• কবিতা

    প্রতিধ্বনি

    প্রতিধ্বনি
    -চিন্ময় মহান্তী

     

    আর সেরকম করে ছবি আঁকা হয়নি কোনোদিন
    দশটা বছর আগে যেমনটা হয়েছিল ,
    সেদিন শ্বেত শুভ্র পট ছিল রঙিন রঙ ছিল তুলি ছিল
    জীবনের পথটা ছিল সমতল সরলরৈখিক ।
    উজান পথের পথিক হয়ে দৃষ্টি হয়েছে সীমাবদ্ধ
    পিছনের ঢাল টানে বারবার -করে রাখে আবদ্ধ ।
    ধূসর পটের উপর সে ছবি আঁকা যায় না
    প্রচেষ্টা করাটাও বৃথা আস্ফালন বোই কিছু নয় ।
    গোধূলির লাবণ্য গায়ে মেখে তুই যখন ফিরে যেতি
    স্বর্নচম্পা আমায় কতবার মিনতি করে বলেছিল —
    ওরে হতভাগা একবার আমার মুখপানে চেয়ে দেখ !
    আমি খুব রাগ করে মনে মনে বলতাম –
    স্বর্নচম্পা তুই আমায় গালাগাল দিচ্ছিস ,
    একদিন একদিন হিংসায় জ্বলে পুড়ে ছাই হবি তুই !
    স্বর্নচম্পা ছাই হয়নি , ওর হতভাগা বলাটা হয়েছে বাস্তব ।
    চোখের প্লাবণ আমি কখনো দেখিনি , সেদিনই দেখলাম
    যেদিন তুই আর এলিনা বিকেলের নদী তটে ,
    আজ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে –
    স্বর্নচম্পা তুই ঠিকই বলেছিলি আমি সত্যি হতভাগা ।
    গগনের নীলিমায় যখন একটি একটি করে
    তারারা জেগে ওঠে আপন মায়া বিলায় ,
    আমি তখন ভালবাসা খুঁজতে নামি বিষাদের সমুদ্রে ।
    জানিস তুই চলে যাওয়ার পর —
    একদিন ভালবাসা খুঁজতে গিয়েছিলাম বসন্তের কাছে ,
    ও আমায় বলেছিল —
    ভালবাসা পলাশ ফুটলে আসে আবার কালবৈশাখীতে চলে যায় ,
    আমি বুঝতে পারিনি ওর কথার মানে গূঢ়গভীরতা ।
    সেদিন যখন স্বর্নচম্পার সঙ্গে আবার দেখা হলো
    ও আমায় দেখে বললো –
    ওরে হতভাগা না পাওয়ার বেদনার চেয়ে ত্যাগের আনন্দ বেশি ,
    নিজের থেকে অপরের ভালো চাওয়ার মধ্যে একটা মাহাত্য আছে ।
    আমি উত্তর করিনি —
    নির্বাক হয়ে শুনেছি স্বর্নচম্পার কথার প্রতিধ্বনি ,
    তাহলে আমি কি তোর ভালো চাইতে পারিনি !
    ভালোই তো চেয়েছি প্রতিনিয়ত , তাহলে —
    তাহলে এ কোন ভালো চাওয়ার কথা বলছে স্বর্নচম্পা !
    আমি আর কিচ্ছু ভাবতে পারছি না , মাথাটা বনবন করছে
    কেউ আছো ?
    আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে যাও—-
    এ কোন ভালোচাওয়ার কথা বলছে স্বর্নচম্পা।
    হ্যাঁ পেয়েছি খুঁজে পেয়েছি —-
    আমি তাকে ভালোবাসা দিতে চেয়েছি শুধু ভালোবাসা
    কিন্তু অভাবের জানালা দিয়ে ভালোবাসা কবে যে উড়ে গেছে
    একদম বুঝতে পারিনি– একদম বুঝতে পারিনি !
    স্বর্নচম্পা ওর ভালো চাওয়ার মাহাত্ম্য খুঁজে পেয়েছি আমি
    বুকের ভেতরটা ভীষণ হালকা লাগছে স্বর্নচম্পা
    আমি ওর ঐশ্বর্যসুখ কেড়ে নিই নি !
    আর সেরকম করে ছবি আঁকা হয়নি কোনোদিন
    দশটা বছর আগে যেমনটা হয়েছিল,
    সেদিন শ্বেত শুভ্র পট ছিল রঙিন রঙ ছিল তুলি ছিল।

  • কবিতা

    বন্ধু হয়ে এসো

    বন্ধু হয়ে এসো
    -চিন্ময় মহান্তী

     

    অনুরাধা তুমি সুখী নেই
    তবুও কত সহজেই দুঃখগুলোকে আড়াল করো–
    সফেদ মুখের মায়াবী আড়ালে ।
    মেজাজী উত্তরগুলো তোমার তেমনই রয়েছে
    যেমনটা ছিল তেরো কি চোদ্দ বছর আগে,
    সেদিন মেজাজের উপর ভালবাসার প্রলেপ ছিল
    আজ আছে শুধু গহীন দুঃখের প্রলেপ।
    তোমার চাহনির মধ্যে কতো আত্মবিশ্বাস ছিল সেদিন
    আজ সেগুলো সব ফিকে আর ধোঁয়াশা।

    অনুরাধা তুমি সুখী নেই
    গোধূলির কনে দেখা আলোয় তোমার সেই রূপঔজ্জ্বল্ল্য
    আজ অস্তাচলের দিগন্তে অপেক্ষমান।
    তবুও মেকাপের আড়ালে কত সহজেই লুকিয়ে রেখেছো
    তোমার রূপের বার্ধক্য গ্রাসের প্রতিটি চিহ্ন ।
    মৃত ভালবাসার শ্মশান হতে হাতছানি দিয়ে বলি
    প্রেমিকা নয় বন্ধু হয়ে ফিরে এসো অনুরাধা ,
    তুমি পারোনা! একবার এগিয়ে তারপর চলে যাও–
    শত যোজন দূরে! চোখের আড়ালে লাজুকতার কুটিরে ,
    তবুও এ হৃদয় আহ্বান করে বলে বারে বারে —
    প্রেমিকা নয় অন্তত বন্ধু হয়ে ফিরে এসো অনুরাধা
    বন্ধু হয়ে ফিরে এসো !

  • কবিতা

    পুরুষানুক্রমে

    পুরুষানুক্রমে
    -চিন্ময় মহান্তী

     

     

    জীবনের চক্রবূহে টালমাটাল হাঁটে নিত্য পদযাত্রী
    শান্তির নীড় খোঁজে উলুবনে ছড়িয়ে রাখা মুক্তোমাঝে!
    সহ্যের দিগন্ত হতে শোনা যায় ঘনঘন ভারী নিঃশ্বাস,
    কাঁধে তখনো জোয়ালের আকল পড়া কালশিটে দাগ
    রূপান্তরিত শোণিত নিবের আগায় ক্রমাগত লিখে চলে
    পাওয়া আর দেওয়ার অনু পরমাণুর হিসেব নিকেশ ।
    পাওয়ার ঘর হাতড়ে দেখে বিরাজে মরুর তপ্ততা মাখা
    পিপাসার্ত পথিকের চাতকের মতো করুণ বারিবেদন,
    দেওয়ার ঘরে কর্ত্যব্যের উদ্দ্যাম দাবী পুরণের চাহিদা ।
    এ যেন পুরুষানুক্রমে চক্রবৃদ্ধি সুদের অলিখিত দলিল
    লেন্সহীন চোখে ঝাপসা হওয়া দৃষ্টি ভেজা চোখে পড়ে-
    কুয়াশা মাখা কাঁচের ভেতর দিয়ে আপন অতীত ইতিহাস।
    পথ তেমনই পড়ে রয় শুধু পথিক পালটে যায়-
    পালটে যায় তার পারিপার্শিক দৃশ্যগুলোও,
    ইতিহাসের উপর আরেক ইতিহাস রচিত হয়- তবুও
    বিবেকের উপর জমা হয় পথের ধুলোর গাঢ় আস্তরণ,
    মৌখিক আধুনিকতার তোরণ নির্মাণ হয় ক্রমাগত
    বিবেকের অলিন্দে বয়ে যায় স্বার্থের আদিম ইতিকথা ।

  • কবিতা

    নতুন প্রেমের গল্প

    নতুন প্রেমের গল্প
    -চিন্ময় মহান্তী

     

     

    ওইখানেতে ছাতিম তলে দুপুর কাটতো ছায়ে
    মাঝিরে তোর ভাটিয়ালী জাগতো নদীর নায়ে।
    চুপিসারে বসতি সখী এসে আমার বাঁয়ে
    স্বপ্নগুলো ইথারেতে ভাসতো ঢেউয়ে ঢেউয়ে।
    বল না সেদিন ফিরবে কবে? কোন সে নতুন ভোরে
    ভুঁইচাঁপাটি উঠবে ফুটে নিকানো উঠান দোরে?
    গুনগুনিয়ে গাইবে অলি নতুন গানের কলি
    বলবে কোকিল কুহুতানে প্রেমের গল্প বলি।
    পড়বে কবে পদচিহ্ন এই এখানে বাটে
    জলকে কবে যাবি সখী পদ্মদীঘির ঘাটে?
    অলস প্রহর কাটেনা আর সময় ঘড়ির তালে
    বসন্ততো এসে গেল পলাশ ডালে ডালে।
    সেদিনের সেই ঘর সাজানো সত্যি হবে কবে
    পুতুল খেলার দিনগুলো কি এখনো তেমন রবে?
    আজকে আমার নতুন ঘরে পুতুল বিয়ে নয়
    সানাইয়ের সুর যেন রাত্রি জেগে রয়।
    স্বপ্নমালা নতুন করে গাঁথবি পারিজাতে
    কাঁকন জোড়া বাজবে তখন নিপুণ দু’টি হাতে।
    আমার ঘরে আঁধার ভেঙে উঠবে আলোর চাঁদ
    খুশি আর কলরোলে ভাঙবে বিষাদ বাঁধ।
    নদীর বুকে ভাটিয়ালী ভাসবে সফেন ঢেউয়ে
    নতুন কোনো প্রেমের গল্প লিখবো নাউয়ের ছাউয়ে।

  • গল্প

    শেষ আশ্রয়

    শেষ আশ্রয়
    -চিন্ময় মহান্তী

     

     

    “ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং।
    ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম্।।”–
    সূর্য প্রণাম সমাপন করিয়া ধুতির কাছাটিকে পুনরায় মজবুত করিয়া একবুক জল হইতে উঠিয়া নৃপেন্দ্র চাটুজ্যে বিন্দুর উদ্দেশ্যে বলিলেন , ” বল কি বলবি ? ” বিন্দু গৃহ হইতে যে ভাবিয়া আসিয়াছিল আজই কত্তাকে জবাব দিয়া আসিবে আর ওমুখো হইবে না তাহার সেই সংকল্প কত্তার সম্মুখীন হইয়া কোথায় পলাইয়া কোন গুপ্ত স্থানে লুক্কায়িত হইল তাহা সে বুঝিতে পারিল না । বিন্দু আমতা আমতা করিয়া বলিল , ” বলি কত্তা , টাকাটা দিলে ছেলেটাকে কলেজে ভর্তি করতে পারতাম । ” গামছা দিয়া তৈলচিক্য টাকটি মুছিতে মুছিতে নৃপেন্দ্র গৃহ মুখে অগ্রসর হইতেছিলেন , বিন্দুও তাহার পশ্চাতে পশ্চাতে আসিতেছিল । তাহার কথা শুনিয়া কিঞ্চিৎ চুপ থাকিয়া কত্তা বলিলেন , ” কালই তো তোকে বললাম আগাম টাকা দেওয়া সম্ভব নয় । ” তথাপি বিন্দু থামিতে চাহিতেছিল না , কত্তাকে প্রসন্ন করিবার নিমিত্তে এমন হেন তৈল নাই যাহা সে লেপন করিতেছিল না । কিন্তু সমস্ত প্রকার তৈলই বিফল হইল । কত্তা গৃহে ঢুকিয়াই আরাধ্য দেবতার পূজা করিতে ঠাকুর ঘরে প্রবেশ করিলেন । বিন্দু নিস্ফল হইয়া চাটুয্যেদের উঠানে বাঁধানো বেদীতে বসিয়া পড়িল । এমতাবস্থায় তাহার পুত্রটিকে কলেজে ভর্তি করিতে কোথায় টাকা পাইবে তাহা চিন্তা করিতে লাগিল । তাহার স্বামী মৃত্যু শয্যায় শায়িত থাকা কালীন যে অন্তিম ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন তাহা সে কিরূপে রক্ষা করিবে এই চিন্তা আসিয়া তাহার মস্তকে ভিড় জমাইয়া জ্বালাতন করিতেছিল । সে একবার ভাবিল টাকা না পাইলে আর কি করিবে একমাত্র পুত্রকে কাহারো ঘরে মুনিষের কাজে লাগাইয়া দিবে , কিন্তু একবার তাহার ইহাও চিন্তা হইল তাহার ছেলেটি ভালো ফল করিয়া দ্বাদশ শ্রেনী উর্ত্তীর্ণ হইয়াছে , তাহাকে উচ্চশিক্ষা হইতে বঞ্চিত করিলে মাতার কর্তব্য পালন হইবে না । পূজার ঘর হইতে ধূপের সুগন্ধ আসিতেছিল , বিন্দু আর একবার কত্তার পায়ে পড়িবে মনস্হির করিয়া সেই বেদীতেই বসিয়া আকাশ পানে চাহিয়াছিল । তাহার আঁখি দুইটি হইতে বিন্দু বিন্দু অশ্রু নিঃসৃত হইয়া একটি ধারা বানাইয়া চিবুক অবধি আসিয়া পড়িয়াছিল ।
    গিণ্ণীমা আপন পুত্রের সহিত বাপের বাড়ি হইতে ফিরিলেন । বিন্দুকে বেদীতে বসিতে থাকিতে দেখিয়া এবং তাহার চোখে জল দেখিয়া তিনি জানিতে চাহিলেন , ” কি হয়েছে বিন্দু ? ” বিন্দু গিন্নীমায়ের নিকট সমস্ত ঘটনার সবিস্তার বর্ণনা করিল । গিণ্ণীমা কিঞ্চিৎ কি যেন ভাবিলেন তাহার পর বলিলেন , ” তুই একটু বোস আমি আসছি । ”
    গিন্নীমা হন্তদন্ত হইয়া পূজার ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন কর্তা সদ্য পূজা সমাপন করিয়া কুশের আসন হইতে উঠিতেছেন । তিনি পশ্চাৎ ফিরিতেই গিন্নীমার সহিত চক্ষুলাপ হইল । নৃপেন্দ্র বলিলেন , ” কতক্ষণ ফিরেছো ব্রজবালা ? ” ব্রজবালা তাহার প্রশ্নের উত্তর না করিয়া বলিলেন , ” বিন্দু দেখলাম উঠোনের বেদীতে বসে কাঁদছে ? ” নৃপেন্দ্র খানিক বিরক্ত হইয়া বলিলেন , ” ওকে তো বলেই দিলাম এতো টাকা আগাম দেওয়া সম্ভব নয় । ”
    ” কিন্তু ওর ছেলেটার কথা একবারও ভাবলে না ! ”
    ” ওদের কথা ভেবে কি হবে ব্রজ ? ওর ছেলে লেখাপড়া শিখলে আমার কি লাভ ? তার চেয়ে বরং লেখাপড়া না শিখলে ভবিষ্যতে আমার ঘরে মুনিষের কাজে লাগবে । যাও গিয়ে রান্নার আয়োজন করো , ওই হাভাতের কথা ভাবতে হবে না । ” বলিয়া নৃপেন্দ্র বারান্দার আলনা হইতে একটি পাঞ্জাবি গায়ে দিয়া বাহির হইয়া গেলেন । তিনি বিন্দুর নিকটস্থ হইতেই বিন্দু বলিল , ” কত্তা ….!” নৃপেন্দ্র তাহার কথায় কর্ণপাত না করিয়া গাড়িতে চড়িয়া চালকের উদ্দেশ্যে বলিলেন , ‘ চল্ ! ‘ গাড়িটি চলিয়া গেল । বিন্দুর মনে হইল গাড়িতে চড়িয়া একটি অমানবিকতার জ্যান্ত মূর্তি চলিয়া গেল ।
    গিণ্ণীমা বাহিরে আসিলেন । বিন্দু তাহার অধোবদন দেখিয়া বুঝিল তিনিও কিছু সুরাহা করিতে পারেন নাই । সে বলিল , ” আমি জানি গিন্নীমা পুরুষের ইচ্ছাধীন নারীকে আপন অনেক ইচ্ছা বিসর্জন দিতে হয় । ” বিন্দুর এই কথার একটি বৃহৎ মর্মার্থ অনুধাবণ করিয়া ব্রজবালার চোখে জল আসিয়া পড়িল । ‘ আমি আসি গিন্নীমা ! ” বলিয়া বিন্দু বেদী ছাড়িয়া উঠিল । গিন্নীমা নিরুত্তর রহিলেন , বিন্দু ধীর পদক্ষেপে আপন গৃহাভীমুখী হইল । গিন্নীমা আঁচল দিয়া চক্ষু দুইটি মুছিয়া ঘরে ঢুকিয়া দেখিলেন তাহার পুত্রটি মেঝেতে একটি খেলনা হেলিকপ্টারের রিমোট লইয়া গবেষণায় মত্ত রহিয়াছে । তাহার মনে একটি ক্ষেদ আসিল , তিনি ভাবিলেন এতো সম্পত্তি থাকিতেও আজ একজন অসহায় মাতাকে তিনি সাহায্য করিতে পারিলেন না । মনের দুঃখ ভুলিতে আপন পুত্রকে ক্রোড়ে করিয়া ছাদে উঠিলেন । তথায় একটি পোষ্য কাকাতুয়া খাঁচায় রহিয়াছিল , পুত্রটি কাকাতুয়ার খাঁচার নিকট বসিয়া সেটির সহিত খেলিতে লাগিল । ইহা দেখিয়া ব্রজবালার মনে হইল খাঁচায় বন্দী কাকাতুয়ার সহিত তাহার কোনরূপ পার্থক্য নাই , তিনিও ইহার মতোই সংসার সমুদ্রে মায়ার খাঁচায় বন্দী ; নিজস্ব কোনো ইচ্ছা নাই কোনো স্বাধীনতা নাই । পূবের রৌদ্র বাড়িতে লাগিল , খবরের কাগজওয়ালা সাইকেলের বেল বাজাইয়া ‘ কাগজ ..’ বলিয়া চিৎকার করিয়া কাগজটি উঠানে ছুঁড়িয়া দিয়া চলিয়া গেল । ব্রজবালা আপন পুত্রকে ক্রোড়ে করিয়া নিচে আসিয়া উঠান হইতে কাগজটি সংগ্রহ করিয়া কর্তার টেবিলে রাখিলেন । পুত্র ভাঙা ভাঙা অক্ষরে বলিল মা … খা …ব …। সদ্য সমাপ্ত দুর্ব্যবহার লইয়া ক্ষেদ বহন করিবার অবকাশ আর ব্রজবালার রহিল না । তিনি পুত্রের ক্ষুধা নিবৃত্তির নিমিত্তে ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন ।
    বিন্দু গৃহে প্রবেশ করিয়া স্বামীর অতি প্রিয় কেদারাটিতে ধপ করিয়া বসিয়া পড়িলেন । তাহার পুত্র কোথা হইতে কয়েকটি কাষ্ঠখন্ড জোগাড় করিয়া নিজের আহারের জন্য উনুন জ্বালাইতেছিল । সে মাতাকে এইরূপ বসিয়া পড়িতে দেখিয়া বলিল , ” কী হলো মা ? কত্তা কি টাকা দিতে রাজি হলেন ? ” পুত্রের প্রশ্ন শুনিয়া বিন্দু চেয়ারের হাতলদুটিতে হাতের ভর দিয়া উঠিতে উঠিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন , ” না ! দিল না ! ” পুত্র মায়ের মনের ব্যথা অনুভব করিয়া বলিল , ” আমরা যে গরীব মা ,আমাদেরকে কি কত্তা বিশ্বাস করবে বলো ; আমাদের তো পরিশ্রম করে ছাড়া শোধ দেওয়ার উপায় নেই ! ”
    বিন্দু দেওয়ালে টাঙানো স্বামীর ছবির প্রতি চাহিয়া বলিলেন , ” তোর বাবা যদি বেঁচে থাকতো তাহলে আজ আমাকে কত্তার কাছে হাত পাততে হতোনা ! ” মাতার চোখে অশ্রু দেখিয়া কি প্রকারে স্বান্তনা দিবে তাহা ভাবিয়া না পাইয়া পুনরায় রন্ধনে নিযুক্ত হইল । কিয়ৎপর মাতা অশ্রু মুছিয়া পশ্চাৎ ফিরিতেই দেখিলেন পুত্র কয়েক গোছা শাক লইয়া বটিতে কুটিতেছে । তিনি বলিলেন , ” ছাড় বাবা ! তুই বরং একবার বিধু মাস্টারের কাছে যা , লোক মুখে শুনেছি উনি নাকি খুব দয়ালু , কিছু একটা ব্যবস্থা করলেও করে দিতে পারেন ! ” ছেলে যে শাকের আঁটিটি কুটিতেছিল তাহার অবশিষ্টাংশ কুটিয়া বঁটি ছাড়িয়া উঠিল । বারান্দার রশি হইতে একটি জামা টানিয়া লইয়া গায়ে দিয়া বাহির হইল । মাতা রন্ধন কার্যে ব্যস্ত হইলেন ।

    বিন্দুর ছেলে যখন বিধু মাস্টারের ঘরে আসিয়া পৌঁছাইল তখন বিধু মাস্টার স্কুলে যাইবার জন্য স্নান সারিয়া গামছাটি উঠানে টাঙানো রশিতে মেলিতেছিলেন । বিন্দুর ছেলেকে সম্মুখে দেখিয়া তিনি বলিলেন , ” কি হলো বিভাস ? ” বিভাস বলিল , ” মাস্টারমশায় আমার বোধহয় আর কলেজে পড়া হবে না ! মা ভর্তির টাকা জোগাড় করতে পারেনি ! ”
    ” আচ্ছা তুই দাঁড়া ” বলিয়া বিধু মাস্টার ঘরে ঢুকিলেন । কিয়ৎক্ষণ পর তিনি কাঁধে একটি কাপড়ের ব্যাগ ঝুলাইয়া বাহির হইয়া বলিলেন , ” চল্ বিভাস । ” বিভাস মাস্টারের মোটরবাইকে চড়িয়া বসিল ।
    স্কুলে আসিয়া বিধু মাস্টার হেড মাস্টারের নিকট সমস্ত বৃত্তান্ত বলিয়া তাহার অনুমতি লইয়া বিভাসকে সাথে করিয়া কলেজের উদ্দেশ্যে চলিলেন । হেডমাস্টার নিকটস্থ সহশিক্ষকদের মুখপানে চাহিয়া বলিলেন , ” এই হেন মানুষটাকে ভগবান সন্তান সুখ হইতে বঞ্চিত করিলেন ! ”
    বিধু মাস্টার বিভাসকে কলেজে ভর্তি করিয়া দিলেন । অধ্যক্ষের সহিত কথা বলিয়া বৃত্তির ব্যবস্থা করিয়া দিয়া এবং হোস্টেলে থাকিয়া পড়িবার ব্যবস্থা করিয়া দিয়া তাহাকে ঘরে পৌঁছাইয়া দিলেন ।
    ঘরে ফিরিতেই বিন্দু জানিতে চাহিলেন , ” কিছু ব্যবস্থা হলো বাবা ? ” বিভাস বলিল , ” হ্যাঁ মা । হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থাও হয়েছে । আগামী পরশু হোস্টেলে যেতে হবে । ” তাহার পুত্র এই প্রথম তাহাকে ছাড়িয়া অন্যত্র থাকিবে ইহা ভাবিয়া বিন্দুর কন্ঠ শুষ্ক হইয়া আসিতে লাগিল । কিন্তু তিনি মনে মনে দৃঢ় সংকল্প বদ্ধ হইতে চেষ্টা করিলেন । যেমন করিয়াই হোউক স্বামীর অন্তিম ইচ্ছা পূর্ণ করিতে হইবে । ভাঙ্গিয়া পড়িলে পুত্রও ভাঙ্গিয়া পড়িবে ইহা ভাবিয়া অন্তরের কষ্ট অন্তরেই চাপিয়া রাখিলেন । মুখে বলিলেন , ” স্নান করে খেয়ে নে বাবা । ” পুত্র স্নানের উদ্দেশ্যে চলিয়া গেল । বিন্দু স্বামীর ছবির নিকট দাঁড়াইয়া বলিলেন , ” ওগো শুনছো তোমার ছেলে পরশু হতে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করবে । তোমার ইচ্ছে পূরণ হবে । ”

    রাত্রি গভীর হইয়াছে । অদূরে কতিপয় সারমেয় থাকিয়া থাকিয়া চিৎকার করিয়া উঠিতেছে । বিন্দুর চোখের পাতা এক হইতেছে না । বিন্দু ভাবিতেছেন কি করিবেন ? কত্তার ঘরে কাজ ছাড়িয়া দিলে উপোস করিয়া মরিতে হইবে আবার গেলেও আপন অসহায়তা প্রকাশ করা হইবে । কিন্তু কিবা করার আছে কত্তা যে বেতন দেন সেই বেতন এই এলাকায় আর কেহই দিতে পারিবে না , না হয় একটু বেশিই খাটিতে হয় । অন্য গৃহস্থে কাজ করিলে বাড়ির ভাড়া দেওয়া দুষ্কর হইয়া উঠিবে । তাহার মনে পড়িল স্বামীর চিকিৎসার জন্য নিজের বাড়ি বিক্রয় করিবার পর স্বল্প ভাড়ার এই গারার বাড়িতে উঠিয়াছিলেন, সেই পাঁচ-সাত বৎসর পূর্বে । আপন সমস্ত সম্পত্তি বিক্রয় করিয়াও স্বামীকে বাঁচাইতে পারেন নাই । স্বামী বেসরকারি ব্যাংকে কার্য করিতেন বলিয়া যে কয়টি টাকা কর্ত্তৃপক্ষের নিকট হইতে পাইয়াছিলেন সেইগুলিও ঋণ মিটাইতে গিয়া নিঃশেষ হইয়া গিয়াছিল । কত্তা আগাম টাকা দিতে অস্বীকার করিয়াছেন ঠিকই কিন্তু বেতন সময় মতোই দিয়া দেন । অবশেষে বিন্দু চিন্তার অবসান ঘটাইয়া ইহা স্থির করিলেন যে যাহার গৃহে দুইবেলা অন্নের সংস্হান করা দুস্কর তাহার সন্মান রাখিলে চলে না , মান -অপমান -অভিমান ইহার ঠাঁই তাহার অন্তরে রাখিতে নাই । যাহাই হোউক তাহাকে কত্তার গৃহে যাইতে হইবে । নানান চিন্তার মধ্যে কখন যে ভোর হইয়া গেল তাহা বিন্দু বুঝিতে পারিলেন তখন যখন পাশের বাড়ির খোঁয়াড় হইতে মুরগির ডাক শুনিতে পাইলেন ।
    ঘুম হইতে জাগিয়া বিভাস মুখ ধুইতেছিল । মাতাকে বাহির হইতে দেখিয়া বলিল , ” কোথায় যাবে মা ? ” পুত্রের মুখপানে চাহিয়া মাতা বলিলেন , ” কত্তা বাবুর বাড়ি । ”
    ” তুমি আবার কত্তা বাবুর ঘরে যাবে ? ” পুত্রের প্রশ্নের উত্তরে বিন্দু বলিলেন , ” ও তুই বুঝবিনা বাবা , পেটের জ্বালা বড় জ্বালা ! ” পুত্র আর কিছু বলিল না । বিন্দু চলিয়া গেলেন ।
    গিণ্ণীমা পুত্রকে ক্রোড়ে করিয়া উঠানে একটি কেদারায় বসিয়াছিলেন , বিন্দুকে দেখিয়া তিনি বলিলেন , ” বিন্দু …” । গিণ্ণীমাকে থামাইয়া বিন্দু বলিলেন , ” আপনাদের দয়া কখনো ভুলবো না গিন্নীমা । ” বিন্দুর কথা গিন্নীমার অন্তরে তীক্ষ্ণ শলাকার মতোই বিঁধিল । বিন্দু ইহা বুঝিয়া বলিলেন , ” গিন্নীমা আপনাদেরকে আঘাত দিতে আমি একথা বলিনি । বহু ভেবে দেখলাম দীর্ঘদিন আপনারা বেতন দিয়ে আমার ও আমার ছেলের পেটের অন্ন জোটাচ্ছেন ।” গিণ্ণীমা বাকস্তব্ধ হইলেন । তাহার প্রতি অবিচার করিবার পরও তাহার আনুগত্য এবং ঔদার্য্য দেখিয়া গিণ্ণীমা ভাবিলেন , গরীবের ঘরে আলো না জ্বলিলেও মনের আলো প্রজ্বলিত থাকে । গিন্নীমা মৃদুকন্ঠে বলিলেন , ” রাত্রের এঁটো বাসনগুলো পড়ে আছে । ”
    ” ঠিক আছে গিণ্ণীমা” বলিয়া বিন্দু বসন ধুইবার নিমিত্তে গৃহাভ্যন্তরে চলিয়া গেলেন । কত্তা বাহিরে কোথাও গিয়াছিলেন , গৃহে ফিরিয়া কলতলায় বিন্দুকে দেখিয়া বলিলেন , ” আমি তো ভাবছিলাম তুই আর আসবি না বিন্দু । ” বিন্দু কোনো উত্তর করিলেন না । কত্তা গিন্নীর উদ্দেশ্যে বলিলেন , ” আমি স্নানের জন্য চললাম । ” গৃহে স্নানের জন্য বাথরুম রহিলেও নৃপেন্দ্র অবগাহন করিয়া স্নানের জন্য পুষ্করিণী যান । এই ব্যাপারে কেহ প্রশ্ন করিলে তিনি বলেন , ” সেই ছোটোবেলায় বর্ণ পরিচয়ে পড়েছি , ” অবগাহন করিয়া স্নান করিবে ,” সেই শিক্ষার মর্যাদা দিয়ে যাচ্ছি । ”

    সকাল হইতে বিভাস গোছগাছ করিতেছিল । মাতার মনে বিষন্নতা আসিয়া ভিড় জমাইতেছিল । অবশেষে বিভাস প্রস্তুত হইয়া হোস্টেলে থাকিয়া লেখাপড়া করিবার উদ্দেশ্যে বাহির হইয়া গেল । মাতা ঈশ্বরকে স্মরণ করিয়া বলিলেন , ” ঠাকুর দেখো ছেলেটা যেন মানুষ হয়ে আমার মাথা উঁচু করে । ” ক্ষণিক নিশ্চুপ বসিয়া থাকিবার পর বিন্দু কত্তার ঘরে যাইবার জন্য বাহির হইলেন ।
    অদ্য মানষিক বিষন্নতার কারণে কার্যে মন লাগিতেছিল না । কলতলায় বাসন ধুইতে গিয়া কয়টি চায়ের পেয়ালা হাত হইতে ফসকাইয়া শানের উপর পড়িয়া শতটুকরা হইয়া গেল । আওয়াজ পাইয়া হাতের খবরের কাগজটিকে ভাঁজ করিয়া টেবিলের উপর রাখিয়া বাহিরে আসিয়া নৃপেন্দ্র দেখিলেন বিন্দু পেয়ালার টুকরাগুলি কলের চাতাল হইতে একটি একটি করিয়া তুলিয়া একটি পাত্রে রাখিতেছে । নৃপেন্দ্র একবার স্বপত্নীক রাসের মেলা দেখিতে গিয়া এইগুলি কিনিয়াছিলেন । তাহার পরদিন হইতেই তিনি এই সখের পেয়ালাগুলিতে চা পান করিয়া আসিতেছেন । চোখের সামনে আপনার সখের পেয়ালাগুলির অবধারিত শ্মশান যাত্রা দেখিয়া তিনি রুষ্ট হইয়া বলিলেন , ” সখের তুই কি বুঝিস ! ভাঙবিই তো , টাকা পাসনি কিনা । ছোটোলোক কোথাকার ! ” বিন্দু মৃদুস্বরে বলিল , ” কি করবো কত্তা হাত ফসকে পড়ে গেল , ছেলেটা আজ আমাকে ছেড়ে হোস্টেলে গেল তো তাই একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম । ”
    ” ছেলেটা হোস্টেলে গেল তাই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম , যত্তসব ” বলিয়া কটাক্ষ করিয়া নৃপেন্দ্র পুনরায় ঘরে চলিয়া গেলেন । ব্রজবালা আপনার কক্ষের জানালা দিয়া স্বামীর রূঢ় বাক্যবান শুনিতেছিলেন । কত্তা চলিয়া যাইতেই তিনি বাহিরে আসিয়া বিন্দুর নিকট দাঁড়াইয়া বলিলেন , ” বিন্দু তুই কিছু মনে করিস না ! তুইতো জানিস মানুষটা ওরকমই । ” বিন্দু ব্রজবালার মুখের প্রতি চাহিয়া বলিল , ” না গিণ্ণীমা মনে করবো কেন ? ছোটোলোকের যে মন থাকতে নেই গিণ্ণীমা ।” ব্রজবালা ইহার পর কি বলিবেন খুঁজিয়া পাইলেন না । তাহার হঠাৎ মনে হইল বাহিরের লোকের নিকট আপন স্বামীর নিন্দা করা মোটেই ঠিক নয় আবার পরক্ষনেই ভাবিলেন , নিজের রক্তও যদি অন্যায় করে তাহার জন্য অনুতাপ করিবার অপেক্ষা ক্ষমাভিক্ষাই শ্রেয় ইহাতে অন্তরের প্রশান্তি সর্বাধিক । কত্তার মুখ হইতে নির্গত ‘ ছোটোলোক ‘ সম্বোধনটি বিন্দুর হৃদয়ে গাঁথিয়া গেল । তিনি ভাবিলেন খাইতে না পাইলেও আর কত্তার গৃহে জলস্পর্শ করিবেন না । একবার তিনি তাহার সংকল্প ভঙ্গ করিয়াছিলেন পুত্রের কথা চিন্তা করিয়া , পুত্রের যখন একটা উপায় হইয়া গিয়াছে আর কোনো অবস্থাতেই সংকল্প ভঙ্গ করিবেন না , এইরূপ চিন্তা করিয়া বাসনগুলি নামাইয়া দিয়া কাহাকেও কিছু না বলিয়া আপন গৃহে ফিরিয়া আসিলেন ।
    দুপুর গড়াইয়া বিকাল হইয়া আসিল । বিন্দুর কোনো কাজে মন লাগিতেছিল না । মনে মনে উপার্জনের একটি উপায় খুঁজিতে লাগিলেন । কিন্তু হতাশ হইয়া ভাঙ্গিয়া পড়িতে চাহিলেন না । তাহার বিশ্বাস এই বলিয়া বদ্ধমূল হইল যে , এতো বৎসর যখন সমস্ত প্রতিকূল বিষয়ের উপায় নিজেই বাহির করিয়াছেন আজিও পারিবেন ।
    সূর্য অস্তাচলে যাইতেছিল , শেষ রোদটুকু গায়ে মেখে অনেক উঁচুতে একঝাঁক সাদা বক উড়ে যাচ্ছিল তাদের গন্তব্যের পথে । বিন্দু ঘরের সদর দরজায় তালা দিয়া বাহির হইলেন ।
    তরুলতার ঘরে আসিয়া বিন্দু দেখিলেন সে একটি ধবধবে সাদা থান গায়ে জড়াইয়া সন্ধ্যা প্রদীপটি মাজিয়া পরিষ্কার করিতেছে । বিন্দুকে দেখিয়া তরুলতা প্রদীপটি মাজিতে মাজিতেই বলিলেন , ” বিন্দু যে , তা এই অসময়ে কি মনে করে ! ” বিন্দু বলিলেন , ” তুই যে কারখানায় কাজ করিস আমার জন্য একটা কাজ দেখে দে না ভাই , বড্ড অসহায় হয়ে পড়েছি । ” তরুলতা এইবার হাতের প্রদীপটি নামাইয়া রাখিয়া বলিলেন , ” তুই যে নৃপেন্দ্র চাটুয্যের ঘরে কাজ করছিলি ? ” বিন্দু নৃপেন্দ্রর উপর ক্ষোভ উগরাইয়া বলিলেন , ” আমি অসহায় হয়ে ওর ঘরে কামিনের কাজ করি বলে কি আমাকে ছোটলোক বলতে হবে ! ” এরপরও বিন্দু কিসব বলে গেলেন তাহা তরুলতার কর্ণে প্রবেশ করিল না , তাহার মনে পড়িল তাহার স্বামী এবং বিন্দুর স্বামী যখন একই অফিসে কাজ করিতেন তখন বিন্দু স্বামীর মাইনা বেশি বলিয়া কয়েকটি সোনার গহনা গড়াইয়া তরুলতাকে দেখাইতে তাহার নিকট সেইগুলি পরিয়া বড়াই করিতেন । তাহার অভিলাষ ছিল বিন্দুকে দেখাইয়া দিবেন কিন্তু স্বামীর কম আয়ের জন্য তাহা হইয়া ওঠে নাই । ইহার প্রভাব কিন্তু উহাদের দুইজনের স্বামীর উপর প্রভাব বিস্তার করিতে পারে নাই তাহাদের বন্ধুত্ব পূর্ববৎ বজায় রহিয়াছিল । তরুলতা কোনো প্রত্যুত্তর দিচ্ছেন না দেখিয়া বিন্দু তাহার হাত ধরিয়া বলিলেন , ” কি ভাই একটা কাজ দেখে দিবি না ! ” তরুলতা আশ্বাস দিয়া বলিলেন , ” বিন্দু , তুই এখন বাড়ি যা আমি দেখি চেষ্টা করে , কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারলে তোকে খবর দেবো । ” ‘ ঠিক আছে ভাই ‘ বলিয়া বিন্দু চক্ষুর আড়াল হইতেই তরুলতা একটা ঝামটা মেশানো স্বরে বলিলেন , ” কাজ দেখবো না ছাই ! তখন তো বড্ড গয়নার গরব দেখাতি ! ” গহনা ব্যতীত অপর কিছু লইয়া যে তাহাদের হিংসা হয় নাই তাহা নহে কিন্তু তরুলতা ইহাকেই অধিক মাত্রায় গুরুত্ব দিয়াছেন । ইহার কারণ নারী জাতির অধিক গহনা প্রীতি , ইহা বলিলে অমূলক হইবে কিনা তাহা শ্রদ্ধেয় পাঠকবর্গ নির্ধারণ করিবেন ।

    দীর্ঘ একমাস অতিক্রান্ত হইয়া গেল , ইহার মধ্যে বিন্দুর পুত্র একবার আসিয়া মাকে দেখিয়া গেল কিন্তু তরুলতার নিকট হইতে কাজের কোনো খবর আসিল না । ঘরের মালিক ভাড়া না পাইয়া বারংবার তাগাদা করিতে লাগিলেন । বিন্দু একবার ভাবিলেন নিজে গিয়া তরুলতার নিকট হইতে কাজের খবর লইয়া আসিবেন , সেইমত সন্ধ্যায় বাহির হইয়া তরুলতার ঘরে আসিলেন ; তরুলতা একটি পিঁড়িতে বসিয়া রাত্রের ব্যঞ্জনের নিমিত্তে কয়টি আনাজ কুটিতেছিলেন । বিন্দুকে দেখিয়াই তিনি বলিলেন , ” না ভাই মালিক বলেছে এখন নতুন কাউকে কাজ দিতে পারবে না । ” তরুলতা আর বাক্যব্যয় না করিয়া ঘরে ফিরিলেন । ইলেকট্রিকের বিল সঠিক সময়ে জমা করিতে না পারিবার কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হইয়াছিল , আন্দাজ করিয়া অন্ধকার ঘরে ঢুকিয়া কেরোসিনের বাতি জ্বালাইলেন । তাহার মনে হইল এই গৃহ ত্যাগ করাই উচিত হইবে , কতোবার আর মালিককে অজুহাত দিয়া ফিরাইবেন । পুত্রের ব্যবহৃত একটি খাতা লইয়া খুঁজিয়া একটি অব্যবহৃত পাতা ছিঁড়িয়া লিখিতে বসিলেন ,
    ” বাবা বিভাস,
    আমি চিরকাল ঠিকানা বদল করেছি । বাপের বাড়ি থেকে তোর বাবার বাড়ি , সেখান থেকে ভাড়া বাড়ি , এটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে , এখন চলেছি কোনো এক রেলস্টেশনে । তোর হোস্টেলের ঠিকানা আমি জানি না তাই চিঠিটা কোথায় পাঠাবো তাও জানি না । বিধু মাস্টারের কাছে দিয়ে গেলাম । বিধু মাস্টার দয়ালু মানুষ উনি হয়তো আমার থাকার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন কিন্তু আর কতো সাহায্য চাইবো ! তাই আমি চললাম অনির্দিষ্ট ঠিকানায় । তুই যেদিন বড় হবি তোর অনেক রোজগার হবে , নিজের বাড়ি হবে সেদিন আমার খোঁজ করিস বাবা । ভালো থাকিস । আমার কথা ভেবে সময় নষ্ট করিসনা বাবা , সন্মান নিয়ে বেঁচে থাকার মতো মানুষ হ ।
    ইতি তোর মা ”
    চিঠিটি হাতে লইয়া বিন্দু রাত্রির অন্ধকারে ঘর ছাড়িয়া বিধু মাস্টারের ঘরের সামনে আসিয়া দেখিলেন চারিদিকে কেমন একটা নিস্তব্ধতা গোটা বাড়িটাকে ঘিরিয়া রাখিয়াছে । চিঠিটা মাস্টারের ঘরের সদর দরজার সম্মুখে ফেলিয়া একটি ছোটো পাথর চাপাইয়া তিনি ঘোর অন্ধকারে অদৃশ্য হইয়া গেলেন ।
    সকাল হইয়াছে । মাস্টার নিত্যদিনের ন্যায় অদ্যও ঘুম হইতে জাগিয়া ইষ্টদেবতার মন্ত্র জপ করিয়া ঘরের দরজা খুলিয়া বাহির হইয়া চিঠিটি দেখিলেন । সেইটি ভালো করিয়া পড়িয়া সযত্নে ভাঁজ করিয়া ঘরে রাখিলেন । মনস্হির করিলেন অদ্যই বিভাসের নিকট সেইটি পৌঁছাইয়া দিবেন । কিন্তু বিভাসের ভাগ্য সুপ্রসন্ন রহে নাই । মুখ ধুইতে গিয়া হঠাৎ করিয়া বিধু মাস্টার পড়িয়া গেলেন আর উঠিলেন না , তিনি এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করিলেন ।

    উপরিউক্ত ঘটনার কয়েকদিন পর বিভাস তাহার মাতাকে দেখিতে আসিয়া দেখিল , ঘরে অন্য একটি গৃহস্থ ভাড়া লইয়াছে । সে মালিকের নিকট গিয়া জানিতে পারিল তাহার মাতা কাহাকেও কিছু না জানাইয়া রাত্রির অন্ধকারে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছেন । এক্ষণে কি করা উচিত স্থির করিতে না পারিয়া সে মাথায় হাত দিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িল , তাহার মা যে কোনো আত্মীয় বাড়ি যাইতে পারেন ইহা সে একবারের জন্যও ভাবিতে পারিল না । বাবার মৃত্যুর পর হইতে কোনো আত্মীয় তাহাদের সহিত যোগাযোগ রাখে নাই । সুদিন হইতে দুর্দিন আসিয়া হাজির হইলে যাহাদের আপন ভাবা হয় তাহার কেমন করিয়া পর হইয়া যায় ইহা বিভাসের প্রত্যক্ষ । তাহার মনে হইল যেভাবেই হোউক মাতাকে খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে , সেইমত নির্দিষ্ট লক্ষ্যস্থান না রাখিয়া চতুর্দিকে খুঁজিয়া বেড়াইতে লাগিল ।
    ঘুরিতে ঘুরিতে ক্লান্ত হইয়া বিভাস রাস্তার পাশে একটি গাছের নিচে বসিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিল । অদূরে একটি অট্টালিকার নির্মাণকর্ম হইতেছিল । দীর্ঘক্ষণ তাহাকে চিন্তিত মুখে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া একজন মধ্যবয়স্ক নির্মাণকর্মী তাহার নিকট আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন , ” বাবা তোমার কি হয়েছে ? এমন করে ঝুমে বসে আছো কেন ? ” বিভাস অধোবদন তুলিয়া নির্মাণকর্মীর মুখপানে চাহিয়া বলিল , ” আমার মাকে খুঁজে পাচ্ছিনা মা হয়তো ………! ” বিভাসের অনুক্ত কথার একটি মর্মবিদারী অর্থ আপন মন মধ্যে স্থির করিয়া নির্মাণকর্মী বলিলেন , ” বাবা , তুমি যদি ইচ্ছা কর আমার সঙ্গে আমার ঘরে চলো সেখানেই তোমার অতীত বৃত্তান্ত শুনবো । ” বিভাস সম্মত হইয়া তাহার সহিত চলিল , যাইতে যাইতে ভাবিল অদ্য হোস্টেল রহিয়াছে কিন্তু পড়াশোনা শেষ হইলে তো আর মাথা গুঁজিবার জায়গা নাই । চাকুরী পাইলে তবেই বাসস্থান গড়িতে পারিবে কিন্তু ততদিন কোথায় রহিবে , পড়িতে পড়িতেই যে চাকুরী হইবে তাহার নিশ্চয়তা নাই ।
    নির্মাণকর্মীর ঘরে পৌঁছাইয়া বিভাস দেখিল একটি ঝুপড়ি ঘর । নির্মাণকর্মীর সঙ্গে একটি কমবয়সী ছেলেকে দেখিয়া পাশের ঝুপড়ির এক বৃদ্ধ বলিলেন , ” কিরে শ্যামলা এ তুই কাকে সঙ্গে করে আনলি ? ” শ্যামল বলিল , ” এক অসহায় সন্তানকে । ” বৃদ্ধ আর কিছু বলিলেন না । বিভাস শ্যামলের পিছুপিছু ঝুপড়ির ভেতর প্রবেশ করিল । তাহার চক্ষু স্থির হইয়া গেল , এ সে কি দেখিতেছে ! এ সে কাহাকে দেখিতেছে ! ঝুপড়িতে চাঁদ নেমে এসেছে । বিভাস কিছুতেই চোখ ফিরাইতে পারিতেছিল না । সে ভাবিল কলেজে অনেক মেয়েকেই দেখিয়াছে , তাহাদের কাহারো কাহারো সৌন্দর্য কম রহে নাই তবে কি সে …..। মেয়েটি মৃদুস্বরে পিতার মুখপানে চাহিয়া বলিল , ” বাবা …। ” শ্যামল বলিলেন যা মা খাবার নিয়ে আয় ছেলেটা সকাল থেকে কিচ্ছু খায়নি । বাবার নির্দেশ মান্য করিয়া মেয়েটি খাবার আনিতে পাশের কুঠুরিতে প্রবেশ করিল । কিয়ৎপর খাবার আসিল । বিভাস সেগুলি দ্রুত গিলিতে লাগিল । শ্যামল বলিলেন , ” আহারে ! বাছার খুব খিদে লেগেছিল । ” মেয়েটি অদূরে দন্ডায়মান থাকিয়া বিভাসের প্রতিটি গ্রাস লক্ষ্য করিতেছিল । শ্যামল উত্থাপন করিলেন , ” বাবা বিভাস , তোমার মা তোমাকে ছেড়ে গেলেন কেন ? ” বিভাস মুখের গ্রাসটি গলধঃকরণ করিয়া বলিতে আরম্ভ করিল । তাহার মুখ হইতে অতীত জীবনের ইতিবৃত্ত শুনিয়া মেয়েটির চোখে জল আসিয়া পড়িল । কোথা হইতে একটি মায়া আসিয়া তাহার অন্তঃকরণ বেষ্টিত করিল । বিভাসের থালার ভাত শেষ হইয়াছে দেখিয়া শ্যামল কন্যার প্রতি চাহিয়া বলিলেন , ” মা সুলেখা আর কয়টা ভাত দে । ” সুলেখা তাহার আহারের ভাতগুলি লইয়া আসিল । বাপ বিটির ভাত শেষ হইল , বিভাস তাহা বুঝিতে পারিল না । খাওয়া শেষ করিয়া উঠিয়া বিভাস হাত ধুইতে বাহিরে যাইতেই শ্যামল মেয়েকে বলিলেন , ” অতিথির সৎকার পুণ্যির কাজ , আমার বাপ ঠাকুরদা বলতেন । যা মা ভাত বসা । ” পিতার নির্দেশ মতো মেয়ে ভাত বসাইতে গেল । বিভাস হাত ধুইয়া ঘরে ঢুকিয়া শ্যামলকে বলিল , ” আমি আসি এবার । ” শ্যামল বলিলেন , ” কোথায় যাবে ? ” উত্তরে বিভাস বলিল , ” আমার ঠিকানা হোস্টেলে । ”” বাবা যদি কিছু মনে না করো এই বাড়িকে নিজের বাড়ি মনে করে থাকতে পারো । ” বলিয়া শ্যামল উত্তরের অপেক্ষায় বিভাসের মুখপানে চাহিয়া রহিলেন । বিভাস কিঞ্চিৎ নিশ্চুপ থাকিয়া ভাবিল , ইনি তাহার প্রতি মায়া প্রদর্শন করিতেছেন ঠিকই কিন্তু যাহার ঘরে সমন্ত মেয়ে রহিয়াছে তাহার ঘরে রহিলে পাড়ার লোকের মুখে অচিরেই বদনাম রটিবে , মেয়েটির বিবাহ সম্পন্ন করিতে তখন এই মানুষটিকে যারপরনাই বেগ পাইতে হইবে । সে কোনোপ্রকারেই এই মানুষটির কোনো ক্ষতি করিতে পারিবে না । মুখে বলিল , ” না আমি আমার হোস্টেলেই ফিরে যাবো । ” শ্যামল বিশেষ আপত্তি আর করিলেন না । বিভাস বাহির হইয়া গেল । সুলেখা চৌকাঠে দাঁড়াইয়া দেখিল আকাশটা মেঘলা হইয়া আসিয়াছে ।
    ঝুপঝুপ করিয়া বৃষ্টি শুরু হইয়াছে । বিভাস বৃষ্টিতে ভিজিতে ভিজিতে হাঁটিতেছিল । কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইতেই সে দেখিল পিচ রাস্তার উপর জনা কয়েক লোক ছাতা মাথায় দিয়া উৎসুক হইয়া কি একটা ঘিরিয়া রাখিয়াছে । সে কাছে আসিতেই চিনিতে পারিল । তাহার চোখের জল বৃষ্টির জলের সহিত মিশিতে লাগিল । জমায়িত জনতার মধ্য হইতে একজন বলিলেন , ” বেচারা বৃদ্ধা বেপরোয়া লরির শিকার হলেন । কি করবে বাবা অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করো । ” বিভাস তাহার প্রতি চাহিয়া বলিল , ” আমার সে সামর্থ্য কোথায় ? ” তাহার অসামর্থ্যের কথা শুনিয়াই জমায়িত জনতার ভিড় ক্রমশ পাতলা হইতে লাগিল । যে ব্যক্তি অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার বিধান করিয়াছিলেন তিনি বিভাসের কাঁধে হাত রাখিয়া বলিলেন , ” বাবা ভুলে যেও না আজও মানুষ আছে বলে সূর্য প্রতিদিন ওঠে । আমি টাকার ব্যবস্থা করবো । ” বিভাস তাহার সম্মুখে নির্বাক হইয়া করজোড় করিল ।
    মাতার যাবতীয় ক্রিয়া কর্ম সম্পন্ন হইয়া গেল । সকলেই চলিয়া গেল , বিভাস সদ্য নেভানো চিতার নিকট বালির উপর বসিয়া স্রোতস্বিনীর তরঙ্গের প্রতি চাহিয়া কি যেন ভাবিতে লাগিল । এইরূপে কিঞ্চিৎ সময় অতিবাহিত হইয়া গেল হঠাৎ বিভাস অনুভব করিল তাহার কাঁধে কেও যেন হাত রাখিল । পিছন ফিরিয়া দেখিল সুলেখার পিতা , সে উঠিয়া দাঁড়াইল । শ্যামল বিভাসের দুই কাঁধ জড়াইয়া বলিলেন , ” বাবা বিভাস সুলেখা তোমার ফেরার অপেক্ষায় চোউকাঠে দাঁড়িয়ে রয়েছে । ” বিভাসের চোখে কয়েক ফোঁটা জল আসিয়া পড়িল , সে মায়ের আঁচল হারাইয়া শেষ আশ্রয় খুঁজিয়া পাইল ।

  • কবিতা

    টালখাওয়া বর্তমান

    টালখাওয়া বর্তমান
    -চিন্ময় মহান্তী

     

     

    অনুরাধা ভালো আছো ?
    শরতের শিশির গায়ে মেখে যে শিউলি কুঁড়িটা ফুটে উঠেছিল-
    আজ অস্তিত্বের প্রলেপটুকুও নেই তার দেহে ,
    আসলে দেহটাই তো তার বিলীন হয়ে গেছে !
    গাছটা আছে- ফিবছর শিউলিও ফোটে, কিন্তু
    সেই শিউলিটা আজো আর ফোটেনি,
    অদ্বিতীয় কিম্বা অদ্বিতীয়া।
    প্রভাত রবির রক্তিম ঔজ্জ্ব্যল্ল্যে যে অলি চেয়েছিল
    সে মধুপ আজো অন্বেষণ করে, আপন ভ্রমে।
    হতাশার ঘোলাজলে অহরহ খাবি খায় চুনোমাছ
    তারপর একসময় স্তব্ধ হয়ে যায় সমস্ত লম্ফঝম্ফ,
    রাতের চাঁদ নিয়ত ভাসে ঘোলাজলের প্রতিটি ঢেউয়ে
    স্বচ্ছতার অভাবে সে অদৃশ্য থেকে যায় রেটিনায় ।
    ভালো থাকার জল ধরানো হয় মনের শরীর জুড়ে
    বসন্ত বয়ে যায় কোকিলের কুহু তরঙ্গে,
    গাতিমান মাঝে পাষাণ চেয়ে রয় ভ্যালভ্যালে চোখে।
    আশার কিনারে টলমলে বৈঠার কাছিতে টান লাগে
    বান ডাকে আঁখি নদী- অনুরাধাকে ভাবনার জল স্রোতে,
    একসময় জল শুকিয়ে গাঙ হয় শুখা !
    তখনও বালুর বুকে চিকচিক করে জ্যোৎস্নার পরশ।
    শিমুল তুলোর বাতাসে ভেসে বেড়ানোর মতোই
    মুখচ্ছবিটা ভাসতে থাকে মন জানালার নিঝুমতা ছুঁয়ে ,
    অনুরাধা হয়তো তখন সোনার কাঠির পরশে
    ঘুম স্বপ্নে আকাশ মেঘে ডানা মেলে দেয় ভবিষ্যতের পথে।
    একটা বর্তমান দিনগোনে অনাগত ভবিষ্যতের আশায়
    ধ্রুব সত্যও মানতে গিয়ে হোঁচট খায় টালখাওয়া বর্তমান,
    অনুরাধা আর আসবে না- এ যেন মেনে নিতে পারে না
    নবীনার ডাকে ঘুম চোখে চেয়ে বর্তমান বিড়বিড় করে-
    সময় কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায় বর্তমান তা জানে না ।

  • গল্প

    রক্তজবা

    রক্তজবা
    -চিন্ময় মহান্তী

     

     

    মেয়েটার নাম জবা। বাবা আদর করে ডাকেন রক্তজবা। যদিও মেয়েটার নামের সঙ্গে গায়ের রঙের কোনো সাযুজ্য নেই, ছিল না, মেয়েটার গায়ের রঙ কালো একেবারে মিশমিশে কালো। কত সম্বন্ধ এলো, গরীব বাপ ভুরিভোজের আয়োজনও করলেন, কিন্তু সবাই পরে খবর দেবো বলে আর খবর দিল না! মেয়েটা বাতায়নে চেয়ে চেয়ে অদৃষ্টকে খুঁজতে চেষ্টা করলো হঠাৎ তার জীবনে একটা ফাগুনী পূর্ণিমা এলো। হুইল চেয়ারে বসা একটা ছেলে এলো জবাকে দেখতে মেয়েটার বাবার পছন্দ হলো না। ছেলেটা বলল- জবা আমি তোমাকে পছন্দ করি কিন্তু তোমাকে তো উপার্জন করে খাওয়াতে পারবো না, তুমি কি এসব জেনে আমাকে বিয়ে করবে?

    জবার চোখে জল এলো, আঁখি দুটি হলো রক্তজবা।মেয়েটা বাবাকে কাছে ডেকে বলল- বাবা আমি ভালবাসা খুঁইজ্যা পাইছি বাবা! বাবা ইতস্তত হয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বললেন- ওর সঙ্গে তোর জীবনটাকে জ্যুইড়লে তোরে অনেক অনেক সংগ্রাম কইরতে হবে মা।

    -আমি পাইরব বাবা আমি পাইরব! ভালবাসার জইন্যে আমি সব পাইরব!

    সাতপাক পেরিয়ে, পেরিয়ে গেল দু’টো বছর । হুইল চেয়ারে বসা স্বামীর সঙ্গে কাটিয়ে দেওয়া দু’টো বছর, বুটিকের কাজ করে কাটানো দু’টো বছর পেরিয়ে গেল।কালো মেয়ের তকমাটা আজ খুঁজে ফেরে পাড়াময়, খুঁজে পায় না মেয়েটাকে, খুঁজে পায় একটা উন্নতিশীলা জবাকে, খুঁজে পায় একটা প্রেরণাদায়িনী জবাকে।মেয়েটা একটা বুটিকের কারখানা খুলেছে নাম দিয়েছে রক্তজবা। যেদিন তার কারখানার উদ্বোধন হলো,গরীব বাপটা এসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বললেন- তুই আমার রক্তজবা-মা।

    হুইল চেয়ারে বসা মেয়েটার ভালবাসার চোখে সেদিন ছিল ঝরে পড়া মুক্তার মতো আনন্দাশ্রু,
    মেয়েটার জীবনে আর অমাবস্যা আসেনি এসেছে শুধুই ফাগুনী পূর্ণিমা আর পূর্ণিমা। আজ জীবনের মধ্য গগনে এসে মেয়েটার মনে পড়ে ওর বাপের গাঁয়ের সুলতা পিসির কথা! পিসিটা বিধবা হয়ে ঘাঁটি গেড়েছিল বাপের ঘরে মেয়েটাকে দেখলেই বলতো- এমন কালো মাইয়ারে বিয়া কইরবেক কোন মাইনসে? তোর বিয়েই অবে না, আইবুড়া অইয়া বাপের বোঝা অইয়া তরে থাকা লাইগব। মেয়েটার আজ সুলতা পিসির কাছে গিয়ে বলতে ইচ্ছা করে, মাইনসে নয়গো পিসি আমি ভালবাসা পাইছিগো ভালবাসা পাইছি। পিসিটা নেই, আকাশে তারা হয়ে গেছে মেয়েটার মা যেমন সেই ছোটবেলায় তারা হয়ে গেছিল তেমনই বোধ হয় তারা হয়ে গেছে। সেদিন তুলসীতলায় মাকে দেখে মেয়েটা যখন কাঁদছিল তখন ওর বাপই বলেছিল- তর মা তারা অইয়া গেছে ।

    মন খারাপের রাতে আজও মেয়েটা তাকিয়ে থাকে তাকিয়ে থাকে তারা ভরা আকাশটার দিকে। কিন্তু, কোনটা যে তার মা তা খুঁজে পায় না। হুইল চেয়ারে বসা ভালবাসা তখনি পিছন থেকে বলে- রানী, এভাবে মাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। জবা তখন ভালবাসার বুকে নিজের বুকটা গুঁজে দিয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে, এই বুকেই সে খুঁজে পায় পরম শান্তি, নিখাদ ভালবাসা ।

  • গল্প

    হৃদয়ের বন্ধন

    হৃদয়ের বন্ধন
    -চিন্ময় মহান্তী

     

     

    দশম বর্ষীয় বালক পলাশ কয়েকটি কদলীর কান্ড জোগাড় করিয়া বিচুলি দড়ি দিয়া সারিবদ্ধ করিয়া বাঁধিয়া ভেলা বানাইয়া, রায় পুষ্করিণীর জলে ভাসাইয়া দিয়া এক টুকরা বংশ দন্ড লইয়া বারংবার জলের বক্ষে প্রোথিত করিয়া পুনরায় তুলিয়া লইতে লইতে ক্রীড়া মগ্ন হইয়াছিল। ভেলাটি ক্রমান্বয়ে ঘাট হইতে দূরে সরিয়া যাইতেছিল। পুষ্করিণীর পাড় দিয়া একটি পথ সর্পিল আকৃতি ধারণ করিয়া ক্ষেত অবধি বহিয়া গিয়াছে। ইহা যে মনুষ্য পদ কর্ত্তৃক সৃষ্ট তাহা তাহার স্বাস্থ্য দেখিয়া অতি সহজেই অনুমেয়। গ্রামের লোক ক্ষেতে যাইবার পথের দৈর্ঘ্য কিঞ্চিৎ স্বল্প করিয়া লইয়াছে। পলাশের পিতা জল ও কাঁচা লংকা সহযোগে কয়’টা মুড়ি খাইয়া হাতে একটি কাস্তে এবং কাঁধে কোদালটি লইয়া ক্ষেতের উদ্দেশ্যে বাহির হইল। পুষ্করিণীর পাড়ে আসিয়া তাহার পুত্রকে জলে ক্রীড়া মগ্ন দেখিয়া ধমকাইয়া বলিল, ”ইস্কুলে যাবার নাম নাই, সারাদিন শুধু খেলা আর খেলা। আমি যেন এসে দেখি তুই ইস্কুলে গেছিস। ”ছেলে পিতার কথায় কর্ণপাত করিল বলিয়া মনে হইল, ভেলার গতি স্থির হইল। পিতা হনহন করিয়া চলিয়া গেল। পলাশ খেলা থামাইয়া ভেলার উপর বসিয়া রহিল। কিঞ্চিৎ পূর্বের তাহার আনন্দ বর্তমানে বিষাদে পরিণত হইল।

    শিমুল স্কুলে যাইবার নিমিত্ত পুষ্করিণীতে স্নান করিতে আসিল। সে পলাশের সহিত গ্রামের বিদ্যালয়ে একই শ্রেণীতে পাঠরত। তাহাদের বন্ধুত্ব দেখিয়া একদিন ভূগোলের মাস্টার মিশ্রবাবু বলিয়াছিলেন, ”তোরা এক আত্মা।” মাস্টারের কথার অর্থ পলাশ এবং শিমুল কেহই বোঝে নাই। যাহা হোউক পুষ্করিণীতে আসিয়া শিমুল দেখিল পলাশ ভেলার উপর নিশ্চুপ বসিয়া রহিয়াছে। সে তাহার নিকট গিয়া ভেলার উপর চড়িয়া বসিল। তৎক্ষণাৎ পলাশ তীব্র চিৎকার করিয়া বলিল, ”তুই আমার ভেলায় চাপলি কেন?” শিমুল কিছু একটা বলিতে যাইতেছিল কিন্তু পলাশ তাহার অপেক্ষা না করিয়া সহপাঠীর পৃষ্ঠে দমাদম কিল মারিল। পিতার প্রতি সঞ্চিত ক্রোধ বন্ধুর উপর বর্ষিত হইল। শিমুল কাঁদিতে কাঁদিতে পুষ্করিণী হইতে সিক্ত বসনে গৃহের অভিমুখে চলিল। পলাশ ভেলার উপর তেমনই বসিয়া রহিল।

    শিমুলের পিতা কুড়ুল লইয়া কয়েকটি শিরিষ কান্ডকে চেলা করিয়া রন্ধনকার্যে ব্যবহারোপযোগী করিতেছিল। পুত্রকে ক্রন্দনরত অবস্থায় আসিতে দেখিয়া হাতের কুড়ুলটি ফেলিয়া রাখিয়া তাহার ক্রন্দনের কারণ জানিতে চাহিল। শিমুল পূর্ববৎ কাঁদিতে কাঁদিতেই রায় পুষ্করিণীতে ঘটিয়া যাওয়া সমস্ত ঘটনা পিতার নিকট সবিস্তারে ব্যক্ত করিল। শিমুলের পিতা যারপরনাই ক্রুদ্ধ হইয়া হনহন করিয়া পলাশের গৃহ অভিমুখী হইল

    পলাশের মাতা গৃহ অভ্যন্তরে আপন কর্মে ব্যস্ত রহিয়াছিল। উঠান হইতে শিমুলের পিতা অমূল্য হাঁক পাড়িল, ”বলি ও পলাশের মা ঘরে আছো?” একটা ঝাঁঝালো ডাক শুনিয়া পলাশের মাতা সুনীতি বাহিরে আসিল। তাহাকে দেখিয়া অমূল্য তীক্ষ্ণ স্বরে বলি , ”ছেলেটাকে তো মানুষ করতে পারলে না। একটা বেয়াদপ ছেলে গর্ভে ধরলে।” সুনীতি কিছু না বুঝিয়া বলিল, ”কেন কি হয়েছে?”

    ”তোমার ছেলেকেই সেটা জিজ্ঞাসা কর, অমানুষ কোথাকার,” বলিয়া অমূল্য বিদাই হইল। অমূল্যের মুখ হইতে তীব্র বাক্য ঝাঁঝ সহ্য করিয়া সুনীতি চালার খুঁটিতে ঠেস দিয়া বসিয়া রহিল। কিয়ৎক্ষণ পর পলাশ পুষ্করিণী হইতে ফিরিয়া আসিল। মাতা কিছু না বলিয়া তাহার চুলের মুষ্ঠি ধরিয়া গৃহাভ্যন্তরে লইয়া গিয়া বেদম প্রহার করিল। পলাশ হাউহাউ করিয়া কাঁদিতে লাগিল। কিন্তু তাহাতেও তাহার মাতার শান্তি হইলো না। পলাশের পিতা শীঘ্রই ক্ষেত হইতে ফিরিয়া আসিল। তাহার হাতে একঘটি জল দিয়া সুনীতি অমূল্য কর্ত্তৃক গৃহে বহিয়া আসিয়া অপমান করিয়া যাওয়ার কথা সবিস্তারে বর্ণনা করিল। সুনীতির স্বামী প্রদীপ দাউদাউ করিয়া ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিল। ঘটির জল একনিঃশ্বাসে পান করিয়া সে বাহির হইয়া গেল। অমূল্যকে একটি মোক্ষম জবাব দিয়া প্রদীপ আসিবে ইহা মনস্থির করিয়া সুনীতি শান্তি পাইল।

    প্রদীপ যখন অমূল্যের গৃহে আসিল তখনও অমূল্য সেই শিরিষ কান্ডে কোপ মারিতেছিল। প্রদীপ তাহার সম্মুখীন হইয়া বলিল, ”আমার ছেলে বেয়াদপ তো তোর ছেলেকে মিশতে দিস না আর আমিও দেবো না।” অমূল্য সায় দিয়া বলিল, ”হ্যাঁ হ্যাঁ যা ওটাই হবে। আর তুই আমার ঘরের ত্রিসীমায় আসিস না যা।” প্রদীপ কিছু না বলিয়া চলিয়া গেল। দুইটি বালকের ঠুনকো ঝগড়া লইয়া উভয় গৃহস্থ গোল পাকাইয়া দিল। বাল্যের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে অবগত নয় বলিয়া দুইটি বাল্য হৃদয়কে জোর পূর্বক পৃথক করিল। এই স্থলে শিক্ষার অভাব পরিলক্ষিত হইল।

    পরের দিন শিমুল এবং পলাশ স্কুলে আসিল। বারংবার এ ওর মুখের প্রতি চাহিতে লাগিল। কিন্তু উভয়ের মধ্যে কোনোরূপ বাক্য বিনিময় হইল না। শিমুলের মনে ভাসিয়া উঠিল তাহার পিতার নিষেধবানী, ”পলাশের সঙ্গে যদি কথা বলিস তো মেরে ঠ্যাং ভেঙে দেবো।” পলাশের মনে ভাসিয়া উঠিল পিতা কর্ত্তৃক আরোপিত অনুরূপ নিষেধবানী। বারংবার ইচ্ছা হইল একে অপরকে গিয়া জড়াইয়া ধরে কিন্তু নিষেধের দুর্ভেদ্য প্রাচীর খাড়া হইয়া তাহাদের ইচ্ছাকে টুঁটি টিপিয়া মারিল। 

    পূর্বোক্ত ঘটনার পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হইয়াছে। পলাশ এবং শিমুলের লেখাপড়ার বিশেষ অগ্রগতি হয় নাই। পারিবারিক অর্থাভাব তদুপরি লেখাপড়ার প্রতি উভয়ের অনাগ্রহই ইহার হেতু হইয়াছে। পলাশ অষ্টম শ্রেনীতেই তাহার লেখাপড়ার বৈতরণীকে অকূল পাথরে নিমজ্জিত করিয়াছে। শিমুল দশম শ্রেণীর গন্ডি টপকাইতে ব্যর্থ হইয়াছে।
    সেইদিনের দুই বালক পলাশ এবং শিমুল বর্তমানে বিশ বছর অতিবাহিত করিয়া যুবক হইয়াছে। সেই যে তাহাদের বাক্যালাপ বন্ধ হইয়াছে তাহা ক্রমান্বয়ে অভ্যাসে পরিণত হইয়াছে। কোনো স্থানে দুইজনের মুখোমুখি দেখা হইয়া গেলে একে অপরের মুখের প্রতি চাহিয়া সেই স্থান ত্যাগ করে, ইহাও নিত্য হইয়াছে। গ্রামের অদূরে একটি কারখানা রহিয়াছে, শিমুল সেই কারখানায় শ্রমিকের কার্যে নিযুক্ত হইয়াছে। পলাশ পিতার সহিত ক্ষেতের কর্মে নিযুক্ত হইয়াছে।

    অদ্য প্রাতে ঘুম হইতে জাগিয়া পলাশ একটি সম্বর কাঠিকে দাঁতন বানাইয়া উঠানে রাখা একটি বড় গাছের গুঁড়ির উপর বসিয়া দাঁত মাজিতেছিল। গতরাত্রিতে অসহ্য গরমের কারণে ঘুম ধরিতে মধ্যরাত্রি পার হইয়া গিয়াছিল বলিয়া অদ্য জাগিতে কিঞ্চিত বিলম্ব হইয়াছে। প্রভাতের রবি আপন মহিমায় মহিমান্বিত হইয়া ততক্ষণে তাহার ক্ষমতা প্রদর্শন করিতে শুরু করিয়াছেন। পলাশ দেখিল শিমুল সাইকেল চালাইয়া কারখানার উদ্দেশ্যে চলিয়া গেল। মুখ ধুইয়া উঠান হইতেই সে হাঁক দিল, ”মা, পান্তা নিয়ে আয়।” তাহার মাতা একটি থালায় করিয়া কয়েকটা চুনোমাছ ভাজা আর পান্তা আনিয়া চালার মেঝেতে রাখিল। পলাশ সেইগুলি তৃপ্তি করিয়া খাইয়া কোমরে একটি গামছা বাঁধিয়া ঢেঁকুর তুলিতে তুলিতে ক্ষেতের পানে চলিয়া গেল।
    বেলা গড়াইয়া মধ্যাহ্ন আসিতেছে। পলাশ রায়-পুষ্করিণীতে স্নান করিতেছিল। বৃদ্ধ খগেন দাদু গামছা কাঁধে আসিয়া পুষ্করিণীর ঘাটে বসিয়া স্নানরত নগেন দাদুর উদ্দেশ্যে বলিলেন, ”বুঝলে নগেন প্রদীপের ছেলেটার অবস্থা খুব খারাপ শুনলাম। ”নগেন দাদু বলিলেন, ”কেন কি হল?” উত্তরে খগেন দাদু বলিলেন, ”কারখানার মেশিনে নাকি তার ডান হাতটা কেটে গেছে। শহরের হাসপাতালে ভর্তি আছে।” পলাশ নিশ্চুপ থাকিয়া দুই দাদুর কথোপকথন শুনিতেছিল। অকস্মাৎ কি হইল সে সেই অবস্থায় জল হইতে উঠিয়া গৃহে ফিরিল। তাহাকে দেখিয়া তাহার মাতা বলিল, ”কাপড়টা ছাড় আমি ভাত বাড়ছি।”
    ”আমি এখন খাব না,” বলিয়া দ্রুত কাপড় বদলাইয়া পলাশ বাহির হইয়া গেল। তাহার মাতা ইহা দেখিয়া পশ্চাতে হাঁকিয়া বলিল, ”এই অসময়ে কোথায় যাস?” পলাশ কোনো উত্তর করিল না।
    পলাশ হাসপাতালে আসিয়া তাহার বন্ধুর খোঁজ করিয়া সোজা শিমুলের বেডের নিকট পৌঁছাইল। দেখিল শিমুলের মাতা পুত্রের শিয়রে বসিয়া রহিয়াছে। বন্ধুর ডান হাতটি নাই, কাঁধ বরাবর একটি ব্যান্ডেজ বাঁধা। পলাশ থমকিয়া দাঁড়াইল, কি বলিয়া কথা আরম্ভ করিবে ইহা চিন্তা করিয়া ইতস্তত বোধ করিতে লাগিল। শিমুল হাসপাতালের জানালা দিয়া বাহিরের খোলা আকাশটার পানে চাহিয়াছিল। মস্তক সহ দৃষ্টি ঘুরাইতেই সে দেখিল পলাশ অনতিদূরে দাঁড়াইয়া তাহার পানে চাহিয়া আছে, তাহার দুই চক্ষু বহিয়া টপটপ করিয়া অশ্রু ঝরিয়া যাইতেছে। এই দৃশ্যে শিমুল আর নিশ্চুপ রহিতে পারিল না, সে চক্ষুর ইশারায় তাহাকে নিকটে ডাকিল। দুই বন্ধু অদ্যও এইমুহূর্তে বাক বিনিময় করিতে পারিল না শুধু চোখের জলে তাহাদের কথোপকথন হইল। ইহা দেখিয়া শিমুলের মাতাও স্থির রহিতে পারিলেন না তাহারও দুই চক্ষুপল্লব অশ্রু সিক্ত হইল। হৃদয়ের বন্ধন যে ঠুনকো নহে অশ্রুই তাহা প্রমাণ করিয়া দিল ।

  • কবিতা

    কুমুদিনী হীন দীঘি

    কুমুদিনী হীন দীঘি
    -চিন্ময় মহান্তী

     

     

    আগোছালো রোদ গায়ে মেখে তুমি যখন স্কুলে যেতে
    একটা ছেলে আনমনে অপেক্ষা করতো তিন রাস্তার বাঁকে ।
    তুমি যখন ওর সামনাসামনি হতে , ছেলেটা ভাবতো —
    আজই বলে দেবে , আজই নিবেদন করবে প্রেম প্রস্তাব ।
    কিন্তু না ! কুমুদিনী তুমি চলে যেতে ,
    ছেলেটার আর বলা হয়ে উঠতো না । আজ হতো কাল ।
    কাল হতো অন্তহীন ঠিক যেমন অনন্তনাগের মাথায় বসুন্ধরা,
    ছেলেটার মাথায় তুমিই তখন বসুন্ধরা ।
    অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে চায় না , সে যেন চির নবীন ;
    তারপর পথ শেষে ছেলেটা দাঁড়ায় এসে নীল সাগরের তীরে ।
    গোধূলির ধুলো ওড়া প্রহর গায়ে মেখে পাহাড় ডোবে আঁধারে ,
    গোলাপের জল গায়ে মেখে তুমি সাজলে কুমকুম আর সিঁদুরে ;
    অস্তরাগের সূর্যটা ডুবে যায় শেষ বিকেলের রোদ গায়ে মেখে ।
    তুমি বললে -বড্ড দেরি হয়ে গেছে ,
    এতো লাজুকতা ছেলেদের মানায় না ।
    তাজা গোলাপটা ধীরে ধীরে বিবর্ণ হয় , মন হয় পাললিক শিলা ।
    প্রত্নতত্ত্বে যে শিলা শুধুই বিরহ রচনা করে , সাদা পাতার বুকে ।
    শরৎ আসে নদীর চরে কাশ ফোটে , পাখির কূজনে ভরে বাগান ,
    ছেলেটা তখনও তাকিয়ে দেখে —
    কুমুদিনী হীন দীঘির বুকে শ্যাওলা চরে রাশিরাশি ।

  • গল্প

    ফিরে পেতে চাই

    ফিরে পেতে চাই
    -চিন্ময় মহান্তী

     

    প্রিয় বন্ধু প্রসেনজিৎ ,
    প্রিয় বললে হয়তো অনেকটাই কম বলা হবে তাই প্রিয় শব্দের সঙ্গে সু যোগ করে বলি সুপ্রিয় বন্ধু। আমি যখন ডায়রি খুলে তোর আর আমার ফেলে আসা দিনগুলোকে স্মৃতির চিলেকোঠা হতে তুলে লিখতে শুরু করলাম তখন অনেক রাত্রি , বাইরে নিম্নচাপের বৃষ্টি অনবরত টিপটিপ করে ঝরে সবে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডেকে চলেছে অবিরাম অনর্গল। আমি বসে রয়েছি বেলকনিতে। আমার সামনের মোমবাতির শিখাটা হালকা বাতাসে বারে বারে দুলে উঠছে। আমি লিখে চলেছি সুপ্রিয় বন্ধু তোর সাথে ফেলে আসা দিনের স্মৃতিকথা।
    আচ্ছা প্রসেনজিৎ , তোর কি মনে পড়ে সেই -সেই—– দিনগুলোর কথা! আমার কিন্তু ভীষণ মনে পড়ে —জানিস , বয়সের মধ্যাহ্নে এসে মনের কোনে উঁকি দেয় –স্কুল থেকে বাড়ি না ফিরে সোজা সিনেমা হলে ঢুঁ মারা ,
    তারপর বাড়ি ফিরে একটা মিথ্যের জন্য হাজার মিথ্যে বলার দিন। বকুনি ছিল – তাহলেও মন্দ ছিল না । নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা ছিল না। এটা নেই ওটা নেই -এই আনতে হবে সেই আনতে হবে , এটা ছিল না। সর্বোপরি কোনো দায়িত্বই ছিল না। শুধু একটাই দায়িত্ব ছিল দুজন একসাথে খেলা -ঘোরা আর ঘোরা। যখন দিন শেষে রাত্রি নামতো তখন বিষন্নতা এসে জড়িয়ে ধরতো আমায়। সকাল হওয়ার অপেক্ষায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম টেরও পেতাম না। যদিও কোনো মানুষই তার ঘুম আরম্ভের সঠিক সময় টের পায় না। সকাল হলেই শুরু হয়ে যেতো নিত্যদিনের রুটিন।
    জানিস বন্ধু, আমার অাবাসনের পিছন দিকটায় একটা বড় পুকুর আছে। একবার ছিপ বানিয়েছিলাম মাছ ধরবো বলে তারপর একদিন গিয়েওছিলাম মাছ ধরতে কিন্তু ফিরে এসেছিলাম একটা মাছও না ধরে। তোর মনে এখন যে প্রশ্নটা জাগবে সেটার নিরসন আমি করি বন্ধু, পুকুরের পাড়ে বসে আমার মন কেবলই উদাসী হয়়েছে, বারবার সেই ছোটোবেলায় পাশাপাশি দুজনে বসে ছিপ ফেলার দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠেছে ; ছিপের চুঁঁইটা দেখতে পাইনি। তারপর আর ওপথ মাড়াই নি কোনো দিন।
    স্কুলের পর দুজনের পথ দুটো যেদিন আলাদা হয়ে গেল সেদিন আমার বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠলো। তুই ভর্তি হলি আলাদা কলেজে আর আমিও আলাদা। আমি ভাবলাম বুঝি আমাদের সম্পর্কে ইতি পড়ল। কিন্তু না , কলেজ থেকে ফিরে প্রথম সন্ধ্যায় যেদিন তুই আমার বাড়ি এলি সেদিন বুকটা আনন্দে ভরে গেল। তারপর সেটা হয়ে গেল প্রাত্যহিক। প্রতি সন্ধ্যায় তোর সঙ্গে দু’দন্ড কথা বলে মিটিয়ে নিতাম মনের খিদে। জানিস বন্ধু, আজও আমার আবাসনে প্রতি সন্ধ্যায় দু’চারজন প্রাত্যহিকীর সাথে গল্পে মেতে উঠি কিন্তু সেদিনটা খুঁজে পাই না ; কোথায় যেন একটা প্রাণের অভাব রয়ে যায় , কই সেদিন তো তোর আর আমার মধ্যে এমনটা ছিলনা বন্ধু।
    বয়স বাড়তে লাগলো, বেকারত্ব এসে আমাকে গ্রাস করতে শুরু করলো। একটা কাজের খোঁজে চলে এলাম কোলকাতায়। কাজও জুটলো একটা কোম্পানীতে। কাজের মাঝে ডুবিয়ে দিলাম নিজেকে। কাজ শেষে যখন প্রতি সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতাম তখন বারবার মনে পড়তে লাগলো তোর মুখ। তুই তখন গ্রামের স্কুলে কর্মব্যস্ত। বাঁধনটা কেমন যেন ঢিলে হতে শুরু করল। আমি থাকতে পারলাম না কোলকাতায় , গ্রামে ফিরে গেলাম। চারিদিকে কর্মব্যস্ত মানুষ আর আমি বেকার হয়ে ঘুরতে লাগলাম। তুইও তোর সময় মতো স্কুলে ব্যস্ত । আমি চোখে সর্ষে ফুল দেখলাম। শুরু করলাম ব্যাবসা । একটা ছোটো দোকান খুলে বসলাম। শুভাকাঙ্খীরা প্রায়ই বলতে লাগলেন , ” তোর এসব মানায় না। একটা সরকারী চাকরির চেষ্টা কর। ” আমার তখন মনে হতো তাদের কে বলে দি , ” সরকারী চাকরি কি হাতের মোয়া ! ” কিন্তু পারতাম না। তুই যখন স্কুল থেকে ফিরে সন্ধ্যায় আমার বাড়ি আসতিস তখন সেসব ভুলে যেতাম এক নিমেষে। তারপর অনেক রাত অব্দি চলতো দুজনের খোশ গল্প।
    একদিন ঈশ্বর সহায় হলেন , আমার একটা চাকরি জুটে গেল। আমি তল্পি তল্পা গুটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। বন্ধুত্বের রংটা ক্রমে ফ্যাকাশে হতে শুরু করলো। তুই রয়ে গেলি গ্রামে। তারপর বাকিটা একটা বিরাট শূন্যস্থান।
    জানিস বন্ধু , আজ তোর ফোন পেয়ে আমার মনটা বর্ষায় ময়ূরের মতো আনন্দে নেচে উঠলো। বারবার ইচ্ছে করছে তোকে কাছে পেতে , তোকে পাশে পেতে। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে তোর পাশে বসে এক থালায় ভাত খেতে। ছোটোবেলার দিনগুলো ফিরে পেতে। পড়ার মাঝে ফাঁকি দিতে। ক্লাস কেটে সিনেমা দেখতে। আর প্রতিদিন বাড়িতে জয়পন্ডা নদীর ব্রীজ উদ্বোধনের অনুষ্ঠান দেখে ফিরতে দেরি হওয়ার মিথ্যে অজুহাত দিয়ে সিনেমা দেখার গল্প গোপন করতে। ফিরে পেতে চাই বন্ধু -ফিরে পেতে চাই সেই ফেলে আসা দিনগুলোকে। কিন্তু সামনে আজ দাঁড়িয়ে চাহিদার বীভৎস নখর থাবা , যে মধ্যেখানে এঁকে দিয়েছে- সীমারেখা।

You cannot copy content of this page