• কবিতা

    পুড়ছে দেশের আত্মা

    পুড়ছে দেশের আত্মা

    -রাখী সরদার

     

     

    কিইবা চেয়েছিল ছেলেগুলো
    একটা বারুদ চুম্বন?
    কিইবা পেল ছেলেগুলো
    সাদা মোমবাতি ও কিছু ফুল?

    ছেলেগুলো বুক চিতিয়ে চলে গেল…

    দেখেছো ওদের কপালের স্বস্তিক চিহ্ন?
    দেখেছো ওদের বুকের ক্রুশকাঠ?
    দেখেছো চোখে সূর্মার ভাঁজ?

    দলা পাকানো মাংসপিণ্ডে
    লেগে আছে মায়ের দুধ
    ছুঁয়ে আছে প্রেমিকার ওষ্ঠ
    গেঁথে আছে সন্তানের তৃষিত চোখ।

    এভাবেই সব লেনদেন শেষ!
    গোলাপ নয় কাঁটা চাই
    মোমবাতি নয় মশাল চাই …

    প্রিয় রাজনীতিকগণ থামুন এবার
    বাঁকা লেজ গুটিয়ে ঘুমান
    গিয়ে শেডের নীচে…

    পুড়ছে ঠোঁট
    পুড়ছে প্রেম
    পুড়ছে দেশের আত্মা

    কষ্ট হয়, আকাশ ফুরিয়ে গেল বোধহয়
    তবুও শুনতে পাই গান…

    ছেলেগুলো ফুসফূসে পতাকা গেঁথে
    বারবার বলে যায়–
    “মা তুঝে সালাম
    মা তুঝে সালাম।”

  • মুক্ত গদ্য

    এ নদী সব‌ই জানে

    এ নদী সব‌ই জানে 

    -রাখী সরদার

     

     

    জলের পাড়ের ওপর ঝোপে কেন পতঙ্গরোদ্দুর চুপ করে বসে থাকে,প্রাচীন লতা টুকরো করতে করতে রামি চণ্ডীদাসের চোখে কী দেখেছিল ,কোন পথে ঘুরে ঘুরে গাছে বাসা বেঁধেছিল গর্ভবতী মেঘ এ নদী সব‌ই জানে ।যার যখনই দেয়াল ভেঙেছে, একলা বাতাসে উড়ে গেছে সম্পর্কের টান সে তখনই এ নদীর জলে চিবুক ডুবিয়ে নিজেকে মেপেছে।ঝাপসা চোখে বলে গেছে এক একটা মিহিন চাঁদ রাতের কথা ।

    এই যেমন হলুদ ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়েটি দুহাতে ঢেউ সরিয়ে সরিয়ে খুঁড়েছিল বালি।সে শুনেছিল তার মায়ের ভাঙাচোরা ছায়া নাকি সেখানে কোথাও পোঁতা আছে।প্রতি এপ্রিলে বাবার কাছে আব্দার
    করে –‘ঢেউ দেখবো,ঢেউ দেখবো।’প্রতিবার বাবা নিয়ে যায়।হলুদ রোদ্দুর যতক্ষণ সমুদ্রের গায়ে
    হেলান দিয়ে থাকে মেয়েটি মুঠো মুঠো বালি খোঁড়ে।
    প্রথমে নখ,তারপর আঙুল,তারপর কব্জি চিৎকার করে –‘আর নয়, রেহাই দাও,ফিরে চলো’ক্ষুধার্ত মন
    নিয়ে ফিরে যায়,ফিরে যায় মুঠো মুঠো নুন ফেনা আর স্বপ্নে দেখা মায়ের ভাঙা শাঁখার টুকরো নিয়ে।
    তারপর কবে কবে হলুদ ফ্রক লাল হয়,নীল হয়,ক্রমে ফ্যাকাসে।একদিন লুকানো সন্ধেয় মেয়েটি
    চলে আসে এ নদীর কাছে।উদ্ভট উপাখ্যান জলে ভাসিয়ে ক্ষয়ে যাওয়া নখ নিয়ে ফিরে যায় খুঁটিনাটি
    জীবনে ।

    এইতো তের‌ই বৈশাখে খাঁ খাঁ দুপুর মাথায় করে পোড়ো ভিটের ঘুঘুটি উড়ে এলো নদীর তীরে।সূর্য তখন গলে গলে পড়ছে।উড়তে উড়তে ঘুঘুর ঠোঁটে কালচে ধোঁয়া পাক খাচ্ছে, ডানা গেছে ছড়ে ।চোখের রক্তাভ লাল পোড়া শালপাতার মতো জ্বলছে।নদীর বুক ঠুকরে দু ফোঁটা জল নিতে গেল বেচারা ঘুঘু,পারলনা স্খলিত বীর্যের মতো টুপ করে নদীর জিনিস নদীতে ফিরে গেল।শেষে নদী মোচড় মেরে ঢেউ তুলে ঘুঘুর ঠোঁটে দিল সফেদ মিস্টি ফেনা। প্রাণ পেল ঘুঘু।নদীর কাঁধে হাত রেখে বলে গেল নকশা জীবনের কথা —-

    একদিন অন্ধকারের সাথে ঝগড়া করে লাল বাড়িতে বাঁধি বাসা।চোরা প্রেমের টানে পেটে ডিম আসে।লাল বাড়ির খোকা খুকির মতো লালচে ডিম।হাল্কা রোঁয়া ওঠা দুটো বাচ্চা।সারাদিন শসাখেতে সবুজ ফড়িংয়ের পিছুপিছু।দেখতে দেখতে ওরা বড় হয়,ডানা নাড়ে,একে একে উড়ে
    যায় গাছগাছালির বাঁকে। পুরোটাই স্বপ্ন ,লাল বাড়ির খোকা খুকি ভাঙা গল্পের মতো ভেঙে ফেলে ডিম দুটি।বড় মায়া।ছেড়ে যেতে পারিনা ওদের।দিন যায়।প্রতিদিন ফরি যাই সেই অন্ধকার গুহায়।থাকতে পারিনা, সূর্যের পিছন পিছন চলে আসি লালবাড়ির ছোট্ট সেই বাসায়।রাতে সবথেকে বড় তারাটির সাথে খুনসুটি সেরে ঘুমিয়ে পড়ি।একদিন ভোরে স্পষ্ট দেখি খোকা খুকি ভিজে পাতা মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে।ডানা ঝাপটাই যেওনা।শোনেনি ওরা।কত বিকেল দেখেছি কার্ণিশে ঝুলে ঝুলে ক্লান্ত হয়েছে।দেয়াল থেকে বালি,সিমেন্টর চাঙড় আলগা হয়ে পা টিপে টিপে নেমে গেছে ঝোপে ঝাড়ে।তবুও জীর্ণ বাসায় বসে থেকেছি।খোকা খুকি ফিরে আসবে ।ওরা আমার সেই লালচে ডিয যে।আজ নিচের চাতালে হঠাৎ সবশুদ্ধ নেমেআসি।পোড়ো ভিটে সাফ চলছে।ডানায় যেটুকু সুর ছিল তাও শেষ…

    কিছু কিছু কথা গোপনে পা ফেলে নদীর কাছে হেঁটে আসে।সারাদিন শুকনো ঝাঁটিঘাসের ঝোপের আড়ালে চুপ হয়ে থাকে।রাতে বিশাল আকাশে বুক চিতিয়ে চাঁদ উঠলে জল ঘেঁষে দীর্ঘ শ্বাস পড়ে। ঘুমহীন শহর থেকে তখন কোন মৃতপ্রায় সৈনিক এসে বসে নদীর কোলে।সৈনিকের ঘাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে নেমে যায় রক্তের স্রোত।বলিষ্ঠ উরু বুলেটের অবিশ্বাস্য হাসিতে ফেটে পড়ছে।কোন ভ্রুক্ষেপ নেই সৈনিকের।অতীত ও বর্তমানের মাঝের ব্রিজটা নড়তে থাকে।সৈনিক ব্রিজের মাঝ বরাবর গিয়ে না এগোতে পারে না পিছিয়ে আসতে পারে।কোন এক সুকোমল বিকেলে দেখা হয়েছিল প্রিয় বন্ধুর সাথে। হাসি,গল্প,সিগারেটের ধোঁয়ায় মনের অন্ধকার পর্দা উড়িয়ে দিয়েছিল।প্রেমিকার হিমজল ছোঁয়া কালো তিলের ছোঁয়া ছুঁয়ি খেলার কথাও বলেছিল।তারপর প্রবল ঢেউ এর মতো ডাক আসে।ফিরে যেতে হবে যুদ্ধক্ষেত্রে।চিন্ময় বসন্ত ফেলে চলে যেতে হয়।একটা একটা শত্রু পক্ষের গুলি ছুটে আসতো আর নির্ভীক সৈনিক শেষ চুম্বনের কথা মনে রেখে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ফিরিয়ে দিত শত্রু পক্ষের বুকের ক্ষেতে।একদিন সাদাকালো বৃষ্টির ভিতর একটা চিঠি এসে পড়ে ——“পুরনো ক্যালেন্ডার ছিঁড়ে ফেলেছি।”সৈনিক এর ভিতরটা ভেঙে যাওয়া বাবুইয়ের বাসার মতো হয়ে পড়ে।টুকরো টুকরো ঘাস পাতা উড়ে যায়। ভৌতিক দাবানল আছড়ে পড়ে শরীরে যখন শোনে বন্ধুর উষ্ণতায় তার প্রেমিকা আহত।মুহূর্তে সমস্ত হাড়ের খিলান নড়ে ওঠে। ভাঙাচোরা একজোড়া মুখ চোখের সামনে অশ্লীল ভঙ্গিতে নাচতে থাকে।আঁকাবাঁকা অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্দুকের তীক্ষ্ম আলো।সৈনিক বিবর্ণ ল্যাম্পপোস্টের মতো পড়ে যায় ।তারপর অনেক গুলো নিরক্ষীয় গ্রীষ্ম পার হয়ে যায় । আবার যুদ্ধ শুরু।বারবার মৃত্যুর জাল বুনতে থাকে,পারেনা। পৃথিবী যেন বিষাদের পালকে পোড়ার জন্য সৈনিক কে দানপত্র হিসেবে এই অগম্য পথে ফেলে রেখেছে।বিয়োগফলের মতো কাটাকুটি খেলতে
    খেলতে এসে পড়েছে এ নদীর কাছে।চোখের কুয়াশা ঘন হয়ে ওঠার আগে ব্রিজ পেরোতে চেয়েছে।নদীর জলে স্মৃতির সজ্জা ধুয়ে ফেলতে চেয়েছে নিঃসঙ্গ সৈনিক।

    এক বর্ষার সন্ধ্যায় নদী একটু বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করছিল,সারাটাদিন মেঘ বৃষ্টির পাগলামিতে অস্থির হয়ে পড়েছিল।কখনো জলকে হিজিবিজি আলপনা আঁকতে হচ্ছিল তো কখনো দুঃসাহসী মেয়ের মতো লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পাতালপুরির অসুররাজের দিকে ঢেউ ছুটিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছিল। সারাদিন পর বাঁকা চাঁদের ফালির সাথে একটু প্রেমালাপে ব্যাস্ত এমন সময় চাপা কান্নার আওয়াজ আসে।কুমুদ চাঁদ বলে ওঠে —‘ওগো নদী, দেখো দেখো ওই যে দূরে কে ভেসে আসে ।’ একটা আধপোড়া চিতাকাঠ ভেসে আসছে।সমস্ত শরীর পুড়ে ছাল উঠে আছে।বুকের কাছে খাঁ খাঁ শূন্য। বড় করুণ অবস্থা।দাহচুল্লী থেকে কোনরকমে ঝাঁপিয়ে নদীতে পড়েছে।পালিয়ে আসা ছাড়া কোন উপায় ছিলনা যে।প্রতিদিন পোড়া মাংসের গন্ধ আর কত সহ্য করা যায়।কচি বাচ্চার নাভি,অবুঝ ছেলেটির মায়ের কোমল হাত,অষ্টাদশীর পদ্মস্তন
    এ সব সব কিছু চিতাকাঠের বুকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হত।কষ্ট হচ্ছে বললেও কেউ শুনতো
    না,সেই যবে থেকে শশ্মান সংসারে ঘর পেতেছে তবে থেকেই শুরু হয়েছে এ যন্ত্রণা।কালো অভিশাপ সবসময় ছায়ার মতো পিছু পিছু ঘোরে।কত মা যে তাকে রাক্ষুসী বলে গালাগালি দিত প্রতিদিন তার
    ঠিক নেই।আর পারলাম না।ভেসে পড়লাম।তারপর ক্ষয় হতে হতে একদিন ঘুমিয়ে পড়বো নদীর ভিতরপানে সেই কাদা বালির দেশে…আরও আরও কতজনের গভীর আর্তনাদ নিঃশব্দে বয়ে নিয়ে চলেছে নদী নিজেই জানেনা।জানবেই বা কিভাবে।এ নদী প্রতিদিন নিজের জলকণার পৃষ্ঠায় লিখে চলেছে শত কান্নার আঁকিবুকি।যার যখনই কষ্ট হয়েছে এসে বসেছে নদীর পাশে।স্তব্ধ একতারায় সুর তুলে নিদারুণ মুহুর্তকে ভুলতে চেয়েছে…অনেক যাতনা পেরিয়ে চলে আসি। ছিঁড়ে ফেলি তুমুল দুঃখ যে কোমল আগুনে যতটুকু পুড়েছি বাকিটা বাঁচানোর ইচ্ছেয় জলে নামি, মাঝরাতে আকাশ ফুরিয়ে গেলেও পাশে থাকে উৎসুক ঘন জল । স্পষ্ট বুঝতে পারি আর কেউজানুক বা না জানুক এ নদী সব‌ই জানে…

  • কবিতা

    আমরা চারজন বিরাট ছায়া

    আমরা চারজন বিরাট ছায়া

    -রাখী সরদার

     

     

    একটা প্রচণ্ড লাল টুকরো পেটমোটা
    নদীটা মুখে পুরে নিলো

    আকাশ ফুরিয়ে যেতে যেতে বিন্দু
    কয়লার গুঁড়োর মত অন্ধকার
    আমরা তিনজন হেঁটে চলেছি —
    পাহাড় ভাঙার শব্দ…

    দিশেহারা — সবাই ছুটতে লাগলাম
    বাতাসে হাড়কাঁপানো শিস্‌ ফুকরে উঠছে 
    কিসে যেন ধাক্কা খেলাম।

    সামনে দেখি
    মাটি ফুঁড়ে ভয় দাঁড়িয়ে, বিরাট চেহারা
    তিনজনে মস্তক নীচু করতে করতে
    ধূলোয় গেলাম মিশে।

    এখন আমরা চারজন বিরাট ছায়া
    বৃহৎ ভয় হয়ে মাটিতে থাকি
    দাঁড়িয়ে .. .

  • অণু কবিতা

    গতযুবতী চাঁদ

    গতযুবতী চাঁদ
    -রাখী সরদার

     

     

    বহুবার ব্যবহৃত হতে হতে
    গতযুবতী চাঁদ
    নবযৌবনা
    কেননা আজ দোলপূর্ণিমা।

    চন্দ্রভগ্নাংশ জোড়ের খেলার সময়

    আদিম রোমশ গাছের প্রতিটা
    রোমসন্ধি থেকে ঠুকরে ঠুকরে
    তুলে নাও উষ্ণতা,

    আমি খুলে ফেলি কৌশলের কাঁচুলি
    পাতায় জমছে গভীর রাত

    চলুক না গোপন স্রোতের মতো
    দীর্ঘস্থায়ী দুষ্টুমি…

  • কবিতা

    একলা

    একলা
    -রাখী সরদার

     

     

    বাবলু
    তোর মনে আছে আজকের দিনের কথা?
    মনে নেই নারে?
    আজকেও জানলা গলে একথালা চাঁদের
    আলো ঢুকে পড়েছে পশ্চিমের ঘরে।
    উঠোনের কোল জুড়ে বেলি ফুলের
    ঝকঝকে হাসি
    কতকগুলো সিঁদুরে আম অপাংক্তেয় ভাবে
    পাঁচিল ঘেষে ঝুলে।
    বৃদ্ধ ব‌ইয়ের তাক নির্জীব হয়ে পড়ে আছে
    প্রত্যেকেই নিজের জায়গায় বসবাস করছে—
    শুধু তুই এখানে উপস্থিত নেই।

    বাবলু
    সমুদ্র পারের দেশে তুই এখন কি করছিস?
    সেই বড় কালো গাড়িটা কিনেছিস নারে?
    ছোটবেলায় কাগজে বিজ্ঞাপন বিভাগে তুই হাঁ করে
    বড় কালো গাড়ির ছবি দেখতিস আর বলতিস—
    ‘মা,বাবা, দেখ বড় হয়ে এই গাড়িটা আমি কিনবো’
    তুই হয়তো এখন দামী গাড়িতে বসে ঝকঝকে
    শহরের রূপ দেখতে দেখতে বাড়ি ফিরছিস—
    আর আমি—আমার এই ভাঙা মাটির বিশ্বকে
    আগলে বসে দিন গুনছি।

    প্রতিদিন যখন উত্তর থেকে দক্ষিণে মাথার উপর দিয়ে ছোট্ট একটা দাগ কেটে যাওয়া শব্দ শুনতে
    পাই-ছুট্টে বেরিয়ে আসি–ভাবি এই প্লেনেই
    হয়তো তুই ফিরে আসছিস।

    স্মৃতির পথে আজ একটু বেশিই হাঁটছি বোধ হয়।
    এক দূর্গা ষষ্ঠীর সকালে আমার সিঁদুর
    চুরি হয়েছিল।
    তুই তখন হাঁটি হাঁটি পায়ে উঠোনে জল ফেলে
    কাদা মেখে ঘুরে বেড়াতিস।
    সেদিন তোর ঠাম্মা বুকে পাথর চাপিয়ে ধবধবে
    শাঁখা গুড়িয়ে দিয়েছিল আর বলেছিল–‘ব‌উমা
    বাবলুকে যে মানুষ করতে হবে।’

    পেটে দাউ দাউ খিদের আগুন জড়িয়ে তোর বড় হয়ে ওঠার স্বপ্নে ঘুমিয়ে পড়তো আমার
    প্রতিদিন।
    তোর শরীরের একবিন্দু রক্ত ক্ষুধার্ত মশা নিজের
    জঠরে যাতে না ঢোকাতে পারে সেদিকে কড়া নজর ছিল তোর ঠাম্মার।
    বড় ভালোবাসতো তোকে।
    আষাঢ়ের ব্যাঙ ডাকা রাতে তুমুল বৃষ্টি মাথায়
    মোড়ের চা দোকানে তোর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতো প্রতি বুধবার।

    কি আনন্দ সেদিন হয়েছিল কি বলবো
    মেসোর চায়ের দোকানে খবরের কাগজে
    বাবলু তোর পাতা জোড়া ছবি!
    সবাই–সবাই অনেক স্বপ্ন দেখার আশ্বাস দিয়েছিল।
    সেই স্বপ্নগুলো আজ দল বেঁধে ব্যঙ্গ করে চলেছে
    ঘর জুড়ে।

    এখনও মনে পড়ে,
    ভাঙা ভাঙা মেঘ ঢাকা ভোর রাতে তুই উড়ে
    গিয়েছিলি ওই দূর দেশে।
    দম ফেটে যাচ্ছিলো তাও বুক বেঁধে তোকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।
    আর ফিরিস নি,ত্রিশটি বছর ধরে প্রতি পাঁচ’ই জ্যোষ্ঠ রাতে বুকটা নতুন ভাবে মোচড়
    দিয়ে ওঠে।

    বুড়ি ঠাকুমা মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে
    পাংশু ঠোঁটে উচ্চারণ করে গেছে—বা–আ–ব–লু–উ
    উঃ, সে কি কষ্ট, প্রাণকে শেষ চেষ্টা করে আটকাতে
    চেষ্টা করছিল আমার নতুন মা,যাকে বিয়ের পর
    থেকে নতুন মা বলে এসেছি—তোর ঠাম্মা।

    কখন যে চাঁদ মুখ ঢেকেছে বুঝতে পারিনি,
    ঝড় উঠেছে—-ছমছমে বৃষ্টির শব্দে কেঁপে উঠছি,
    ঘরের চালে নিদারুণ কান্নায় আছড়ে পড়ছে শিরিষের ডাল।
    মনে পড়ে তোর? কত ঝড়ের রাতে বিদ্যুতের
    আলোয় তুই কেঁদে ফেলতিস।

    কতদিন আর ভিজে স্মৃতি আগলে অন্ধকারে
    একা বসে থাকব বলতে পারিস?
    কেউ পাশে নেই–আমি যে এখন বৃদ্ধা ন‌ই
    তোর মতো শিশু হয়ে গেছি রে,
    একলা ঘরে বড় ভয় করে বাবলু, বড় ভয় করে।

  • কবিতা

    তারপর না হয়…

    তারপর না হয়…
    – রাখী সরদার

     

     

    এই সেদিন‌ও শান্ত স্নিগ্ধ
    অথচ আজ …
    আজ অষ্টমীর সকাল করুণ হয়ে এসেছে
    তোমার মুখর কবিতা ভীষণ একা
    বিনা যুদ্ধে সময়ের কাছে
    আত্ম সমর্পণ করতে হবে জানি
    তা বলে এত তাড়াতাড়ি?
    জীবন যেন সবচেয়ে অসমাপ্ত
    অসম্পূর্ণ বলে মনে হল ।
    মনে হল তুমি অন্য বাড়ির দিকে
    হেঁটে গেলে।
    ঠাণ্ডা ছায়া তোমাকে সাথে নিয়ে
    আড়াল অন্ধকারে ডুব দিল,
    আর কটাদিন
    তারাদের ধুকপুক অনুভব
    করতে পারতে
    তারপর না হয়…

  • কবিতা

    অহল্যা তুমিও!

    অহল্যা তুমিও!

    -রাখী সরদার

     

     

    অহল্যা তুমিও!
    তুমিও পুরুষের মাংসাশী দাঁতের শিকার!
    তোমাকেও নড়বড়ে জটিল সমাজের সামনে
    দ্বিচারিতার কাদা মেখে যুগ যুগ
    ধরে পাথর হয়ে থাকতে হলো!

    হায়রে পুরুষ! হাজার হাজার বছর পূর্ব থেকে
    আজ পর্যন্ত শুধুমাত্র নারীর জন্যই
    পৈশাচিক যন্ত্রণার অলংকার স্তরে
    স্তরে সাজিয়ে রেখেছো?

    কখনো জনক দুহিতাকে
    জগত সংসারের সামনে সতীত্বের অগ্নি পরীক্ষায়
    পুড়তে হয়,কখনো বা পৃথিবী শ্রেষ্ঠ কৌরব
    রাজসভায় বীর পুরুষদের ছাইচাপা লোলুপ
    দৃষ্টির সামনে অসূর্য্যস্পর্শা কৃষ্ণাকে
    বস্ত্রহীন হতে বাধ্য করা হয়।
    ব্যাথায় ক্লান্ত, শ্রীরাধাকে রঙ মেখে হোলি উৎসবের
    নামে রক্তাক্ত শরীর ঢাকতে হয়।

    কেন? কেন বলতে পারো?

    ঋষি গৌতম নাকি সিদ্ধ পুরুষ ছিলেন?
    কোন আধারে শ্রেষ্ঠ তিনি?
    পতিব্রতা স্ত্রীর ভালোবাসা, ব্যাথা, বেদনা ,যন্ত্রণা
    কোনদিনই নিজ হৃদয়ের মর্মমূলে
    উপলব্ধি করতে পারেননি।
    তিনি তো মহাজ্ঞানী ছিলেন, তাহলে কেন?কেন
    তিনি কপট ইন্দ্রের কুৎসিত মনোভাবের কথা
    পূর্বেই জানতে পারেননি?
    ধ্যানবলে প্রকৃত সত্য জেনেও ঋষি অহংবোধে
    নিরপরাধ নারীকে শাপ দিলেন।
    অভিশাপ না দিলে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী মানুষের
    শিরোপা পাবেন না যে।

    তিনশো বছর ধরে কুসুম কোমল নারী দেহ
    পাথর হয়ে শুদ্ধ অশুদ্ধের অঙ্ক কষে গেছে ,
    অথচ জগতে ধর্ষণ প্রথার সূচনা করেও
    সর্বশ্রেষ্ট রাজ পদের অধীশ্বর রূপে
    দিব্যি ভোগ-সম্ভোগের খেলায় মেতে
    র‌ইলেন দেবরাজ ইন্দ্র।
    তোমরা বলবে কেন ইন্দ্র ও তো অভিশাপ গ্রস্হ ছিলেন,
    হ্যাঁ, অভিশাপ তাঁকেও দেওয়া হয়েছিল,
    তবে মূক,বধির, পাথর হয়ে তাঁকে
    যুগ যুগ কাটাতে হয়নি।

    অহল্যা তোমাকে ধরণীর
    গভীর তলে কতকাল নিশ্চুপ হয়ে থাকতে হয়েছে,
    সবুজ ঘাস,শরতের আলো,পাখির কূজন,বৃষ্টির রঙ,বাতাসের গন্ধ—এই সব কিছু মাতাল ছোঁয়া
    থেকে দূরে সরে অন্ধকার মাটির গোপন
    কোল জুড়ে নিস্তব্ধ ভাবে শুয়ে থাকতে হয়েছে।
    প্রতিটি বসন্ত পাথরের গায়ে মাথা কুড়ে মরেছে বারংবার।
    তোমার বুক ফেটে গেছে যন্ত্রণায়, তোমার ওষ্ঠ
    থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্তস্রোত বয়ে গেছে কতদিন।
    তোমার হৃদয় প্রেমিক স্পর্শহীন ভাবে
    অনূর্বরা থেকেছে দীর্ঘকাল।
    কেউ কোনদিন তার খো়ঁজ রাখেনি।

    পুরুষের লালসার আগুনে তোমার শরীরে যে
    অশুচিতার ফোস্কা পড়েগিয়েছিল —-সেই নষ্ট
    গন্ধের আকর্ষনে যন্ত্রণার পোকা দিনরাত
    শরীরে নড়ে চড়ে বেড়িয়েছে।
    তুমি কষ্ট পেয়েছ,চিৎকার করে কদর্য কীটগুলোকে
    দুহাত দিয়ে সরাতে চেয়েছো,আঁচল
    দিয়ে শরীর ঢাকতে চেয়েছো—পারোনি–
    তুমি যে পাষাণী অহল্যা।

    পুরুষ তোমার কাছে–নারী হলো কামনা নিবৃত্তির
    মাংস পিণ্ড,তোমার কাছে নারীর অর্থ–ভোগ্যবস্তু
    নারী মানে সর্বকালের দাসী।
    যদি এতোই নারীর ওপর তোমাদের অধিকার—
    তাহলে নারীর সম্ভ্রম রক্ষার দায়িত্বে এত গফিলতি কেন?

    শিশুর মতো নিস্পাপ অহল্যা এতবছর পাথর
    হয়েছিলো,ঋষি গৌতম তোমার মধ্যে কি
    এতটুকু অনুশোচনা জেগেছিল নিজ পত্নীর জন্য?
    যদি তোমাকে তিনশো নয় মাত্র তিনদিন মমি
    করে রাখা হত তাহলে হয়তো অনুভব করতে পারতে অন্ধকারে অর্ধমৃত ভাবে বেঁচে থাকার জ্বালা।

    শ্যামবর্ণ পুরুষের পদস্পর্শে যখনই তন্বী অহল্যা
    প্রাণ ফিরে পেলে গৌতম তুমি গদ গদ
    হয়ে পূর্ণ যৌবনা নারীর হাত ধরে
    নিয়ে গেলে পর্ণ কুটিরে।
    শুদ্ধমতি নারীকে নূতন ভাবে শুরু করতে হল
    পুরুষের পদ সেবা,দেহ সেবা।
    তোমার বুকে যে বছর বছর কামনার আগুন জ্বলে চলেছে।
    তা তো স্নিগ্ধময়ী রমনীকেই প্রশমিত করতে হবে।

    অহল্যা তোমার হয়ে সমগ্র নারীর
    প্রশ্ন এটা গলিত সমাজের কাছে—-
    যুগ যুগ ধরে ভারতবর্ষের নারী আর কত অবমাননার শিকার হবে?
    কতদিন পুরুষ তোমরা পিতৃতান্ত্রিক
    সমাজের দোহাই দিয়ে তোমাদেরই জননী, জায়া,
    ভগিনী, প্রেমিকার খয়েরী হৃদয়কে নিষ্পেষিত করে যাবে? কতকাল রমণী ক্ষত, যন্ত্রণা নিয়ে স্তব্ধ হয়ে
    থাকবে? কত যুগ ধরে নারী তার কবোষ্ণ মনকে
    পাথরে পরিণত করবে?
    কতবছর আর নারীকে নিজ লজ্জা বাঁচাতে
    চিতার লকলকে আগুনকে বেছে নিতে হবে?

    এ প্রশ্নের উত্তর স্বরূপ একদিন
    পৃথিবীতে যুদ্ধ হবে—মহাযুদ্ধ–নারী পুরুষের যুদ্ধ,
    নারীর অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ।
    দেখতে পাচ্ছো কি? পূব আকাশের সূর্য দিন দিন
    গাঢ় রক্তবর্ণ ধারণ করে এগিয়ে আসছে।

    সেই মহাক্ষণ প্রায় আগত
    সেদিন সমস্ত অহল্যারা গর্জে উঠবে, পদ্মচোখ
    হয়ে উঠবে রক্তচক্ষু,
    রামায়ণ,মহাভারত নতুন ভাবে রচিত হবে।

    মহাকাব্যের পাতায় পাতায় থাকবে শুধুমাত্র
    নারীর বিজয়গাথার কাহিনী।

  • কবিতা

    আজ‌ও পঞ্চমী

    আজ‌ও পঞ্চমী
    – রাখী সরদার

    সেই যে যেবার
    পঞ্চমীতে লাল শাড়িটি পরেছিলে
    কোঁকড়ানো চুলে নেমে এসেছিলো উসখুসে মেঘ
    ভুরুতে লুকিয়ে ছিল তৃতীয়ার সন্ধ্যা
    আমার মধ্যে আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে চলেছিল।

    আজ আবার পঞ্চমী
    কেমোথেরাপিতে পুঁছে পুঁছে গেছে মেঘচুল
    দুই ভ্রুর নাচন গেছে থেমে
    তবুও তো কাশফুলে ঢলে পড়ে চাঁদ

    বর্ণালী ভালোলাগা
    ধবধবে লাল শাড়িতে চিকমিক করছে
    তোমার ত্বক ।

    ছায়াপথে ঢেউ ওঠে
    চারদিক চন্দন কাঠের গন্ধ
    গলায় শব্দ আটকে
    কখন যে আঙুল গলে উড়ে গেছো…

    আজও পঞ্চমী ,বিপন্ন প্রেমিকের মহা পঞ্চমী…

  • কবিতা

    নাভিঝিল

    নাভিঝিল
    -রাখী সরদার

     

     

    এখন নাভিঝিলে ডুব মারো

    ডুব, ডুব, কোঁকড়ানো সুগন্ধি ডুব

    তারপর বলবো, সবটাই অপ্রয়োজনীয়
    নাকি আনমনা বৃষ্টি ছলাৎ।

    ঝিলভরা কাঁচরঙা জল, মাঝেমধ্যে
    সবুজ ঝাঁঝি

    দস্যুর মতো গোড়ালিতে চুমু খায়
    খয়েরি শ্যাওলা

    নিপুণ স্রোতের টান গভীর থেকে গভীর তর

    দুজনে এগিয়ে যাই

    তারপর…
    পথ আটকে হাজার জলের চাঙড়

    ঘন নিশ্বাসের একতারা বাজলো না

    ফিরে আসি
    পাতলা ঢেউয়ের মতো পড়ে থাকে নাভিঝিল
    পড়ে থাকে মেঠো আকাশের নীচে…

  • কবিতা

    ছ্যাঁকছ্যাঁকে দৃশ্য

    ছ্যাঁকছ্যাঁকে দৃশ্য
    -রাখী সরদার

    একসারি ছোট্ট পিঁপড়ে
    সারি দিয়ে চলেছে,
    মুখে কারো নিজের ডিম
    কারো বা বাদলপোকার ঠ্যাং
    কিছুজন,লাল টুকটুকে
    রক্তের ডেলা নিয়ে চলেছে
    কোথা থেকে পেল!

    এগিয়ে যাই,এগিয়ে যাই…
    সঙ্কেতময় গাঢ় লতার বন
    ময়দার লেচির মতো
    পড়ে আছে ভ্রুণ ।

    কার? কে ফেলে গেছে? কেন?
    উত্তর নেই
    গাছেরা কিছুক্ষণ স্তব্ধ
    আবার পাতা ওড়াউড়ি,
    চোখ চাওয়াচাওয়ি

    প্রকাণ্ড সূর্য মাথার উপর
    নড়ে ওঠে লালচে ভ্রুণ
    পুড়ে যাচ্ছে দেহ
    ককিয়ে ওঠে
    একটু ছায়া দাও…

You cannot copy content of this page