-
কবিতা- নিকুচি করেছে কবিতা – ২
নিকুচি করেছে কবিতা – ২
বিকাশ দাস
মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা সবাই দিনদিন
স্বার্থপর হয়ে উঠছি,
কিছুর বদলে কিছু দিতে হবে, না হলে সর্বনাশ বেশি।
শরীর চায় অবসাদ শ্রান্তি জুড়িয়ে নিতে মাথা
চট জলদি এক কাপ গরম গরম চা।
পুণ্যি চায় পরিশ্রমের ঘাম মুছতে নরম ন্যাতা।
কর্ম চায় দু’বেলা ভাত সব্জির অল্প বিস্তর গন্ধ
ঈশ্বর চায় মাথাধরার ওষুধ।
ক্লান্তি জড়ালে ফকির ভিখিরি ভিখ মাগা বন্ধ রাখে
প্রার্থনা মিনতির বদলে ওদের গলা থেকে নিঃসৃত হয়
বুকের পাঁজর ভেঙে দীনতার বাতাস।
হে ঈশ্বর কি চাইবো এ পৃথিবীর কাছ থেকে
যে দেয় ভুখাদের পেট ভরে খেতে
ধনীদের ধনদৌলৎ, হত্যাকারিদের অস্ত্র রুগীদের রোগ,
দুর্বলদের নির্বলতা আর অন্যায়ীদের হাতে সত্তার ভার।
তৈরি করো নিঃস্বার্থতা সহানুভূতি এখনও আমি লিখছি কবিতা
শব্দের চিরতা রাত ভিজিয়ে ভাবনার জলে নিকুচি করেছে কবিতা!***
-
কবিতা- নিকুচি করেছে কবিতা – এক
নিকুচি করেছে কবিতা – এক
-বিকাশ দাস
যে পেটের ছেলে
মায়ের দুঃখজ্বালা বোঝে না
গোবর ঘুঁটের গায়ে মায়ের হাতের ছাপ
লোকের কাছে বলতে লজ্জা করে
পরের উচ্ছিষ্ট বাসন মেজে মায়ের দু’হাত
দু’মুঠো ভাত সংসারের ক্ষুধা ভরে ;
সে ছেলে মুখ ফিরিয়ে
মায়ের সঠিক ব্যাখ্যা সবিস্তারে ফলাও করে কবিতা লেখে
শব্দ কুচির গর্ভে মায়ের কষ্টজ্বালার আঁচড়ের স্তবক ঢেকে ।বা! কবিতা ।
যে ছেলে বুড়ো বাপের ঘাড়ে বসে অন্ন ধ্বংস করে
বাপকে ঊনতা দেখায়
বংশের অভাব অনটনের অকিঞ্চনতার প্রদর্শন ধরে
রংবাহারি কবিতা লেখায় ।
সে ছেলে বাহুতে পৌরুষ দেখিয়ে
বাপের সম্বল আধকাঠা জমির উপর পৈতৃক ভিটেমাটি
উপড়ে ফলিতার্থ নির্মাণ চায়
প্রচুর আমদানি চোলাই মদের ভাটির ঘাঁটি ।সে ছেলে বাপমায়ের রক্তঅশ্রুজমাট শিলায়
ইস্তাহার দিয়ে উদ্ভিদ উচ্ছেদের কবিতা লেখে ।
শব্দের শিড়দাঁড়ায় উঁচিয়ে গলা অধিকার দাবি
আমি প্রসবসূত্রে প্রথম উত্তরাধিকারী
হাতকাটা বাপের শরীর থেকে শ্বাস নিবর্তন হলে
একবাক্যে বলতে পারে
বাপের মৃত্যু
বাপের মুখাগ্নি চুলোয় যাক ।
কবিতার বীজমন্ত্র ফলমন্ত আধকাঠা মাটি
বেঁচে থাক বাপমায়ের দান নিকুচি করেছে কবিতা ।***
-
কবিতা- তোমার সংসারে আমি
তোমার সংসারে আমি
-বিকাশ দাস
তোমার কাজের মাসি কিছু না বলে হঠাৎ উধাও হলে,
তুমি রাগে গন গন।
তোমার চলা ফেরায় শুকনো লঙ্কার ঝাঁঝ,
যদিও সাময়িক ঝনত্কার।
তবুও নিতে ভোলো না তুমি লতা মাসির খবর,
ওর মাতাল বর করলো না তো মারধর,
না কি বাড়লো দুম করে আবার ছেলেটার জ্বর …মাথার ভেতর হাজার প্রশ্নের জমাট ভিড় তোমার পিছু পিছু ঘুরতে থাকে অবান্তর।
মাসি ফিরে এলেই ঠিকঠাক জবাব কৈফিয়েত না পেলে রাগে বলে ফেল:
এবার কাজে ফাঁকি দিলে তোর মাইনে কাটবো দেখে নিস বলেই …
তোমার ঠোঁটে এক চিলতে শুভ্র হাসির ঝিল।
মাসিও জানে তোমার দরাজ দিল।
তোমার শরীর খারাপ, তা সত্তেও হয়না ভুল তোমার।
একগাদা কাপড় চোপড় কাচতে, এঁটো বাসন কোসন ধুয়ে রাখতে,
সন্ধে সকাল বাড়ি উঠোন পরিষ্কার করে এলো চুল বাঁধতে,
আবার দু’ হাতে সলতে পাকাতে, ফুলের আলপনায় পূজোর আসন সাজাতে,
ধূপকাঠি জ্বালিয়ে সময়ে সন্ধেবাতি রাখতে।
ছড়াতে ঘরের ভেতর বাহির সন্ধ্যা সাঁজাল।
সময় করে আবার ফ্রিজে জল রাখতে, বেডকভার টান টান,
সোফার কুশন ঠিক রাখতে, আনচান ।
সব কিছু পরিপাটি না হলে, তোমায় খুঁত খুঁতানি চেপে ধরে তোমার সর্বাঙ্গ অস্থিরতায়।
তোমার শরীর সাতসতেরো ঝামেলা ঝিমানো কাঁটায়,
তোমার চাউনিরা কাড়ে না কোনো ঝাপটায় ।
যেদিন তোমার নিরামীষ আমাদের জন্য একটা না একটা আমিষপদ ভোলো না রাঁধতে ।তোমার উপোস দিনে সবার খাবারের ভুল করো না আয়োজন রাখতে।
সময় করে আত্মীয় পরিজনের নিয়ম মাফিক খোঁজ খবর প্রযত্নে রাখা।
ছোটো বড়ো সকলের সুখ দুখ এ সামিল থাকা।
কক্ষনো ভুল কর না সম্পর্কগুলো অবাধে জোর রাখতে অজুহাতের জটিলতায়।
কোন তিথি পূর্নিমা, অমাবস্যা, পুজো পার্বণ, পাঁজির বিবরণ তোমার নখদর্পণে।
সঙ্গে সব ষষ্টীর খেয়াল রাখা।
কোনো কিছুর ভুল ত্রুটির খামতি থাকে না।
সব খুঁটিনাটির দিকে তোমার কড়া নজর।
রোজকার বাজার তুমি একাই সারো নিজের হাতে,
আমার হাত খুব পাতলা, হিসেব হীন বলে।
রোজ এতো ভিড়ের মুখে আমার এলানো শরীর
তোমার দু’হাতের স্পর্শে আড়ালে আমার ঘুম জাগানো।
উষ্ণ গরম চা আমার অলস হাতে বাড়ানো। আমার স্নান সারা হলেই ,
ইস্ত্রির পাট করা জামা কাপড় আমার হাতের নাগালে রাখা,
অফিস যাওয়ার প্রস্তুতি সাজিয়ে তোলা,
আমার রুমাল, চশমা, মোবাইল, বটুয়া একে একে এগিয়ে রাখা।
তোমার আলতো হাতে নধর চোখে মুখশুদ্ধি পরিবেশন।
নিজের হাতে আতরের ইষৎ ফোঁটায় আমার শরীর ভিজিয়ে,
সদর দরজা অবধি তোমার আসা।
দু’ হাত নাড়িয়ে প্রতিশ্রুতির প্রতিবেদন নিঃশব্দে জানানো
তোমার আধুত ঠোঁটের বিড়বিড়ানি… দুগগা দুগগা দুগগা।
কিন্তু ঘরে প্রবেশ বাইরে জুতো খুলেই, জুতোর প্রবেশ বারণ ঘরের ভেতর।
কখন ঠেকায় আমার হাত টানের সংসার ছিলো বিক্ষত,
লেগেছিলো পরিস্তিতির বর্গায় জোরুল আর চুনখসার আপদ।
এ সবের অভিযোগ বা সিকায়াত রাখোনি কোনদিনই তোমার কাছ ছাড়া।
বলোনি গলা বাড়িয়ে।
খুচখাচ সঞ্চয়ের কৌটো থেকে ঠিক সময় ধারের কিস্তি
শোধ দিয়েছো অভাবের কাঠে আগুন নিভিয়ে।
রোজকার রূপচর্চা, পরচর্চা বালাই তোমার অভিধানে বাতিল ও অরুচি।
বলো খামোকা উড়ান আদ্দিখেতামী ।
প্রতিদিনের অসংযত কাজের ফাঁকে, টবের মাটি কাটা,
ফুল গাছে জল । স্নান সারা । পুজো আর্চা। তুলসীর মূলে জল ঘোরানো,
মাথা ঠেকানো । সংসারের মঙ্গল চাওয়া টুকু একমাত্র তোমার কাম্য ।
মধ্য দুপরের স্তব্ধতা আঁচড় কাটে তোমার শরীরে
সারাদিনের ব্যস্ত জ্বালার আঘাত সারাতে ।
রবিবার তোমাকে বেশি করে দেখার ইচ্ছে চোখে রাখি ধরে
সকালে কাছে পাওয়া বেশি করে, স্নানের পর ভিজে কাপড়ে
চুলের জল ঝাপটানো, জলের ছিটে আমার গায়ে লাগানো। এ সুখ পাড়া পড়শীর ঈর্ষা ।
ঠোঁট ভিজিয়ে গুন গুন গান গাওয়া, হাত যখন কাজ গুছনোতে ব্যস্ত তোমার ।
চুপ চাপ কান পেতে শোনা। আচমকা গা জড়ানো ।
তোমার লজ্জার ঠেলায় গা ভাসানো ।
ফিরতে আমার রোজ দেরী হয় ।
জেনো ও সন্ধে নামলে কাছের দূরত্ব কে আরো কাছে টানার অভিসারের চঞ্চলতায়;
দু চোখ তোমার সজাগ রাখো এ জানালা ও জানালার পর্দায় ।
অথচ ভুল হয় না তোমার
গরম ভাত বা গরম ফুলকো রুটি বেড়ে দিতে ।
অন্তিমে গরম দুধ খাওযার পীড়াপিড়ি তোমার ।
গোঁসা হলেও আমার বুক জুড়াতো তোমার ভালোবাসার নিবীড় একান্তে ।
এক ভাবে বসে তোমার দু চোখ আমার খবর নিতো ।
দুপুরে কি খেলাম, কাজের চাপ কমলো কি না, হাঁটুর ব্যথা কম আছে কি না,
ওর খোঁজ পেলে কি না, আরো অনেক কিছুর খোঁজ গোঁজা থাকতো তোমার আঙুলে ।
প্রশ্নের কাঁটা ক্ষনিকের জ্বালা হলে ও এ জ্বালা ভালোবাসার চিরকালীন ।
শোবার আগে আমার বাকি ওষুধ এগিয়ে দিতে সঙ্গে জলের গ্লাস ।
আবছা আলোর সন্দিক্ষনের শিহরন অগোচরে ।
তোমার দু চোখের নীরব সরব সাক্ষাত্কারে, আমার সারা শরীরে বর্ষা নামতো ।
সারাদিনের ঝক্কি ক্লান্তির জ্বর কুল পেতো, এসে তোমার আচঁলে ।আকাশের বিছানায় চাঁদ তখন ঘুমিয়ে পড়ে আলোর মশারিতে;
পাশা পাশি শুই পরস্পর কে ছুঁয়ে, আমার উতপ্ত শরীর শীতাপিত ।
এত কিছুর পরও….
আমার সোয়াস্তির দরজায় তোমার দুচোখ জাগিয়ে রাখো
যাতে এক চুল ব্যাঘাত না ঘটে আমার নিশিন্ত ঘুমের ।
ধন্য তুমি ধন্য
হঠাৎ দেখি কাক ভোরের আলোতে তোমার না খাওয়া
জরুরী ওষুধ পড়ে আছে অবহেলায় তোমার বালিশের তলায় ।
তখন ও তোমার হাত আমার হাতে। এ সংকোচ আমায় ভাবিয়ে তোলে ।
দুচোখ কষ্টের জলে উপচে পড়ে, নিজেকে ধিক্কারের আগুনে পুড়িয়ে দিতে ।
আমি কেন পারি না তোমার হাতে হাতে আমার হাত বাড়িয়ে দিতে ।
তোমার কষ্টের ভাগ নিতে ।
তুমিও তো পারো বলতে মুখ ফুটে ।
বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না তোমার ।
এ কি তোমার অবোধ ভালোবাসা ।
না তোমার অভিমান ? না আমার খামতি সবার নজর থেকে আড়াল রাখা ।
আজও
তোমার আদর শ্রমে সুখ সম্বৃদ্ধির ধান ফোটে আমার ঘর গেরস্থালীর সংসারে । -
অণু কবিতা- কবির শেষপাতা
কবির শেষপাতা
-বিকাশ দাস
কবিতা কি পাথর
কল্পনাতীত
দু’হাতের শ্রম ভেঙে ভেঙে মানুষের আদলে
মূর্তি বানানো
শব্দের আঁচড় অনুসন্ধিৎসু
সৌন্দর্যয়ের লাবণী রক্তঘাম।কোন এক খোলা প্রত্যহে
বাজারের চৌমাথায় একলা ছেড়ে আসা
জমজমাট মানুষের যাওয়া আসার ভিড়ে মুক্তির বোধ।ক্রমশ কবির নির্মাণ
নিঃশ্বাস নিস্তরঙ্গ
অযত্নে ভেঙে ভেঙে মৃত্যুর খটকা
আর এক পাথর রুদ্ধশ্বাস সমাধি কবিতার শেষ পাতা। -
কবিতা- এখন আমি একা
এখন আমি একা
-বিকাশ দাস
তোমাকে দেখেছি সাত সকালে
যখন পুবের আকাশ ঘাম ছিলো তরল আলোয় ।
ছ্যাতলা ধরা পুকুর পারে
বাঁধানো সিড়িতে বসে চিকন চুলের গোছা খানি
উল্টে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলে নিজস্ব কায়দায় ।
অনন্ত পিপাসায় পুকুরের শ্যাওলার মতো
আমিও দেখেছি তোমাকে বারবার
অকারণে দেখার একটা আলাদা স্বাদ যেমন ।
রুপোর তোড়ায় বাঁধা তোমার পায়ের পাতা
ডুবিয়ে ছিলো সবুজ জলে,
অলজ্জ জল তোমায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে সুখ পেয়েছিলো
অধিকার আঁকড়ে রাখার মতো
আর বাকি মানুষের মতো সেদিন আমারও ঈর্ষা হয়েছিলো ।রোজ তোমায় দেখে চোখ জুড়িয়েছি
চোখ জুড়ানোর আড়ালে আমার বুক পুড়েছিলো
অনেক দিন পর হদিশ পেয়েছিলাম ।
তোমার দু’পায়ের নিচে রাঙা পথের
আলতা ধুলো লেগে লেগে আকাশ হয়েছিলো
অবান্তর চঞ্চল তোমার নুপুরের ছন্দে
উলসে দিয়েছিলো আমার শরীর ।
ছোটো ছোটো রোদ বৃষ্টি খুব সাবধানে
বাঁধা শাড়ির আঁচল খুলে
জোড়া পদ্মের নির্জন সরোবরের খোলা ঘাটে
দেখেছিলাম আমার বাসাবাড়ি ।
সময়ের মতো আমিও চলেছিলাম দ্রুত ঢালা অন্ধকারের বুক নিংড়ে
তোমার চিবুকে উগরে থাকা বাতাস গন্ধ মাধুরী
ঠিকরে পড়েছিলো আমার শরীরের পোশাকে,
মধুলগ্ন সন্ধার চৌকাঠে থমকে এসে দাঁড়িয়েছিলো ।
তোমার মৌন ইশারায় চাঁদ ধুয়েছিলো,
তার দু’চোখ তোমার গা ভেজানো পুকুর জলে
হারিয়েছিলো নিজেকে সেই অতলান্তে ।
রূপ লোভাতুর পলকহীন আমার দু’চোখ
ডুবেছিলো পা নাচানো জল তরঙ্গে ।
এখন দেখতে পাচ্ছি
সূর্য সপ্তরাঙা বর্ণচ্ছটা নিঃশেষ করে ঘুমিয়ে পড়েছে
পৃথিবীর সবুজ পালঙ্কে ।
আর, আমি এখন একা । -
মৃত্যু
মৃত্যু
-বিকাশ দাস
মৃত্যু মারা যায় না
কারোর ডাকে রাকাড়ে না ।
মৃত্যু আতঙ্ক ভয় জ্বর শূন্য
মৃত্যু অহঙ্কারবোধ একলা
মৃত্যূ অঙ্ক অদৃষ্টের ধারধারে না ।কারোর দু’পায়ে বা দু’হাত ধরে বলে না
আমার জীবন ফিরিয়ে দাও ।
মৃত্যু যুদ্ধ শেষ কুল অবশেষে বলে না
আমার জীবন জিরিয়ে দাও ।মৃত্যু মনিব শরীরের শরিক মৃত্যু ভবিষ্যত
ভাগ্যের ধারধারে না ।
মৃত্যু রোগ মৃত্যু ভোগ জেগে থাকার শর্ত
ধাপ্পার ধার ধারে না ।মৃত্যু বিদায় মৃত্যুর চোখে নিশ্চুপ কান্নার
অল্প ঘুম ।
মৃত্যু প্রেম মৃত্যু বিষ অসুস্থতার আরোগ্য
সুস্থ ঘুম ।
মৃত্যু আঘাত মৃত্যু বিশ্রাম হাড়ের নিশ্চিন্ত
মগ্ন ঘুম ।
মৃত্যু ইচ্ছে বেঁচে থাকা শরীরের ফাঁকজুড়ে
অনন্ত ঘুম ।
মৃত্যু ছাই মৃত্যু যায় মৃত্যু আসি
মৃত্যুর ঠোঁটে মৃত্যুর একলা বাঁশি ।***
-
কবিতা- জরায়ুজ
জরায়ুজ
-বিকাশ দাস
থাক বয়স দূরে অনেক দূরে গিয়ে
থাক বয়স পাহাড় পাথর চাপা দিয়ে ।
থাক বয়স বন অরণ্যের কালান্তরে
থাক বয়স সাগর জলধির ওপারে ।
বয়সকে
দিও না ঘেঁষতে কোনো কৌশলে
কুশল চিঠি সই পাতার হিল্লোলে
পরিচর্যার অজুহাতে শরীরের ভেতরের ঘরে ।
বয়স ধরলে
শরীরের কল্লোলে ক্রমশঃ ভাঙ্গন ধরে
শরীরের বিনুনির গিঁট আলগা করে
শিরদাঁড়ায় কালচে পড়ে ।
পাপপুন্য জল শূন্য জীর্ণ মাটি সামান্য ফসলের গন্ধে
আকাশ মেঘ্ময় ।
নিঃসঙ্গ বাতাসের সন্ততি থাক নিত্য পোশাকের ছন্দে
শরীর অস্তিময় ।
শরীরের ভেতর আর এক শরীর বয়সের মূর্ধায় থির ।যদিও শরীর …..
আলো অন্ধকারের গমক গমক আঁচের গভীরে
ষোলো আনা লোভ আরো বেঁচে থাকার বৃষ্টি সরস সরোবরে
অন্তর্বাস তত্ত্বের বর্ণের ঝনৎকারে ।
দু’হাত কোলাহল হাতড়ে আরো বেপরোয়া আরো যত্নশীল
সব বয়সের দিন দিগন্ত আঁকড়ে ।
শরীর…… ভিখিরির জাত ক্ষুধিত স্বভাব
জরায়ুজ ।
শরীর…… পুরুষ নারীর স্নাত সংশোধিত পল্লব
জরায়ুজ ।
শরীর…… সংকল্পিত বাস্তব ভাস্কর্য
জরায়ুজ ।***
-
কবিতা- কবির নির্লজ্জ কবিতা
কবির নির্লজ্জ কবিতা
-বিকাশ দাস
কবিরা শব্দ টুকে টুকে কবিতা লেখেন।
যেমন… ভিজে মাটি।
কাশ ফুল। স্থির নদী। সিঁদুর চুবানো দেবতার থান।
ভিজে পাহাড়। যৌনতার রূপটান। সমুদ্র বলবান।
গাছপালার কুঁড়ির বয়স বাড়ে, ভালোথাকার সুবাদে ছাঁটা গর্দান।
সাদা কাগজের মতো বিধবার শুভ্র থান কাপড় নিকানো উঠান।কবির কলমের আঁচড় ছবির মতো কথা বলেন।
যেমন …
রঙ্গপ্রবণ অন্ধকারে কার পাশে শুয়ে শরীর মেলে
আজও নির্দ্বিধায় দু’হাত ভরে খিদের চাল মেলে।কবির দু’চোখ নিঃশব্দতা ছুঁয়ে লিখে রাখেন।
যেমন…
শরীরে ঈশ্বর থাকে বলে উনুনের আঁচ কথা বলে।
ধর্ষণের নির্যাতন একলা নিবিড় বর্ষণ বৃষ্টির জলে
উবু হয়ে
বসে থাকা
নারীর স্তনের‘ওমে’লিখে ক’খান কবিতা
নির্বাক ধানের বুক দুধের স্বাদে মানবিকতা।
কলমের টানের স্পর্শে বর্ণহীন মানসিকতা।
ধর্ম নিঃসাড় নির্বিকার
ধর্মান্ধ রক্ত দুধের সুবাসে কন্যা জায়া জননীর সংসার।কবিতার শব্দের ফেনায়
পুরুষের হাতের আঙুলের মধ্যমা তর্জনী
স্থিতির খাপে খাপে বাহাদুরি।
ফুসলে ফাসলে তুলে নাজুক কিশোরীর
অস্থিমাংসে আনন্দ সুড়সুড়ি ।
শিস-ওঠা আলোর অন্তরায় বিঁধে থাকা।
এক গোটা রাত।
এক থালা ভাত।
কবিতার সংকলনে কবির বেঁচে থাকা ।
পৃথিবীর
দিনরাত্রির অস্থি পোড়ে
ক্ষীণশবে স্বাস্থ্য পোড়ে
আকাশের নীচে মানুষের কাতার। জেহাদ ঘর পাতার।জননীর আঁচল স্নেহ মমতা আহ্লাদীর।
সুনীল আকাশ সন্ততির বুকের নিবিড়।
ঠা-ঠা রোদ্দুর। ঘর-গেরস্তি। একঝাঁক বিহঙ্গ। স্বস্তির নিঃশ্বাস।কবি নিঃশব্দে চলে যান ঠোঁটে শব্দ বাজিয়ে।
যেমন…
কবে পুড়ে গেছে আকাশ
পুড়ে গেছে নির্মল বাতাস
রঙচটা বাস্তব অমোঘ অভিশাপ
শৃঙ্খলা ভেঙে ভেঙে ধাপে ধাপ
বেড়ে উঠছে ভুবন ডাঙায় পোক্ত ঘরবাড়ি।
নগ্নতম শরীর স্নান সারা নারীর জলুস
সর্বোত্তম কাম খুবলে বিলাসী পুরুষ
কবির চৌকাঠে কবির নির্লজ্জ কবিতা।***
-
কবিতা- কবিমঙ্গল
কবিমঙ্গল
-বিকাশ দাস
কবিতা
কিছুটা সত্যি কিছুটা মিথ্যে শব্দ ধ্বনির জ্বালা
কবির কলমে ।
গোপন দুঃখকষ্ট গাঁথা কবির বুকের শঙ্খমালা
শব্দের মলমে।
কবি বুঝতে পারেন
নারীকে স্পর্শ না করে নারীকে নিয়ে কবিতা লেখা
কতখানি বিদ্যুৎচমক কঠিন ।
কোনদিন নিজেকে মানুষ হয়ে না পারার দেখা
কতটা চশমার কাচ দৃষ্টিহীন ।
কাগজের উপর শব্দের ভিড় চাপিয়ে দিলে
কবিতার মঙ্গল মিছিল নয় ।
কবিতার বুকে পিঠে শব্দের আঁচড় দিলে
বাদ প্রতিবাদের দলিল নয় ।শব্দের মৃত্যু
শহিদ হলে কবিতার উদযাপন ।
বধ হলে শ্রদ্ধাঞ্জলির বিজ্ঞাপন ।
যে যার মতো চলে যায় এর ওর গন্ধ শুঁকে
এক সংসার থেকে অন্য এক সংসারের সুখে
কবিতা পাপোশের মতো নির্বাক চেয়ে মুখে
শব্দের সুবাসে সম্পর্ক বেঁধে বেঁধে ঘর প্রান্তর ।কবি
শব্দ মঞ্জুরীর আকাশ নামিয়ে মাটিতে ফুলের আঁচে
শব্দের বিস্তার গলিয়ে
নিভৃতে কবিতার উত্তরীয় বিছিয়ে
প্রখর সুখী শব্দের তৃণে শিশির ভিজিয়ে ।
কবি
মঙ্গল চেয়ে শব্দের মঙ্গলগ্রহ ধরে রাখেন পরাণে
নদ নদীর বাঁক ভেঙে ভেঙে শব্দ সাগর উজানে ।
কবির দুঃখ
কখন মানুষ মরলে স্বর্গ পায়
কখন মানুষ মরলে নরকে যায়
কেউ কি জানতে পারে কে কোথায় যায় ?
ঠোঁটের কাঁপুনিতে স্বার্থ, দিব্যি তৃষ্ণা রোমাঞ্চ মেখে
রেখে যায় স্মৃতি কবিতায় কবিতায় ।যে হাতে চিতার আগুন জ্বেলে আসে
সে হাতে কলসির জল ঢেলে আসে
শব্দ খোঁজে পাগল করা অন্ত্যমিল
আঙুল ছন্দের গন্ধে জমাট হিম
শব্দ ভেঙে আর এক শব্দের সমাস সন্ধি বুঝে নিতে মরিয়া ।কবির কলমে কলমে
কবিতার চোখে মুখে শরীরে শব্দের বাতাস হয়ে ফিরলে
কবিতার কাঠে আগুন লাগে ধোঁয়ার স্পর্শে বোধন জাগে
কবি
নিজের জন্মান্তর বয়সের উপর ভর দিয়ে হেঁটে যায়
দু’হাতে একগুচ্ছ মেঘ শব্দের আবেগ হাওয়ায়
বজ্রমণি বৃষ্টির পায়ে পায়ে ঘুঙুর
লক্ষ্মী ধানের বুকে ভিজে মাটির সুর
কবিতার জমিনে আকাশি আলোর কোহিনুর
সরস্বতী শব্দের মোহন বীণায় উপোষী আঙুলে অস্থির ধ্বনি
কবিমঙ্গল কলমগাথা ।
*** -
গল্প- তুমি রবে নীরবে
তুমি রবে নীরবে
-বিকাশ দাস
বিকেল বেলা কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছি। রাস্তায় আসতেই ঠিক সেই মুহুর্তে পিছন থেকে মেয়ের গলায় কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। আমি ভাবছি এমনি করে কে ডাকছে আমায়? আমার আশেপাশে কাউকে তো দেখতে পাচ্ছিনা। মেয়েটার কণ্ঠস্বর ক্রমশঃ আমার দিকে ভেসে আসছে। ভাবছি কে আবার আমায় ডাকছে? না না অন্য কাউকে ডাকছে হবে হয়তো। আমার তো কোন মেয়ে বন্ধু নেই। আমি নিজের মতো করে হেঁটে চলেছি। হঠাৎ দেখি আমার সামনে এক মেয়ে দাঁড়িয়ে। বেশ সুন্দর দেখতে। গায়ের রঙ টকটকে ফর্সা। পড়নে তুঁতে রঙের শাড়ি। ম্যাচিং ব্লাউস। কপালে ছোট্ট লাল বিন্দি। সুশ্রী আর মিষ্টি। দেখে তো মনে হচ্ছে ভদ্র ঘরের মেয়ে।
মেয়েটি দুম করে আমার সামনে এসে বলল, কি মশাই? শুনতে পাচ্ছেন না? আপনার নাম ধরে এতো করে ডাকছি আর আপনি কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে হন হন করে চলে যাচ্ছেন? আপনার নাম তো আভাস?
– হ্যাঁ, আভাস।
– মশাই, আভাস নন্দি।
– হ্যাঁ,আপনি কি আমাকে চেনেন?
– আলবৎ চিনি।
– আমি কিন্তু আপনাকে চিনতে পারছিনা।
– আপনি আমায় কি করে চিনবেন, মশাই?
আমি তো একবারে আকাশ থেকে পড়লাম। মেয়েটি মুখ ভেঙচি দিয়ে বলল।
– আপনি ছাড়া আপনার চারপাশে কে আছে বলুন তো?
-আচ্ছা ঠিক আছে। বলুন কি প্রয়োজন। কেন ডাকছিলেন?
-আপনি তো এই কলেজে পড়ান?
-হ্যাঁ, পড়াই, কেন বলুনতো?
– এতো কেন কেন করেন কেন বলুন তো? আপনাকে বাড়িতে অভি বলে ডাকে, তাইতো!
-হ্যাঁ, তাই। আমার ডাক নাম। আপনি এতো কিছু জানলেন কি করে?
– আপনার বাবা এখানে থাকেন না। আপনি আপনার মায়ের সঙ্গে গড়িয়ায় থাকেন। আপনার মোবাইল নম্বরও জানি। বলবো?
– আচ্ছা ওসব ছাড়ুন কি দরকার বলুন। আমার একটু তাড়া আছে। মাকে ডাক্তার দেখানোর আছে। যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন।
– মাসিমার আবার কি হলো?
– আপনি আমার মাকে চেনেন?
– হ্যাঁ, চিনি। আচ্ছা তাহলে কাল কথা হবে। আজ মাসিমাকে ডাক্তার দেখিয়ে নিন। কাল না হয় কথা হবে।
যাক মায়ের কথা বলে মুক্তি পেলাম। আমি দ্রুত বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেলাম। ঘুরে লক্ষ্য করলাম মেয়েটি ঠিক আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি একটু মনে মনে ভয়ও পেলাম। আজকাল যা দিন পড়েছে কোনো মেয়ে কেমন বলা যায় না। কি ভাবে কাকে কখন ফাঁসিয়ে দিতে পারে। ওনাকে তো আগে কোনদিন কলেজে দেখিনি। আমাদের পাড়াতেও দেখিনি। হয়তো এ শহরে নতুন এসেছে। একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না যে উনি এতো কিছু আমার ব্যাপারে কি করে জানেন! আমার পরিবারকেও চেনে। মেয়েটির নামও জিজ্ঞাসা করলাম না। যাক এসব ভেবে লাভ নেই। বাসে বসে আজেবাজে চিন্তায় মাথা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। ভাবলাম এ ঘটনার কথা মাকে জানাবো। আবার ঠিক করলাম, না থাক মাকে পরেই জানাবো।আজ রাত্রে ঠিক এগারোটার সময় আমার মোবাইল বেজে উঠলো। এই সময় আমি খেয়ে দেয়ে কালকের লেকচার ঠিকঠাক করি। একটু আধটু গান শুনি। রাত্রি বারোটায় শুয়ে পড়ি। আননোন নম্বর দেখে কেটে দিচ্ছিলাম। বারবার ফোন বেজে যাচ্ছিলো। এতে রাতে আবার কার ফোন? ফোন তুলে বললাম।
– কে বলছেন?
ওপার থেকে মেয়ের কণ্ঠস্বর ।
– বা! এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন? আচ্ছা মশাই আপনি। আমার গলা চিনতে পারছেন না? আমি সেই মেয়ে। আজ বিকেলে আপনার সাথে দেখা হলো। কথাবার্তা হলো।
– না, ঠিক বুঝতে পারছিনা।
– আচ্ছা আপনি বেশ তো মশাই! এতক্ষণ আপনার সাথে কথা বললাম এর মধ্যেই ভুলে গেলেন। আপনার মা, মানে মাসিমা অসুস্থ! কি এবার মনে পড়লো মশাই। আচ্ছা ঠিক আছে। আমার নাম অনামিকা। তখন আপনাকে আমার নাম বলা হয়নি। আগে বলুন মাসিমা কেমন আছেন?
– ভালো আছেন। কাজের কথা বলুন এতো রাত্রে কেন ফোন করেছেন? শুনুন, এ ধরনের আচরণ আমার পছন্দ নয়। আপনার কিছু দরকার থাকলে চটপট বলে ফেলুন। না হলে আমি ফোন রেখে দিচ্ছি।
– না না ফোন রাখবেন না। এরপর দেখলাম মেয়েটি কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো, আমি আপনার গান শুনতে চাই। একটা গান শোনান না?
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম। শুনুন, আমি গান গাইতে পারিনা ।
– মিথ্যে কথা বলছেন? আমি জানি আপনি ভালো গান করেন।
– আপনি কি করে জানলেন?
– মশাই আপনি গান জানেন এতো সবাই জানে। বিশেষ করে রবীন্দ্র- নজরুল সংগীত। আমি আপনার গলায় গজলও শুনেছি। সত্যি দারুণ।
– দেখুন এ ভাবে আমাকে বিরক্ত করবেন না। আপনি একজন মেয়ে হয়ে এতো রাতে এক অপরিচিত পুরুষকে ফোন করে বলছেন গান শোনাতে। আপনার একটু লজ্জা শরম বলে কি কিছু নেই।যেই বলা মেয়েটি কান্না জুড়ে দিলো।
– আচ্ছা আপনি কাঁদছেন কেন? আমাকে কি ভয় দেখাচ্ছেন? কি ভেবেছেন আমি গলে পড়বো?
– আপনি যদি গান না শোনান, তাহলে আমি কিন্তু এক্ষুুুুণি আপনার বাড়ি চলে আসবো। আপনাকে জড়িয়ে ধরবো। বাড়ির সবাইকে জানিয়ে দেবো । আপনি আমায় ভালবাসেন।
– আপনি এসব যাচ্ছেতাই কি বলছেন?
– সত্যি বলছি। আমি সব করতে পারি।
মনে মনে ভাবলাম। না একটা গান শুনিয়ে দি। যদি ছাড়া পাই। এ তো দেখছি নাছোড়বান্দা মেয়ে। গান না গাইলে মুশকিল। ইচ্ছে করছিলো ফোনটা কেটে দিই। কিন্তু পারলাম না। ওনার জেদের কাছে হেরে গেলাম। এই বলে গান শুনিয়ে দিলাম । এবার ঠিক আছে? আমি ঘুমোতে যাচ্ছি। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে। অনেক পড়াশোনা আছে।
– আর একটা গান প্লিজ। ওই গানটা ‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম নিবিড় নিভৃতে পূর্ণিমানিশীথিনী সম’ জানেন এটা আমার খুব প্রিয় গান।
আমি এই গানটা শুনিয়ে দেবার পর বুঝলাম উনি খুব খুশী। গুড নাইট বলে ফোন ছেড়ে দিলেন। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।এমনি করে প্রত্যেক রাত্রে মেয়েটি আমাকে ফোন করতো গান শোনার জন্য। আমি গান শোনাতে বাধ্য হতাম। কথায় কথায় উনি ফোন করে বলতেন, জানেন আপনার গান না শুনলে আমার ঘুম আসে না। আমি রোজ একই কথা বলতাম কিন্তু ওনার উপর কোনো প্রভাব পড়তো না।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, আচ্ছা আপনার বাড়িতে কেউ নেই। এতো রাত্রে ফোন করেন কেউ কিছু প্রশ্ন করে না?
মেয়েটির সোজাসাপ্টা জবাব,-আজ্ঞে মশাই, আমি হোস্টেলে থাকি। সঙ্গে আমার এক বান্ধবী।
এবার সত্যি করে উনাকে ধমক দিয়ে বললাম,-দেখুন এগুলো ঠিক হচ্ছে না। আপনি কি করেন, কেনই বা আমাকে ফোন করেন আপনি কি চান আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না।
– দেখুন আভাস বাবু। যতদিন এ শহরে আছি আপনাকে রোজ আমাকে গান শোনাতে হবে। আপনার গান না শুনলে আমার ঘুম আসেনা। আপনাকে কতবার করে বলেছি। এতে আপনার কোথায় অসুবিধে। আবার বলছি আপনি যদি গান না শোনান তাহলে যেদিন কলেজে আসবেন, আমি সকলের সামনে আপনাকে জড়িয়ে চিৎকার করে বলবো, আই লাভ ইউ। একেবারে হিন্দি সিনেমার মতো। তখন আমাকে দোষ দেবেন না। আমি রোজ রাত্রে শুধু এক দু’খানা গান শুনতে চেয়েছি। আর তো কিছু চাইনি।এতে আপনার মহাভারত অশুদ্ধ হবেনা। একটা মেয়ের জন্য এইটুকু করতে পারবেন না?
আমিও মনে মনে ভাবলাম যাক এই অজুহাতে আমার গান করা হয়ে যাবে। একটু আধটু রেওয়াজ হয়ে যাবে। সারাদিন কলেজ করে সময় পাইনা। কোনোদিন যদি টাকা হয় নিজের গানের এ্যালবাম বার করবো।এই ভাবে প্রত্যক রাতে ওনাকে গান শোনানোর পর্ব চলতে থাকলো। অনেক গানের অনুরোধ থাকতো যেমন ‘সে দিন দু’জনে দুলেছিনু বনে’ / ‘চরণ ধরিতে দিওগো আমারে’ / ‘ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে’ / ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’…
রোজ রাতে ঠিক সময়ে ওনার ফোন আসতো। ঘরের কেউ জানতে না পারে বলে আগেভাগেই আমি আমার শোবার ঘরে চলে আসতাম। এই ভাবে প্রায় এক মাসের উপর চললো। আমিও ইতিমধ্যে তিক্ত বিরক্ত হতাম। রোজ ভাবি ওনাকে বলে দেবো কিন্তু সাহস কুলিয়ে উঠতে পারতাম না। অনেকবার বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু নানান ভাবে আমার এই করে দেবে ওই করবে বলে আমায় জব্দ করতো। এই ভাবে ওনাকে রোজ গান শোনাতে হতো খুব রাগ হতো আমার। মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতাম যে কবে এ ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি পাবো। ছুটকারা পেলে বাঁচি।
আজ সকাল থেকে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। কিন্তু আমার কলেজ যাওয়া খুব দরকার। স্নান খাওয়া সেরে অপেক্ষা করে আছি। বৃষ্টি একটু কমলে বেড়িয়ে পড়বো। টিপ টিপ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। ছাতা হাতে নেওয়ার আমার কোনদিনই অভ্যাস ছিলো না। আজও নিই নি । ছাতা না নেওয়ার জন্য মার কাছ থেকে অনেক বকুনি খাই।
এখন আকাশ অনেকটা পরিষ্কার। কলেজের গেটের সামনে আসতে দেখলাম সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে। খুব দামি সালোয়ার কামিজ পড়ে। দেখতে অপূর্ব লাগছে। কাঁধে শান্তিনিকেতনি পাটের ঝোলানো ব্যাগ। ব্যাগের সামনের দিকে রবিঠাকুরের দাড়িওয়ালা ছবি। চারপাশে নজর কাড়া আল্পনার নক্সা। আমি ওনাকে দেখেই নিজেকে আড়াল করে কলেজের ভেতরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। উনি ঠিক আমাকে ধরে ফেললেন। নিজেকে কিছুতেই ওনাকে এড়িয়ে যেতে পারলাম না।
মেয়েটির গলা ভেসে এলো।
– কি মশাই! আমাকে দেখে পালিয়ে যাচ্ছেন। আচ্ছা বলুন তো, আপনার আমি কি ক্ষতি করেছি? আপনি আমাকে দেখে দিব্যি এড়িয়ে যাচ্ছেন যে? নিশ্চিন্ত থাকুন আপনাকে প্রাণে মারবো না। একটু না হয় রোজ রাতে গান শুনতে চেয়েছি, এইতো। আরে বাবা আর তো ক’টা মাস তারপর এই শহর ছেড়ে চলে যাবো। আপনাকে আর বিরক্ত করবো না।
খুব আগ্রহে মেয়েটি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন।– আসুন আসুন, বৃষ্টি জোরে পড়ছে। ও আপনি তো আবার ছাতা আনেন নি। শুনেছি আপনার ছাতা নিয়ে চলার অভ্যাস টভ্যাস নেই।
– আপনি এসব আবার কোথা থেকে জানলেন?
– ঠিক আছে। আসুন আমার ছাতার তলায়। আপনি তো ভিজে যাচ্ছেন। কলেজের স্টাফরুমে যেতে যেতে একদম ভিজে জল হয়ে যাবেন। আসুন আপনাকে পৌঁছে দিই। আপনার তো আবার ঠাণ্ডা লাগার ধাঁচ আছে।
আমিও ভাবলাম। না উনি ঠিক বলছেন । আর কিছু না ভেবে অগত্যা ওনার ছাতার তলায় আমার মাথা গুঁজে দিলাম। উনি আমাকে স্টাফরুমের গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন। এটা সেটা নিয়ে উনি এতো বকবক করতে থাকলেন আর আমি হু হ্যাঁ করে কাটিয়ে দিলাম। শেষে ওনাকে ভদ্রতার খাতিরে থ্যাংকস বলে সোজা স্টাফরুমে চলে গেলাম।জানিনা মেয়েটি আমার কাছ থেকে কি চায়। আমার বাড়ির সবাইকে চেনেন জানেন। ভাবলাম পরের বার দেখা হলে পুরো ব্যাপারটা জানবো। মেয়েটি ওনার নাম বলেছিলো অনামিকা। বাড়ির সবাই আদর করে অনু বলে ডাকে।
মেয়েটি বিনম্রতার সঙ্গে আমাকে জানালো,
– জানেন, আপনি এতদিনে যতো গান শুনিয়েছেন আমি আমার মোবাইলে রেকর্ড করে রেখেছি। আমি আপনার গান মন দিয়ে শুনি। শুনে শুনে গাইবার খুব চেষ্টাও করি কিন্তু হয়ে ওঠেনা। আমি গান গেয়ে রেকর্ড করে আপনাকে একটা স্যাম্পল পাঠাবো। শুনে বলবেন তো আমার দ্বারা গান গাওয়া হবে কি, না? আমি অবশ্য একটু আধটু কবিতা লিখি। বলতে পারেন এটা আমার শখ।
এমনি করে অজান্তে ওনার সাথে আমার বন্ধুত্ব বেড়ে উঠলো । একএক সময় ভাবতাম এতো মেলামেশা ঠিক নয়। হিতে বিপরীত না হয়ে যায়। ওনাকে বলেই দেবো, দেখুন প্রেম ট্রেমের মধ্যে আমি নেই। একদিন মেয়েটিকে বলেই দিলাম। মেয়েটি একটু গম্ভীর ভাবে উত্তর দিলো,-বলে আবার প্রেম হয় নাকি? প্রেম তো হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে বেড়িয়ে আসে। কেউ কি বলতে পারে প্রেম কখন, কবে কি ভাবে দু’জনের মনের মধ্যে দোলা দিতে পারে? আচ্ছা ওসব কথা বাদ দিন। সত্যি বলছি, আপনার গলার মধ্যে মাদকতা আছে। গাইবার এক বিশেষ সৌজন্যতা আছে যেটা সকলের ভালো লাগবে।
শুনুন, কাল বিকেলে মধু কাকার চায়ের দোকানে বসবো। আপনাকে আমার কিছু জরুরি কথা বলার আছে। আপনি তো মাঝে মাঝে অনুরোধ পেলে গানের ফাংশন করেন। এই পৃথিবীতে আমরা ঢের দিন বেঁচে থাকি মৃত্যুর ধ্বনি শুনে শুনে তার মধ্যে আনন্দ খুঁজে নিতে হয়। কি ঠিক বললাম তো?
আমি কোন উত্তর দিলাম না।
– যাক এসব আপনার মাথায় ঢুকবে না।
আমি বললাম, এর আগে আমার গান কোথায় আপনি শুনেছেন?
– শুনেছি মশাই, শুনেছি। সব বলবো একদিন। ডু নট ওয়ারি।
আমি জেনে শুনেই বললাম। আমি ছোটবেলা থেকে গান শিখে এসেছি। ইচ্ছে ছিল বড় গায়ক হবো। কিন্তু বুঝতে পারতাম আমার অভাবের সংসার। গান গেয়ে কি আর সংসার চালানো যায়। বি এড করেছি। ইংলিশ নিয়ে এম এ করেছি। কলেজে পার্ট টাইম ইংলিশ পড়াই। যতোটুকু টাকা পাই তাতে কোনমতে মা ছেলের সংসার চলে যায়। যদি একটা পাকাপাকি ভালো চাকরি পাই। তখন গানের ব্যাপারে কিছু ভাবনা চিন্তা করবো।দেখলাম মধু কাকার চায়ের দোকানে আগে থেকেই অনামিকা বসে আছেন। আমাকে আসতে দেখে উনি আমার দিকে এগিয়ে এলেন।
আসুন আসুন।
আমি বললাম, বলুন কি বলবেন? আমার তাড়া আছে।
– আচ্ছা মশাই। বেশি সময় নেবোনা। অনেক দিন আপনার সাথে দেখা হয়নি তাই আপনাকে দেখতে ইচ্ছে হলো বলে এখানে আপনাকে ডেকে নিলাম। এক এক বার ভাবি আপনার বাড়ি গিয়ে আপনার সাথে আড্ডা মেরে আসি। আপনার মায়ের সাথে গল্প করে আসি। আপনার কোন আপত্তি নেই তো? থাকলে বলে দিন।
আমি একটু উঁচু গলায় বললাম। আচ্ছা বলুন তো, এতো মানুষ থাকতে আপনি আমার পেছনে পড়লেন কেন? আপনাকে দেখলে মনে হয় আপনি বেশ বড় ঘরের মেয়ে। অর্থবান পরিবার। অথচ এরকম ব্যবহার করছেন কেন আমার সাথে?
– হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। আমার বাবার প্রচুর টাকা। সে তো বলতে পারবো না, কেন আপনাকে বিরক্ত করি। হ্যাঁ, শুনুন। যে কারণে আপনাকে এখানে ডেকেছি। এই নিন ভিজিটিং কার্ড। ইনি কে চিনতে পারলেন?
আমি হাতে কার্ড নিয়ে চোখ বুলিয়ে দেখলাম কার্ডের উপর নাম লেখা আছে, সুনির্মল বর্মন। ইনার খুব নাম ডাক আছে। ইনি একজন নাম করা মিউজিক ডিরেক্টর।
– আজ্ঞে । ঠিক বলেছেন আভাস বাবু।
মেয়েটি উল্লাস ভরা হাসি নিয়ে আমার প্রতি অধিকার ফলাও করে বলে উঠলেন। কাল বর্মনদাকে ফোন করে ওনার সাথে দেখা করে আসবেন। ওনাকে আপনার ব্যাপারে সব ডিটেলসে বলা আছে। বর্মনদা আমার খুব পরিচিত । উনি আপনার গান শুনেছেন এবং খুব তারিফ করেছেন। আপনাকে দিয়ে কিছু গান গাওয়াবেন।
আমি ইতস্ততঃ হয়ে বললাম, কি বলছেন এতো বড় লোক। আপনি আমার সাথে ইয়ার্কি করছেন না তো?
– আচ্ছা বলুন তো এতে আমার কি স্বার্থ থাকতে পারে? কাল দেখা করে বর্মনদা কি বললেন আমাকে জানাবেন। হ্যাঁ, আর ভুলবেন না আমি রোজ রাতে আপনাকে ফোন করবো আর গান শোনাতে হবে।এই ভাবে মাস দু’য়েক রোজ রাত্রে ওনার পছন্দ মতো গান শোনাতে হতো। নিজেকে খুব খারাপ লাগতো কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম।
মাঝে মাঝে উনি আমাকে মধু কাকার চায়ের দোকানে আসতে বলতেন। অনেক সাবজেক্ট নিয়ে কথাবার্তা হতো। কিন্তু ওনার মাথার থেকে আমার গান শোনার ভুত কিছুতেই ছাড়াতে পারছিলাম না। রোজ ঘড়ির কাঁটা ধরে ওনার ফোন আসতো আর আমাকে গান শোনাতে হতো।ওনার কথামত বর্মন বাবুর সাথে দেখা করলাম। আমার গান শুনলেন। গলার প্রশংসা করলেন। ইনি নিশ্চয় ওনার পরিচিত। না হলে আমাকে এতো কেন পাত্তা দেবেন। আমাকে কিছু গান দিয়ে বললেন, -প্র্যাকটিস করো। আগামী সোমবার আমার সাথে সকাল দশটায় দেখা করো। সেদিন রেকর্ডিং করবো আর অনামিকাকে বলে দিও। তুমি পাশ করেছো। একদিন তুমি খুব বড় গায়ক হবে যদি চেষ্টা চালিয়ে যাও।
তারপর কিছুদিন দিন কেটে গেলো। দেখলাম ওনার আর রাতে ফোন আসেনা। কলেজেও দেখা হয় না। মনে মনে বেশ নিশ্চিন্ত হলাম। এবার মেয়েটির জ্বালাতন থেকে রেহাই পেলাম। যেন খাঁচা ভেঙে খোলা আকাশ পেলাম। ওনার ফোন না আসাতে আমার ভালোই লাগছিলো। নিজেকে খুব রিলিফ মনে হচ্ছিলো।
সপ্তাহ খানেক যাওয়ার পর মনটা যেন কেমন কেমন করে উঠলো। অনেক প্রশ্ন জাগতে শুরু করলো মনে। উনি আর কেন ফোন করেন না? ওনার আবার কিছু হলো নাতো? সারাদিন মনটা খচখচ করতো। কোন কাজে ঠিক ভাবে মন বসাতে পারতাম না। ভেতর ভেতর ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। আজ হঠাৎ কেন এমন মনে হলো। আমি তো ওনার কাছ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলাম। তবে জীবনটা আমার অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে কেন? মনে হচ্ছিলো আমি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলছি ।
দিনের পর দিন ওনার ফোন না আসাতে আমার মন প্রচণ্ড চঞ্চল হয়ে উঠতো। রাতে ঠিক মতো ঘুমোতে পারতাম না। জানিনা কেন আমার কষ্ট হতো। কাউকে শেয়ারও করতে পারতাম না। মনে হতো আমার শরীর আছে কিন্তু প্রাণ নেই। তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। ভীষণ ভাবে ওনার অভাব ফিল করতাম। ওনাকে কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না। রোজ রাতে ওনার ফোনের জন্য হাঁ পিত্যেশ করে জেগে থাকতাম। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব ছোটো মনে হতো। প্রতিদিন আহত হতাম ওনার কথা ভেবে। তবু মনে আশা রাখতাম একদিন না একদিন উনি ফোন করবেন। ওনার পছন্দ মতো গান শোনার জন্য আমার কাছে জেদ করবেন। আমাকে ভয় দেখাবেন। একবার মনে হতো ওনার কাছে যাই। ওনার খবর নিই। কিন্তু উনি কোথায় থাকেন তাও জানতাম না। এমন মূর্খ আমি। আমি চোখ বন্ধ করলে শুধু ওনার সঙ্গে কাটানো সময়গুলোর স্নিগ্ধ রাতগুলোর কথা মনে পড়তো। যদিও তখন সেই রাতগুলোতে ওনাকে গান শোনানো আমার কাছে খুব বিরক্তবোধ ছিলো। কখন যে ওনার সাথে আমার এক গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো আমি টের পাইনি। এখন বুঝতে পারছি সেগুলো ওনার আন্তরিক আচরণের বিবহলতা আমাকে এখন বেশ গ্রাস করছে। আমি কি শেষ পর্যন্ত এক অন্ধ বিবরের বাসিন্দা হয়ে থেকে যাবো? আমার যৌবনের উল্লাসের মদমত্ত আগল খুলে দাঁড়িয়ে আছি। আর ভাবতাম। উনি আসুক। আমাকে জড়িয়ে ধরুক। চিৎকার করে বলুক আমি আভাসকে ভালোবাসি। ওনার নিস্তব্ধ প্রণয়ের আঘাতে আমি বারবার রক্তাক্ত হওয়ার ইচ্ছে রাখতাম। যেন অবসন্ন হই। আলোর উৎসবে রাতের অন্ধকারে ওনার সঙ্গী হই।
মনকে জিজ্ঞেস করতাম কেন উনি এতোদিন আমার জীবনে এসে আমার গান শোনার জন্য উন্মাদ থাকতেন। আমার গান শুনতে না পেলে উনি রাতে ঘুমতে পারতেন না। আমার হৃদয় কি এতোই পাষাণ ছিলো যে সেই অনুভুতিটুকু বুঝতে পারিনি। উনি কি আমাকে ভালোবেসে ছিলেন? এই ভালবাসাবাসির অবুঝ খেলা আমি কেন বুঝতে পারিনি?এই ভাবে মাস ছয়েক কেটে গেলো। ইতিমধ্যে দু’একটা বর্মন স্যারের গান গেয়ে আমার একটু নাম ডাক হলো। কলকাতা ও আশেপাশের গ্রাম শহর থেকে লাইভ শো পেতে থাকলাম। সিনেমারও এক দু’টো গান গাইলাম। আমার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। গানের চাপে কলেজের পার্টটাইম চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। গান গেয়ে ঘরে লক্ষ্মী আসতে শুরু করলো।
তবু আমার সেই অভ্যেসটা কিছুতেই গেলোনা রোজ রাতে মোবাইল চেক করাা ওনার কোন মিস কল আছে কি না। ওনার কোন মেসেজ আছে কিনা। একদিন হঠাৎ হোয়াট’স আপ দেখলাম উনি ওনার ছবি পাঠিয়েছেন। রাজকন্যার মতো লাগছিলো। সৌন্দর্য ফেটে পড়ছিলো। কপালে সূর্যডোবা টিপ। দু’চোখে উপলব্ধির কাজল। গলায় সোনার সরু চেন। ঠোঁটে সনির্বন্ধ হাসি। খোঁপায় ফুলের মালা। ছবির নীচে মেসেজ। ভালো থেকো। গান ভালোবেসে গেও। নিয়মিত রেওয়াজ করো। তোমার নাম যশ হবে। আমি তক্ষুনি ওনাকে ফোন করলাম কিন্তু ফোন সুইচড অফ। মনে খটকা লাগলো কেনই বা উনি ছবি পাঠালেন? কেনই বা ওনার ফোন সুইচড অফ। মনটা আরো আনচান করতে লাগলো। আমি ওনার সংস্পর্শের অন্তরঙ্গতা পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলাম।– অভি আজ তোর সময় হবে।
-কেন মা?
-তোর বাগুইহাটি বকুল মাসির কথা মনে পড়ে? তখন তুই খুব ছোটো ছিলিস।
-হ্যাঁ, একটু একটু মনে পড়ছে। তখন আমরা ওখানে থাকতাম। আজ সকালে ফোন করে বকুল জানালো। ওর মেয়ে নাকি খুব সিরিয়াস। শেষ শয্যায়। ওকে তুই দেখলে হয়তো চিনতে পারবি।
-কি হয়েছে মা তুমি কি কিছু জানো? শুনেছি ব্লাড ক্যানসার। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে। হয়তো আর কটা দিন পৃথিবীর আলো দেখতে পাবে।
মায়ের কথাটা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। যাওয়ার ইচ্ছে না থাকা সত্তেও মা’কে নিয়ে যেতে হলো।
আমরা বকুল মাসির বাড়ি গেলাম। মেয়েটিকে দেখে আমি আঁতকে উঠলাম। ইনি তো সেই মেয়েটি। অনামিকাা- খাটে শুয়ে। চোখে মুখে উজ্জ্বলতার ঝলক নেই। যাকে এতোদিন খুঁজছিলাম। আমার চোখে পৃথিবী যেন বনবন করে ঘুরছে। ওনার কোন সাড়া শব্দ নেই। শীর্ণকায়া শরীর নিস্প্রভ।
অনামিকা আমাকে দেখতে পেয়ে আমার দিকে দু’চোখ এক দৃষ্টিতে চেয়ে। ঠোঁটে স্মিত হাসি। ওনার দু’চোখ থেকে অনর্গল অশ্রু ঝরে পড়ছিলো। আমার বুক ফেটে যাচ্ছিলো। আমি ডুকরে ডুকরে কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে পারছিলাম না। আমার ইচ্ছে করছিলো ওনার সমস্ত সত্তাকে আঁকড়ে জড়িয়ে বলি। অনামিকা, আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমরা দু’জন এক দু’জনের চোখের দিকে তাকিয়ে সবার অলক্ষ্যে অনেকক্ষণ ধরে অনেক কথা বলছিলাম আর মনে মনে বুঝে নিচ্ছি্লাম পরস্পরকে এক দু’জনার চাউনির আকর্ষী মেখে।মা আর বকুল মাসি এক দু’জনকে জড়িয়ে কাঁদছিলো। ডাক্তার অনামিকার এক পাশে দাঁড়িয়ে।
মৃত্যুর মাধ্যমে বোধহয় জীবনের সব চাওয়া পাওয়ার অবসান হয়ে যায়। এ রোগের থেকে হয়তো আর মুক্তি পাবে না । মৃত্যুর আত্মহনের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। একদিন বাগানে সব ফুল ফুটবে মাধবীলতা জুঁই বেলি গোলাপ, গন্ধে ভরে দেবে আমার উঠোন বাড়ি। রাতের অন্ধকারে আলোর বৈধব্য রজনীগন্ধা জানাবে আমি আর বেঁচে নেই।
হাওয়ায় ভেসে আসছে অনামিকার কথার সংলাপের নিস্তব্ধতা আমার কানে।
– জানো? তোমার গান শুনে তোমার কথা স্পর্শ করে সহজে হয়ে গেছি তোমার মনের বাসিন্দা। পৃথিবীর সব সুখদুঃখ, ভালোবাসা, বিষাদ,বেদনা উল্লাস আজ কোন কিছুর আবেগের স্পর্শে রাখতে পারবেনা। আকারে ইঙ্গিতে আমাকে বুঝিয়ে যাচ্ছিলো যে দূরে সরে থাকা বিরহ মাঝে মধ্যে মিলনের চেয়েও মধুর হয়ে ওঠে।অনামিকা আমাকে দাঁড় করিয়ে উনি চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে থেকে গেলেন। অন্তরের কথা অন্তরে চেপে।
বছর দু’য়েক পর মাকে নিয়ে আমি মুম্বাই চলে আসি কলকাতার পাট চুকিয়ে। বারো বছর ধরে মুম্বাইতে আছি। কিছুদিন হলো মাও চলে গেলেন আমাকে ছেড়ে। অনামিকার ছবি বড় করে বাঁধিয়ে রেখেছি আমার শোবার ঘরে। রোজ রজনীগন্ধা ফুলের মালায় সাজিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করি। আমার শোকাস্তব্ধ হৃদয়ের আকুল আর্তি ওনার বকবকানি খুঁজে বেড়ায়। অস্থির অনুরণন। অনুচ্চার অব্যক্ত ব্যথা। বুকের ভেতর নিঃসঙ্গতার পাথর চাপিয়ে সঙ্গোপনে আজও রোজ রাতে অনামিকার ফোনের অপেক্ষায় থাকি হৃদয়ের নিভৃতে। জানি, উনি আর ফোন করবেন না। তবু অপেক্ষায় থাকি ।