-
গল্প- শুধু খবর
শুধু খবর
-শম্পা সাহাখুবই গরিব ঘরের ছেলে সমীরন ,বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করে তাদের তিন ভাইবোনকে বড় করেছেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট সমীরণ, কিন্তু ওই ভাই-বোনদের মধ্যে পড়াশোনায় সবচেয়ে ভালো । ওর বাবা নিমাই সর্দার যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন যাতে ছেলের পড়াশোনার ক্ষেত্রে কোন অসুবিধে না হয়। বাবার আশা পূর্ণ করে ছেলেও বেশ ভালোভাবেই বিএ পাস করেছে তাই ওর পরের পড়াশোনা চালানোর জন্য টিউশনিই ভরসা, কারণ নিমাই সর্দার আর পারবেন কি ভাবে?
সমীরন জানে, পরিশ্রম না করলে সফল হওয়া যায় না তাই টিউশনিটা ও খুব মন দিয়ে করে । অনেক ছাত্র পড়ে ওর কাছে,তাদের প্রত্যেকের দিকে কিন্তু ও আলাদা আলাদা নজর দেয়। তাই ছাত্র-ছাত্রীদের রেজাল্ট ও হয় খুব ভালো।প্রাইভেট মাস্টার হিসাবে বেশ নাম ডাকও হয়েছে। তবে ও কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের শুধু বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনায় উৎসাহ দেয় না, তাদের সঙ্গে সঙ্গে মানবিক শিক্ষাও দেয়। খুব ভালো ছেলে হিসেবে ও বেশ জনপ্রিয় । সব বাবা-মা তাদের ছেলেমেয়েদের সমীরণের কাছে পড়তে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত। সমীরন বাচ্চাদের নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেয় ,অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ না করার শিক্ষা দেয়।
একবার সরস্বতী পুজোর দিন কোচিং সেন্টারে পূজো, কিশোর-কিশোরী ছেলেমেয়েদের ভিড়, বারো থেকে ষোলো সব মেয়েরাই শাড়ি পড়ে গিন্নী সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ছাত্র-ছাত্রীদের ভোগ প্রসাদ দেবার আগে সমীরনের মনে পড়ল পাতা তো আনা হয়নি। ছেলেমেয়েগুলো আনন্দ করছে দেখে ওদের আর বিরক্ত না করে ও নিজেই সাইকেল নিয়ে বের হল । কিছুটা যেতেই চোখে পড়লো রাস্তার ধারে ছোট্ট একটা প্যান্ডেলে গান বাজছে আর ছেলেপেলেরা উদ্দাম নাচ জুড়েছে । দুটো বাচ্চা মেয়ে রাস্তা থেকে যাবার সময়, ওরা জুড়লো অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি । মেয়ে দুটো সমীরনের চেনা মনে হল না, তবে দেখে মনে হল ক্লাস এইট নাইনে পড়ে। মেয়েগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওই এলাকার পাড় হবার চেষ্টা করলেও অসভ্য ছেলে গুলো কিন্তু ওদের পিছু নেয়। এই দেখে সমীকরণ সাইকেল থেকে নামলো। পুরো বিষয়টার নির্বাক সাক্ষী হয়ে থাকতে ও আর পারল না। ওর ভেতরের প্রতিবাদী মানুষটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল, দৌড়ে ছুটে গেল, ইতিমধ্যে একটা অসভ্য ছেলে হলুদ শাড়ি পরা মেয়েটার আঁচল ধরে দিয়েছে এক টান! সমীরন সপাটে চড় কষালো ছেলেটার গালে।ছেলেটা হতচকিত হয়ে টাল সামলে ঝাঁপিয়ে পড়ল সমীরনের উপর, ততক্ষণে ওর আরো বন্ধু এসে পড়েছে। কিল, চড়, ঘুষি অজস্র বর্ষিত হতে লাগল সমীরনের উপর। মেয়েদুটো থর থর করে কাঁপছে । চারিপাশে বেশ একটা ভীড় ,সবাই তাকিয়ে দেখছে, কিন্তু কারো সাহস নেই মারমুখী মাতাল ছেলেগুলোর হাত থেকে সমীরনকে বাঁচানোর! জনগণ শুধু তামাশা দেখছে !
খবর পেয়ে সমীরনের ছাত্রছাত্রীরা ,পরিবারের লোকজন ছুটে আসতে দেখে ,অসভ্য ছেলেগুলো দিল চম্পট। মেরুদণ্ডহীনরা এভাবেই পালায় !রক্তাক্ত সমীরণকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু বাঁচানো যায়নি । মাথার বাঁদিকটা পাথরের আঘাতে একেবারে থেঁতলে গেছিল !আর বাকিটা খবর! খবরের কাগজের একটা খবর জনগণের সহানুভূতির কারণ হলো, “কিশোরীর সম্মান বাঁচাতে প্রাইভেট মাস্টার এর আত্মবলিদান! “ -
গল্প- শিবরাত্রি
শিবরাত্রি
-শম্পা সাহা“তাড়াতাড়ি চলো বৌমা আর ভালো লাগছে না” তাড়াতাড়ি পা চালায় সরমা। আজ মহা শিবরাত্রি আটটায় চতুর্দশী লেগেছে। পঁয়ষট্টি বছরের সরমা আর তার বৌমা তিথি দুজনেই উপোস করে রয়েছে। সংকেত দুজনকেই বারণ করেছিল কিন্তু মা-বউয়ের এই জোটের সামনে তার কোনো মতামত এর কি কোনো মূল্য আছে? আগে মা ছড়ি ঘোরাতো এখন আবার তার সঙ্গে জুটেছে তিথি। এ বাড়িতে তাই সংকেত যাকে বলে থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার।
বাড়ি থেকে মন্দির প্রায় সাত মিনিট হেঁটে। যদিও মোটরসাইকেলে আসতে পারতো তাহলে আবার বৌমা শাশুড়ি আলাদা হয়ে যেত তা আর সইবে কেন? তাছাড়া সঙ্গে ডাবের জল, দুধ, গঙ্গাজল, ফুল মালা, হাজার গণ্ডা জিনিস, তাই দুটিতে গুটি গুটি হাঁটা দিয়েছে আর সংকেত জাস্ট বডিগার্ড।
মন্দিরের সামনে আজকে পুজোর দিনে কয়েকজন ভিখারি জমেছে। পুণ্যার্থীরা পুজোর শেষে যদি কিছু দেয় এই আশায়। মন্দিরের বাঁদিকে একটি মেয়ে কোলে বাচ্চা। বাচ্চাটা ক্রমাগত কেঁদেই চলেছে। দূর থেকেই ওর কান্নার আওয়াজ কানে আসছে। কাছে যেতে তিথির চোখে পরলো মা আর বাচ্চা। নোংরা হতদরিদ্র চেহারা, সামনে একটা বাটি, যদি ফলমূল কিছু পায় ।
তিথির এখনো কোনো বাচ্চাকাচ্চা হয়নি, যদিও সংকেত বা সরমা এ নিয়ে কোনোদিন কিছু বলেনি তবে তিথির প্রথম বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর থেকেই ওর মনে ভয় চেপে বসেছে। ও যদি আর কোনোদিন মা না হতে পারে! শাশুড়ি স্বামী দুজনেই বোঝায়, “এটা কি কোন ব্যাপার? এরকম আজকাল কত হয়! “কিন্তু তিথির ভয় যায় না। আজ তো শিবরাত্রি, এটাও একটা কারণ আজকের উপোসের। সন্তানের জন্যই তাদের মূলতঃ এখানে আসা।
মন্দিরের সামনে মা আর কাঁদতে থাকা বাচ্চাটাকে দেখে তিথির অপূর্ণ মাতৃহৃদয় উদ্বেল হয়ে উঠলো। ওর কি মনে হল মেয়েটাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “ও কাঁদছে কেন? মেয়েটা একটু হকচকিয়ে গেল, সবাই আসে, যায় কেউ কেউ দু’ চার টাকা, একটা আধটা ফল ও দেয় কিন্তু বাচ্চার কান্নার কারণ তো কেউ জিজ্ঞাসা করে না! তাই মেয়েটি চুপ করে রইলো। “কিগো ও কাঁদছে কেন?” আবারও জিজ্ঞাসা। এবার মেয়েটি উত্তর দেয়, “খিদে পেয়েছে গো মা” কাঁচুমাচু অসহায় মা। “তা ওকে খাওয়াও!” মেয়েটি মাথা নিচু করে রইলো। তিথি মেয়েটিকে ভালো করে দেখলো, অপুষ্ট শরীর তার নিজেরই খাবার নেই তা আর বাচ্চাকে কি খাওয়াবে? সব বুঝে তিথি বললো, “তোমার ওই বাটিটা সামনের কল থেকে ধুয়ে নিয়ে এসো তো”
-“কেন বৌদি?”
-” যা বলছি তাই করো” তিথি ধমক দেয়। পুণ্যার্থীদের হাত পা ধোয়ার জন্য মন্দিরের ভেতরে যে কলটা ছিল, মেয়েটি ওখান থেকে বাটিটা ধুয়ে নিয়ে এল। তিথি ঘটি সম্পূর্ণ উপুড় করে দিলো মেয়েটির বাটিতে, তারপর সংকেতকে ডেকে বললো,”দুশোটা টাকা দাও তো” সংকেত একটু ধীর পায়ে হাঁটছিল, ওর তো আর খিদে পায়নি। ও এসে দেখে তিথি দুধটা ঢেলে দিলো মেয়েটির বাটিতে। ও তিথিকে ভালই চেনে তাই আর উচ্চবাচ্য না করে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে তিথির হাতে দুঊটো একশ টাকার নোট দিলো। তিথি মেয়েটির হাতে দিয়ে বললৈ, “এই নাও আজ, আর বসে থেকো না ,বাড়ি গিয়ে দুধটা গরম করে বাচ্চাকে খাইয়ে দাও।”
শাশুড়ি বৌমার দেরি দেখে বেরিয়ে এসে ডাকলো, “ও বৌমা দেরি হয়ে যাচ্ছে তো!” তিথি প্রসন্ন মনে চললো শিবের মাথায় জল ঢালতে। ও শুনতে পেল হতভম্ব মেয়েটি তখন বলছে ,”ভগবান তোমার ভালো করুক মা, তোমার কোলে চাঁদের মত ছেলে আসুক।”
তিথি মন্দিরে ঢুকতে ঢুকতে ভাবলো আজ পূজো আর প্রার্থনার আগেই ওর বর পাওয়া হয়ে গেল। ও গিয়ে দাঁড়ালো পুণ্যার্থীদের লাইনে। -
অণু গল্প- যদি
যদি
-শম্পা সাহাআজকের ইন্টারভিউটা ফেল করলে কিছুতেই চলবে না। বয়স বাড়তে বাড়তে ত্রিশের কোটায়, প্রথমদিকে হাতে টিউশনের হাজার দশেক টাকা আসাতে প্রশান্ত ভেবেছিল চাকরীর চেষ্টা করার দরকার নেই, বাবার মাইনেটা ছিল। দিদির বিয়েটা বাবা থাকতেই দিয়ে গেছেন। সেজন্য অবশ্য মনে মনে বাবার প্রতি ও কৃতজ্ঞ। কিন্তু বাবা মারা যাবার পর ফ্যামিলি পেনশনটা থাকলেও তাতে সংসার চালানো একটু চাপের। তার ওপর বয়স বাড়ছে, সঙ্গীতা বারবার বিয়ের জন্য তাগাদা দেয়।টিউশনিটা ভবঘুরে জীবনের সাহারা হতে পারে, কিন্তু বিবাহিত জীবনের নয়। তবে থেকেই ও চাকরির জন্য মনোযোগী হয়ে ওঠে।
ঠিক সকাল ন’টায় খেয়েদেয়ে, ইস্ত্রি করা ফরমাল পোশাকে পা বাড়ায় অফিসের দিকে। ইন্টারভিউটা বেলেঘাটা ফুলবাগান মোড়- এ বাটার শোরুম এর ওপরে, একটা ইলেকট্রনিক্স কোম্পানির ডেস্ক জব, স্টার্টিং স্যালারি পনেরো হাজার দেবে। অ্যাড দেখে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাপ্লাই করেছে। এখন অনলাইনে খুব সুবিধে, সব ঘরে বসেই হয়ে যায়।
বাসে উঠে একটা সিট পেয়ে বসে গেল প্রশান্ত। মৌলালী থেকে ফুলবাগান খুব বেশি হলে মিনিট চল্লিশেক। ক্যাবে অনেক ভাড়া আর দূরত্ব ও এমন কিছু নয়। ওর সামনেই শিয়ালদহ থেকে উঠলেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক। পোশাক আশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে গ্রাম্য। হাতে একটা প্লাস্টিকের ঢাউস ব্যাগ, ভালো দাঁড়াতেও পারছেন না। ঝাঁকুনি দিলে বারবার হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ওর ঘাড়ের উপর।
হঠাৎই বাসটা বরফ কলের সামনে এসে দাঁড়াতে ভদ্রলোক উপুড় হয়ে পড়লেন প্রশান্তর ওপর। “একটু সোজা হয়ে দাঁড়ান না” পোষাকের ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠে ও। ইন্টারভিউতে পোশাক একটা ফ্যাক্টর। কিন্তু ভদ্রলোক উঠছেন না কেন? তাড়াতাড়ি ওনাকে বসিয়ে দেখে, নাঃ, শ্বাস চলছে, মারা যান নি। মুখে চোখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা হলেও চোখ খুললেন না। একবার তাকিয়ে আবার বুঁজে ফেললেন, বোঝা গেল প্রচন্ড যন্ত্রণাতে কষ্ট পাচ্ছেন, তার ছাপ মুখে চোখে স্পষ্ট।
অফিস টাইম, সবাই সামান্য কৌতূহল, তারপর সহানুভূতি দেখিয়ে যে যার গন্তব্যে নেমে যেতে লাগল। মুখে অনেকেই বললো, “হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে” কিন্তু কেউ যেতে রাজি হল না। যেহেতু উনি প্রশান্তর গায়ের উপর পড়েছেন তাই দায় যেন ওর একার। প্রশান্ত দু’চারবার চিন্তিত মুখে ঘড়ির দিকে তাকালো তারপর ত্রি কোণ পার্কের স্টপেজে ভদ্রলোককে পাঁজাকোলা করে নিয়ে নেমে গেল বাসস্ট্যান্ডের কাছের নার্সিংহোমে। ওর তখন মাথায় ঘুরছে, “বাবার তো এই বয়সই ছিল। ওনাকে যদি ট্রেনে স্ট্রোক হবার পর ঠিক সময়ে কেউ হাসপাতালে নিয়ে যেত তাহলে হয়তো উনি আজও আমাদের মধ্যে থাকতেন।” -
কবিতা- শুধু
শুধু
– শম্পা সাহাশুরুটাই করতে পারলাম না কখনো
শুরু করলে হয়তো দিব্যি গরগর করে এগিয়ে যাওয়া যেতো
কয়েক শতাব্দী
কয়েক যোজন দূরত্ব অনায়াসে পাশাপাশি হতো
দু’টো হাত হাতের মুঠোয়
আঙুল আঙুলের কথকতা সোচ্চার নিঃশব্দে
পড়ে ফেলা যেত যত গোপন গুপ্তধন নকশা
হয়ত খুঁজে পাওয়া গেলেও যেতো পারত
অন্য কোনো সভ্যতা মায়ার আদলে
নিদেনপক্ষে কোনো অজানা মহাদেশ
অজানা হীরের খনি হারানো সড়ক
হয়তো লেখা হয়ে যেত মহাকাব্য কয়েকখানা
অথবা নতুন প্রেম ইতিহাস
সর্বোচ্চ পুরস্কারের সর্বস্বত্ব হয়তো হতো
আমারই অধীন
ঝুলতো মেডেল কয়েক ডজন
অহংকারে পড়তো না পা মাটিতে
সব সবই হয়তো হতো অনায়াসে
শুধু শুরুর অপেক্ষা
শুরুটাই করা হয়ে উঠল না আর
এদিকে বেজেছে ঘন্টা ফেরৎ যাবার। -
কবিতা- চেয়েছিলাম তো কত কিছুই
চেয়েছিলাম তো কত কিছুই
-শম্পা সাহাআমি বৃষ্টি হতে চেয়েছিলাম
অঝোর ধারায় ঝরে ভিজিয়ে দেবো সব রুক্ষতা
পৃথিবী আবার সবুজ হবে!
আমি ঝর্ণা হতে চেয়েছিলাম
রুনুঝুনু তীক্ষ্ণতায় পাথর ফাটিয়ে দিকবিদিকে ছড়িয়ে যাবো
দুপাড় রঙীন হবে!
আমি মাটি হতে চেয়েছিলাম
সব সবুজের আবাহন আমার মাঝেই পাবে পূর্ণতা
শ্যামল সতেজ সবকিছু।
আমি আশা হতে চেয়েছিলাম
দুঃখের শেষেও আলোর ঝিলিক উঁকি দিয়ে বলে যাবে
জীবনের শেষ নেই কখনো!
আমি গহন বন হতে চেয়েছিলাম
বুকের মাঝে আগলে রাখবো নাম না জানা কত জীব প্রজাতি
প্রাণ সমৃদ্ধ হবে!
কখনো মেঘ হতে চেয়েছি, কখনো স্বপ্ন, কখনো কিশোরীর প্রথম লাজুক প্রেম
অছোঁয়া অধরা অথচ তীব্র আবেশময়
ভীরু অথচ তীব্র নেশার মত
আজ উনুনের পাশে বসে রুটি সেঁকি
জীবন স্যাঁতসেঁতে পড়ে উঠোনের কোণে
অযত্নে। -
কবিতা- জীবন ফিনিক্স পাখি
জীবন ফিনিক্স পাখি
-শম্পা সাহাআজকাল আর আলো ভালো লাগে না
এক অন্ধকার বুকের উপর চেপে বসে চাপা স্বরে মন্ত্র পড়ে
বুঝিনা সে ভাষা ঠিক ঠাক
বুঝতে পারি শুধু ফুরিয়ে যাবার আগে
নিভে যাবার আগে আরো একবার হয়তো জ্বলতে বলছে
বলতে বলছে যা কিছু বুক চাপা পাথরের মত
লোভ হিংসা ঘৃণা দ্বেষ যা কিছু বিকট অশালীন অশোভন
মনের গহন কোণে যাদের নিত্য যাতায়াত
বারবণিতার মত স্নো পাউডারে সাজিয়ে নকল মনকে
পেশ করি রোজ
আসল মনের ঠিকানা নাই বা জানলাম
নাই বা রাখলাম কোথাও লিখে দু’ একটা সংকেত
তবু কণ্ঠার উপর চাপ
সত্যি কথা বল… বল একবার শেষবার
ফুরিয়ে যাবার আগে নিভে যাবার আগে
মুখোশ খুলে মুখ নিয়ে সামনে দাঁড়া
মুখোশের ভার বইবার ক্ষমতা থাকে না সবার
তোর আছে
সেই আশায় বাঁচে যারা দেয় সাড়া
বলে আছি বেঁচে
তাদের মত বল ঘৃণার নতুন ধারাপাত
না হয় পড়লো বাদ লাভ ক্ষতি হিসেব নিকেশ
তবু বেশ হয় সত্যের মশাল জ্বালিয়ে সব ছাড়খার করে
মহাপরিনির্বাণ এর পথে যেতে যেতে
পেছনে ফিরে দেখি
জীবন ফিনিক্স পাখি
বেঁচেছে আবার উঠে
মেলেছে আবার ডানা
এই শুভ দিনে হতাশার মন্ত্র পড়া মানা। -
অণু গল্প- পুঁই চিংড়ি
পুঁই চিংড়ি
-শম্পা সাহারহমান চাচা অনেকক্ষণ ধরে বাজারের থলি হাতে ঘোরাঘুরি করছে কিন্তু কিছু কিনছে না। বার দুয়েক দোকানের সামনে দিয়ে খালি ব্যাগ নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখে খলিল জিজ্ঞাসা করে, “ও চাচা ভালো নদীর চিংড়ি আছে, নিই যাও, নিই যাও। বেশি না, ষাট টাকা শ। এ দ্যাকো একোনো লড়তিছে।” তাকিয়ে দেখেন সত্যিই দু’ একটা চিংড়ি গায়ে সাদায় সবুজে ফুটি ফুটি পা বাগিয়ে ঝুড়ির বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। রহমান চাচা, “না লাগবে না” বলে দূরে সরে যায়।
এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে এক ফালি কুমড়ো কুড়ি টাকা দিয়ে নিয়েছে। এই লকডাউন কাটার পর যেমন লোকের রোজগার কমেছে তেমনি বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম। বাবা! সবজি তো না যেন সোনা! আলুও নেয় হাফ কেজি, লঙ্কা পঞ্চাশ।
ছেলেটা রাজমিস্ত্রি খাটে, রহমান নিজেও তাই। কিন্তু এই সময়ে সব কাম কাজ একেবারে বন্ধ, কি করে যে চলছে তা ওই জানে! “আল্লাহর যা ইচ্ছে!” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রহমান চাচা।
বেলা প্রায় একটা। এত দামি চিংড়ি কে কিনবে? তায় কোন ভোরে ধরা, একটু নরম হতে শুরু করেছে। খলিল চেঁচাতে থাকে, “চিংড়ি, চিংড়ি ,চিংড়ি, মাত্র এই কটা পড়ে আছে, চল্লিশ টাকা, চল্লিশ টাকা, চল্লিশ টাকা। নিয়ে যান, নিয়ে যান”, জলের ছিটে দিয়ে আরও একবার মাছগুলো নাড়াচাড়া করে। রহমান সামনে এসে দাঁড়ায়। “একশো চিংড়ি দে তো খলিল” খলিল অবাক হয়, কিন্তু মুখে কিছু বলেনা। মেপে একশো পাল্লা থেকে ঢেলে দেয় রহমানের ঝোলায়।
যাক বাবা একশো টাকার মধ্যেই সব হয়ে গেছে! পোয়াতি বৌমাটা সেই কবে থেকে চিংড়ি দিয়ে পুঁই শাক খেতে চেয়েছে । হাসিনাকে বলে এসেছে পুঁই ডাঁটা মাচা থেকে কেটে রাখতে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই হাসিনার সকালকার কাজ সারা হয়ে আখা ধরানো হয়ে গেছে।। তাড়াতাড়ি না গেলে মাছগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। প্রসন্ন মুখে দ্রুত বাড়ির দিকে পা চালায় রহমান চাচা। -
অণুগল্প- মিড ডে মিল
মিড ডে মিল
–শম্পা সাহাছোট্ট ভাইটা নাকের পোটা সারা মুখে মাখিয়ে কেঁদে যাচ্ছে, তাতে দু’ একটা মুড়িও লেগে আছে। চোখের জলে নাকের জলে একেবারে মাখামাখি।
সবাই সকালবেলা মুড়ি খায় মোটা চালের মুড়ি, দু’ পাঁচ টাকায় পাওয়া যায়। এই এলাকার সবারই মুড়ি জোটে সহজে কিন্তু ভাত নয়। মুড়ির চাল দিয়ে দু’ একবার ভাত করে খাবার চেষ্টা করেছিল অনেকে, কিন্তু পেটে সয়নি, বিশেষ করে বাচ্চাগুলোর। তাই মুড়ি দিনে তিনবার, যদি ঘরে থাকে। ভাত রেশনের চালের, তাও যা পাওয়া যায় তাতে মাত্র একবারই হয় এই ছয়জনের সংসারে।
সোনালী, নিজে মুড়ি জল দিয়ে খেয়ে স্কুল বেরোনোর সময় ভাইকে কাঁদতে দেখে মনটা খুব খারাপ হলো। বেচারা হাঁটতে পারে না, শুধু শুয়ে থাকে। আজ ভাতের বায়না ধরেছে সকাল-সকাল।
মিড ডে মিলের থালাটা নিয়ে সোনালী একটু আড়ালে গিয়ে প্লাস্টিকের ভেতর গরমাগরম ভাত তরকারী ভরে দৌড়ে গিয়ে ব্যাগে রেখে আবার থালা নিয়ে লাইনে দাঁড়ালো। -
কবিতা- দূর্গা রূপ
দূর্গা রূপ
– শম্পা সাহাবারুদ ছিল মনের ভেতর
আগুন তবু জ্বললো না
ঘেন্না করে ওরা ভীষণ
মুখ ফুটে কেউ বললো না।
মারল ছুঁড়ে অ্যাসিড শিশি
কাটলো গলা নৃশংস
মানুষ ওরা ভাবলো না তো
ভাবলো শুধুই নারী মাংস।
ছুঁড়লো আগুন জ্বাললো চিতা
সতীদাহের কি বদনাম!
মা মেয়েরা মেয়েছেলেই
এটাই আজো যে সম্মান।
পণের নামে পণ্য হলাম
শুষলি রক্ত থাকলো ছাই
তাই আমি মানুষ বলতে
আজ নিজেকে লজ্জা পাই।
মানুষ আমি নইরে আজ
মেয়ে হয়েই বাঁচতে চাই
লক্ষ্মী নয় চন্ডীর রূপ
আজকে আমি নিয়েছি তাই।
আসবি নাকি? মারবি নাকি?
দেখি কত সাধ্য তোর?
ছিঁড়বোই আজ নাড়ীর বাঁধন
দেখি কত তোর পেশীর জোড়।
আমি যেমন জন্ম দিই
মারতে পারি তেমনই
বুঝি শুধুই লক্ষ্মী চেন?
দূর্গা রূপ দেখোইনি। -
অণু কবিতা- হাস্যকর
হাস্যকর
– শম্পা সাহাবছরের চারটে দিন নারী শক্তির জাগরণ
আবাহন আত্মশুদ্ধি মন্ত্রোচ্চারণ
পরিণতি বিসর্জন
নোংরা পূঁতিগন্ধময় ক্লেদাক্ত জলে
ধুয়ে যায় রং গলে যায় মাটি
খড়ের কাঠামো দাঁত বের করে হাসে
আঙ্গুল তোলে সেই সমাজের দিকে
যাদের সারা বছর ধর্ষণ নারী নির্যাতন
ভিড়ে অথবা ফাঁকা পেয়ে
শারীরিক বা মানসিক নিষ্পেষণ
তারপরে হাস্যকর এই
বার্ষিকী শারদীয়া মাতৃ পূজন!