• কবিতা

    কবিতা- শুধু একা..

    শুধু একা….
    – পারমিতা ভট্টাচার্য

    কথার বেড়াজালে নিত্য বাঁধো আমায়
    অপলক চোখে তবু মেঘের আনাগোনা
    ভুবন ভোলানো হাসিতে লুকিয়ে কষ্টের ধারাপাত
    এতো পথ হেঁটে তবু, তোমায় হলোনা জানা।

    ভালোবাসি বলা বড়ো সোজা
    কঠিন যে হাত ধরে পথ চলা
    দিনের শেষে অস্তরাগ মেখে ভাবি
    কত কথা হলোনা কিছুতেই তোমায় বলা।

    পায়ে পায়ে হেঁটে যাই, দোটানার সুরে
    পাকদণ্ডী বেয়ে হিমস্রোত নামে শিরদাঁড়ায়
    মনের অলিন্দে জাফরী চোঁয়ানো রোদ, সিকলী সাজায়
    সন্ধ্যা নামে, ঘরে ফেরা ক্লান্ত পাখির ডানায়।

    তুমি ঘুমাও, স্বপ্নপলাশ ভরে থাকুক তোমার মন জুড়ে
    শুধু আমার রাতজাগা করুণ আঁখি উঠে বারংবার কেঁপে
    কথায় কথায় রাত্রি নামে অবসন্ন এই মনে
    হলোনা শুধু তোমার হৃদয়তলে নিজেকে দেওয়া সঁপে।

    মনে করো, অনেক অনেক বছর পরে
    হঠাৎ করে বিলাসী রোদে হয় কখনো দেখা
    তুমি তখন বুঝি অন্য কারোর মানুষ
    শুধু মন খারাপের হওয়ায় ভাসে আমার এ মন…একা।

  • কবিতা

    কবিতা- শুনতে কি পাও 

    শুনতে কি পাও
    – পারমিতা ভট্টাচার্য

     

     

    শুনতে কি পাও তার কাতর গোঙানি?
    এখনও যত্ন করে রাখা তার খেলনা থরে থরে
    যার ঠোঁট ফোলানো অভিমানে সবাই আকুল হতো,
    এখন চিরঘুমে শায়িত সে লাশকাটা ঐ ঘরে।

    মেয়ে হয়ে জন্মেছিল, ঘরটি আলো করে
    ভাঙ্গবে নাকি সে ঘুম আর….কী হবে আর জেনে?
    তার চোখের পলক মাপত মা বাপ, চোখের মণি বলে….
    একলা পেয়ে হায়েনার দল তবুও নিয়েই গেল টেনে।

    রাস্তার মোড়ে নেকড়েরা সব রাত্রদিন ওৎ পেতেই থাকে,
    তবু স্বাধীনতার পতাকা বাতাসে পতপত করে ওড়ে
    রাজা – উজির ব্যস্ত শুধুই গোগ্রাসে দেশ খেতে….
    এ আর নতুন কথা কী? সেই দেশেতে হাজার মেয়ে এমন করেই মরে।

    ক্যালেন্ডারে ভীত আজ তারিখ – মাস – বছর,
    মানচিত্র যখন লাজে মুখ ঢাকে এই দেশে….
    আজ কাঠুয়া, আলীগড় শুধুই ডুকরে কেঁদে ওঠে,
    কন্যা শিশুর খুন, ধর্ষণ দাঁড়িয়েছে শ্বাপদের অভ্যাসে।

    বেটি বাঁচাও স্লোগানে যখন তোলপাড় হয় দেশ,
    আমরা করি মাতৃপূজার বৃহৎ আয়োজন…
    তখন ধুলায় পড়ে কাতরায় রক্তমাখা কন্যা শিশুর শরীর
    সেই দেশেতে মোড়ে মোড়ে মিথ্যা ভাষণ অন্তত নিষ্প্রয়োজন।

  • কবিতা

    কবিতা- প্রতীক্ষা

    প্রতীক্ষা
    – পারমিতা ভট্টাচার্য

     

     

    আমি শেষ ট্রেনের হুইসেল শুনি কান পেতে
    কেউ যদি ভগ্ন দরজায় আরও একবার দেয় টোকা
    ছুটে আসে ডাকনাম ধরে হাঁক দিতে দিতে
    অনন্তকাল অপেক্ষায় থাকি বসে দুয়ার এঁটে একা।

    সব লেনদেনা চুকে গেলে, পড়ে থাকে কাছিমের খোল
    জং ধরা সম্পর্কে ছড়ায় বিবর্ণ কান্নার রোল
    ছকে বাঁধা জীবনপঞ্জি জুড়ে হাহুতাশ বাঁধে বাসা
    উদাসী হাওয়ায় ভাসে নিঃসঙ্গ একতারাটির বোল।

    স্বপ্নে চকমকি পাথর ঠুকে জ্বালায় কারা আগুন
    ক্লান্ত চক্ষু অর্ধ উন্মীলিত, সময় ফুরিয়ে আসে
    প্রতিদিনই শেষ ট্রেন সময়ের যবনিকা টেনে চলে যায়
    কেউ আসেনা, শুধু বাতাসে মনকেমনের গন্ধ ভাসে।

  • গল্প

    গল্প- সারপ্রাইজ

    সারপ্রাইজ
    – পারমিতা ভট্টাচার্য

     

     

    ‘হতচ্ছাড়া ছেলে, তোকে না বিশ দিন বারণ করেছি ওকে নিয়ে বেশি আদিখ্যেতা করবি না।’ বেশ ঝাঁঝিয়ে কথাটা বলে ওঠে অনিকেত তার ছয় বছরের ছেলে বাবাইকে।
    বাবাই তো বাবার এহেন আচরণে প্রায়ই খুব অবাক হয়ে যায়। ওইটুকু একটা প্রাণী, তাকে দু’টো খেতে দিলে কী এমন ক্ষতি হবে, এটাই বুঝে উঠতে পারে না বাবাই। বাবাইয়ের সেই ভালোবাসার ‘ম্যাও’কে তার বাবা একদমই সহ্য করতে পারে না। রোজ সকাল বিকেল একটা বেড়াল বাবাইদের বাড়িতে আসতো। বাবাই সেই বেড়ালকে খেতে দিতো, মাথায় হাত দিয়ে আদর করতো। এক কথায় শহুরে জীবনে বাবাইয়ের ছোট্ট মনের একটু অক্সিজেন ছিল সেই বেড়ালটি। বেড়ালটি তার পোষ্য ছিল না কোনও দিনই। শুধুমাত্র দু’টো খাবার জন্য আর একটু ভালোবাসার জন্যই বেড়ালটা বাবাইয়ের পোষ মেনে গিয়েছিল। বাবাইয়ের মা সঞ্চয়িতা বাবাইকে এ ব্যাপারে কিছু বলতো না। সে বরং বাবাইকে একটু প্রশ্রয়ই দিতো। কারণ, বাবাই সে ভাবে বন্ধুদের সাথে খেলাধুলো করার সুযোগই পেতো না। বাবাইদের বাড়ি ছিল লেক টাউনে। শহুরে জীবনে বন্ধু বলতে, খেলার সঙ্গী বলতে ওই বেড়ালটিই ছিল। বাবাইয়ের অবসর সময় কাটতো ওই ‘ম্যাও’কে নিয়ে। কিন্তু এর জন্য অনিকেত উঠতে, বসতে কথা শোনাতো মা ও ছেলেকে। অনিকেত নিজে উচ্চ শিক্ষিত এবং এম.এম. এন.সি-তে উচ্চ পদে কর্মরত। সে নিজে শিক্ষিত হওয়া সত্বেও বড় বেশি কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল। ওই বাড়িতে আসা বেড়ালটাকে সে মোটেই দেখতে পারতো না। কারণ, বেড়ালকে সে চরম অপয়া বলে মনে করতো। কিন্তু ছোট বাবাই বিড়ালটার প্রতি স্নেহবশত বাবার কথাতে খুব একটা বেশি আমল দিতো না।

    কিন্তু একদিন ঘটল ঘোর বিপত্তি। সে দিন ছিল অনিকেতের অফিসের জরুরি মিটিং। এই মিটিং আয়োজনের যাবতীয় দায়িত্ব ছিল অনিকেতের উপর। এই মিটিং নিয়ে তাই সে খুব উত্তেজিত ছিল। সকাল সাত’টার মধ্যেই সঞ্চয়িতা অনিকেতের ব্রেকফাস্ট রেডি করে দেয়। অনিকেতও খুব তাড়াতাড়ি করে ব্রেকফাস্ট করে রেডি হয়ে যায় বেরোনোর জন্য। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে নিচে অপেক্ষা করছে। এমতাবস্থায় ঠাকুর প্রণাম করতে সে ঠাকুর ঘরে যায়। এটা তার বরাবরের অভ্যাস। ঠাকুর প্রণাম সেরে অনিকেত গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় বাবাইয়ের আদরের বেড়ালটা অনিকেতের রাস্তা কেটে চলে যায়। ব্যাস, আর কোথায় যায়? সে তো চিৎকার করে ওঠে। অপয়া বলে শাপ- অভিশাপ দিতে থাকে বেড়ালটাকে। পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা বাবাই আর সঞ্চয়িতাকে বলতে থাকে – ‘আমার আজ এত বড় টেন্ডারের মিটিং আছে। এই মিটিংটা সাকসেসফুল হলে আমার প্রমোশনটা বাঁধা ছিল। তোমরা এর মর্ম কী বুঝবে? ঘরে বসে যা চাইছ তাই পাচ্ছ, ঠান্ডা ঘরে আরামে জীবন কাটাচ্ছ। আজ এই জরুরি কাজে বেরোনোর আগে ওই অপয়া বেড়ালটা আমার রাস্তা কেটে চলে গেল। সব শেষ হয়ে গেল আমার। আদৌ ঠিকঠাক অফিসে পৌঁছতে পারবো কি না, মিটিংটা সাকসেস হবে কি না তা ভগবানই জানেন। তোমাদের জন্য আজ আমার এত দিনের পরিশ্রম জলে চলে গেল। আজ আমি বাড়ী ফিরে যদি ওই অপয়াটাকে বাড়ীতে দেখি তাহলে তোমাদেরও ওর সাথে বাড়ী থেকে বের করে দেবো।’

    সে দিন সকাল থেকেই বাবাই আর তার প্রাণের থেকেও প্রিয় ম্যাওকে ডাকলো না, আদরও করলো না, কিছু খেতেও দিলো না। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে দেখল বিড়ালটি তারই অপেক্ষা করছে। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে বাবাই তার মাথায় হাত বোলায়, দুধভাত খেতে দেয়। কিন্তু সে দিন বাবার বকুনির ভয়ে কিছুই করলো না। বাবাইও সে দিন স্কুল থেকে ফিরে কিচ্ছু খেলো না। অন্য দিকে বিড়ালটির মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে সঞ্চয়িতাও। দরজার ওপারে এক নাগাড়ে বিড়ালটা মিউ মিউ করে ডেকেই চলেছে। কেউ দরজা খোলেনি আজ। ছোট্ট বাবাই কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায়।

    অন্য দিকে অনিকেতের মিটিং সাকসেসফুল। টেন্ডারটা তাদের কোম্পানি পেয়ে গেছে। কোম্পানি সব ক্রেডিটটাই অনিকেতকে দিচ্ছে। তাই এবার তার প্রমোশনটাও একেবারে পাকা। এই খুশির খবর সে বাড়িতে ফোন করে জানালো না। ভাবলো বাড়ি গিয়ে সঞ্চয়িতাকে সারপ্রাইজ দেবে। বাবাই মিষ্টি ভালোবাসে তাই তার জন্য একটু মিষ্টি কিনে অনিকেত বাড়ি ফিরলো রাত আট’টায়। কলিংবেল বাজলেই
    অন্যদিন বাবাই ছুটে আসে দরজা খুলতে, আজ দরজা খুললো সঞ্চয়িতা। সঞ্চয়িতার মুখের দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে অনিকেত বললো- ‘আজকের মিটিং সাকসেফুল হলো আমার। আমরা টেন্ডারটা পেয়ে গেছি।’ কিন্তু ভাবলেশহীন সঞ্চয়িতার মুখের দিকে তাকিয়ে অনিকেত কিছু অঘটনের আঁচ পেলো। সে জিজ্ঞেস করলো সঞ্চয়িতাকে- ‘বাবাই কোথায়? কিছু হয়েছে নাকি? তখন সঞ্চয়িতা কান্না ভেজা গলায় বললো- ‘তুমি সকালে বলে যাবার জন্য আজ আমরা কেউ বেড়ালটাকে খেতে দিই নি। এমন কি ঘরেও ঢুকতে দিই নি আজ একবারও। সারাদিন সে ঘরের বাইরে মিউ মিউ করে ডেকে গেছে।স্কুল থেকে ফিরে বাবাইও আজ কিচ্ছু খাইনি। কেঁদে কেঁদে আমার কোলে শুয়ে ঘুমিয়ে গেছিলো।বিকালে একটু বাড়ীর বাইরে বাবাইকে নিয়ে দোকান যাওয়ার সময় দেখি রাস্তার পাশে বিড়ালটির রক্তাক্ত, নিথর দেহটা পড়ে আছে। বাবাই তো দেখেই চিৎকার করে উঠেছিল। ক্ষিধের জ্বালা সহ্য করতে না পেরেই হয়ত অন্য কারোর বাড়ীতে যাচ্ছিল বেড়ালটা। রাস্তা পেরোনোর সময় কোনো গাড়ী তাকে চাপা দিয়ে চলে যায়। সেই থেকেই বাবাই ঘরে চুপ করে বসে কেঁদেই যাচ্ছে। কিছু বোঝালেও বুঝছে না।’
    অনিকেত সব শুনে ছেলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারলোনা। একটা বিশ্রী অপরাধবোধ ওর বুকের মধ্যে চেপে ধরলো। আজ অনিকেত প্রসন্ন মনে বাড়ীতে একটা সারপ্রাইজ দেবে ভেবেছিল কিন্তু বাড়ী ফিরে এসে নিজেই একটা ভয়ঙ্কর সারপ্রাইজের সম্মুখীন হলো। আস্তে আস্তে নিজের ঘরে গিয়ে চেয়ারে চুপ করে মাথাটা দু’হাতে চেপে বসে রইলো। আর মনে মনে এটাই ভাবতে লাগলো যে, কে কার জন্য অপয়া হলো আজ? বিড়ালটা তার জন্য নাকি সে বিড়ালটার জন্য?

  • কবিতা

    কবিতা- তথাপি

    তথাপি
    -পারমিতা ভট্টাচার্য

     

     

    বুকের মধ্যে যত্ন করে আঁকি একটা নদী
    যার ছোট্ট ছোট্ট ঢেউয়ে আমি বাঙুর হয়ে যাই
    দু’চোখে আঁকি নক্সী কাঁথার অপূর্ব এক মোহ
    টুপটাপ শব্দে সারা শরীর জুড়ে তবু বৃষ্টি নামে কই?
    হৃৎপিণ্ড থেকে নাভিমূল অবধি বনবিথির ছায়া
    ঠোঁটের কোণে পুষে রাখি মাতাল মহুয়া বসন্ত
    একটিবার বুকের ঊষর উপত্যকায় বৃক্ষ রোপণ করো
    সমস্ত অনাবিল ইচ্ছেরা ছুঁয়ে যাবে দূর দিগন্ত
    মনের অদম্য ইচ্ছেগুলো আজ
    প্রজাপতির মত মেলতে চায় পাখা
    তবুও সংযমী সময় বারবার কড়া নাড়ে
    রাকা চাঁদ দেখো কালো মেঘে রয় ঢাকা।
    এসো আজ আরও একবার ঘুমঘোর মুছে
    নদীর মোহনায় অস্তরাগে মাখামাখি হয়ে বসি
    পাঁজরে তালাবন্ধ রাখি বিষের তীব্র জ্বালা
    তথাপি বুকের মধ্যে গুঁড়ো স্বপ্নের আসমানী রঙ পুষি।

  • গল্প

    গল্প- না বলা কথা

    না বলা কথা
    -পারমিতা ভট্টাচার্য

     

     

    ‘বাড়িতে এক ঘেয়ে বসে থাকতে আর ভালো লাগে না আমার। মাঝে মাঝে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে সুদূর দিগন্তের দিকে। খোলা আকাশের নিচে বসলে নিজের কষ্টকে কিছুটা হলেও ভোলা যায়। নিজেকে অনেক প্রাণবন্ত লাগে।’ এসব কথাই অপু বলছিল ভাই সঞ্জুকে। সঞ্জুও তাই বাড়ির পারমিশন নিয়ে দাদাকে একটু ঘুরতে নিয়ে বেরিয়েছিল। অপুর অশক্ত, দুর্বল শরীর তাই বেশি দূর যেতে পারেনি। বাড়ির কাছেই মালিয়া স্টেশনের বেঞ্চেই বসেছিল ওরা দু’জন। এই স্টেশনটি একটু নির্জন। দু’ দিকে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের সমাহার। মাথার উপর খোলা আকাশ। এই পরিবেশে বসে অপুর আরও অনেক দিন বাঁচতে ইচ্ছে করছে। উপভোগ করতে ইচ্ছে করছে প্রকৃতির এতো রূপ। ঠিক তখনই সে দেখে উল্টো দিকের প্ল্যাটফর্মে নীলা। সাথে স্কুলের আরও শিক্ষক, শিক্ষিকা ও এক ঝাঁক শিশু। নীলার সাথে একটু কথা বলার জন্য ছটফট করে উঠল অপুর মন। কিন্তু চিরকালের মত সে দিনও সে গুটিয়ে রাখলো নিজেকে। বাড়িতে বসে অপু ভাবতে লাগলো নীলা এখন নিজেকে অনেক শক্ত করে নিয়েছে। যদিও এখনও সে বাচ্চাদের মতই ছটফটে প্রাণবন্ত আছে। সে দেখতে যতই বিকৃত হয়ে যাক, আজও সে অপুর চোখে স্বর্গের অপ্সরী। অপু মনে মনে ভাবলো, তার হতে সময় খুব কম। যে কথা সে এত ধরে বুকে জমিয়ে রেখেছে, মুখ ফুটে তার সামনে বলে উঠতে পারেনি.. সে কথা একটা চিঠি লিখে নীলাকে জানাবে। নিজের খুড়তুতো বোন ঈশিতার হাতে চিঠিটা দিয়ে নীলাকে দিতে পাঠালো। ঈশিতা নীলার হতে চিঠিটা দিয়ে বলল – ‘এখন নয়, রাতে পড়িস।’
    রাতে শোবার সময় নীলা তার অতি ক্ষীণ দৃষ্টি দিয়ে চিঠিটা পড়তে লাগলো।

    ” প্রিয়তমাষু,

    আজ যখন তোমায় মালিয়া স্টেশনে দেখলাম তখন একটা অদ্ভুত ভালোলাগা মনে জুড়ে আধিপত্য বিস্তার লাভ করেছিল। বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল আমার। কন্ঠ থেকে কিছুতেই কোনো শব্দ স্বর হয়ে বেরোতে চাইল না আজ। শুধু মনে হলো দু’ চোখ ভরে দেখে যাই তোমায়। তুমি এখনও সেই অষ্টাদশীর মতই সুন্দর, প্রাণবন্ত আছো। মনে আছে নীলা, আমি তোমার সামনে গেলেই কেমন ক্যাবলা হয়ে যেতাম। তুমি সারাক্ষণ কত কথাই না বকবক করে যেতে। আর আমি? দূর থেকে তোমার মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতাম। কখনও তোমাকে কোনও চিঠি লেখার ইচ্ছে বা সাহস কোনওটাই আমার হয়নি। আমি সারা জীবন তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে শ্রাবস্তীর কারুকার্য খুঁজে যেতাম। ভেবেছিলাম তোমার হাতটা হাতের মধ্যে রেখে কাটিয়ে দেবো সারা জীবন। আমৃত্যু তোমার চোখে খুঁজে নেবো জীবনের মানে। এখন হাসি পায় সে সব কথা ভাবলে। আজ কোথায় তুমি আর কোন অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া আমি। তোমার মনে আছে নীলা, ঈশিতার হাত দিয়ে একটা চিরকুট পাঠিয়েছিলাম তোমায়। তখন আমার মাঝে মাঝেই জ্বর আসতো। কলেজ যেতে পারতাম না। তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছে করতো তখন। কিন্তু তখন তুমি রাজেশের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছো। সে চিরকুটখানা তুমি খুলে দেখার প্রয়োজনও বোধ করলে না । রাজেশ তখন নিজের লাল্টুস রূপ নিয়ে তোমার মত সহজ সরল মেয়েদের প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে সর্বনাশ করে যাচ্ছে। তোমাকে সাবধান করতেই লিখেছিলাম সেই চিরকুট। তারপর যা হওয়ার হলোই। তুমিও রাজেশকে ভালোবেসে ঠকে গেলে। বলতে গেলে একেবারেই শেষ হয়ে গেলে। আমি তখন রোগশয্যায়। সদ্য ধরা পড়েছে আমার বোন ক্যান্সার। কলেজ তো একেবারেই প্রায় বন্ধ। তবুও যেন এমন একটা দিন যায় না যে দিন আমি তোমার কথা ভাবি না। তোমার উপর যখন রাজেশ অ্যাসিড এট্যাক করে তখন আমি ব্যাঙ্গালোরে। বাড়ি ফিরে সব শুনে মাথার রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল আমার। কিন্তু আমি নিরুপায় একটা মানুষ। বাবা, মা তখন আমার চিকিৎসা করাতে প্রায় নিঃস্ব। ওদের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কিছুই করতে পারিনি। তুমি যখন হসপিটালে অ্যাডমিট ছিলে, আমি প্রায়ই যেতাম তোমায় দেখতে। তুমি কিচ্ছুটি জানতেও পারতে না। তোমার মত সুন্দর মন আমি আর কোত্থাও পায়নি নীলা। তুমি যে আজ আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছো, স্কুলে পড়াচ্ছ, বাচ্চাদের মত খিলখিলিয়ে হাসছো, আনন্দে আছো এই দেখে আমি আজ ভাবি, আমি হয়তো এবার মরেও শান্তি পাবো। তোমাকে সারা জীবন দূর থেকেই দেখতে চেয়েছি। কিন্তু তাই বলে ছুঁয়ে দেখতে মন যে কখনওই চায়নি, তা নয়। কিন্তু মনকে বারবার বুঝিয়েছি তুমি হলে ফুলের সুগন্ধ, পূর্ণিমা চাঁদের জ্যোৎস্না। তোমাকে শুধুই অনুভব করা যায়, ছোঁয়া যায় না। নীলা, এই চিঠি তোমাকে লেখা প্রথম ও শেষ চিঠি আমার। তুমি এই চিঠি যখন পাবে আমি তখন হসপিটালের বেডে হয়তো মৃত্যুর অপেক্ষা করবো। একটা শেষ অনুরোধ তোমার কাছে নীলা। রাখবে? তোমার কাছে আমি কোনও দিন কোনও দাবী করিনি, আজ করছি। আসবে হসপিটালে একটিবার আমাকে দেখতে? তুমি আজও আমার কাছে সেই একই আছো যাকে আমি সারা জীবন ভালোবেসে এসেছি। ঈশিতার হাত দিয়ে চিঠিটা পাঠালাম। এবারটা অন্তত পড়ো চিঠিটা। তোমাকে অনেক কথা যে আমার বলার ছিল নীলা। পরশু আমার অপারেশন। হয়তো আর বাঁচবো না। শরীর আর অপারেশনের ধকল নিতে পারে না। একটিবার – শুধু একটিবার তোমায় হাতে হাত রেখে বলতে চাই নীলা, আমি এ জীবনে শুধু তোমারই ছিলাম। সেই সুযোগটুকু পাওয়ার ভাগ্যও কি আমি করিনি নীলা? অপেক্ষা করবো তোমার।

                                            ইতি ভাগ্যহীন,
                                                  অপু। “

    সে দিন রাত থেকেই অপুর শরীর খুব খারাপ হতে থাকে। ডক্টর এসে বলে হসপিটালে অ্যাডমিট করাতে। অ্যাম্বুলেন্সে ওঠার সময় নীলাদের বাড়ির দিকে এক পলক তাকিয়ে দেখে অপু। নীলা দাঁড়িয়ে আছে গেটের কাছে। হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পথেই অপু শেষ হয়ে যায়। অপুর না বলা কথা গুলো আজ মহাশূন্যে ঘুরপাক খেয়ে শেল হয়ে বেঁধে নীলার বুকে।
    হঠাৎই অপুর মা আসে নীলাদের বাড়ি। নীলার বাবাকে তিনি বলেন যে, তাঁর ছেলে মৃত্যু সময় তার বাবাকে বলে গেছে তার চোখ দু’টো যেন নীলাকে দেওয়া হয়। কারণ, অ্যাসিড এট্যাকে নীলার একটা চোখ একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে, আর একটা চোখেও দৃষ্টি ক্ষীণ।

    নীলা আজ বাড়ি আসছে, দু’ চোখে দৃষ্টি নিয়ে। অপুর ভালোবাসা বিফলে যায়নি। সারা জীবন অপু তার সাথেই থাকবে, চোখের মণি হয়ে।

    সমাপ্ত।

  • চিঠি

    চিঠি- খোলা চিঠি

    খোলা চিঠি
    -পারমিতা ভট্টাচার্য

     

     

    শ্রীচরণেষু
    মা,

    অনেক দিন হলো তোমাদের কোনও খবর পাইনি। আশা করি ঈশ্বরের কৃপায় তোমাদের সব খবরই কুশল। বাবার বুকের ব্যথাটা কেমন আছে মা? পরান বাবু দাদার চাকরিটা করে দিয়েছে? মিলি এখন কত বড় হয়েছে মা? কত দিন হয়ে গেল তোমাদের দেখিনি। জানো মা, শহরে যখন তুমুল বৃষ্টি নামে আমি জানালার ধারে বসে তখন ছোট বেলার বৃষ্টি ভেজার দিনগুলোর কথা মনে করি। শ্রাবণের ধারা তখন গড়িয়ে পড়ে আমারও গাল বেয়ে। মনে আছে মা, বৃষ্টিতে ভেজার পর তুমি তোমার আঁচল দিয়ে আমার গা, মাথা মুছিয়ে দিতে। জ্বর হলে সারা রাত মাথার কাছে জলপট্টি আর পাখা নিয়ে বসে থাকতে জেগে। তোমার গায়ের গন্ধ কত দিন পাইনি মা। খুব লোভ হয় জানো সেই গন্ধটার। তাই কালীপুর যাওয়ার সাহস না হলেও স্টেশনে গিয়ে বসে থাকি। তখন দূর থেকে দেখি দাদা স্টেশনে বাপি, ছটুদের সাথে তাস খেলছে, মদ খাচ্ছে, খিস্তি দিচ্ছে মুখে। আমি একদিন কিছু টাকা তোমাকে দিতে গিয়েছিলাম মা। কিন্তু দাদা কিছুতেই আমায় বাড়ি যেতে দিলো না। বলল, ‘নষ্টা মেয়ে! তুই গেলে আমাদের বাড়ির মান সম্মান সব মাটিতে মিশে যাবে।’ কিন্তু টাকাটা ছিনিয়ে নিলো আমার হাত থেকে। আমি নষ্টা মেয়ে আর আমার রোজগারের টাকাটা খুব প্রয়োজনীয়…. তাই না? আমি প্রতি মাসে আমার গতর বেচে তোমাদের যে টাকা পাঠাই, তা দিয়ে তোমাদের মুখে অন্ন জোটে। এক বারও ভেবে দেখো ওই টাকাতে কতটা চোখের জল, হৃদয় নিংড়ানো কষ্ট মিশে আছে?

    মাত্র ওই কটা টাকার জন্য তোমার সনাতন বাবুর মত পিশাচের হাতে আমায় তুলে দিয়েছিলে। আর পিশাচটা লোক দেখানো আমায় বিয়ে করে এনে তোলে এই বেশ্যাখানায়। আমাকে বেচে দেয় মোটা টাকার বিনিময়। আমাকে বেচা টাকাতে তোমরা কোঠা দালান বাড়ি তুলেছিলে। সাজিয়ে ছিলে নিজেদের সংসার। আমি জানি মা, আমার মত সমত্ত মেয়ের বাড়িতে থাকার জ্বালা। প্রতিবেশীদের, আত্মীয় স্বজনের নজর এড়াতে তাই আমায় বাড়ি থেকে একেবারেই নিকেশ করে দিলে। জানো মা, আমার আজ আর কোনও দুঃখ নেই। কোনও অভিযোগও নেই তোমাদের বিরুদ্ধে। এখন আমি আর কাঁদি না। শরীরে – ব্যথা – যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমি এটা বুঝি যে আমি তোমাদের গলায় কাঁটার মত আটকে ছিলাম। আর আমার মত উঠতি বয়সের মেয়েকে খাওয়ানো পরানো অনেক ঝামেলার ব্যাপার। মা, আমার মত অতি সাধারণ একটা মেয়েকে বেচে দালান কোঠা তোলায় কোনও অপরাধ নেই। কিন্তু ওই মেয়েটা সামনে গিয়ে দাঁড়ালে তার ছায়া মাড়ালেও অপবিত্র হতে হয়। পাড়া প্রতিবেশীর কাছে মুখ দেখাতেও লজ্জাবোধ হয় তোমাদের।

    তোমায় তো মা বলে ডাকার আরও কেউ আছে, মা। কিন্তু আমি কাকে মা বলে ডাকি বলো দেখি? মা তো একটাই হয়, তাই না? তোমরা কি পারতে না একটা গরীবের ছেলে দেখে আমার বিয়ে দিতে, সংসার করে দিতে? আমি ভালো আছি মা এখানে। রোজ খাটে শুই। ভালো ভালো খাবার খাই, সুন্দর সাজগোজ করি। আমার কোনও কিছুর অভাব নেই মা। অভাব শুধু তোমাদের, অভাব একটা সংসারের, অভাব একটা নিজের মনের মানুষের। একটা অনুরোধ রাখবে মা আমার? আর কখনও কোনও অনুরোধ তোমার কাছে করবো না। তোমরা মিলির একটা বিয়ে দিও। গরীব ঘরের ছেলে হলেও দেখে ওর একটা সংসার করে দিও। ওর একটা সংসার হোক, মনের মানুষ হোক, মা বলে ডাকার কেউ থাকুক ওকে। আর যদি একান্তই বিয়ে দিতে না পারো তাহলে ওকে তোমরা ওর ভালোবাসার মানুষের কাছে চলে যেতে দিও। ও তার সাথে সংসার করুক। আমাকে তোমরা কৌশিকদা’র সাথে যেতে দাওনি। কারণ ও নিচ জাতের ছিলো। আমিও সে দিন তোমাদের কথা অমান্য করতে পারিনি। তার ফল আমাকে জীবন দিয়ে চোকাতে হচ্ছে মা। এতটা ভালো আমার নাও করতে পারতে তোমরা। তোমাদের মতই না হয় আমিও খুদ কুঁড়োর অভাবের সংসার করতাম। তবুও তো বাঁচতাম। এখন যে প্রতিনিয়ত মরি আমি। মিলির বিয়ের জন্য টাকা জমিয়ে আমিও রাখছি। তোমায় পাঠাবো। আজকাল তোমাকে বড্ড দেখতে ইচ্ছে করে। এ জীবনে কি সেটা আর সম্ভব হবে? আজ এই পর্যন্তই থাক। তোমরা সবাই খুব ভালো থেকো। তুমি, বাবা ও দাদা আমার প্রণাম নিও। মিলিকে আমার ভালোবাসা দিও। আর মনে মনে ভেবো তোমার বড় মেয়ে মরে গেছে তোমাদের জীবন থেকে।

    ইতি,
    তোমার একান্ত অভাগী

  • গল্প

    গল্প- উপহার

    উপহার
    – পারমিতা ভট্টাচার্য

     

     

    তন্দ্রা মাহাতো…..খুব গরীব ঘরের মেয়ে। বাবা ডমরু মাহাতো ক্ষেত মজুরের কাজ করে  সংসার চালায় খুবই কষ্টে শিষ্টে।সংসারে খেতে পড়তেই সব পয়সা শেষ হয়ে যায়। তবু মেয়ে তন্দ্রাকে একটু বেশীই ভালোবাসতো ডমরু। কারণ পড়াশোনায় তন্দ্রা ছিল ভীষণ ভালো। ক্লাসে সে হতো দ্বিতীয়। একটা মাস্টারও দিতে পারেনি কখনও ডমরু। স্কুলের দিদিমনিরাও খুব সাহায্য করত তন্দ্রাকে। কিন্তু পোড়া কপাল হলে যা হয় আর কি! হঠাৎ দু’দিনের জ্বরে ডমরু মারা গেলো। ঘোর অন্ধকার নেমে এলো তন্দ্রাদের জীবনে। ওর মা লোকের বাড়ী বাসন মেজে পাঁচজনের পেট চালাতে পারতো না। তাই অনিচ্ছা সত্বেও তাকে তার মামার বাড়ী চলে যেতে হলো। মামারা তাকে লেখাপড়া শেখানোর থেকে সংসারী করতে বেশী উদ্যোগী ছিল। ঘাড় থেকে নামতে পারলে বাঁচে তারা। তন্দ্রা খুব ভালো কবিতা লিখতো। ছোটো হলেও তার লেখার হাত ছিল। সাথে বই পড়তেও খুব ভালোবাসত।অনেক কাকুতি মিনতি করেও কোনো লাভ হলোনা। কেউ তার কথায় কর্ণপাতই করলোনা। মামীরা ব্যাঙ্গের সুরে বলতো “ওসব কাব্যি করে পেট চলবেনা। সংসারের কাজ শেখো। কাজে দেবে।” যন্ত্রণা বুকে চেপেই একদিন তার থেকে বয়সে দ্বিগুণ একটা লোকের সাথে তার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পরও সে লেখাপড়া চালিয়ে যাবার অনুরোধ জানিয়েছিল তার স্বামীর কাছে।কিন্তু বছর ঘুরতেই তার কোলে এলো সৌম্য।এরপর আর কি? সংসার সমুদ্রে পুরোপুরি ডুবিয়ে দিলো তন্দ্রা নিজেকে। তন্দ্রার স্বামী মনে করতো মেয়েরা সংসার করার জন্যই পৃথিবীতে আসে। তাই তন্দ্রার লেখাপড়া বা ওর লেখা কবিতা নিয়ে কোনোদিনই তার মাথা ব্যাথা ছিলো না। নিজের গোপন ডায়েরি গোপনেই পড়ে থাকতো তার। সবার কথাই মাথা পেতে নিয়েছিল তন্দ্রা নিজের সব আকাঙ্ক্ষাকে জলাঞ্জলি দিয়ে। কখনো লেখার জন্য সংসারকে অবহেলা করেনি সে।স্বামীর চাহিদা পূরণ করে, সংসারের চাহিদা পূরণ করে যেটুকু সময় সে পেত সে লিখতো। লেখা সে ছাড়তে পারেনি। শুধু তার লক্ষ্য ছিল ছেলেটাকে নিজের মনের মতো করে মানুষ করার, পেরেছে সে। ছেলে সৌম্য এখন বাংলার প্রফেসর। সৌম্যর বরাবরের খুব প্রিয় ছিল ওর মায়ের লেখা।
    কত জায়গায় যে মায়ের লেখা কবিতা আবৃত্তি করে ও পুরস্কার পেয়েছে। তন্দ্রা সৌম্যকে তার জীবনের সবটুকু দুঃখের ইতিহাস বলেছে। যাতে সে মাকে বুঝতে শেখে। বেশ কিছুদিন একটা ঘটনা তন্দ্রাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। সেটা হলো সে তার কবিতার ডায়েরিটা হঠাৎ করেই খুঁজে পাচ্ছেনা। যেটা কেউ কোনোদিনও খুলেও দেখেনি সেটা এতো বছর পর কার কোন প্রয়োজনে লাগলো সেটাই সে বুঝতে পারছেনা।
             একদিন তন্দ্রার জন্মদিনে সৌম্য কলেজ থেকে ফেরার পথে একটা বার্থ ডে কেক নিয়ে বাড়ী ঢুকলো। তন্দ্রা দেখলো কেক ছাড়াও সৌম্যর হাতে আর একটা প্যাকেট। যাই হোক, কেক কাটা হলো, সৌম্য মায়ের হাতে সুন্দর প্যাকিং করা একটা প্যাকেট দিয়ে খুলতে বললো। তন্দ্রা সেটা খুলে তো অবাক। স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবেনি সে এটা। দু’চোখ দিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়লো। তার লেখা কবিতার বই বের করেছে সৌম্য…….”দিগন্তের কবিতারা”। সার্থক আজ তার ছেলে মানুষ করা। সার্থক তার লেখা কবিতারা। যে লেখাকে কেউ কোনোদিন খুলেও দেখেনি, পড়া তো দূরের কথা সেই কবিতারা আজ বইয়ের পাতায় উঠে এসেছে। এটা ভেবেই রোমাঞ্চে আনন্দে সে বইটা খুলে সারারাত তার গন্ধে বুঁদ হয়ে রইলো। আজ একটা নতুন সকাল এলো তার জীবনে।

  • গল্প

    গল্প- লটারি

    লটারি
    – পারমিতা ভট্টাচার্য

     

     

    সুনন্দা এই শহরে নতুন এসেছে। তার স্বামী বিনয় যেহেতু ব্যাংকে চাকরি করে তাই কিছু বছর অন্তর অন্তরই সে ট্রান্সফার হয়। নতুন নতুন শহরে সুনন্দাকেও ঘুরতে হয় তাই। বর্তমানে তারা এসে উঠেছে আরামবাগ শহরে। মফঃস্বল ঘেঁষা শহর। সবুজের ছোঁয়াও আছে এখানে। কবিতা প্রেমী সুনন্দার তাই খুব পছন্দ হয়েছে এই শহরটা। ওদের যখন বিয়ে হয় তখন বিনয় ছিল মালদাতে। তার পর মিষ্টি জন্মালো। মিষ্টি ওদের একমাত্র মেয়ে, বয়স চার বছর। ছোট্ট মিষ্টিকে নিয়ে ওরা মালদা থেকে এলো কৃষ্ণনগর। সেখান থেকে বর্তমান ঠিকানা ওদের আরামবাগ। দেখতে দেখতে ছ’বছর কেটে গেছে ওদের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু এত ব্যস্ত বিনয় নিজের চাকরি নিয়ে যে সে সুনন্দা আর মিষ্টিকে ঠিক মত সময়ই দিয়ে উঠতে পারে না। একে তো বদলির চাকরি। সমস্ত লটবহর নিয়ে এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুরতে সুনন্দার আর ভালো লাগে না। কিন্তু চাকরি তো আর ছেড়ে দেওয়া যায় না। অগত্যা তাকে নতুন শহর, নতুন মানুষ জন, নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতেই হয়।

    সকালের দিকটা একটু ব্যস্তই থাকে সুনন্দা, রান্নার কাজে। সকাল দশটার মধ্যে বিনয় অফিস বেরিয়ে যায়, সাথে ছোট্ট মিষ্টিকেও স্কুলে দিয়ে যায় সে। ওরা বেরিয়ে গেলে সুনন্দার অনন্ত সময় কাটে গল্পের বই পড়ে, গান শুনে আবার কখনও বা জানালার ধারে বসে নতুন জায়গার মানুষজন দেখে। কাজের মাসি এসে সকাল – বিকেল কাজ করে দিয়ে যায়। সুনন্দার কাজের মাসিটি গল্প করতে ভারী ভালোবাসে। বোবা থাকা সুনন্দারও স্বভাব নয়। কিছুটা সময় তাই তার গল্প করেও কেটে যায়। কাজের মাসি চলে গেলে আবার সুনন্দা একা হয়ে পড়ে। তখন সে রাস্তার দিকে জানালার ধারে বসে কবিতার ডায়রি হাতে শূন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে নতুন কিছু লেখার আশায়। এই জানালার ধারে বসেই সে রোজ একটা জিনিস লক্ষ্য করে। একটা মাঝ বয়সী লোক, পরনে ছেঁড়া, নোংরা জামা প্যান্ট, উস্কোখুস্কো চুল, গালে কত দিনের না কামানো দাড়ি নিরন্তর রাস্তায় কী যেন খুঁজে চলেছে। কখনও ডাঁই করে রাখা নোংরায় তো কখনও রাস্তার দু’ ধারে প্রতিনিয়ত একই ভাবে সে কী যেন খুঁজে চলে। বেশ অদ্ভুত লাগে তার লোকটিকে দেখে। লোকটিকে দেখে সুনন্দার পাগল বলেই মনে হয়। মুখে কী যেন বিড়বিড় করে বলে চলে। একদিন কৌতূহল সামলাতে না পেরে কাজের মাসিকে সে জিজ্ঞাসাই করে বসে সেই পাগলটার বিষয়। তখন কাজের মাসি অবাক দৃষ্টিতে সুনন্দার দিকে তাকিয়ে বলে – ‘তুমি ওকে দেখেছো বুঝি?’
    তখন সুনন্দা বলে – ‘রোজই তো দেখি। রাস্তার ধারে রোজই কী যেন খুঁজে চলেছে ও।’
    তখন কাজের মাসি মাটিতে বসে বলতে লাগে সেই পাগলের অতীত কাহিনী।

    পাগল লোকটির নাম, রতন। লোকটি আগাগোড়া পাগল ছিল না। গরীব মধ্যবিত্ত সংসার ছিল তার। রতন একটি কারখানায় কাজ করতো। মাসে মোটা মাইনে না পেলেও কষ্টে শিষ্টে এক ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে তার দিন চলে যেত। কষ্টের সংসারে তার একটা বদ অভ্যাসের জন্য অশান্তি লেগেই থাকতো। বদ অভ্যাসটি হলো লটারি খেলা। সে প্রায় প্রতিনিয়তই পঞ্চাশ – একশো টাকার লটারি খেলে টাকা উড়িয়ে দিতো। সে অভ্যাসবসত লটারির প্রতিটি নম্বর একটা খাতায় নোট করে রাখতো। কিন্তু কোনও দিনই লটারি থেকে কোনও টাকাই সে পুরস্কার স্বরূপ ফেরত পেত না। একে তো ওই ক’টা টাকা মাইনে, তাতে সংসারটাই ভালো করে চলে না…. তার উপর ছেলের পড়াশোনা, রোগ – অসুখ সবই ছিল। এর উপর প্রতিদিন লটারি খেলে টাকা উড়িয়ে দেওয়ার ফলে সংসারে অভাব বাড়তো বই কমতো না। এই নিয়েই ছেলে, বৌয়ের সাথে তার প্রতিদিনই প্রায় তুমুল ঝগড়া, অশান্তি লেগেই থাকতো। টাকার অভাবে সে ছেলেটিকেও সে ভাবে লেখাপড়া শেখাতে পারেনি। সংসারে বেহাল দশা দেখে অল্প বয়সে ছেলেটিও কারখানার কাজে ঢুকে যায় দু’টো পয়সা রোজগারের আশায়। তার সাথে ধরে মদ, গাঁজার নেশাও। এক কথায় সংসারের অবস্থা দিন দিন আরও অবনতির দিকে যেতে থাকে। কালী পুজোর সময় চারিদিকে এত খুশি, এত আলোর রোশনাই, কিন্তু রতনের বাড়িতে দু’ দিন যাবৎ হাঁড়ি চড়েনি। কারণ সেই একটাই, তার লটারি খেলা। কালী পুজোয় বাম্পার লটারির টিকিট কাটে রতন। একদিকে খাবার কোনও সংস্থান নেই, অন্য দিকে ধার দেনা করে লটারির টিকিট কাটায় বাড়িতে অশান্তি চরমে উঠে। সে দিন রতনের বৌ তুমুল ঝগড়া করতে থাকে রতনের সাথে। রাগ সামলাতে না পেরে রতন লটারির টিকিট নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এর পর রাগের মাথায় কুচোকুচি করে রাস্তায় ফেলে দেয় লটারির টিকিটটা। এমতাবস্থায় সন্ধ্যাতে বাজারে গিয়ে মুখ গোমড়া করে লটারির দোকানে ঢোকে রতন। তখন দোকানি লটারির কাগজ আনতে বলে রতনকে। রতন তখন বিজিত পুরস্কারের নম্বরটা লিখে নিয়ে বাড়ি আসে। বাড়ি এসে ডায়রিতে লেখা নম্বরটার সাথে বিজিত পুরস্কারের নম্বরটা মেলাতে গিয়ে দেখে হুবহু এক নম্বর। সে তো তখন হাঁ। বাম্পার লটারিতে প্রথম পুরস্কার পেয়েছে সে, পঞ্চাশ লাখ টাকার। কিন্তু লটারির টিকিট কই? সেতো টুকরো টুকরো করে রাস্তায় ফেলে দিয়ে এসেছে সে। অভাবের সংসারে সেই টাকাটা ছিল আলোর ঝলক। সাথে সাথে সে ছুটে যায় রাস্তায়, যেখানে সে লটারির টিকিট ফেলে এসেছিল। কোথায় বা সেই টিকিট আর কোথায় সেই পঞ্চাশ লাখ টাকা!! কত লাঞ্ছনা, গঞ্জনাই না সহ্য করেছে সে এই লটারির নেশার জন্য। আজ যখন টাকা ভাগ্যে এলো তখন সব শেষ। তীরে গিয়েও তরী ডুবে গেল। এই মনঃকষ্ট সে সহ্য করতে পারলো না শেষ অবধি। খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়েই দিলো, কাজেও যেত না আর। ফলে সংসারের দারিদ্রতা দিন দিন মারাত্মক রূপ নিলো। এর সাথে যোগ হলো ছেলে, বৌয়ের অশান্তি। তবে তার পর থেকে রতন লটারি খেলা চিরকালের মত ছেড়ে দিয়েছিল। এই রকম পরিস্থিতিতে সে ভয়ংকর ভাবে ডিপ্রেশনে চলে যায়। মাথার গন্ডগোল দেখা দেয় ভয়ংকর ভাবে। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কাগজ দেখলেই তা কুড়িয়ে লটারির নম্বর মেলাতে থাকে সে। লটারির নম্বর ছাড়া তার সমস্ত ভাষা মন থেকে মুছে গিয়েছিল। সব সময় মুখে বিড়বিড় করে যেত লটারির সেই নম্বরটা। প্রথম প্রথম রতনের বৌ রতনকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে এসে খাবার খাওয়াতো, ঘরে দরজা বন্ধ করে রেখে দিতো.. কিন্তু পরে পরে রাস্তা থেকে নিয়ে আসা, ঘরে আটকে রাখা কোনোটাই আর সম্ভবপর হতো না। কারণ, সে অত্যধিক মারধোর করতো, কামড়ে – খিমচে একাকার করতো। ধীরে ধীরে বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হয় রতন।

    সব শুনে সুনন্দা হাঁ হয়ে গেল। মনে মনে ভাবতে লাগলো এরকমও হয় মানুষের জীবন! কিন্তু সে ভেবেই বা কী আর করতে পারে? মানুষটার জন্য শুধু সহানুভূতি জ্ঞাপন ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।
    একদিন বিকেল থেকে আরম্ভ হলো প্রচন্ড বৃষ্টি। বিনয় প্রায় কাক ভেজা হয় অফিস থেকে ফিরলো। সে দিন সবাই তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লো। কিন্তু সুনন্দার ঘুম এলো না কিছুতেই। মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগলো নানা চিন্তা। বৃষ্টি চিরকালই খুব প্রিয় সুনন্দার। সে বৃষ্টি দেখতে খুব ভালোবাসে। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। সুনন্দা বিছানা থেকে উঠে পাশের ঘরের জানালার ধারে এসে দাঁড়ালো। রাস্তায় জনপ্রাণী কেউ নেই। রাস্তার ধারে ল্যাম্প পোস্টের আলোয় হঠাৎ সে দেখতে পেলো রতনকে। ওই প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যেও রাস্তার ধারে সে কাগজ কুড়োচ্ছে আর কী যেন মেলাচ্ছে। এক অজানা মন খারাপের মেঘ ছেয়ে গেল সুনন্দার মন জুড়ে।

    সমাপ্ত।

  • গল্প

    গল্প- এক চিলতে আকাশ

    এক চিলতে আকাশ

    -পারমিতা ভট্টাচার্য

     

    লাবনী ছিল মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। অনেক কষ্ট করে ওর বাবা বিজন বাবু ওকে লেখাপড়া শিখিয়ে ছিলেন।লাবনী মধবিত্ত ঘরের মেয়ে হলেও তার বাবা কখনও তাকে মাথা নিচু করে বাঁচতে শেখান নি। তাই লাবনী ছিল আত্ম-সচেতন মেয়ে। অনেক কষ্ট করে বিজন বাবু তার বিয়ে দিয়েছিলেন নামী অফিসে কর্মরত অর্ণবের সাথে। মা- ছেলের ছোট্ট সংসার। ফ্ল্যাটের চারিদিকে নান্দনিক শৌখিনতা, অর্ণবের আর্থিক সচ্ছলতার জানান দেয়। তবে লাবনী মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, আর্থিক প্রাচুর্যতায় ভরপুর সংসারে মানাতে তার একটু অসুবিধা হবে বইকি। তার বাবা জীবনেও কোনও দিন মদ ছুঁয়েও দেখেননি, সেখানে অর্ণবের লাগাম ছাড়া জীবন – মদ, পার্টি, সঙ্গিনী আর তার সাথে প্রতি রাতে টালমাটাল পায়ের একটা মানুষ। এর সাথে যুক্ত হয় প্রতি রাতে লাবনীর সাথে পশুর মত ব্যবহার। নিজের আত্মসম্মান বোধ জলাঞ্জলি দিয়ে লাবনী সব মেনে নিয়েছিল শুধু নিজের বাবা –মা’র কথা ভেবে। মাঝে মাঝে খুব মন চাইতো রুখে দাঁড়াবার জন্য। কিন্তু পরক্ষণেই বাবা- মা’র মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলেই সে নিজেকে শান্ত করে নিত।

    এভাবেই ভালোয়- মন্দে কেটে যাচ্ছিল লাবনীর জীবন। হঠাৎ একদিন খুশির খবর বয়ে আনল অর্ণব লাবনীর কাছে। অর্ণবদের অফিস থেকে ট্যুরে শিমলা যাবার প্ল্যান হচ্ছে। তাই এই ট্যুরে অর্ণব লাবনীকেও সাথে নিয়ে যেতে চায়। উদ্দেশ্য হানিমুনটাও সেরে নেবে ওরা। অবশেষে ওরা এসে উপস্থিত হল শিমলাতে। উফফ কী সুন্দর দৃশ্য চারিদিকে। লাবনীর শরীরে –মনে একটা অদ্ভুত ভাললাগা মিশে যাচ্ছে। তাই হোটেলের রুমে ঢুকেই সে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। পাহাড়ের অপরূপ রূপ দেখে সে নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে ধরা দিলো প্রকৃতির কাছে। সন্ধ্যাবেলা ওরা দু’জনে একটু ঘুরতে বেরল। সবাই আগেই চলে গিয়েছিল। ওরা একটু দেরি করেই বেরল একটু নিজেদের মত সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে। ঘুরতে ঘুরতে ওরা ম্যালে এসে হাজির হল। শিমলা কালীবাড়ি থেকে দূরের পাহাড়ের রাতের দৃশ্য দেখে লাবনী মুগ্ধ হয়ে গেল। এই তো তার স্বপ্নের স্বর্গ রাজ্য। রেলিং ধরে সে একদৃষ্টে দেখতে থাকে রাতের পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য। সে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল যে অর্ণব কখন তার পাশ থেকে চলে গেছে সে টেরও পায়নি। হঠাৎ তার মনে হল অর্ণব তো তার পাশে নেই। সে চারিদিক দেখতে লাগলো, কোথায় অর্ণব? এখানের কোনও রাস্তাঘাটই সে চেনে না। কোথায় খুঁজবে তাকে? এদিকে রাত বাড়ার সাথে সাথে ম্যালও ফাঁকা হচ্ছে। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে সে দেখতে পেল অর্ণব তার বন্ধুদের সাথে একটা বার থেকে বেরোচ্ছে। অর্ণবকে দেখেই সে রাগে ফেটে পড়লো। কিন্তু বন্ধুদের সাথে থাকায় লাবনী একটা কথাও সেই মুহূর্তে বললো না। অন্যদিকে অর্ণব এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন সে কিছু অন্যায়ই করেনি। ওদের অফিসের ম্যানেজার ওদের সাথে আসেননি। পরে এসে যোগ দিয়েছেন ওদের সাথে। বয়সে অর্ণবদের বয়সীই হবে। অর্ণব পরিচয় করিয়ে দিলো লাবনীর সাথে। নাম অখিলেশ বসাক। এতদূর ঠিকই ছিল। কিন্তু সেই ছেলেটি আচমকাই লাবনীর সাথে হাত মেলানোর উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিলো লাবনীর দিকে। লাবনীও সৌজন্যতাবশত হাত বাড়ালে ছেলেটি লাবনীর হাতে আলতো করে চাপ দিতে থাকলো আর আঙুলে করে হাতে বিলি কাটতে লাগলো। এক ঝটকায় লাবনী তার হাতটা ছাড়িয়ে নিতেই ছেলেটি লাবনীর কানের কাছে বলল – ‘যা তোমার ইচ্ছা।‘ এতো শীতেও তার কান মাথা গরম হয়ে উঠল ছেলেটির ব্যবহারে।

    সেদিন রাতে লাবনী একটু রাগারাগিও করলো অর্ণবের সাথে এই সব ব্যাপার নিয়ে। রেগে সেই যে অর্ণব রুমের বাইরে বেরল আর ফিরল না। বন্ধুদের সাথে মদের আড্ডায় মিশে গেল সে। লাবনী ভাবে এই তার হানিমুন? এটা আসলে বাড়ির বাইরে রাত্রি যাপন ছাড়া আর কিছুই নয়। হঠাৎ মাঝরাতে কলিং বেলের আওয়াজ শুনে সে তাড়াতাড়ি দরজা খোলে, ভাবে অর্ণব এসেছে বুঝি। দরজা খুলে দেখে, কোথায় অর্ণব? সামনে দাঁড়িয়ে আছে ম্যালের সেই ছেলেটি— যে লাবনীর হাতের স্পর্শে মোহিত হয়ে গিয়েছিল। কিছু না বলেই ছেলেটি মানে অর্ণবের অফিসের ম্যানেজার ঘরে আচমকাই ঢুকে দরজা ভিতর থেকে লক করে দেয়। চিৎকার করতে গিয়েও লাবনী চুপ করে যায় কারণ সে বোঝে তার চিৎকারে কেউ আসবে না তাকে সাহায্য করতে। এরপর ছেলেটি লাবনীর হাত ধরে টেনে নিজের বুকের কাছে আনতে চাইলে সে সজোরে একটা থাপ্পড় কষায় ছেলেটির গালে। অপ্রত্যাশিত থাপ্পড় খেয়ে ছেলেটি ঘুরে বিছানায় গিয়ে পড়ে। এরপর লাবনীর মাথায় আসে কলেজে পড়ার সময় থেকেই তার পার্সে সবসময় আত্মরক্ষার জন্য ব্ল্যাক পিপার স্প্রে থাকে। তড়িঘড়ি লাবনী পার্স থেকে সেটা বের করে পিছনে লুকিয়ে রাখে। এরপর ছেলেটি আবার উঠে তার দিকে এগিয়ে এলেই লাবনী তার চোখ লক্ষ্য করে সেটি স্প্রে করে দেয়। আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ছেলেটি। এই ঘটনার পর লাবনী ভালোই বুঝতে পারে তাকে শিমলা আনার উদ্দেশ্যটা অর্ণবের আসলে কী? শুধুমাত্র নিজের প্রোমোশনের জন্য নিজের স্ত্রীকে নিজের হাতে ভোগ করতে দেয় অফিসারের হাতে। এসব ভেবে গা গুলিয়ে ওঠে লাবনীর। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল।

    পরদিন তাদের ফেরার পালা। সকালে ঘরে এসেই অর্ণব এক চড় কষালো লাবনীর গালে, তার সুবর্ণ সুযোগ প্রোমোশন আটকে যাবার জন্য। লাবনী একটা কথাও বলল না প্রতি উত্তরে। কারণ,তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। বাড়ি ফিরে তার অনেক কাজ বাকি। লাবনী একেবারে স্থির হয়ে গেছে শুধু এই কথা ভেবে যে, মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েদের বড়লোক স্বামীরা এই ভাবে ব্যবহার করে উচ্চপদ হাসিল করে? আজ তার নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন জাগে। অর্ণবও কিছুটা স্তম্ভিত এতো পরিণত লাবনীকে দেখে। এই অচেনা লাবনীকে দেখে একটু হলেও অর্ণবের বুক কেঁপে ওঠে।

    লাবনী শিমলা থেকে ফিরে জরুরী কাজ আছে বলে ষ্টেশন থেকেই বাপের বাড়ি চলে যায়। লাবনীর বাবা-মা তো আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় অনেক দিন পর মেয়েকে কাছে পেয়ে। কিন্তু পরদিনই লাবনী যখন তার বাবার কাছে তাঁর অ্যাডভোকেট বন্ধু নন্দলাল পাঠকের ফোন নম্বর চেয়ে বসে তখনই তার বাবা-মায়ের কপালে চিন্তার গভীর রেখা ফুটে উঠে।

    সেদিনের ঘটনার পর অর্ণবের অফিসের ম্যানেজার মিঃ বসাকের চরিত্রের কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। কারণ এতদিন তিনি অবলা নারীকেই দেখে এসেছেন। কিন্তু লাবনীকে দেখার পর তিনি দেখলেন নারীর প্রতিবাদী রূপ। এই ঘটনার পর মিঃ বসাকের যতটা না নিজের উপর ঘৃণা বোধ জন্মাল তার থেকে বেশি ঘৃণা হল অর্ণবের উপর। কারণ যে ব্যক্তি নিজের প্রোমোশনের জন্য এতটা ঘৃণ্য কাজ করতে পারে, সে ব্যক্তি কখনই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারেনা। তাই মিঃ বসাক অর্ণবকে চাকরী থেকে বরখাস্ত করার কঠিন সিদ্ধান্ত নেন এবং অর্ণবের হাতে ধরিয়ে দেন বরখাস্তের চিঠি। অতো টাকা মাইনের চাকরী হারিয়ে যখন পাগলপারা অর্ণব ঠিক তখনই একদিন পোস্টম্যান অর্ণবের হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে যায়। সেটা খুলে অর্ণবের মাথায় বজ্রাঘাত পড়ে। লাবনী বিবাহ বিচ্ছেদের চিঠি পাঠিয়েছে। অতিরিক্ত লোভ তাকে পথের ভিখারি করে দিলো। অন্য দিকে লাবনী নিজের মতো করে বাঁচার এক চিলতে আকাশ পেয়ে তানপুরায় গান ধরে – ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু——‘ শুরু হয় তার জীবনের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।

    সমাপ্ত

You cannot copy content of this page