• কবিতা

    কবিতা- কঠিন সময়

    কঠিন সময়
    -মানিক দাক্ষিত

     

     

    ভরসার অভাব, চিড়ধরা বিশ্বাস,
    প্রতি শ্বাস নাগপাশ, আটকানো ফাঁস।
    পরমানন্দ বিষাদিত, খুশী নিশ্চুপ,
    মোহিনীভুবন আজ যেন অন্ধকূপ।
    স্বপ্নময় গতিরুদ্ধ জীবনের পথে,
    সোনালী আলোরা আজ আঁধারের সাথে।
    জীবনের দাম নাই, লহমায় থামে,
    অদৃষ্টের পরিহাস লেখা নীল খামে।

    চারিদিকে যমদূত পরোয়ানা হাতে,
    ঘরে-বাইরে তাণ্ডব চলে দিনে-রাতে।
    দেশ আজ ধ্বংসস্তুপ, জ্বলছে আগুনে,
    নিরোর মত্ততা দেখি সেতার বাদনে।

    হাতে হাত, দেরী নয়, কঠিন সময়,
    মোকাবিলা কড়া হাতে, ভয় হোক জয়।

  • কবিতা

    কবিতা- ঠিক দাঁড়াবো ফের ঘুরে

    ঠিক দাঁড়াবো ফের ঘুরে
    -মানিক দাক্ষিত

    ভয় ঢুকেছে চোখে- মুখে, ভয় ঢুকেছে অন্তরে,
    বলতে পারো ঘুচবে কবে, কোন যাদুবল মন্তরে।

    খুশীরা আজ নাইকো মনে, কোন অচেনা প্রান্তরে,
    হারিয়ে গেছে শোক তাপেতে, বিষণ্ণতার অম্বরে।

    চেনা মানুষ অচেনা আজ, দূরে সরাই চীত্‍কারে,
    স্নেহের বাঁধন টুটছে সদা, এক লহমায় ফুত্‍কারে।

    মরণ আসে যখন তখন, নিত্যনতুন হুংকারে,
    স্বপ্ন-আশা তাসের ঘরে, মর্মে মরি ধিক্কারে।

    নাইকো হিসাব মরছে মানুষ, জমছে দেহ লাশঘরে,
    হারিয়ে স্বজন বিয়োগ ব্যথায়, কান্না শুধু দেশজুড়ে

    কঠিন সময়, চলবে লড়াই, নয় থাকা আর চুপ করে,
    বিষের অসুর মেরে সবাই, ঠিক দাঁড়াবো ফের ঘুরে।

  • কবিতা

    কবিতা- তোমাকে চাই

    তোমাকে চাই
    – মানিক দাক্ষিত

     

     

    তোমাকে পেয়ে আমি খুব খুশী
    তোমায় আমি ভীষণ ভালবাসি।

    দশটি মাস বসে আছি ঠায়–
    তোমার অপেক্ষায়।
    সুস্থতার শান্তি নেবো
    তোমার হিমেল ছোঁয়ায়।

    তোমাকে সারা দেহে জড়িয়ে
    লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে
    রঙীন আকাশে উড়ি,
    তোমার বরফ-শীতল যৌবন
    ঘরছাড়া করে যখন তখন
    ডানা মেলে সাগরে নয়তো পাহাড়ে চড়ি।

    তুমি এসেছো আমি খুব খুশী
    তোমায় আমি ভীষণ ভালবাসি।

    তোমার আদরে জ্বর-সর্দি-কাশি
    কিংবা একটু হাঁচি,
    তাছাড়া রোগ নাই
    দিব্যি ভাল আছি।

    উদর বাবাজীর এখন পোয়াবারো
    আহ্লাদে আটখানা,
    যা পায়, তাই খায়
    কোন কিছুতেই মানে না মানা।

    তোমার দৌলতে খেঁজুড়ের রস
    নলেন গুড়ের সন্দেশ,
    পিঠে পুলি, রকমারি সব্জি
    পরমানন্দে চালিয়ে যাচ্ছি বেশ।

    শুধু আমি নই
    আমরা সবাই তোমাকে চাই,
    শীতের চাদরে ঢাকা নবযৌবনা শীত
    তোমাকে অভিবাদন জানাই।

  • কবিতা

    কবিতা- বারো মাসে তেরো পার্বণ

    বারো মাসে তেরো পার্বণ
    – মানিক দাক্ষিত

     

     

    বারো মাসের তেরো পার্বণ বাংলা মধুর বোলে,
    আছে শুধু এই ধরাতে বাংলা মায়ের কোলে।
    দু:খ জয়ের শক্তি পেতে সারাটা বছর ধরে,
    পালিত হয় পূজা উত্‍সব নানান উপাচারে।

    বোশেখ মাসে নববর্ষ গণেশ পূজো দিয়ে,
    জ্যৈষ্ঠ মাসে জামাই ষষ্ঠী মেয়ে জামাই নিয়ে।
    আষাঢ়েতে রথযাত্রা রথের দড়ি টানা,
    এ-মাসেতে দশহারা আছে সবার জানা।
    শ্রাবণ মাস বর্ষণমুখর বৃষ্টি অবিরত,
    এইসময়ে মনসা পূজো, জন্মাষ্টমী ব্রত।
    ভাদ্র মাসে ভাদোর লক্ষ্মী প্রতি ঘরে ঘরে,
    সত্যনারায়ণ পূজিত হন পরম ভক্তিভরে।
    কাশের দোলে শিউলি ফুলে বাদ্যি যখন বাজে,
    আশ্বিন মাসে মা দুর্গা আসেন নতুন সাজে।
    কার্তিকে কার্তিক পূজো, ভায়ের কপালে ফোঁটা,
    কালীপূজো আলোর মেলা আনন্দেতে মাতা।
    অঘ্রাণে সোনার ফসল মাঠে মাঠে ধান,
    নতুন ধানে ঘরে ঘরে হয় যে নবান।
    পৌষমাসে পোষলক্ষ্মী পিঠে পুলি পায়েস,
    শীতের আমেজ, নলেনগুড় একটুখানি আয়েশ।
    মাঘমাসে শ্রীপঞ্চমী, মহাশ্বেতার পূজা,
    ফাগুনেতে দোলযাত্রা হোলির রঙে সাজা।
    চৈত্রমাসে শিবের গাজন মহা ধূমধামে,
    বারোমাসটা এমনি কাটে পূজো-পার্বণে।

    বাংলা বাঙালীর স্বর্গপুরী, খুশীর বৃন্দাবন,
    এইখানেতেই হারিয়ে গেছে সব বাঙালীর মন।

  • গল্প

    গল্প- বিজয়া

    বিজয়া
    -মানিক দাক্ষিত

     

     

    দশমীর পূজো সেরে বামুনঠাকুর ঘট নাড়াতেই ঠাকুর-তলায় মায়ের বিসর্জনের বাজনা বেজে ওঠে। বাঙালীর ঘরে ঘরে বিষাদের ছায়া নামলেও আজ বসু পরিবারে নেমেছে কান্নার রোল। হারিয়ে যাওয়ার এক মহা-আশঙ্কা। পরিবারের সকলের চোখে মুখে এক আতঙ্কের ছায়া। সবার মুখে একটাই প্রশ্ন- সকল চেষ্টা কি শেষ পর্যন্ত বিফলে যাবে! কান পাতলে শোনা যাচ্ছে পরিবারের প্রতিটি ঘরের কোণায় কোণায় একটা চাপা ফোঁপানি কান্না।

    দাদু, ঠাকুমা, বাবা, মা আর একমাত্র মেয়ে বিজয়াকে নিয়ে এই বসু পরিবার। পরিবারটি একসময় ছিল অত্যন্ত সুখী পরিবার। কিন্তু যেদিন জানলো মেয়ের কঠিন অসুখ-মেয়ে আক্রান্ত এক মারণ রোগে, সেদিন থেকে চলে গেল তাদের হাসি খুশী আর আনন্দ। মনের মধ্যে বাসা বাঁধলো চরম উত্‍কন্ঠা আর হারিয়ে যাবার তীব্র ভয়। গত পাঁচটি বছর চলছে মেয়েকে আপ্রাণ বাঁচিয়ে রাখার, সুস্থ করে তোলার এক কঠিন সংগ্রাম।

    একুশ বছরের সুন্দরী যুবতী বিজয়া। কি অপরূপ রূপই না ছিল তার! একেবারে পটে আঁকা লক্ষ্মী।
    এখন ক্রমশ: তার শরীর জৌলুস হারাচ্ছে, চুলের গোড়া আলগা হচ্ছে, নামছে মন্থরগতিতে যৌবনে
    খরা।

    বিজয়া লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত। ক্রনিক মায়েলয়েড লিউকেমিয়া। সোজা কথায় ব্লাড ক্যানসার। চিকিৎসকদের অভিমত- শ্বেত রক্তকণিকাগুলি যেভাবে বিকৃত এবং অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে রোগীর পরমায়ু বড়জোর পাঁচটি বছর। আজই হচ্ছে পাঁচ বছরের সেই অন্তিম দিন।

    কেশববাবু মেয়ের চিকিত্‍সার কোনো ত্রুটি রাখেননি। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কেমোথেরাপী, সাথে
    সাথে রেডিয়েশন থেরাপিও চলছে নিয়মিত। ভবিষ্যতের জন্য জমানো টাকা সম্পূর্ণ নি:শেষ। শেষ‌ পর্যন্ত বসত বাড়ীটি ব্যাঙ্কের কাছে বন্ধক রেখে হাউস ফিজিশিয়ান ডক্টর সান্যালের পরামর্শে গত মাসে বিজয়ার হয়েছে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জারি। আজই আসবে শেষ দফার শারিরীক সব রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাথে যাবতীয় রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট।

    এতক্ষণ বাড়ীর কর্তা সমরেশবাবু স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূর সাথে নিজের ঘরে নাতনী বিজয়ার বিষয়ে কথা বলছিলেন। কি যেন মনে হওয়ায় তিনি হঠাত্‍ শান্ত মৃদু স্বরে বলে ওঠেন, “চলো, সকলে মিলে একসাথে দিদিভাইয়ের সাথে একটু সময় কাটাই। ওরও ভালো লাগবে।”

    চোখে-মুখে বিষন্নতা আর উদ্বিগ্নতার ছায়া নিয়ে সকলে মিলে ঘরে ঢুকতেই দেখে- বিজয়া কি যেন
    একটা আঁকতে ব্যস্ত। বিজয়া সকলকে একসাথে দেখে রং-তুলি সরিয়ে খুশীতে ডগমগ হয়ে বলে,
    “তোমাদের একসাথে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। বসো। দাদুভাই, তুমি আমার একবারে সামনে বসো।” আঁকা ছবিটা দাদুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, “কাল রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিলো না।
    কি করবো! বসে বসে মা দুর্গার কৈলাসযাত্রার ছবিটা এঁকেছিলাম। সম্পূর্ণ হয়নি। এইমাত্র শেষ করলাম। দেখে বলোতো কেমন হয়েছে!”

    ছবিটা দেখে সকলে অবাক হয়ে যায়। দাদু বিস্ফারিত নেত্রে আনন্দে চীত্‍কার করে ওঠেন –“কেমন করে আঁকলি দিদিভাই, মায়ের এমন মনোমুগ্ধকর সুন্দর ছবি! মায়ের চোখে-মুখে নাই এতটুকু বিচ্ছেদ আর বিষাদের ছায়া। নাই চোখের কোণায় এতটুকু অশ্রু। এ-যে দেখি মায়ের মুখে বিজয়িনীর হাসি! “
    বিজয়া একগাল হেসে বলে, “ঠিক ধরেছো তুমি দাদুভাই। মায়ের চোখে-মুখে রয়েছে তৃপ্ত, দৃপ্ত, গর্বিত হাসি। যুদ্ধ জয়ের হাসি। গতবছর বিজয়া দশমীর দিন তুমি না বলেছিলে–বিজয়া দশমী মন খারাপের দিন নয়, বিশেষ আবেগ আর গভীর অনুভূতিকে স্পর্শ করার দিন। ন’দিন ন’রাত্রি মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এই দশমীর দিনে তাকে পরাস্ত করে মা যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন।”

    -“একদম ঠিক বলেছিস দিদিভাই। তাইতো মা দুর্গার আর এক নাম বিজয়া। আমাদের স্থির বিশ্বাস–তুইও তোর ‘বিজয়া’ নামকে সার্থক করে তুলবি। তোর কাছে মারণরোগের অসুর ধ্বংস হবেই হবে। দেখবি তুই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবি।”

    দাদুর কথাগুলো শোনামাত্রই বিজয়া অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। হতচকিত হয়ে সকলে ভয়ে চমকে ওঠে। গত পাঁচ বছরে তার দমফাটা এমনি হাসি কারোর তো নজরে পড়েনি। মা কমলা মনে মনে প্রমাদ গোণে। এটা কি তবে ফুরিয়ে যাওয়ার অশুভ সংকেত! না, মোমবাতি নিভে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত! বাঁধ মানে না, ডুকরে কেঁদে ওঠে কমলা।

    সমরেশবাবু উদ্বিগ্নচিত্তে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বন্ধু ডক্টর সান্যালকে ব্যাপারটা বিস্তারিত ফোনে জানিয়ে জিগ্যেস করেন, “তুমি কখন আসছো?”
    –“রিপোর্ট সব পেয়ে গেছি। আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আসছি।”
    সমরেশবাবু রিপোর্টের ব্যাপারে কিছু জিগ্যেস করতে যাবে অমনি ফোনটা কেটে যায়। দোটানায় পুনরায় ফোনটা করার আর সাহস পান না। ফোনটা রেখে দেন।
    তারা বসে থাকে ডক্টর সান্যালের আগমনের প্রতীক্ষায়।

    ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ত্রস্তপদে ডক্টর সান্যাল ঘরে ঢোকেন। ঘরের পরিবেশ একেবারে থমথমে। টানটান উত্তেজনা। জানা নাই তারা ডক্টর সান্যালের কাছে কি শুনবে–হতাশা, না আশার বাণী!

    ডক্টর সান্যাল ভীষণ উদ্বেগে বিজয়ার সামনে এসে দাঁড়ান। মিষ্টি মধুর মৃদুস্বরে জিগ্যেস করেন, “কেমন আছো দিদিমণি?”
    বিজয়া বিন্দুমাত্র দেরী না করে স্মার্টলি উত্তর দেয়, “খুব ভালো আছি ডাক্তারদাদু। আজ নিজেকে খুব ফ্রী লাগছে।”

    -“এরমধ্যে গায়ে জ্বর এসেছিলো নাকি?”
    -“না।”
    -“শরীরে কোনো কাঁপুনি?”
    -“না।”

    হাত-পা গুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন চামড়ার নীচে রক্তজমা ছোপগুলো অদৃশ্য। জিজ্ঞেস করেন,
    “দাঁতের মাড়িতে কোনো ব্যথা আছে?”
    -“না।”
    -“এরমধ্যে কোনো তোমার শ্বাসকষ্ট হয়েছিলো?”
    বিজয়া মৃদু হেসে উত্তর দেয়, “একেবারেই না।”

    ঘরে উপস্থিত সকলেই সমস্বরে জানায় তারাও বিজয়ার শ্বাসকষ্টের ব্যাপারটা টের পায়নি।

    ডক্টর সান্যালের চোখে মুখে খুশীর ঝলক–“গুড, এবার হাত-পা ছড়িয়ে একটু শুয়ে পড়ো তো মা।”

    বিজয়া বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লে ডক্টর সান্যাল পেটটা পরীক্ষা করে দেখলেন ঢাউস
    পেটটা অনেকটা ছোটো হয়ে গেছে। লিভার, স্পলীনের অবস্থানও স্বাভাবিক। চোখের কাছে
    মুখ নিয়ে গিয়ে বলেন, “একটু বড় করে তাকাও।”
    দেখলেন, চোখের ভেতরে সাদা অংশে জমে থাকা ছোটো ছোটো রক্তের স্পটগুলোও উধাও। খুশীতে
    ডক্টর সান্যালের চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে। মনের আনন্দে ক্ষণেক বিরতিতে জোরে জোরে তিনবার হাততালি দেন। বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে বিজয়ার হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে প্রবল আবেগে বলেন, “কনগ্রাচুলেশান বিজয়া, ইউ হ্যাভ ওন এ ডিফিকাল্ট ব্যাটল। ইউ আর দ্য উইনার্। ইউ হ্যাভ রিসিভড পারমিশন ফ্রম গড টু স্টে ইন দিস বিউটিফুল ওয়ার্ল্ড ফর এ লং টাইম।’

    কারোর মুখে কোনো কথা নাই। পরমপ্রাপ্তির এক অনির্বচনীয় আনন্দে সকলের চোখে এখন অবিরত বিগলিত অশ্রুধারা।

  • ভৌতিক গল্প

    ভৌতিক গল্প- ভূত

    ভূত
    -মানিক দাক্ষিত

     

     

    ১৯৭৩ সালের কথা। বেশ মনে পড়ে সেদিনটা ছিল শীতকালের অমাবস্যার রাত। সময় প্রায় রাত দশটা। হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। হাতে অগাধ সময়। আমরা ছয় বন্ধু মিলে ক্লাবঘরে খোসমেজাজে লণ্ঠনের আলোয় আড্ডা দিচ্ছি। প্রত্যন্ত অজ পাড়া গাঁ। তখন ইলেকট্রিসিটির কথা ভাবাই যায় না। উচ্চ মধ্যবিত্তদের হ্যরিকেন, গরীব মধ্যবিত্তদের লণ্ঠন আর খেটে খাওয়া গরীব মানুষদের ঘরে
    লম্ফ বা কুপীই ছিল রাতের আলো। বিভিন্ন পূজো-পার্বন, উত্‍সব, অনুষ্ঠান, যাত্রাপালা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আলোর উত্‍স ছিল হ্যাজাক বা ডে-লাইট।

    পাড়া গাঁয়ের দশটার রাত মানেই গভীর রাত।শুনশান। বাইরেটা যেন নিকষ কালো অন্ধকার চাদরে ঢাকা। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকে রাতটাকে কেমন যেন এক অদ্ভূত রহস্যময়ী মায়াবী নি:স্তব্ধ আর একাকী করে তুলেছে। আড্ডা দিতে দিতে হঠাত্‍ তর্ক বেধে যায় কালুর সাথে বিশুর। তর্কটা বাধে ভূত নিয়ে। কালু বলে, ভূত বলে কোনো জিনিস আছে–আমি বিশ্বাসই করি না।

    বিশু গলা ফাটিয়ে চীত্‍কার করে–আলবত্‍ ভূত আছে। আমি নিজের চোখে ভূত দেখেছি। আমাদের
    দিকে তাকায়–কিরে তোরা ভূত বিশ্বাস করিস?
    আমার আবার ভূতের ভীষণ ভয়। আমরা সবাই মিলে বিশুর মতকেই সমর্থন করি। কালুর
    মুখে অবজ্ঞার হাসি—একমাত্র গাঁজাখোর আর যারা ভীতুর ডিম, তারাই বিশ্বাস করে ভূতকে।
    বিশু তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে—জানিস, অমাবস্যার রাতে ব্রহ্মদত্যি,ভূত, পেত্নি, শাঁকচুন্নী- দের দেখা মেলে!

    কালুর গলায় আত্মপ্রত্যয়ের সুর—“বেশ তো, আজ তো অমাবস্যা! দেখা না তোদের ভূত প্রেত
    ব্রহ্মদত্যিকে। আমি তৈরী। বল কোথায় যেতে হবে। আমি যেতে রাজী।”
    বিশু চীত্‍কারে গলা ফাটায়—“সোনাডাঙার মাঠে ঘোলগোড়ে কুকুরবাঁদি পুকুরের পাড়ে যে বুড়ো
    বটগাছটা আছে, তার তলায় যেতে পারবি?”

    কালু দৃঢতার সাথে উত্তর দেয়—পারবো।

    আমরা প্রমাদ গুনি। বুকটা কেঁপে ওঠে। বলে কি কালু! এ-তল্লাটের সবাই জানে ঘোলগোড়ে
    কুকুরবাঁদি কি ভয়ংকর জায়গা! নাম শুনলেই ভয়ে প্রাণ আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। সন্ধ্যের পর
    ঐ পথ মাড়াতে কেউ সাহস পায় না। কত যে মানুষ ঐ বুড়ো বটগাছটায় গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে, তার ইয়ত্ত্বা নাই। কয়েকমাস আগেও মেটে পাড়ার নিধিরাম দিনদুপুরে গলায় দড়ি দিয়ে মরলো। জনশ্রুতি আছে–একবার যদি কেউ মরার কথা উচ্চারণ করে, তার আর রক্ষে নাই! ঐ বুড়ো বটগাছ তাকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করে। শেষ পরিণতি–গলায় দড়ি দিয়ে তার মৃত্যু। বুকটা আমার কেঁপে ওঠে। বারণ করি কালুকে।
    —অত সাহস ভাল নয় কালু। কোথা দিয়ে কি অঘটন ঘটে যাবে, বলা যায় না। সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করার কি দরকার!

    কালু ঝেঁঝিয়ে ওঠে— থামতো! ভীতুর ডিম কোথাকার!

    বিশু চোখ টিপে বিষয়টা চেপে যেতে বলে। আমি চুপ করে যাই।

    কালু হাত বাড়ায়—বাজী রাখ, যদি যেতে পারি, কি দিবি?

    বিশু সপাটে কালুর হাতে হাত লাগিয়ে বলে– একটা গোটা খাসি। আর যদি না পারিস? মরে
    যাস?

    —মরে গেলে তো কথাই নাই। গেলাম। যদি না পারি, হেরে যাই, তাহলে আমিও দেবো গোটা
    খাসি।
    তর্কটা জমে উঠল। বিশু বলে–তুই যে সত্যিই রাতের অন্ধকারে ওখানে যাবি, আমরা বুঝবো
    কি করে?
    —বিশ্বাস!
    “বিশ্বাসে কাজ নাই ভাই” বলে বিশু ঘর থেকে বেরিয়ে একছুটে বাড়ী থেকে মস্ত বড় একটা
    লোহার গজাল আর হাতুড়ী এনে কালুর হাতে ধরায়, -এই গজালটা তুই বটগাছের গোড়ায় পুঁতে
    আসতে পারলেই জানবো তুই গেছিস।

    –কুছ পরোয়া নেহি–বলে শীতের চাদরটাকে ভাল করে গায়ে জড়িয়ে কালু অন্ধকারে বেরিয়ে
    যায়।

    ভয়ে আমাদের হাত-পা পেটের ভেতর সেঁদিয়ে যাবার যোগাড়। মুখে কথা নাই। বিশুর দিকে
    তাকাতেই দেখি বিশুর চোখে-মুখে দুষ্টামির হাসি। বলে–“বেচারী একা। সতর্ক থাকা দরকার।
    জায়গাটা ভাল নয়। তোরা টর্চ নিয়ে পিছন পিছন আয়। আমি চললাম” —বলে এক নিমেষে
    এই কনকনে শীতের রাতে শরীর থেকে জামা- প্যাণ্ট খুলে বগলে ভরে একেবারে উদোম গায়ে
    দে ছুট।

    দেরী না করে আমরা চারজন পাঁচ ব্যাটারির দুটো টর্চ নিয়ে রওনা দিলাম সোনাডাঙার দিকে।
    আমরা চারজন, সাথে দুটো পাঁচ ব্যাটারির টর্চ– তবুও ভয়! কি হয় কি হয়! গা ছম ছম করছে।

    বটগাছটার কাছাকাছি আসতেই কানে ভেসে এল একটা বিশ্রী গোঙানির শব্দ। টর্চ জ্বালতেই
    আমরা হতভম্ব। ভয়ে শিয়রে উঠলাম। বিধ্বস্ত চেহারায় কালু বটগাছের তলায় পড়ে গোঙাচ্ছে।
    সাড়া শব্দ নাই। দু-চোয়াল বেয়ে বইছে সমুদ্রের ফেণার মত গ্যাঁজলা। শীতের চাদরটা গায়ে নাই, বটগাছের গোড়ার কিছুটা উপরে আটকানো। আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। দেখি বিশু হাঁপাতে হাঁপাতে হাজির। পরনে শার্ট-প্যাণ্ট।

    বললাম–কোথায় গিয়েছিলি আর এখন কোথা থেকে আসলি?
    কোন কথার উত্তর না দিয়ে বিশু দৌড়ে গিয়ে কালুর শীতের চাদরটাকে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে
    নেয় গাছ থেকে। তারপর পুকুর থেকে দুহাতের আঁজলা করে জল এনে কালুর চোখে মুখে
    ছেটায়। গোঙানি বন্ধ হয়। কালু চোখ মেলে তাকায়। চোখে মুখে তার বিশাল আতঙ্কের
    ছায়া।

    জিগ্যেস করি, কি হল?
    আতঙ্কে আমায় চেপে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে। বলে, আগে আমায় এখান
    থেকে তোরা নিয়ে চল। বাড়ী গিয়ে সব বলবো।

    বাড়ী এসে চোখে মুখে জল দিয়ে একটু ধাতস্থ হলে কালু বলতে আরম্ভ করলো–“তোদের কথা না
    শুনে এঁড়েমি করে মস্ত বড় ভুল করেছি রে আমি। সত্যিই জায়গাটা বড় ভয়ংকর! ভূত, পেত্নী ব্রেহ্ম-
    দত্যির এক্কেবারে আড়ত্‍। কেবল ওখানে ছোটাছুটি আর দাপাদাপির শব্দ। প্রাণ একেবারে শুকিয়ে যায়।
    ভাগ্যিস তোরা আমার পিছু পিছু গিয়েছিলি, তাই এ-যাত্রায় বেঁচে গেলাম। নইলে মরে কাঠ হয়ে পড়ে
    থাকতাম।”
    বিশু আমাদের দিকে ঈষত্‍ বাঁকা চোখে তাকিয়ে কালুকে জিগ্যেস করে, “কি দেখলি, সেটা বল!”
    কাঁপা কাঁপা গলায় কালু বলে, “বলতে পারবো না, ভয়ংকর দৃশ্য। ভাবলে এখনও গা কাঁটা দিয়ে ওঠে।
    তোর দেয়া লম্বা গজালটা বুড়ো বটগাছটায় পুঁতেছি কি–দেখি ছোটো খাটো একটা তালগাছের মতো
    একটা ন্যাংটা ভূত বটগাছের উপর থেকে আমার
    সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। আমি ভয়ে দৌড়ে পালাতে যাবো–দেখি কে যেন আমার চাদরটাকে
    টেনে ধরেছে, কিছুতেই ছাড়াতে পারছি না। ভিরমি খেয়ে ওখানেই পড়ে গেলাম। তারপর আর কিছু
    আমার মনে নাই। সেটা তোরা বলতে পারবি।”

    বিশু গম্ভীর কণ্ঠে জিগ্যেস করে, “এবার বল, ভূত আছে কি নাই ?”
    নিজের দুই কান ধরে তড়িত্‍ গতিতে কালু উত্তর দেয়, রাম রাম রাম। সে আবার বলতে, ওনারা
    আছেন। অবিশ্বাসের কোনো জায়গা নাই। নিজের চোখে আজ আমি ভূত দেখলাম।”

    অপারেশন সাকসেসফুল! বিশুর চোখে-মুখে যুদ্ধ জয়ের এক পরিতৃপ্ত হাসি।

    সেদিন ছোটোখাটো তালগাছের মতো যে একটা ন্যাংটা ভূত কালুর সামনে হুমড়ী খেয়ে পড়েছিল, আসলে সেটা ভূতও নয়, পেত্নীও নয়, সেটা ছিল ডানপিটে ডাকাবুকো দুষ্টু পাজী অদম্য সাহসী ঐ যুবক বিশু। শীতের রাতে উদোম গায়ে অকুস্থলে কালু পৌঁছানোর আগেই সে ঝড়ের
    গতিতে ওখানে পৌঁছে বটগাছের উপরে বসেছিল। কালু গজাল পোঁতার সময় হনুমানের মতো ওর
    সামনে লাফিয়ে পড়েছিলো। আর কালুর শীতের চাদর কেউ টেনে ধরেনি।
    কালু নিজের অজান্তেই চাদরের একপ্রান্ত নিজেই গজালের সাথে পুঁতে ফেলেছিলো।

  • কবিতা

    কবিতা- বললো ভক্ত করজোড়ে

    বললো ভক্ত করজোড়ে
    – মানিক দাক্ষিত

     

     

    স্বার্থের তরে মানত করে
    বললো ভক্ত করজোড়ে,
    “দে-না মা তোর সন্তানেরে
    মনের ইচ্ছে পূরণ করে!
    দিতে পারিস যদি আমায়
    অনেক টাকা, গাড়ী-বাড়ী,
    দেবোই তোকে জোড়া পাঁঠা
    বাড়তি পাবি নতুন শাড়ী।”

    লজ্জা-ঘেন্নায় মা রেগে কয়–
    “স্পর্দ্ধা তোদের বলিহারী,
    আকার-প্রকার মানুষ হলেও
    নয়কো আচার মানুষেরি।
    তোরা হাড় বজ্জাত ধূর্ত্ত লোভী
    আমাকেও দিস ঘুষের কড়ি,
    অহং তোদের কোন সীমানায়
    ভেবেই আমি মর্মে মরি।
    এই জগতের সব জীবেদের
    আমি হলেম জগন্মাতা,
    আমার সন্তান বলি দিয়ে
    খুলিস নিজের পূণ্যি খাতা?
    আমার ছেলের রক্তে রাঙাস
    চোখের সামনে আমার উঠান,
    বলতে পারিস এ-অনাচার
    সইবে কেমন আমার পরাণ!

    পশুবলির কথা লেখা
    আছে বিধান শাস্ত্রমতে,
    সে-পশুটা এ-পশু নয়
    আছে সবার এই মনেতে।

    মনের ভেতর থাকা পশু
    যেদিন পারবি বলি দিতে,
    মহাজ্ঞানীর তকমা নিয়ে
    সেদিন পারবি ‘মানুষ’ হতে।”

  • গল্প

    গল্প- প্রাপ্তি

    প্রাপ্তি
    – মানিক দাক্ষিত

     

     

    মাকে জড়িয়ে ধরে অপরূপা কথাটা বলতেই মা সস্নেহে মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বলে, “আর দেরী নয় এবার তোর বাবাকে কথাটা খুলে বল। ভালো হবে। ভয় কি, বাবা তো তোর বন্ধুর মতো। সব কথা তো তোরা শেয়ার করিস।”

    অপরূপা সত্যিই অপরূপা। রূপে গুণে লক্ষ্মী, বিদ্যায় সরস্বতী। এবার এম.এসসি.কমপ্লিট করেছে।
    গুটি গুটি পায়ে অপরূপা বাবার লেখার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। বাবা লিখতে লিখতে মুখ না তুলে কৌতুক স্বরে জিগ্যেস করেন, “কিছু বলিবেন রাজকুমারী?”

    –আজ্ঞে হ্যাঁ পিতাশ্রী, অতিশয় লজ্জায় কথাগুলি ঠিক মতো সাজাইয়া বলিতে পারিবো না বলিয়া এই অনুঘটকটিকে রাখিয়া যাইলাম। আপনি সময়মতো যত্নসহকারে শুনিয়া আপনার সুচিন্তিত মতামত প্রদান করিবেন।”

    উদার সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ অরুণবাবু মুখটা তুলে দেখলেন–একটা ছোট্ট মুঠো টেপ রেকর্ডার্। পরম
    সাগ্রহে চালালেন— “আমি মাতাশ্রীর নিকট শুনিলাম আপনি আমাকে পাত্রস্থ করিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন। সনির্বন্ধ অনুরোধ, দয়াপূর্ব্বক কষ্ট করিয়া আর আমার পতিদেবতার খোঁজ করিবেন না। বর্তমানে আমার সন্ধানে রহিয়াছে। পাত্র ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ। ভীষণ গরীব। সংসারে অসুস্থ মা ছাড়া আর কেহ নাই। অন্তর ও বাহির খুবই সুন্দর। বাজাইয়া দেখিতে পারেন। আদেশ পাইলে পাত্রকে সশরীরে আপনার সম্মুখে উপস্থিত করিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করিব।”

    রবিবার সুদর্শন যুবক সৌম্য অরুণবাবুর বাড়ী আসলে অপরূপার মায়ের ভীষণ পছন্দ হয়। বিচক্ষণ অরুণবাবু সৌম্যকে নিয়ে একটা আলাদা ঘরে আলাপ আলোচনার জন্য বসলেন। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর ও আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অরুণবাবু যখন শুনলেন তার মায়ের নাম বেলা সেন, তখন তিনি বিস্ময়ে চমকে উঠলেন। প্রশ্ন করলেন, “তা’লে নিশ্চয়ই তোমাদের আদি বাড়ী টালিগঞ্জ নয়?”
    -আজ্ঞে না।
    -কোথায়?
    -বর্ধমানের মেমারী। রেলস্টেশনের কাছেই।
    -হাসপাতাল মোড়ে?
    -হ্যাঁ – হ্যাঁ, আপনি জানলেন কিভাবে?
    -সেসব কথা পরে হবে। তোমার মামারবাড়ী কি মন্তেশ্বর?
    -হ্যাঁ, মন্তেশ্বর নীচু বাজারে। আমার দাদু, মামাকে কি আপনি চেনেন?
    -চিনতাম। তোমার বাবার সম্বন্ধে তুমি কতটুকু জানো?
    -বাবার চরিত্র মোটেই ভালো ছিলো না। মদ খেতো। রেসের মাঠে যেতো। মায়ের গায়ে যখন তখন হাত তুলতেও দেখেছি।
    –মারা গেলেন কিভাবে?
    –কার একিসেডেণ্টে।
    -তোমাদের সংসারের অবস্থা তো ভালো নয়। চলে কিভাবে?
    -ডিউটি করা অবস্থায় বাবা মারা যাওয়ায় সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণবাবদ বেশ কিছু নগদ টাকা মা পেয়েছিলেন। জমানো টাকার সুদ আর আমার কয়েকটা টিউশানি থেকে মোটামুটি চলে যায়।


    -এই অবস্থায় বিয়ে করা তো একরকম দু:সাহস!

    নির্ভীক সৌম্যর গলায় আত্মপ্রত্যয়ের সুর। স্বচ্ছন্দ সাবলীল ভঙ্গীতে বলে – অসুস্থ মা বিয়ের জন্যে পীড়াপীড়ি করলেও এই মুহূর্তে বিয়ের জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত নই।অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনীয়ার পদে আমার কে.এম.সি’র প্যানেলে ১ নম্বরে নাম রয়েছে। প্রসেসিং হচ্ছে। আশা করি মাস দুয়েকের মধ্যেই অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার পেয়ে যাবো।

    অরুণবাবু চোখ বন্ধ করে কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, “আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি ভেতরে যাও।”

    হাঁপ ছেড়ে বাঁচে সৌম্য। অরুণবাবুর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বেরিয়ে আসতেই দেখে দরজার আড়ালে অপরূপা দাঁড়িয়ে। এতক্ষন ঘাপটি মেরে সব শুনেছে দুষ্টু মেয়েটা। অপরূপা একরকম সৌম্যকে ছোঁ মেরে মায়ের কাছে হাজির করে হাসিতে গড়িয়ে পড়ে।
    -মা, দেখো টেনশনে ছেলেটার কি অবস্থা! ঘেমে নেয়ে উঠেছে। জামাটা ভিজে একেবারে গোবর
    ভেজা।
    সৌম্য কিছুটা অপ্রস্তুত। অসহায় দৃষ্টিতে ম্লান হেসে অপরূপার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে
    বলে, “ওরাল পরীক্ষায় মনে হচ্ছে ডাঁহা ফেল মারলাম।”

    রাতে খাবার টেবিলে খেতে বসে অপরূপার মা উদ্বিগ্ন চিত্তে কর্তাকে জিগ্যেস করে, “কি গো
    ছেলেটাকে তোমার পছন্দ হয়নি? আমার তো খুব ভালো লেগেছে। একেবারে রাজপুত্তুর! যেমন মিষ্টি চেহারা, তেমনি আচার-ব্যবহার।”
    রাশভারী অরুণবাবু গম্ভীর মুখে উত্তর দেন, “তোমাদের পছন্দ হলেও ছেলেটিকে আমার মোটেই পছন্দ হয়নি। কোনোদিকেই ও-আমার মেয়ের উপযুক্ত নয়। ওর সাথে বিয়ে হলে আমার মেয়ে সুখী হবে না। সংসারের অবস্থা ভালো নয়, কোনোরকমে ওদের দিন চলে।”
    গিন্নি বোঝাবার চেষ্টা করে, “কিন্তু ছেলেটা তো দু-একমাসের মধ্যেই চাকরীতে জয়েন করবে
    শুনলাম। তা’লে আপত্তিটা কিসের?”
    অরুণবাবু তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন, “ছাড়ো, ছাড়ো, অনেক দেখেছি। গাছে কাঁঠাল, গোঁফে
    তেল! চাকরী বললেই চাকরী হয়ে যাবে! ছেলের হাতে মোয়া আর কি!”

    একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাত। অপরূপা নিশ্চুপ। নিশ্চল পাথরের মতো চেয়ারে বসে। মুখের গ্রাস
    হাতের মধ্যেই ধরা। চোখ হতে নীরবে বইছে অবিরল অশ্রুধারা।

    হঠাত্‍ মা-মেয়েকে চমকে অরুণবাবু হো-হো করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন। হাসি থামিয়ে একঢোক জল খেয়ে স্মিতহাস্যে তারিয়ে তারিয়ে বলেন, “আরে না-না, তোমাদের সাথে এমনি মজা করছিলাম। সৌম্য ছেলে হিসাবে সত্যিই খুব ভালো। কাঁচ নয়, একেবারে হীরের টুকরো। আমারও ভীষণ পছন্দ। বলতে পারো‌ আমার মেয়ের নির্বাচন একেবারেই সঠিক।”
    অপরূপা অবাক বিস্ফারিত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে। নিজের চোখ-কানকে সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। আনন্দে বিহ্বল। ভাতের গ্রাস থালায় নামিয়ে এঁটো হাতেই বাবার
    গলা জড়িয়ে খুশীতে জুড়ে দেয় হাউহাউ করে কান্না।
    বহু আকাঙ্খিত ঈপ্সিত বস্তুটি মানুষ যখন পায়, তখন এমনি করেই বোধ হয় তার হৃদয় খুশীর
    জোয়ারে উথাল পাথাল করে!
    মায়ের দু’চোখেও দেখা যায় টলটল করছে আনন্দ আর খুশীর যুগল অশ্রু।

    সৌম্যের সাথে আলাপ আলোচনার পর থেকেই অরুণবাবুর মনটা উদ্বিগ্ন আর অস্থিরতায় পরিপূর্ণ।
    কিছুতেই মনটাকে স্থির রাখতে পারছেন না। গভীর রাত। চোখে ঘুম নাই। বারান্দায় অস্থিরভাবে তার পদচারণা। জ্বলছে মুখে একটার পর একটা সিগারেট।
    সাঁইত্রিশ বছর আগে কালের আবর্জনায় চাপা থাকা দু:সহ মর্মান্তিক ঘটনাগুলো একটার পর একটা তার মনের পর্দায় ফুটে উঠছে। স্পষ্ট মনে পড়ে, বেলার অনুরোধে এক শীতের সন্ধ্যায় সদ্য চাকরী পাওয়া এক গরীব যুবক বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তার প্রভাব প্রতিপত্তিশালী বড়লোক বাবার কাছে গেলে জুটেছিল কি চরম অপমান আর লাঞ্ছনা। সদম্ভে বেলার বাবা বলেছিলো, “কোন সাহসে তুমি বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াও? আর একবার আমার মেয়ের নাম উচ্চারণ করলে তোমায় কুচি কুচি করে কেটে খড়ি নদীর জলে ভাসিয়ে দেবো মনে রেখো। বেরোও আমার বাড়ী থেকে।”
    দারোয়ান দিয়ে ধাক্কা মেরে বাড়ীর বাইরে বার করে দিয়েছিলো। বেলা তীব্র প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু লাভ হয়নি। ফল হয়েছিলো উল্টো। টানা ছ’মাস ঘরের মধ্যে আটকে রেখে মেমারীর এক ধনীর দুলালের সাথে জোর করে তার বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো।

    অদৃষ্টের কি পরিহাস! যে ভালোবাসার মানুষটি এতোদিন বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছিলো, এতোদিন পর বেলাশেষে আবার একটা নতুন পবিত্র সম্পর্কে বাঁধা পড়তে চলেছে।
    চাওয়া-পাওয়ায় নয়, হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার মানুষটাকে চোখের সামনে দেখতে পাওয়াও
    যেন মনে হয় তার কাছে এক পরম প্রাপ্তি। অরুণের দেহ-মনে-প্রাণে বয়ে যায় এক অনির্বচনীয় আনন্দের শিহরণ।

    দেখতে দেখতে কেটে গেছে তিন তিনটে মাস। সুখবর। সৌম্য চাকরী পেয়েছে। কে.এম.সিতে
    সে এখন অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনীয়রের পদে কর্মরত। গত সপ্তাহে মহা ধূমধাম সহকারে অপরূপা+সৌম্যর বিয়েটাও নির্বিঘ্নে চুকে গেল। দুই পরিবারে এখন খুশীর হাওয়া।
    মেয়েটা চলে যাবার পর থেকে কর্তা-গিন্নি দুজনের মনটাই বেশ ভারাক্রান্ত। কোনো কাজে মন বসছে
    না। অরুণবাবু টেবিলে খাতা-পেন নিয়ে কি সাত- পাঁচ ভাবছে—অমনি তার মুঠোফোনটা বেজে
    ওঠে। ফোনটার দিকে তাকিয়ে অরুণ একগাল হেসে বলে, “হ্যাঁ, বলো বেলা।
    -উঁহু, বেলা নয়। এখন থেকে বেয়ান।
    -তথাস্তু দেবী। বলো, কি বলবে!
    -দুদিন ধরে মনের ভেতর কয়েকটা কথা কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে, বলবো বলবো করেও বলা হচ্ছে
    না তোমাকে। এখন বলি।
    -বলো।
    -আমরা দুজনেই সমবয়সী। একই স্কুলে, একই কলেজে একই ক্লাসে আমরা দুজনে পড়াশুনা
    করেছি। তোমার মনে আছে–আমরা দুজনে স্ট্যান্ড করতাম। কখনও তুমি হতে ফার্স্ট, কখনও
    আমি। দুজনেই আমরা ফার্স্ট-সেকেণ্ডের মধ্যে থাকতাম। কখনও আমরা থার্ড হইনি। হায়ার সেকেণ্ডারীতে আমরা দুজনেই তিনটে বিষয়ে লেটার মার্কস নিয়ে ফার্স্ট ডিভিশানে পাস করেছিলাম, তোমার মনে আছে অরুণ?
    -বেশ মনে আছে।
    -জানো সমবয়সী হয়েও ভীষণ ইচ্ছে করছে তোমায় একবার সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে। তুমি মহান। আমার বিত্তশালী অহংকারী বাবা সেদিন যা পারেনি, আজ তুমি তোমার মেয়েটাকে আমার ছেলের হাতে তুলে দিয়ে তুমি তাই করে দেখিয়েছো। আমি ধন্য তোমার লক্ষ্মী প্রতিমার মতো সুন্দরী বিদুষী মেয়েকে আমার ছেলের বৌ হিসাবে পেয়ে। এতোটুকু মিথ্যা নয়–সত্যি বলছি, অপরূপা মায়ের স্পর্শে আমার সংসার পেয়েছে নতুন জীবন। এই ক’দিনে ওর অকৃত্রিম ভালোবাসা আর সেবায় মনে হচ্ছে আমার অসুস্থ শরীর অর্ধেক ভালো হয়ে গেছে। বলতে পারো অরুণ, বেলা শেষে বেলার এটা পরম প্রাপ্তি।

    ফোনটা কেটে যায়।
    ———-

  • কবিতা

    কবিতা- আর কতোদিন অপেক্ষার বাকী

    আর কতোদিন অপেক্ষার বাকী
    – মানিক দাক্ষিত

     

     

    পিলে বাড়া হাড় জিরজিরে কঙ্কালসার ছেলেগুলো
    সংখ্যা হয়ে দুর্ভিক্ষের ক্ষিদে পেটে দাঁড়িয়ে।
    কোটরে থাকা নিষ্প্রভ জুলজুলে চোখগুলো
    খোঁজে বাসি রুটি চারদিকে হতাশা মাখিয়ে।
    নর্দমার পাশে পড়ে থাকা বাসি পচা খাবার
    অমৃত সমান। এখনই হয়ে যাবে সাবাড়।
    খাবারের ভেতর জন্মানো ব্যাকটেরিয়ার দল
    এখানে অপ্রাসঙ্গিক। পেটের ভেতর সেঁধিয়ে
    পাচকরসে হাবুডুবু খেতে খেতে পাবে অক্কা।

    ওদের জীবনে অমাবস্যার আঁধার কাটিয়ে
    কতদিনে গনগনে সূর্যটা আসবে মধ্যগগনে!
    নাকি যুগ যুগ ধরে খাবি খাবে। নাকি জ্বলবে
    ঝুলে থাকা বাবুইয়ের বাসায় ওরা জোনাকী
    হয়ে।দেখা যাক আর কতোদিন অপেক্ষার বাকী।

  • কবিতা

    কবিতা- আসবে সে-দিন—আসবে

    আসবে সে-দিন—আসবে
    -মানিক দাক্ষিত

     

     

    একটু আগুনের ফুলকি দেখে
    উল্লাসের দামামা বাজিয়ো না।
    শুনতে পাও–কালের অসহ্য মর্মান্তিক কান্না।
    অন্ধকারের বুক চিরে পূর্ণিমার আলো ফুটতে
    এখনও ঢের বাকী–
    সাহসের কৌটোয় প্রাণটাকে বন্ধ রেখে
    ততদিন নিজেদের প্রস্তুত রাখি।

    তোমাদের হাত থেকে দাসত্বের শেকলটা
    খসে পড়লেও মরচে পড়েনি।
    অত্যাচারের কড়া চাবুকটার
    আস্ফালন থামলেও স্তব্ধ হয়নি।

    মানুষের চামড়ায় ঢাকা শয়তানগুলো
    মুহূর্তে বহুরূপী—
    শক্ত করে চাপতে হবে কেউটের ঝাঁপি।
    অনুকূল পরিবেশে যতই খণ্ড বিখণ্ড করো
    রক্তচোষা জোঁকটাকে,
    অমরত্বে বারবার ফিরবে নিয়ে প্রাণটাকে।
    ওদের জীবনীশক্তি কিলবিল করে
    বিশ্বের অস্থি-মজ্জায়।

    আগুনের ফুলকি দেখে
    উল্লাসের দামামা বাজিয়ো না—
    যে-কোনো মুহূর্তে ওরা
    তোমাদের মস্তিষ্কে দিতে পারে হানা।

    তোমাদের ক্ষমতা অসীম–
    এক একটা আগ্নেয়গিরি
    এক একটা জলপ্রপাত
    এক একটা সাইক্লোন
    জন্ম থেকে তৈরি আছে তোমাদের বুকের মাঝে।

    আসবে—সে-দিন আসবে–
    হিমেল হাওয়ায় সবুজপাতা দুলবে
    সাগর মাঝে হাঙর কুমীর ছবি হয়ে ভাসবে;
    চুনো-পুঁটি মাছগুলো সব বাঁচার মতো বাঁচবে।

    যে-দিন ওরা আকাশ থেকে
    উল্কা হয়ে পড়বে—
    সে-দিন তোমরা আকাশ মাঝে
    তারা হয়ে ফুটবে।

You cannot copy content of this page