-
কবিতা- বাকী পথটুকু
বাকী পথটুকু
– তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়আত্মমগ্ন থাকতে থাকতে কখন ভুলেছি তোমাকে।
কখন যেন আত্মচিন্তা, আত্মপ্রদর্শন গ্রাস করেছে সব।
তারপর…
নিরবিচ্ছিন্ন একাকিত্ব—
আর তখনই আবার তোমাকে খোঁজার শুরু…
কিন্তু তুমিও তো তখন পাল্টে ফেলেছো নিজেকে!
ভাঙা মন কখনো জোড়ে না।
আর সম্পর্কের শিকড় মাটিছাড়া হলে,
সেও তো শুকোয়।
অনুভূতিগুলো জমতে জমতে কখন যেন মস্ত পাহাড়।
আর অভিমানের নদী ছুটে চলে নিঃশ্বাসের তরঙ্গ তুলে।
মন বলে
তুমি আছো…তুমি আছো।
আমি আছি… আমি আছি।
আর নিরন্তর খুঁজে চলেছি সেই মনের পেলব ছোঁয়া।
এসো আবার একসাথে চলি সামান্য পড়ে থাকা বাকী পথটুকু।। -
অণু কবিতা- সমর্পণ
সমর্পণ
– তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়দু’দিনের অতিথি হয়ে আশ্রয় নিয়েছি
আকাশের নীচে।
আর শুধু জেনেছি সমর্পণ।জীবনের কাছে সমর্পণ।
সময়ের কাছে সমর্পণ।
নিয়তির কাছে সমর্পণ।সবকিছু হাতে নেই।
তাই মাথা নীচু করে সমর্পণ
করে যাই চিরকাল।
ক্লান্ত মন পথ খোঁজে অন্ধকার থেকে আলোয়।
পায়ের বালুরাশি ধুয়ে দেয় সময়ের জল।
আকাশের নক্ষত্ররাজি ঘুম আনে চোখে।। -
কবিতা- গাছের মত
গাছের মত
– তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়গাছ হ’বি তুই?
লতায় ডালে সবুজ পাতায় ছড়িয়ে দেওয়া বৃক্ষযোগী।
ছড়াবি তোর শিকড়বাকড় মাটির গভীর জলের ধারায়।গাছের মত প্রেমিক হ’বি?
তোর ছায়াতেই চোখটি বুজে শান্ত হবো।
রোদ ধরবি পাতায় পাতায়।
বৃষ্টি ভিজে শুদ্ধ হবি।
আমায়ও তোর সঙ্গে নিবি।
ফুলের মত উঠবো ফুটে।
মিষ্টি হাওয়ায় দুলে দুলে পড়বো
নুয়ে তোরই পায়ে।
মেঘে মেঘে ছায়ায় ছায়ায় কাটিয়ে দেবো বারোমাসই।। -
গল্প-শেষ থেকে শুরু
শেষ থেকে শুরু
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়অফিস থেকে ফেরার পথে রুটি তড়কা কিনে ফ্ল্যাটে ঢুকলো রাতুল। আজ খুব খিদে পেয়েছে ওর। ভাগ্যিস হোটেলগুলো খুলছে এই আনলক পিরিয়ডে, নয়তো বাড়ি ফিরে আবার খাবার গরম করে খেতে হতো। যদিও রোজই তাই করে কিন্তু আজ খুব ক্লান্ত লাগছে। ফিরেই স্নানঘরে ঢুকে শাওয়ারের তলায় ঠান্ডাজলে স্নান করে নিলে খানিক ফ্রেশ লাগবে। তারপরে খেয়েই একটা জম্পেশ করে ঘুম দেবে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখতে পেলো একটা অচেনা নাম্বার থেকে মিসকল হয়ে আছে। দূর এখন আর রিং ব্যাক করতে ইচ্ছে হলোনা- ভাবলো যার দরকার সে নিশ্চয়ই আবার করবে।
এতদিন এতবছর ধরে জমিয়ে রাখা আবেগ দোদুল্যমান মন নিয়ে আজ মল্লিকা ফোন করেছিলো রাতুলকে।দীর্ঘ পাঁচবছর সাংসারিক জীবনে বিচ্ছেদের পরেও ও পারেনি ভুলতে কিছুই। আসলে প্রকৃত ভালোবাসলে বোধহয় ভোলা যায় না, ঘৃণা করা যায় না। বড্ড উৎকন্ঠা হচ্ছে ওর, ফোনটা বেজে গেলো অথচ ধরলো না! অবশ্য নতুন এই নাম্বারটা ওর জানা নেই। হয়তো অচেনা নাম্বার দেখে ধরেনি ও। তাও মল্লিকা অপেক্ষা করে একবার যদি রাতুল কল ব্যাক করে! আবার পরক্ষণেই ভাবে হয়তো রাতুলও ওর মতোই পুরোনো নাম্বারটা ছেড়ে দিয়েছে।
পরেরদিন রাতে একইসময় ফোনটা আবার একটু বেজেই কেটে গেলো। রাতুলের মনে পড়লো গতকাল একই নাম্বার থেকে ফোনটা এসেছিলো। এবার রাতুলই কল ব্যাক করলো। ফোনটা বেজে উঠলো ওই প্রান্তে।কে যেন ফোন ধরে চুপ। তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে রাতুল কিন্তু কোনো উত্তর নেই।
–হ্যালো কে বলছেন?
এবার মৃদুস্বরে কে যেন বললো, আমি।
-আমি? আমিও তো আমি। কিন্তু আপনি কোন আমি?
এবারে ওপ্রান্ত বললো- গলা শুনে চেনা যাচ্ছে না? কেমন আছো?
কানের মধ্যে মিষ্টি ঝর্ণার কলতানে প্রাণ জুড়িয়ে গেলো রাতুলের। এ গলা তার বহু পরিচিত, ভীষণ কাছের। -কে? মল্লিকা?
— হুম,চিনতে পেরেছো? মনে আছে আমায়?
— তুমি তো আমার মনেই আছো মল্লিকা।
এবারেও ওপ্রান্ত চুপ।
রাতুল এবার বললো–এতদিনে মনে পড়লো আমাকে?
এবারে ওপ্রান্ত হেসে উঠে বললো -তুমিতো আমার মনেই আছো রাতুল।
রাতুলও এবার মৃদু হেসে বললো– দ্যাখো, মনে মনে আমরা কত কাছাকাছি কিন্তু পায়ে পায়ে কতদূরে চলে গেছি।
ওপ্রান্তে মল্লিকা চুপ। শুধু একটা মৃদু দীর্ঘশ্বাস রাতুলের কানে পৌছলো।
আমি এখন অনেক পাল্টে গেছি মল্লিকা…নিজেকে চিনেছি, চিনেছি আশেপাশের মানুষজনকে। আসলে সময় আর পরিস্থিতি আমাকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে। এতো রাতে তুমি যে আমার সাথে কথা বলছো তোমার উনি কিছু বলবেন না’তো?
– কোন উনি? জিজ্ঞাসা করলো মল্লিকা।
– না তোমার এখন পাশে যিনি।
– আমার পাশে তো কেউ নেই। আমি আর আমার অস্তিত্ব দু’জনে মিলেমিশে বেশ আছি।
– বিয়ে করোনি কেন মলি?
– ওই যে তুমি বলেছিলে- আমাকে তুমি এত ভালোবাসবে যে অন্য কাউকে আমার মনেই ধরবে না–তাই। তা তুমি করেছো নিশ্চয়ই বিয়ে?
– না মলি, তা আর পারলাম কই? আমারো পুরো অস্তিত্ব জুড়ে শুধু তুমিই আছো। এই যে তুমি এত দূরে থেকেও মনে মনে বলেছো “ভালোবাসি ভালোবাসি”। আর তা আমার মনেও প্রতিধ্বনি তুলেছে প্রতিদিন। তাই তো তুমি আমার কাছেই ছিলে মল্লিকা আর তাই অন্য কাউকে প্রয়োজন হয়নি জীবনে।
– বাহ বেশ গুছিয়ে কথা বলতে শিখেছো তো এখন। কবিতা টবিতা লিখছো না’কি আজকাল?
– মনে মনে সবাই কবি ম্যাডাম আর তুমিই তো আমার কবিতা… হাসে রাতুল…বলে আমি এখন শুধু গুছিয়ে কথাই বলিনা গুছিয়ে সংসারের কাজও করতে পারি। একদিন এসে দেখে যাও ম্যাডাম।
– সে কি? তুমি আর ঘরের কাজ?
– হুম, পাল্টেছি নিজেকে। সবই অভ্যেস জানো! আসলে তুমি চলে যাবার পর… আমার সংসারটা ভেঙে যাবার পর…বাড়িতে আর মন টিঁকছিলোই না। ভাইয়ের বিয়ে হলো…আমার ঘরটা ওকে ছেড়ে দিলাম। তারপর দমদম স্টেশনের কাছে এই ফ্ল্যাটটা নিলাম। অনেক ভেবেছি যে আগে কেন নিইনি এই সিদ্ধান্তটা।আসলে পারিবারিক সম্পর্কে নানাজনের মতামতের চাপে স্বাধীন চিন্তাভাবনা করাটা বেশ শক্ত। এখন কিন্তু বেশ আছি। আমার একলা জীবন পাল তুলেছে তোমার কথা ভেবে…শুধু তোমার কথাই ভেবে। আর এই ভাবনার জোর আছে কিন্তু। দ্যাখো,তুমি আমায় ফোন করলে। অবশ্য আমিও তোমায় করেছিলাম কিন্তু অন্য মানুষ ফোন ধরেছিলো। আমি ভেবেছিলাম তোমার বর।– না,পুরোনো নম্বরটা বদলে ফেলেছি অভিমানে।
– অভিমান হওয়ারই কথা। আমি অবিবেচকের মত খারাপ ব্যবহার করেই গেছি তোমার সাথে। আমি আজ অনুতপ্ত। পারলে ক্ষমা করে দিও আমায়।
– থাক ওসব পুরোনো কথা…কিছু আমি ভুলেছি…কিছু তুমিও ভুলেছো। তার চেয়ে নতুন কথা বলি এসো।
এরপর রোজ ফোনে কথপোকথন চলতেই লাগলো। একদিন রাতুলই বললো– এসো একদিন দেখা করি।
-আবার?
-হুম,নতুন করে আবার সব গোছাবো।
– শখ তো মন্দ নয়।
– না,ভাবছি…শেষ থেকে আবার শুরু করলে কেমন হয়?
– এই শুরু আর সেই শুরু মেলাতে পারবে তো?
– নিশ্চয়ই মেলাবো। তিনি যখন আবার আমাদের মিলিয়েছেন তখন আমাদের চেষ্টা করতে দোষ কি?
রাতুল বাইক নিয়ে দাঁড়ালো সেই জায়গায়…ডিউটি শেষে মল্লিকাও এলো সেইখানে। দু’জনে গিয়ে বসলো সেই নদীর ধারে যেখানে ওরা প্রথম প্রেমপর্বে যেত।মৃদু মৃদু হাওয়া বইছে। নদীর ধারের গাছগুলো যেন ওদের চিনতে পেরে শাখা দুলিয়ে সাদরে সম্ভাষণ করলো।বাসা ফেরত পাখিরাও যেন ওদের দেখে গাছে গাছে কিচির মিচির করে আনন্দে কোলাহল করে উঠলো। নদীর ধারের বেঞ্চে ওরা চুপ করে খানিক বসে রইলো। সুবিশাল আকাশ আর শান্ত নদীও ওদের দিকে অপলক চেয়ে রইল…সত্যি এই দুজনের জুটিকে কী ভীষণই না মানাতো…অথচ….।
সে যাক…দুখের কথা যাক ভেসে যাক নদীর জলে। রাতুলই প্রথম কথা বললো…বললো, দেখো তখন আমার কী ভীষণ জেদ, রাগ, ঈর্ষা ছিলো…সবকিছু শেষ করে দিতে ইচ্ছে হতো। এখন সেসব কিছুই নেই। এখন আমি অন্য মানুষ। বিশ্বাস করো, তোমার চলে যাওয়া আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আর কখনো এমন করে চলে যেও না বলে আলতো করে হাত ছুঁলো মল্লিকার।
মল্লিকা খানিক চুপ থেকে বললো–বোঝো নি আমায়,বোঝো নি কীভাবে তোমার নরম ছোঁয়ায় বেঁচেছিলাম।অভিমানে ডুবে গেছে সব…ভালোবাসাও।
রাতুল ওর শক্ত মুঠোয় নিলো মল্লিকার নরম হাতটি আর এমন করেই ওরা পুরোনো সবকিছু ভুলে আবার নতুনের পথে পা বাড়ালো।
বেশ কিছুদিন পরে রাতুল বললো- আমরা আবার একসাথে থাকতে পারি’না?
– এই তো বেশ আছি। আবার নতুন করে আর লোকে কি বলবে?
-ভয় পাচ্ছো? না, আর আমি তোমাকে বিয়ে করতে বলছি না। এবার শুধু একসাথে থাকো। পরে কখনো ভরসা হলে বিয়ে কোরো কাগজে-কলমে।
– মানে? লিভ টুগেদার? ও আমি পারবো না। সবাই কি ভাববে?
-মলি, এখনো তুমি লোকের কথা ভাবো? লোক কি তোমার এতদিনের মনের কষ্টের কথা ভেবেছিলো? কেউ ভাবে না বুঝেছো…সবাই শুধু নিজের ভালোটাই ভাবে…এ দুনিয়া বড় স্বার্থপর। তুমি বোকা… তাই এসব ভাবছো। লোকের বলায়, ভাবায় আর আমাদের কিছু যাবে আসবে না। আমাদের সম্পর্কের মাঝে আর কাউকে আমি আসতে দেবো না।
এখন শুধু যে অভিমানগুলো তোমাকে আর আমাকে ছুঁয়ে আছে সেগুলোর কথা ভাবো… সেই অভিমানগুলোকে ভুলিয়ে দাও আদরে,ভালোবাসায়। যে সময়টা আমরা মিছিমিছি নষ্ট করেছি…অবহেলা করেছি… সেই সময়টা আর ফিরে আসবেনা।তাই এখন থেকে যেটুকু সময় পাবো শুধু টুপটাপ ঝরে পড়া সুখ কুড়োই, চলো। প্লিজ মলি, বোঝো একটু।
ঘর ছাড়ার আগে মলি মাকে বলেছিলো…মা শুনে বলেছেন –কি তোদের নতুন যুগের ন্যাকামি…বুঝি না বাপু…শুধু শুধু লোক হাসানো।দমদমের সেই ফ্ল্যাটে আবার নতুন করে সংসার পাতে দু’জন মিলে। সেখানে খোলা দখিনের ব্যালকনিতে রোদ আসে…বৃষ্টি নামে…পাখি গায়…ফুল ফোটে আনন্দে আর রঙীন প্রজাপতি পাখা মেলে। আর দুটো সাদা মনের ক্যানভাসে সাতরঙের রঙ তুলিতে কতই’না ছবি আঁকা হয়।
দুটো মনপাখি আবার উড়ে যায় খোলা আকাশে স্বপ্নের ডানা মেলে।
-
কবিতা- স্বপ্নে বাঁধে
স্বপ্নে বাঁধে
– তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়শান্ত নদীর তীরে তখন হাসনুহানা গন্ধে ঢাকে।
আমি জানি, স্বপ্নগুলো সেথায় রাখা থাকে।নীল আকাশের মেঘগুলো সব স্বপ্ন দেখায়,
উড়ে যাওয়া প্রজাপতির রঙীন পাখায়।সূর্যডোবা কনে দেখা হলুদ আলো,
ঝিরঝিরে ওই মিঠে বাতাস লাগে ভালো।বসন্ত ওই কৃষ্ণচূড়ার আগুন ছোঁয়া।
মনটা তখন ভালোবাসায় শিশির ধোয়া।সবাই ওরা বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখায়।
দু’টি চোখে মায়ার কাজল যত্নে মাখায়।সমুদ্রের ওই উত্তাল ঢেউ, ঝাউপাতার ফাঁকে সূর্য কণা।
পায়ের কাছে “মিউ মিউ মিউ “, খুব আদরের বেড়াল ছানা।রুমঝুমঝুম বৃষ্টি ভিজি খোলা ছাদে।
জানি আমি, সবাই ওরা স্বপ্নে বাঁধে। -
গল্প- হারিয়ে খুঁজি
হারিয়ে খুঁজি
– তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়ভুলে যাবো বললেই কি আর ভুলে থাকা যায়? দূরে থাকা মানেই কি আর সত্যিই দূরে থাকা? লক্ষ যোজন দূরে থেকেও তো মনে মনে কাছাকাছি থাকা যায়…রাখা যায় তাকে মনের ভিতর ঘরে। মনে হয়, এই তো সে…তাকে লুকিয়ে রেখেছি মনের সিন্দুকে।
তোমাকে ভুলে যাবো মুখে বললেও, রাতুল তোমাকে একটা দিনের জন্যও ভুলতে পারেনি তোমার মল্লিকা। তোমাকে ভুলতে গেলে তো আমার নিজেকেই ভুলতে হ’তো…ভুলতে হতো আমার সবকিছু… তোমার খুনসুটি, আদর, ভাব –স-অ-ব সবকিছু। আসলে এগুলোই তো আমি বাঁচিয়ে রেখেছি প্রতিদিন, মনের ভিতর অতিযত্নে।
ছুটির দিনে ট্রামে পাশাপাশি বসে গল্প করতে করতে আর বাদামভাজা চিবোতে চিবোতে পার করেছি কত সুখের দিন! লেকের জলে বোটিং, পুজো শপিং, পাল্লা দিয়ে ফুচকা খাওয়া–আমাকে হারাতে কখন যেন চোখের ইশারায় ফুচকাওয়ালাকে ঝাল দিয়ে দিতে বলতে! তুমি জানতে আমি বেশী ঝাল খেতে পারি না। বাপরে কী ঝাল!! আমি তখন একেবারে চোখের জলে নাকের জলে… পকেট থেকে রুমাল বের করে এগিয়ে দিতে আবার পরক্ষণেই রুমাল নোংরা করে দিয়েছি বলে চেঁচাতে! অফিস ফেরত চায়ের স্টলে চা আর প্রজাপতি বিস্কুট। তুমি বলতে প্রজাপতি গায়ে বসলে বিয়ের ফুল ফোটে আর প্রজাপতি বিস্কুট খেলে কি হয়? সত্যি কত কথাই না বলতে তুমি! আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে… আমার বড় বড় চোখের পাতা খুললে না’কি তোমার মনে হয় পদ্মফুল পাপড়ি মেলছে! আমিও তোমার দুষ্টুমি ভরা চোখে নিজেকে খুঁজে পেতাম।
অবশ্য তোমার এসব মনে পড়বে কেনো?এসব শুধুই আমার একার অনুভব…শুধুই আমার একার।
তোমার সাথে বিয়ে হবার পরেই সবকিছু যেন কেমন পাল্টে গেলো। তুমি তো জানতে বাবা মারা যাবার পর বাবার চাকরীটাই আমি পেয়েছিলাম। সংসারের হালও তো ধরতে হবে। বোন তখন পড়াশোনা করছে। বাবার অফিসে লিখিত দস্তখতে অঙ্গীকার করেছিলাম যে মা আর বোনকে দেখবো।ওদের আমি না’ দেখলে কে দেখতো বলো?
তোমার বাড়ির কারোর আমাকে পছন্দ হয়নি…একে রঙ কালো…তারপর কন্যাপণ দিতে পারিনি আমরা। তোমার হয়তো আরো অনেক ভালো বিয়ে হতো! আমি চুপচাপ নিজের মনে থাকতাম বলে আমার নিন্দে হতো-আমি না’কি একাচোরা, মিশুকে নই…স্বার্থপর। তুমিও আমাকে বুঝতে না। তুমি তখন কাজের চাপ,অফিসের ঝামেলা, সাংসারিক দায়িত্ব কর্তব্য সামলে সংসারের নানা কূটকচালিতে বিপর্যস্ত হতে.. নানা মিথ্যে বানানো গল্পে উত্তেজিত হতে।আমাকে একবারও কিছু জিজ্ঞাসা না করেই মেজাজ দেখাতে! আমার খুব অভিমান হতো।
সংসারে দেখতাম দখলদারির গেলো গেলো ভাব। আমি বুঝতাম একটা ছেলের বিয়ের পরে দু’দিক সামলে চলাটা কত্ত মুশকিলের।নানা কথা শুনেও কখনো তুমি প্রতিবাদ করতে না…উলটে আমাকেই কথা শোনাতে।তোমাকে কিছু বললেই শাশুড়ীমা তোমার পক্ষ নিয়েই আমাকে দোষারোপ করতেন… বলতেন আমার ছেলেটাকে একটু শান্তি দিতে পারোনা?আমিই তোমার জীবনে অশান্তির মূল ছিলাম…তাই না? এখন তুমি নিশ্চয়ই খুব শান্তিতে আছো? বাড়ির পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে সুখে সংসার করছো?
আমি তো মিলে থাকার চেষ্টা কম করিনি।অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরেই রান্নাঘরে চা, জলখাবার, রাতের রান্না, পরের দিনের অফিসের টিফিন সব রেডী করতাম। অফিস থেকে ফেরার পথে দোকান বাজার, টুকিটাকি…তাও করতাম। সংসারে টাকাও দিতাম। তাও আমার বাড়ি যাওয়া…বাড়িতে টাকা দেওয়া নিয়ে কথা শুনতে হয়েছে।
আমি তো কখনো কোনদিন তোমাদের কাছে কিচ্ছু চাইনি। একটু মানসিক শান্তি… সেটাও কী দিতে পেরেছো তোমরা? শুধু চোখের জল ফেলেছি। একটু প্রাণ খুলে হাসতে, আনন্দ করতেও পারি নি। পিসতুতো দেওর এসে মাঝেমাঝে গল্প করতো…ওর মজার মজার কথায় একটু হাসতাম…তা নিয়েও কত কথা!
রোজ রোজ ঝগড়া অশান্তিতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছিলাম। তুমি একদিন বললে, আমার সংসারে না’কি মন নেই…আমরা আলাদা থাকলেই না’কি ভালো থাকবো। তাই এই সমঝোতা–এই বিচ্ছেদ।
কিন্তু এই ভাইরাস ছড়ানো পৃথিবীতে বড্ড চিন্তা হচ্ছে তোমার জন্য। কে জানে কেমন আছো তুমি!
প্রথম দিকে ভাবতাম তুমি ফোন করবে।তারপর একদিন আমার সিমটাই ফেলে দিলাম। এখন আমার অন্য নাম্বার। তুমি নিশ্চয়ই পাল্টাও নি তোমার নম্বর। তোমাকে আমি ফোন করবোই…কথা বলবে তো তুমি?জানিনা হয়তো আমার মুখটাই আজ ঝাপসা তোমার কাছে।জানো অনেক আঘাত, অপমান সহ্য করে, বিচ্ছেদের আগুনে পুড়ে আজ বুঝেছি… সম্পর্ক নেই, যোগাযোগ নেই কিন্তু প্রেম আছে লুকিয়ে কোথাও।
-
অণুগল্প- ভুল
ভুল
– তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়অফিসের একটা কাজের ব্যাপারেই প্রথম ফোনে যোগাযোগ ওর সাথে। ফোনের সেই মিষ্টি গলাটা শুনতে শুনতে কখন যেন মনের মধ্যে তোলপাড় শুরু হলো। কারণে অকারণে কাজের অছিলায় ফোন করতে শুরু করলাম। ও হয়তো বুঝতো কিন্তু আমি ভাবতাম হয়তো বোঝেনি।
তারপর সেই ফোনালাপ পেরিয়ে দেখা হলো একদিন। কবেকার সে’সব কথা- আমার অফিস কোলকাতায় আর ও অনেকটাই দূরে, সেই ব্যারাকপুর। তা-ও দেখা হতো, কথা হতো, তারপর ক’বে যেন আমার ঘরের চৌকাঠ পেরোলো ওর আলতা রাঙা পা।
অনেক রঙীন আলো সারারাত জ্বলেও ভোরের দিকে ক্লান্ত তো হয়- নিভে তো যায় সেই আলো।
সুন্দর সাজানো তটভূমিতে বালির ঝড়ও তো ওঠে? ঠিক তেমনি বাসা ভাঙা পাখির মত পড়ে রইলাম আমি। ও চলে গেলো ভাঙা কাঁচ মাড়িয়ে- সেই আলতা রাঙা পা রক্তে রাঙা হলো ।আমার দায়কে কিভাবে অস্বীকার করবো আমি? পারিনা- পারিনা তা। আমার এই বদমেজাজ, সন্দেহবাতিক মন, জেদ, নিজের কাজে ডুবে গিয়ে ওকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা।
আজ পাঁচবছর- ডিভোর্সের পরে নিজেকেই ক্ষতবিক্ষত করেছি। পাল্টাতে চেষ্টা করেছি নিজেকে। মেডিটেশন করেছি, দীক্ষা নিয়েছি, শান্ত হয়েছি, বয়সের সাথে সাথে আজ কিছুটা পরিণতও হয়েছি।
না, অন্য কোন মেয়েকে আর মনে ধরেনি।গল্প করেছি, কথা বলেছি ওদের সাথে-ওদের কেউ কেউ মায়া দেখিয়ে কাছে আসার চেষ্টাও করেছে কিন্তু আমি ব্যবধান বাড়িয়েছি। আমি কাউকে চাইনা। শুধু ওকে আমার ভীষণ দরকার- আমার মল্লিকাকে।
কিন্তু ওর মত শান্তশিষ্ট, মিষ্টি, কোমল মনের মেয়ের সামনে আমি কি মুখ নিয়ে দাঁড়াবো?হয়তো ও ভালো আছে- হয়তো নতুন কোনো সম্পর্কে জড়িয়েছে ও। হয়তো আমাকে ভুলে গেছে, আমি তো খুব বাজে একটা মানুষ।
আবার ফোনে ওর মিষ্টি গলাটা শোনার জন্য ছটফট করতে লাগলাম। মোবাইলে ওর নম্বরে কল করলাম…বাজছে ফোনটা…ও’কি ধরবে না? ও কি আমাকে ক্ষমা করে দেবে না?
কিছুক্ষণ রিং হবার পর ফোনের ওপার থেকে মোটা গলার এক পুরুষ কন্ঠ ফোনটা ধরলেন।
কাকে চাই বলতে বল্লাম মল্লিকাকে একটু দিন না।
বিস্ময়ভরা কন্ঠে লোকটি বললেন- মল্লিকা?
না, সেইনামে এখানে কেউ থাকে না তো।আমি বললাম, কিন্তু এটাতো মল্লিকার নাম্বার।
লোকটি গম্ভীর শব্দে ঈষৎ হেসে বললেন-স্যরি, রং নাম্বার…এটা আমার ফোন নাম্বার।দেখুন হয়তো ভুল টাইপ করেছেন কিংবা হয়তো সে ভুল নাম্বার দিয়েছে আপনাকে।ফোনটা কেটে দিলাম।
-
কবিতা- চলো ফিরে যাই
চলো ফিরে যাই
– তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়চলো ফিরে যাই সেইখানে।
যেখান থেকে শুরু হয়েছিলো।
আসাটা যেমন সত্য,
যাওয়াটাও সত্যি ভীষণ।
কেন মিছে মায়ার পড়তে জড়ালে নিজেকে?
মায়া, মোহ সব মিছে।
মূল্যহীন যা করেছো সঞ্চয় এতদিন।
তার চেয়ে চলো ওই খোলা আকাশের নীচে,
সবুজ ঘাসের গালিচায়।
পাশে এসে বোসো, হাত দুটি ধরো।
এইটুকু সঞ্চয়–
কিছুটা সময় অক্ষয় হয়ে থেকে যাবে।কিছুই থাকে না জানো, কিছুই থাকে না।
শুধু তোমার আমার ভালো কিছু কথা,কিছুটা সময় আর ভালোবাসা স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবে চিরদিন।
জানো, ভালোবাসা মরে না কখনো।
ক্ষয় নেই, নেই তার চলে যাওয়া। -
কবিতা- তেমনই আছি
তেমনই আছি
– তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়আমি এখনো যেমন ছিলাম তেমনই আছি, জানো?
এখনো একটু অভিমানে চোখ ছলচ্ছল জল।
যদিও অভিমানের কে আর তেমন দাম দেয় বলো?
তবুও আমি কাঁদি।
একটু খুশীর ছোঁওয়ায় কিন্তু রোদ ঝলমল হাসি।
ভুল বুঝোনা- এখনো আমি কম কথাই ব’লি।
চুপচাপ থাকাই আমার স্বভাব।
কথা বলতে গিয়ে এখনো হই থতমত।
সাবধানী হই, কথা দিয়ে কাউকে আবার দুঃখ দিলাম না’তো!
সবুজ মাঠে শিশির ঘাসে পা ফেলাতেই সুখ।
তেমনি করেই সুখ খুঁজে দেয় নীল আকাশের পাখী।
জানো, অবাক হয়ে এখনো আমি আকাশটাকেই দেখি।
আর দেখি আনমনে ওই নীল সায়রের জল।
ওর কাছেই লুকিয়ে রাখা দুঃখ ভোলার ছল।
আজও সকাল হ’লে, ঘুম ভেঙে এক রাজকন্যা জাগে।
নিজেকে তখন নিজেরই কেমন অচেনা লাগে।
এখনো স্বপ্ন দেখি দু’চোখ ভরে।
এখনো গান গাই, বৃষ্টিকুঁচি মাখি।
এখনো মনে ফোটে হাজার গোলাপ।
এখনো আমি তেমনি আছি,জানো? -
কবিতা- জীবন মানে
জীবন মানে
– তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়জীবন মানে ওঠাপড়া, জীবন মানে ছোটা।
জীবন মানে ভালোবাসা, প্রেমের ফুল ফোটা।জীবন মানে কাজের হিসেব, দায়িত্বের চাপ।
জীবন মানে ভুলের পাহাড়, নেই কোন তার মাপ।জীবন মানে হিংসা-বিবাদ, লোভের হাতছানি।
জীবন মানে বন্ধুতার, বাড়ানো হাতখানি।জীবন মানে অনেককিছু,জীবন মানে বাঁচা।
জীবন মানে স্বাধীনতা, খোলা মনের খাঁচা।জীবন মানে রৌদ্রছায়া, জ্যোৎস্না মাখা আলো।
জীবন মানে ভেসে যাওয়া আরেকটা দিন ভালো।জীবন মানে অন্ধকারে জোনাক জ্বলা রাত।
জীবন মানে মায়ের আদর,পরম স্নেহের হাত।জীবন মানে বেঁচে থাকার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস।
জীবন মানে মুক্তির আকাশ- নীলাকাশ।জীবন মানে দুখের মাঝেও বেঁচে থাকার সুখ।
জীবন মানে হৃদয় জুড়ে দীনবন্ধুর মুখ।জীবন মানে কাব্য লেখা, জীবনের জন্য।
জীবন মানে ফুরিয়ে যাওয়া, জীবন অনন্য।