• কবিতা

    কবিতা- যদি

    যদি
    -শুক্লা রায় চৌধুরী

     

     

    আমার কলঙ্ক যদি দেই তোমায় দু’হাত ভরে-
    পান করে হবে কি তুমি নীলকন্ঠ!
    অমৃত ভান্ড উপুর করে দেবে কি আমায় সুধা?
    নাকি গরল স্নানে সিক্ত করাবে আমার শরীর!

    আমার ইচ্ছে পাখিটা যদি তুলে দিই তোমার হাতে-
    যত্নে লালন করে রাখবে সোনার খাঁচায়!
    সোহাগ ভরে শুনবে তো তার মধুর কুহুতান?
    নাকি ঘৃণার নাগপাশে স্তব্ধ করবে শ্বাস!

    আমার সুখ চাবির ভার যদি দিই তোমার কাঁধে-
    আলোর ঝর্ণায় ধুয়ে দেবে মনের শ্যাওলা!
    আগলে রাখবে কি জিয়ন কাঠি ছুঁয়ে?
    নাকি কাঁটার তার ছুঁড়ে করবে রক্তাত্ব!

    আমার একাকীত্ব দিই যদি তোমায় ভাগ করে নিতে-
    বুক জুড়ে আগলে রাখবে তো সুখ বাসরে!
    স্মৃতির পাতায় গাঁথবে কি হাজার রঙিন স্বপ্নে?
    নাকি ভাসিয়ে দেবে গহন দুখের সায়রে!

  • কবিতা

    কবিতা- শুধুই আমাকে

    শুধুই আমাকে
    – শুক্লা রায়চৌধুরী

     

     

    শুধুই আমাকে ঘিরে আছে আলোর বন্যারা,
    চুঁয়ে পড়ছে শরীর বেয়ে তাদের অস্তিত্ব;
    আলোকিত পরিসরে মাখামাখি কত স্বপ্ন
    তাদের দেখা মেলে গোপন অভিসারের রাতে।

    শুধুই আমাকে ছুঁয়ে মেলছে প্রজাপতির হাজার ডানা,
    পরাগ রেনুর তুলির টানেই অপরূপ এক সাজ;
    সে সাজ দেখার বড্ড সাধ ছিল তোমার জানি!
    কিন্তু চিতা ভস্মই পেয়েছো আমার শরীর জুড়ে।

    শুধুই আমাকে নিয়ে বেড়ে উঠছে নিষিদ্ধ প্রেম,
    কত অলীক হাতছানি আঁকিবুকি কাটছে চোখে;
    মিলিয়ে যাচ্ছে কল্পনার অতল সমুদ্রের গভীরে-
    অবচেতনে আবার গুটিগুটি পায়ে আছন্নতায় মুড়বে।

  • কবিতা

    কবিতা- মনের কথন

    মনের কথন
    – শুক্লা রায় চৌধুরী

    ফুরিয়ে যাওয়া ভালোবাসার দেখা যদি মেলে-
    জানতে ভুলো না কেমন করে কাটছে তার দিন;
    কত সুখ বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে ওই শরীর!
    বিবাদহীন দুপুর আজও কি যায় আলস্যে গড়িয়ে?
    কনে দেখা আলো লুকোচুরি খেলে সে জানলায়!
    রাতজাগা চোখে এখনও চলে কি ঘুমের ওই পাহারা?
    আচ্ছা সরলীকরণ করা গেছে জটিল কাটাকুটির অঙ্ক?
    নাকি সব মিলেমিশে একাকার ভুলের সেই খাতায়!
    তবে আমার কিন্তু বেশ ভালোই বয়ে চলে সময়,
    তাচ্ছিল্য আর অবহেলা, সে তো এখন অভ্যাসের দাস;
    সুর হারিয়ে কত বেসুরো রাত ঝরে পড়ে আঙুল গলে-
    শুকিয়ে যাওয়া কান্নার দাগও ভুলে বিবাগী কোন এক পথে;
    প্রতি রাতে আলতো হাতে যন্ত্রণার লালন করি বুকের খাঁচায়,
    মনখারাপি-বিকেল পেয়ালায় স্তরে স্তরে জমা হয় অভিমান;
    অতীত স্মৃতি আস্তে আস্তে জাঁকিয়ে বসছে আমার মজ্জায়,
    বিশ্বাসের ঘরে অন্ধত্বের চাবুকে ক্ষত বিক্ষত হয় মন।

  • কবিতা

    কবিতা- পাগলিনী মা

    পাগলিনী মা
    -শুক্লা রায়চৌধুরী

     

     

    পৃথিবী ঘুরছে আজ বিবর্তনের পথে,
    এক একটা ঘূর্ণনে খসে পড়ছে তার চেহারা-
    পাল্টে যাচ্ছে দিনলিপি নিজের তাগিদেই।
    সমাজের বায়োস্কোপে ফুটে উঠছে নাট্যরূপ-
    ক্রুর হাসির রেখা খেলে যায় হিংস্র চোখে,
    সে রাজপথে হেঁটে যায় বিবস্ত্র পাগলিনী;
    তোমার খেয়াল শুধুই তার শরীর জুড়েই।
    বুভুক্ষু চোখের লালসা উপেক্ষা করেই তার দিন যাপন-
    পরনের সুতো জোগাড়ের তাগিদ নেই কোনো,
    শুধুই খাবারের খোঁজ চলে আস্তাকুঁড়ের ময়লা ঘেঁটে;
    না, এ খোঁজ শুধু আপন উদর পূর্তির নয়!
    কোলের শিশুটার মুখে তুলে দেওয়ার চেষ্টা মাত্র,
    যাকে দেখলে, নাক সিঁটকে মুখ ফিরিয়ে নাও!
    ফেলে রাখা অবহেলা মেখেই বাড়তে থাকে সেই শৈশব;
    শুকনো মুখে তাকিয়ে দেখে নিষ্ঠুর কত উল্লাস-
    তার চোখে তো ভাসে কান্না ভেজা মায়ের মুখ।
    অচেনা কামুকের উদ্দামতায় বীজ বপন মাতৃ গর্ভে,
    কোন এক ঝড়ের রাতেই অবাক পৃথিবী দেখে ছিল-
    পরিবর্তন আজকাল ধরা দেয় তার শরীর জুড়েও;
    কাঁচের ফালা টুকরোটা তাই বুকে করে এক অনন্ত অপেক্ষা,
    পাশবিক যন্ত্রনা যাতে মিশতে না পারে ছোট্ট শরীরে;
    এ শিশুও যে ধরা পড়বে তোমার চোখে যৌন উদ্দীপক হয়েই!

  • কবিতা

    কবিতা- কি দিতে পারো আমায়

    কি দিতে পারো আমায়
    – শুক্লা রায়চৌধুরী

     

     

    আমায় একটু বাতাস দিতে পারো?
    ফুসফুসে ভরে বাঁচবো কিছু দিন;
    সোঁদা মাটির গন্ধ মেখে মৃন্ময়ী হয়ে –
    তোমার হাতে ধরা দেই যদি?
    ফিরিয়ে দেবে কি আমায়!
    নাকি সেই হারিয়ে যাওয়া প্রেমের বাঁধনে –
    ওই পুরুষালি পাঁজরে বেঁধে রাখবে!

    আমায় একটু জীবন দিতে পারো?
    সঞ্জীবনীর টানে ভাসবো সুখ চাবি ছুঁয়ে।
    আমার করেই খুঁজে পাবো কি তোমায়?
    ভালোলাগার নেশায় কাটাবো –
    ভীষণ প্রিয় একটা রাত!
    আড়মোড়া ভাঙা রোদের আলতো চুমু-
    একটা একটা করে স্বপ্ন রাঙাবে।

    আমায় একটু আগুন দিতে পারো?
    তোমার জমানো অভিমান পুড়িয়ে-
    কষ্টি পাথরে সাজাবো আমার জগৎ।
    আবার নিভিয়ে দেবে কি আমায়?
    নাকি অদম্য উষ্ণতায় ভরিয়ে-
    শুরু করবে এক নতুন অধ্যায়ের;
    মিষ্টি সোহাগে জাগবে সেই আনকোরা প্রেম।

  • অণু কবিতা

    অণুকবিতা- সংস্কারের গপ্প

    সংস্কারের গপ্প
    – শুক্লা রায়চৌধুরী

    আমায় ঘিরে বাড়তে থাকে এক ঘুন ধরা পাঁচিল,
    অধমুখী মনের গভীর সে জাল বড়ই জটিল;
    সোঁদা শ্যাওলায় ঢাকা পরে আলোর ওই উৎস,
    সভ্যতার ইতিহাস হয়ে ওঠে বড়ই বেরঙ্গীন ক্ষুদ্র;
    অন্ধ বিশ্বাসের কাটাকুটি খেলায় সতীর সহ মরণ,
    সংস্কারের ছলে কেবল চলে মানের অপহরণ;
    ভাঙুক এই গোলোক ধাঁধা হয় যদি চির ক্ষয়,
    কু এর ঘরে তবেই হবে সু এর বিরাট জয়।

  • কবিতা

    কবিতা- রাতের গল্প

    রাতের গল্প
    – শুক্লা রায় চৌধুরী

     

     

    রাতের ঘুম ভাঙানি গান শুনেছো কখনো?
    নতুন সে সুর সাধে তারা আমার জন্য অবিরত;
    ভীষণ চেনা আঁধার বিন্দু জড়িয়ে গায়ের চাদরে,
    আলোর মালা জোনাকি সাজায় আগলে রেখে আদরে;
    স্বপ্ন ভারী চোখের পাতায় তারার অঢেল গল্প,
    কার্নিশ ছোঁয়া জমাট কালোর গোপন সে প্রেম অল্প;
    রজত সায়রে সিক্ত শশীর অপরূপ শোভা সাজে,
    নিবিড় তমসা ঘনায় যখন কৃষ্ণ সোহাগ জাগে;
    মেঘের মুখোশ আড়াল করে দিনের দারুণ প্রকাশ,
    একলা রাতের মুখ লুকানোর নেই কোনো অবকাশ;
    অশ্মমেধের হোমের আগুন রবির তেজে বাড়ে,
    অন্ধ ছায়া ছাইলো চোখে দিগন্ত পাড়ের পরে;
    চির শান্তির অসীম খোঁজে অমোঘ ঘুমে ডুব,
    অবাধ শর্বর আছে বলেই নতুন ভোরের এতো সুখ।

  • গল্প

    গল্প- হারানোর ভয়

    হারানোর ভয়
    – শুক্লা রায় চৌধুরী

     

     

    বাথরুমের কল থেকে সারা সকাল টুপ টুপ করে জল পড়েই যাচ্ছে। মনের গভীরের সেই যে গোপন ক্ষতটা থেকে যেমন ক্ষরণ হয় ঠিক তেমন করেই। না আর এই ভর সন্ধ্যে পর্যন্ত শুয়ে না থেকে উঠে ঘরের লাইট জ্বালালাম। অন্ধকার ঘরটা সাদা আলোয় ভেসে যেতে শুরু করলো সাথে সাথেই।জীবনের সব অন্ধকার পর্যায়গুলো যদি ঠিক এমন করেই আলোয় ভাসানো যেত বেশ হত তবে! দূর এসব ছাইপাশ ভেবে কাজ নেই।দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। চেনা শহরের এই অচেনা রূপ দেখে মনটা আরও ভারাক্রান্ত হতে শুরু করলো। এখন প্রায় পৌনে সাতটা বাজে। বাড়ি ফিরতি মানুষের ভিড় উপচে পড়ার কথা রাস্তায়! কিন্তু এখন কেমন শ্মশানের নীরবতা নিয়ে একলা পড়ে আছে পিচ কালো রাস্তাটা। শরীরটা ক’দিন ধরে ভালো না। চুল ওঠা, পায়ের মাসেলে অসম্ভব ব্যথা; সাথে বমি ভাবটাও আরো বাড়েছে। এখন ছয় মাস চলছে আমার। এত নেগেটিভ চিন্তা আমার আর আমার ভিতরে বেড়ে ওঠা ছোট্ট প্রাণের জন্যও একদমই ঠিক না। নীপা খুব বকে আমাকে এই কারণে। আমি সত্যিই চাই না এসব ভাবতে কিন্তু কেন যে মাথায় চলে আসে? নীপা সকালে বেরোনোর আগে বললো কাল ডক্টরকে ফোন করবে বলবে আমার প্রব্লেমগুলোর কথা। এখন এই পরিস্থিতে ডক্টর চেম্বার করছেন না ঠিকই কিন্তু অসুবিধা হলে ফোনে জানাতে বলেছেন।আজকের রাতটা গেলে বাঁচা যায়। কাল সকাল সকাল নীপা ফিরলে ফোন করে সব অসুবিধার কথা জানাতে হবে ওনাকে। কিছু দিন ধরে সমস্যাগুলো বড্ড বাড়ছে আমার। ওহ্ নীপা কে? সেটাই তো বলা হলো না। নীপা আমার বোন, নাম করা কেমিস্ট। এখন এই কঠিন পরিস্থিতিতেও ওকে ল্যাবে যেতে হয়। ওর কাজটাই তো এমন। তাও আজকাল অল্টারনেট ডে করে যেতে পারছে। আমার বড্ড অহংকারের জায়গা ও। খুব খেয়াল রাখে আমার। কি খাবো, কি করবো সবটা। ও ছাড়া আমার কেই বা আছে। বাবা মা? তারা তো আমি ক্লাস এইটে পড়া কালীন গাড়ির দুর্ঘটনায় দুজনেই মারা যান। তখন নীপা ফোরে পড়ে। বাবা একটা কোম্পানির হেড সুপারভাইজার ছিলেন। তাই আমাদের টাকা পয়সার সম্যসা হয়নি তেমন কোনোদিনই। আমাদের এক দূর সম্পর্কের মাসি আমাদের কাছে থাকতেন, আমরা মিষ্টি মাসি বলতাম, মাসি আমাদের বড় করে। মিষ্টি মাসিও দুই বছর আগে ছাদে জামা কাপড় তুলতে গিয়ে স্ট্রোক হয়ে মারা যায়।আমরা টের পাই কলেজ থেকে ফিরে আসার পর। মাসি চলে যাওয়ার পর বড় একলা হয়ে গেছিলাম। তখনি আমার জীবনে আসে সেই মানুষ। মানুষ বলা বোধয় ঠিক হলো না! হ্যাঁ, নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলাম অবিনাশকে। বিয়ের পর আমুল বদলে যেতে দেখলাম চোখের সামনে ভীষণ চেনা মানুষটাকে একটু একটু করে। রোজ রাতে শুরু করতো অমানবিক অত্যাচার। আবার নিজে পরে আদর করে কাছে ডেকে নিত।ওর যে মানসিক রোগ ছিল এটা আমি বুঝিনি। মার ধর করে আবার নিজে ওষুধ লাগিয়ে দিত। রাত বাড়লে এখনো আমার ত্রাস শুরু হয়। দেড় বছর সংসার করতে পারলাম, হয়তো বলা ভালো চেষ্টা করছিলাম সংসার করার। হাল ছেড়ে চলে আসার পর বুঝলাম আমার শরীরের মধ্যে বাড়ছে একটা ছোট্ট ভ্রূণ। নীপা চায়নি আমি ঐ অমানুষের চিহ্ন বহন করি। অনেক করে বোঝালাম ওকে। আমার জীবনে কি আছে আর।
    যে আসছে ওকে নিয়ে বেঁচে থাকব বাকি জীবনটা। না হয় গানের স্কুল খুলবো। তাতে চলে যাবে মোটামুটি। আমার কথা বুঝবে না আমার ছোট্ট নীপা সে আবার হয় নাকি! মেনে নিল নীপা। এত কিছু বললাম আমার নামটাই বলা হলো না তো! আমি দীপা, মনিদিপা রায়।
    এসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন একটা ঘোরের মত এসে গেছিল। সম্বিৎ ফিরলো মুঠোফোনটা বেজে ওঠায়। তাড়াহুড়ো করে লিভিং রুমের দিকে যেতে গিয়ে হোঁচট খেলাম। আবার সেই বাজে গন্ধটা। সারাদিন পাওয়া যায়না। তিন দিন হল দুপুরের পর থেকে বাড়তে থাকে। সহ্য করা যাচ্ছে না এই গন্ধ। না চাইতেও সোফার দিকে চোখ গেল।ফ্ল্যাশ ব্যাকের মত ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা ছবির মত একের পর এক উঠে আসতে শুরু করলো চোখের সামনে। সাতদিন আগে এরকমই এক সন্ধ্যে বেলায় তানপুরা নিয়ে বৃন্দাবনী সারং এর সুর নিয়ে খেলছিলাম।ঠিক তখনই ফোনটা আসে। ফোনের ও পাশ থেকে রোজের মত নীপা- “কি করছে আমার দিপু ডার্লিং? রেওয়াজ নিশ্চয়ই!”
    -“তোর ফাজলামি আর গেল না? তুই আমাকে বড্ড বুঝিস রে সোনা।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম “ঘরবন্দি হয়ে আর ভালো লাগছে না; তাই গান নিয়ে বসলাম। বাইরে দাঁড়িয়ে অচেনা শহরটাকে দেখছিলাম রে। কি যে হয়ে গেল।”
    -“বুঝতে পারি তোকে দিভাই কিন্তু তোর মতন করে বোঝাতে পারি না আমার কথাগুলো।” নীপা মাঝে মাঝে এমন কথা বলে আজকাল আমি বুঝি না। অনেক বড় হয়ে গেছে বোনটা।
    স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই বলে ওঠে নীপা “হরলিক্স খেয়েছিস? “
    আমি বললাম “তোকে বলছিলাম না হরলিক্সের টেস্টটা কেমন যেন রে? একদম খেতে ইচ্ছে করে না। তাও খেলাম জোর করেই। না হলে তোর বকুনি খেতে হবে যে।”
    -“বেশি করে নিয়ে খা দেখবি ভালো লাগবে টেস্ট। তোর এমনিতেই কিছুই ভালো লাগে না আজকাল। আমাকেও লাগে না হয়তো” – অভিমানী সুরে বলে উঠলো নীপা।
    -“কি যা তা বলছিস? তুই ছাড়া কে আছে আর? আচ্ছা শোন কাল ডক্টরকে ফোন করতে হবে। আমার প্রব্লেমগুলো খুব বাড়ছে রে। আর পারছিনা। হাঁপিয়ে যাচ্ছি গান করতে গিয়েও। এখন রাখছি পরে কথা বলছি।”

    ফোনটা রেখে তানপুরা পাশে সরিয়ে রেখে কোনো রকমে টয়লেটে গিয়ে বমি করলাম। চোখে মুখে মাথায় জল দিলাম।টাওয়েল দিয়ে মুছতে গিয়ে দেখি এক দলা চুল উঠে এলো।বুকের পাশের চিনচিনে ব্যথাটা কেন যেন বাড়তে শুরু করছে। কোনো রকম গিয়ে শুয়ে পড়লাম ড্রয়িংরুমে রাখা সোফাটার উপর। কি অসহ্য কষ্ট হচ্ছে!কেন হচ্ছে এরকম। নীপাকে ফোন করে আসতে বলতে হবে। কোনো রকম ফোন নিয়ে ফোন করতে যাব নীপাই ফোন করলো।
    -“নীপা খুবব কষ্ট হচ্ছে। তুইইই আয় প্লিজজজ। ডক্টরকে ফোন কর। আমি.. আমি আর পার….ছি না না।” ফিসফিসিয়ে বলে উঠলাম। নিজের গলা নিজেই চিনতে পারছিলাম না। ফোনের ওপাশ থেকে নীপা কেঁদে বলে উঠলো।
    -“আমার খুব কষ্ট হয় দিভাই। তুই আমাকে কোনো দিন ভালোবাসিস নি। তাই তো আমার কথা না ভেবে ওই অবিনাশের কাছে ছুটে গেছিলি। আবার ওর দেওয়া বীজ নিয়ে ঘুরছিস। তাকে আনবি পৃথিবীতে? আবার আমাকে একা করে ওকে নিয়ে মেতে থাকবি। না আর সহ্য করতে পারবো না।তাই তো দুজনকেই একসাথে — “
    -“তোর কথা কিছু বুঝতে পারছি না। আমার সামনে সব ঘোলা হয়ে আসছে তুই আয়” জানিনা কথা শুনতে পেল কিনা ফোনটা কেটে গেল।
    হ্যাঁ, নীপা এসেছিল অনেক রাতে। সোফার উপর রাখা আমার নির্জীব শরীরটা ধরে পাগলের মত কাঁদলো। কি সব বলে যাচ্ছিল নিজের মনেই। প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না তখন। কিন্তু রোজ এই একই ছবি চলতে থাকে সন্ধ্যের পর থেকে আমার সামনে।এখন বুঝতে পারি সব ও কি বলছিল সেদিন। মুখস্থ হয়ে গেছে সব চিত্র নাট্যের মতই। হরলিক্সের মধ্যে থিলিয়াম সল্ট মিশিয়ে দিয়েছিল নীপা নিজের হাতে করে, যাতে আমি আর ভিতরের ছোট্ট প্রাণটা আসতে আসতে চির ঘুমে ঘুমিয়ে পড়তে পারি। এখন যা বিভীষিকাময় পরিস্থিতি বাইরে কেউ কারো খবর রাখে না। এর থেকে আর ভালো সময় হয় না। তাই আমি আছি কি নেই কে খবর রাখবে। যে রাখতো সেই তো নিজে হাতে করে শেষ করলো। কি একটা ক্যেমিকাল দিয়ে আমার শরীরটাকে রেখেছে যাতে তাড়াতাড়ি পচন না ধরে। অবিনাশকে নীপা পছন্দ করতো না বুঝতাম কিন্তু এত রাগ যে, ওর চিহ্ন মুছতে আমাকেই মুছে দিল! আমার জীবনে প্রথমে আবিনাশ আসাতে ও ভেবেছিল ওর জায়গা হারিয়েছে।কারণ মা বাবা যাওয়ার পর আমাকে আঁকড়েই বেড়ে উঠছিল ছোট্ট নীপা। আমিও বুঝিনি যে কখন অজান্তে ওকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম। অবিনাশ আসাতে আমার জীবন কেমন রঙিন হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। বুঝিনি সবটাই ভুল ছিল। তাই নীপাকে একা রেখেই বিয়ে করে নিয়েছিলাম মন্দিরে গিয়ে। বিয়ের প্রথম ছয় মাস খবরও নিইনি বোনটার। বিয়ের যে মোহ কাটতে সময় লেগেছিল ওই ছয়মাসই। বাকি দিনগুলো চেষ্টা করেছিলাম যদি সংসার করতে পারি। অবিনাশের ছিল টাকার লোভ আর বিকৃত চাহিদা। ওর কবল থেকে বাঁচতে নীপার কাছেই আবার ছুটে আসি। তখন নীপা অনেক আগলেছে আমাকে।অবিনাশের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাও ওই নিয়েছে। না হলে হয়তো ওই কটা দিনও বাঁচা হতো না আমার। কিন্তু যখন বুঝলো আমি মা হব আবার আমাকে হারানোর ভয়ে পাগল হয়েই হয়তো শেষ করে দিল ওর প্রিয় দিভাইকেই।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প – মনের গভীরে

    মনের গভীরে
    – শুক্লা রায় চৌধুরী

     

     

    গরম কফির মগ হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে বসে কুয়াশা ঘেরা পাহাড় দেখতে ভীষণ ভালো লাগছিলো রাইয়ের। কোলাহল বর্জিত এমন একটা নির্বাসন চাইছিল বহুদিন ধরেই।শুধু হাওয়ার আওয়াজ খেলে বেড়াচ্ছে সামনের পাহাড়ের ঢালগুলো বেয়ে, সাথে পাখির কিচিরমিচির। প্রাণ মন সব জুড়িয়ে যাচ্ছে। কত না বলা কথা আছে নিজেকে বলার; এখনই বলে নিতে হবে না হলে আবার ও চলে আসবে, কিছুই বলা হবে না তখন। এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ করে সব চোখের সামনে ঘোলা হতে লাগলো? পাখির কুজন এখন হাহাকার হয়ে বিঁধছে কানে।উফঃ কি কষ্ট। মিশকালো অন্ধকারের পর্দাটা ছিঁড়ে আলো আসতে শুরু করছে। তার মানে আবার সেই কদর্য মানুষটা আসছে! ঠিক তাই ! সারা গায়ে রক্ত মেখে দাঁত বার করে হাসছে বিকাশ রোজের মত। এখনই ওই নোংরা হাতে আমাকে ছোঁবে। খুবলে খাবে আমাকে তিলে তিলে। তারপর আস্তে আস্তে মিশে যাবে আমার মধ্যে। আমি আর ও আলাদা থাকব না, এক হয়ে যাব রোজের মত।
    ‘ মিস দত্ত মিস দত্ত, তাকান। এই তো তাকাচ্ছে।’
    চোখ খুলে নিজেকে পাহাড়ের এক জঙ্গলে খুঁজে পেল রাই।
    “কেমন লাগছে এখন? আরে ভয় পাচ্ছেন কেন? আমি বিকাশ নই, ডক্টর দাস। বিকাশ আপনার মনের তৈরি করা মানুষ ছাড়া কিছু না। আপনি এটা যত বুঝতে পারবেন ততো তাড়াতাড়ি সেরে উঠবেন।”
    কথার উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা নেই রাইয়ের খুব ক্লান্ত লাগছে রোজের মতই। ঘরে ফিরে লম্বা একটা ঘুম চাই ওর। কালকে আবার এই একই ঝড় বইবে। ডক্টর দাসের কথা খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে কিন্তু বিকাশ যে আছে; রোজ আসে ওর কাছে সেটা কেউই বুঝবে না।

  • কবিতা

    কবিতা- শেষ সময়

    শেষ সময়
    – শুক্লা রায় চৌধুরী

     

     

    নিঙরে নেওয়া আলোর মাঝে
    জগৎ-জোড়া কালোর বাস,
    দেখবো নাআর সিগ্ধ সকাল-
    থাকবে শুধুই ক্ষণিক শ্বাস।

    মায়ার বাঁধন ছিঁড়ছে না তাই
    উথাল পাথাল মনের ঢেউ;
    চলছি আমি ঘুমের দেশে-
    একলা পথে নেইতো কেউ।

    স্তব্ধতা আজ বিপুল হয়ে-
    ঘিরছে আমার চারিপাশ,
    হিসেব সকল মিটল এমন-
    গোলক ধাঁধাঁয় অস্তরাগ।

    ঝাপসা হওয়া মুখগুলো আজ-
    ছোঁয়ার সীমার বাইরে যেই;
    দলা পাকানো কান্না জমে-
    হারবো জেনেও যুদ্ধ সেই।

    খালি হাতেই ফিরতে হবে-
    সময় কাঁটা দিচ্ছে পাক;
    বাঁধা আছে কঠিন নিয়ম,
    আসবে না আর নতুন বাঁক।

You cannot copy content of this page