-
গল্প- মানবিক ও অমানবিক
।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
মানবিক ও অমানবিক
–অমিত কুমার জানামেদিনীপুর শহরের গোলাপীচকের যুবক ছেলে সুভাষ পেশায় মারুতি ড্রাইভার। সে তার বয়স্ক বাবা এবং অসুস্থ মায়ের সঙ্গে এককামরার একটা একতলা বাড়িতে থাকে। ওর মা মারাত্মক ‘নার্ভ ডিসঅর্ডার’ রোগে আক্রান্ত। ড্রাইভারি করে ওর যা উপার্জন হয় তার বেশিরভাগটাই মায়ের ওষুধ কিনতে খরচ হয়ে যায়। তবুও এতটুকু বিরক্ত না হয়ে মাতৃসেবা থেকে সুভাষ নিজেকে কখনও বিরত রাখে না।মা অসুস্থ থাকায় রান্নাবান্নার কাজটাও তাকেই সামলাতে হয়। প্রতিদিন সকালে রান্নাবান্না এবং স্নান, খাওয়া সেরে নটার মধ্যে মালিকের মারুতি নিয়ে সে চলে আসে কেরানীটোলায়। ওখানে অনেক মারুতির সাথে সেও অপেক্ষা করে ভাড়া ধরার জন্য।
সুভাষের একটি বিশেষ গুণ হলো পরোপকার। অপরের বিপদে আপদে নিজের সমস্যাকে হেয় করে সে সর্বদাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই তো মাসখানেক আগের কথা:
সুভাষ মারুতি নিয়ে অপেক্ষা করছিল রোডের পাশেই। হঠাৎ দুটো মোটর বাইকের মুখোমুখি এক্সিডেন্ট। একজন বাইক আরোহী লুটিয়ে পড়লো রোডের উপরে । তার অচেতন দেহ থেকে রক্তস্রোত বেয়ে পড়ছিল। সুভাষ বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে মারুতিতে করে আহত আরোহীটিকে পৌঁছে দিয়েছিল নিকটবর্তী জেলা হাসপাতালে। ডাক্তার তার খুব প্রশংসা করে বলেছিল যে বেশি দেরী হলে অত্যধিক রক্তক্ষরণের জন্য বাঁচানো সম্ভব হতো না। এতে সুভাষ যেন অমূল্য পুরস্কার প্রাপ্তির এক অনাবিল আনন্দ পেয়েছিল। কেননা আর যাই হোক সে একটা জীবন বাঁচিয়েছে তো।প্রতিদিনের ন্যায় সেদিনও সুভাষ মারুতি নিয়ে কেরানীটোলায় পৌঁছেছিল যথাসময়ে। মারুতির মধ্যে বসেই ছিল সে। কিন্তু সেদিন তার পেট ব্যথা করছিল খুব। হয়তো বদহজম হয়ে গেছিল। সে আর বিলম্ব না করে পার্শ্বস্থ মেডিসিন শপে গেল অ্যন্টাসিড কিনতে। তার চোখে পড়লো দোকানের সামনেই পড়ে রয়েছে এক বান্ডিল টাকা। প্রথমে সে হকচকিয়ে গেল। তারপর টাকার বান্ডিলটা হাতে তুলে নিয়ে দেখল বান্ডিলের সবকটি নোটই দুহাজারের। গুনে দেখলো মোট পঞ্চাশ হাজার টাকা রয়েছে। সে তৎক্ষণাৎ ওই মেডিসিন শপে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো যে এটা ওদের কারও কিনা। দু একজন মিথ্যা বলে ঐ বান্ডিলটা আত্মসাৎ চেষ্টাও করলো। অথচ যে হতভাগা মারুতি চালিয়ে সামান্য উপার্জন করে মায়ের জটিল রোগ নিরাময়ের চেষ্টায় নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে তার ঐ টাকার প্রতি কিঞ্চিৎমাত্র লালসা নেই। সত্যিই এ যুগেও কোন কোন মানুষের অভাবেও স্বভাব নষ্ট হয় না। সুভাষের মতো কেউ কেউ শত কষ্ট নির্বিঘ্নে সহ্য করেও অমূল্য মানবতা ও সততাকে আঁকড়ে ধরে রাখে।
এই ঘটনার মাত্র মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সেখানে হাজির হলো বহুমূল্য প্যান্ট শার্ট পরিহিত এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। এসে না এসেই মেডিসিন শপে জিজ্ঞেস করলেন ,-“আমি এইমাত্র আপনার দোকান থেকে ফিরে গেছি। কিন্তু আমার পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা বান্ডিল এখানেই পড়েছে বোধহয়। কেউ যদি…”
শপকীপারের মুখ থেকে শুনলেন ঐ ভদ্রলোক শহরের বিখ্যাত মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভ ।নাম প্রকাশ রায়। সুভাষ প্রকাশ রায়ের নামটা কোথায় যেন শুনেছে। সে প্রাণপণ মনে করে চেষ্টা করলো।
সুভাষ টাকার বান্ডিলটা প্রকাশ রায়ের হাতে তুলে দিয়ে বললেন,-“গুনে নিন ,ঠিক আছে কিনা।”
প্রকাশ রায় সুভাষের সততায় ভীষণ অভিভূত এবং আনন্দিত হয়ে বললেন,-” এই উপকারের বিনিময়ে তুমি কি চাও বলো?”এবার প্রকাশ রায়ের কথা সুভাষের মনে পড়লো। সে কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা হৃদয়স্পর্শী ভিডিও দেখেছিল। হেডলাইনে লেখা ছিল “শহরের বিখ্যাত মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভের কি অমানবিক আচরণ।”
ভিডিওতে দেখাচ্ছে : কেরানীটোলার বাজারে প্রকাশ রায়ের দুটি পা ধরে একটা ক্ষুধার্ত পথশিশু ভিক্ষা চাইছে কিন্তু অসহিষ্ণু প্রকাশ রায় শিশুটিকে সপাটে চড় মেরে যাচ্ছে।সুভাষ শিশু নিপীড়নের এই বেদনাময় স্মৃতির বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর প্রকাশ রায়কে মার্জিতভাবে বললো , -“এর বিনিময়ে আমার কিছু দাবি নেই। তবে আমার একটি পরামর্শ- আপনি ওই হতভাগা পথশিশুটির ওপর হাত তুলে ঠিক করেন নি। কারোর প্রতি সহানুভূতি না দেখাতে পারেন, তেমনই অসহায়ের প্রতি অত্যাচার করার অধিকারও আপনার নেই।”
ততক্ষণে সেখানে অনেক লোক জড়ো হয়ে গেছে। সুভাষের উপদেশবার্তা তাঁর মোটেই সহ্য হলো না। তিনি সুভাষকে টেনে তার গালে সজোরে দু চড় বসিয়ে দিলেন। তারপর ক্রোধের আগুনে জ্বলে উঠে বললেন, -” তোর এত বড় স্পর্ধা, তুই আমাকে জ্ঞান দিস্। ছোটোলোক কোথাকার…”
চারিদিকে যেন সবাই নির্বাক দর্শক! কেউ একজনও মানবিকতা প্রদর্শনের সাহস দেখাল না। একজনও এগিয়ে এলো না এই ঘৃণ্য অমানবিকতার বিরুদ্ধে সদর্পে প্রতিপাদ জানাতে।আর বেচারা সুভাষ! তার তো আর কাজ নেই তাই পথশিশুর অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার মার্জিত প্রতিবাদ করার মানবিকতা উপচে পড়ছে। পঞ্চাশ হাজার টাকায় তার মতো সাধারণ ছেলের হয়তো দশ- বারো মাস আরামেই কাটতো। তা না করে…
ইস্, সুভাষের মতো দুষ্প্রাপ্য নির্ভেজাল মানবিকতার প্রতীকটা যদি এমন ভাবতে পারতো!এখনো কতিপয় সুভাষ বেঁচে আছে। বেঁচে আছে তাদের সততা,নিষ্ঠা, মনুষ্যত্ব। তারাই প্রকৃত জীবনের অর্থ উপলব্ধি করতে পারে। তারা যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব তা তারা প্রতিক্ষণে উপলব্ধি করতে পারে। এমন মহানুভবতার প্রতি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা উদ্ভাবিত হবেই হবে।
—– -
গল্প- ডিভোর্স
।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
ডিভোর্স
-অমিত কুমার জানাপ্রতিদিনের মতো সকাল সকাল বিভাসদার চায়ের দোকানে গিয়ে লাল চায়ে এক চুমুক দিয়েছি,এমন সময় বিভাসদার মোবাইলটা বেজে উঠলো। এক দু মিনিট কথোপকথন হওয়ার পর বিভাসদা আমাকে বললো, “বুঝলি ভাই, একটা সমস্যা সমাধান করে ফেলেছি। আমার পাড়ার একটা ছেলেকে ডিভোর্স হওয়া থেকে বাঁচিয়েছি।” আমি কৌতূহলী হয়ে মজার ছলে বললাম,”তুমি কবে থেকে আবার সমাজ সেবা করছো গো? দোকান চালানোর সাথে সাথে আজকাল এইসব হিতকর কাজও করছো,বেশ ভালো কথা।”
বিভাসদা বললো, “আসলে আমাদের পাড়ার একটা ছেলে জিতেন, পাঁচ বছরের বিবাহিত। তিনদিন আগে স্ত্রী (কেকা)-র সাথে ওর প্রচণ্ড ঝগড়া হয় এবং ওর স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে যায়। শুধু তাই নয়,জিতেন এবং কেকা উভয়েই ডিভোর্সের সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়। জিতেনের শ্বশুর, শাশুড়ী এবং সম্বন্ধী সবাই ওর উপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সম্বন্ধী তো জিতেনের নামে বধূ নির্যাতনের মামলা করবে বলে হুমকিও দেয়। এদিকে জিতেন ও তার ডিভোর্সের সিদ্ধান্তে অনড়। গত পরশু রাতে দোকান বন্ধ করে বাড়ি যাওয়ার পথে গ্ৰামের ক্লাবে ঢুকেছিলাম। ক্লাবের ভেতরে কয়েকটা ছেলে ক্রাম খেলছিল।
ওখান থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেখলাম ক্লাবের উঠোনের এককোণে জিতেন বসে বসে সুরা পান করছে। এ অবস্থাতেও তাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল। যে ছেলেটাকে আগে কখনো সুরাপান করতে দেখিনি,তাকে এমতাবস্থায় দেখে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে কি হয়েছে। “
জিতেন এমনিতে মিতভাষী, কিছুক্ষণ পর ও বললো যে ওর পত্নীর সাথে ভীষণ ঝগড়া হয়েছে এবং রাগান্বিত হয়ে ও ওর উপর হাতও উঠিয়েছে। সেই থেকে কেকা বাপের বাড়ি পালিয়ে গেছে।বিভাসদা ওকে ঝেড়ে কাশতে বললো। জিতেন বলতে শুরু করলো, ” কেকার সাথে আমার বিয়ের কিছুদিন পর আমি কলকাতায় চলে আসি। কলকাতায় একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করতাম। কিন্তু কেকা গ্ৰামের বাড়িতে একা একা ভীষণ বোর হয়ে যেত। তাই কিছুদিন পর ওকেও কলকাতায় নিয়ে চলে আসি। এখানে আমরা ভাড়াবাড়িতে থাকতাম। পাশের বাড়ির এক বৌদি খাবার রান্না করে খাবার পাঠিয়ে দিতেন। আমরা দুজনেই উনার রান্নার প্রশংসা না করে পারতাম না।
সকল দশটায় খাওয়া দাওয়া করে আমি চলে যেতাম ডিউটিতে,তারপর ফিরে আসতাম সন্ধেবেলায়। ও সারাদিন একা একাই থাকতো। এতেও ও বোরিং ফিল করতো। কেকা মাধ্যমিক পাশ। তাই ওকে বললাম ও যদি আর পড়াশোনা করতে চায় তবে ওকে ক্লাস ইলেভেনে ভর্তি করবো। ও রাজী হয়ে গেল। সেইমতো ওকে আবার নিয়ে এলাম গ্ৰামের বাড়িতে। পাশের গ্ৰামের একটা হাইস্কুলে ওকে ইলেভেনে ভর্তি করলাম। তারপর আমি কর্মসূত্রে কলকাতায় চলে এলাম। গ্ৰামের বাড়িতে ও আমার বাবা মায়ের সাথে থাকতো। এইভাবে মাসখানেক অতিক্রান্ত হওয়ার পর ওর সম্বন্ধে যা শুনতে শুরু করলাম তাতে আমি বেশ টেনশনে পড়ে গেলাম। শুধু তাই নয় কেকার উপর আমার মনে ক্ষোভের আগুন জমা হতে লাগলো। আমি যতটা সম্ভব দ্রুত গ্ৰামের বাড়িতে ফিরে এলাম। বেশ কয়েকজন বন্ধুর মুখে শুনলাম যে কেকা ক্লাসের এক বন্ধুর সাথে পার্কে যায়। এককথায় কেকা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। আমি ওকে বোঝালাম যে বিয়ের পর এসব করা ভদ্র মেয়েদের মানায় না।আমি এসব সহ্য করবো না। “
জিতেনের এসব কথা কেকা মোটেই সহ্য করলো না। শুধু তাই নয় সে বলতে শুরু করলো, “কলকাতায় যে বৌদি তোমাকে খাবার পাঠাতেন তুমি উনার যে সব অশ্লীল চ্যাট করতে তা আমি জানি। তুমি যদি অবৈধভাবে ঐ বৌদির সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পারো,তবে আমি কেন পারি না। আমি তোমার ফোনে হোয়াটস্ এপ ম্যাসেজ চেক করে এসব জানতে পারি।”
প্রত্যুত্তরে জিতেন বললো, “ও তুমি তাহলে গোয়েন্দাগিরি করতে আমার সাথে কলকাতায় গিয়েছিলে? ঐ বৌদির সাথে আমার কোন সম্পর্কই নেই,জাস্ট টাইমপাস ছাড়া কিছু নয়।”এইসব কথোপকথন হতে হতে এই যুবদম্পতির মধ্যে তুমুল ঝগড়া শুরু হলো। একে অপরকে কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ শুরু করলো। জিতেন
রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে কেকাকে সজোরে এক চড় লাগিয়ে দিল। অতঃপর জিতেন বললো,”আমি তোমাকে ডিভোর্স দিয়েই ছাড়বো।”
কেকা উত্তেজিত হয়ে বললো, “তোমার সাথে কে থাকবে? আমিও ডিভোর্স চাইছি এখনই।”এই বলে কেকা বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল। এরপর বিভাসদা বললো, “পরদিন ক্লাবে জিতেনকে পরামর্শ দিলাম যে ডিভোর্স হতে বেশিদিন লাগবে না। কিন্তু তোদের দুজনের ভবিষ্যৎটা কি হবে? তোর মেয়ের ভবিষ্যৎ কি হবে? এক কাজ কর, তুই এখনই কেকাকে ফোন করে জিজ্ঞেস কর যে ওকে নিয়ে আসতে গেলে ও ফিরে আসবে কিনা?”
জিতেন তখনই কেকাকে ফোন করলো এবং কেকাও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ফিরে আসতে রাজী হয়ে গেল।
বিভাসদা জিতেনকে বুঝিয়ে বললো, “তুই বেশ কিছু ফল মূল,মিষ্টি নিয়ে বিকেলের দিকে শ্বশুরবাড়ি চলে যা। আর হ্যাঁ, ওখানে গিয়ে রাতে কেকার সাথে একসাথে সময় কাটিয়ে সকালে ফিরে আসবি।”
জিতেন তাই করলো। যদিও জিতেনের সম্বন্ধী তা মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু সকাল হতে না হতেই জিতেন এবং কেকা হাসিমুখে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। কেকার বাপের বাড়ির লোকজন তো একেবারে অবাক।সকালে বাড়িতে পৌঁছে জিতেই প্রথমেই বিভাসদাকে ফোন করে বলে, ” কি ভাষায় যে তোমায় ধন্যবাদ জানাবো বুঝে উঠতে পারছি না। তুমি আমার বিরাট একটা সমস্যার সমাধান করে বড়ো উপকার করলে। আমি চির কৃতজ্ঞ থাকবো।”
বিভাসদার মুখে এই সত্য ঘটনাটা শুনে ওকে করজোড়ে নমস্কার করে বললাম ,”সত্যিই তুমি এ সব মামলায় বস।”
বিভাসদা তখনই একজনকে ফোন করে বললো, “উকিল সাহেব গুড মর্নিং, আমি বিভাস। আপনার কাছে পাওয়া পরামর্শ অনুযায়ী আমি একজনকে ডিভোর্স থেকে বাঁচালাম। আপনি গ্ৰেট,ভালো থাকবেন।”
এরপর বিভাসদা আমায় বললো, “ডিভোর্স আটকানোর এই কৌশলমূলক শিক্ষা আমি পেয়েছিলাম এই উকিলের কাছে। এক বছর আগে দীঘা গিয়েছিলাম। আমি এবং আমার বন্ধুরা যে হোটেলে ছিলাম ,ঐ উকিল সাহেব সেই হোটেলের এক রুমে ছিলেন। দীঘা থেকে ফিরে আসার দিন সকালে উনার সাথে পরিচয় হয়। উনিই আমাকে বলেন যে এক দম্পতি ডিভোর্সের জন্য উনার কাছে এসেছিলেন। ওদের উনি বুঝিয়ে দীঘা নিয়ে আসেন এবং একরাতের জন্য দুজনকে এক রুমে রাত কাটানোর জন্য অনুরোধ জানান। যদিও উক্ত দম্পতি তাদের ডিভোর্সের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। কিন্তু দীঘায় এক রাত কাটিয়ে সকালে উনারাই উকিল সাহেবকে বলেন যে তাঁরা ডিভোর্স চান না। এখন থেকে একসাথেই থাকবেন। আজকের দিনে এমন সমাজসেবী উকিল পাওয়া বড়ই দুষ্প্রাপ্য!”আমি বিস্মিত চোখে বিভাসদার দিকে তাকিয়ে বললাম ,”তুমিও কোন অংশে কম সমাজসেবী নও।”
আমি হাসতে হাসতে বলললাম,”আমার বা আমার পরিচিত কারও এ ধরনের সমস্যা হলে তোমার শরণাপন্ন হবো।” -
গল্প- কোয়ারেন্টিনা
।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
কোয়ারেন্টিনা
-অমিত কুমার জানামে মাসের মাঝামাঝি পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা ভারতবর্ষে করোনা সংক্রমণ আবার নতুন রূপে দেখা দিল। দেশব্যাপী সংক্রমণের হার এবং মৃত্যুর হার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেল। তিন বছর পূর্বে করোণা সংক্রমণের কারণে দেশে লকডাউন এর জন্য অনেক আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। দরিদ্র এবং মধ্যবিত্তরা চরম সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল।
মেদিনীপুর জেলার কুমারপাড়া একটা ছোট্ট গ্ৰাম। সেই গ্ৰামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে মানস গতবছর মাধ্যমিক পাশ করেছে। তার বাবা বিধানবাবু কথা দিয়েছিলেন যে মানস মাধ্যমিকে আশি শতাংশের উপরে মার্কস্ পেলে তাকে একটা মোবাইল গিফ্ট করবেন। কিন্তু মানসের ভাগ্যে মোবাইল জুটলো না। কারণ গতবারে মাধ্যমিক পরীক্ষাই হয়নি করোনা সংক্রমনের কারণে। মধ্যশিক্ষা পর্ষদ সব পরীক্ষার্থীকে গড় মার্কস দিয়ে পাশ করিয়ে দিয়েছিল। বাধানবা সেই অজুহাত দেখিয়ে ছেলেকে আর মোবাইল কিনে দেন নি।
সেই থেকে মানসের তার বাবা মায়ের উপর খানিক অভিমান জমে আছে।
বিধানবাবু একসময় বিডিও অফিসে কেরানীর চাকরি করতেন। কিন্তু প্রতিনিয়ত মদ্যপান করে অফিস আসতেন। একাধিকবার শোকজ করেও কোন লাভ হয়নি। শেষমেষ এই বদঅভ্যাসের শাস্তি স্বরূপ তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এরপরেও বিধানবাবু মদ্যপান থেকে একদিনও বিরত থাকেন না। শুধু তাই নয় ,তাঁর পত্নী কাকলীদেবী টেলারিংয়ের কাজ করে যা উপার্জন করেন তাতেও তিনি জবরদস্তি ভাগ বসিয়ে সেই টাকায় মদ্যপান করেন।মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে সারা পশ্চিমবঙ্গে করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকল হু হু করে। মেদিনীপুর জেলার কুমার পাড়া গ্রামও করোনার হাত থেকে রেহাই পেল না। শহরের মত সংক্রমণের হার এত বেশি না হলেও গ্রামেও বেশকিছু মানুষ আক্রান্ত হতে লাগলো।
গত তিন-চার দিন ধরে মানসের তিন বছরের ছোট্ট বোন অনুজা জ্বরে ভুগছিল। তিন বৎসর পূর্বে ভারতে যখন প্রথম করোনার সংক্রমণ হতে শুরু করেছিল সেই সময় ওর জন্ম হয়। সেই সময় থেকেই এখানকার মানুষ কোয়ারেন্টাইন শব্দটার সঙ্গে পরিচিতি লাভ করে ।
তাই ওর মা ওকে কোয়ারেন্টাইন বলে ডাকে।বিধানবাবু স্থির করলেন যে অনুজার কলকাতায় কোভিড টেস্ট করাবেন এবং প্রয়োজন হলে ওখানেই ভর্তি করাবেন। এতে অনুজার মা ভীষণ আপত্তি করলেন এবং বললেন যে মেদিনীপুরে তো এখন কোভিড টেস্ট হচ্ছে এবং কোভিড পজিটিভ রোগীদের ভর্তিও নিচ্ছে। বিধানবাবু বললেন, ” মোটেই না,এখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা আমার জানা অছে! বহু রোগী ভুল চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। আমি মেয়েকে কলকাতা নিয়ে যাবোই।”
বিধানবাবুর নাছোড়বান্দা জেদের কাছে কাকলীদেবী হার মানলেন।
লকডাউনের জন্য প্রায় সব লোকাল এবং এক্সপ্রেস ট্রেন বন্ধ থাকায় একটা মারুতি ভ্যান ভাড়া করে অনুজাকে কলকাতা নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। মারুতিতে সপরিবারে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। বিধানবাবু বললেন, ” চিন্তার কোন কারণ নেই,ওখানে আমার এক বন্ধু থাকে,কোন অসুবিধায় পড়লে ও হেল্প করবে।”
চৌরঙ্গীর মোড়ে রেড সিগন্যাল থাকায় মারুতি থামলো। অনুজা তার বাবার মোবাইলে গেম খেলছিল। মারুতির ডানদিক ঘেঁষে একটা এম্বুলেন্স এসে থামলো। এদের সবার দৃষ্টি পড়লো এম্বুলেন্স-এর উপর। অনুজা গেম খেলা বন্ধ করে মারুতির বাইরের দিকে নজর দিল। নজর দিতেই তার কানে একটা আওয়াজ ভেসে এলো “বাঁচাও বাঁচাও”। বিধানবাবু বললেন যে কোন রোগী রোগের যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে হয়তো। কিন্তু ছোট্ট অনুজার মনে সন্দেহ ঘনীভূত হলো, “রোগী বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করে না,বরং কেউ কিডনাপ হলে এমন চিৎকার করে।”
ছোট অনুজার শ্রবণশক্তি এবং বুদ্ধিমত্তা। অন্যদের তুলনায় বেশি। সে তখনই তার বাবাকে বলল যে তাকে এখনই গাড়ি থেকে একটু নামতে হবে এবং সে তখনই মারুতি থেকে নেমে পড়লো। তারপর এম্বুলেন্সের নাম্বার মনে মনে নোট করে নিল। তারপর এক মুহূর্ত দেরি না করে পুলিশের টোল ফ্রি নাম্বারে ফোন করে ব্যাপারটা জানিয়ে দিল। এরপর অনুজা বাবাকে বললো একটু অপেক্ষা করতে।
মেদিনীপুর কোতয়ালী থানা থেকে চৌরঙ্গীর দূরত্ব মাত্র আট কিলোমিটার। দশ মিনিটের মধ্যে সিনিয়ার ইন্সপেক্টর সহ এক ভ্যান পুলিশ হাজির হলো চৌরঙ্গীর মোড়ে। উনারা অনুজার বাবার কাছ থেকে জানতে পারলেন যে ঐ এম্বুলেন্সটি এন.এইচ.সিক্সের দিকে চলে গেছে। ইন্সপেক্টর তখনই নিকটবর্তী ট্রাফিক এবং টোল প্লাজায় ফোন করে জানিয়ে দিলেন ঐ এম্বুলেন্সের নাম্বার এবং এও বললেন যে এম্বুলেন্সে কে কে আছে চেক করে ছাড়তে। এরপর তিনি ছোট্ট অনুজার নাম জিজ্ঞেস করলেন। কাকলীদেবী বললেন ,”আমার মেয়েকে আমি ‘কোয়ারেন্টিনা’ বলে ডাকি।” “বাহ্,বেশ আনকমন নাম “-বললেন ইন্সপেক্টর।
এরপর ইন্সপেক্টর তাঁর নিজের মোবাইল নাম্বার কাকলীদেবীকে দিয়ে বললেন, “আমার নাম্বার নোট করে রাখুন,কোন অসুবিধায় পড়লে জানাবেন।”। যদিও বিধানবাবু বললেন, “না না, কি আর অসুবিধা হবে? ধন্যবাদ।”এর পনেরো মিনিট পর পঁচিশ কিলোমিটার দূরে একটা টোল প্লাজায় পুলিশ ঐ এম্বুলেন্স থামিয়ে তল্লাশি করে জানতে পারেন সত্যি সত্যিই ওতে যে মেয়েটা চিৎকার করছিল সে রোগী নয়। তাকে কিডনাপড্ করা হয়েছে। এম্বুলেন্সের চালক সহ কিডনাপ কাণ্ডে জড়িত আরও দুজনকে পুলিশ গ্ৰেপ্তার করেন। মেয়েটার বয়স আঠারোর উপরে,ওকে চন্দ্রকোণা রোড থেকে কিডনাপ করে কলকাতা নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল কোন নিষিদ্ধ পল্লীতে বিক্রি করে দেওয়ার জন্য। যাইহোক ওকে উদ্ধার করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়।
এর দু দিন পর। ইন্সপেক্টর সাহেব গত দুদিন ধরে ভীষণ উতলা হচ্ছিলেন এই ভেবে যে যার জন্য মেয়েটাকে উদ্ধার করে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারলাম সেই কোয়ারেন্টিনাকে একটা ‘থ্যাংকস’ জানাবার সুযোগ হলো না। কেননা,উনার কাছে কোয়ারেন্টিনার বাড়ির মোবাইল নাম্বারও ছিল না।
হঠাৎ সকাল সাতটা নাগাদ ইন্সপেক্টর সাহেবের মোবাইলটা বেজে উঠলো। ” ইন্সপেক্টর সাহেব আমি কোয়ারেন্টিনার মা বলছি। কলকাতার একটা হাসপাতালে করোনা সন্দেহে আমার মেয়েকে ভর্তি করেছিলাম দু দিন আগে। হাসপাতাল কতৃপক্ষ কিছুতেই মেয়ের সাথে আমাকে দেখা করতে দিচ্ছেন না। খুব ভয় লাগছে।”
ইন্সপেক্টর বললেন ,” বেশি চিন্তিত হবেন না, আমি তিন চার ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি। আর হ্যাঁ, এটা আপনার মোবাইল নাম্বার তো?”
কাকলীদেবী বললেন, ” না, ওর বাবা মোবাইলটা আমাকে একবারও দিচ্ছে না কল করার জন্য। শুধু একটাই কথা বলছে যে অযথা ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ নেই,বরং সমস্যা আছে। আমি একটা অপরিচিত লোকের মোবাইল থেকে আপনাকে ফোন করছি।”
ইন্সপেক্টর এটা শুনে বেশ অবাক হলেন। সকাল এগারোটার সময় ইন্সপেক্টর সাহেব কলকাতার উক্ত হাসপাতালে পৌঁছে গেলেন এবং কাকালীদেবীর সাথে দেখা করলেন। দেখলেন কাকালীদেবীর দু চোখ বেয়ে অঝোর ধারা ঝরে পড়ছে। তিনি কাঁদতে কাঁদতে ইন্সপেক্টরকে বললেন, “একটু আগে হাসপাতাল থেকে জানানো হলো যে আমার মেয়ে করোনায় মারা গেছে। এটা হতে পারে না। তাছাড়া ও যদি সত্যিকারের করোনা পজিটিভ ছিল তাহলে হাসপাতাল কতৃপক্ষ একবারও আমাদের জানায় নি কেন? “
ইন্সপেক্টর জিজ্ঞেস করলেন যে কোয়ারেন্টিনা কোন বিল্ডিংয়ে ভর্তি ছিল। কাকলীদেবী আঙুল দেখিয়ে বললেন,” ঐ যে দোতলায় বিধানব্লকে।”ইন্সপেক্টর কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ঐ বিধানব্লকের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। দোতলার একটা জানালাগুলো খোলা ছিল। হঠাৎ জানালা দিয়ে একটা ছোট্ট হাত নাড়া দিয়ে উঠলো এবং উচ্চস্বরে বললো, “পুলিশ আঙ্কেল,আমি কোয়ারেন্টিনা, আমাকে বাঁচাও।”
ইন্সপেক্টরের কানে কোয়ারেন্টিনার আর্ত চিৎকার পৌঁছে গেল। তিনি আর দেরি না করে দ্রুত বিধানব্লকে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু গেটকীপার বাধা দিলেন। ইন্সপেক্টর আই.কার্ড দেখিয়ে ধমক দিয়ে সোজা উপরে উঠে গেলেন। উপরে উঠে দেখলেন বিধানব্লকের এন্ট্রান্সের সামনে কয়েকজন মস্তান গোছের লোক দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মূলপাণ্ডা উনাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি চাই আপনার?”
—-“এখানে অনুজা নামে একটা বাচ্চা মেয়ে ভর্তি ছিল। ওকে নিতে এসেছি।”
—–“ও করোনায় মারা গেছে। এই হাসপাতালের রুল অনুযায়ী করোনা পেসেন্টের লাশ ফেরৎ দেওয়া হয় না।”
——(মূলপাণ্ডার গালে সজোরে এক চড় মেরে) “তাহলে আমি কি অনুজার ভূতের সাথে কথা বললাম?” ও আমাকে নিজে উপর থেকে ওর নাম জানিয়েছে। তাই ওকে নিতে এসেছি।”এরপর ইন্সপেক্টর সজোরে বিধানব্লকের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন এবং কোয়ারেন্টিনা (অনুজা)-কে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। নীচে এসে তিনি বিধানবাবুর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করেন, “কি বিধানবাবু, আপনি নাকি আপনার মোবাইল পর্যন্ত আপনার পত্নীকে কল করার জন্য ব্যবহার করতে দেননি? আপনি সত্যিই আপনার মেয়ের মঙ্গল চান? আচ্ছা শুনেছিলাম, এখানে আপনার কে বন্ধু আছে? উনার নাম ,ঠিকানা বলবেন?”
বিধানবাবু নতমস্তকে নিরুত্তর থাকলেন। ইন্সপেক্টরের ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হলো না। তিনি কলকাতা কলকাতার বিধাননগর থানায় উক্ত হাসপাতালের নামে অভিযোগ দায়ের করলেন। কলকাতা পুলিশ দলবল নিয়ে এলেন ঐ হাসপাতালে। তাঁরা জানতে পারলেন যে ঐ হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার নামে মানুষের মূল্যবান অঙ্গ বিক্রির ব্যবসা চলছে। অপারেশন করে কিডনি, হার্টের মতো অমূল্য অঙ্গ বের করে রোগীকে করোনায় মৃত বলে ঘোষনা করে দেওয়া হচ্ছে এবং করোনার সংক্রমনের ভয় দেখিয়ে রোগীর আত্মীয়দের সাথে কোনরকম সম্পর্ক বা যোগাযোগ করতে দেওয়া হচ্ছে না । এরপর ঐ হাসপাতাল সিজ্ড করে দেওয়া হয় এবং আদালতের রায়ে চিকিৎসাকে হাতিয়ার করে এই ঘৃণ্য কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ডাক্তার,নার্স এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তি ও জরিমানার ব্যবস্থা করা হয়।
কোয়ারেন্টিনা সপরিবারে বাড়িতেই আছে। সুস্থ আছে। ওর করোনাই হয়নি। তবুও জোরজবরদস্তি ওর বাবা বিধানবাবু কলকাতার ঐ হাসপাতালে মেয়েকে ভর্তি করিয়েছিলেন। কারণ বিধানবাবু জানতেন ঐ হাসপাতালে শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক রোগীদের মূল্যবান অঙ্গ বিক্রির কারবার চলে। এইজন্য বিধানবাবুর সঙ্গে আগে থেকেই হাসপাতালের এক দালালের সাথে মোটা টাকার চুক্তি হয়। ইন্সপেক্টর সাহেব এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না যে বিধানবাবু টাকার জন্য নিজের তিন বছরের মেয়েকে—-,ছি ছি। যদিও তিনি ব্যাপারটা গোপন রেখে নিজের পরিপারের কাছে বিধানবাবুকে ছোট হতে দেননি। তবে কোয়ারেন্টিনার ইন্সপেক্টর সাহেবের একটা দীর্ঘমেয়াদি সুন্দর সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেল। এখনও পরস্পরের সাথে ফোনালাপ হয়। আর বিধানবাবু এখন আগের চেয়ে অনেক ভদ্র হয়েছেন, মদ্যপান ও কমিয়ে দিয়েছেন।
-
গল্প- এক প্রতিবাদিনী
।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ।।
এক প্রতিবাদিনী
-অমিত কুমার জানাসরাসরি নারী সুরক্ষা দপ্তর থেকে অফিসাররা সকাল দশটা নাগাদ যুথিকার বাড়িতে পৌঁছে গেল। এতদিনে সোসাল মিডিয়া এবং নিউজ চ্যানেলের সৌজন্যে যুথিকার প্রতিবাদীসত্তা বেশ বিখ্যাত হয়ে গেছে। শহরের সুবিদিত ‘দত্ত এন্টারপ্রাইজের’ স্বত্বাধিকারীর একমাত্র ছেলের পত্নী যুথিকা। তিন বছর হলো যুথিকার বিয়ে হয়েছে।
নারী সুরক্ষা দপ্তরের দুজন অফিসার তিনতলা বাড়িটার সামনে পৌঁছে বেশ নিস্তব্ধতা অনুভব করলো। বিখ্যাত অভিজাত পরিবারেও আজ যেন একেবারে নীরবতার ছায়া নেমে এসেছে। অনেক ডাকাডাকি করেও কারও কোন সাড়া না পেয়ে তারা নীচতলার একটা ঘরের দরজায় টোকা দিল।
দরজাটা সামান্য ঠেলতেই খুলে গেল। ঘরে টিভিতে কার্টুন চলছিল। টিভির সামনে একটা চেয়ার। কিন্তু কে টিভি দেখছে? তারা চেয়ায়ের সামনে গিয়ে দেখতে পেল একটা আড়াই-তিন বছরের ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে কার্টুন দেখছে। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে অর্ধোচ্চারিত মনোগ্ৰাহী মিষ্টি ভাষায় জিজ্ঞেস করলো,-” তোমরা কে? তোমাদের নাম কি? “
এইটুকু একটা বাচ্চার এহেন চটপটে বাক্যালাপের ভঙ্গিতে অফিসাররা স্তম্ভিত হয়ে গেল। তারা জিজ্ঞেস করলো ,” সোনামনি, তুমিই কি যুথিকাদেবীর মেয়ে?” মেয়েটা মাথা নেড়ে ইতিবাচক উত্তর দিল এবং বললো তার নাম রিতিকা। ছোট্ট রিতিকা তাদের বসতে বললো।কিছুক্ষণ পর যুথিকা বাথরুম থেকে স্নান সেরে এল। অফিসাররা নিজেদের পরিচয় দিলেন। এরপর যুথিকা বললো,-” আপনারা এসেছেন ভালো কথা,তবে কেউ আমার সঙ্গ দিক আর না দিক আমাকে এ জীবন যুদ্ধে জয়ী তো হতেই হবে। এছাড়া অন্য উপায় নেই।”
অফিসাররা তার বিবাহিতা জীবনের তিন বছরের কাহিনী জানতে চাইলেন। যুথিকা গোড়া থেকে বলতে শুরু করলো,-” বছর তিনেক আগে আমি আর আমার মা ‘দত্ত এন্টারপ্রাইজে’ গিয়েছিলাম মার্কেটিং করতে। ওখানেই দত্তদের একমাত্র ছেলে রাকেশ দত্তের সাথে আমার পরিচয় হয়। প্রথম সাক্ষাতেই ও আমাকে প্রেম নিবেদন করে এবং মোবাইল নম্বর চায়। প্রথমে একেবারেই বিশ্বাস হচ্ছিল না যে এরকম একজন বিখ্যাত অভিজাত পরিবারের ছেলে আমাকে সত্যিই ভালবাসে কিনা। কিন্তু অতঃপর ও আমাকে একটা দামী এনড্রয়েড মোবাইল কিনে দেয় এবং কিছুদিনের মধ্যে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেয়। তারপর বিয়ের পাকাকথাও হয়ে যায়। আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। আমার মা অঙ্গনওয়াড়ী স্কুলে চাকরি করে। তা থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়েই যথাসম্ভব চেষ্টায় বিয়ের গয়নাসামগ্ৰী কেনাকাটা করা হয় এবং আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের সময় শ্বশুরবাড়ির লোকেদের মিষ্টি ব্যবহারের সুদক্ষ অভিনয় আমার বিন্দুমাত্র বোধগম্য হয় নি।
বিয়ের প্রায় দুবছর পর থেকে ওদের আসল চেহারা ক্রমশ আমার সামনে স্পষ্ট হতে থাকে। যে কোন উপায়েই আমাকে বাড়ি থেকে বহিষ্কার করার চেষ্টায় তৎপর হতে থাকে। রাকেশ আমাকে ‘সামান্য বাড়ির মেয়ে’ বলে গালিগালাজ করতে থাকে। কিন্তু খুব অদ্ভুত লাগত যখন দেখতাম আমার শ্বশুর এবং শাশুড়িও তাদের একমাত্র এই আদরের ছেলেকে পুরো সমর্থন করতো। প্রথমে মনে হতো এই দুর্ব্যবহার বোধহয় ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে। কিন্তু না , ঠিক এর উল্টোটাই ঘটতে থাকলো।
তারপর একদিন কানপেতে ওদের গোপন আলোচনা শুনতে পেলাম। আলোচনার সারমর্ম এইটাই যে আমাকে তাড়িয়ে দিয়ে রাকেশের নতুন করে বিয়ে দেওয়া হবে। আমি ভীষণ শোকাহত হয়ে গিয়েছিলাম এবং আসন্ন বিপদের কথা ভেবে জড়োসড়ো হয়ে গিয়েছিলাম।
কিন্তু তারপর ভাবলাম এত সহজে হার মেনে নিলে চলবে না। এইটাই তো আমার প্রকৃত ঘর। আমি বাপের বাড়িতে গিয়ে কেন থাকব? নিজেকে বেশ শক্ত করলাম এবং এর একটা প্রতিকার খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। তখন আমার কোলে দেড় বছরের মেয়ে রিতিকা। ওকেও বড়ো করে তুলতে হবে তো।এরপর একদিন বিকেলের দিকে বাড়িতে কেউ ছিল না। হঠাৎ আমার রুমের দরজায় কেউ টোকা দিল। দরজা খুলতেই বলপূর্বক আমার রুমে প্রবেশ করলো এক যুবক। ওকে কোথায় দেখেছি ঠিক মনে করতে পারছিলাম না। ও আমার গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করছিল। আমি তার আগেই অতি সাবধানে মোবাইলের ভিডিও রেকর্ডারটা স্টার্ট করে দিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গেই কোথা থেকে হঠাৎ রুমের সামনে হাজির হলো আমার বাড়ির লোকজন। রাকেশ বললো,-” ছি ছি, শেষকালে আমার বন্ধুর সঙ্গে তুমি!” শ্বশুর,শাশুড়ি সবাই আমাকে দুশ্চরিত্রা বলে বিশ্রী ভাষায় গালি দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বললো।
আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই নি মোটেই। তখনই আমার বান্ধবী উকিল (দিশা)- কে ফোন করে সব জানালাম এবং শ্বশুরবাড়ির বাড়ির বিরুদ্ধে বধূ নির্যাতনের মামলা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। শহরের আদালতে মামলা দায়ের করা হলো। দিশা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আমাকে আশ্বস্ত করেছিল যে আমি মামলা জিতবোই। এখন আমি মামলা জেতার মুখেই।”
অফিসাররা বিস্মিত হয়ে বললেন ,-” এমন কি প্রমাণ আছে যে আপনি মামলা জিতবেনই?”
যুথিকা বললো,-” ভিডিও রেকর্ড। আমাকে ঘরছাড়া করার ষড়যন্ত্রের রেকর্ড এবং রাকেশের বন্ধু যে নোংরামি করার চেষ্টা করেছিল তার রেকর্ড। আমি এই কাজটা খুব সাবধানেই করেছিলাম। শুধু তাই নয় রেকর্ডেড ভিডিও দিশার মোবাইলেও পাঠিয়ে দিয়েছিলাম যাতে আমার মোবাইল চুরি বা নষ্ট হয়ে গেলেও ভিডিও না নষ্ট হয়। এ সংগ্ৰামে আমার সম্মান এবং জীবন দুটোই রক্ষা করতে হবে আমাকেই। আমি তো ভীষণ একা।
শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে মামলা করেছি,তাই এই নীচের রুমটাতে ঠাঁই হয়েছে। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতেই আছি। আর কিছুদিনের মধ্যে পূর্ণ মর্যাদা ফিরে পাবোই পাবো এবং ওদেরকেও আমার কাছে অপরাধ স্বীকার করতেই হবে।”
যুথিকার সুন্দর এবং প্রতিবাদী দুটো চোখ বেয়ে নেমে এল অশ্রুধারা।
পুরো ঘটনা শুনে নারী সুরক্ষা দপ্তরের অফিসাররা বললেন,-” আপনি এই মামলা অবশ্যই জিতবেন। কোনরকম অসুবিধায় পড়লে আমাদের জানাবেন। আমরাও আপনার পাশে আছি। আপনার অধিকার এবং যর্যাদা আপনি অতি শীঘ্রই ফিরে পাবেন। শুভ কামনা রইলো।” -
গল্প- এক বর্ষায়
এক বর্ষায়
– অমিত কুমার জানা2008 সালের আগষ্ট মাসের শেষ সপ্তাহ। সারা সপ্তাহ জুড়ে ঝির ঝির বৃষ্টি ঝরছিল। নারায়ণপুর গ্ৰামের খাল -বিল সবই জলে থৈ থৈ করছিল। সেই বৃষ্টিতেই রবি খেলার মাঠে পাড়ার বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলায় মেতে ছিল। বৃষ্টিতে ভিজে কাদায় গড়াগড়ি খেয়ে বল খেলার যে অনাবিল আনন্দ তা বোধহয় পনের বছরের রবি ভালো করেই জানে।
কর্দমাক্ত মাঠের উপর ছেলেরা ফুটবল খেলছিল এবং গড়াগড়ি খাচ্ছিল। এমন সময় রবির মা বহুছিদ্রবিশিষ্ট একটি ছাতা মাথায় নিয়ে রবিকে ডাকতে ডাকতে মাঠে চলে এলেন এবং বললেন, “এখনই ঘরে চল, বৃষ্টিতে আর ভিজিস না, শরীর খারাপ হবে। তোর দাদা এইমাত্র বাড়ি এসেছে।” রবির দাদা রঘু পড়াশোনা সূত্রে খড়গপুর শহরে থাকে। দাদার কথা শোনামাত্র রবি খেলা ছেড়ে নিজের ঘরের দিকে দৌড় লাগাল রুদ্ধশ্বাসে। তার বাকি খেলার সঙ্গীরা কর্দমাক্ত শরীরে দৌড়ে গিয়ে লাফিয়ে পড়লো মাঠের পার্শ্ববর্তী কপালেশ্বরী খালে। বছরের অন্যান্য সময়ে এই ছোট্ট নদীটি শুকনো থাকলেও এই বর্ষার মরসুমে বেশ স্রোতস্বিনী হয়ে ওঠে।বৃষ্টি স্নাত কর্দমাক্ত রবি বাড়ি ফিরে এল। প্রায় মাসতিনেক পর তার দাদা শহর থেকে বাড়িতে এসেছে। রঘু কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বহু দিন পর দুই ভাইয়ের সাক্ষাৎ হলো। এমনিতে ছেলেবেলায় দু’জনের একেবারেই বনিবনা হতো না, কিন্তু এখন তারা অনেকটাই পাল্টে গেছে। সন্ধ্যার দিকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। রবির মা খানিক চিন্তিত হয়ে বললেন, “এবারও বন্যা হবে না তো! ওরকম যেন আর না হয়…” এই বলে ঠাকুরের নাম করলেন। রাত্রি নয়টা নাগাদ মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। লোডশেডিং, বাড়িতে কেবল হ্যারিকেনের আলো। বাড়ির বাইরে বর্ষার প্রকৃতি নিকষ কালো আঁধারে একেবারে আচ্ছন্ন।
এদিকে বইখাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রবি নিদ্রাচ্ছন্ন। ঘুমন্ত অবস্থায় পায়ের যন্ত্রণায় ছটকাচ্ছে। তার মা এসে বকুনি শুরু করলেন- “কতবার বলেছি বর্ষায় খেলতে যাস না..তোকে নিয়ে আর পারলাম না…তোকেও কোথাও বাইরে দিয়ে আসবো।”
এই বলে তিনি রবির পায়ে বাটাহলুদ সহ গরম তেল লাগিয়ে দিলেন। ছেলের ছোটখাটো দুষ্টুমি সব মায়েরাই তো প্রশ্রয় দেয়।সকালে যখন সবার ঘুম ভাঙলো রবিরা দেখতে পেল কপালেশ্বরীর জল দু’কূল ছাপিয়ে তাদের বাড়ি থেকে ষাট-সত্তর ফুট দূরে থাকা আমগাছটার তলদেশ স্পর্শ করেছে। পাড়াপ্রতিবেশীরা আসন্ন বন্যার অশনিসংকেত পেয়ে তার কারণ এবং ভবিতব্য কুফল সম্পর্কে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করে দিল। কেউ কেউ বললো যে কপালেশ্বরী দীর্ঘদিন সংস্কার না করার জন্যই এই দুরবস্থা।
এদিকে টিভি এবং রেডিওর আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুসারে বৃষ্টি থামবার কোন সম্ভাবনা নেই। বরং সময়ের সঙ্গে উপর্যুপরি মুষলধারে বৃষ্টি হতে লাগলো। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া।দুপুরের দিকে রবির মা রান্নার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আসন্ন বিপদের অনুভূতির ছাপ তাঁর চোখে মুখে স্পষ্ট পরিলক্ষিত হলো। তিনি বড়ছেলে রঘুকে পাঠালেন কিছু মশলা বাজার করে আনতে। রঘু তাদের সেই পুরানো বহুছিদ্রবিশিষ্ট ছাতাটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। অর্ধসিক্ত শরীরে রঘু পৌঁছে গেল অনতিদূরের বাদলদার ভূসিমাল দোকানে। সেখানে আচমকা দেখা হয়ে গেল তার হৃদয়াকাঙ্খিত স্বপ্নসুন্দরী পিয়ালীর সঙ্গে। সেই স্কুলজীবন থেকেই রঘু মনে মনে পিয়ালীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। পিয়ালীও এটা জানে। কিন্তু উভয়পক্ষ থেকেই পরস্পরের প্রতি এখনও মৌখিকভাবে কোন প্রেম নিবেদন হয় নি। স্কুলের পড়া শেষ করে রঘু শহরে চলে গেল, আর পিয়ালী এখনও নারায়ণপুর গ্ৰামেই থাকে। পিয়ালী এতক্ষণ বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় ছিল, কিন্তু থামেনি। সে রঘুর হাতে ছাতাটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো রঘুকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলবে কিনা। এদিকে রঘুও ভাবছিল যদি সে পিয়ালীকে তার ছত্রতলে সযত্নে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারতো! শেষমেশ রঘুই তার ছাতার তলে পিয়ালীকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এলো এবং যখন তারা পৌঁছাল দু’জনেই বৃষ্টির জলে ভিজে একাকার। পিয়ালী তার মিষ্টি মুচকি হাসিতে রঘুকে বিদায় জানালো। রঘু বাজার করে বাড়ি ফিরলো। তার হৃদয়ে তখন বৃষ্টি ভেজা প্রেমের শিহরণ।
দুপুর দু’টো নাগাদ কপালেশ্বরীর জল রঘুদের মাটির বাড়ি স্পর্শ করলো। জলের উচ্চতা বাড়তে লাগলো খুব দ্রুত। রঘুর মা, বাবাসহ সবাই ঘরের বিশেষ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং মূল্যবান কাগজপত্র গোছাতে শুরু করলো। বাড়িতে মজুত চাল, মুড়ির টিন ইত্যাদি একে একে নিয়ে যাওয়া হলো গ্ৰামের সবচেয়ে উঁচু স্থান সেই হাইস্কুলে। গবাদি পশুদের দড়ি খুলে দেওয়া হলো, তারা সাঁতরে পার হয়ে গেল বন্যার জল। কিন্তু আটকা পড়লো একটি দুগ্ধপোষ্য ছোট্ট বাছুর। সে এখনও সাঁতার শেখে নি। রবি তাকে ঘাড়ে তুলে বেশ কষ্টে প্লাবিত জল অতিক্রম করে স্কুল মাঠে নিয়ে এলো।
সন্ধ্যা নাগাদ কপালেশ্বরীর তীরবর্তী সমস্ত মানুষ জন ঘর ছেড়ে আশ্রয় নিল স্কুলটিতে।ক্রমশ জলস্তর বেড়েই চলেছে। একটা একটা করে মাটির ঘর ভেঙে পড়ছে। নিকষ আঁধার থেকে প্রায়ই শোনা যাচ্ছে অসহায় কুকুরের আর্তনাদ। কয়েকটা ভাগ্যবান কুকুর জল বিপদসীমা অতিক্রমের পূর্বেই আশ্রয় নিয়েছিল স্কুলমাঠে। বাকিরা বোধহয় বন্যার স্রোতে বেপাত্তা। স্কুল বারান্দায় কয়েকটা লম্ফ এবং হ্যারিকেনের আলো মিটমিট করে জ্বলছে। বাইরের কালো আঁধারেও দিগন্ত বিস্তৃত বন্যার জলের অস্তিত্বে সবার বুক অজানা ভয়ে কেঁপে উঠছিল। মাঝেমধ্যে শেয়ালের বেসুরো ডাক ভেসে আসছিল, সঙ্গে ঝিঁঝি পোকার অসহ শব্দ। সব মিলিয়ে বন্যার সেই রাতটা ভয় এবং আশঙ্কায় রহস্যময়ী হয়ে উঠেছিল।
পরেরদিন সকাল হতে না হতেই রবি এবং রঘুর মা তৎপর হয়ে সর্বাগ্ৰে পৌঁছালো তাদের সেই মাটির কাঁথের বাড়িটা দেখতে। কিন্তু, একি! রবির মা নিশ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকলেন। তাঁর দু’চোখ বেয়ে নেমে আসা অশ্রুধারা ফোঁটায় ফোঁটায় বন্যার জলে মিশে যাচ্ছে। সেখানে তাদের বাড়ির কোন অস্তিত্ব ছিল না। ভেঙে পড়া বাড়ির উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল বিক্ষুব্ধ কপালেশ্বরীর সর্বগ্ৰাসী জলপ্রবাহ। বাড়ির প্রায় সমস্ত জিনিসপত্র, বই, খাতা, আসবাব তখন জলের তলে তলিয়ে গেছে কিংবা ভেসে কোথায় চলে গেছে। রবি এবং রঘু মাকে এসে জড়িয়ে ধরে বললো, “বন্যার জল সরে গেলে এখানেই তো আমরা আবার ছিটাবেড়ার ছোট্ট বাড়ি বানাবো। “
-
কবিতা- যদি তুমি
যদি তুমি…
– অমিত কুমার জানারৌদ্রতপ্ত পরিবেশে অভিযোজিত হতে পারি
যদি তুমি শ্রাবণের জলধর থেকে ঝরে পড়ো।
মনের কোণে হতাশার মেঘ জমিয়ে রাখতে পারি
যদি তুমি নতুন প্রভাতের আলো হয়ে এসো।
অসহ দাবদাহ অক্লেশে সইতে পারি
যদি তুমি দখিণা বাতাস হয়ে এস।
তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো অপেক্ষা করতে পারি
যদি তুমি বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ো।
মরুর তপ্ত বালিতে হেঁটে যেতে পারি
যদি তূ্মি মরুদ্যান রূপে দেখা দাও।
বেদনাদগ্ধ বুকেও মুখে হাসি মাখতে পারি
যদি সে হাসির উৎস শুধু তুমি হও।
তোমায় নিয়ে স্বপ্নের আল্পনা আঁকতে পারি
যদি তুমি আমার অক্ষয় আল্পনা হয়ে থেকো। -
মন-পাখি
মন-পাখি
-অমিত কুমার জানাখাঁচায় বন্দী বিহঙ্গের কি যন্ত্রণা!
স্তব্ধ হয়েছে তার অবাধ উড্ডয়ন,
তেমনই হতাশা ক্লিষ্ট মন-পাখি-
যন্ত্রণায় পঙ্গু হয়েছে তার স্ফুরণ।মন-পাখির হৃদয়-দেওয়াল জুড়ে
কত রঙিন স্বপ্নরা ছিল আঁকা,
একে একে সব বিবর্ণ হয়েছে
মন-পাখি যেন খাঁচায় বন্দী একা!মন-পাখি তার কল্পনার তুলিতে
আবারও এঁকেছে রঙিন আল্পনা,
শান্তির খোঁজে পাগলপারা মন
সুখ-স্বপ্ন দেখতে তার নেইকো মানা।মন-পাখি পাখনা মেলি
উড়ে যেতে যায় তেপান্তরে চলি
যেথায় শুধু খোলা হাওয়া
যেথায় বিচরণের অমূল্য স্বাধীনতা পাওয়া। -
ভালোর পথযাত্রী
ভালোর পথযাত্রী
-অমিত কুমার জানা‘ভালো’ সুগন্ধি কুসুম সম ছড়ায় সৌরভ,
ভালো হওয়া তাই মনুষ্যত্বের গৌরব।
ভালো সূর্যালোক সম আলোক ছড়ায়,
মন্দের তমসা সেই আলোকেই ঘুচায়।
উত্তম পথের পথিক সততায় করে পাথেয়
অধম বড়ই অবুঝ সততায় করে হেয়।
ভালো হওয়া কাঙ্খিত,সমাজের হিতকর,
তাহলে সবাই সুখী হয় মনুষ্য আপামর।
ভালো হতে হয়তো পেরতে হয় কাঁটাপথ,
তবুও পরিশেষে মেলে সন্তুষ্টির বিজয়রথ।
ভালোর সংস্পর্শে অনেকে হয় ভালো,
ভালোরাই অধমের চোখে জ্বালে জ্ঞানের আলো।
কুকর্মকারী হয়তো পায় সাময়িক সুখ,
ভবিষ্যতে তার কুফলস্বরূপ পায় অযাচিত দুখ।
তাই আমিও ভালো হতে হই সদাসচেষ্ট,
ভালোর পথের পথিক হতে বুক পেতে নেব সব কষ্ট। -
অবিস্মরণীয় উপহার
অবিস্মরণীয় উপহার
-অমিত কুমার জানাদ্বাদশ শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র সৈকত পড়াশোনায় খুব ভালো না হলেও খেলাধুলা এবং ছবি আঁকায় বেশ দক্ষ। সৈকত বরাবরই মিতভাষী এবং লাজুক প্রকৃতির ছেলে। ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠান শুরু হলো। সৈকত অন্তরে একটা আনন্দমূলক চাপা উত্তেজনা অনুভব করলো। বিশেষত তার হাইজাম্পের দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে যখন স্কুলের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক মহাশয়রা হাততালি দেয় তখন যে সে কি অপার্থিব আনন্দ পায় তা সেই-ই জানে। শুধু তাই নয়, দ্বাদশ শ্রেণীর সবচেয়ে সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী মেয়ে সোনালী ও তার ক্রীড়াদক্ষতার বেশ প্রশংসা করে।
যথাসময়ে হাইজাম্প শুরু হলো। চারিদিকে দর্শকের সমাগম। কিন্তু সৈকত সোনালীকে দেখতে পাচ্ছে না কোথাও। তার মনটা যেন মনখারাপের মেঘে ছেয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় সেখানে হাজির হলো সেই অষ্টাদশী অপরূপা সুন্দরী। সৈকতের প্রেমাতুর মন আবেগমাখা খুশির জোয়ারে ভেসে গেল।
সে পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির হাইজাম্প দিয়ে স্কুলে নতুন রেকর্ড করলো।
পুরস্কার বিতরণী আনুষ্ঠানের দিন মঞ্চ থেকে পুরস্কার হাতে নামছিল সৈকত। শত হাততালির মাঝেও সে যেন সোনালীর মুখ থেকে ‘অভিনন্দন’ কথাটা শুনতে পেল। এই কোকিল কন্ঠ তার কাছে যেন শ্রেষ্ঠ উপহার মনে হলো। সে লাজুক চোখে প্রেমপূর্ণ নির্মল দৃষ্টিতে সোনালীর দিকে তাকালো।দিনটা ছিল ৩১শে ডিসেম্বর। চতুর্থ পিরিয়ডে ক্লাসে রসায়ন বিভাগের শিক্ষক প্রবেশ করলেন। রাসায়নিক সমীকরণের গাণিতিক সমস্যাগুলো সৈকতকে ক্রমশ বেশ সমস্যায় ফেলছিল। ক্লাস শেষ হলে সে বলে উঠলো ,-“কারোর কাছে রসায়নের রেফারেন্স বই থাকলে আমাকে দিস তো, খুব প্রয়োজন।” তার কথা বোধহয় তার সহপাঠীদের কাছে সেদিন ততটা গুরুত্ব পায়নি।
আগামীকাল ২০১৯সালের ১লা জানুয়ারি, অর্থাৎ নতুন একটা বছর শুরু হতে চলেছে। সহপাঠীরা কে কাকে গ্ৰিটিংস কার্ডের মাধ্যমে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানাবে তাই নিয়ে আলোচনা করছিল ।
সৈকতও সেই চিন্তাতেই মশগুল ছিল। সে এবার মনে মনে ঠিক করেই ফেললো যে সে সোনালীকে গ্ৰিটিংস কার্ডের মাধ্যমে প্রপোজ করবেই। ১লা জানুয়ারি স্কুল ছুটি। জানুয়ারির ২ তারিখ সৈকত যখন ক্লাসে উপস্থিত হলো তখন সোনালীর সামনে হাইবেঞ্চের উপর গ্ৰিটিংস কার্ডে ভরে গেছে। সোনিলীকে গ্ৰিটিংস দিয়ে প্রপোজ করেছে বেশ কয়েকজন ছেলে। তা দেখে সৈকত যেন নিজের পরাজয় অনুভব করলো। সে ভেতর থেকে ভেঙে পড়ছিল। ঠিক সেই সময় সোনালী সৈকতের উদ্দেশ্যে তার সেই ভুবনভোলানো হাসি আর কোকিল কন্ঠের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ জানালো। সৈকতের আসন্ন সব আলতো যন্ত্রণা যেন নিমিষেই স্তিমিত হলো।স্কুল ছুটির পর সোনালী সৈকতকে একা ডেকে জিজ্ঞেস করলো,- “কি রে,তুই আমাকে নিউইয়ারের উপহার দিবি না? আমার মন সেই কখন থেকে তোর উপহারের অপেক্ষায় ছটফট করছে।”
সৈকত খুশিতে একেবারে ফেটে পড়লো। সে ব্যাগ থেকে বের করলো সোনালীর জন্য সযত্নে রাখা সেই বিশেষ উপহার। উপহারটি হলো একটা A-4 সাইজের কাগজের একদিকে মনোযোগের সহিত পাঠরতা সোনালীর ছবি এবং অন্যদিকে অতি সুন্দর হরফে রংপেন্সিলে লেখা ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ ।
সোনালী এই বিশেষ উপহারটিকে দু’টো হাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
সৈকত তার মনের গোপন কথাটি আর গোপন রাখতে পারছিল না। ঠিক এই সময় সোনালী তার ব্যাগ থেকে রসায়নের রেফারেন্স বইটা বের করে সৈকতের হাতে দিল। সৈকত অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে ভাবলো,”সেদিন তাহলে ও আমার কথা শুনেছিল এবং গুরুত্বও দিয়েছিল।”
তারপর দু’জনেই যে যার বাড়ি ফিরে গেল। রাতে সোনালীর দেওয়া রসায়নের রেফারেন্স বইটার পাতা উল্টাচ্ছিল সৈকত। রাসায়নিক বিক্রিয়ার অধ্যায় খুলতেই সে একটা সুন্দর গ্ৰিটিংস কার্ড এবং লেখাভর্তি কয়েকটা পৃষ্ঠা দেখতে পেল।গ্ৰিটিংস কার্ডে লেখা ছিল “সৈকত,আই লাভ ইউ। আমি জানি তুইও আমাকে
ভালোবাসিস”।
আর ওই পৃষ্ঠাগুলোতে লেখা ছিল সহজে রাসায়নিক সমীকরণের গাণিতিক সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি। সৈকত এক অপার খুশিতে আত্মহারা হলো। এটা তার জীবনের এক অবিস্মরণীয় উপহার। অন্যদিকে সোনালীও সৈকতের দেওয়া সেই উপহারটি তার পড়ার ঘরে রেখে দিয়েছে ফ্রেমবন্দি করে। -
জীবনযাত্রার বৈপরীত্য
জীবনযাত্রার বৈপরীত্য
-অমিত কুমার জানাজীবনব্যাপী কেউ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে,
কারো বা আলস্যে সময় কাটে অবহেলে।কারো খাবার প্রতুল, নিঃসংকোচে ছুঁড়ে ফেলে অতিরিক্ত,
কেউ খাদ্যহীনতায় শুষ্ক প্রাণ, উদর রিক্ত।কেউ অতিভোজনের মেদ ঝরাতে জিমে যায় নিত্য,
কোন জীবনযোদ্ধা নিত্য পরিশ্রম করে অকথ্য।কারো সারাক্ষণ গাড়িতে চড়ে সময় সানন্দে অতিবাহিত,
কারো জীবনপথের কাঠিন্যে পদযুগল ক্ষতবিক্ষত।অর্থের বলে বলীয়ান কেউ করে বেহিসেবি অপচয়,
সামান্য অর্থ উপার্জনের তরে কারো সর্বদাই হয় জীবনের ক্ষয়।লিফটে চড়ে কেউ আসে যায় ইমারতের বহুতলে,
কারো ছোট্ট স্বপ্ন ফুঁপিয়ে কাঁদে কোন্ সে অতলে।আভিজাত্যে ভরা পোশাক পরিহিত বাবুরা হেঁটে যায় রাজপথে,
ক্ষুধার তাড়নায় অপেক্ষমান ভিখিরি ধূলো মাখে ফুটপাতে।চাকরির খোঁজে উদভ্রান্ত উচ্চশিক্ষিত দরিদ্র বেকার,
অশিক্ষিত নেতার অবাধ শোষণ, সঙ্গে পদাধিকারের হুঙ্কার।সত্যের পথযাত্রী কেউ আজীবন ধরে রাখে সততা,
সব পেয়েও কেউ বা প্রতিনিয়ত করে মানবতার হত্যা।