-
কবিতা- উন্মোচন
উন্মোচন
-অযান্ত্রিক
উন্মোচনের পরে, টেবিলে চিৎ হয়ে পরে থাকে পত্রিকা।
সভায় সামনের সারিতে বসে থাকা জড়বুদ্ধি ছেলেটার,
কোনো হেলদোল নেই ।সে শুধু হাততালি দেবে বলেই এসেছে।
ধোপ দুরোস্ত নবীন প্রবীণ কবি সাংবাদিক,দেখে হেসেছে।যারা ছোটো বেলায় শূন্য আর বৃত্তের ফারাক খুঁজতে হয়রান হত,
ছেলেটা সেই দলের কেউ নয়,শুধু হাততালি দিতে শিখেছে এতদিনে।
সবাই উঠে দাঁড়াল ,শোক প্রস্তাবে,দু মিনিট মুক-বধিরতা আঁকলো,
ছেলেটার কোনো হেলদোল নেই,চুপচাপ বসে থাকলো।ছেলেটা যেনো ঈশ্বর কোনো,নির্বিকার নীরব চিত্ত,
যায় আসে না কিছু ফারাক জেনেও শূন্য নাকি বৃত্ত।
স্তবকের শেষে, চুপকরে বসে,বলে যায় কানে কানে,
যারা কথা বলে, শব্দের দলে,তারাই ঠকাতে জানে। -
কবিতা- হলো না এবারেও
হলো না এবারেও
-অযান্ত্রিকসেভাবেই ভেঙে যায় সভা,পত্রিকা প্রকাশ,যেভাবে শুরু হয়েছিলো,
এক এক করে দরজার অভিবাদন শেষ করে ,রাস্তায় নামে মানুষের নকল মিছিল,
শব্দেরা একাই ফেরে। সন্ধ্যায় শহরের ওড়ালপুলের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে চাঁদ,
কখনো বা থাকেও না।তাতে শব্দের কিছু যায় আসে না।
খিদের যায় আসে।
কাঁধে ঝোলা ব্যাগের সবটুকু দায় শুধু,
কবিতার খাতা আর জলের বোতলে।
প্রতিবাদে বা ভালবাসায় নয়।
একই কথা বার বার ব্যবহারে জৌলুশ,কমে যায়,
যেমন কবিতায় রোদ্দুর আর গমক্ষেত।রুটি আর আলুর তরকারি গন্ধ শুঁকে শুঁকে বাড়ি ফেরে কবি।
বাসের জানলায় ঘামের গন্ধে, অবিন্যস্ত চুলে হাত দিয়ে ভাবে,
আগামী কবিতায় ,একটা ইলেক্ট্রিকের তারের কথা বলা যায় ,
নরম শিরদাঁড়া বোঝাতে ,ব্যবহার করা যেতে পারে নুয়ে পরা ,
পান্থপাদপ,কিম্বা সংগ্রামী শ্রেণী বোঝাতে মুনিসিপালিটির লরি।
রক্ত বোঝাতে বাসের চাকায় চেপ্টে যাওয়া টমেটোর হারপাঁজড়া।দুই মলাটের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা শব্দের ,শুধু হাসি পায়,
নবীন কবি ,বোধগম্যতার বানান ভুল করে কেনো? -
কবিতা- দুই আঙুলে ঘোড়া
দুই আঙুলে ঘোড়া ,
-অযান্ত্রিকতারাই সামনে এসো, যারা আগামীতে দুই আঙুলে সূর্য ওড়াবে,
তারা সামনে এসো, যারা দুমড়েমুচড়ে বেঁচে যাওয়া শেখাবে।
তারা পিছনে থাকো, যারা মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেছো সর্ষে ক্ষেতে,
যারা শব্দের ভিতরে নীল লাল আগুন লুকিয়ে ঘুমোতে যেতে।
তারা হাত তোলো, যাদের আঙুলে আছে কালির শুকনো দাগ,
যাদের হাত এখনো লিখতে পারে “প্রিয়বরেষু”, ভাষার পাপ।
গতি আর আধুনিকতা বোঝাতে যারা ভাষাকেও দেয় বেচে,
তাদের জন্য বড় করুণা হয়।একটা কোর্টের রায়, বদলাতে পারে না আমার নিঃশ্বাস, আজও
একটা বিবৃতি এক করতে পারেনি জিভের আরষ্ঠতা, আজও
একটা হুমকি থামাতে পারেনি পায়ের চলার ছন্দকে, আজও,
একটা মিছিল, ক’টা মোমবাতি বোঝতে পারেনি রাগ, আজও
তবে, এক নিমেষে, এক্ষুণি গলা তুলে বলে দিতে পারি,
“চোপরাও বেজন্মার দল। একদম একদম চুপ,
তুমি আমাকে ঠিক করে দিতে পারো না,”
“আমি কি ভাষায় কথা বলবো” -
কবিতা- চর
চর
-অযান্ত্রিকপ্রশ্ন আর উত্তরের মাঝামাঝি কোনো জায়গায়,
যেখানে দ্বিধারা বিশ্রাম নেয়, মন গাছের ছায়ায়।
পাইন গাছের পাতা থেকে ঝরে পরে রাতের শিশির,
পরিত্যক্ত অতীত নিবাসের উঠোনে খেলে বেড়ায় রোদ্দুর।
সেখানে মুখোশ পরা মানুষের প্রবেশ নিষেধ।
নিলোফার, ঈশ্বর মানুষের জন্য যে মুহূর্তেগুলো রেখেছেন,
সেগুলো শীতের গির্জা ঘরের মতো, শুধু দুঃখের দিকে খোলে।
মানুষ সুখের কথা ভাবতে ভাবতে, দুঃখের সাথেই ঘর করে,
রোজ ঘুম থেকে ওঠে, বাজারের থলি হাতে দৌড়ায়, বাজারে
মাংসের দোকানের ছেলেটা, যে একটা ঘুড়ির জন্য, দিয়ে দিতে
পারতো তার জমানো সাতাশ টাকা, তাকে জিজ্ঞাসা করোনা।
সেও জানাবে,
মানুষ সুখ কিনতে এসে, কেজি দরে দুঃখ নিয়ে যায়,
কেউ পায়ের কাছের দুঃখ, কেউ পাঁজরের একটু নীচে নরম,
কেউ সামনের পায়ের উপরের অংশ। ছেলেটাই কেটে দেয়।
প্রশ্ন করে না।
নিলোফার, মানুষ সুখ ভেবে দুঃখই জড়িয়ে থাকে সারা জীবন -
কবিতা – বীজ
বীজ
-অযান্ত্রিকএকেক বার মনে হয়,
এত যে স্বপ্ন হারিয়েছি, চলার দাবী মানতে গিয়ে,
সে আমার পুরনো বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো স্বপ্ন,
তাদের কাছে যাই।
বলি ভাই, এসো একটু বসা যাক গাছের ছায়ায়,
এসো পাশাপাশি বসি, তাহলে বেশ হয়,
তার হাত নিয়ে রাখি নিজের কড়া পরা হাতে,সেও অনুভব করতে পারবে,
আমার শক্ত হয়ে যাওয়া আমার হাতের তালু,
যেখানে অগুনতি রেখা উপরেখার নদীপথ, কোনোটা আয়ুনদী,
যার ভিতর দিয়ে আমার নিত্য যন্ত্রণার পাল তোলা নৌকা,
টলমলে ধারায় সাঁতরে চলেছে
কোনো রেখায় চরার মতো জেগে উঠেছে, বাজারের অনেক দেনা।কোনোটায় অফিসের ডামাডোল ছাঁটাইয়ের সম্ভাবনা।
যে রেখাটা আসতে আসতে হারিয়ে যাচ্ছে, যেখানে আমার উচ্ছন্যে যাওয়া
ছেলে তার ইয়ার বন্ধু দের নিয়ে রোজ ফুর্তি করছে।
হঠাৎ করে বেঁকে যাওয়া কোনো রেখায়,
আমার পরিণত যৌবনা মেয়ে রাত করে বাড়ি ফিরছে।
কোনো রেখায় আমার একলা হয়ে যাওয়া মা, সাদা শাড়ির আঁচলে,
বেঁধে রাখছে একটু একটু করে ফুরিয়ে যাওয়া শখ শৌখিনতা।
নিজের সাথে আপোষ করতে করতে খিটখিটে হয় যাওয়া আমার বউ,
আচ্ছা, তখন, ও আমার হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন, তুমি কি বলবে!
এই নাও কাঁধ, রাখো মাথা, আর একটু কেঁদে নাও প্রাণ খুলে। -
কবিতা- পর মানি না
পর মানি না
-অযান্ত্রিক
সবাই তো আর অন্য রকম ভালোবাসার শরীর নিয়ে জন্মায় না,
কেউ কেউ ছাতের ছড়ানো চালের মতো ভালোবাসা খুঁটে ,শরীর গড়ে
ও আমার নীল পাহাড়িয়া মেয়ে,ও আমার সুখ জাগানিয়া পাখি,
আমি সেই দ্বিতীয় সারিতে থাকি,।
আমার খুব ইচ্ছে করে জানো, তোমার দেশে যেতে,খুঁটে খুঁটে ক্ষুদ খেতে।
চেখে দেখতে তোমার দেশের প্রতিটা শিশুর মুখে মুক্তোর হাসি।
খুব ইচ্ছে করে,ছুটে যেতে মহুলের বনে ,যেখানে গাছে গাছে চিঠি ঝোলে,
আর হলুদ পোশাক পরা যৌবন শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদের সাথে চালায় মাধুকরি।
দূরের কোনো ক্ষণজন্মা ঝিলের থেকে ছিটকে আসে,বৃদ্ধা আপেল গাছের স্বস্তি।
সদ্য বিধবা জুঁই ফুলের ছায়া ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে বলে এসো চুপটি করে বসো।
আমি কবি নই, শব্দ প্রচার সচিবের চাকরী আমার,তাকে কি করে বোঝাই?
বিজ্ঞ লম্বা পাইন গাছের ডালে বসা বদরি পাখির একটা পালকের জন্য,
আমি নির্দ্বিধায় নষ্ট করেছি আমার শিশুকাল,আজ যৌবনের শেষ প্রান্তে এসে।
রাগে উপরে ফেলতে ইচ্ছে মগজের রেললাইন,ভাবনার চিন্তার ট্রেন ।
আমার আশপাশের যত সদ্য কবিতার কৃষিকাজ করা কবিদের ,সুখের
শব্দ শেখাতে চাই, তোমার কাছ থেকে সুখ ধার করে।
যাতে তারা তাদের ,কোনো এক কবিতার শেষতম পংক্তিতে ,
বেড়ে ওঠে সবুজ দেবদারু গাছ, যার ছায়ায় চারটে দামাল শিশু খেলা করবে,
“অনি মানি জানি না ,তুমি আমি পর মানি না” -
কবিতা- অবান্তর
অবান্তর
– অযান্ত্রিকআমার খুব ভাবতে ভালো লাগে,
খুব ইচ্ছে হয় কবিতার মতো, গানের মতো বাঁচতে,
যে কবিতার কপালে জোটে হাজার হাততালি,
যে গানের সুর ভেসে বেড়ায় মানুষের মুখে মুখে,
আমার কবিতাবাঁচা যেন হয়, মানুষের বাঁচার রসদ,
পাড়ায় পাড়ায় মণ্ডপে মণ্ডপে বেজে উঠবো আমি
এক জন প্রেমিক তার ভালবাসা বোঝাবে আমায় পাঠ করে,
এক জন শ্রমিক তার দাবি জানাতে পড়ে উঠবে আমায়।
একজন চাষী তার ঋণ মুকুবী দরখাস্তে লিখবে আমায়,
একজন ডাক্তার তার প্রতিটা রোগীকে বলবে শুনতে,
আসামি, তার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আমার নামেই করবে শপথ,
একজন সৈনিক, আমায় পড়েই থামিয়ে দেবে যুদ্ধ।
আমায় ছুঁয়েই বোমারু বিমান, বোমার বদলে ফেলে আসবে ফুল।
আমার নামেই শপথ করে রাষ্ট্রপতি নামবেন কুচকাওয়াজে,
আমার যে কি ভাবতে ভালো লাগে, এই সব অবান্তর।
ভাবনায় ভেসে যায় প্রতিদিন বাড়ি ফেরার শেষ ট্রেন,
দাঁড়িয়ে থাকে একপাশে গুটিশুটি মেরে একলা
আমার হাততালি না পাওয়া কবিতারা,
ওদের কে আর বাড়ি নিয়ে যাবে? কেউ তো নেই আমি ছাড়া। -
কবিতা- পারিনা বলে
পারিনা বলে
-অযান্ত্রিকগন্ডা গন্ডা কবিতার লেখার পর মনে হয়,কোনো লাভ নেই।
এতোদিন যত কবিতা লিখেছি ,তাতে একটাও কাজের কবিতা নেই,
নেই কোনো বাড়ি বানানোর কবিতা,চাষের কাজ করে দেয়ার কবিতা,
রান্না করার কবিতা,চুল বাঁধার কবিতা।
যদি হত তাহলে দূরে ,কোনো নদীর ধারে,কিংবা জঙ্গলের কিনারে,
কবিতা দিয়ে বানাতাম একটা বাড়ি,সেই বাড়ির উঠোনে জবা, টগরফুলের গাছ,
মাঝখানে একটা গোবর নিকোনো তুলসী মঞ্চ,যেখানে,
আমার বৃদ্ধ মায়ের রোজকার কাজে সাহায্য করতে,
লিখে দিতাম একটা মালতি মাসির মতো জ্যান্ত কবিতা,
হয়ত একটু দূর থেকে জল আনতে হবে,তারজন্য লিখে দিতাম,
একটা ষণ্ডামার্কা কবিতা যে তোমাকে জল এনে দিতো সন্ধ্যে বেলায়।
একটা দাসী বাদীর মতো কবিতা ,যে তোমার চুল বেঁধে দিতো
আমি কাজ থেকে ফিরলে স্নানের জল এগিয়ে দিতো গামছা।
কিন্তু আফশোস এমন কবিতা আমি লিখতে পারিনা,
কোথায় শেখ যায় তাও জানিনা, তবে,,
যদি কোনোদিন শিখে ফেলি,যদি কোনোদিন লিখতে পারি,
নিলোফার,সেদিন ,সেদিন কি সত্যিই তুমি আসবে আমার বাড়ি। -
কবিতা- কান্না পেলে
কান্না পেলে
-অযান্ত্রিককি করবে তুমি মনখারাপের বিকেল,
কি করবে তুমি হঠাৎ কান্না পেলে।
নীল শাড়িতে বিছিয়ে শরীর আঁচল,
রাখবে মাথা? আমি দেখতে গেলে।তখন তোমার বয়স পুঁজি কম,
তখন তোমার স্বপন নদীর মাঝি।
খেয়ায় তুলে যুবতীর সরগম,
আগলে রাখতো টাটকা ফুলের সাজি।এখন আমার সংখ্যা বেড়েছে বেশ,
চালশে চোখে স্বপ্নরাও বেরঙীন।
কিন্তু জেগে তোমার হাসির রেশ,
চাইছে ফিরে ভালোলাগার দিন।তোমার আঁচল হলদে হয়েছে কবেই,
সংসার গাড়ি নিয়েই চলেছি ঠেলে।
জানি একদিন আবার দেখা হবেই,
রাখবে মাথা আবার কান্না পেলে। -
কবিতা- ভুল বানানের মানুষ
ভুল বানানের মানুষ
-অযান্ত্রিকআমি অস্ফুটে যা কিছু বলি,বিড়বিড় করি,
তোমরা শোনো না,
তোমরা তোমাদের শ্রেষ্ঠত্ব জানাও, আমি মেনে নিই,
যদিও প্রতিযোগী নই।
আমায় হাতছানি দেয় নিস্তব্ধতা,
উপরে ওঠার সিঁড়ির অন্ধকার,
ঘোমটার আড়ালে থেকে হত্যা মুখ শোনায় হাসির তিরষ্কার।
শব্দের হিজাবের নীচে আমার কোনো কবিতা থাকে না,থাকে ,মানুষ
মৃত,জীবিত,বিরোহী উদাসীন আর যত রকম ভুল বানানের মানুষ।
তাদের হাত নেই,তবু ডাকে,পা নেই, তবু ছোটে, বুক নেই তবু,
স্বেদ,ক্লেদ রক্ত মল মূত্র ছেড়ে সংগম, সহবাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে,
নির্দ্বিধায় দেখে যায়, ভালোবাসার স্বপ্ন,যেখানে কোনো শরীর নেই,
কোনো কামনার লালসার পায়ের ছাপ পর্যন্ত নেই ,যা আছে ,
সেটা মঞ্চে কবিতা পড়তে ওঠা কবির চোখে পড়ে না,
ধারালো শব্দের সঞ্চয় বাড়ানো কবিতা লেখক দেখতে পায়না।
তাই তাদের কবিতা বিকৃত,যারা দেখতে পায় ,তারা জানে ,
কবিতার কোনো বিক্রয় মূল্য নেই।