-
গল্প- পুণ্যি … জলে!
পুণ্যি … জলে!
-অমল দাস
কথাসাহিত্যিক শরৎ চন্দ্রের শহর ছেড়ে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের শহরে ট্রেনটি প্রবেশের পথে ঐতিহাসিক জুবিলি সেতুটি পাড় করতে হয়। দুই শহরের মধ্যে একটা আত্মিক টান তৈরি করেছে এই সেতু। এটি উনবিংশ শতকের নব্বইয়ের দশকে নির্মিত। এখন বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত। তাই সমস্ত ট্রেনই অতি ধীর ও সন্তর্পণে চলে। সেতুটির শিল্পশৈলী, ঝনঝন আওয়াজ, পুরনো গার্ডরেলিং, নিচে নদী, জেলেদের নৌকা, ঘাটে স্নানরত মানুষ দেখতে দেখতে ক্ষণিকের সময়ে মনটা নস্টালজিক হয়ে যায়।
তবে এই নস্টালজিক পরিবেশ বেশি সময়ের নয়। বর্তমানে ফিরিয়ে আনে হঠাৎ টুং টাং কিছু শব্দ। নিবারনেরও অন্যথা হয়নি। ব্রিজের লোহার পাতে কয়েনের সংঘর্ষে এই আওয়াজ। কয়েন কোথা থেকে এলো তা বলার অপেক্ষা বোধহয় দরকার নেই। এপথের যাত্রীরা জানেন। তাঁরাও হয়তো কখনো কখনো হুগলী নদীতে এক-দু’টাকার কয়েন ছুঁড়ে দিয়েছেন। ভাবছেন বৃথা! না বৃথা কেউ একাজ করেন না। এর পিছনে লুকিয়ে থাকে পুণ্য লাভের গভীর অভিসন্ধি।
নিবারন পাশের যাত্রীকে কয়েন ছুঁড়তে দেখে জানতে চাইলো, ক’টাকা ফেলে দিলেন জলে?
পাশের যাত্রীটি, প্রশ্নে আশ্চর্য হয়ে গেলেন- সে কি! জলে ফেলতে যাবো কেন? মা গঙ্গাকে দান করলাম তো!
-দান করলেন? ভগবানকে দান করা যায়? ভগবান বলে যদি কিছু থাকে, তবে আমারই তো তাঁর দান! আমরা তাঁকে কী দান করতে পারি?
-মশাই কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। এ হলো গিয়ে এক প্রকার পুণ্যি কামানো। তাই ওই দু’টাকাটা! এ আর এমন কি…?
অবশ্যই এ যুক্তিতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ নিবারন জানে যাঁরা এই পথের পথিক তাঁরা সকলেই প্রায় একই ভাবনায় চলেন। সে জিজ্ঞাস করলো, আচ্ছা এই যে সবাই টাকা জলে ফেলে, তাতে গঙ্গা মায়ের উপকারটা কি? মানে তিনি করবেন কি পয়সা দিয়ে? জলের তলায় তো আর দোকান বাজার নেই! প্রসাধনী সামগ্রী কেনারও মায়ের আশা করি কোনরূপ ইচ্ছা নেই! ছবি অনুযায়ী তিনি অপূর্ব রূপসী। সে রূপে যে কোন প্রসাধনী ম্লান হয়ে যায়। তাহলে কেন এই লাখ লাখ কয়েন শতক ধরে মানুষ ফেলে আসছে জলে! আমাদের কি ভাবতে নেই এই অর্থ দেশের সম্পদ, যা জলে দিয়ে নষ্ট করা ছাড়া অন্য কিছু হচ্ছে না?
-ধুর মশাই! অতো কথা কেন? আপনার ভালো লাগেনি আপনি ফেলেন নি! আমার মনে হয়েছে আমি ফেলেছি.. অতশত ভাববার সময় নেই আমার…
এই বলে পাশের ভদ্রলোকটি একটু বিদ্রূপ দৃষ্টিতে নিবারনের দিকে তাকালেন। আশেপাশের দু’চারজন যাত্রীও, আপাত দৃষ্টিতে মনে হওয়া জ্ঞানদাতাকে একটু তাচ্ছিল্যের চোখে মুখ ঘুরিয়ে দেখেনিলেন।
নিবারন যাত্রীদের মনোভাব অনুভব করতে পেরে আর কিছু বললো না। নিজের ব্যাগ থেকে জলখাবারের কেক দুটি বার করে কাগজ ছাড়িয়ে ছুঁড়ে দিলো নদীতে। তখন ট্রেনটি জুবিলি পার করার শেষ মুহূর্তে। অনুমান করা যায় কেক দুটি জলেই পড়েছে।
এই দেখে পাশের যাত্রীটি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাস করলেন, কি করলেন মশাই ? কেক দুটি ফেলে দিলেন যে? ওগুলো কী নষ্ট হয়ে গেছে?
-না নষ্ট কেন হবে! এইতো প্যাকেট খুললাম আপনার সামনে।
-তবে ফেলে দিলেন যে বড়ো!
আসলে সবাই পুণ্যি কামাচ্ছেন, আমারও ইচ্ছে হলো! আমি ভাবলাম কয়েন ফেলে তো পলিতে চাপা দেওয়া ছাড়া কিচ্ছু হবেনা, কারণ জলজ প্রাণী গুলিও ওই কয়েন চিবোতে পারবে না। মা গঙ্গাও পয়সা নিয়ে নৈহাটি বা ব্যান্ডেলের বাজারে যাবেন না। কিন্তু কেক দুটি ফেলে কয়েকটি জলজ প্রাণের খিদে কিছুটা হয়তো মেটানো যাবে। এটাই ওদের জন্য উপকার। আর যেটা উপকার সেটাই আমার পুণ্যি বলে মনে হয়…
পাশের যাত্রী আর সাড়া দিতে পারলেন না। তিনি চোখ নামিয়ে নিলেন, মুখটি কেমন যেন শুকিয়ে গেলো। আর পাশের যাঁরা কিছুক্ষণ আগে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখেছিলেন তাঁরাও আর ফিরে তাকাবার সাহস পাচ্ছিলেন না।
-সমাপ্ত –
-
কবিতা- বহ্নি নও, তুমি বন্যা
বহ্নি নও, তুমি বন্যা
-অমল দাস
সেদিন তুমি গর্জে ওঠোনি দাওনি ধারালো মতবাদ
যে দুঃখের মেঘ ছেয়েচো উপমায় সেই ছায়া দিনরাত।
সেদিন তুমি নীরবে মাটি ফেটে গেলে পাতালপুরে
প্রতিবাদের জুতোটা সমাজে পারলেনা দিতে ছুঁড়ে!
রাজসভাতেও যেদিন তোমার খুলল শাড়ি টেনে,
সেদিনও তুমি কৃষ্ণ স্মরণে, প্রতিবাদ না হেনে।
শকুন্তলাও ন্যায়ের তরে তোলেনি প্রশ্নবাণের তীর,
যেদিন পুত্র হাতে রাজার দ্বারে, দৃশ্য ভিক্ষাবৃত্তির।
সুভদ্রা তোমার কৃষ্ণ ভ্রাতা, তবু দোয়াজ ঘরে দিলে
পাটরানীও না, পুত্র হেরে তুমি কেমনে নীরব ছিলে?
মনে পড়ে অহল্যা তোমার কিই-বা ছিল দোষ!
ইন্দ্রকেও আর বললে না, এবার পাথরটাকে চোষ!
ঈশ্বরীয় যুগ হতেই তোমরা সত্যের অগ্নি কন্যা,
পারনি জ্বালতে প্রদীপ শিখা, আজও দুচোখ জুড়ে বন্যা।
-
কবিতা- তোমায় কি দিই উপহার?
তোমায় কি দিই উপহার?
–অমল দাস
সায়হ্নে ধূসর কালে মিশে যাই সশরীরে
পিষে যাই দেয়ালের কোণে,
নিশীথের বনে তুমি চন্দ্রিমা সাথে লয়ে
এসেছিলে মনের গহীনে!
জীবন তো হেঁটে ছিল বালুকা বেলায়
পিছু ডাকেনি কখনো আর কেউ!
জ্বলন্ত রোদ্দুরে ছায়া হয়ে তরু তলে
তুমি, দিয়েছিলে অনুপম উচ্ছ্বল ঢেউ।
যতগুলি ঝিনুক কুড়িয়ে পেয়েছি, হাতের-
আড়ালে নোনা জলে সব,
ফেনিল স্রোতের ফেনায় উঠে এলে তুমি
বহু শঙ্খ সমুদ্র কলরব।
নিথর পাথর বেশে জড়া জীর্ণ প্রহরে
আমি, ধীর ক্ষয়ে শল্কমোচন;
মরুর জ্বলা হতে শৈল্পিক দ্বারে এনে
তোমা হাতেই কালিমা শোধন।
এই সুরভিত স্নিগ্ধতায় শিহরিত অবয়ব
তোমার আহূতি আমার অহংকার,
ফিরে আসা চেনা পথে বাঁকে বাঁকে তুমি
ভাবি তোমায় কি দিই উপহার?
-
কবিতা- জীবন বোধের মূল্য
জীবন বোধের মূল্য
-অমল দাস
জীবন বোধের মূল্য এখনো শূন্য পথেই ডাকছে
ক্যানভাসে রঙ যতই লাগুক নীরবতাই আঁকছে।
পাঁকের মধ্যেই আবদ্ধ আজও পদ্ম হওয়া হলনা
লক্ষ শ্যাওলা ঘিরে রেখেছে সৌর আলো এলনা।
জলপ্রপাত হয়ে ঝরছি নিত্য পাথরের বুকে কান্না
বোঝে নি ব্যথা পর্যটক, দেখেছে অপরূপ.. ঝর্ণা।
তাপে উত্তাপে বাষ্প আবার বাষ্পে জমেছি মেঘ
আর্দ্রতাই চেপে বসেছে আসেনি ধারা-বৃষ্টি-বেগ।
যে জোয়ারে নৌকা ভাসাই স্রোত আপনি থেমে যায়
বাঁধের খুঁটিসম দাঁড়িয়েই থাকি মাটির তল হারায়।
হয়তো আকাশ মুক্ত আঙন বা হরিৎ সদা বাহার
সমান্তরালও আপত্তি টানে, জাগছে বাঁধার পাহাড়
একান্তরে রৌদ্রপুরে ভাঙছি পায়ে শুষ্ক মরু খেত,
বলয়ের তুষারস্তুপের কবরে ঢাকা সর্ব অভিপ্রেত।
উল্কাসম আলোর দ্যুতি কই? পতন অনন্ত চলছে
দাবানল নেই এমন নয়! আমি বৃক্ষটাই জ্বলছে।
-
কবিতা- কপিরাইট
কপিরাইট
-অমল দাস
এ জগতের সমস্ত রঙে চোখ হোলি খেলেছে
কোলাহলের মল্লার সুরে কান শুধিত
দূষণের সুগন্ধ এড়িয়ে নাকের ছিদ্র দ্বয়-
বাঁচিয়ে রেখেছে জ্যান্ত অনুভূতি,
ব্যথা-বিরহ, তাপ-উত্তাপ সবই আছে,
যদিও অস্তিত্ব গুরুত্বহীন,
এক প্রকার জড় বস্তু!
নদীর জলের কলকল ধ্বনি রক্ত স্রোতে স্পর্শ করেনি!
ঝরে গেছে বহু বৃষ্টি, মাটিতে দাগ কেটে…
আমার বাগানের পাতা ঝরে অন্যের উঠোনে!
তারপর ঝাড়ু, তারপর শুষ্কতায় অন্যের উনুনে।
ছাই-ভস্মের দায় সব বামাক্ষ্যাপার…
আদ্র আবহের সুযোগে আমাকে শ্যাওলা ঘিরেছে,
আহ্লাদে আমোদ, ক্রিয়ায় পরকীয়া নাই বা থাকুক
কপিরাইট সব এখন কীটপতঙ্গের।
-
কবিতা- শুনতে চাই মৃত মানুষের ঠোঁটে…
শুনতে চাই মৃত মানুষের ঠোঁটে…
– অমল দাস
আপনার মতামত কি ?
এই যে এভাবে মৃত হয়ে পড়ে আছেন
সমস্ত বিষয়-আসয় ছেড়ে!
কিছুক্ষণেই আপনি বাসি হবেন।
আত্মীয় স্বজন মুহুর্মুহ শোক বিহ্বলতায় অশ্রুজলে সিক্ত হচ্ছে!
মনুমেন্টের ধ্বংসস্তূপের মত অন্যের কোলে লুটিয়ে পড়ছে
বহু দশকের তৈরি স্থাপত্য জলে ভাসছে
কেমন লাগছে আপনার এই দৃশ্য?
আপনার সাথে ইহজন্মের কোন লেনদেন নেই
পূর্বজন্মের ঋণ সুতোয় আবদ্ধ ছিলেন, মনে হয়না
ভাব ছিলনা! ভালবাসারও প্রশ্ন নেই
এমন কতেক আজ ফিসফিস করে বলছে-
“ওর চলে যাওয়ায় বড় দুঃখের”
সত্যই কি আপনি দুঃখ দিলেন?
না নিজে, দুঃখের আঁধার অন্তরালে মুক্তি নিলেন?
আচ্ছা! এই যে আপনি নিস্পলক উর্দ্ধমুখী চেয়ে আছেন!
আশেপাশে সকলের মুখচ্ছবি ব্যথিত, অর্থাৎ
তাদের এ জন্মের ক্ষতি হল!
আপনি থাকলে সত্যিই কি তাদের লাভ হতো?
যারা! মনে মনে ভাবল ল্যাটা চুকেছে…
এতদিন কি তাদের পথের কাঁটা ছিলেন?
যারা দূর থেকে মেকি শান্তি কামনায় আকুল…
জীবিতাবস্থায় কামনার চৌহদ্দিতে এসেছিল তারা?
বলুন না, কি বলবেন এ ব্যাপারে?
তাছাড়া আরও একটা প্রশ্ন!
বাইরে দেখলাম আলোচনা হচ্ছে-
আপনাকে শ্মশানে কাঠে জ্বালবে না চুল্লীতে, তাই নিয়ে দ্বিধা
কার্বন তো দু”টিতেই উড়বে!
আপনি কোথায় জ্বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন?
আসলে ওরা সবাই কান্নায় বিহ্বল,
ওদের প্রশ্ন করতে আমার বিবেকে বাধে
তাই আপনিই বলুন,
একটু এই ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে
আমি সব রেকর্ড করছি, লাইভ ষ্ট্রিমিং হবে…
সদ্য জার্নালিজম্ ডিগ্রীটা হাতে পেয়েছি
অনেক প্রশ্ন…
একধাপ নয়! পৃথিবী থেকে লাফিয়ে,
শুনতে চাই মৃত মানুষের ঠোঁটে…
-
অণু গল্প- আজব ‘আই কিউ’!
আজব ‘আই কিউ’!
-অমল দাস
ফুরফুরে সকাল, হালকা শীতের আমেজ। পিঠে রোদের আরাম নিয়ে বন্ধুদের বিশ্বজোড়া গল্প। সিদ্ধান্ত থাকুক বা নাই থাকুক, সমাজে অভিযোগ কিন্তু ভুরিভুরি। এমন সময় পশ্চিমী হাওয়ার বেগে একবন্ধুর বাইক এসে থামল। তেলের ট্যাঙ্কিতে ভুঁড়িটা রেখে সমবেতদের কাছে নিবেদন রাখে ‘কেউ একটা বিড়ি দে’। এরা সকলেই বিড়িতুতো ফ্রেন্ড। তৃপ্তির সুখটানে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকাতে পাকাতে বলল– বুঝলি ভাই, সেই মেয়েটাকে আজ দেখলাম।
যাকে লক্ষ্য করে বলা, সে হয়তো মনে মনে ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলো। নিরুপায়হীন হয়ে শেষে- কোন মেয়েটা রে…?
-মনে নেই কয়েকবারই তো গল্প দিয়েছিলাম।
-মনে থাকার কি কথা? চারিদিকে এতো জ্ঞান তাত্ত্বিকের নতুন নতুন বাণীর সাথে এতো পুরনো অনুৎপাদক কথা কেই বা মনে রাখে, রে…।
-আরে.. যাকে প্রপোজ করেছিলাম একসময়, সেই মালটা। বলেছিলাম মনে নেই?
বন্ধুটির ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের সুর– লে… বিয়ে করেছিস বাছা দশ বছর পার হয়ে গেল, এখনো মালে নজর? তা এককালে সে বস্তুটা তো মেয়ে ছিল! প্রপোজাল ফেলে দেওয়ার পর সেটা মাল হয়ে গেলো?
-ওই আর কি! কথা ধরিস না বা*!
– তা তোকে দেখলো? এখন কেমন লাগছে?
– আর বলিস না! পুরো মাগি একাটা।
– মানে?
– আরে বিয়ে হয়নি এখনো, মাগি বলব না তো কি বলবো!
– এটা কি কথা ভাই..? ছোট বেলায় মেয়েটা ভালো ছিল, তাই প্রপোজাল দিলি। সে না বলার পর মাল হলো। কোন কারণে দেখে মনে হল বিয়ে হয়নি, তাই সে মাগি? তা রাস্তায় অনেক বিবাহিত মহিলাকেই আজকাল বিয়ে হয়েছে বলে মনে হয় না। তাই বলে সবাই…! লাজবাব তোর ‘আই কিউ’ ভাই!
– ওই হল আরা কি….
– না! এটা হলো না…
-
অণু গল্প- মালতী
মালতী
-অমল দাস
মালতীকে ছোট বয়সেই রমেশে এনেছিল। সেই থেকেই মালতী রমেশের চোখের মণি।তার সংসারে বৌ শ্যামলা আর বছর পাঁচের মেয়ে সম্প্রীতি।মালতী যখন এসেছে, তখন সম্প্রীতি ঘরে আসেনি।আলোর রশ্মি মালতীই এনেছিল।স্বামী-স্ত্রী দু’জনার সহচর্যে আদরে আহ্লাদে বেশ বেড়ে উঠেছে। শ্যামলা নিজের গর্ভজাতকে জন্ম দিলে দু’জন একই সাথে পালিত হতে থাকলো। একটা সময় দু-বছর পরপর খরা হওয়ার দরুন কৃষি ভালো হয়নি। খুব আর্থিক সংকটে দিন কাটাতে হয়। সেই বছর দু-একবার মালতীকে বেচে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল রমেশ। পারেনি। যখনি মালতীর গলার দড়ি খুলে ক্রেতার হাতে দেওয়া হত, তখনই সে হাম্বা হাম্বা করে কান্না জুড়ে দিত। আর দু-চোখ জলে ভেসে যেত। রমেশ-শ্যামলা শেষমেশ অনটন মেনে নিয়েছিল। হেরে গিয়েছিল মালতীর আর্তনাদের কাছে।
কিন্তু ঈশ্বরের কি নির্মম খেলা! তা না হলে রমেশের ফুটফুটে মেয়ে সম্প্রীতি কি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়? চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা দরকার। গরিবের সে সম্বল কই। রাতে মালতীকে গোয়ালে খাবার দিতে দিতে চোখের জলে ফেলেছিল রমেশ। কিন্তু মালতীর নজর এড়াতে পারেনি। সে তার প্রভুর অন্তরের ব্যথা অনুভব করতে পেরেছিল। শুধু দুবার নিজের জিভ দিয়ে রমেশের চোখ মুছে দিয়েছিল নীরবে। রমেশের অসহায়তার কথা শুনে এক ক্রেতা সকালেই এসে হাজির। রমেশ আজ মালতীর দড়ি খুলতে গেলো না। ক্রেতার দেওয়া তিরিশ হাজার টাকা নিয়ে বসে রইল দাওয়ায়। শ্যামলাও নিশ্চুপ মেয়ের শয্যার পাশে। যখন একটু জ্ঞানে এলো, তখন রমেশ কাঁদতে কাঁদতে ছুটে যায় গোয়ালে– ‘তোমরা ওকে নিওনা! আমার যা হয় হবে। ওকে তোমরা নিওনা…’
না! আজ আর তার কান্না শোনার কেউ নেই গোয়ালে।মালতী অনেক আগেই নতুন মালিকের সাথে চলে গেছে। শুধু আজ আর বিদায় কালে চোখের জলে হাম্বা স্বরে ডাকে নি…
-
অণু গল্প- সোহাগ
সোহাগ
-অমল দাস
-বলছি এ বাড়িতে কেউ কি আছে, কথা শোনার মত? না কি আমি উপেক্ষিত? এই অনাহুতের দিকে একবার দেখলেতো উদ্ধার হই! শশাঙ্কবাবু রাগে সাপের মত ফুঁসতে ফুঁসতে একবার এ ঘর একবার ও ঘর একবার ডাইনিং-এ পায়চারী করছেন।
বৌমা শাশুড়ি রান্নাঘরে ব্যস্ত। শাশুড়ি সাড়া না দেওয়ায় বৌমা বলল- মা তুমি যাও, দেখো বাবা কি বলছে!
-তুমি থামো শুভ্রা! ও মানুষটা সারাজীবন ওই রকমই করে গেলো আমার সাথে।কেন করছে বুঝিনা ভাবছো… বলতে বলতে এগিয়ে গেলো।
কেতকীদেবী কর্তার ঘরে ঢুকে প্রশ্ন- কি, হয়েছে কি? সেই থেকে দেখি হুমড়ি-তুমড়ি করছো! লাজ-শরম কি খেয়েছ?
-হ্যাঁ… সে তো বহুকাল আগে বাসী-বিয়ের জলের সাথে খেয়েছি। এ আর নতুন কি?
-মানে! কি বলতে চাও?
-আর কি! সত্তরটা বছর শেষ হয়ে গেলো তোমার সাথে…
-মনে হয় জন্মেই একসাথে গাঁট বেঁধেছি…! কথা-বার্তা চিন্তা করে বলো না?
-কেন? এতো দিন তো শুনতাম চিন্তা করতে হবে না, আমি স..ব সামলে নেবো। এখন আমার চিন্তা কিসের?
– তা কেন? আমার দায়, আপনি তো অতিথি… বলি হুজ্জতিটা কিসের?
-আমি মানুষটা জ্যান্ত আছি যে! খিদে পায় তো না কি?
-মানে? আধাঘন্টাও হয়নি রুটি-তরকারি খেলে এরই মধ্যে… পেটে কি ইঁদুর ঢুকেছে?
– মাথা গরম করোনা! রান্না ঘরে হচ্ছে কি? একটা সুস্বাদু গন্ধ এলো!
-বুঝেছি! আগেই বুঝেছি এ কিসের যন্ত্রণা…
মুখভার করে রান্না ঘরে চলে যান কেতকীদেবী।
বৌমা কৌতূহলী –কি হয়েছে মা?
-কি আবার? খাই রোগ…! দাও! একবাটি পায়েস দাও… গন্ধ পৌঁছে গেছে নাকে!
শশাঙ্কবাবু হাই-সুগারের রোগী। পায়েস পেয়ে খুবই আপ্লুত আবেগে- শোনো-না.. কেতকী রাগ করোনা! তুমি ছাড়া আমার অস্তিত্ব নেই। জানো তো কত ভালোবাসি…
-হয়েছে! সোহাগে আর বাঁচি না…
-
কবিতা- জীবিতের নামাবলী
জীবিতের নামাবলী
-অমল দাস
পৃথিবীর অ্যালবেডোর পরে, যেটুকু আলো আমাদের জন্য বরাদ্দ
আমার অপূর্ণতার দায়ভারের জনম কুন্ডলী কাঁধে নিয়ে
সকালের সেই রোদের সিংহভাগ,
কাঁচের জানলায় বিপরীত প্রতিফলনে ফিরে যায়!
ল্যাদ খাওয়া শরীরে আড়মোড়া ভাঙা খাটের তাচ্ছিল্যের খিটখিট হাসি
সম্মুখের দেয়ালে ঝুলে থাকা আরশিতে চেনা মুখের
এক অচেনা প্রতিবিম্ব জেগে ওঠে!
তখন মৃদু দোলায় টালির চালে বাঁশের আড়ায় ঝুলে থাকে
কালিমাখা বিরহ!
এ জগতের সমস্ত উদাসীনতার ধূলি
আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আমার অসহায় দেহে!
এভাবেই রোজ স্মৃতির গামছা কাঁধে ফেলে বাইরে বেরিয়ে আসি
স্নিগ্ধ হাওয়ার আশায়
যন্ত্রণার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অণু কণা ফিল্টার করে স্বচ্ছ শ্বসন আর হয়না
দায়িত্ব আর কর্তব্যের মিশ্র রসায়নে অস্তমিত বেলায়
উদ্বায়ী পদার্থ হয়ে অমীমাংসিত রয়ে যায় বাষ্পীয় রজনী
রোজনামচার এই নিত্য কলহের ভিড়ে মিথ্যে সুখের সন্ধান করি
আসলে এ জগতে সুখ মৃত্যুর’পারে,
জীবিতের নামাবলীতে অসুখের উপর অসুখ।