-
কবিতা- সৈকত সন্ধানে
সৈকত সন্ধানে
-অমল দাস
ছয় মূর্তির অচর্চিত ইতিহাস,
নিদ্রিত রাত্রির তিন প্রহরের প্রথম লগ্নে
নিরাকার চাদর ভেদ করে পথের উপর।
কোন সৈকতে সমুদ্র ফেনায় শোধিত হবে আপাদমস্তক উল্লাস।
চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা রাজপথ-
ক্লান্তির পক্ষাঘাত সয়ে পড়ে আছে নির্বিকার।
মাঝে মাঝে নিশাচর চারচাকাগুলি
স্তব্ধ হয়ে থাকা শিরার মধ্যে হঠাৎ রক্ত স্রোতের উদ্দীপনার মত
ডাক দিয়ে যায় তীব্র বেগে।
অনুভবে যন্ত্রণা, বাস্তবে! যন্ত্রের মত ভাবাবেগ।
আমরা আর বিগত ইতিহাস উন্মোচনে আগ্রহ দেখাইনা!
গভীর অন্বেষণে নেমে পড়ি নৈসর্গিক আলো আঁধারি রূপে।
আপাত নিস্তব্ধ সারিসারি সবুজের কালো দল-
এভাবেই জীবনদায়ী প্রবাহ ছড়িয়ে চলেছে যুগান্তর।
আঁধারের করুণাঙ্কিত চোখে নত মস্তকে নির্বিবাদ-
এখানে সেখানে পাহারারত গৃহহীন সারমেয়রা।
তখন পথের ধারে পথিক সেবায় উনুন জ্বলে ওঠে
কোন এক গ্রাম্য ঘরের বিনিদ্রিত হাতে!
এ দৃশ্যে ভারতের ক্লান্তি নেই, নিদ্রা নেই, দ্বেষ নেই, নেই ভেদাভেদ,
কেবল বর্ণহীন কতগুলি মানুষ উষ্ণ আমেজে মুখোমুখি!
এক অচেনা পাখি শান্তির প্রশস্তি ডাকে উড়ে গেলে পশ্চিম কোণে
আমরা এগিয়ে চলি ভয়-বাঁধাহীন সমুদ্র সৈকতের সন্ধানে।
-
কবিতা- অভিমানী অবশিষ্ট
অভিমানী অবশিষ্ট
-অমল দাস
সারি সারি গাড়ি, ইমারতের লড়াই
পদতলে রাস্তা- যন্ত্রের দাপটে কেঁপে ওঠে,
কেঁপে ওঠে পা, কেঁপে ওঠে বুক!
কিন্তু উড়ালপুলের মত মনোরম হাওয়া আসেনা
আমাদের শহর যন্ত্রণার কবর কেটেছে
ছন্নছাড়া জীবন চিতায় পুড়ে নদীর ওপর দিয়ে
পশ্চিম ছুঁয়ে মিশে গেছে ঢলে পড়া অধর্মী আকাশের নিচে
অবশিষ্টাংশ পাঁচফুট ছয়ফুট যা ছিল,
তা প্রায় সবই হকারের পাতে!
অভিমানী সূর্যের অস্ফুট আপেক্ষিক আলো!
তবু আসা যাওয়া লেগেই থাকে যাপিত রাত্রি পরে।
শতাব্দীর জীর্ণ জানলা ঘেরা শিক ভেদ করে-
নবজাতের কান্নার চিল চিৎকার ভেসে আসে
ক্ষয়িষ্ণু শ্যাওলাবৃত পলেস্তার ঘেঁষে।
একটিও বৃক্ষ নেই বুভূক্ষ পাখিদের
বসার জানলাও সব স্লাইডারে বন্ধ।
কতকাল বন্দি রয়েছে, সে আজও একাকিনী
সিঁড়ি ধুয়ে নেমে আসা চোখের জল
ছাপাখানার সুরমা মেখে ঘুমিয়ে থাকে উপন্যাসের পাতায়!
-
কবিতা- তুমি একবার এসো
তুমি একবার এসো
-অমল দাস
কাগজী নৌকা ভেসেছিল বর্ষা জলে;
আমার, একটি তোমার!
ভেজা আবহ, প্রবাহ স্রোত এগিয়ে দেয়
সাবলীল পথে নামার।
জলাশয় ছেড়ে, নদী শহর বেয়ে
মোহনা ধরে আসি সমুদ্র,
মিষ্টতা ধীরে ক্ষয়ে আসে আমদের
নোনাজলে অতি ক্ষুদ্র।
তবুও প্রতিশ্রুতি লেখা কুয়াশা দেয়ালে
শৈত্যের মৃদু শব্দ,
আসবে পূর্ণ জ্যোৎস্নার সান্ধ্য লগনে
রাঙাতে আমার অব্দ।
সুদীর্ঘ রাত বেঁধেছি আঁখির পাতায়
এক প্রাপ্তির অপেক্ষায়,
মেঝের উপর সুগন্ধি পাপড়ি পড়ে থাকে
নিস্তেজ পাহাড় জমে যায়।
আমি কতগুলি ছবি এঁকেছি তোমার
রাতের রক্তরাঙা লালে,
জমাট প্রেম তোমায় উপহার দেবো
তুমি একবার এসো সকালে।
-
কবিতা- সরণ
সরণ
-অমল দাস
ভাড়াটে পৃথিবীতে আমরাও ভাড়াটিয়া,
প্রত্যেক শ্বাসে নবীকরণের সমঝোতায়-
পূর্বের তুলনায় নিম্নগামীর সরণ চলে রোজ!
মস্তিষ্কের ক্ষরণ ঘটে রঙ্গমঞ্চের নথি শোধরাতে
পাকস্থলী আহার ভুলে প্রায় রুগ্ন মরু
এদিকে মূল্যবৃদ্ধিতে মহার্ঘ্য বেতন বাড়লেও,
আয়ুষপাখি ক্রমান্বয়ে ক্ষুদ্র, অনেকটা হামিংবার্ড।
বর্ণের অপ্রতুলতা নেই ভাবনার ডানায়
ঋতুচক্রের পাক্ষিক প্রহরে রংধনুতে বাহ্যিক রঞ্জিত।
যদিও হামিং-এর শ্রুতিমধুরতা ছুঁতে পারিনা,
জাগ্রত মূর্তির কলহে গুঞ্জন তীব্র কর্কশ।
পোষ্যের খাঁচা থেকে যেদিন কার্বন পত্র মিলবে
সেদিন আনন্দের আমাজন খুঁজে পাবো না।
প্রকাশ্যেও আসতে মানা আমাদের অদৃশ্য অবয়বের।
-
কবিতা- মৌসুমী কেঁদে গেলো
মৌসুমী কেঁদে গেলো
-অমল দাস
মৌসুমী কেঁদে গেলো…
কলার পাতায় শব্দ ঝরে টুপটাপ…
আশিসের ঘাস, ডুবে আছে চুপচাপ…
মৌসুমী কেঁদে গেলো…
অনেকটা পক্ষ পরে শুভ গোধূলি দিনে
হলুদ গায়ে জল পড়েছিল আষাঢ়ের শেষ লগ্নে।
রাশি, গ্রহ, ফল, বেঁধে নৈঋত পথে এসেছিলে আমাদের প্রান্তে
উল্লাসের আবহে কেটে গেল কিছুদিন।
যতটা আশা, কর্মশৈলী বর্ণিত ছিল তার প্রারম্ভিক কুণ্ডলীতে
ক্রমান্বয়ে সে মোহের আঁধারে এসে পড়ে রুক্ষ আলো।
শুরু হয় কানাঘুষো, টিটকিরি, তাচ্ছিল্যের মশকরা!
অবজ্ঞায়, উৎকণ্ঠায়, অসহায় মৌসুমী কেঁদে ছিল অল্প।
শ্রাবণ যায়, ভাদু যায়, আরও দিন যায় কতেক, পুজোও যায়
অবকাশ অবশেষে, অফিস আদালত খুলে যায় সব!
আমাদের তরফ থেকে বিচ্ছেদের নোটিস দিয়েছিল আবহ-আদালত!
মৌসুমী বিদায়ে কেঁদে গেলো শেষে…
বিচ্ছেদ বিরহে, না অবহেলার ক্ষোভে, বোঝা গেলো না!
মনে যন্ত্রণার আর্তনাদ নিয়ে আসা পথেই ফিরে যায়!
মৌসুমী কেঁদে গেলো শেষে…
-
কবিতা- মুখ ঢেকে রাখি লজ্জায়
মুখ ঢেকে রাখি লজ্জায়
-অমল দাস
জানলার ধারে বসে যাতায়াত আমার
প্রকৃতির লাস্যময়ী মুখ,
ভাবি মহীরুহ তলে আগাছা যত
চিরদিনই কত সুখ।
সারি সারি দূর সবুজের দল
পিছে যায় সরে সরে,
ভ্রমে আমি! আদতে তারা অবিচল
আমিই চলে যাই দূরে।
নিত্য কোলাহল শুনি ধুম্র ধোঁয়ায়
শ্বাসে বাতাসে হাহাকার,
গন্ধ-ঘাম ঠাসাঠাসি মাঝে বেঁচে আছি
মুক্ত চাহিদা অন্তরে সবাকার।
চিলেদের সাথে তুলো মেঘ ভেসে আসে
জল… বাষ্পের সন্ধানে,
বৃষ্টি আমাকে ছোঁয়নি, ছুঁয়েছে এক শিশু
কাঁদো গাল অশ্রু-অঞ্জনে।
কত অভাব শত অভিযোগ লেখা
অন্তঃ আঁধারিত পাতায়,
সৌরালোর খামতি নেই বাইরের কোনাংশে
পৌঁছায়নি রুষ্ট জীবন খাতায়।
জ্ঞাত অজ্ঞাত অবয়বের যত মূর্তি
খোলস তলে কঠিন-দুর্বোধ্য
আত্মিক উপভোগ মিলেমিশে যান্ত্রিক গোলযোগে
নিংড়ে মনন অ-সাহিত্যের গদ্য।
গহনা কংক্রিটের ঢাকা মেঠো পথ, চিরন্তন
শুয়ে আজও একই শয্যায়!
বদলে যায় আবহ, বদলায়নি আমার আমি
মুখ ঢেকে রাখি লজ্জায়।
-
কবিতা- এভাবেই লেখা জন্মায়
এভাবেই লেখা জন্মায়
-অমল দাস
এভাবেই লেখা হয় পংক্তি এভাবেই জন্মায় কবিতা
দুরন্ত ধু ধু মাঠ পেরিয়ে ছুটে আসে শব্দ-দ্বন্দ্ব,
বিহগার সুরে সবুজের দূরে দিক-অন্ত মিলে যায়
বৈকালিক স্নিগ্ধতায় আকাশে বাতাসে ওড়ে ছন্দ।
এভাবেই আলোড়িত যুবতীর রূপ এভাবেই প্রকৃতির মুগ্ধতা
সুদীর্ঘ বেণীর কামাতুর ঝর্ণার অপূর্ব জলপ্রপাত,
কায়ার সু-উচ্চ পর্বতে তুষারের ওড়না জড়ানো
পাদদেশ বেয়ে নিম্নে ঘন অরণ্যে গভীর মায়াবী খাদ।
এভাবেই দ্বৈত অর্থ প্রকাশ এভাবেই ভাষার বিন্যাস
কৃষ্ণ গহ্বরে সমাহিত অগণিত আলোকিত তারা,
উপেক্ষিত আগাছাই বনানীর তারুণ্যের কারণ
মেহনতে গড়া উঁইয়ের ঢিবি নির্দয়ী শ্রাবণে বাস্তুহারা।
এভাবেই জুড়ে যায় মনে মন এভাবেই বিরহিত ধারা
তুমি হীনা আঁখি পল্লবে আর্দ্র নিবৃত্ত বসন্ত লহর,
নোনা দেয়ালে শৈবাল প্রেম বৃষ্টির জলে পরাভূত
ভাঙনের চড়ে সমাধি প্রস্তরে নাম লেখে উদ্বেলিত জহর।
এভাবেই জাগে সামাজিক ঢেউ এভাবেই পতনের বেগ
স্বার্থের ঘোলা জলে নিমজ্জিত আত্মিক সহমর্মিতা,
দস্তাবেজে শিক্ষার মূল্য আঁটা কর্মে ভগ্ন মেরুদণ্ড
অবৈধ উত্তাপ ঝাণ্ডার ঝড়চাপ- নেভে নিরীহ মোমবাতিটা।
-
গল্প – ভাঙা মন্দির
ভাঙা মন্দির
– অমল দাস
টালির চালা ঘর থেকে বেরিয়ে গ্রামের ভাঙা পুকুরের পার ধরে সুমনা এগিয়ে চলছে সিদ্ধার্থের খোঁজে। আজ এই নিয়ে চারদিন সিদ্ধার্থ সুমনার সাথে দেখা করেনি তাদের প্রিয় স্থান গ্রামেই পরিত্যক্ত ভাঙা মন্দিরের অশ্বত্থ তলে। দেবতার অবয়ব হীন এই ভাঙা মন্দিরের শপথ করেই সিদ্ধার্থ বলেছিল, দেবতা নেই তো কি হয়েছে, এই মন্দিরকেই সাক্ষী রেখে বলছি তুই আমার হৃদয়ের অর্ধেক অংশ, মন্দির ভাঙা হলেও তোর মন আমি ভাঙবো না!
কথা রাখেনি সে! সুমনার খুব মন খারাপ, সিদ্ধার্থ কেন তার সাথে দেখা করেনি চারদিন। কি হয়েছে? সুমনা নিজে কি কোন ভুল করেছে! না কি ওর শরীর খারাপ! কেনই বা ও খবর দিল না! নাকি ও জেনে গেছে তাই পালিয়ে বেরাচ্ছে, আমি তো ওকে কিছু বলিনি। আমি তো আর আমি একা নই! ওর আদুরে স্পর্শে! ওকে বুঝতেও দিইনি। তাহলে…
এক আকাশ চিন্তা মাথায়! বুক দুরুদুরু অবস্থায় কাঁপাকাঁপা পা দুটো এসে থামল গ্রামের শুরুর দিকে সিদ্ধার্থদের মস্ত বাড়ির গেটে।
বন্ধ গেটের ডানদিকের ছোট খিড়কিটায় একবার স্বভয়ে ঠেলাতে হালকা আওয়াজ হলো, তাতে যেন ভয়ে সুমনা আরও শিঁটিয়ে গেলো। চোখ মুখে এক উদ্ভ্রান্ত শীর্ণকায় রূপ জেগে উঠেছে। গেটের আওয়াজে কেয়ারটেকার ভানু ছোট দরজা থেকে ঈষৎ গলা বার করে তাকে সম্পূর্ণ লক্ষ্য না করেই বলে -এখন যাও! এখানে ভিক্ষা-টিক্ষা হবেনা।
– -ভানু কাকু আমি সুমনা, সিদ্ধার্থকে একবার ডেকে দেবে? নিরাসক্ত স্বরে সুমনা।
প্রথমে খেয়াল না করলেও, এখন ভুল ভাঙতেই জিভে দাঁত বসিয়ে অনুশোচনার স্বর বেরিয়ে এলো- ও… ইস… সুমনা… আমি খেয়ালই করিনি, তা চোখ মুখের এমন হাল কিকরে হলো! চেনবারই উপায় নাই যে!
একথায় সুমনা গুরুত্ব দিল না! তাই উত্তর দেওয়ারও প্রয়োজন নেই। সে আবার বলল- সিদ্ধার্থকে একবার ডেকে দাও না… কাকু!
ওমা তুমি জানো না সিধু বাবু তো বাড়িতে নেই, সে দুবাই যাবে চাকরি করতে! সকালেই সবাই কলকাতায় বেরিয়ে গেছে সিধু বাবুকে হাওয়াই জাহাজে তুলে দিতে।
নিমেষে সুমনার হৃদয়ে উথাল পাথাল ঝড়! অত্যাশ্চর্য হয়ে কথা হারিয়ে কেবল নির্বোধের মত জিজ্ঞাসা করল- মানে?
-সে কি ছোট বাবু তোমাকে কিছুই বলেনি? তার চাকরি লেগেছে! এই যে গেলো আবার দুবছর পর আসা। কিছুই বলেনি! তুমি ওর ভালো বন্ধু! আমি তো জানি…
শেষের কথাগুলো ক্ষীণ হয়ে সুমনার কানে এলো, সুমনা আগেই আত্মহারা হয়ে প্রায় জ্ঞান হারানোর পর্বে।তার চোখের সামনে এখন ঘোর অন্ধকার, সেই অন্ধকারে অজস্র বিন্দুবিন্দু আলোর ঝিলিক, দিগ্বিদিক শূন্য। সুমনা দু পা পিছিয়ে এলো, যদিও তা স্ব-ইচ্ছায় নয়। রাস্তার পাশেই একটি আম গাছের তলে অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে রইল, কতক্ষণ এভাবে ছিল জানা গেলো না। কেয়ারটেকার ভানুও গলার পরিবর্তে শরীর বার করে আর দেখার চেষ্টা করল না সুমনা আছে না চলে গেছে।
-
কবিতা- নদী ও কিনার
নদী ও কিনার
-অমল দাস
কিনার অবলীলায় উদার হৃৎপিণ্ড দ্বিখণ্ডিত করে
নদীর চলার পথ প্রশস্ত করেছিল সানন্দে।
ডান ও বাম অলিন্দে সবুজায়নের ঘেরাটোপে
আকাশের রঙ বাঁধা শাড়িতে নদীও চিরযুবতী সেজেছিল-
আরাধ্য কিনারের জন্য!
আনন্দ উচ্ছ্বাসের প্রেম পরাগে সহাবস্থানে বেঁধেছিল ঘর।
লোলুপতার দৃষ্টিতে আমাদের এ জগত তীব্র রূঢ়!
একটু একটু বালুকাবৃত ক্ষোভ দীর্ঘদিন অন্তরে পুঞ্জীভূত করে
নদী ব্যাকুল প্রলয় নিয়ে আছড়ে পড়ে কিনারের’পরে।
অবুঝ ভালোবাসার জলাহুতিতে কিনার তখন চূর্ণবিচূর্ণ!
ক্ষয়ে যায় তবু মাস্তুলসম দাঁড়িয়ে থাকে –
নদীকে ভালোবেসে আগলে রাখে দৃঢ় অঙ্গীকারে।
নদী বোঝনি কিনারের আত্মবলিদান অথবা বুঝেছিল!
হয়তো নিরুপায় সে, হয়তো বা শঠতায় আছড়ে পড়ে নানা অছিলায়!
নিরুত্তাপ নিরুত্তরে বিদীর্ণ কিনার প্রতিবাদহীন
যুবতী নদীকে সাবলীল ক্রমে সাজিয়ে চলে নির্দ্বিধায়
আজও ভালোবাসার গভীরতা অধরা নদীর কাছে,
শুধু চাহিদা আর মেকি অশ্রুতে তা সমাহিত
কিনারের অঙ্গহানিতে নদীর মনস্কাম পরিপূর্ণ
দুই অলিন্দ দূরে আরও বহু যোজন দূরে..পথ প্রশস্ত করে
ভাঙা গোধূলিবেলায় ভাঙা আঙিনায় কিনার মিলিয়ে যায় সমতলে!
নদীর ঐশ্বর্য যৌবন ফিকে পড়ে অস্তমিত সূর্যের আড়ালে
আদর্শ গভীরতা গতি হারা হয়ে বার্ধক্যের পতনে
আজও কিনারের প্রেম বোধস্পর্শ করেনি নদীর।
-
অণু গল্প- “রঙ”
রঙ
-অমল দাস
রবিবার ছুটির দিন একসাথে সবাই মিলে চায়ের টেবিলে। একসাথে সবাই মানে খুব বেশি নয়। মা, বাবা আর প্রভাংশু এই তিন জনের পরিবার। প্রভাংশু চায়ের কাপে হালকা মেজাজি চুমুক দিতেই মা দীর্ঘ দিনের সুপ্ত ইচ্ছা জাগিয়ে বাবার দিকে চেয়ে বলে ওঠে- এবার একটা মেয়ে-টেয়ে দেখো অংশুর জন্য!
প্রভাংশুর বাবা বলল- বেশতো দেখলেই হয়! আত্মীয় স্বজনদের খবর দিয়ে দাও তাহলে। তারপর প্রভাংশুরকে উদ্দেশ্য করে জানতে চায়- তা তুই কি বলিস? বা তোর কোন মতামত থাকলে বল।
প্রভাংশু মৃদু হেসে বলল- মতামতের আর কি আছে! তোমাদের যখন ইচ্ছা বা বিয়ে যখন একটা করতেই হবে, তবে দেখতে তো হবেই।
মা বলল- আমি তাহলে তোর মাসী, আর পিসিমাকে খবর দিয়ে রাখি? যদি তাদের পরিচিত কোন মেয়ে থেকে থাকে জানাশোনার মধ্যে।
বাবা বলল- সে তো বলবেই! তা অংশুর যদি কোন কেউ পছন্দে থাকে সেটাও আগে জেনে নাও।
প্রভাংশু স্বাভাবিক স্বরেই- না বাবা.. তেমন কেউ নেই! তবে চ্যটার্জী বাড়ির মেয়েটি দেয় কিনা খোঁজ নিয়ে দেখত পারো তোমরা!
মা একটা অবজ্ঞা মিশ্রিত সুরে বলল- কে? প্রিয়া না কি নাম সেই মেয়েটা?
-হ্যাঁ! মেয়েটি জানাশোনার মধ্যে ভালোই শুনেছি।
মা চোখ উঁচিয়ে, ঠোঁট বাঁকিয়ে উস্মা প্রকাশ করে বলল- না…. না… ওই মেয়ের সাথে তোর বিয়ে!
– কেন ও মেয়ের আবার কি হল? তুমি কিছু জানো না কি? বাবা জানতে চাইল।
– জানি বলতে মেয়ের গায়ের রঙ খুবই চাপা, অংশুর সাথে মানাবে না।
প্রভাংশু বলল- মা গায়ের রঙ আজকাল আর ম্যাটার নয়! মেয়েটা ভালো কি মন্দ সেটা দেখার। কারণ ভালোটার সাথে জীবন কাটবে রঙের সাথে নয়!
হালকা ধমক বা জোর খাটানো কণ্ঠে- তুই থাম! সরকারী চাকরি করছিস, তোর জন্য কোথায় একটা ফর্সা রূপসী মেয়ে আনবো ভাবছি! তা.. না….
– কতখানি ফর্সা মানেই কি মেয়ে ভালো? প্রভাংশুর প্রশ্ন।
এসবের মধ্যে বাবা আর সাড়া দিল না ঠোঁট দু’টো মুচকি হাসিতে উজ্জ্বল করে তুললো মজা নেওয়ার ভঙ্গিতে।
-তুই যাই বলিস! প্রিয়ার গায়ের রঙ আর তোর গায়ের রঙ মানাবেই না।
– মা…! পৃথিবীতে সব কি মর্জিমত মানিয়েই হয়? অনেক কিছু মানিয়ে চলতে হয়। এই ধরোনা তোমার আর বাবার কথাই বলি! তোমাকে কি বাবার পাশে মানিয়ে ছিল, সেই চারহাত এক হওয়ার সময়?
বলতে বলতে চায়ের শেষ চুমুকটা দিয়ে প্রভাংশু উঠে গেল। মা কোন সাড়া দিল না বা দিতে পারলো না। আর কিই বা বলবে কথাটা যে আক্ষরিক অর্থে সত্যি তা সে মরমে মরমে টের পেয়েছিল। একবার অংশুর বাবার মুখে নির্লিপ্ত ভাবে চেয়ে নিজেই মাথা নত করে বসে রইল অনেকক্ষণ এবং টেবিলের কাঁচের গ্লাসে নিজেরই প্রতিবিম্বের মধ্যে নতুন করে নিজেকে খোঁজার এক দীর্ঘ প্রয়াস চলতে লাগলো।