-
কবিতা- একটা জীবনের গল্প
একটা জীবনের গল্প
– পারমিতা ভট্টাচার্যফুরিয়ে যাবার আগে চলো না বন্ধু
আর একবার যাই বুড়ো বটের তলায়
ছোটবেলার মতো খেলি,পুতুলের বর বউ
ঘুরি আবার চুপি চুপি পীর সাহেবের মেলায়।চলো না আবার ভাঙা মন্দিরটার দেউরিতে
তুই তুলে ধরবি আমার ঘোমটা টানা মুখতোর আঙ্গুলে দেবো ছোট্ট একটা কামড়
চাঁপার গন্ধে থাকবে মিশে আমাদের সেই সুখ।আর একবার যাবো ওই নদীটার কাছে,
যেখানে বটের ছায়া নদীর বুকে আলতো করে পড়ে
ছুটতে ছুটতে হারিয়ে যাবো গোঁসাই বাবার বনে
হারান মাঝির নৌকায় যাব ভেসে কোথাও দূরে।আজও বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছি চিঠি
শাড়ির খুঁটে রেখেছি বেঁধে আগুনে প্রেমের কথা
পায়ের নূপুরে আটকে রেখেছি ফেলে আসা সব ঝড়
যদিও বুকের মাঝের উত্তাল নদী আজ ক্ষীণস্রোতা।আজ তুই অন্য কারো পুরুষ, অন্য কারো প্রেম
অন্য কারো ছবি ভাসে তোর গভীর চোখের তারায়
আমি জানি, বিরহই প্রেমের পূর্ণতা আনে শুধু
তবু বলতে পারিস কি দোষ ছিল আমার ভালোবাসায়?ফুরিয়ে যাবার আগে, চোখে ভাসে তোর মুখ
অন্তিম সময়ের জানান দেয় দ্রুত পড়া নিঃশ্বাস
অপেক্ষা করি মনে মনে শুধু একটা পরজন্ম সুখের
বিষাদ ছুঁয়েছে আমায়, কে রোখে আমার সর্বনাশ।। -
কবিতা- ভালো থাকিস…….
ভালো থাকিস…….
– পারমিতা ভট্টাচার্যকিছু কথা ভুলবো বললেও
ভোলা যায় না।
যদিও মনে রাখার দরকারও পড়েনা।না,না,আমি হাতে হাত রেখে
শহীদ মিনারে চিনা বাদাম খাবার
গল্প শোনাচ্ছি না।
আমি বলছি সেই প্যালিওলিথিক
যুগের ফুরিয়ে যাওয়া কথাদের কথা।
আকাচা জামার গন্ধদের কথা,
হঠাৎ ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া উদ্বিগ্নতাদের কথা,
ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার পর জানলায় দাঁড়ানো
ফ্যাকাসে মুখটার কথা,ফোনের ওপারে ‘ নিজের খেয়াল রাখিস ‘ দের কথা,
এক জীবনে চব্বিশটা ঘণ্টা সংসার করার কথা,
কথা দিয়ে কথা না রাখবার কথা,
এসব কী ভোলা যায়?ডাক নামটা আজ আই.সি.ইউ তে
মৃত্যুর প্রহর গোনে
বাতিল হয়ে যাওয়া প্রিয় স্যান্ডেল
স্থান পায় ডাস্টবিনে।সেটাই স্বাভাবিক।
সুখ নামক অ্যালকোহলের নেশায় বুঁদ হয়ে
স্বপ্ন নামক নিকোটিনে দেয় ডুব কেউ,
ভবিষ্যতকে তুরুপের তাস করে
নতুন বক্ষ বিভাজিকা জরিপ করতে করতে
ফুরিয়ে যায় তার বাকি বসন্তগুলো।
এই তো মানুষের জীবন।একবারও ভেবে দেখেনা,
কেন অভিমানগুলো জোনাকির মতো
ফুরিয়ে যেতে চাইলো অসময়ে!! -
কবিতা- কথা দিলাম
কথা দিলাম
– পারমিতা ভট্টাচার্যআজ চারিদিকে এতো আলো,তবু মনে সংশয় বোঝা
আসন্ন হলে যাবার সময়,বাকি থাকে হিসেব খোঁজা।
জীবন মরণ সীমায় দাঁড়িয়ে তবু শুনি জীবনের জয়ধ্বনি
মৃত্যু,সে তো অমোঘ সত্য,এ কথাও মানি।
এতো খুশি,এতো সুখ,প্রাণের যত মিতে
কি করে যাবো সব ছেড়ে?বড়ো মায়া এই পৃথিবীতে।
পৃথিবী তুমি কী বোঝনা,তোমার রূপের এত অপার আয়োজন
মানুষ ছাড়া কেই বা করবে রূপের রসাস্বাদন?
পৃথিবী কার উপর করো তুমি এতো অভিমান?
কোন অন্ধকারে পরবাসী হয়ে করো মৃত্যুকে আহ্বান?
জানি,মানবতাহীন মানুষ তোমাকে দিয়েছে অনেক ব্যাথা
তবু,মানুষ বিনা অজানা তুমি,এই মানুষই তোমার সার্থকতা।
তোমার জঠরে প্রাণের ছোঁয়া,তুমিও তো মা
সন্তান আজ সকাতরে কাঁদে,তুমি কী শুনতে পাচ্ছোনা?
তোমারই বুকে মহামারী রূপে আঁধার করে অভিযান
কেমন করে মৃত্যুর কাছে তুমি করলে আত্মসমর্পণ?
তোমার সন্তান আজ মৃত্যুবাণে হারিয়েছে তার দিশা
তোমারই স্নেহের পরশ দিয়ে ঘোচাও অমানিশা।
মানুষ বিনা,প্রাণ বিনা,তুমি নিষ্প্রাণ এক গ্রহ
কে পুজিবে তোমায় সিংহাসনে ভেবে মাতৃ বিগ্রহ?
ক্ষমা করে দাও আজ,সন্তানের যত গূঢ়তর অপরাধ
তোমার আকাশে সূচিত হোক একটা নবপ্রভাত
একদিন মৃত্যু আসবে বলেই জীবনে এত পরিপাটি আয়োজন
দেখ,মানুষের মাঝে ভগবান এসে আজ সামলায় রণাঙ্গন।
তাকিয়ে দেখ,তোমারই বুকে,মাটিতে আজ নেমেছে ভগবান
ভুলিনি পৃথিবী,ভোলেনি মানুষ তোমার অবদান।
পৃথিবী,একবার শুধু তোমার আশীষজ্যোতি ঢালো
কথা দিলাম,তোমায় রাখবো চোখের পলকে,বাসবো তোমায় ভালো। -
কবিতা- আয়না ভাঙার শব্দ
আয়না ভাঙার শব্দ
– পারমিতা ভট্টাচার্যস্বপ্নবোনা সেই চোখের দৃষ্টি আজ ঘোলাটে
তবুও কিসের টানে গোলাপে সাজাই টেবিলের ফুলদানি?
ধুলোধরা খাতার প্রতিটি অক্ষরে চেয়ে দেখো
এখনও সেরকমই আছি,আগের মতোই আমি।তুমি এসেছিলে দেবদূতের মতো পা টিপে
মন ভেবেছিল এ হয়তো পূণ্য জন্মের ফল
গমক্ষেতে ঠোঁট ডুবিয়ে যে পাখি প্রত্যাশা খোঁজে
সে কী জানে তার জন্য অপেক্ষমান আল কেউটের হলাহল?পাথর বিদীর্ণ করা শিকড়কে জিজ্ঞেস করো
ভালোবাসা কাকে বলে? স্বপ্ন কাকে বলে?
তুমিও শুধু প্রয়োজন ভেবেছিলে, প্রিয়জন নয়
তাই এতো সহজে পেরেছিলে সব ছিঁড়ে যেতে চলে।আজ আমি নৈঃশব্দের ঝর্না কলমে
একাকীত্বের কবিতা লিখি বসে, একা
তখন তুমি বুঁদ থাকো অন্য চুলের গন্ধে
তোমার দেওয়া কথা তখন অবিশ্বাসে হয় সেঁকা।আজ যখন খোলা জানলার সামনে দাঁড়াই
চোখে ভাসে তোমারই মুখ, হে আমার প্রিয়জন
যাকে মনের সিংহাসনে নারায়ণ শিলা ভেবে বসিয়েছিলাম
সেই আজ বাঁচতে চাওয়া জীবনের ধ্বংস – উপকরণ।। -
কবিতা- অযাচিত উপহার
অযাচিত উপহার
– পারমিতা ভট্টাচার্যছুঁয়েছিলে যতটুকু,
ভালোবাসতে পারোনি ততদূর
শুধু স্বেদগন্ধটুকু ছেড়ে গেছো অগোচরে।
আমিও যত্ন করে তুলে রেখেছি তা
আমার গোলাপ বাগানের মণিকোঠায়।
যতোটা কাছে এসেছিলে,
ভালোবাসতে পারোনি ততটা আপন করে।
শুধু আলগোছে ছুঁয়ে গেছো জীবনখানা।
যতোটা চোখে হারাতে চেয়েছ আমায়
ততটা ধরে রাখতে পারোনি চোখের মণিতে।
আমি তবুও সমস্ত ছেঁড়া পাতা জুড়ে
স্বপ্নের করি চাষ,ঊষর ভূমিতে।
যতোটা আপন করেছিলে,
ততটা হৃদয়ে স্থান দিতে পারোনি কোনোদিন
চাঁদের আলোয় ভেসে ওঠে যখন সেই মুখ
তখন আমি হাঁসুলী বাঁকে করি অতীত বিশ্লেষণ,
বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরি যত উপেক্ষা
দুহাতে জড়ো করি সমস্ত অবহেলা,উপহার
আসছে বসন্তে তবুও আমি খুঁজবো সেই মুখ
পরের জন্মে শুধু হতে চাই জাতিস্মর। -
কবিতা- খোলা খাতা
খোলা খাতা
– পারমিতা ভট্টাচার্যভাবলে কী করে সবকিছু এতো সহজেই হয়?
এতো দিনের লালিত কত কথা
হাতে হাত রাখা,দুঃখ,ব্যথা
এতো সহজেই কি হয় নিরাশ্রয়?
খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ভাবি
এতো বছরের খোলা খাতা
তার ছত্রে ছত্রে লেখা আনন্দ মুখরতা
কী করে হয়ে যায় ছায়াছবি?
এতই কি সহজ বদলে দেওয়া জীবনের মানে?
চেনা গন্ধে ডুবে স্নান
চেনা চেনা অভিমান
টেনে খোলো আজ একটানে।
কী ভাবো? মাটিতে মিশে যাবে সব?
আমি কি কেবলই এক পাথর?
আমারও তো প্রার্থনা আছে অকাতর!!
আমারও মনে,ফাগুনের বনে পাখি করে কলরব।
তুমি চেয়েছিলে তাই হৃদয়ে
বেজেছিল সুর রিনরিন
এখন বুঝি, সেসবই আজ সঙ্গতবিহীন
মিশে যেতে চাই তাই অজানা পথে,আগামী সূর্যোদয়ে। -
কবিতা- প্রার্থনা
প্রার্থনা
– পারমিতা ভট্টাচার্যহাতে হাত রাখা ভরসাগুলো
হারিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে
কপালে আঁকা ওষ্ঠের ওম সব
গুটানো থাকে স্মৃতির কাঁথা মুড়ে।জীবনের আসা যাওয়া,এপার ওপার
নিপাট সাজানো ঘর ছেড়ে গুটি গুটি
থেকে যায় শুধু ধরে ডাকা নামের রেশ
আসছে বসন্তে বাতাস ঘুরপাক খাবে একাকী।নদী দিয়ে বয়ে যাবে যত দুঃখ বিলাস
কালচক্রে মিশে যাবে চেনা হাতের পরশ
ভেজা চোখে ঝাপসা আলোর খেলা
স্মৃতি বুকে চেপে কেটে যাবে কত বরষ।ধ্যানমুদ্রা ছেড়ে উঠে বসে তখন চেতনা
মৃত্যুর মাঝে বিরাজমান ধ্যানমগ্ন শোক
যারা ওপারের ডাকে ছেড়ে গেলো সব,
যারা এপারে রইলো পড়ে
প্রার্থনা করি,সবাকার মঙ্গল হোক। -
কবিতা- জ্বলছে মানবতা
জ্বলছে মানবতা
-পারমিতা ভট্টাচার্যপুড়ছে মানবতা,মানবতায় জ্বলছে রিপুর আগুন
অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে ভাবি
রক্ত শিকলে বাঁধা অস্তিত্বের বিকিকিনি হাট জুড়ে
তবুও তো মানুষ হিসাবে দেখি তোমার আমার মুখ।রাস্তা জুড়ে ছড়ানো ছিটানো লাশ
দুপায়ে মাড়িয়ে যাই চেতনার ছিন্নমূলের সারি
নাড়ির টানে,মাটির টানে যারা মুখ গুঁজে পড়ে রয়
কাগুজে সভ্যতা বুকে শেল বিঁধে চোখ করে দেয় ভারী।আজ ফুঁপিয়ে ওঠে মন ,কত পরিজন
নদীর স্রোতের টানে ভেসে গেছে ঘর, পরিবার
ত্রস্ত মন তবু অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে বসে
মানুষের নামে চলে আজ ধর্মের করবার।আজ অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে সারি সারি মুখ
মানুষের পরিচয় শিকার অথবা শিকারী
বুকে চেপে ধরি সন্তানের কোমল মুখ
বাঁচতে দাও মানুষ হিসাবে হে,সভ্যতার কারবারি।রক্ত আর আগুনে তাপ সেঁকে সভ্যতা দিচ্ছে ঘুম
ভ্রম হয়, এ কোন আলোয় দেখি মুখ
মানবতার শিকড়ে শিকড়ে বিষের সমারোহ
হিংসার স্রোতে ভেসে যায় আজ মানুষের যত সুখ। -
গল্প- বিপন্ন শৈশব
বিপন্ন শৈশব
-পারমিতা ভট্টাচার্যবর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় চলতে গিয়ে আমাদের প্রত্যেকেই বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।আমাদের দেশ ভারতবর্ষ তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় সেখানে আর্থ সামাজিক ব্যবস্থায় নানা রকম সমস্যা শিকড় গেড়েছে অবলীলায়।অপুষ্টি, অশিক্ষা,স্বাস্থ্য সম্পর্কে অসচেতনতা প্রভৃতি সমস্যার সাথে বেশ বড়সড় আকার নিয়েছে আর একটি সমস্যা,তা হলো’বঞ্চিত শৈশব।’ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষদের কাছে বিরাট একটা জ্বলন্ত সমস্যা হলো দিন গুজরানের। এই কারণেই ছোটো বয়স থেকেই ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া ছেড়ে বেঁচে থাকার তাগিদে বিভিন্ন কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে।যেমন ছোটো ছোট মেয়েরা পরের বাড়ি ঠিকে কাজে, ইঁট ভাটায়,রাস্তা মেরামতের কাজে কিংবা বাবা মায়ের সাথে তাদের ছোটোখাটো ব্যবসায় সাহায্য করতে থাকে।ছোটছোট ছেলেরাও লেদের কারখানায়, দোকানে, রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে,কিংবা বিভিন্ন হাতের কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে একটু রোজগারের আশায়। অপেক্ষাকৃত কম মজুরিতে ছোটছোট ছেলেমেয়েদের কাজেরও অভাব হয়না এই নির্দয় সমাজে।ফলে শিশু বয়স থেকেই তাদের শৈশব বলে কিছুই থাকেনা। তারা না পায় শৈশবে ভালোবাসা,আবদার স্নেহ,বা চারিত্রিক বিকাশের ফুসরত। ফলে কখনও কখনও তাদের মনে অপরাধ প্রবণতা অজান্তেই বাসা বাঁধে। খেলার ছলেই চৌর্য বৃত্তি বা বিভিন্ন নেশার যেমন ধূমপান,ডেনড্রাইট, চরস প্রভৃতি নেশার বশবর্তী হয়ে পড়ে ওরা।
এর সাথে যুক্ত করা যায় সমাজে মেয়েদের প্রতি একটা অসাম্য দৃষ্টিভঙ্গি। মেয়ে মানেই পড়াশোনার দরকার নেই।অল্প বয়স থেকেই ঘরের কাজ,একটু বড়ো হলেই বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা।আঠারো বছরের আগেই মা হওয়া এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া।গ্রামে গঞ্জে এই প্রথা চালু আছে অনেক ভাবেই।এর ফলে এই সমস্ত মেয়েদের শৈশব বলে কিছুই থাকেনা।যদিও প্রশাসনের উদ্যোগে বাল্য বিবাহ কিছুটা হলেও রোধ করা গেছে বর্তমানে।
এর সাথে বর্তমানে যুক্ত হয়েছে আর একটি বিষয় যা শিশুদের শৈশবকে এক্কেবারেই শেষ করে দিচ্ছে। তা হচ্ছে, শিশুদের মানুষ করার নামে তাদের প্রতি বাবা মায়ের অকল্পনীয় প্রত্যাশা।ছোট্ট শিশুর কাঁধে বিরাট ওজনের ব্যাগের বোঝা।তার সাথে স্কুলগুলোতেও পড়াশোনার অত্যধিক চাপ প্রদান বাচ্চাদের উপর। একে তো নিউক্লিয়ার পরিবার এখন,দাদু ঠাকুমার আদর থেকে এমনিতেই বঞ্চিত এখনকার শৈশব।এর সাথে কোনো সুযোগই নেই খেলার। বন্ধু নেই, খোলা মাঠ নেই, দুষ্টুমি নেই, আবদার নেই আছে শুধুই কেরিয়ার সর্বস্ব শৈশব। তাদের ছোট্ট জীবন বাবা মায়ের আর শিক্ষক শিক্ষিকাদের স্বপ্ন পূরণের যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে। গিনিপিক হয়ে খুড়োর কলের পিছনে ছোটার কৌশল শিশু বয়স থেকেই তারা রপ্ত করে ফেলেছে। ফলে তারা শৈশবের মধুর দিনগুলো কেমন হয় তার কোনো সম্যক ধরণাই মনে তৈরি হয়না। তারা অপরের দুঃখে অথবা সুখে আন্দোলিত হতে শেখেনা,বন্ধু বান্ধবের সাথে শুধুই প্রতিহিংসা আর কম্পিটিশন এর সম্পর্ক গড়ে উঠে, কীভাবে নিজেকে আরও
‘ টপার ‘ করে গড়ে তোলা যায় সেদিকেই তাদের লক্ষ্য থাকে দৃঢ়। ফলে শৈশবটা কখন অস্তমিত সূর্যের মতো ঢলে পড়ে জীবন পথে।শিশুরা বড়ো হয়,মানুষ হয়,জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয় ঠিকই শুধু তাদের বড়ো হবার পর শৈশব সম্পর্কে কোনো মনখারাপ থাকেনা,থাকেনা ক্লান্ত জীবনে একদণ্ড ফুরসৎ পেলেও শৈশবে ফিরে যাওয়ার গভীর আকুতি।
-
গল্প- কাঙালি ভোজন
কাঙালি ভোজন
-পারমিতা ভট্টাচার্যআজ চাটুজ্যে বাড়িতে যোগ্যি চলছে।মোহনপুর গ্রামের সবথেকে ধনী পরিবার হলো মনোহর চাটুজ্যের পরিবার।তাদের তিন পুরুষের সুতোর ব্যবসা কলকাতায়।পরিবারের বেশিরভাগ লোকই থাকে কলকাতায়।কিন্তু বছরের প্রথম দিনে তারা সবাই মোহনপুরের এই গ্রামের বাড়িতে এসে হাজির হন তিন চার দিনের জন্য।বছরের প্রথম দিনেই চাটুজ্যেদের বাড়ির সামনের খোলা মাঠে প্যান্ডেল বানানো হয়।বহু গরীব দুঃখীকে পেটভরে খাওয়ানো হয়,আর সাথে শীতের পোশাক,কম্বল প্রভৃতি দান করাও হয়। সাত পাড়ার লোকে ধন্য ধন্য করে মনোহর চাটুজ্যেকে।
আজ সকাল থেকেই নিতাইয়ের মনটা খারাপ।এমন মন খারাপ তার প্রায়ই হয়।মুখ গোমড়া করে পেল্লাই বাড়ির ভাঙা দাওয়ায় প্লাস্টার খসা দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে সে।নিতাইদের বাড়িটা তিনতলা,কিন্তু এখন প্রায় ধ্বংসাবশেষটুকু যাইহোক করে টিকে আছে আর কি।বাড়ির ছাদে বট অশ্বত্থের ঝুরি ,সাথে দেওয়ালের গায়ে পুরু শ্যাওলা আর আগাছার উপস্থিতি।নিতাইয়ের বয়স বছর পনেরো।তাদের অবস্থা চিরকাল এমন দুর্দশাগ্রস্ত ছিলনা। খুবই স্বচ্ছল পরিবার ছিল।মাএর মুখে তাদের অতীতের গল্প শুনতে শুনতে নিতাইয়ের রক্ত গরম হয়ে ওঠে।কিন্তু সে নিরুপায়।কারণ টাকার জোর তাদের নেই।একসময় জমিদার বাড়ি ছিল তাদের বাড়ি।কত লোকের আশ্রয়স্থল ছিল এই মজুমদার পরিবার।কত আলোর রোশনাই ছিল এই পেল্লাই বাড়িটা ঘিরে।আর আজ! একটা ঘরে যাইহোক করে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে তারা থাকে।বৃষ্টির দিনে ছাদ চুঁইয়ে জলে ভেসে যায় সব।ভাঙা বাড়িতে সাপ আর শেয়ালের সাথে বসবাস করতে হয় তাদের।নিতাইয়ের মাও পরের বাড়ি কাজ করে যাইহোক করে সংসার চালায়।
নিতাইদের আগে সুতোর বিরাট করবার ছিল কোলকাতায়, নিতাইয়ের দাদুর গদাধর মজুমদারের আমলে।তখন ইংরেজ আমল। মূলত এই সুতোর কারবারেই ফুলে ফেঁপে ওঠে ওদের জমিদারী।তখন এই জমিদার মনোহর চাটুজ্যে নিতাইদের সুতোকলের একজন কর্মী ছিল। তাদের অবস্থা খুবই করুণ থাকার দরুণ নিতাইয়ের দাদুই মনোহর চাটুজ্যেকে এই কাজটা দেয়। পরে সে সুপারভাইজারও হয়ে যায়। বয়স্ক গদাধর মজুমদার বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে ক্যাশের সব দায়িত্ব ছেড়ে দেন মনোহর চাটুজ্যের উপর। কারণ নিতাইয়ের বাবা মানবেশ মজুমদারের বিষয় বুদ্ধি কিছুই ছিলনা বলতে গেলে। সে ছিল বাবু মানুষ।গান বাজনা,ছবি আঁকা,বইয়ের মধ্যেই ডুবে থাকতো সর্বক্ষণ। এই সুবর্ণ সুযোগেই গদাধর মজুমদারের মৃত্যুর পর তার ব্যবসা করায়ত্ত করে মনোহর চাটুজ্যে। সব শেষ হয়ে যায় মজুমদার পরিবারের। অন্যদিকে ফুলে ফেঁপে ওঠে মনোহরের পরিবার। নিতাইয়ের বাবাও অল্প বয়সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়।আজ তিনদিন হলো নিতাইদের ফ্যান ভাতে নুনটুকুও জোটেনি।মাসের শেষ সপ্তাহটা ওদের এভাবেই কেটে যায় ।তবুও ওরা কখনো কারো কাছে হাত পাতে না। হয়তো বনেদিয়ানাই এর জন্য দায়ী। আজ মনোহর চাটুজ্যের বাড়ি মহাভোজ। যত গরীব দুঃখী আজ চলেছে ওখানে। নিতাইয়ের বন্ধু তপন বেলায় এসে নিতাইকে তৈরী থাকতে বলে গেছে। দুজনে মিলে
চাটুজ্যেদের বাড়ি খেতে যাবে। নিতাই প্রথমে না করে দেয়। তপন কিন্তু নাছোর বলে , ‘ মাংস খাবি,পায়েস খাবি,মিষ্টি খাবি।সারাবছরের এই একটা দিনই তো খেতে পাবি ভালোমন্দ।বাকি সারা বছরই তো ফ্যানভাত আর শাক সেদ্ধ।’ একপ্রকার জোর করেই টানতে টানতে তপন নিতাইকে নিয়ে গেলো চাটুজ্যেদের বাড়ি। সেখানে গিয়ে নিতাই দেখে আজ যেনো সেখানে মেলা বসেছে। হাজার হাজার লোকে লোকারণ্য।মাইকে হেঁকে কম্বল , পোষাক বিতরণ করা হচ্ছে। হঠাৎই নিতাইয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো মনোহর চাটুজ্যে। একদৃষ্টে তার খর্বাকার চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলো নিতাই।তখন মনোহর চাটুজ্যে তাকে বললো , ‘ পেটভরে খেয়ে যাস,তোদের মতো কাঙালিদের জন্যই তো বছরে একটা দিন এসবের আয়োজন করি। সারাবছর শাক পাতা সেদ্ধ আর ফ্যানভাত খাস।একটা দিন তাই কাঙালি ভোজন করাই।আর শোন, যাবার সময় একটা চাদরও নিয়ে যেতে ভুলিস না যেনো।’
একটা হিম স্রোত বয়ে গেলো নিতাইয়ের সারা শরীর বেয়ে। মনে হলো কে যেনো ঠাস ঠাস করে কতকগুলো চড় কষিয়ে গেলো গালে। মনোহর চাটুজ্যের কথাগুলো অট্টহাসির মতো তার কানে বাজতে লাগলো। তাদেরই সম্পত্তি গ্রাস করে চাটুজ্যেদের এতো রমরমা,আর তাকেই কিনা আজকের দিনে এতো লোকের সামনে অপমান করা। মাঠের ভিড় ঠেলে পুকুর,রাস্তা,জমি পেরিয়ে রুদ্ধশ্বাসে সে দৌড় লাগালো।অবশেষে বাড়ির উঠোনে এসে ধপ করে বসে পড়লো সে।ঘরের ভাঙা দরজা ঠেলে ছুটে এলো মা।ছেলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করলো, ‘ কী হয়েছে?’ নিতাই কিচ্ছু বললো না।শুধু মাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলো।আর জিজ্ঞেস করলো, ‘ মা আমরা কি কাঙালি? ‘ মা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ তোর মতো সাত রাজার ধন মানিক আছে যার ঘরে সে কখনও কাঙালি হতে পারে? ‘ শান চটা মেঝেতে বসে পরম স্নেহে মা ছেলেকে ফ্যানভাত খাওয়াতে লাগলো। বছরের প্রথম দিনের এই তৃপ্তি যে পরমান্নতেও নেই সেটাই অনুভব করলো নিতাই।