনাথ

     

     

    রবিবারের খবরের কাগজ লুকিয়েও কোনো লাভ হয়নি। পাশের বাড়ির রীমার কাছ থেকে চেয়ে আনেন বঙ্কুবাবু। এমন দুবার হওয়ার পর তীর্থ আর খবরের কাগজ লুকোয় না। এই দুজনের পরিচয়টা দেওয়া যাক। এরা দাদু ও নাতি। বঙ্কুবাবুর নাতি তীর্থ ওরফে তীর্থঙ্কর বিশ্বাস। বন্ধুরা টিবি বলে ডাকে। বাগবাজারের বাসিন্দা বঙ্কুবাবুর বয়স ছিয়াত্তর। বয়সের অনুপাতে যথেষ্ট শক্ত ,সমর্থ।এখনও চুলে নিয়মিত কলপ করেন। জিনস পরেন‌ সাথে লাল , নীল , সবুজ রঙের টি শার্ট। তর্জনী ও মধ‍্যমাতে সেতুবন্ধন করে থাকে গোল্ড ফ্লেক। বেশ নেচে নেচে , গোড়ালি না ফেলে হাঁটেন। মাঝে মধ্যে এদিক ওদিক রে ব্যান সানগ্লাসের ফাঁক দিয়ে ভ্রু কুঁচকে কি যেন জরিপ করেন। তীর্থ দাদু , ও সরি দাদু বলা যাবে না আবার , দাদাই এর সাথে বেরোতে যত না লজ্জা পায় , বঙ্কুবাবু তার থেকে বেশি লজ্জা পান। বলেন , “কি যে ম্যাড়মেড়ে সাতচল্লিশ সালের বিধবাদের মত জামাকাপড় পড়িস। তোকে নিয়ে চলতেও কেমন যেন ডাউন ফিল হয়। একটু ‘কুল ‘ জামাকাপড় পড় , বুঝলি ঢ্যাড়স ।”
    তীর্থ লুকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বন্ধুদের দাদুর সাথে তুলনা করে। তবে তীর্থর বন্ধুরা খুব উপভোগ করে ব্যপারটা। “হাই হ্যান্ডসাম” বলে ডাক দেয়। আড়ালে “রকিং বুড়ো” বলে। তীর্থ তেত্রিশ বছরের যুবক। সরকারী চাকরি করে। বাড়িতে বিয়ের চাপ সহ‍্য করে চলেছে। এই নিয়ে অশান্তি চরম হওয়াতে একবার বদলির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেই থেকে কেউ কিছু বলে না।

    বাড়িতে আরো একটি নিরীহ প্রানী আছে। আসুন , পরিচয় করিয়ে দি। তমা বিশ্বাস। তীর্থর মা।
    তীর্থর বাবা নেই। তীর্থ যখন খুব ছোট , বছর দশেক এর , কার্ডিয়াক ফেলিওর এ চলে যান। তমা এমনিতেই শান্ত , মুখচোরা স্বভাবের মানুষ। স্বামী মারা যাবার পর আরো চুপচাপ হয়ে যান। ইদানীং পুজোর ধুম বেড়েছে। সপ্তাহে পাঁচ দিন , পনের রকম দেব -দেবীর পুজো করে। বিভিন্ন ভাষায় মন্ত্র পাঠ করা শিখছে। কিছু দিন আগেও সপ্তাহে চারদিন উপোস করা শুরু করেছিল। বঙ্কুবাবু এবং তীর্থ দুদিন অনশন ঘোষণা করে ব্যপারটা বন্ধ করিয়েছে। সেই থেকে মুখ চুন করে ঘুরে বেড়ায়। যেন বিরাট পাপ করে ফেলেছে। তার বন্ধুদের সবার ছেলে মেয়েদের বিয়ে হয়ে নাতি নাতনি হয়ে গেছে। ছেলের বিয়েতে অরুচি দেখে চিন্তা হয়। তার প্রদীপের শেষ সলতে তীর্থ। খুবই দুশ্চিন্তায় আছে সে।

    খবরের কাগজের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কেন তীর্থ লুকোয় ? বঙ্কুবাবু ঠিক করেছেন , বিয়ে করবেন। তাই বিজ্ঞাপন দেখা চলছে। অল্পবয়সী মেয়ে চাই। পঁচিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ। বিজ্ঞাপনটা তীর্থকে দিয়েই লিখিয়েছেন। ” শিক্ষিতা, মিশুকে , চাইনিজ খাবার রান্না জানা , চুলে রঙ করতে জানা , অনর্গল বকবক করা মেয়ে চাই। চাকুরীরতা চলিবে।” পাড়ায়ও বলে বেড়াচ্ছেন।
    অনেক ছবি, বায়োডাটা সমেত এসেছে। দিন রাত ঝুঁকে পড়ে মন দিয়ে সাজাচ্ছেন বঙ্কুবাবু। সবই পঁচিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে মেয়ে। তমার তো মাথায় হাত। শ্বশুরকে পিতা জ্ঞানে মানে। কিছু বলতেও পারছে না , আবার গিলতেও পারছে না। পিওন আসার সময়টা পুজোর ঘরে ঢুকে বসে থাকে।নিতে পারে না ব্যপারটা মনে হয়। ছেলেকে বলেছে ঘটনাটা। তীর্থ বুঝতে পারছে না কি করবে। একবার বলতে গিয়েছিল দাদুকে। বঙ্কুবাবুর যুক্তি হল , ” তুই বিয়ে করবি না , ঠিক আছে। আমাকে বাঁধা দেওয়ার তুই কে হে হরিদাস । ইটস মাই লাইফ, আফটার অল।” সত্যিই কিছু বলার নেই।

    এক শনিবার বঙ্কুবাবু ঘোষণা করলেন , তিনি মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছেন। মেয়েটির নাম শ্রীরাধা। একটি স্কুলে পড়ায়। বয়স আঠাশ। বাবা ও মেয়ে থাকেন। বাবা তিনবছর পর রিটায়ার করবেন।
    তীর্থ দুবার বিষম খেল কথাটা শুনে। তমা , ঠাকুর ঘরে ঢুকে পড়ল।
    পরদিন রবিবার তীর্থর ছুটি। বঙ্কুবাবু বললেন , ” আমি আজ মেয়ে দেখতে যাব । তুই আমার গার্জেন হিসাবে যাবি। তোর নতুন ঠাকুমা আসবে , দেখে শুনে নে।”
    তীর্থ না যাওয়ার অনেক বাহানা দিল। ধোপে টিকল না। অগত্যা বিকেলে শ্রীরাধাদের বাড়ি যাওয়া হল। সারা রাস্তা বঙ্কুবাবু শ্রীরাধাকে নিয়ে কত গল্প জুড়ে দিলেন। তীর্থর কোনটাই কানে গেল না। রাগে গা কিরকির করতে শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে।
    বেল বাজাতে শ্রীরাধাই দরজা খুলে দিল। বঙ্কুবাবু তীর্থর সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন। তীর্থ অবাক হয়ে গেল শ্রীরাধাকে দেখে। অপূর্ব সুন্দর মুখশ্রী , গমরঙা ত্বক , কাঁধ অব্দি চুল। ভীষণই স্মার্ট একটি মেয়ে। একটু পরেই শ্রীরাধার বাবা সুশান্তবাবু এলেন। ওদের দেখে খুব খুশি। শ্রীরাধা বেশ হাসিখুশি। খুব গল্প ,আড্ডা জমে উঠল। তীর্থ আড়চোখে শ্রীরাধাকে দেখতে লাগল। সে ভেবেই পাচ্ছে না , এত সুন্দর ,অল্পবয়সী একটা মেয়ে তার দাদুর মত একজন বয়স্ক মানুষকে কেন বিয়ে করবে! যাইহোক, কিছুক্ষণ ওখানে থেকে ওরা বাইরে চলে এল। বিয়ে নিয়ে কোনো কথাই উঠল না। বঙ্কুবাবুকে জিজ্ঞাসা করতে বললেন, ” ও নিয়ে তুই ভাবিস না। আমাদের আগেই ফোনে সব কথা হয়ে গেছে। ”

    বঙ্কুবাবুর বিয়ের দিন ফাইনাল। দুমাস বাকি। তীর্থর নতুন কাজ পড়েছে। প্রায় প্রতি শনিবার বা রবিবার বঙ্কুবাবু তার হবু বৌকে কিছু না কিছু উপহার পাঠান। তাও আবার তীর্থর হাত দিয়ে। তীর্থ অবাক হয়ে যায় শ্রীরাধাকে দেখে। কোনও অস্বস্তি নেই। হাসিমুখে সব নেয়। তীর্থকে চা খাওয়ায়। অনর্গল গল্প করে যায়। তীর্থকে ছাদে নিয়ে নিজের হাতে করা ফুলের বাগান দেখায়। তীর্থ লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে দেখে । তীর্থরও আজকাল বেশ ভালো লাগে শ্রীরাধার সাথে সময় কাটাতে। তীর্থ একটু কম কথা বলা মানুষ। ভীষণ পড়াশোনা করে। বন্ধুদের সাথে যদিও ভালোই মেশে। কিন্তু ঘরে কথা কম বলে। শ্রীরাধা কথা বলে যায় , কত গল্প যে ওর জানা তার ইয়ত্তা নেই। তীর্থ মন দিয়ে শোনে। একে ঠাকুমা ভাবতে হবে ভাবলেই বুকটা কেমন করে যেন। এমন আগে কখনও হয় নি।

    এদিকে বঙ্কুবাবু বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন। চল্লিশ দিন বাকি। মহা উৎসাহে লেগে পড়েছেন। তমা একবার ওনার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল , কিছু বলবে বলে। বঙ্কুবাবু বুঝতে পেরে “যব প্যার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া… প্যার কিয়া কোই চোরি নেহি কি…” গানটা জোরে চালিয়ে দিলেন। ঘর ভর্তি বিয়ের তত্ব এনে রেখেছেন। তমা আঁচল মুখে চেপে ধরে চলে গেল।

    তীর্থর ওপর দায়িত্ব পড়েছে শ্রীরাধাকে নিয়ে শপিং করানোর। তীর্থ আজকাল কারণে , অকারণে শ্রীরাধাকে ফোন করে। শ্রীরাধা বিয়ে ছাড়া অন্য সব কিছু নিয়ে গল্প করে। একবার সাহস করে জিজ্ঞাসা করেছিল তীর্থ। শ্রীরাধা বলেছে , ” আপনার দাদুকে আমার ভীষণ সুইট লাগে। কত খেয়াল রাখেন আমার। আর এই বয়সী বিয়ে করলে কত লাভ জানেন ?”
    ” কি লাভ ? তীর্থ উৎসুক।
    ” আমাকে ছাড়া অন্য কিছু ভাববেন না আমার হাজব্যান্ড । দুই . যা বলব তাই শুনবেন। তিন . নিখাদ ভালবাসা পাব। চার . আমি চাকরি করি। উনি রিটায়ার্ড। ঘরের দেখভাল করবেন। পাঁচ . স্কুল থেকে এলে চা টা দেবেন ,নিশ্চয়ই। ছয় . যত্ন করবেন। সাত. বয়সে বড় বলে কখনও ঝগড়া করবেন না।
    এমন আরো অনেক ফায়দা আছে , বুঝলেন তীর্থ? ”
    তীর্থ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন রেখে দেয়। কেউ যদি সুইসাইড করতে নাছোড়বান্দা হয় তাকে কোন্ ইয়ে আটকাবে। তবুও মনটা কেন যে খচখচ করে। এত সুন্দর কথা বলে শ্রীরাধা। হাসলে বাম গালে টোল পড়ে। থুতনিতে একটা লাল তিল আছে। দাদুর ওপর খুব রাগ হয় তীর্থর। কেউ এমন করে ? আজকাল বন্ধুদের সাথে আড্ডায় যায় না ও। পাড়ায় ফিসফিস, কানাঘুষো শুনতে পায়। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে‌। শ্রীরাধা বিয়ের পর এ বাড়ি এলে ও কোথাও চলে যাবে। বন্ধুদের মেসে গিয়ে থাকবে। এখানে কদাপি নয়। সহ‍্য করতে পারবে না ও। মনটা কেন যে উদাস হয়ে যায় ! আজকাল স্যাড সঙ গুলো খুব শোনে তীর্থ। দাদাইটা র্নিলজ্বের মত প্রেমের গান শুনছে। কোনো গায়ক -গায়িকা বাদ দিচ্ছে না। তীর্থ থাকলে একটু জোরেই শোনে মনে হয়। বিটকেল বুড়ো একটা। রাগ উঠে যায়। মায়ের জন্য কিছু বলতে পারে না।

    দেখতে দেখতে দিনটা চলে এল। কাল বিয়ে। রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হবে। সই -সাবুদ হয়ে গেলে পুরোহিত কিছু নিয়মকানুন করিয়ে দেবেন। সারারাত জানলা দিয়ে আকাশ দেখল তীর্থ‌। ঘুমই এল না। ভোরের দিকে মায়ের কাছে গিয়ে শুয়ে পড়ল। তমাও একটু আশ্চর্য হল, ছেলের এমন আচরণে।
    একটা হল বুক করা হয়েছে। সেখানেই সবাই পৌঁছে যাবে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে। দাদাইএর কয়েকজন বন্ধু আসবে। তীর্থকে বলেছিলেন বঙ্কুবাবু ওর বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করতে। তীর্থ বলে দিয়েছে , ওর কোনও বন্ধু নেই। তমা তো এমনিতেই সাতে পাঁচে থাকে না। এক দাদা আছে। দেশের বাইরে থাকে। ওরও কেউ আসার নেই। আর এই বিয়ে ঠিক হওয়ার পর তমা মন্দিরে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। অনেকেই হাসাহাসি করে। হাজার প্রশ্ন। তীর্যক মন্তব্য। কত সহ‍্য করা যায়?

    সকাল থেকে তীর্থ কিছু খায়নি। ভালো লাগছে না কিছু। মাথা ভার। শরীরটা কেমন যেন লাগছে। একটা জমা কষ্ট বুকে। দুটো রজনীগন্ধার মালা নিয়ে সূর্যোভবনে তমাকে নিয়ে হাজির হল সাতটা দশে। শ্রীরাধাকে গোলাপি বেনারসিতে অপূর্ব লাগছে‌। চোখ সরাতে পারছে না তীর্থ। বঙ্কুবাবু বিউটি পার্লার গেছেন। ওখান থেকে সোজা আসবেন। শ্রীরাধা ও সুশান্ত বাবু এসে গেছেন। ওদের সাথে কিছু আত্মীয় , বন্ধু এসেছেন। রেজিস্টার এখনো আসেন নি। পুরোহিত সব কিছু রেডি করে বসে আছেন। লগ্ন আটটা থেকে নটা। শ্রীরাধা কথায় কথায় বলেছিল যে , ও এসব ধর্মীয় আচার বেশ মানে। আটটা বেজে গেল। বঙ্কুবাবুর পাত্তা নেই। শ্রীরাধা খুব উতলা হয়ে পড়েছে। তীর্থকে বারবার তাড়া দিচ্ছে বঙ্কুবাবু কোথায় দেখার জন্য। তীর্থ ফোন করেছিল দাদাইকে। একবার পেয়েছিল। বঙ্কুবাবু বলেছেন , আসছেন। কিন্তু এখন ফোন সুইচ অফ বলছে । সাড়ে আটটা বেজে গেছে। শ্রীরাধা বলছে , নটার মধ্যে বিয়েতে বসতেই হবে। লগ্নভ্রষ্ট্রা হতে পারবে না। তাহলে সুইসাইড করবে। পৌনে নটা বাজে। তীর্থ ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। শ্রীরাধার কথা ভাবছে।কি করবে সে। রাগ হচ্ছে খুব দাদাইএর ওপর। বুড়ো গেছে সাজতে, ভীমরতি। সুশান্ত বাবুও এদিক ওদিক পায়চারী করছেন। নটা বাজতে পাঁচ। বঙ্কুবাবু আসেন নি এখনো। শ্রীরাধা তীর্থকে গভীর দৃষ্টিতে দেখল। তীর্থ একমুহূর্ত আর সময় নষ্ট করল না। চেয়ার থেকে হাত ধরে শ্রীরাধাকে টেনে তুলল। মাকে অন্য হাতে ধরে সোজা পুরোহিতের কাছে এসে দাঁড়াল। সুশান্ত বাবুও এগিয়ে এলেন।
    ” আমায় বিয়ে করবেন শ্রীরাধা ? আমি আপনার যোগ্য কিনা জানি না। কিন্তু আপনাকে আমি বিয়ে করতে চাই। ” তীর্থ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলে।
    শ্রীরাধা মৃদু হেসে সম্মতি দেয়। উপস্থিত সবাই হাততালি দিয়ে ওঠে। পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারনের মধ্যে সংক্ষেপে তীর্থ ও শ্রীরাধার বিবাহ সম্পন্ন হয়। সুশান্ত বাবু কাকে যেন ফোন করে আসতে বলেন। তীর্থ ও শ্রীরাধা সবার আশীর্বাদ নেয়। এমন সময় হই হই করতে করতে চার-পাঁচ জন বন্ধু নিয়ে ঢোকেন বঙ্কুবাবু।
    ” কি রে ঢ্যাড়স , বিয়ে করে নিলি আমায় ফেলে ?”
    ” তুমি কোথায় ছিলে ? আমি কি করব। শ্রীরাধা লগ্নভ্রষ্ট্রা হবে বলে ভয় পাচ্ছিল। তুমি যদি বল তাহলে আমি বিয়ে ক্যানসেল করে দি। তুমি করে নাও।” তীর্থ কাঁচুমাচু মুখ করে বলে।
    সুশান্ত বাবু , বঙ্কুবাবু ও শ্রীরাধা খুব হাসতে থাকে।
    ” আরে সাধে কি তোকে ঢ্যাড়স বলি। বই পড়ে পড়ে তোর বাস্তব বুদ্ধিটাই হল না। এটা তো আমাদের প্রি প্ল্যান ছিল। তুমি সোজা নাক ধরবে না। তাই ঘুরিয়ে ধরালাম। বুঝলে চাঁদু। শ্রীরাধাকে দেখে তো প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলি। ” বঙ্কুবাবু হো হো করে হেসে ওঠেন।
    ” কিন্তু বাবা , আপনি আমায় তো বলতে পারতেন।” তমা ভীষণই অবাক।
    ” তোমায় বললে তীর্থ জেনে যেত বৌমা । মিশন সাকসেস হত না।” বঙ্কুবাবু সান্ত্বনা দেয় তমাকে।

    তীর্থ আজ তার জীবনে অনেকগুলো মানুষের অবদানের কথা ভাবছে। বিশেষ করে ,দাদাইএর কথা। বাবা বেঁচে থাকলেও এভাবে তীর্থকে নিয়ে ভাবত কিনা জানা নেই। কি অদ্ভুত মানুষ দাদাই।
    “আচ্ছা , আপনি খুশি তো ? ” বাসর রাতে তীর্থ তার জীবনসঙ্গীকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করে।
    শ্রীরাধা হাসে। বলে ,” আপনার দাদুর সাথে মিলেই এটা করেছি আমরা। পছন্দ তো ছিলই আপনাকে।”
    বাইরে একটু একটু করে আলোর প্রকাশ হচ্ছে। তীর্থ ও শ্রীরাধা বারান্দায় এসে সূর্যোদয় দেখতে থাকে‌। তীর্থ অবাক হয়ে তার নতুন বউকে দেখে। শ্রীরাধার আলো ঝলমলে মুখটা আজ নতুন ভাবে দেখা সূর্যের মত মনে হচ্ছে।।

  • কবিতা

    রাত .. যখন যেমন

    রাত .. যখন যেমন
    -শম্পা দেবনাথ

     

    অপেক্ষার রাতগুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় –
    এক আকাশ বিষাদ ধীরে ধীরে চৌকাঠ ডিঙ্গোয় ,
    রাত পেঁচাদের ক্লান্ত ডাক ফিরে গেছে সেই কখন,
    সপ্ততারার ভিড়ে একটি ছোট তারার উপস্থিতি চোখে পড়ে না তেমন আর,
    ভালবাসি বলতে সহস্রযুগ কেটে যায়,
    পড়ে থাকে কিছু ছেড়া পুঁতি,ভাঙা একতারা,আর কিছু হারানো সময়।
    উচুঁ ডালটা জোর করে নামিয়ে ফুল পাড়া হলে –
    ছেড়ে দিলেও তেমন কি সোজা দাঁড়ায় !
    ঘাসপথ পেরিয়ে পিছনে তাকালে, দূর্বা বোবা চোখে চায় ;
    ঢিল ছুঁড়ে তরঙ্গ তোলার খেলায় মাতলে,
    ‎জলের কান্না শোনা যায় একটু কান পাতলে,
    ‎অবুঝ বসন্ত সোনা রোদ্দুরে ধুলো মাখে,
    ‎নাছোড় শিমুলের ওড়াউড়ি চোখে লাগে,
    ‎সরল যখন জটিল থেকে জটিলতর হয়–
    ‎অনুভূতিগলোও হালকা হতে হতে একদিন ফিকে হয়ে যায়,
    ‎অপেক্ষার রাতগুলো তখন দীর্ঘতর থেকে দীর্ঘতম হয়।

  • গল্প

    বকুলকথা

    বকুলকথা
    -শম্পা দেবনাথ

     


    সকাল থেকেই পরমার মেজাজ সপ্তমে।আমি আর মেয়ে রীতিমতো ভয়ে ভয়ে আছি।আজ রবিবার।গতকাল থেকে আমাদের বাড়ির কাজে পরমাকে সাহায্য করা মহিলাটি আসছে না।ওর নাম বকুল।এমনিতে সপ্তাহে একদিন, মাসে চারদিন ওর ছুটি থাকে।গতকাল বিকেলে খবর পাঠিয়েছে যে ,শরীর ভালো না।তাই মঙ্গলবারের আগে আসতে পারবে না।পাড়াটা মোটামুটি বকুল আর বকুলের দুই মেয়ের দখলে।বেশ মেজাজী।রানীগঞ্জের মত ছোট্ট শহরে ঘরের কাজে সাহায্য করার লোকের খুব অভাব।পরমা মানে আমার স্ত্রী, লোক ছাড়া এক মুহূর্ত চলতে পারে না।আজ বাইরে থেকে খাবার আনাব ভেবেছি।টাকার শ্রাদ্ধ হয় হোক্, কিন্তু গৃহ শান্তি বজায় থাকুক।নেহা মানে মেয়েকে বলেছি বেশী মায়ের কাছে না যেতে।বাড়ির পরিবেশ বেশ গম্ভীর।আমি কাল ভাবছি একটা সি.এল মেরে দেব।হাতে হাতে একটু সাহায্য করে দিলে বউ কিছুটা শান্ত থাকবে।সময়মতো তাহলে চা পেয়ে যাব আশাকরি।একটু লেখালেখির ঝোঁক আছে।তার জন্য মাঝেমধ্যে চায়ের জন্য পরমাকে যথেষ্ট তোয়াজ করে চলি।

    বকুলের দুই মেয়ে।রঞ্জনা আর চন্দনা। রঞ্জনা বড়।বিয়ে হয়েছিল।একটা মেয়েও আছে।স্বামী তিনবছর পর অন্য মহিলার সাথে থাকতে শুরু করায় ,বিস্তর ঝগড়াঝাটি ,মারপিট করার পর রঞ্জনা নিজেই বাড়ি ছেড়ে চলে আসে। বকুল কখনও সখনও নাতনীকে নিয়ে কাজে আসে ।তিনবছরের মিষ্টি একটা ছোট্ট মেয়ে , ঝিমলি।পরমা কেন জানি ভীষণ বিরক্ত হয়।জিজ্ঞাসা করেছিলাম একদিন।বলল, ” ও এলে বকুল কাজে ফাঁকি দেয় বড্ড। তার ওপর নেহাকে খেতে দিলে তাকিয়ে থাকে।ভালো লাগে না এসব আমার “।
    আমি অবাক হয়ে বলি ,” তা ঐটুকু একটা বাচ্চা ,ওকেও তো দিতে পারো।কি হয় দিলে ?”
    ” দি তো।অন্য বাড়ি বাইরে বসিয়ে রাখে দেখ গিয়ে।বকুল ইচ্ছে করে খাওয়ার সময় নিয়ে আসে”।
    পরমার এমন ছোট ভাবনায় আমার কষ্ট হয়।
    অথচ বিয়ের পর দেখেছি ছোটখাটো কারণে ওর চোখে জল আসত।আমাদের বাড়িতে একটা পোষা বেড়াল ছিল, মিনি।বয়স হয়েছিল।পরমা প্রথমে ওটাকে পছন্দ করত না।কিন্তু মিনির সাথে ভাব হয়ে যায়।মিনি একবার অসুস্থ হলে পরমা দিন রাত ভুলে ওর সেবা করেছে।পরে যখন মিনি মারা যায় ,পরমা দুদিন খায়নি।কি কান্না তার। এ পরমাকে আমি আগের সাথে ঠিক মেলাতে পারি না।ওর ঐ নরম মনটা কোথায় হারিয়ে গেল ,ভাবি।

    এইভাবেই চলছিল বেশ।আমি ব্যস্ত আমার কাজ আর লেখালেখি নিয়ে।পরমা ব্যস্ত তার সংসারের খুঁটিনাটি নিয়ে।যদিও আমি সাধারণতঃ কোনও ব্যাপারে নাক গলাই না। পরমার হাতে টাকা দিয়ে হাত তুলে দি।পরমাই সব করে।তাই খরচ নিয়ে কথা বলা আমার সাজে না।এরমধ্যে একদিন দেখি বকুলের জায়গায় রঞ্জনা এসে কাজ করছে। পরপর তিন-চারদিন হয়ে গেল।কৌতূহলবশতঃ স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করাতে বলল,বকুল অসুস্থ।তাই রঞ্জনাই সামলাচ্ছে।যাক, আমার টেনশন কমল।বকুল এটা বুদ্ধিমতীর মতো কাজ করেছে মেয়েকে পাঠিয়ে।
    রঞ্জনা ধীরে ধীরে পরমার খুব নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠল।কিছু অতিরিক্ত কাজও করে দিতে লাগল।আমাকে সকালের দিকে চাও ও করে দিত।পরমা দেখলাম রঞ্জনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।এরমধ্যে একদিন আমায় বলল,এরপর বকুলকে ছাড়িয়ে রঞ্জনাকেই রাখবে।আমি মৃদু আপত্তি করেছিলাম।ধোপে টিকল না।আমি যে সংসারের জন্য কতটা অনভিজ্ঞ সেটা পরমা যথারীতি মনে করিয়ে দিল।অগত্যা চুপ করে গেলাম।

    একদিন বাজার থেকে ফিরে দেখি বকুল আর পরমার খুব ঝগড়া হচ্ছে।জানতাম হবে।বকুল তার অধিকার ছাড়বে না।
    “তুমি জাননা বৌদি ,মেয়েটা একদম বাজে হয়ে গেছে।ঘরে একপয়সাও দেয় না।নিজের মেয়েটাকে দেখেও না।ঐ একরত্তি বাচ্চাটা মা-মা করে হেদিয়ে মরে।ডাইনিটা ঘুরেও তাকায় না।আমার হয়েছে যত জ্বালা।তুমি ওকে রেখোনা বৌদি।কাল থেকে আমিই আসব।”
    “তোমার বয়স হচ্ছে বকুল।শরীর ভালো যায় না।প্রায়ই কামাই কর।রঞ্জনা তো বলে ,তুমিই ওকে দেখতে পারো না।তোমার যত টান ছোট মেয়ের প্রতি।তাছাড়া ও কামাই করে না।টুকটাক এক্সট্রা কাজ করে দেয়।তুমি তো কিছু বললেই ঝাঁঝিয়ে ওঠ।আমাকে তো আমার ফায়দাও দেখতে হবে?” পরমাও ছাড়ার পাত্রী নয়।
    বুঝলাম,ছুটির দিনে যে নতুন একটা লেখা শুরু করেছিলাম ,তাতে এখন এদের প্রেমালাপে মনসংযোগ করা যাবে না।পাঞ্জাবীটা গলিয়ে হারুর চায়ের দোকানের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলাম।

    পরমাই শেষ পর্যন্ত জিতে গেল।রঞ্জনাই বহাল হল।যদিও রঞ্জনার অতিরিক্ত ভালো মানুষী কেন যেন আমার ভালো লাগত না।একথা একবার পরমাকে বলেছিলাম।
    “তোমার ভালো জিনিস কবে ভালো লেগেছে।তাহলে তো আমার সাথে ভালো ব্যবহার করতে।আমার কোনও কিছু ভালো দেখেছ কোনোদিন ?” পরমা সহজ অকাট্য যুক্তি দিল।
    বলে বুঝলাম মৌচাকে ঢিল মেরে বিনা প্রোটেকশনে দাঁড়িয়ে রয়েছি।কবে যে আমার বুদ্ধি হবে সেই ভেবে পরবর্তী আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকলাম।

    শীত শেষ হয়ে বসন্ত ধীরে ধীরে কাছে আসছে।নতুন পাতা,নতুন কুঁড়িতে সামনের কৃষ্ণচূড়া রঙ ছড়াচ্ছে।এই সময়টা সত্যিই খুব সুন্দর।আমার একটা বই এবারের স্থানীয় বইমেলায় বেরিয়েছে।সেই নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকায় সংসারে বিশেষ মন দিতে পারিনি। শনিবার অফিস ছুটি থাকে।দুপুর বেলা।পরমা কোথাও বেরিয়েছে।ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে পূর্নেন্দু পত্রীর পকেট বইয়ের সংকলন নিয়ে নাড়াচাড়া করছি এমন সময় পরমা ছুটতে ছুটতে এসে বলল ,”চল হাসপাতালে যাব”।
    “কোথায় ,কেন, কার কি হল ‘? আমি লাফ দিয়ে উঠি।
    “বকুলের অবস্থা খুব খারাপ। চল যেতে যেতে বলব। “।পরমা গুছিয়ে নিতে নিতে বলল।

    পথে যেতে যেতে সংক্ষেপে যা শুনলাম তা হল- বকুল কদিন থেকেই অসুস্থ।রঞ্জনা ,বকুলকে হাসপাতালে ভর্তি করবে বলে পরমার কাছ থেকে দশহাজার টাকা নেয়।পরমাও দিয়ে দেয়।পরশু থেকে রঞ্জনা আসছে না ।কোনও খবরও পাঠায় নি।গতকাল পরমা ,রঞ্জনা যে যে বাড়িতে কাজ করে সেই সেই বাড়িতে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখে ,রঞ্জনা ওদের থেকেও তিন -চার হাজার করে টাকা ধার নিয়েছে। আজ সকালে বকুলের ছোট বোন চন্দনা মুখার্জীদের বাড়িতে গিয়ে কান্নাকাটি করে বলে গেছে ,রঞ্জনা পরশু ঘর থেকে কোথায় চলে গেছে। ঘরে দু -তিনটে সোনার কানের দুল,একটা গলার চেন সব উধাও।কোনও টাকাপয়সাও নেই।মেয়েটা মা -মা করে কাঁদছে।বকুল সত্যিই অসুস্থ।কাল রাতে বাড়াবাড়ি হওয়ায় ওকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।একা চন্দনা ঐটুকু বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে জলে পড়েছে।
    আমি শুনলাম সব।জানতাম ,কিছু একটা হবে।রঞ্জনার হাবভাব কোনদিনই আমার পছন্দ ছিল না।এখন এসব প্রসঙ্গ তুলে লাভ নেই।আগে হাসপাতালে পৌঁছনো দরকার।

    বৈশাখের শুরুতেই এত গরম পড়ে গেল যে দুপুরে ঘর থেকে বেরোনো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ল।এমনিতে রানীগঞ্জে গরম একটু বেশীই পড়ে।আজ অফিস ছুটি থাকায় ভেবেছিলাম একটু আসানসোল যাব ব্যক্তিগত কাজে।গরমে আর ভালো লাগল না।কুঁড়েমি পেয়ে বসল।চিরসঙ্গী বই নিয়ে বসলাম।মানুষ চেনা যে কত বাকি তা ফ্রয়েডের ‘ইন্টারপ্রিটেশন অফ ড্রিম’ ঘাটাঘাটি করতে করতে ভাবছিলাম।যে পরমাকে আমি চিনতাম তার এই রূপ আমি কি কল্পনা করেছিলাম কখনও!
    সেদিন বকুলকে হাসপাতালে দেখে পরমা হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিল।চন্দনা ,ঝিমলিকে নিয়ে উদভ্রান্ত।কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।বকুলের গলব্লাডারে স্টোন ধরা পড়ল।পরমা নিজে রোজ গিয়ে ডাক্তারদের সাথে কথা বলে অপারেশনের দায়িত্ব নেয়।ঝিমলিকে ও চন্দনাকে নিজের ঘরে রাখে।চন্দনা এখান থেকেই কাজে যেত।নেহার স্কুলে গরমের ছুটি পড়াতে ঝিমলিকে রাখতে অসুবিধা হয় নি।পরমা নিজের হাতে ঝিমলিকে খাইয়ে দিত। বকুল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর চন্দনা ওদের ঘরে ফিরে গিয়েছিল।ঝিমলিকে আরও অনেক দিন পরমা নিজের কাছে রেখেছিল। বকুল পুরোপুরি সুস্থ হয়ে এখন শুধু আমাদের বাড়িতেই কাজ করে।তবে ভারী কাজগুলো চন্দনা এসে করে দেয়। ঝিমলিও সারাদিন এখানে থাকে।বিকেলে বকুল আর ঝিমলি বাড়ি ফিরে যায়।

    আমি মাঝেমধ্যেই অবাক হয়ে পরমাকে দেখি।ওর মুখটা অদ্ভুত পবিত্র লাগে।দেবীর মত মনে হয়।হাঁ করে তাকিয়ে থাকি।পরমা চা দিতে এসে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে ,”মশাই মেয়ে বড় হয়েছে , তাকানোটা একটু ঠিক কর।দিন দিন খুব অসভ্য হয়ে যাচ্ছ তুমি”।
    এমন অসভ্য আমি সারাজীবন থাকতে চাই ,মনে মনে বলি আমি

You cannot copy content of this page