• কবিতা

    মনের কথা

    মনের কথা
    – রুদ্র প্রসাদ

     

     

    আজব এই দুনিয়াটারই আজগুবি খামখেয়ালে,
    আজকের চারপাশে কত কিছুই তো ঘটে চলে!
    আঙুলের একটু আলতো ছোঁয়ায় খুলছে দুয়ার,
    সভ্যতায় বহমান প্রাণহীন আলোড়নের জোয়ার ।
    জাদুকাঠির ঐ পরশে সচল হয় আরও কত কি!
    আপাত স্তব্ধ মনের বন্ধ আগল তাতে খোলে কি?
    সাদা চোখে যায় দেখা একের সাথে অন্যের মিল,
    ভেতরে ভেতরে বহুরূপী সবই, গঠনে তো গরমিল!
    হঠাৎ আসা দমকা হাওয়ায়, ভাবল একলা মন,
    কিসের ব্যথায় মলিনতা এল, হ’লটা কি এখন!
    ছেঁড়া খোঁড়া কিছু স্মৃতি আবছায়ায় এলোমেলো,
    সুখ-দুঃখের কথাগুলো যে ভাবতেই লাগে ভালো ।
    পেরিয়ে আসা সময়ের ঝুলিতেই জমা কত কিছু,
    কোলাজে আঁকা ছবিই চলতে থাকে আগুপিছু ;
    কেন, কিসের অপেক্ষা, নিবেদন যেন কোনখানে?
    কখন যে কাকে এনে, কেমনে ধরে বসায় প্রাণে!
    কার জন্য নিজেরে বিলায় নিজেকে দিয়ে ফাঁকি,
    মনস্তত্ত্ব বেজায় জটিল, সেকি যা তা কথা না কি!
    খাঁচায় বন্দি মনের পাখিটা পাখনা তখনই মেলে,
    প্রাণের ছোঁয়া হৃদসায়রে একটু দোলা দিয়ে গেলে ।
    তখনই খুলে ঝাঁপি সোল্লাসে, অবিরাম কথা কয়,
    হৃদয়ের আকুতি যখন তার সাথে মিলেমিশে রয় ;
    উপস্থিতির জানানে আসে নিয়ে মুগ্ধতার আলো,
    অতীত ভুলে এক লহমায় মুছে দিতে চায় কালো!
    তিল তিল বুদ্বুদে গড়া, বিশাল ইমারত স্বপ্নচয়নে,
    তিলোত্তমার কল্লোলিনী সাজ কল্পিত বাস্তবায়নে!
    কাঠিন্য মেখেই হোক না মনের গন্তব্য দুর্গম যত,
    ভিন্নতার আস্বাদনেই জীবন উপভোগ্য হবে তত ।
    গোলকধাঁধায় হারিয়ে যদি পথের দিশা পেতে চায়,
    সঞ্চরণে আঁকিবুকি কাটে, লেখাজোখা নিরালায় ;
    মুক্ত মনের বোঝাপড়ায়, অবশেষে হারায় সংশয়,
    দোসরের অপেক্ষায় মন একাকীই পথ চেয়ে রয় ।
    নূতনেরই দিকে ধীর লয়ে ধায় মন, অগ্রণী সরণে,
    উদ্বেলিত উচ্ছ্বাসে কম্পিত হয় সমাদৃত আভরণে ;
    চেয়ে থাকে অনুরাগী মনটা রাতের আকাশ পানে,
    মনের যে কি আকাঙ্ক্ষা, তা শুধু একা মনই জানে ।।

  • কবিতা

    অশান্ত সময়

    অশান্ত সময়
    -রুদ্র প্রসাদ

     

     

    অশান্ত সবই, সবেগে ধাবমান সময়ের ব্যস্ত গতি,
    জীবনের বাতি নেভালো নদীর পাগল পারা মতি ;
    কলের পুতুলের মতো ছোটে সব এদিক-ওদিকে,
    অস্তিত্ব বজায়ের লড়াইয়ে সবই শূন্য দিগ্বিদিকে!
    কালের নিয়মে সবাই তো হয়েই গিয়েছে যান্ত্রিক,
    প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে মানুষ হ’ল দানবিক!
    থাকবে কেমনে অস্তিত্ব টিকে আজকের নিরিখে?
    সমবিব্যহারে না একান্তেই, সঙ্গিন এই তারিখে…!
    অকারণ আস্ফালনে কদর্য ক্ষমতা প্রদর্শন চলে,
    মানবতার রবি হতাশার আবহেই গেল অস্তাচলে!
    স্বার্থান্বেষী মাংসাশীরা আড়ালে মুখ মুছতে থাকে,
    সদা অহিংস বৈষ্ণব সাজে ঠকাতে চাইছে কাকে?
    কর্মহীন কতশত যুবা হচ্ছে দিশাহারা প্রতিনিয়ত,
    আত্মহননে মুক্তির পথ খোঁজে হেরে যাওয়া যত ;
    মাতৃজঠরে হিংসার বলী শৈশবের অপাপবিদ্ধতা,
    মরম শরমহীন, অনুতাপে পরিহাসে দগ্ধ মুগ্ধতা ।
    অস্থিরতা মেখে আলোচনায় মুখরিত কোলাহল,
    ধ্বংস মুখে দাঁড়িয়ে বিবেকের অন্তহীন দোলাচল ;
    শতেক ওঠা পড়ার ফাঁকে মেলে মহাকালের সাজা,
    তারই মাঝে অলীকে বিভোর, সবাই উলঙ্গ রাজা ।
    তবুও চাতকের মতোই চাওয়া এক পশলা বৃষ্টির,
    অলিন্দে চেতনা জাগিয়ে ধোঁয়াশা কাটবে দৃষ্টির ;
    শীতল উষ্ণতা নিয়েই প্রশান্ত হবে অখণ্ড চরাচর,
    ধন্য হবে মানব জনম, হরষে বিকশিত আপামর ।
    বসে আশা ভাবে আনমনে, লাগবে হাওয়া পালে,
    অবগুণ্ঠন সরালেই মিলবে দেখা দিকচক্রবালে ;
    সাজে রেঙে ধরা দিয়ে যাবে তার ঐ আবর্তনীতে,
    অকিঞ্চনে সমাহিত আগামী, বদ্ধ সুদৃঢ়বেষ্টনীতে ।
    আজও কল্পলোকে শ্রুতিতে অশ্রুত বেহাগ রাগিণী,
    অসুখে সুখের শীৎকার খোঁজে কাঙ্খিত আগমনী ;
    কূপমণ্ডূকসম অর্বাচীনের হাহাকারে প্রশ্ন যত রয়,
    বিশ্বাসেই বৈতরণী পার হবে চপলমতি এই সময় ।
    সঞ্চারিত আবাহনে নিরুদ্বেগ মুহূর্ত হবে সমাদৃতা,
    সজ্জিত অনুভূতির স্পর্শেই সুঠাম হবে সমাগতা ;
    স্থবিরতা আসবে নেমে নবোদয়ের প্রতীকী সাজে,
    সোচ্চারে নীরবে অপেক্ষারই মন্দ্রিত ধ্বনি বাজে।।

  • কবিতা

    আবহে হতাশাতন্ত্র

    আবহে হতাশাতন্ত্র
    -রুদ্র প্রসাদ

     

     

    ধিকিধিকি, ঠিক যেন ছাইচাপা তুষের আগুনে,
    দহন জ্বালায় জর্জরিত, ক্ষতবিক্ষত প্রতিক্ষণে!
    উদ্দেশ্যহীনতার দুঃসহযাত্রা চলছে বিরামহীন,
    ছায়াবাজীর নিষ্ফল আক্রোশে সবই কায়াহীন!

     

    চাহিদার অন্ত খোঁজা, জবাবে, নাই আর নাই ;
    অনন্ত বাসনা পূরণের হদিস কোথা গেলে পাই?
    উদ্যমে ভর করেই হতে চেয়েছি এক কর্মযোগী,
    কর্মাভাবেই অলস মস্তিষ্ক হয়েছে হতাশাভোগী ।

     

    আবাদী উদ্যোগে ফলাতে চাই সোনার ফসল,
    সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে চাষের জমিও বিরল!
    গ্রাসাচ্ছাদনের কারণেই দরকার একটা চাকরী,
    সুযোগ মেলা ভার, খুঁটি ষোলো আনা দরকারী!

     

    আতুর মন হাহাকার তোলে ‘চাই আজ বাঁচতে’;
    সাধ অনেক সাধ্যবহুল, উপায়ই নাই সাজতে!
    সুবর্ণ এই গোলকধামেই হয়তো আছে ভরা সব,
    কানাগলির ঠোক্কর খেয়ে প্রায় হতে চললাম শব!

     

    অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে চাই, কিন্তু নেই ছাড়পত্র,
    পথ হারিয়ে, আজ উপরে খুঁজেই ফিরছি ছত্র ।
    নীরবতা কাঁপিয়ে উঠে আসতে চায় আর্তনাদ,
    কিন্তু কিভাবে সোচ্চার হবে ভাষাহীন প্রতিবাদ?

     

    সংঘবদ্ধ মিছিলে তুলতে চাই সমবেত অনুরণন,
    হায়! ন্যায়ালয় কেড়ে নিয়েছে তার অনুমোদন!
    শান্তির ধর্মঘটে সরব হওয়াও সাযুজ্যে রয়েছে,
    সেখানেও বাধা আইনের, সত্তাই বিকিয়ে গেছে ।

     

    ছড়িয়ে আপন সৌরভ চাই আজ ভালোবাসতে,
    প্রেমের আধুনিকীকরণ সংজ্ঞা চায় বদলাতে!
    জীবনের স্মৃতি সাজিয়ে চাই বাঁচতে সুস্থভাবে,
    অঙ্কুরেই বিনষ্ট সম্ভাবনা, পরিবেশেরই অভাবে!

     

    সখেদে নিরাশা বেছে নেওয়ার পথই হল ‘মরণ’,
    নিষ্পেষিত জীবন রেখা করেছে সে ‘সুখ’ হরণ!
    জমে থাকা নিরাশাগুলো ফেটে পড়তে চায় সব,
    ইচ্ছে করে হয়ে উঠি ভয়ানক, বিধ্বংসী দানব ।

     

    তাই হতাশা ছাড়তে আজ সকলকে দেই ডাক,
    ‘একটি বার এসো, একই সাথে গর্জে ওঠা যাক ;
    পর্যাপ্ত বারুদ নিজের ভেতরেই আছে মনে কর,
    কলিজায় ভরে দম, এগিয়ে এসো, শপথ কর’।

     

    চেতনায় জাগ্রত মানবিকতার রঙ মুঠোয় ভরে,
    ছড়িয়ে দেব সকলের মাঝে উদারতা অকাতরে ;
    স্বচ্ছ দৃষ্টি সজাগ রাখব জীবনের প্রতিটি বাঁকে,
    আর হারাব না পথ, জাত-ধর্মের নোংরা পাঁকে ।

     

    করব যে সবকিছুরই যুক্তিবাদী চুলচেরা বিচার,
    গুঁড়িয়েই দেব, আছে যত, জীর্ণ সব কু-আচার ;
    ক্ষতি নেই যদি তাতে সমাজ নাম দেয় বেয়াড়া,
    তবুও ডিঙিয়ে যাব সমস্ত প্রাদেশিকতার বেড়া ।

     

    সকলকে করে আপন, ভাবি সব বৈরিতা ছেড়ে,
    হাতে হাত ধরে ধীরে ধীরে সমষ্টিতে উঠব বেড়ে ;
    নিঃস্বার্থ নিয়োজনে সেবাধর্মেই সবাই হব ব্রতী,
    উজ্জ্বলতর আশার আশায় সবে হবে মেহনতী ।

     

    দাবানলের মতোই জ্বলে উঠবে আগুনে বিপ্লব,
    বিত্ত-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই হয়ে উঠবে কুশীলব ;
    প্রসারতার ইমারতে ভিত্তি, প্রতিটি হৃদয় মাঝে,
    নব যুগ সূচনার আহ্বানের মন্দ্রিত ধ্বনি বাজে ।

     

    জ্ঞানচৈতন্য উন্মেষ সাথে হবে আঁধার দূরীভূত,
    আশার সঞ্চারে সমাহিত প্রেম, হতাশা পরাভূত ;
    নবীকরণে পুনরুজ্জীবিত মন রইবে নাকো যন্ত্র,
    বিদায়ীক্ষণ সূচীত? কাটবে আবহের হতাশাতন্ত্র?

  • কবিতা

    শুধু এক পরিচয়

    শুধু এক পরিচয়
    -রুদ্র প্রসাদ

    অখণ্ড এ “ভারতভূমি”……
    খণ্ডে খণ্ডে প্রদেশ ভাগ,
    শতাধিক কোটি সন্তান তার,
    রন্ধ্রে রন্ধ্রে হিংসা – রাগ !
    ভিন্ন ভিন্ন ধর্মবিশ্বাস মাঝে ;
    ছিটে ফোঁটা জাত বিচার,
    ভিন্ন ভাষা-ভাষীর সংস্কৃতিতে,
    গরমিলেরই মোতিহার !!!
    হরেক রীতির হরেক মানুষ,
    বিবিধ নিয়ম, বিবিধ বাস !
    কষ্টে-সৃষ্টে দিন কেটে যায়,
    মনে তবুও উচ্চ আশ !!!
    ঘরোয়া কোন্দল লেগেই আছে,
    গুলিগোলারও বিরাম নেই ;
    নেতৃবর্গের মুখে ফাঁকা বুলি ছাড়া,
    কাজের কোনও বালাই নেই ।
    যতই থাক হানাহানি, রেষারেষি,
    যতই বা থাক হিংসা – দ্বেষ ;
    সবাই জানি, এই আমার জন্মভূমি,
    “ভারতবর্ষ” আমাদের দেশ ।
    এইখানেতেই ঐক্য মোদের,
    এক সাথেতেই সবাই হাসি ;
    বিশ্বমাঝে এক পরিচয় —
    আমরা শুধুই “ভারতবাসী” ।

  • কবিতা

    তুমি ছাড়া নাই…!!!

    তুমি ছাড়া নাই…!!!
    -রুদ্র প্রসাদ

     

     

    প্রণমি সদা তোমারে বিশ্বকবি, হে গুরুবর,
    তোমারই অখণ্ড সৃষ্টসত্তায় ব্যাপ্ত চরাচর ।
    সচ্চিদানন্দ ধ্বনি অনন্ত, সহস্রারই মাঝে,
    সে মহা ওঙ্কার স্বরূপ, তাহাতেই বিরাজে ;
    ব্যথাহত দেখে সেথা ব্যথাবিজয়ের প্রেরণা,
    মৃত্যুপথযাত্রীর প্রাপ্তি মৃত্যুঞ্জয়ী সান্ত্বনা ;
    দার্শনিকের আয় প্রকৃত সত্যের সুলুকসন্ধান,
    রাজনীতিকের পাথেয় হয় নির্ভুল বিধান ।
    দুঃখ-দ্বন্দ্বময় নৈরাশ্যপীড়িত এ সময় যত,
    তোমাতেই অবগাহনে স্বস্তি মিলেছে সতত ।
    ব্যক্ত-অব্যক্ত স্ব-কার ফিরে ফিরে খুঁজে,
    সাধনেই জ্ঞানের চেতনারা মূর্ত হয় বুঝে ;
    তুমি স্রষ্টা, তোমার সৃষ্টি স্থিতি-লয়কারী,
    গুণী-নির্গুণে চিন্তনে তুমিই চিরঅধিকারী ।
    তোমাতেই শুরু জানি, তুমি যে অশেষ…;
    অন্তরের অন্তঃস্তলে স্থির, প্রজ্ঞা নির্নিমেষ ।
    প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অভূতপূর্ব মিল,
    নবোন্মেষিত স্বদেশীকতায় একাকার দিল ।
    সদাজাগ্রত কর্ম তোমার যেন অতন্দ্রপ্রহরী,
    জ্যোতির্ময় সাধনায় তুমিই আনন্দ লহরী ।
    সীমিত জীবনকালের যে দিকেই তাকাই,
    তোমারই জয়গান কবিগুরু, তুমি ছাড়া নাই ।
    অনিত্যের মাঝে তোমার নিত্যলীলা চলে,
    সঙ্কটকালে বরাভয় পাই তুমি রয়েছ বলে ;
    নিরানন্দ মাঝে তুমিই শাশ্বত, সদানন্দময়,
    সময়ের করাল ছায়াকে হেলায় করেছ জয় ।
    বাল্মীকী-প্রতিভা থেকে থেকে সোনার তরী,
    পদাবলী ভারে নৈবেদ্যের খেয়া নিয়েছ ভরি ;
    নবজাতক থেকে শেষের কবিতা মধ্যে উধাও,
    চতুরঙ্গে সমুজ্জ্বল, বাদ পড়েনি তো কোথাও ।
    গীতাঞ্জলিতে মৈত্রীর বার্তা সাথে বিশ্বশান্তি,
    নোবেলও কখনও বয়ে আনেনি তব ক্লান্তি !
    কথা ও সুরে মিলে একাকার সঙ্গীত মূর্ছনা,
    আজও মেলে তৃষিত হৃদয়ের তৃপ্ত ব্যঞ্জনা ।
    ভাবে ধরা দিয়েও চিরকাল রয়েছ অধরা…,
    বিক্ষুব্ধ ঝঞ্ঝামাঝে তুমি সমাহিত, নির্বিকারা !
    প্রাদেশিক সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধে করেছ আলাপন,
    রাখি বেঁধে করেছ সৌভ্রাতৃত্বের মানববন্ধন ।
    সকলে তোমারে জানে, চেনে হয়তো কেউ ;
    পরশে আন্দোলিত হৃদসায়রে উদ্বেল ঢেউ ।
    চিরলাঞ্ছিত-ভর্ৎসিত তুমি, তর্কে মেলে নাই,
    ভাস্বর উপস্থিতি সদা রবির কিরণে পাই ।
    পরাভব গ্লানি ভুলিয়ে মনের করায়েছ জয়,
    ক্ষয়িষ্ণু সব মাঝে তুমি তাই অজেয়, অক্ষয় ।

  • কবিতা

    বন্ধু

    বন্ধু
    -রুদ্র প্রসাদ

     

     

    ‘বন্ধুত্ব’ – সেটা আবার কি!!! হয় নাকি আজকের
    দিনে ! যত্তোসব ফালতু, নীতিবাগীশ ফাঁকা বুলির
    কচকচানি স্বার্থের দুনিয়ায় । অর্বাচীন সব বোকা
    বোকা কথাবার্তা, নেই তো সেই রামরাজত্ব এখন,
    আর অযোধ্যাও ; আছে তো খালি শুধু আঁতেলামি
    আর আখের গোছানোর ধান্দা । মানবিকতার যে
    বড়ই অভাব ! মানুষের মুখোশপরা আপাতনিরীহ,
    অমানুষ আর বহু-রূপীর ভিড়ে খুঁজে ফেরে এই
    বান্দা, যদি পাওয়া যায়, একজন প্রকৃত হৃদয়বান,
    সাথীসুলভ সঙ্গী । সত্যিকারের সুহৃদও তেমনই
    একজন, ঠিক যেন মনের মত দোসর, যার সাথে
    কখনোসখনো যদিও সামান্য কিছু মতের অমিল
    হয়, তবুও, একদম মনের কাছেই থাকবে চিরদিন,
    পাশে থেকে দেখাবে আশার আলো, জুগিয়ে যাবে
    সাহস, সাথে দিয়ে যাবে সীমাহীন প্রেরণা । বন্ধুর
    মানে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সমান সমান ভাগ ।
    বন্ধুত্ব মানে অফুরন্ত ভালোবাসার ভাণ্ডার, সাথে
    অনেকখানি সহমর্মিতা আর সামান্য একটুখানি
    রাগ । বন্ধু মানে ‘আমি তো আছি’র আশ্বাস আর
    একাকীত্বের মুক্তি । বন্ধুত্ব মানে জীবনের সঠিক
    দর্শন – পাথেয় – যুক্তি । অন্ধকারের বুকটা চিরে
    আলোর রেখা যেমন করে পথ দেখায়, বহমান,
    চঞ্চল স্রোতোস্বিনী জলধারা ঠিক যেমন করে সব
    কলুষতা – মলিনতা ধুইয়ে দেয়, প্রকৃত বান্ধবের
    সাহচর্য ঠিক তেমনই । তাই তো বলি, ‘সত্যিকারের
    প্রাণের বন্ধু, সে তো ভাস্বর সবসময়েই । বন্ধনের
    দৃঢ়ত্বের সীলমোহরে বন্ধুত্বের স্বাক্ষর, সদা উজ্জ্বল,
    মনের মণিকোঠায় থাকে শাশ্বত অমলিন চিরকাল’ ।।

  • কবিতা

    আত্মকথন

    আত্মকথন
    -রুদ্র প্রসাদ

    কেউকেটা নই, অতিসাধারণ আমার পিতা,
    মা দীক্ষাগুরু, পরিচয়ে জনমদুঃখিনী সীতা ।
    ঘরহীন ঘরামী আমি, সাজাই না বলা গাথা,
    যেমন কালের হাতে শুকনো এক ঝরা পাতা ।
    দর্শনে সুখ লভী মানুষের মুখের অমলিন হাসি,
    চিন্তনে দুঃখী হই, আগামীকে যে ভালোবাসি ।
    অবক্ষয়ের সমাজ আজ ভীষণ বেদনাদায়ক,
    মানবতার সুর বিলিয়ে ফিরেই হয়েছি গায়ক ।
    অজানার অচেনা পথই যে আমার আলিঙ্গন,
    অভিসারে সমাজের জাত-ধর্ম-শ্রেণীর বর্জন ।
    জীবন প্রেমের জয়গানে হোক সোচ্চার গগন,
    হৃদয়ের পোষণ শুধুমাত্র সুদৃঢ় মানব মনন ।
    উচ্চারণে যে আমার নতুনের উদাত্ত আবাহন,
    দূষণহীন ভবিসভ্যতার ভরসাই আমার ভাষণ ।
    পরিচয়ে আমি তোমাদেরই সামান্য এক সাথী,
    সাকিন নেই, বাসস্থান যে সারা প্রেমময় পৃথ্বী ।।

  • কবিতা

    বাংলার সমাজ

    বাংলার সমাজ
    -রুদ্র প্রসাদ

     

     

    মিথ্যার পসরা সাজিয়ে উন্মত্তলীলায়,
    মেতে উঠেছে সমাজ । পরিবেশ ভরে
    গেছে ঠগ, জোচ্চোর, প্রবঞ্চক আর
    বদমাশের দলে । অলি-গলি পরিপূর্ণ
    জুয়ার আড্ডায় ; মদের ঠেকের গন্ধ,
    এখন আর বিশ্রী লাগে না । লাস্যময়ী
    ললনার বেহায়াপনায়, এই সভ্যতার
    উন্নতির সোপান অস্তাচলগামী, শৈশব
    শুধুমাত্র ছাপার কালো হরফেই বাঁচে,
    তথাকথিত পুরুষমানুষদের ব্যবহারে,
    পথের কুকুরও লজ্জায় পথ ছাড়ে,
    ধর্ষণই যেন আদর্শ পৌরুষের স্বীকৃতি !
    হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছে প্রত্যেকটা
    সাধারন মানুষ, ‘আজ তাদের দুর্দ্দিন’ ।
    মাতাল, চরিত্রহীন, আঁধারের পথিক,
    খুনী – এরাই আজকের আমাদের এই
    সমাজের ধারক-বাহক, ভাগ্যবিধাতা,
    মধ্যমণি । প্রশাসন ? সেও তো আজ
    প্রহসন বলেই খ্যাত । তাই তো নির্ভীক,
    স্পষ্টবাদী, ফুটপাত আবাসীরা হয়েছে
    আজ বুর্জ্জোয়া । আজ শোষণ করেই
    কালোবাজারীরা হয়েছে কোটিপতি !
    সর্বহারা, অসহায় শোষিতের মরমীয়া
    নেতা-নেত্রী !!! নেশা-ভাঙের মূল্যটা
    আকাশছোঁয়া হলেও দুধের দাম মাত্র
    সামান্য কয়েকটা টাকা ! জীবনদায়ী
    ঔষধ সাধারণের সাধ্যাতীত ! ব্যাঙের
    ছাতার মতন গজানো আধুনিকতার
    নির্লজ্জ ধ্বজাধারী ম্যাসেজ পার্লারে
    চলে, আজ স্বেচ্ছাচার, অনাচার আর
    ব্যাভিচারের দিন । আগামী প্রজন্মের
    ভবিষ্যৎ ক্রমান্বয়ে ক্ষয়িষ্ণু, ক্ষীণ থেকে
    ক্ষীণতর হয়ে চলেছে আজ মাদকের
    ধোঁয়ায় আর জুয়ার ফেরে । ঘুষ ছাড়া
    কাজ পাওয়া মুশকিল ! ভরণপোষণ
    চালানোই দায় আজ দুর্মূল্য বাজারে ;
    শিক্ষা বর্তমানে মূল্যহীন, ভঙ্গুর দর্শনে
    আজ পঙ্গু মানবতাবাদ, টেবিলের নীচে,
    গোপন বিনিময়েই হয় মূল্য নির্ধারণ !
    যোগ্যতা ? হয় কব্জির জোর, নয়তো
    খুঁটির, নতুবা গ্যাঁটের, এসবই মূলতঃ
    মাপকাঠি, মেধারা নিমজ্জিত, ন্যুব্জ
    হতাশার এই আঁধারে ! আজকের এই
    সমাজে গনতন্ত্র কেবলই আভিধানিক,
    স্বৈরতন্ত্র নাম । হিংস্রতা আর বর্বরতা,
    অস্ত্র-শস্ত্র নিত্যসঙ্গী । পৈশাচিকতার
    উন্মাদনায় নিগ্রহ, নৃশংসতা — সবই
    রাজার সেই মহান উদারিকরণ নীতির
    আর এক নাম !!! পশুত্বের কাছে হার
    মেনেছে মমত্ব, ভ্রাতৃত্ববোধ, সম্প্রীতি ।
    কখনও সামান্য, ছোট ঘটনা, কখনও
    অস্ত্র-মিছিল, কখনও কন্ডোম-লাঞ্ছিত
    ত্রিশুল, কখনও বা জাত-ধর্মের নামে
    বজ্জাতি…; বিশৃঙ্খলা সর্বত্র, সর্বস্তরে
    আজ, কি করে বলব, ”এ আমারই
    বাংলা-মা, আমারই বাংলা সমাজ” !!!

  • কবিতা

    অলীক-প্রেম

    অলীক-প্রেম
    -রুদ্র প্রসাদ

     

     

    দিনমানেই চলে অলীকের সন্ধান,
    ভাঙা-গড়ার মাঝেই ধাবমান ;
    ফানুসেরা সব মিথ্যায় বলবান,
    স্বপনে ত্রিভঙ্গে নাচে মন-প্রাণ ।
    চাহিদারা নিত্য পসরা সাজায়,
    কল্পসুখ-শিখা হরষে সেথায় ;
    নিদারুণ প্রেম বেহাগ বাজায়,
    লাজে-আধো প্রস্ফুটিত হায় !
    সবই রঙীন ভালোবাসা কাননে,
    বিলিয়েই যাওয়া এই জনমে ;
    সময় রাখে ছাপ, ক্লিষ্ট আননে,
    প্রেম সত্য-শুদ্ধ, ক্ষত মরমে !
    ভালো রাখার প্রচেষ্টা সামগ্রিক,
    অনুভূতিগুলো সবই ঐচ্ছিক ;
    মানিয়ে মেনে নেওয়া ঐকান্তিক,
    হাস্যে কুশল বিনিময় মৌখিক ।
    বেদনার বিষ প্রোথিত অন্তরে,
    নিস্তেজ শোণিত ক্রমশই ক্ষরে ;
    ক্ষয়িষ্ণু কায়ার পরিণতি অঙ্গারে,
    বিধিলিপি খণ্ডাবে কেমন করে ?
    মানাভিমান সব একাকার দরশনে,
    বাসনারা কেমন অবসন্ন মনে ;
    আত্মা অন্তর্হিত স্বেচ্ছা নির্বাসনে,
    পরজনমেই মিলব তব সনে ।।

  • কবিতা

    ঠিকানার খোঁজে

    ঠিকানার খোঁজে
    -রুদ্র প্রসাদ 

     

     

    এক অশান্ত মন আকুতি নিয়ে কোথা ধায় !
    খুঁজে বেড়াই হেথা হোথা ক্ষণিকের শান্তি,
    আলোকের পিয়াসী মন কেঁদে ফেরে হায়…;
    অচিরেই হয় হতোদ্যম, জোটে শুধুই ভ্রান্তি !
    মেপে নিতে বুভুক্ষু হৃদয়ের ক্ষীণ গভীরতা,
    গেলাম ছুটে উত্তুঙ্গ মহা সাগরের কিনারে ;
    বললে ঢেউ, ‘মনের দুঃখে, নিয়ে নিঃসঙ্গতা,
    বৃথাই আছড়ে মরি এসে জনাকীর্ণ বালুচরে’।
    অপরিণত হৃদয়ের অতলে অসার পরিব্যাপ্ত,
    গেলাম উচ্ছাসে সমাহিত পবনের স্মরণে ;
    সখেদে বলে এলোমেলো বাতাস, ‘আমি তো
    হতাশ, আভূষণহীণতার বরণে আর মননে ।
    তাই কখনও বা নিঃসীম শূন্যতায় চুপ করে,
    আনমনে বয়ে চলি, তখন আমি খুবই শান্ত ;
    কখনও বা ফুঁসে উঠি, ডাকি দুর্দমনীয় স্বরে,
    আক্রোশে মাতাল সবকিছু করি যে অশান্ত’।
    দেখতে ক্রমহ্রাসমান শক্তি, পর্বতের দেশে,
    গেলাম হিমশীতল দুর্নিবার ছুটে চলা স্রোতে,
    ক্ষতবিক্ষত পাথর বলে, ‘পেয়েছি অনায়াসে,
    দৈন্যতা, খর্বতা ডিনামাইটের সবল আঘাতে’।
    জানতে জীবনের গতি, গেলাম ছুটে নদীতে,
    দুঃখী প্রবাহিণী অস্ফুটে বলে কুলুকুলু রবে ;
    ‘উন্নত সভ্যতার ময়লা রোজই জোটে মাথে,
    আবর্জনা দিয়েই দূষিত করে চলেছে সবে ।
    আজ কমে গেছে গভীরতা, সহনের শক্তি,
    রণক্লান্ত আমি স্বীকার করেছি আজ নতি ;
    সবার ভার বুকে নিয়ে কলুষিত, চাই মুক্তি,
    পারছি না আর রাখতে বজায় স্বতঃগতি’।
    দুরুদুরু বুকে সবশেষে গিয়ে মাটিরে শুধাই,
    ‘আছো কি আজও ? ওগো মা, স্নেহময়ী…,
    কবলিত সকলেই, নিরাশা ছাড়া কিছুই নাই,
    অগতির গতি, আশা-ভরসা তুমিই দয়াময়ী…’।
    মাটি বলে, ‘অলক্ষ্যে সবারে নীরবে দেখে চলি,
    মানবতাহীনতার বজ্জাতি আর স্ব – হানাহানি ;
    নগ্ন ধ্বংসাবশেষে জর্জরিত, সব বাসনার বলি,
    আপন সন্তানের রক্তেই সিঞ্চিত হই আপনি’ ।
    নিঃস্তব্ধ আমি বধির হলাম, বাজল মনে ব্যথা,
    মূঢ় আমি সামনে দেখি বুকে নিয়ে গভীর ক্ষত,
    ভয়াল হীনমন্যতা নিষ্পেষিত কি ভীষণ কথা,
    শোনাল আমায় এ ধরণীর ক্ষুদ্র ধূলিকণা যত !
    ভগ্নাতুর হৃদয়ে ব্যাকুল, কূপমণ্ডুকতা নিয়ে…,
    আঁধারের গোলকধাঁধায় খুঁজি মনের ঠিকানা,
    কোথা গেলে শান্তি পাই, সবকিছুর বিনিময়ে ?
    পথ আজও তো রয়ে গেছে অচেনা – অজানা ।
    জলভরা চোখে দেখি, বসেছে তারার মেলা,
    অসীম, অনন্ত আকাশ বলছে সেথায় সহাস্যে,
    ‘হতাশায় কাজ কি ? মিছে সব মায়ার খেলা,
    চলছে বিবেকহীন অনাচার-রাজ প্রকাশ্যে ।
    আত্মসংযমী, নির্ভীক, স্থিতপ্রাজ্ঞ হও অশেষ,
    মনটাকে বড় কর, বিলিয়ে দাও পার্থিব যত,
    সামান্য এ জীবন শূন্য হতে শুরু, শূন্যেই শেষ,
    সবই হবে একদিন পঞ্চভূতে লীন, আছে যত’।
    হয়ে গেলাম শান্ত, পেয়ে মনের মতো জবাব,
    নতুন করে ভাবি আজ, জীবনটা সবার তরে ;
    উদারতার এমন মহা-বীজমন্ত্রে ঘুচল অভাব,
    মনকে সঠিক দিশা আকাশই তো দিতে পারে ।।

You cannot copy content of this page