• কবিতা

    কবিতা- শিশুর সাধ

    শিশুর সাধ
    -শিলাবৃষ্টি

    শিশু! সে তো সবার প্রিয়-
    মায়ের যখের ধন,
    বুকের হিরে, চোখের মাণিক,
    ফুলেল্ সম মন।
    নিষ্পাপ তার মুখের হাসি,
    আধো আধো বোল…
    চোখ দু’টি তার খুঁজে ফেরে –
    কোথায় মায়ের কোল!
    ছোট্ট বুকে স্বপ্ন অনেক …
    কবেই হবে বড়ো!
    সাবধানী মা সব সময়েই
    ভাবেন তাকে জড়!
    তারও যে চাই ইচ্ছে ডানা
    কেউ বোঝে না তেমন,
    নীল আকাশে উড়তে সে চায়
    যেথায় খুশি যেমন।
    ফুলের বনে গোলাপ হয়ে
    ফুটে ওঠার লাগি…
    ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখে
    হঠাৎ ওঠে জাগি।
    ওই ঝমঝম্ বৃষ্টি এলো
    নিকষ কালো মেঘে,
    স্বপ্ন দেখে ছোট্ট শিশু
    মায়ের কোলে জেগে।
    জল ছিটিয়ে দস্যিপনা
    করতে যদি পেত-
    সারা গায়ে বৃষ্টিফোঁটা …
    কেমন মজা হত!
    স্বপ্ন দেখে ছোট্ট শিশু
    ছোট্ট দু’টি চোখে।
    কচি বুকে রং বেরঙের
    রামধনু রং মাখে।

  • কবিতা

    গল্প- র‍্যাট কিলার

    র‍্যাট কিলার

    -শিলাবৃষ্টি

     

     

    গণেশ আর গণেশের বউ টুম্পার খুব কষ্টে দিন চলে। রোজগার পাতি খুব কমে গেছে।  এখন আর ইঁদুর  মারা বিষ তেমন বিক্রি হয়না শহর বাজারে,  ট্রেনে বাসে। টুম্পা গণেশকে বোঝায় এভাবে আর কদিন চলবে! সে একটা বাসন মাজার কাজ পেয়েছে। গণেশ মত দিলেই সে দু বেলা লোকের বাড়িতে খেটে কিছু টাকা রোজগার করতে পারে! কিন্তু গণেশ একদম রাজি হয়না। সে বলে ” দেখ টুম্পা!  আমাদের একটা বংশ মর্যাদা ছিল!  আজ হয়তো নুন আনতে পান্তা ফুরোয় কিন্তু  আমার ঠাকুরদাদা বড় পূজারী ছিল। আমরা ব্রাহ্মণ!  তুই কিনা লোকেদের বাড়িতে এঁটো বাসন মাজবি? ” টুম্পা  এসব কথা বহুবার শুনেছে!  গণেশ রেগে গেলে সে চুপ করে যায়!  কিন্তু কিছু তো একটা করতেই হবে!
    কয়েকদিন পরেই টুম্পা বুঝতে পারে তার পেটে গণেশের সন্তান।  তাদের ভালোবাসার সম্পদ। কিন্তু এই অভাব অনটনের মধ্যে সেই সন্তানকে কিভাবে সে পৃথিবীর আলো দেখাবে!কয়েকদিন ধরেই গণেশের জ্বর আসছিল,  সে ফেরি করতে বেরোতে পারেনি।  টুম্পা দোকানে ধার করে চাল ডাল,  আর ওষুধ কিনে চালাচ্ছিল।  না আর গণেশের কথা শুনলে হবেনা। তাকে কাজটা ধরতেই হবে।
    গণেশকে আজ সকালে হাসপাতালে টিকিট করে দেখাতে নিয়ে গেছিল। ডাক্তারবাবু কেন জানি ভর্তি করে দিতে বললো। টুম্পা চিন্তায় পড়লেও ভর্তি করেই ফিরলো। তবে ডাক্তারবাবু বলেছে ভয় নেই কোনো। শরীর দুর্বল, তাই সেলাইন দিতে হবে।
    আর দেরি না করে সে ছুটলো কাজের বাড়িতে। বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে, কাজটা যদি অন্য কেউ ধরে নেয়!
    যা ভেবেছে ঠিক তাই। ও বাড়ির মাসীমা বললেন ” নারে বৌ, তুই পরের দিন এলিনা দেখে অন্য লোক লাগিয়েছি।”
    টুম্পা অসহায় ভাবে মাথা নেড়ে বেরিয়ে আসতে যাবে, এমন সময় মাসীমা ডাকে
    ” এই শোন শোন, তুই ভালো রান্না করতে পারিস? ” টুম্পা হাতে যেন স্বর্গ পেল। ” হ্যাঁ মাসীমা আমি খুব ভালো রান্না পারি।”
    “তোরা কি জাত?”
    ” আমরা চক্রবর্তী ব্রাহ্মণ গো মাসীমা, অবস্থার ফেরে আজ কাজ খুঁজে ফিরছি।”
    মাসীমা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ” তাহলে
    কাল থেকেই লেগে পড়। আমাদের বোউটা পোয়াতি। সে আর নিজে রান্না করে খেতেই পারছেনা। খুব অরুচি মুখে! ” টুম্পা অন্যমনস্ক হয়ে যায়… সেওতো পোয়াতি, অথচ…. যাক গে”
    রাতে একা ঘরে শুয়ে শুয়ে টুম্পা ভাবে এখন কোনো কথা গণেশকে সে জানাবেনা। টুম্পা যে মা হতে চলেছে তাও সে গণেশকে লুকিয়ে রেখেছে। রান্নার কাজে বেশী অসম্মান নেই, পরে গণেশ জানলে খুশিই হবে হয়তো।
    সকাল হতে না হতেই টুম্পা রান্না করতে বেরিয়ে গেল। ভালোই লাগছে তার অনেক রকম রান্না করতে। জল খাবারের পরোটা আলুর দম তাকেও খেতে দিল মাসীমা। ওরা বলেছে টুম্পা রান্না খারাপ করেনা। দু’হাজার টাকা দেবে ওরা। মাসীমা অগ্রিম টাকা দিয়েছেন কিছু, তাতেই চালাতে হবে।
    দশটার সময় সে গণেশের কাছে গেল। আজ গণেশকে অনেকটা সুস্থ লাগছে। টুম্পার মনটা শান্ত হলো। চার বছর ওদের বিয়ে হয়েছে। দুজনেই দুজনকে খুব ভালোবাসে। গণেশ সব সময় টুম্পাকে আগলিয়ে রাখতে চায়। ডাক্তার বাবু বলেছে কাল ছুটি দেবে।
    পরের দিন কাজের বাড়ি থেকে এসে
    টুম্পা গণেশকে বাড়িতে নিয়ে এলো। মাছের ঝোল ভাত রান্না করে দুজনে খেল।
    গণেশ প্রশ্ন করে ” তুই বাজার করেছিস, মাছ এনেছিস কিন্তু টাকা কোথায় পেলি?”
    টুম্পা বলে ‘ তুমি এখন অসুস্থ, এত কথা তোমাকে চিন্তা করতে হবেনা! ” গণেশ বিকেলের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছে। আসলে ওষুধ খেয়ে শুধুই ওর ঘুম ঘুম পাচ্ছে।
    সন্ধ্যা বেলায় রুটি বানাতে যেতে হবে মাসীমাদের বাড়িতে, টুম্পা একবার ভাবলো গণেশকে বলেই যাবে। কিন্তু ও তো ঘুমাচ্ছে। থাক রাতেই সে সব খুলে বলবে। ভালো তাঁতের শাড়িটা পরে সে বেরিয়ে যায় সন্তর্পণে।
    পাশের বাড়ির কাকি এসে ডাকে ” ও গণেশ ওঠ বাবা, ওঠ। আজ কেমন আছিস? তোকে দেখতে এলাম!” গণেশ উঠে বসে। টুম্পাকে ডাকে। কাকি বলে ” তোর বৌ তো কাজ ধরেছে ওই রায় বাড়িতে। সেখানেই গেছে বোধহয়!” গণেশ
    আকাশ থেকে পড়ে, সে স্তম্ভিত। টুম্পা তার অমতে রায় বাড়িতে বাসন মাজতে গেছে! সে থ হয়ে বসে থাকে। কাকি চলে গেলে রাগে দুঃখে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সে ঘরের তাকে থরে থরে সাজিয়ে
    রাখা তার ব্যবসার জন্য কেনা ইঁদুর মারা বিষ কয়েকপাতা জলে গুলে খেয়ে নেয়। এ জীবন থেকে কি হবে! স্বামী হয়ে স্ত্রীকে খেতে দিতে পারেনা সে। তাই তো টুম্পা বাসন মেজে খাওয়ার জোগাড় করে। তাদের বংশের সম্মান আজ ধুলোয় মিশে গেল। সব অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। গণেশের
    জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছে। ” টু..ম্পা, টু…ম্পা” কেমন যেন একটা গোঙানির মতো আওয়াজ বেরোচ্ছে গণেশের গলা থেকে।
    টুম্পা খানিক বাদেই এসে পড়ে। দরজা ঠেলে ঢুকে আলোটা জ্বালিয়ে সে হতবাক। একি! গণেশ এরকম ভাবে শুয়ে আছে কেন? মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে কেন? মেঝের দিকে তাকিয়ে সে চিৎকার করে ওঠে ” গ…ণে…শ”। বিষের ছেঁড়া প্যাকেটগুলো ছড়িয়ে পড়ে আছে এদিক ওদিক।
    ছুটে বাইরে বেরিয়ে কাঁদতে কাঁদতে পাড়ার ছেলেদের ডেকে নিয়ে আসে সে। তারপর সবাই মিলে ধরে একটা ভ্যানে করে হাসপাতালে নিয়ে যায় গণেশকে। ওয়াশ করে প্রায় চার ঘণ্টা পরে গণেশকে ছাড়লো হাসপাতাল থেকে। টুম্পা পাগলের মতো অস্থির হয়ে মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে বেড়িয়েছে। ঠাকুর তার ডাক শুনেছেন। গণেশ ঘরে এসেছে। তার জ্ঞান ফিরেছে।
    রাতে টুম্পা গণেশের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে ” কেন তুমি এরকম কাজ করলে? কিছু যদি হয়ে যেত আমি কোথায় যেতাম? বলো আমার কি হতো?”
    কান্নায় ভেঙে পড়ে টুম্পা। গণেশ অভিমানে প্রথমে চুপ করে থাকলেও টুম্পার কান্না তার সহ্য হয়না। বলে – ” তুই
    আমার সম্মান নষ্ট করেছিস, আমার অবাধ্য হয়ে কায়েত বাড়িতে এঁটোকাঁটা…. ছি ছি ছি! “
    ‘ চুপ করো তুমি! আমি রান্নার কাজ নিয়েছি। মাস গেলে দুহাজার টাকা পাবো। আর টাকাটা এখন আমাদের ভীষণ দরকার! “
    গণেশ অবাক হয়ে তাকায় টুম্পার মুখের দিকে। সে ভুল ভেবেছিল? বলে – ” কেন টাকা ভীষণ দরকার কেন? “
    “টুম্পা চুপ করে থাকে, তারপর গণেশের
    পাশে শুয়ে পড়ে গণেশের চোখে চোখ রেখে বলে ” দেখোতো আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে, কিছু বুঝতে পারো কিনা! ” গণেশ খুব ভালো করে টুম্পাকে নিরিক্ষণ করে! ” কি হয়েছে তোর? কোনো অসুখ করেছে? বলনা!”
    টুম্পা খিলখিল করে হেসে ওঠে। বলে ” এই যে আমার হাঁদা গঙ্গারাম বর! আরে তোমার টুম্পা যে মা হবে তুমি বুঝতেও পারলেনা? “
    ” কি!! তুই মা? মানে আমি বাবা হবো?”
    পাগলের মতো টুম্পাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে গণেশ। ” ছাড়ো না ” টুম্পা কোনরকমে বলে। গণেশ বলে ” না, ছাড়বোনা আমি তোকে, সারারাত আদর
    করবো।”
    ……………
    কত রাত কে জানে। দুজনের বিনিদ্র কাটে। কত কল্পনা দুজনের আগামীর জন্য। টুম্পা বলে – কোনো কাজই ছোট নয় গো! রান্না একটা শিল্প! পরে আমি হোম ডেলিভারি খুলতে পারবো। আমি ভালো ভালো রান্না করবো আর তুমি সাইকেলে করে সেই রান্না অর্ডার মতো বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেবে। আমাদের সন্তানকে আমরা ভালোভাবে মানুষ করবো। “
    ” হ্যাঁ রে টুম্পা আমি পরশু থেকে আবার ট্রেনে হকারি শুরু করবো। তবে এই সাধারণ ইঁদুর মারা বিষ নয় এবার আমি বিক্রি করবো র‍্যাট কিলার! “

  • গল্প

    গল্প – সোনালী হোটেলে

    সোনালী হোটেলে ( সম্পূর্ণ কাল্পনিক)
    -শিলাবৃষ্টি

     

     

    তখন আমার ক্লাস নাইন। পুরী যাব প্রথম বার, ভীষণ উত্তেজনা। মাসীমণিরাও যাবে। জগন্নাথ এক্সপ্রেসে টিকিট কাটা হয়েছে। কয়েকদিন আগে থেকেই গোছগাছ শুরু করে দিয়েছি। অবশেষে যাওয়ার দিন এসে গেল, আমরা ট্রেনে খুব মজা করতে করতে ভোর বেলায় পুরী পৌঁছে গেলাম। একজন পাণ্ডার সাথে মেসোর আলাপ ছিল, সেই পাণ্ডাই আমাদের স্টেশনে এসে রিসিভ করে নিয়ে গেল! অটোয় উঠে সমুদ্র দেখতে দেখতে আমরা
    হোটেলে গেলাম। সমুদ্রের কাছেই আমাদের হোটেল। নাম সোনালী। দোতালায় দুটো বড় বড় রুম আমাদের জন্য খুলে দিল। ঝাঁ চকচকে নতুন হোটেল না হলেও, বেশ আভিজাত্যে মোড়া। আমার তো খুব পছন্দ হয়ে গেল!
    ব্যাগপত্র রেখে আমরা সী-বিচে চলে গেলাম। কচুরি, ঘুগনী, চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারা হলো। মাসীর মেয়ে ফুচুদি আমার থেকে তিন বছরের বড়ো। ফুচুদি আর আমি সমুদ্র স্নানে নেমে পড়লাম। বাবা মা মাসী মেসো সবাই নামলো। তবে আমার আর ফুচুদির আনন্দটা যেন সবাইকে ছাপিয়ে গেল।
    হোটেলে ফিরে চেঞ্জ করে খেতে গেলাম বিখ্যাত মাসীর হোটেলে। ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল, তাই সারা দুপুর ঘুমালাম আমরা। সন্ধের দিকে বীচে গেলাম, একের পর এক এটা ওটা খাওয়া চলতে লাগলো। অবশেষে ডিনার সেরে সোনালী হোটেলে ফিরলাম।
    এতক্ষণে আমরা খেয়াল করলাম হোটেলে আমরা ছাড়া আর তেমন কেউ নেই! ফুচুদিই বললো ~” একটা জিনিস নোটিশ করেছ তোমরা? পুরীতে এত ভিড়, অথচ এই হোটেলে আমরা ছাড়া কেউই নেই বোধহয়!”
    হ্যাঁ তাইতো সকাল থেকে এতবার বেরোলাম ফিরলাম, তেমন কারো সাথেই দেখা হয়নি! শুধু ম্যানেজার বা হোটেলে কাজ করা দু একটা লোক ছাড়া!
    যাইহোক আমরা ফ্রেস হয়ে গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়। ফুচুদি আর আমি একটা বেডে, আর মা বাবা আরেকটা বেডে। মাসীমণিরা পাশের রুমে।
    গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কে জানে!
    ঘুমটা ভেঙে গেল বাবা মায়ের গলার আওয়াজে। মা বলছে ” তুমি দরজাটা লক করোনি?”
    বাবার উত্তর ” কেন করবোনা! দেখো দরজাটা লক আছে এখনো!”
    আমি আর ফুচুদিও উঠে বসলাম –
    “কি হয়েছে বাপী? “
    মা বললো যে, মা স্পষ্ট কাউকে রুমের ভেতর চলাফেরা করতে দেখেছে! “কে? কে তুমি?” বলার পরে আর দেখতে পায়নি। বাবারও তখন ঘুম ভেঙে গেছে!
    আমি বললাম ” দরজাটা খুলে একবার দেখো।! আবার মায়ের মনের ভুলও হতে পারে! ” মা এ কথা শুনে খুব রেগে গেল।
    বাবা ইতস্তত করছে দেখে আমি আর ফুচুদি রুমের লাইট জ্বেলে দরজা খুলতে এগোলাম। পেছনে বাবা। লম্বা বারান্দার অল্প আলোয় তাকিয়ে দেখলাম আমরা তিনজনেই- টুপি পরা একটা সাহেব গোছের লোক এগিয়ে আসছে পায়ে পায়ে।
    কাছাকাছি আসতেই লোডশেডিং হয়ে গেল গেল মানে ঘরের আর বারান্দার আলোগুলো নিভে গেল। কিন্ত সেই সাহেবটার চোখের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা এক অদ্ভুত রশ্মিতে হালকা আলোয়
    ভরে গেল টানা বারান্দাটা। লোকটা বিকট ভাবে হাসতে থাকলো।আর আমরা কাঁপতে থাকলাম। বাবা তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিল। ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে ফুচুদি মোবাইলের টর্চ জ্বেলে খাটে গিয়ে বসলো। বাবা আমাকে বললো” এ হোটেলে থাকা যাবেনারে টুলটুল।” আমরা অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকালাম। “বেশ কয়েকবছর আগে পেপারে মনে হয় এই সোনালী হোটেলের কথাই পড়েছিলাম! এই হোটেলে নাকি আত্মা ঘুরে বেড়ায়! ” শুনে আমরা তো ভয়ে কাঠ। সবাই একটা বেডেই জড়ো হয়ে বসে আছি। এমন সময় কারেণ্ট এলো। মা তাড়াতাড়ি ঘরের বড় আলোগুলো জ্বেলে দিলো। সবাই শুয়ে পড়লাম। বাবা বললো ভোর হলেই হোটেলের খোঁজে বেরোবে। আর কয়েক ঘণ্টা এখানে এভাবেই কাটাতে হবে!
    সবাই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে বা তন্দ্রাচ্ছন্ন! আমার চোখে কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছেনা। আবার লোডসেডিং হয়ে গেল! খানিক বাদে দরজার বাইরে পায়ের আওয়াজ আর ফিসফিসানি শুনতে পেলাম। ভয়ে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল, চোখ খুলতে পারছিলাম না। তবু অন্ধকারে সাহস করে চোখটা খুলতেই দেখি ফ্যানের সাথে একটা বডি ঝুলছে! রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে আমার গলা থেকে একটা চিৎকার শুধু প্রতিধ্বনিত হলো…, বাবা গো…..
    আর কিছু মনে নেই আমার। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন ভোরের আলো ফুটে গেছে আর আমার চারিদিকে সকলে ভিড় করে আছে।
    হোটেল চেঞ্জ করে আমরা আর ওমুখো হইনি। ম্যানেজার বিশ্বাস না করলেও, পরে আলোচনা প্রসঙ্গে অনেকের কাছেই শুনেছিলাম সোনালী হোটেলে অনেক বছর আগে এক সাহেবকে কেউ খুন করে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করেছিল ওই ১৬নং রুমেই। তারপর থেকেই মাঝে মাঝে সাহেবের ভুত নাকি ওখানে দেখা যায়! আর বড় একটা কেউ জেনেশুনে ওই হোটেলে ওঠেনা।
    এখনো সেই দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে!!!

  • গল্প

    গল্প- বিশ্বাসঘাতক

    বিশ্বাসঘাতক
    -শিলাবৃষ্টি

     

     

    কোনোদিন তার মনোভাব এরকম হবে নিজেই ভাবতে পারেনি মীরা। কারো খেলার পুতুল সে নয়, সেটাই এবার বোঝাবে। শুধু পায়ে ধরতে বাকি রেখেছিল সে, কিন্তু মিথ্যের পর মিথ্যে দিয়ে সাজানো নাটকে অভ্যস্ত তপন তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে জীবন থেকে। মীরা খুব বোকা। তার বন্ধুরা তাকে অনেক বাধা দিয়েছিল, কিন্তু কারো কথাই তখন কানে দেয়নি মীরা। প্রেমের জোয়ারে সে তখন ভেসে গেছে। ফেরার কথা ভাবতেই পারেনা। তপন তাকে কথা দিয়েছিল বিয়ে করবে। তার ডিভোর্সের কেস চলছে, তাই কেস মিটে গেলেই.. এখন হাসি পায় ভাবলে।
    এরা একজনকে নিয়ে বেশিদিন খুশি থাকতে পারেনা, এরা বদল চায়। সম্পর্কের শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে মীরা পাগলের মত চেষ্টা করেছে তপনকে ফেরাতে। একটি বার দেখা করতে চেয়েছে। কিন্ত কোনো ফল হয়নি। তার এখন সময়ের বড় অভাব। যে সারাটাদিন মীরার জন্য ছুটে বেড়াতো, সে আজ দশ মিনিটও সময় দিতে নারাজ। সরু বিনি সুতোয় যে সম্পর্কটা আটকে ছিল, তাও একদিন ছিঁড়ে গেল! অনেক রাত ঘুমোতে পারেনি মীরা। বন্ধুরা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আনন্দ দিতে চেষ্টা করেছে কিন্তু মীরা অশান্ত মন নিয়ে হেসেছে, কেঁদেছে। অভিনয় করে গেছে। তার ভালোবাসায় কেউ ছুরি মেরে পালিয়ে গেছে, তাই শাস্তি তাকে পেতেই হবে। তপনের অভিনয় মীরা ধরে ফেলেছে। বদলা নিতে বদলে ফেলে নিজেকে মীরা। তিন বন্ধু মিলে অনেক সাবধানে পা ফেলতে শুরু করে। মীরা আর দুজনে ফেক একাউন্ট বানায়। আর কিছুদিন আগে পরে তিনজনেরই টোপ গেলে তপন, ব্যাস শুরু হয়ে যায় খেলা।
    বেশ কিছুদিন চলতে থাকে প্রেম প্রেম খেলা। প্রায় সাত আট মাস কেটে গেছে।
    তপন দেখা করার জন্য মরিয়া, কিন্তু এরা তিনজনও নানান অজুহাতে দেরি করতে থাকে। মানে মাছকে খেলিয়ে টোপ গেলানো আর কি!
    অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ!
    নেহা দিন এবং সময় ঠিক করে দিয়েছিল। ওইদিন সন্ধ্যা ছ’টায় ইছাপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একটা নির্দিষ্ট বেঞ্চে নেহা খুব সুন্দর সেজেগুজে বসলো। আর একটু আড়ালে থাকলো বিপাশা। তপনের বৌকে নিয়ে আর একপাশে গা ঢাকা দিল মীরা। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে তপনের স্ত্রী এর সাথে যোগাযোগ করতে কোনো বেগ পেতে হয়নি। তপন নির্দিষ্ট সময়ের কিছু আগেই হাজির হলো। নেহার সাথে আলাপ যখন প্রলাপে এগিয়ে যাচ্ছে, নাট্যমঞ্চে অবতীর্ণ হলো বিপাশা। সে অন্য ছবিতে তপনের বান্ধবী। তাই তাকে চিনতেও পারলোনা তপন। দূর থেকে মীরা সবটাই ওয়াচ করছিল তপনের স্ত্রী মানে বরুণাকে নিয়ে। বরুণার বিস্ময়ের সীমা ছিলনা। মীরা আগে থেকেই তিন বান্ধবীর সাথে তপনের গোপন মেসেজের স্ক্রিনশট পাঠিয়ে রেখেছিল বরুণাকে। এবার সামনে এলো মীরা আর বরুণা। ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো তপন। চারজন ঘিরে ধরলো তাকে। পালানোর পথ নেই আর। মীরা বলতে থাকে- “আজ আমি পেরেছি তপন, তোমার খেলা আর কতজনের সাথে চলছে জানিনা। তবে আশা করি আমি তোমাকে শাস্তি দিতে পেরেছি। এবার তোমার স্ত্রী কি করবে জানি না, তবে ঈশ্বর তোমাকে আরো বড় কোনো শাস্তি দেবেন দেখে নিও।” কথাগুলো বলেই পাগলের মতো হাসতে শুরু করে মীরা।তারপরেই কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। বরুণা ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধু বলে -“এই জন্যই অফিস থেকে ফিরতে তোমার এত দেরি হয়? আর কত জনের সাথে ডেটিং করো?তালিকাটা খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। একবুক ভালোবাসা নিয়ে তোমার সাথে ঘর বেঁধেছিলাম তপন। আজ সে ঘর ভেঙে পড়লো। মীরাকে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখিয়েছিলে। অনেক মনের জোর নিয়ে মীরা আজকের দিনটা আমায় দেখালো… বাই তপন। আর এক ছাদের তলায় আমরা স্বামী স্ত্রীর অভিনয় করবো না। ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেবো, অপেক্ষায় থেকো।”

  • গল্প

    গল্প- স্বপ্নের পুরুষ

    স্বপ্নের পুরুষ
    -শিলাবৃষ্টি

    সে ছিল আমার কিশোরী বেলার প্রেম। তাকে একটিবার দেখার জন্য রোজ বিকেলে ব্যালকনীতে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। সে কি বুঝতো! না কি অবুঝ ছিল! কে জানে! বয়েসে আমার থেকে অনেকটাই বড় ছিল! তাই প্রেম নিবেদন আর করা হয়নি সেই বয়েসে। আমার স্বপ্নের পুরুষ হয়েই ছিল।
    আমি এখন সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ি। কোএডুকেশন কলেজ, সব বন্ধুরা ভালোই প্রেম করতে শুরু করেছে। লিজার মানে আম্রকুঞ্জে ওরা সময় কাটাতে চলে যায়। আমি বুঝতে পারি একজোড়া চোখ আমায় ফলো করে। রাজিব..রাজিব মিত্র। থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। কলেজের জি এস। কারণে অকারণেই কথা বলে। আমার খারাপ লাগেনা। সেদিন লাইব্রেরিতে ঢুকেই দেখি রাজিব বসে আছে একটা বই নিয়ে। আমাকে দেখে একটু সরে বসলো। আমিও অনার্স-এর বইটা পেয়ে কিছু নোট লেখার চেষ্টা করবো, এমন সময় রাজিব বললো “রাধা, আজ আমায় একটু সময় দেবে”
    “কখন রাজিবদা?”
    “তোমার যখন সময় হবে”
    ‘আচ্ছা, আমার শেষ ক্লাস তিনটে চল্লিশে। তারপর…”
    “ঠিক আছে আমি ওয়েট করবো”
    তখনো বুঝতে পারিনি রাজিব ঠিক কেন দেখা করতে বলেছে। জি এস-কে রাগানো একেবারেই ঠিক নয়। তাই রাজি হয়েছি ঠিকই কিন্তু ক্লাসমেটদের কি বলবো ভাবছিলাম। যাইহোক নিজের কাজে মন দিলাম। বিকেলে ছূটির পরে অনেকেই একসাথে বাসষ্টপ অব্দি ফিরি! আজ বলতে হলো আমি লাইব্রেরিতে যাবো, কিছু নোটস তৈরীর জন্য, তোরা এগিয়ে যা। আরতি আর আমার বাড়ি একই দিকে। তাই ও বললো ” চলনা আমি বসছি! একসাথেই ফিরবো। ”
    ” আরে না না, আমার অনেক দেরি হবে!”
    ওরা চলে যাওয়ার পর আমি এদিক ওদিক তাকালাম কিন্তু রাজিব কে দেখতে
    পেলাম না। কলেজ এখন ফাঁকাই বলতে গেলে! একপা একপা করে গেটের কাছাকাছি এগোতেই দেখতে পেলাম রাজিব বাইক নিয়ে আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে বললো – ” বসো পেছনে”
    ” কোথায় যাবো? ”
    ” ভয় নেই রাধা, আমি তোমাকে নিয়ে পালাবো না! ” বলেই হা হা করে হেসে উঠলো। আমিও সে হাসিতে যোগ দিলাম।
    ও একটা কফিসপে গিয়ে থামলো –
    ” চলো একটু কফি খাই! “আমি কিন্তু কিন্তু করছিলাম, তবু যেতেই হলো।
    কফি আর স্ন্যাকস অর্ডার করে রাজিব আসল কথার অবতারণা করলো –
    ” রাধা! তুমি কি এনগেজ?”
    আমি একটু অবাক হয়েই তাকালাম রাজিবের দিকে, কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না।
    ” বলো না, সত্যি বলবে কিন্তু! ”
    “কেন? ”
    ” তুমি বুঝতে পারছোনা? এ প্রশ্ন কেউ কেন করে? ”
    ” সেভাবে আমি এনগেজ নই রাজিবদা!”
    “তার মানে! ” রাজিব বিস্মিত।
    “মানেটা শুনলে তুমি হাসবে। আমি স্কুল লাইফে একজনকে ভীষণ পছন্দ করতাম, রোজ তাকে একবার দেখার জন্য আকুল হতাম। সে কিন্তু কিছুই জানেনা। তবে আমার ধারণা তাকে একদিন আমি খুঁজে পাবোই!” কথাগুলো শুনে রাজিব আবার প্রাণখোলা হাসি হাসলো। ” ওসব কল্পনা বাদ দাও রাধা। আমি তোমাকে লাইক করি এই কথাটা জানানোর জন্যই এখানে এসেছি। তোমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকবো।আশা করবো পজেটিভ উত্তরই পাবো।!”
    একটু অস্বস্তিতে পড়লাম। মুখে বললাম
    ” আমি জানতাম শুভ্রাদির সাথে তোমার….”
    ” ঠিকই জানতে, তবে রিলেশনটা টেকেনি!”
    ব্যাপারটা আমিও শুনেছিলাম। কফি খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। দুজনেই উঠলাম।
    ” কিছু বললেনা তো?”
    ” আমাকে কয়েকদিন সময় দাও রাজিবদা”…
    ” আচ্ছা আচ্ছা, তবে বেশি দেরি করোনা।”

    কি করে বলি রাজিবদা তোমাকে আমার সেভাবে পছন্দই নয়। আর তুমি আরেক জনের সাথে এতবছর…. যাক গে। সন্ধ্যায় দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম আজকের সব কথা! আর ভাবছিলাম আমার স্বপ্নের সেই পুরুষের কথা। আনিনা তার নাম, জানিনা তার ধাম! কোথায় হারিয়ে গেল একদিন সেই মুখ! সেই ব্যক্তিত্বময় হাঁটা! আর কি কোনদিন দেখতে পাবোনা তোমায়?
    আমার অপেক্ষা কিন্তু শেষ হয়নি! শেষ হয়নি আমার বারান্দার পথ চাওয়া!

    দিন দুয়েক পরে ইংলিশ অনার্সের ক্লাসে
    এ কে বি বললেন নতুন প্রফেসর জয়েন করেছেন, উনার ক্লাস আমরা আগামীকাল থেকে পাবো। রুটিনটা একটু চেঞ্জ হলো – সেকেন্ড পিরিয়ডে থাকবে নতুন স্যার এস সি মানে সুদীপ চ্যাটার্জীর ক্লাস।
    পরেরদিন সেকেন্ড পিরিয়ডে আমরা অপেক্ষা করছি, এ কে বি স্যার পরিচয় করিয়ে দিতে ঢুকলেন যাকে নিয়ে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম তাকে দেখে। এতো আমার সেই স্বপ্নের পুরুষ, যাকে দেখার জন্য আমি প্রতিদিন ছটফট করেছি। আজ এভাবে দেখবো সত্যিই আশা করিনি। এ কে বি খুব রসিক মানুষ, বললেন -” এই নাও সুদীপকে। তোমাদের নতুন লেকচারার। ড্রামার ক্লাস নেবেন আমাদের কলেজেই ওর প্রথম পোস্টিং। ব্যাচেলার, হ্যান্ডসাম
    ইয়াং ম্যান।তোমাদের ভালো লাগবে আশা করি। আমি এবার যাই, তোমরা পরিচয় করে নাও! ”
    স্বপ্নের ঘোরে যেন সময় কেটে গেল!
    ক্লাস শেষ হোলো। আমি সুযোগের অপেক্ষায় থকবো, আমি বলবো আমার মনের সব জমে থাকা কথা! আনন্দে দুচোখ জলে ভরে গেল। আমার ভালোবাসায় কোনো ফাঁকি নেই তা আজ নিজেও বুঝলাম। এভাবে ঈশ্বর ফিরিয়ে দিলেন আমার স্বপ্নকে বাস্তবে। যেভাবেই হোক আমি ওকে পাবোই নিজের করে এ বিশ্বাস আমার আরো দৃঢ় হলো।

    রাজীবকে ইনবক্সে জানালাম – ” আমি ফিরে পেয়েছি আবার আমার স্বপ্নের পুরুষকে, সেই যাকে আমি রোজ একবার দেখার জন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতাম!”

  • গল্প

    গল্প- মনের খবর

    মনের খবর
    -শিলাবৃষ্টি

    ভীষণ ভালোবাসতাম জানো, ওর প্রতি খুব টান অনুভব করতাম। কিন্তু বলতে পারিনি সেদিন। কিছুতেই বলতে পারিনি। কতবার ছুটে গেছি শুধু একবার জানতে চাইব বলে, সেও কি ভালোবাসে আমাকে? না অন্য কাউকে! সময় বয়ে গেছে তার নিয়মে। আমার না বলা কথা মনের অন্তস্থলেই থেকে গেছে। এখনো দেখা হয় বছরে দু’এক বার।
    বিচলিত হই। একান্তে বসে গল্প করার ইচ্ছেও হয়।

    হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের একটা মাধ্যম যদিও আছে, তবু সেখানে বিশেষ দিনে বিশেষ ম্যাসেজ ছাড়া আর তেমন কিছু দেয়া নেয়া হয় না।
    আমাদের পাড়ায় ভাড়া এসেছিল অশোকদারা।
    দুর্গাপূজার সময় আলাপ হলো ওদের পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারের। বিজয়া সম্মেলনে অশোকদা রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে আমার মন জয় করে নিল। জানলাম প্রেসিডেন্সি কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। ম্যাথ অনার্স। আমার তখন ইলেভেন। সাইন্স নিয়ে পড়ছি। মাঝে মাঝে অঙ্কের খাতা নিয়ে ছুটির দিনে দৌড়াতাম অশোকদার কাছে। কখনো দেখিয়ে দিত, সুন্দর করে বুঝিয়ে দিত। আবার কখনো “ধুস পালা৷ আমি এখন বেরোবো, কাজ আছে” বলেই বেরিয়ে যেত। মাসীমা যেতে দিতনা সহজে। রান্না করতে করতে গল্প করতো। ওদের বীরভূম জেলায় বিরাট বাড়ি, অনেক মানুষ। ছেলের লেখাপড়ার জন্য কলকাতায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে। নাড়ু মোয়া, এটা ওটা আমায় খাওয়াতো। কখনো কখনো বলতো “দেখতো মা, তোর দাদা এলো কিনা!”
    “দাদা” শব্দটায় আমি হোঁচট খেতাম। একদম ভালো লাগতোনা। কারণ আমার মনে তখন ভালোবাসার প্রথম বসন্ত। অশোকদাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন আমার চোখে। বুঝতাম পড়াশুনার ক্ষতি হচ্ছে! তবু মন মানতো না। চোখ শুধু খুঁজে ফিরতো কাউকে। কিন্তু তার তেমন কোনো ইন্টারেস্ট দেখতাম না। তুই বলে সম্বোধন! এসব দেখেশুনে আমার কেবলই মনে হতো.. তাহলে অশোকদাও কি আমাকে বোনের চোখেই দেখে! এই ভাবনাটাই আমার কাছে কষ্টদায়ক ছিল। আমার নিজের দাদা ছিলনা তবু আমি দাদার আসনে ওকে বসাতে পারিনি।
    ভালোভাবেই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে রেজাল্ট নিয়ে ছুটলাম ওদের বাসায়। কিন্তু খুব খুশী হলো না। মাথায় একটা গাট্টা মেরে বললো “ফাঁকি দিয়েছিস! এর থেকে অনেক ভালো রেজাল্ট তুই করতে পারতিস।” তারপরেই চেঁচিয়ে মাকে ডাকলো “মা ওকে মিষ্টি খাওয়াও! অনেক কষ্ট করে পাশ করেছে।”
    জানাতে পারলাম না আমার মনের কথা। ওর তখন সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা। এসব কথা বললে হয়তো পড়াশুনার ক্ষতি হবে!
    একটা সুযোগ এলো, অশোকদার পরীক্ষার পরে লম্বা ছুটিতে যখন ওরা বাড়ি যাবে বাসন্তী পুজো উপলক্ষে পাড়ার কয়েকজনকে আমন্ত্রণ করলো।
    আমি আর মা ওদের সাথেই গেলাম ওদের বীরভূমের বাড়িতে।
    পুরানো আমলের বিশাল জমিদার বাড়ি। সবুজ দিয়ে ঘেরা। আমার খুব ভালো লাগলো ওদের পরিবেশ। অশোকদা আমাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ওদের পুকুর, মন্দির, গ্রাম সব দেখালো, কেমন ছেলেমানুষ হয়ে গেল। অনেক গল্প করলো। ভাবলাম এই সুযোগ আর পাবোনা। পুজোর দিন বলবো। একটু ভয় ছিল! যদি রেগে যায়! আর কখনো কথা না বলে! না৷ ভয় পেলে চলবেনা কিছুতেই।… পরের দিন ভীষণ আড়ম্বরে পুজো শুরু হলো। হায় কপাল! আমি যখন সুযোগের সন্ধান করছি, ঠিক তখনই কলকাতা থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র-ছাত্রী মানে অশোকদার বন্ধুরা এসে হাজির। ব্যাস ওদের নিয়েই ও ব্যস্ত হয়ে গেল! আমাকে যেন ও চেনেই না। খুব খারাপ লাগছিল। আরো খারাপ লাগছিল, যখন নিবেদিতাদিকে নিয়ে অশোকদাকে ওরা ইয়ারকি করছিল। নিবেদিতাদি বেশ ভালো দেখতে। পোশাক পরেছে খুব সোবার। কথাবার্তাও খুব সুন্দর, মার্জিত। সেদিন শুধু মনে হয়েছিল নিবেদিতাদিকেই অশোকদা ভালোবাসে।
    আমরা বাড়ি এলাম পরের দিন। আর আমি পেছাতে শুরু করলাম।
    এর কয়েকমাস পরেই ওরা চলে গেল আমাদের পাড়া থেকে। অশোকদা আমাদের বাড়িতে দেখা করতেও এসেছিল। বললো, ভুবনেশ্বর ইউনিভার্সিটিতে এম এস সি করবে। চান্স পেয়ে গেছে।
    আমাকে বলে গেল “ভালো করে লেখাপড়াটা কর। ফাঁকি দিবিনা একদম। অবসরে চিঠি লিখিস!” আমার চোখে জল দেখে আবার বললো “পাগলি একটা! মায়ের সাথে দেখা করে আসবি!”
    গেছিলাম। তখন ও ছিলনা। মাসীমার চোখেও জল দেখলাম। বার বার বললেন বীরভূমের বাড়িতে যেতে।
    ব্যাস… এরপর মনটাকে বুঝিয়ে ছিলাম “যা আমার নয়, তার জন্য মন খারাপ করবোনা।

    ঠিকানা দিয়েছিল। চিঠিও লিখেছি, উত্তর পেয়েছি কাব্যে ভরা। এরপর শুধুই ব্যস্ততা! প্রচুর চাপ। আমি এম এস সি করে একটা স্কুলে চাকরি পেয়েছি। তারপর একবার আমাদের পাড়ার কয়েকজন মিলে ওদের বাড়ির সেই বাসন্তী পুজোয় গিয়েছিলাম। দেখা হলো, কথা হলো। আমরা রাতেই ফিরে এসেছিলাম। তারপর ভালো পাত্র দেখে আমার বিয়ে দিয়ে দিল বাবা মা।
    বিয়ের পর বরকে নিয়ে যখন তারাপীঠে গেছি, গাড়ি নিয়ে সোজা ওদের বাড়িতে গিয়ে দেখা করে এসেছি। অশোকদা ছিলনা। শুনলাম উত্তরবঙ্গের একটা কলেজে পড়ায়। রিসার্চ করছে।
    শুনে খুব ভালো লাগলো। আরো কয়েকটা বছর কেটে গেছে। আমি এখন মা। আমার ছেলের বয়েস দশ। দুর্গাপূজার সময় বাপের বাড়ি আসি, এবারেও এসেছি। বিজয়া সম্মেলনে চমকে উঠলাম অশোকদার নাম শুনে। গাইলো – “আমার প্রাণের পরে চলে গেল… ”
    আবার দেখা হলো। বাড়িতেও এলো। অনেক কথা হলো। আমার বরের সাথে আলাপ করলো।
    অবাক হলাম বিয়ে করেনি শুনে। একা কথা বলার অনেক সুযোগ পেয়েছিলাম কিন্তু অশোকদা তো শুধুই আমার ছেলের সাথে খুনসুঁটি করতেই ব্যস্ত!
    সামনেই মায়াপুরের রাধাকৃষ্ণর বিশাল ছবিটার দিকে তাকালাম। মন যেন নির্দেশ
    পেল — এই তো একটা সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক!! কি লাভ!! এখন আর বিব্রত করে বা বিব্রত হয়ে। যে কথা সময়ে বলা হয়নি, আজ আর তা বলতে চাইনা!

  • কবিতা

    কবিতা- বর্ষ বরণ

    বর্ষ বরণ
    -শিলাবৃষ্টি

     

     

    বঙ্গের হল বর্ষপূর্তি
    বিদায়ী সম্ভাষণে,
    আকাশের আলো আজ বড় কালো
    বিদায় সন্ধিক্ষণে।
    এসো তুমি এসো আগামী বর্ষ
    আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে,
    দু’হাত পেতেছি মনকে বেঁধেছি
    প্রবোধ বাক্য দিয়ে।
    যত কিছু আছে উজাড় করব
    নতুন বর্ষ ‘পরে
    বরণ করব আগমন ক্ষণে
    শঙ্খ বাজবে ঘরে।
    সংকট আজ চরম আকারে
    সমাজের মুখোমুখি
    মহুয়া, মলুয়া, কাজলরেখারা
    নয়তো মোটেই সুখী।
    লাঞ্ছিতা হয় বেহুলার দল,
    কাঁদে দেখো ফুল্লরা
    ভাটিয়ালি আর ভাটিয়ালি নেই
    হয়েছে সর্বহারা।
    বাউল কীর্তন হারাতে বসেছে
    নিজস্ব স্বকীয়তা;
    প্রভাব ফেলেছে সবার ওপরে-
    মার্কিনী সভ্যতা।
    চেতনায় আজ আশাবাদ রেখে
    আবার আসব ফিরে…
    নানান সুতোয় নকশিকাঁথারা
    অনেক স্বপ্ন ঘিরে।
    বর্ষপূর্তি বর্ষবরণে
    ভরসাপূর্তি হোক,
    আশা আর ভাষা থাক মোর সাথে
    সকলের শুভ হোক।।

  • গল্প

    গল্প- অ-সম

     অ-সম
    – শিলাবৃষ্টি

    সাম্যের শুরুটা হোক ছোট থেকেই। নাহলে আরো অনেক অনেক যুগ ধরে মেয়েদের কন্যা হয়ে জন্মগ্রহণের নতি স্বীকার করে যেতে হবে।
    ” কি হয়েছে? মেয়ে?” ঠাকুমার এই ভ্রু কোঁচকানো, বাবার মুখাবয়বে নৈরাশ্য – কেন?
    কতদিন চলবে এই বৈষম্য জানি না!
    আজ আমি মিতালী বসু অনেক স্বপ্ন চোখে এঁকে ডাক্তারি পড়তে ঢুকেছি, অবসর নেই বললেই চলে!  তবু মনে এসে ভিড় করে হাজার কথা। আজ বিশ্ব নারী দিবসে উদাসী মন ফিরে ফিরে যায় শৈশব থেকে মেয়েবেলায়।
    বাবারা দু’ভাই, জ্যেঠু, জ্যেঠিমা, বাবা, মা,  ঠাকুমা আর এক বিধবা পিসিমাকে নিয়ে ছিল আমাদের বসু পরিবার। জ্যেঠিমা যখন মা হতে চলেছে বাড়িতে স্বাভাবিক ভাবেই আনন্দ এসে দেখা দিয়েছে। সকলের সাবধানতায়,  যত্নআত্তিতে দশ মাস কেটে যাওয়ার পর যখন হাসপাতাল থেকে জ্যেঠু জানিয়েছে জ্যেঠিমার পুত্র সন্তান হয়েছে, তখন ঠাকুমা ঠাকুরঘরে ছুটে গিয়ে প্রণাম করেছে। পিসিমা শাঁখ বাজিয়ে মঙ্গল ঘোষণা করেছে, আশা পূর্ণ  হয়েছে বলে ঘটা করে নারায়ণ পুজো করা হয়েছে বাড়িতে। পাড়ায় মিষ্টি বিতরণও বাকি থাকেনি। আর জ্যেঠিমার আদর এ বাড়িতে অনেক গুণে বেড়ে গেছে।
    এর দুবছর পরে আমার মা সন্তানসম্ভবা যখন হয়েছিল, তখন একই ভাবে মায়ের খেয়াল রাখা হলেও মেয়ে হওয়ার পরে মানে আমি হওয়ার পরে বাড়ির মানুষের চেহারাগুলো কেমন পাল্টে যায়।  না – শঙ্খ বাজেনি ঘরে। পাড়ার লোকের মুখ মিষ্টি করাও হয়নি। বাবার মুখেও শুনেছি হাসি ছিল না।
    তবে জ্যেঠিমা আমাকে বরণ করে ঘরে  ঢুকিয়েছিল। জ্যেঠু কোলে তুলে নিয়েছিল। আমার তিন বছরের দাদাভাই বোনকেই তার খেলার পুতুল ভেবে নিয়েছিল।
    ঠাকুমা পিসিমার কাছে উঠতে বসতে মাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছিল। মায়ের চোখের জল সেদিনগুলোয় বাবাও মুছে দিতে আসেনি।…..

    ছোটবেলা থেকেই আমি লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিলাম। সে তুলনায় দাদা সেরকম রেজাল্ট করতো না। জ্যেঠু জ্যেঠিমা দাদাকে খুব বকাবকি করতো। কিন্তু দাদা কেয়ার করতোই না। কারণটা হয়তো ঠাকুমা পিসিমার আস্কারা।

    কিছু কিছু অনুভূতি আজো বেদনাদায়ক!
    সাত সকালে দুই ভাইবোনকে মুড়ি আর রসগোল্লা দিয়ে বসিয়ে দিয়েছে পিসিমা।  দাদা আরেকটা মিষ্টি চাইলো, সাথে সাথে পেয়ে গেল। আমি করুণ চোখে তাকিয়ে থাকতাম কিন্তু পেতাম না। ঠাকুমা প্রতিমাসে তার পেনসেনের টাকা থেকে লুকিয়ে দাদার হাতে দু’শ টাকা দিত। আমি সামনে এসে গেলেও কোনোদিন দেয়নি। অথচ ঠাকুমার প্রতি ভালোবাসা আমার কমেনি কখনো।
    একবার দোলের সময় পিচকিরি এলো, বাবাই এনেছিল। দাদার পিচকিরিটা খুব সুন্দর দেখতে বড়। আর আমারটা একদম ভালো ছিল না। খুব কেঁদেছিলাম সেদিন। তাতে ভাগ্যে সবার বকুনিই জুটেছিল। দাদা কিন্তু বুঝতে শিখেছিল তখন অনেকটাই। তাই সেদিন তার ভালো পিচকিরিটা আমায় দিয়ে দিয়েছিল। বেশ জোর গলায় বলেছিল “একরকম পিচকিরি আনতে পারলে না কাকু?”
    এভাবেই মানুষ হলাম। দাদা গ্র‍্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে জ্যেঠুর ব্যবাসার দেখাশোনা করে এখন। আমি মায়ের ইচ্ছেপূরণের লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছি। আজ ঠাকুমার মুখে আমার জন্য খুশীর হাসি দেখেছি। আমিই এখন ঠাকুমার শারীরিক সুস্থতার দেখাশোনা করি। পিসিমা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে। বাবা বুঝেছে মেয়েরাও কোনো অংশে কম নয়। আর জ্যেঠু জ্যেঠিমা দাদাভাই-এর আদর ভালোবাসা আমার জীবনের পাথেয়। মা আমার আদর্শ।

  • গল্প

    গল্প- ভালোবাসার প্রলেপ

    ভালোবাসার প্রলেপ
    – শিলাবৃষ্টি 

     

     

    হাতটা কি ভীষণ নিশপিশ করছিল… কিন্ত অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল আয়েসা।
    এই ছেলেটা তাকে ডে ওয়ান থেকে বিরক্ত করেই যাচ্ছে! যেখানেই দেখে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলে চলে যায় “আই লাভ ইউ” অসহ্য লাগে।
    নতুন জায়গা। খাপ খাওয়াতে কিছুদিন লাগবে। তবে এই অতিরিক্ত ঝামেলাগুলো কাটাতে সে ভালোভাবেই জানে। এই মহেশপুরেই সে বঙ্গ বালিকা বিদ্যালয়ের বায়োলজির টিচার হয়ে জয়েন করেছে গত মাসে। চাকরিটার তার খুব দরকার ছিল। বাবার এক পরিচিতের বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হয়ে আছে। প্রতি শনিবার স্কুল করে বাড়ি যায়,  ফেরে সোমবার সকালে। এখানকার পরিবেশ বেশ ভালোই। এখনো পর্যন্ত স্কুলেও কোনো অসুবিধে হয়নি! ইলেভেন টুয়েলভের মেয়েরা তার মতো নতুন টিচারকে ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়েছে।
    শুধু এই এক আপদ রাস্তায় মাঝে মাঝেই বিরক্ত করে চলেছে। বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পথে আজ হঠাৎ বাইকটা সামনে এনে পথ আটকালো। ওর আবদার ওর সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে।  কী আশ্চর্য! পাশ কাটিয়ে যেই চলে আসার চেষ্টা করে আয়েসা হঠাৎ করেই ওর হাতটা ধরে ফেলে লোফারটা। ঝাঁকুনি দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয় আয়েসা। কঠিন দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে ওর চোখের দিকে। “আই লাভ ইউ ম্যাডাম” কী সাহস ছেলেটার! মনে হচ্ছিল গালে একটা চড় মারতে! অনেক কষ্টে রাগটা সংবরণ করে।
    খুব দ্রুত বাসার দিকে হাঁটতে থাকে। পেছনে তাকিয়ে দেখার সাহস হচ্ছে না।

    একদিন সন্ধেবেলায় ছাদে পায়চারি করছিল আয়েসা, সাথে কাকুর মেয়ে নেহাও ছিল। আয়েসার চোখ গেল গেটের বাইরে। সেই ছেলেটা বাইকে হেলান দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। নেহা এসে পাশে কখন দাঁড়িয়েছে আয়েসা খেয়ালও করেনি। “আয়েসাদি দেখো দেখো ওই ছেলেটাকে। ওই যে বাইকে…ও না পাগল হয়ে গেছে! গত বছর ওর বাবা-মা দুজনেই এক অভিশপ্ত ভাইরাসে মারা গেছে মাত্র তিনমাসের ব্যবধানে। বাবা-মা অন্ত্য প্রাণ ছিল ওর।মায়ের মুখাগ্নি করে শ্মশান থেকে ফেরার পর কেমন পাগলামি করতে থাকে। আর ও যে মেয়েটাকে ভালোবাসতো সেও সরে গেছে! শুনেছি কোনদিন খায়, আবার কোনোদিন খায় না।”
    আয়েসা অবাক হয়ে যায় সব শুনে। বলে “ওর বাড়িতে আর কেউ নেই?”
    “কাকারা আছে। ওরা খুব একটা সুবিধের নয়।”
    “ও…” আয়েসার কপালে ভাঁজ পড়ে।
    “জানো আয়েসাদি, ও খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিল। জয়েণ্টে খুব ভালো রাঙ্ক করেছিল।”
    “ও কি চাকরি করতো?”
    “না না এম টেক করছিল। লাস্ট ইয়ার। তবে বোধহয় পড়া ছেড়ে দিয়েছে” নেহা উত্তর দেয়। আয়েসা আবার তাকায় রাস্তার দিকে। দেখতে পায় না ছেলেটাকে।
    “ওর নাম কি নেহা?”
    ” ময়ূখ… ময়ূখ মুখার্জি… “
    চমকে ওঠে আয়েসা। এ নামটা তো একদিন তার ধ্যান জ্ঞান ছিল! সে মুসলিম বলে সম্পর্কটা টেকেনি।

    মাস খানেক কেটে গেছে এরপর। রাস্তায় কেউ আর বিরক্ত করে না আয়েসাকে। তবু কেন দুটো চোখ কাউকে খুঁজে বেড়ায় বোঝে না আয়েসা।
    পুজোর ছুটি কাটিয়ে আয়েসা ফেরে মহেশপুরে। আবার সেই রুটিন মাফিক জীবনের স্রোতে ভেসে চলা! স্কুল থেকে ফিরে কাকিমার ডাকে খাওয়ার টেবিলে গিয়ে বসলো আয়েসা।
    “মা আমিও একটু চা খাবো।” বলেই নেহা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো, “জানো মা, আজ নাকি ময়ূখদাকে কলকাতার মেন্টাল হসপিটালে পাঠিয়ে দিচ্ছে ওর কাকারা! বুবুন বলছিল ফোনে।”
    ” কি!” আয়েসা চমকে যায় কথাটা শুনে।
    “হ্যাঁ গো আয়েসাদি। ও নাকি বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে! এখন আর বাইরে বেরোয় না।
    বাড়িতে একটা ঘরের মধ্যেই বসে থাকে!” কাকিমাদের দয়ায় যেটুকু জোটে তাও আর খায় না।” নেহার কথা না শেষ হতেই আণ্টি বলে ওঠে –
    “খুব ভালো ছেলে ছিল! শুনলেও কষ্ট লাগে। আসলে ও সব হারিয়ে ফেলেছে। ভালোবাসা দেওয়ার কেউই নেই! “
    আয়েসার গলা দিয়ে খাওয়ার নামছে না আর। কানের পর্দায় এসে আঘাত করছে দুটো কথা – আই লাভ ইউ। আমাকে একটু ভালোবাসা দেবে ম্যাডাম?….

    না আর দেরি করা যাবে না। উঠে দাঁড়ায় আয়েসা। “নেহা আমাকে একটু নিয়ে যাবে ওদের বাড়িতে?”
    আণ্টি বলে ওঠে “সেকি! কিছুই তো খেলে না মা… “
    “আণ্টি আমি একবার শেষ চেষ্টা করে দেখি…”

    বাড়ির বাইরে একটা কালো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। পাড়ার লোকেরা বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে চাপা আলোচনায় মত্ত।
    মেন্টাল হসপিটালের ড্রেসপরা চারজন লোক প্রায় টানতে টানতে ময়ূখকে গেটের বাইরে আনছে। ময়ূখ কিছুতেই বাড়ির বাইরে আসতে চাইছে না। চিৎকার করছে
    ” মা মাগো….. আমি যাবোনা মা। বাবা…. বা বা গো… “
    জোর করে ওরা টেনে আনার চেষ্টা করছে কিন্তু ময়ূখ গ্রিলটা সবলে হাতের মুঠোয় আটকে রেখেছে। পায়ে পায়ে আয়েসা এগিয়ে যায়।
    “থামুন আপনারা। ও কোথাও যাবে না “
    সবাই অবাক হয়ে আয়েসার দিকে তাকায়।ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে – “মানে? তুমি কে ওকে আটকানোর?”
    “আমি এখানকার গার্লস স্কুলের টিচার! আর তার থেকেও বড় পরিচয় আমি ময়ূখকে ভালোবাসি। আর মোয়ূখও আমায় ভালোবাসে। তাই না ময়ূখ? একবার বলো সবার সামনে…”

    ময়ূখ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আয়েসার দিকে। আয়েসা ময়ূখের গালে হাত রাখে। ময়ূখের দুচোখে জলের বন্যা। ও কাঁদছে। ভীষণ কাঁদছে। আয়েসা চারজন স্টাফকে বলে “আপনারা ফিরে যান প্লিজ, মেন্টাল ট্রিটমেন্ট-এর ব্যবস্থা আমি-ই করবো। আজ থেকে ময়ূখের সমস্ত দায়িত্ব আমার।”

  • কবিতা

    কবিতা- আমাদের সেদিন

    আমাদের সেদিন
    -শিলাবৃষ্টি

     

     

    মাগো আমার সরস্বতী!
    লিখব তোমায় কিছু-
    গোপন কথা লিখতে বসে
    তাকিয়ে নিলাম পিছু।
    গেছে চলে যেদিনগুলো
    তুলনা তার নেই
    অনেক কথা মনেও, তবু
    হারিয়ে ফেলি খেই।
    নিজের হাতে পূজো করা
    ফুল চুরিতেই মজা,
    কাগজ কেটে সাজিয়ে ফেলা
    খুশির আমেজ খোঁজা।
    যেইনা হলাম একটু বড়
    বিদ্যালয়ের ভার…
    উৎসাহ আর উদ্দীপনা
    নেই উপমা তার।
    সেই কটা দিন মুক্তি ছিল
    উধাও বাধা ধরা
    হলুদ শাড়ী , ছোট্ট টিপে
    মনটা কেমন করা।
    পাশের স্কুলের আসত ছেলে
    আড় চোখে যেই চাওয়া
    কেমন যেন ভালো লাগা
    অল্প খুশি হওয়া।
    সংস্কৃতি আর পূজন ভোজন
    ভালোবাসায় উজাড়…
    খিঁচুড়ি আর বাঁধাকপি
    মিষ্টি কয়েক ভাঁড়।
    স্কুলে স্কুলে চলতো লড়াই
    কাদের ঠাকুর ভালো!
    বিসর্জনে বাস ভর্ত্তি
    হাজার রকম আলো।
    আজও আছে ঠাকুর পুজো
    আজও হলুদ শাড়ী,
    বন্দনা আজ প্রতি পাড়ায়
    বোধহয় প্রতি বাড়ি।
    তবু কোথাও কমতি আছে
    সেকাল একাল মিলে
    ভালোবাসার বদলেছে রঙ
    মনের গরমিলে।
    পূজোর মজা অনেকটা ম্লান
    মোবাইলের যুগে,
    সবাই কেমন যন্ত্র মানব…
    খেলছে অনুরাগে।
    হারিয়ে গেছে সেদিন গুলো
    হারিয়েছে সে মানুষ
    বদলে গেছে প্রজন্ম সব
    ছেলে খেলায় বেহুঁশ।

You cannot copy content of this page