কবিতা

  • কবিতা

    কবিতা- অচেনা

    অচেনা

    তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়

    কতো কতো চেনা মুখ,
    চেনা কতো কতো নাম,
    ভুলে যাওয়া নাম হয়ে,
    ভুলে যাওয়া মুখ হয়ে,
    অচেনার মত স্মৃতিতে হারায়।
    কেউ আর খোঁজ রাখে না তাদের…
    মনে আর পড়ে না তারা।

    সময় ব্যস্ততা দিয়ে মুছে দেয় অতীতকে।
    হয়তো বা অতীত নিজেই নিজেকে দেয় মুছে।

    ভেবে দেখি,কতকাল নিজেরই নিজেকে হয়নি যে খোঁজা।
    ডাকনামগুলো আজ অচেনা।
    এলোমেলো হাওয়া,
    ঝরে যাওয়া পাতা,
    শুধু জুড়ে থাকে মনে…অচেনার মত।

    কখনও অলস সময় ছায়াময় মায়াতে জড়ায়।
    স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে আবছা আলোয় হারানো সে মুখ।
    মনে পড়া কথাদের ভিড়ে ব্যথারা ছোঁয়াচে।

    স্মৃতির মিনারে স্বপ্ন আটক।
    উথাল-পাথাল মন সুখের আশায়,
    সাজায় রঙীন ছবি…ছেঁড়া মাস্তুলে।
    সময় ফুরোলে, ফেরার সময় হ’লে,
    একা মন হিসেব মেটায়।
    লিখে রেখে যায় নতুন দিনের গান।
    জল থইথই চোখে, ধুলোমাখা পথে
    হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত চরণ,
    বিশ্রাম চায়।
    অনন্ত বিশ্রাম।।

  • কবিতা

    কবিতা- জীবন-কথা

    জীবন-কথা
    -সুমিত মোদক

    কেউ কাউকে সে ভাবে মনে রাখে না;
    প্রয়োজন ছাড়া কেউ কাউকে মনে রাখে না;

    গ্রামের পূর্ব দিক দিয়ে একটা মাটির পথ
    মাঠের মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছিল
    দূরের আরেক গ্রামে়;
    দিনের পর দিন সে ভাবে কেউ
    হাঁটাচলা না করতে করতে
    এক সময় সেটি যেন কোথায় হারিয়ে গেল;
    কত সহজেই ভুলে গেল সে কথা;

    পথ হারায়, কথারা হারায়, হারায় নিজেদের;
    কেবল মাত্র পড়ে থাকে মৌনতা;
    বাবা চলে যাওয়ার পর বাড়ির বারান্দাও
    ছোট হয়ে গেছে খুবই তাড়াতাড়ি;
    কাটা পড়েছে বাবার হাতে বসানো গাছগুলো,
    সম্পর্ক সকল;

    আকাশ পথ ধরে উড়তে উড়তে উড়তে উড়তে
    প্রচণ্ড গরমে এসে হাজির চাতক পাখি;
    বার বার ডেকে যায় …
    বৃষ্টির জল চায় …
    ঠিক যে ভাবে আমি বা আমরা চেয়ে থাকি
    আরও অনেক কিছুর পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে;

    কেউ কাউকে নিঃস্বার্থ ভালবাসে না;
    দেয়াও না কিছু;
    সবটুকুই রঙ মেখে অভিনয় …
    বাহবা পাওয়া যায়, হাততালি পাওয়া যায়;
    পাওয়া যায় মিথ্যা প্রশংসা;

    একটা কালবৈশাখী ঝড় ছুটে আসছে;
    হয় তো এসব কিছু ওলোটপালট করে দেবে;
    মুছে যাবে পায়ের চিহ্নগুলি;
    তারপর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে …

    ইতিহাস একটু একটু করে তুলে নিয়ে রাখবে
    আকর-জীবন-কথা, অস্পষ্ট হৃদয় যাপন।

  • কবিতা

    কবিতা- মেয়েটা

    মেয়েটা 
    -অঞ্জনা গোড়িয়া (সাউ)

    মেয়েটা ভালো হতে চেয়েছিল।
    মেয়েটা স্বপ্ন দেখেছিল,
    মেয়েটা ভাবতে শিখেছিল।
    মেয়েটা কিছু করতে চেয়েছিল।
    মেয়েটা বাঁচতে চেয়েছিল,
    মানুষের সেবা করতে চেয়েছিল।
    মেয়েটা শতশত পুরুষের মাঝে
    মাথা উঁচু করে লড়তে চেয়েছিল।
    তবু মেয়েটা কেন হেরে গেল?
    কতগুলো নোংরা হাত তাকে ভালো হতে দিল না।
    মেয়েটার স্বপ্নগুলোকে ভেঙে মুচড়ে দিল।
    মেয়েটার দিকে এগিয়ে আসছে অসংখ্য বিষধর সাপ।
    না না হেরে গেলে হবে না।
    রুখে দাঁড়াতে হবে।
    একা মেয়েটা, বড্ড একা।
    তবু সে লড়তে চেয়েছিল।
    তবু সে কষ্ট ভুলে জিততে চেয়েছিল।
    তবু-মেয়েটা কেন হেরে গেল?
    এ হার মেয়েটার একার নয়।
    এ লজ্জা মেয়েটার একার নয়।
    মেয়েটা আর পাবে না ভয়।
    সে জিতবে, করবেই জয়।
    মেয়েটা আর কাঁদবে না
    মেয়েটা লড়বে নিজের জন্য।
    লড়তেই হবে আর সবার জন্য।
    হোক সে বড়ো ক্লান্ত।
    হোক সে একা-
    তবু মেয়েটা লড়বে।
    এগিয়ে যাবে সূর্যালোকের দিকে।
    আগামী ভবিষ্যতের অপেক্ষায়।
  • কবিতা

    কবিতা- অ-সময়

    অ-সময়
    সুমিত মোদক

    ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে অতি পরিচিত কথাগুলি;
    বদলে যাচ্ছে চেনা-জানা মানুষ, মনুষ্যত্ব;

    এক পা এক পা করে সামনের দিকে
    যারা এগিয়ে গিয়ে ছিল মৌন মিছিলে
    তারা আর ফিরে আসেনি;
    এসে ছিল একটি নিখোঁজ তালিকা;
    সে তালিকা এতটাই বড় ছিল যে,
    নামটুকুও খুঁজে পাওয়া খুবই মুশকিল হয়ে পড়ে;

    শব্দের জন্য চিৎকার,
    ভাষার জন্য উল্লাস,
    নাকি শুধুই পাপের প্রায়শ্চিত্ত!
    ঠিক বুঝে উঠতে পারে না দেহাতি মানুষ সকল;
    একটু একটু করে ভেঙে পড়ছে পুরানো স্মৃতি বিজড়িত
    ভালবাসার সৌধগুলি;

    মন খুলে কথা না বলতে বলতে কি
    মৌন হয়ে যাবে পরবর্তী সময়!
    না কি শেষ বেলায় মুখ ফিরিয়ে নেবে
    ডুবন্ত সূর্যের আলো থেকে!

    অ-সময়, তুমি কি পেয়ে গেছো অমরত্ব নিজের কাছে!

  • কবিতা

    তোমার কথা নিয়ে

    তোমার কথা নিয়ে
    -অজয় বিশ্বাস

    তুমি কথা বল না
    কথা বলতে চাও না
    বলতে পার না কথা
    অথচ একদিন তোমার কথা নিয়েই
    দিন শুরু হত
    ফুল হেসে উঠত বাগান জুড়ে
    সকালের রোদ এসে চুপিচুপি বসত
    তোমার কথা শোনার জন্য
    গালে হাত দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা
    বারান্দার কোণে চুপটি করে
    অপেক্ষা করত চড়ুই।

    নদী কত দূর থেকে বয়ে এসে
    পাড়ে থমকে যেত তোমার কথা শুনবে বলে
    ওই যে বুড়ো বটগাছ
    সে-ও কি কম লোভী ছিল!
    কান খাড়া করে রাখত
    তুমি কখন কথা বলবে…

    আর রাত হলে
    নক্ষত্রগুলো ডানা মেলে নেমে আসত
    পরীদের মত
    তোমার কথা নিয়ে স্বপ্ন বুনবে বলে
    এখনও বাতাস পাতার ফাঁকে ফাঁকে
    ফিসফাস করে
    তোমার কথা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে বলে…

    চেয়ে দেখ তোমার কথা হারিয়ে গেছে বলে
    আকাশ ঝুঁকে আছে…
    উদাসী পাখির মত
    যদি আবার ভেসে ওঠে হঠাৎ কোনো কথা….

  • কবিতা

    কবিতা- দরবার

    দরবার

    -অমল দাস

    ছুঁয়ে দেখনি আমাকে —ছুঁয়ে দেখনি বহুকাল

    এই তপ্ত মরুতে পাথর হয়ে আছি কাঁটা-ঘেরাটোপে!

    বৃষ্টির জলে শেষ কবে অমৃতের স্বাদ পেয়েছি

    মনে নেই —কবে জোছনার রাতে চৌকাঠে স্বপ্ন পুঁতেছি

    অথবা স্বপ্নের বীজ খুঁটে খুঁটে খেয়ে গেছে মূষিকের দল…

    ছুঁয়ে দেখনি আমাকে —বহুকাল ছুঁয়ে দেখনি

    আমি ছুঁতে চেয়েও ছুঁতে পারিনি পলাশের লালে নিষিক্ত রস

    কতগুলি ফাগুনের রাত হুতুমেরা উল্লাসে ছিঁড়ে ফেলে-

    অ-শৃঙ্খল বনানীর ‘পরে

    এলোমেলো উঠোনের ঘাস পিষে গেছে

    বে-ফালতু পশ্চিমি ঝড়ে,

    সমবেত সপ্রতিভ প্রতিবাদী স্বর রক্তের লালে নেয়ে

    মুছে গেছে হাতেখড়ির কালশিটে স্লেটে

    তবুও দেখনি ছুঁয়ে পোড়া পোড়া দাগ বিভেদের দ্বারে

    আমি পেনসিল হাতে নিয়ে

    ‘স্বরে-অ’, অথবা ‘স্বরে-আ’ মনে রেখেছি? নাকি!

    কবর দিয়েছি তোমার দরবারের বহু ক্রোশ দূরে!

  • কবিতা

    কবিতা- মনমোহিনী

    মনমোহিনী
    -সুবিনয় হালদার

    পুঞ্জিভূত ক্ষোভের লাভা গাদাগাদা
    তুঁষে চাপা ধিকধিকিয়ে জ্বলছিল সে বুকে-,
    নীল আকাশে তারা গুলো মিটিমিটি
    চাঁদেরহাটে ভোগবিলাসে জ্যোৎস্না মেখে-
    চুপিচুপি দিব্যি ছিলো স্বর্গ সুখে ;
    আয়েশ করে দুষ্টু ছেলে ছলেবলে-
    খাচ্ছিল পঞ্চ-ব্যঞ্জন বৃদ্ধাঙ্গুল চেটে !

    মনমোহিনী ছদ্মবেশী অমৃত কলস হাতে
    বিলিয়ে দিলো সকল সুধা নৈরাজ্যের হাটে ;
    রাহু কেতু জলের তোড়ে গেঁড়ি গেলা গিলে
    উদ্ভ্রান্ত পোষ্য স্তাবক চাটুকার পঞ্চভূতে মিলে,
    বিষিয়ে দিয়ে নিভিয়ে দিলো গোকুল অন্ধকারে !

    দাপিয়ে বেড়ায় হিংস্র প্রায় ভস্মাসুর শতশত
    সদলবলে কসাই সেজে ভালোবাসে কত
    সুযোগ বুঝে মারছে কোপ নিচ্ছে লুটে সর্বস্ব !

    আরো কতটা সময় ধরে থাকবি-রে সব নিশ্চুপ ;
    আর কতটা গভীর তলে- কালো প্রহর কামড়ে খেলে
    খুলবে তবেই সাঙ্গ প্রাণে দয়াদানের মৌন মুখ !

    চোখ চেয়ে সব অন্ধ সেজে থাকিসনে আর
    সব বুঝে সব শুনে সবাই মিছে কেন সাথ ;
    তাই চুপিচুপি শক্ত মনে চোয়াল চাপা কণ্ঠস্বর
    সমবেত পদধ্বনি বজ্র মুষ্টি আওয়াজ কর ।

  • কবিতা

    কবিতা- ইচ্ছে ডানা

    ইচ্ছে ডানা
    -গঙ্গাধর পরামানিক

    ইচ্ছে আমার পাখি হয়ে উড়বো আকাশে
    কিচিরমিচির মধুর ধ্বনি ছড়িয়ে বাতাসে,
    মাছ হয়ে সাঁতার কেটে ঘুরবো জলের দেশে
    ফুল হয়ে ভরাবো ভুবন মনোহারী সুবাসে।

    পাহাড় চিরে ঝর্ণা বেয়ে ছৎ-ছলাৎ-ছল
    আমি হব তৃষ্ণাহারী মিষ্টি নদীর জল,
    প্রজাপতি হয়ে রঙিন পাখনা দেবো মেলে
    বৃক্ষ আমি, ক্লান্ত পথিক বসবে ছায়া তলে।

    বনের রাজা সিংহ আমি গর্জনে বন কাঁপে
    নৃত্য-গীতে মন মাতাবো বন ময়ূরের রূপে,
    তাঁরা ভরা রাতের আলোয় চাঁদের মুখে হাসি
    সূর্য মাখা দিনের আলোয় স্বপ্ন-সুখে ভাসি।।

  • কবিতা

    কবিতা- ১৬ই ফাগুন

    ১৬ই ফাগুন
    -শুক্রাচার্য্য…

     

     

    বিংশ শতকের ফাগুন বদলেছে
    নবীন বহ্নির অর্ণবে…
    বাঞ্ছিত তিমিরের অভিলাষ না জানি
    অন্তরীক্ষে চাহিয়া কবে…
    বৃন্তে গাথা পরিণয়ের গল্প শিশিরের
    ন্যায় ঝরে যাবে…
    লগ্নের জাহ্নবী সায়াহ্নের তিতিক্ষায়
    মৃত্যু কে খাবে…
    তবুও রোমাঞ্চিত হবে বসন্ত তুমি!
    সেই আগের মত…
    কেন রহে আড়ালে বসন্ত অন্তরালে
    মন চঞ্চল অবিরত…
    ভালো মন্দের বাতাসে উড়িছে আকাশে
    জানা অজানা কুঞ্জে…
    শব্দে শব্দে বিমর্ষ হৃদি নিসর্গের বুকে
    ছবি আঁকে গুঞ্জে…

  • কবিতা

    গল্প- সোনার সিঁড়িতে পা

    সোনার সিঁড়িতে পা
    -সুনির্মল বসু

     

     

    তখন আশ্বিন মাস। পশ্চিমবাংলা জুড়ে দুর্গাপূজার আয়োজন চলেছে। সকালবেলায় ঘাসের উপর শিশিরের শব্দ, মাঠে মাঠে কাশফুল, আকাশে হালকা সাদা মেঘের ভেলা, দীঘির জলে শাপলা শালুক, নদীতে ভেসে যাচ্ছে গায়নার নৌকো। উদাসী প্রকৃতি। বাতাসে বাজছে উৎসবের সুর।

    তিনি ইংল্যান্ডের বিখ্যাত শিল্পপতি। দেশে-বিদেশে তাঁর অনেকগুলি শিল্প কারখানা। ভদ্রলোকের নাম, জেনাথন হকিন্স। স্ত্রী ইভা হকিন্সকে নিয়ে তিনি কলকাতার পূজো দেখতে এলেন।

    গুগল ঘেঁটে তিনি ইতিমধ্যেই পটুয়া পাড়ার শিল্পীদের খবরা-খবর নিয়েছেন।

    মধুসূদন পাল, রাখাল পাল, রমেশ পাল, শম্ভু পালদের সঙ্গে কথা বলেছেন।

    ভালো লেগেছে সাহেব এবং তাঁর স্ত্রীর।

    অবশেষে তিনি অনিল পালের দেবী মূর্তি দেখতে এলেন। তরুণ শিল্পী। কাজে অভিনবত্ব আছে।

    সাহেব প্রশ্ন করলেন, আপনি এত কষ্ট করে মূর্তি বানান, যখন এগুলি নদীর জলে বিসর্জন হয়, আপনার কষ্ট হয় না।
    অনিল পাল বললেন, কষ্টের কি আছে? আমি টাকা পাই, মূর্তি বেচি, এর বেশি আর কি!
    সাহেবের স্ত্রী ইভা প্রশ্ন করলেন, সত্যি বলছেন?
    অনিল পাল বললেন, একবার খুব কষ্ট হয়েছিল।
    হকিন্স সাহেব বললেন, কেন?
    অনিল পাল বললেন, ক্যালকাটা ফায়ার ব্রিগেডে প্রতিমা বানিয়েছিলাম। সেটা এমন সুন্দর হয়েছিল,
    আমি প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় সেই ঠাকুর দেখতে যেতাম। তারপর যেদিন আউট্রাম ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন হয়েছিল, সেদিন দূরে গাছের আড়াল থেকে
    সেই দৃশ্য দেখে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। ভাগ্যিস,
    কেউ আমাকে সেদিন দেখে ফেলেনি।
    হকিন্স সাহেব বললেন, তাহলে আপনি যে বললেন, আপনি টাকার বিনিময়ে প্রতিমা তৈরি করেন, এর বেশি কিছু নয়।
    ইভা হকিন্স বললেন, আসলে, টাকার জন্য নয়, শিল্পকে ভালোবেসে আপনি শিল্প সৃষ্টি করেন।
    অনিল পাল ধরা পড়ে গিয়েছেন, এমন মুখের ভাব করে চুপ করে মাথা নিচু করলেন।

    সেই থেকে হকিন্স পরিবারের সঙ্গে অনিল পালের একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল।

    ও দেশের মানুষ যে শিল্প সৃষ্টিকে এত মর্যাদা দেন, তিনি এবং তাঁর পরলোকগত বাবা শিল্পী কার্তিক পাল কখনো সে কথা জানতেন না।

    মিসেস ইভা হকিন্স কিছু ছোটখাটো মূর্তি নিয়ে লন্ডন ফিরে গিয়েছিলেন।

    অনিল পাল ভালো ইংরেজি জানেন না। তবুও হকিন্স সাহেবের প্রশংসার কথাগুলো মনে গেঁথে গিয়েছিল। সুপার্ব, ওয়ান্ডারফুল, বিউটিফুল, ইত্যাদি।

    ইভা হকিন্স অনিল পালের জন্য দেশে ফেরার আগে
    অনেকগুলি উপহার দিয়ে যান।

    তারপর বহু বছর অতিক্রান্ত হয়েছে।

    মৃৎশিল্পী অনিল পাল কলকাতা বিখ্যাত হয়েছেন। বিদেশেও তাঁর বানানো প্রতিমা বিশেষ সমাদর পেয়েছে।

    একদিন বার্ধক্য জনিত কারণে তিনি মারা গেলেন। বিধবা স্ত্রী জয়া আর একমাত্র ছেলে বিশ্বরূপ অথৈ জলে পড়ল।

    গঙ্গা মাটির দাম বেড়েছে, সব সময় চাহিদা মতো পাওয়া যায় না, মাসে একবার বা দুবার মাটি আসে।
    আগের বছর বর্ষার জন্য অনেকগুলো প্রতিমা শেষ পর্যন্ত বিক্রি হয়নি।

    জয়া অবশ্য সংসারটা বাঁচাবার জন্য লক্ষ্মীর পট, মনসার পট বানিয়ে বিক্রি করে কোন মতে সংসার চালিয়েছেন।

    এভাবে দারিদ্র নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। তাই বিশ্বরূপ সেদিন মাকে বলেছে, আমি এবার থেকে সোনার দোকানে কাজ নেব। এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাওয়া যায় না।

    জয়া দেবী বলেছেন, বাপ ঠাকুর্দার পেশা ছেড়ে অন্য কাজ নিবি, তা হয় না।

    শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য মা ছেলের লড়াই চলেছে।

    একদিন সকালে নেতাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে নেমেই, হকিন্স সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী ইভা সোজাসুজি উবের ট্যাক্সি করে পটুয়া পাড়ায় এসে হাজির হয়েছেন।

    অনেক বছর বাদে আবার তিনি কলকাতায় এলেন।
    অনিল পালের মূর্তি গড়ার কারখানার সামনে এসে,
    তিনি প্রশ্ন করবেন, হয়ার ইজ মিস্টার পল?
    বিশ্বরূপ কমার্স নিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পড়াশোনা করেছে। সে বলল, হি ইজ নো মোর।
    ও,আই সি। আই মিস হিম। হি ওয়াজ মাই গ্রেট ফ্রেন্ড।
    বিশ্বরূপ সাহেব দম্পতিকে ঘরের ভিতরে নিয়ে বসালো। জয়া দেবী ওদের জন্য চা বানালেন।

    বিশ্বরূপ ‌ জানালো, বাবা মারা যাবার পর ওদের বর্তমান আর্থিক দারিদ্রের কথা।

    সাহেব প্রশ্ন করলেন, হোয়ার ইজ দ্য প্রবলেম?
    বিশ্বরূপ বোঝালো, কাজের জন্য মাটি পাওয়া যায় না। প্রতিমা সাজাবার জিনিসপত্র অত্যন্ত অগ্নিমূল্য।
    প্রতিযোগিতার বাজারে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়া। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রতিমা বিক্রি না হওয়ায়, ক্রমাগত ব্যবসায়িক ধাক্কার কথা।

    জেনাথন সাহেব সব শুনলেন। বললেন, আই শুড ডু সামথিং ফর মাই বিলাভেড ফ্রেন্ড।
    বিশ্বরূপ এবং জয়া দেবীর জন্য পাসপোর্ট ভিসা করা হলো।
    সাহেব ওদের নিজের দেশে নিয়ে গেলেন।

    আজকের জনপ্রিয় দৈনিকে সুদূর ইংল্যান্ডে বিশ্বরূপ পালের গড়া মূর্তির প্রশংসা বেরিয়েছে।

    জয়া দেবী জেনাথন সাহেবকে বলছিলেন, আপনারা না থাকলে, আজ আমরা এই সুদিন দেখতে পেতাম না।
    সাহেব বললেন, আমি কোনো বন্ধুকৃত্য করিনি, আমি শিল্পকে হেরে যেতে দিই নি, আমি চেয়েছিলাম, শিল্পীর মৃত্যুর পরেও, শিল্প যেন বেঁচে থাকে।

    আজ বিদেশ জুড়ে শিল্পী বিশ্বরূপ পালের চতুর্দিকে প্রশংসা শোনা যাচ্ছে।
    বিশ্বরূপ সাহেবকে বলল, আঙ্কেল, অল দিজ আর ফর ইয়োর কাইন্ডনেস।
    সাহেব বললেন, নো মাই সন। অ্যাবসলিউটলি,নট।
    দ্য পাওয়ার অব ক্রিয়েশন ইজ এবাব অল।

    গভীর কৃতজ্ঞতায় বিশ্বরূপ মাথা নিচু করলো।

    সাহেব আর মেম সাহেবের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে সাফল্যের খুশিতে কেঁদে ফেললো।

You cannot copy content of this page