-
ধারাবাহিক- পুনারাবৃত্ত (পর্ব-২)
পুনারাবৃত্ত (পর্ব-২)
-অযান্ত্রিকবংশী ডাকলো, “বউদিমনি, দুপুরের রান্না হয়ে গেছে, আপনাদের কি খেতে দিয়ে দেবে, মানে ঘরে দিয়ে আসবে, জানতে চাইলো, রাধার মা।“
“ওমা সেকি! এর মধ্যে রান্না হয়ে গেলো? কি কি রান্না করল গো রাধার মা?“ নিজেকে স্বাভাবিক করতে করতে বললেন মোহনা।
“তাড়াতাড়ি কি বলছেন বৌদিমণি, ঘড়িতে দেখেছেন দেড়টা বাজতে গেলো, কাল সারা রাত ভালো করে বিশ্রাম হয়নি, একটু বিশ্রাম না নিলে চলবে কি করে আপনাদের সামনে এতো বড় কাজ? ঐ যেমনটা আপনি বললেন তেমনই ভাত, মুশুরডাল, আলুভাজা, পেঁয়াজ পোস্ত আর আমড়ার আঁচার”
“বাবা এইটুকু সময়ে এতো কিছু করে ফেললো রাধার মা, এলেম আছে বলতে হবে। ঠিক আছে দাঁড়াও, আমি স্নানটা সেরে আসছি তোমার দাদাবাবু বোধহয় ঘুমাচ্ছে দেখছি গিয়ে, আধ ঘণ্টা সময় দাও দুজনেই আসছি নীচে, ওখানেই খেয়ে নেবো“ জানালেন মোহনা। বংশী মাথা নেড়ে চলে গেলো, আর মোহনাও দোতলায় নিজেদের ঘরে চলে গেলো। দরজাটা ভেজানোই ছিল, ঠেলা দিয়ে ঘরে ঢুকেই দেখলো, অরিত্র ঘরের মধ্যে পায়চারী করছে।
“কি ব্যাপার ঘুম হলো? স্নান করে নিয়েছ নাকি? খেতে যাবে তো? কখন উঠলে?” বেশ মজার স্বরেই বললেন মোহনা ।“ হ্যাঁ হ্যাঁ ওসব আগেই মিটিয়ে রেখেছি, স্নান করেই শুয়ে ছিলাম, খুব ভাল ঘুম এসেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো, দেখলাম খিদেও পেয়েছে, তাই উঠে পায়চারি করছিলাম, তুমি এলে একসাথে খেতে যাবো। দারুণ জায়গা কিন্তু মানতেই হবে, যেমন ঘুম হয় তেমন খিদেও পায়, নাও নাও তুমি একটু তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসো তারপর একসাথে খেয়ে একটু জঙ্গলের দিকটায় ঘুরে আসবো। এসে থেকে জঙ্গলটা ডাকছে কিন্তু একবারও যেতে পারলাম না..” বললেন অরিত্র।
“ও বাবা সেকি গো, তারপর বউ ছেড়ে সংসার ছেড়ে জঙ্গলের ডাকে চলে যেও না যেন। তবে একটা বিষয় নিশ্চিন্ত, রাতে যা নাক দাকার আওয়াজ, তাতে বাঘ সিংহ যা আছে জঙ্গলে ঘাড় ধরে আবার তোমায় ফিরিয়ে দিয়ে যাবে..” স্নান ঘরে ঢুকতে ঢুকতে হেসে বলে গেলো মোহনা, অরিত্র কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই দড়াম করে স্নান ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন মোহনা।
একটু পরেই দুজনে নীচে রান্না ঘরের রাখা খাওয়ার টেবিলে হাজির হলো। ওদের আসতে দেখেই বংশী আর রাধার মা দুজন খাওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছিল। খেতে বসে, গরম গরম ভাত, ডাল, ভাজা, পোস্ত পেয়ে মোহনাও ভুলে গেলেন সিঁড়ির দরজার কথা। অরিত্র জঙ্গলের কথা জানতে চাইলেন বংশী আর যোগেন বাবুর কাছে, জীবজন্তু বেরোয় কিনা রাতের বেলায়, কি কি বন্য জন্তু আছে এই জঙ্গলে এই সব আর কি। ওদের কথা চলাকালীন, এক ভদ্রমহিলা বংশীর পিছনে এসে দাঁড়ালো। খুব বেশী বয়স হবে না, বড়জোর বছর তিরিশের হবে, বংশীর কানে কানে কিছু বলল, বংশী মাথা নেড়ে সায় দিতেই ভদ্রমহিলা আবার রান্নাঘরের ভিতরের দিকে চলে গেলো। মোহনা বংশীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বংশী দাদা উনিই তোমার রাধার মা? তা উনি চলে গেলেন কেন? তোমরা খেয়ে নিয়েছো তো না কি?”
“ওসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনাদের মিটলে পরে আমরা খেয়ে নেবো ক্ষণ। ঐ রাধার মা জানতে চাইছিল, আপনারা রাতের বেলায় কি খাবেন? রাতের খাবার, বিকালের জল খাবার করে দিয়ে আমাদেরও বাড়ি যেতে হবে, বাড়িতে বুড়ো বাপ ছোট মেয়েটা একা আছে। আর পথটাও তো কম নয়, শেষ বাস সন্ধ্যে ছটায় ছেড়ে যাবে। তার আগেই চলে যেতে হবে।“ বললো বংশী ।
“সেকি আমরা এখানে একা থাকব? কোথায় কি আছে জানি না তো” প্রায় আঁতকে উঠে বললেন অরিত্র।
“না না স্যার, ওসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, ওরা চলে যাবে আমি তো আছি। আমি এখানেই থাকি।” অরিত্রকে আশ্বস্ত করে বললো যোগেন বাবু ।
“আচ্ছা সরকার বাবু, আমাদের এখানে স্টাফ কোয়াটার এর ব্যবস্থা করা যায় না? যদি নাও হয় আমাদের গাড়িটাতো আছেই, অতে করেই না হয় ওনাদের পৌঁছে দিয়ে আসব আবার সকালে নিয়েও আসব, কি বলেন?” বললেন মোহনা।
“সে হতেই পারে, তবে আমাদের এই বাড়ির পিছন দিকে বেশ কয়েকটা ঘর আছে সেগুলো দীর্ঘদিন অব্যবহারে মেরামতের অযোগ্য হয়ে গেছে। ভেঙ্গে নতুন করে করতে হবে, ততদিন দেখি কিছু অন্য ব্যবস্থা করা যায় কিনা“ জানালো যোগেন সরকার।
“দেখুন যা করবেন একটু তাড়াতাড়ি করুন, কারণ অনলাইন বুকিং শুরু হয়ে গেছে, খুব শীগগির অতিথিরাও আসতে শুরু করবেন। তখন যদি এই সমস্যা থেকে যায় তাহলে মুশকিলে পরে যাবো। আচ্ছা তাহলে আমি এবার উঠি, আলো থাকতে থাকতে একবার জঙ্গলের দিকটা ঘুরে আসি, মোহনা কি করবে? যাবে না কি একটু বিশ্রাম নিয়ে নেবে?” বলে খাওয়া শেষ করে উঠে পরলেন অরিত্র সোম।
“ না না তুমিই যাও আমি একটু ঘুমিয়ে নি বরং..“ মোহনা দেবীও খাওয়া শেষ করে উঠতে উঠতে বললেন। বংশী মোহনাকে হাত ধোয়ার জল এগিয়ে দিয়ে বললো, আপনারা কি রাতে রুটি খাবেন। তাহলে রুটি আর একটা কি দুটো তরকারী করতে বলে দি রাধার মা কে?” মোহনা সম্মতি জানিয়ে নিজেদের ঘরের দিকে চলে গেলো। সত্যিই যেন ডাকছে, চোখের জানলা দু’টো যেন কেউ জোর করে বন্ধ করে দিতে চাইছে। সেপ্টেম্বরের দুপুর হলেও গরম একেবারেই নেই। ঘরে ঢুকতেই জঙ্গলের দিক থেকে একটা ঠাণ্ডা হাওয়া মোহনাকে এমন জড়িয়ে ধরলো যে মোহনা বিছানায় পিঠ দিতে দিতেই হারিয়ে গেলো ঘুমের সমুদ্রে।
কয়েক ঘণ্টা কিভাবে কেটে গেলো মোহনা বুঝতেই পারলো না। মোহনার ঘুম ভাঙলো মেয়েলী কণ্ঠের একটা ডাকে। মোহনা ধড়মড় করে উঠে বসে দেখলেন, রাধার মা চায়ের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। “বউদিমনি আপনি এতো ঘামছেন কেন? শরীর খারাপ লাগছে নাকি? কোনো ভয়ের স্বপ্ন দেখেছেন?”
“না, ঠিক বুঝতে পারছি না। কটা বাজে? তোমাদের বোধ হয় খুব দেরী হয়ে গেল তাই না? দাদাবাবু ফিরেছেন?” একটু অপ্রস্তুত হয়ে জানতে চাইলো মোহনা ।
“হ্যাঁ হ্যাঁ দাদাবাবু তো অনেক্কখন ফিরে এসেছেন, যোগেন দাদার সাথে পিছনে ভাঙ্গা ঘরগুলো দেখছেন। কিন্তু আমি একটা কথা বলছিলাম যদি রাগ না করেন“ বললো রাধার মা।
“হ্যাঁ হ্যাঁ নির্ভয়ে বলো, আমি সহজে রাগ করি না, আর বাড়ির লোকের কথায় কি কেউ রাগ করে?”
“ বলছিলাম কি বউদিমনি, আমরা সারা দিন এখানে কাজ করবো, কিন্তু থাকার ব্যবস্থা করতে হবে না। বাড়িতে ছোট মেয়েটাকে আর বুড়ো বাবাকে রেখে আমরা এখানে থাকতে পারব না “
“ ওমা এই কথা! তা ওদের ওখানে একা রাখতে বলেছে কে? ঘরগুলো তো নতুন করে করা হচ্ছে যাতে তোমরা এখানে সবাই একসাথে থাকতে পারো। ও নিয়ে কিছু ভাবতে হবে না একটু সময় লাগবে ততদিন অন্য কিছু ব্যবস্থা ঠিক করে ফেলবো আমরা“ আশ্বস্ত করলেন মোহনা।
“ না গো বউদিমনি, সেটাও আসল কারণ নয়। কারণটা আমি এক্ষুনি বলতে পারবো না, সে অনেক কথা ওদিকে আবার কাজ পরে আছে, বাড়িও যেতে হবে। এখন আমি আসি“ বলেই হুড়মুড় করে দৌড় লাগাল রাধার মা, আর সঙ্গে সঙ্গে ঘরে এসে ঢুকলেন অরিত্র, চায়ের কাপ হাতে। ”কি গো ঘুম হলো? তোমার চোখ মুখ অমন শুকনো লাগছে কেন?“
“ ঘুম তো হলো কিন্তু ভুলভাল স্বপ্নে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। এখন আবার সেগুলো মনেও করতে পারছি না, যাই হোক ছাড় ওসব কথা, তুমি পিছনের ঘরগুলো দেখলে? কি অবস্থা?” জানতে চাইলেন মোহনা।
“দেখলাম, ওগুলো সত্যি মেরামত করা যাবে না। ভেঙ্গে নতুন করে করতে হবে। ততদিন ভাবছি একটা পিকআপ ভ্যানের ব্যবস্থা করবো। এমনিতেও স্টেশন থেকে গেস্ট পিক আপের জন্য লাগতোই, সেটা নাহয় কদিন আগেই কিনে নেবো, ওদের নিয়ে আসা দিয়ে আসার কাজে লেগে যাবে যতদিন না ঘরগুলো কমপ্লিট হয়” অরিত্র কথা শেষ করার আগেই ঘরের বাইরে কেউ টোকা দিল। “দাদাবাবু আসবো?”
“আরে এস এসো, বংশী দাদা “ বললেন অরিত্র। বংশী দুটো প্লেটে করে ভরতি আলুর পকোরা আর পেঁয়াজি নিয়ে ঘরে ঢুকলো। সামনের টেবিলে রাখতে রাখতে বললো,
“বউদিমনি, খেয়ে দেখুন আলুর পকোরা আর পেঁয়াজি রাধার মা খুব ভালো বানায়, ফ্লাক্সে করে চা এনেছি আর আপনাদের রাতের খাবার নীচের ঘরে টেবিলে রেখেছি সেগুলো কি উপরে দিয়ে যাবো? আসলে এবার আমাদেরও রওনা দিতে হবে সন্ধ্যেও হয়ে আসছে।”
“না না ওসব করার দরকার নেই আমরা নীচে গিয়েই খেয়ে নেবো, তোমাদের তো দেরী হয়ে যাচ্ছে তোমরা এগোও, অরিত্র ড্রাইভার দাদাকে একটু বলে দাও না ওদের পৌঁছে দিয়ে আসুক“ বললেন মোহনা, অরিত্র কিছু বলার আগে বংশী বললো, “না না বউদিমনি আপনাদের কষ্ট করতে হবে না আমরা ঠিক চলে যাবো, তবে একটা কথা ছিল, যদি কিছু মনে না করেন..”
“কি কথা বলো না, সঙ্কোচের কি আছে?” বললেন মোহনা , “দাদাবাবু অচেনা জায়গা তো রাতের বেলায় বেরোবেন না, কোন শব্দ পেলেও না। আর যতটা পারবেন উপরেই থাকবেন নীচে যাওয়াটা এড়িয়ে চলবেন, শুনেছি এখানে অপদেবতা বেরোয়, একটু সাবধানে থাকবেন।“ বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো বংশী। বংশী বেরিয়ে যেতেই মোহনা বললেন “এই বাড়ির কিছু ইতিহাস আছে অরিত্র আমি নিশ্চিত, আর সেটা এরা খুব ভালো জানে কিন্তু বলছে না।”
পাহাড়ি জঙ্গল এলাকায় যেমন ঝপ করে সন্ধ্যে নামে ঠিক সেই ভাবে হঠাৎ করে চারিদিকে সন্ধ্যে নেমে এসেছে বাইরে। অদ্ভুত একটা গাম্ভীর্য যেন গ্রাস করে নিতে চাইছে পুরো বাড়িটাকে, শুধু পারছে না জঙ্গল থেকে ভেসে আসা বন্য জন্তুর ডাক আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার জন্য। অরিত্র একটা আড়মোরা ভেঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “সারাদিনে এখানে কাজের চক্করে মেলগুলো চেক করা হয়নি, দেখি একবার আর মাল পত্তর কিছু আসার কথা ছিল আজ কিছুই তো এলো না সে গুলোও জানতে হবে” বলে ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বার করে বিছানার পাশে টেবিলটায় গিয়ে বসলেন। মোহনাও ডুবে গেলেন একটা পত্রিকায়। আসার সময় কিনে ছিলেন পড়ার সময় হয় নি। কিছুক্ষন দুজনেই নিজের কাজে ডুবেই রইলেন । চমক ভাঙল একটা শব্দে, কেউ বা কারা নীচে সদর দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। অরিত্র বিরক্ত হয়ে বললেন “কে এলো আবার এখন? ওহ হতে পারে লজিস্টিকস-এর লোক বোধ হয়; কিন্তু যোগেন বাবু তো নীচেই ছিলেন, আমিই গিয়ে দেখি..” বলে ল্যাপটপ বন্ধ করে নীচে নেমে এসে দরজা খুলে দেখলেন কেউ নেই। তাও চারিদিক একবার চোখ বুলিয়ে দরজা বন্ধ করে সিঁড়িতে উঠতে যাবেন আবার দরজা ধাক্কানোর শব্দ, অরিত্র আবার নেমে এসে দরজা খুলে দেখলেন নাহ্ কেউ কোথাও নেই, কে এমন মস্করা করছে কে জানে?চলবে …………..
-
ধারাবাহিক- পুনরাবৃত্ত (পর্ব-১)
পুনরাবৃত্ত (পর্ব-১)
– অযান্ত্রিক“বারান্দা থেকে জঙ্গলের দিকটা দেখতে দারুণ লাগছে, তাইনা মোহনা? দক্ষিণ দিকটা বোধ হয় ঐটাই” বললেন অরিত্র বাবু, মানে অরিত্র সোম। সোম হলিডে রিসোর্টের মালিক। মাস ছয়েক আগেই কিনেছেন এই প্রাসাদপম অট্টালিকা। বরাবরের মতই অকশানে। এই সোম দম্পতির, পায়ের তলায় তো সর্ষে, আর ব্যবসাটাও যখন রিসোর্টের তখন সেটা বাড়ানোরও তো একটা তাগিদ দুজনেরই আছে। বছর কয়েক আগে, জলদা পাড়া ন্যাশনাল পার্ক ঘুরতে এসেই শুনে ছিলেন অরিত্র বাবু, জঙ্গলটাও কাছেই যদিও সেটা জলদা পাড়া নয়, চিলাপাতা জঙ্গল। অরিত্র বাবু, দেখেছিলেন জঙ্গলটা খুব পরিচিত নয় ভ্রমণ পিপাসু মহলে, আশে পাশে তেমন ভাল হোটেল নেই। কাজেই থাকতে গেলে সবাইকেই সেই হাসিমারা টাউনেই থাকতে হয়। অরিত্র বাবু ভ্রমণ পিপাসু মানুষ বলেই এই অভাবটা সত্যিই অনুভব করেছেন। আর ওনার যে খুব তীব্র ব্যবসায়িক বুদ্ধি সেটা কে আর না জানে। এমন জঙ্গলের কাছে যদি একটা আধুনিক সুযোগ সুবিধা যুক্ত থাকার জায়গা করা যায় তাহলে তো আর কথাই নেই। অরিত্র বাবুদের হোটেল ব্যবসা বেশ কয়েক পুরুষের, দেশের নানা প্রান্তে ওনাদের হোটেল রিসোর্ট আছে- বকখালী, মন্দারমণি, দীঘা, গাংটক, চাদিপুর, গোপালপুর। অরিত্রবাবু নিজেও বেশ কটা করেছেন মধুপুর, গিরিডি, নেতারহাট, বক্সার। যদিও নামগুলো শুনেই বুঝতে পারছেন অরিত্র বাবুর জঙ্গলের প্রতি একটা টান আছে। গত তিন বছর ধরে চেষ্টার পরে কয়েক মাস আগেই এই বাড়িটা কিনেছেন। বাড়ি বলা ভুল হবে হাভেলি বলাই ভালো, জঙ্গলের একদম গায়েই। অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে তারপর অরিত্র বাবু খুলতে পারছেন তাদের সোম হোটেল রিসোর্টের নবতম শাখা চিলাপাতা জঙ্গলে। কেনার পর অরিত্র বাবু কয়েকবার ঘুরে গেলেও মোহনা দেবী প্রথমবার এলেন এবারই। আর আসবেন নাইবা কেন? দু’ দিন বাদেই তো উদ্বোধন হবে “চিলাপাতা গ্রিন ভাল্যি রিসোর্ট’। সব শাখা সাজানো গোছানোর দায়িত্ব সাধারণত মোহনা দেবীরই থাকে। আগে থেকে লাইভ ভিডিওতে যা যা করানোর, করিয়েছেন এবার শেষ বা ফিনিশিং টাচগুলো দিতে সশরীরে আসতেই হয়েছে। অরিত্র বাবুর কথায় মোহনা দেবী কোন উত্তর দিলেন না, শুধু মাথা নেড়ে সন্মতি জানালেন।
“তোমার কি মনে হয়? লোকেশন হিসেবে ব্যবসা কেমন হতে পারে?“ আবার বললেন অরিত্র বাবু।
“সবার তো জঙ্গল ভালো লাগে না, তবে যাদের লাগে সেই স্তরের লোকের কাছে পৌঁছাতে পারলে ব্যবসা না হওয়ার তো কারণ দেখি না। তবে আমার মনে হয় যদি বাড়িটাকে রাজবাড়ীর মত করে আরও ডেকরেট করতে পারলে অন্য শ্রেণীর লোকের কাছেও পৌঁছানো যেতো। আজকাল তো হামেশাই বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য এমন বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়। ঘর তোঁ অনেক গুলোই আছে“ বললেন মোহনা দেবী।
“সেটা আমার মাথায়ও আছে, বহুদিনের বাড়ি হলেও, আমাদের রং করানো, আর ইলেকট্রিকের কাজ ছাড়া তেমন কিছু কাজ করতে হয় নি। তুমি লক্ষ্য করেছো কিনা জানি না একটাও দরজা জানলা দীর্ঘদিনের অব্যবহারেও পালিশ নষ্ট হয় নি, মেঝের মারবেল পালিশও খারাপ হয়নি। তাহলে ভাবো যিনি এই বাড়ি তৈরি করেছিলেন, কত ভাল ভাল জিনিষ ব্যবহার করেছিলেন।“
“সে আমিও লক্ষ্য করেছি। আচ্ছা অরিত্র বাড়িটার ইতিহাস সম্বন্ধে কিছু জেনেছ? মানে কাগজ পত্রে যা বয়স লেখা আছে সেটাই ঠিক নাকি বাস্তবে তার থেকে অনেক বেশী। আজ পর্যন্ত কতবার হাত বদল হয়েছে? কোন গঠনগত পরিবর্তন হয়েছে কিনা? অথবা প্রথম অবস্থায় কেমন ছিল দেখতে“ জানতে চাইলেন মোহনা দেবী।
“না না অতসব আমি খোঁজ নিই নি, যা জানি সেটা অকশান ডকুমেন্ট থেকেই জেনেছি। ওদের কাগজ আর দলিল দেখে জেনেছিলাম, এই বাড়িটা ১৮৯৭ সালে হাসিমারার কোনো মহারাজ শৈল বিক্রম সিংহ করে ছিলেন, উনি নিজে ভাল শিকারীও ছিলেন। যদিও ১৯২০ সালে কোনো দুর্ঘটনায় উনি মারা যান। তার প্রায় বছর দশেক পরে ওনার পরিবারের লোক এই বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র চলে গেছেন। তারপরেও বহু হাত বদল হয়ে শেষমেশ বিজয় সরকার নামে একজন প্রপার্টি ডিলারের হাতে ছিল বাড়িটা। উনিও এই বাড়ি বাঙ্কের কাছে জমা দিয়ে বড় অঙ্কের টাকা লোন নিয়েছিলেন। পরে শোধ করতে না পারায়, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বাড়িটা নিলাম করে দেয়। আমি সেখান থেকেই কিনেছি, মালিকানার ব্যাপারে এর থেকে বেশী কিছু জানি না।“
মোহনা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু চা জল খাবার নিয়ে বারান্দায় ঢুকলো বংশী, “স্যার চা নিয়ে এলাম, আর দুপুরে কি রান্না করবে জানতে চাইলো রাধার মা, যা বলবেন সেই মতো বাজার যাবো।“
“আসো, আসো বংশীদাদা আরে আমাদের স্যার ম্যাডাম, বলে বাইরের লোক করে দিও না। আমরা তোমাদের বাড়ির লোক, বাড়ির লোককে কি কেউ স্যার ম্যাডাম বলে নাকি?” হাসতে হাসতে খুব আন্তরিক ভাবে বললেন মোহনা। “দুপুরে যে কোনো কিছু রান্না করো, মাছ মাংস খাওয়ার তেমন ইচ্ছে নেই। রাধার মাকে বলে দ্যাখো না যদি বাড়ির মতো করে মুসুর ডাল আর কিছু ভাজা টাজা আর একটা তরকারী করে দেয়, সারা রাত ট্রাভেল করে এসেছি তো, রিচ কিছু খাব না।“
“আচ্ছা ঠিক আছে, আমি সেটাই বলে দিচ্ছি, রাধার মাকে“ বলে চলে যাচ্ছিলো বংশী, কিন্তু অরিত্র বললেন, “আচ্ছা বংশীদাদা, তোমরা তো শুনেছি এখানকার আদি বাসিন্দা। তাহলে এই বাড়ির ব্যাপারে নিশ্চয়ই অনেক কিছু জানো, মানে এই বাড়ির ইতিহাস আর কি। যদি একবার সে সব সময় করে একবার জানাও তাহলে সেই অনুযায়ী বাড়িটাকে সাজানো যায়, আমরা তো তেমন কিছু জানি না।“
“হ্যাঁ, সে ঠিক কথাই বলেছেন দাদাবাবু, আমরা প্রায় চার পুরুষ ধরে এখানেই আছি, আমার ঠাকুরদা তার বাপ তো এই বাড়িতেই কাজ করতো। তবে কিনা আমি জন্ম থেকে বাড়িটা বন্ধই দেখেছি, এর থেকে বেশী কিছু জানি না। জানলে শিতলদাদা জানতে পারে। বছর কয়েক আগে অব্ধি ঐ তো দেখাশুনা করতো, আর আমাকেও তো ঐ এখানে কাজের খবর দিয়েছিলো। দেখছেনই তো আশেপাশে দশ কিলমিটারের মধ্যে কোনো বাড়ি ঘর নেই, কে আর খবর রখে এই সিংহ বাড়ির.. “
“ওঃ তাহলে তো হয়েই গেলো, তাহলে একদিন চলো না শিতল দাদার কাছে বা একবার সময় করে নিয়েই এসো, আমার গাড়িটা আছেই এখানে।“ বললেন অরিত্র।
“হে হে দাদাবাবু, শিতল দাদা আমার ঠাকুরদাদা গো, বড্ড বুড়ো, হাঁটতে চলতে পারে না, আসবে কি করে? আপনাদের ম্যানেজার যোগেনকেও তো শিতল দাদাই খবর দিয়েছিলো, সেই জন্যই আমি আর যোগেন এক সাথেই কাজ লেগেছি।“
“ঠিক আছে, আমরাই না হয় যাবো একদিন সময় করে তোমার বাড়ি তাতে কোন আসুবিধা নেই তো? বললেন অরিত্র। বংশী লজ্জায় কানে হাত দিয়ে সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো। বংশী চলে যেতে মোহনা বললেন, “একবার পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখলে হতো না? কি কি কাজ বাকি আছে সেটা তো দেখাই হল না।“
“সে করা যেতেই পারে রানী সাহেবা, কিন্তু সারা রাত গাড়ি চালিয়ে আমার একটু ঘুম পাচ্ছে। বিকালে দেখলে হতো না? আচ্ছা ঠিক আছে চলো” মৃদু আপত্তি জানিয়ে বললেন অরিত্র। “না ছেড়ে দাও, তুমি বরং চা জলখাবার খেয়ে ফ্রেশ হয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও, আমি নিজে ঘুরে দেখে নিচ্ছি, আর যোগেনবাবু তো আছেনই।“ বললেন মোহনা।
চা জলখাবার শেষ করে, ফ্রেশ হয়ে মোহনা দোতলার থেকে নীচে নেমে এলেন, সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করে প্রথম যে ঘর সেই ঘরে। এসে প্রতি কোনা দেওাল খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। অরিত্র যদিও আগেই মোহনার কথা মতো সব দেওয়ালে ওয়াল পেপার আর মেঝেতে কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু দেওয়ালগুলো কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মোহনাকে নীচের তলায় ঘোরাঘুরি করতে দেখে এগিয়ে এলেন ম্যানেজার যোগেন সরকার।
“বৌদি, কিছু লাগবে?”
“ না না, আমার কিছু লাগবে না দাদা। এই একটু ঘুরে দেখছিলাম বাড়িটা। বাড়িটার গড়নটা তো বেশ রাজ বাড়ির মতো, তাই ভাবছিলাম এই দেওয়ালগুলোতে কিছু পুরনো ছবি লাগালে, সাজানোটা আরও আকর্ষণীয় লাগতো। আপনি কি দেখেছেন? উপরে ছাদের সাথে বেশ কয়েকটা হুক লাগানো আছে। এমন হুক সাধারণত ঝাড়বাতি লাগানর জন্যই হয় অথবা দড়ি টানা পাখা। আসলে দাদা, মানুষ এখন এমন রাজকীয় পরিবেশ বেশী পছন্দ আর তার জন্য অতিরিক্ত খরচ করতেও পিছুপা হয় না। তাই ভাবছিলাম এই বাড়ির পুরনো কোন ছবি, বা মালিকদের কোন তৈলচিত্র যদি এই দেওয়ালে লাগানো যায়, তাহলে মন্দ হয় না, আপনি কি বলেন?” বললেন মোহনা।
“সে আপনি যেমন ঠিক বোঝেন, মুশকিল হল আমি যত দিন এই বাড়িটাকে চিনি তাতে এই বাড়ির ছবি বা যেমন ছবির কথা আপনি বলছেন কোনটাই আমি দেখিনি। তবে শিতলদাদা জানতে পারে, কারণ উনিই দীর্ঘ দিন এই বাড়ির দেখভাল করেছেন আমিও তো গত দশ বারো বছর হলো ওর সাথেই এসেছি, তাও আমি ঝাড়বাতি, ছবি, দড়িটানা পাখা কোনোটাই দেখিনি।“ জানালো যোগেন সরকার ।
“ওহ তাহলে ঠিক আছে, আচ্ছা? গদি,খাট,পর্দা এসব যে পাঠিয়েছিলাম সে সব যেভাবে লাগাতে বলে ছিলাম সে ভাবেই লাগিয়েছেন তো, ভিডিও কলে যদিও দেখে ছিলাম তবে ওভাবে দেখলে তো ঠিক বোঝা যায় না তাই..“
“সে সব আপনার কথা মতই সেট করে দিয়েছি, আপনার যদি কোন অসুবিধা না থাকে তাহলে এখনই একবার দেখে নেবেন চলুন না।” বলে মোহনাকে সঙ্গে করে নিয়ে সব ঘরগুলো ঘুরে দেখাতে শুরু করলো। নীচ উপর মিলিয়ে কুড়িটা ঘর, যাদের মধ্যে একটা ঘর খুব বড়, সেটাই ওরা ঠিক করে রেখেছে খাওয়ার ঘর করবে, এমনি ঘরটা সাজানো হয়ে গেছে, শুধু চেয়ার টেবিলগুলো কাল কলকাতা থেকে এসে পৌঁছালে বসিয়ে দিলে হবে। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে এবার উঠতে উঠতে মোহনার মনে হল ঘরগুলো কেন জানি না বেশ চেনা চেনা লাগছে। তবে বাড়িটার ধরণটা কিন্তু বেশ। মূল দরজা দিয়ে ঢুকে বড় একটা ড্রয়িং রুম, সেই ড্রয়িং রুমের ঠিক শেষ যেখানে, সেখানে দুইদিক দিয়ে দু’টো সিঁড়ি উঠে এসেছে দোতলায়। ড্রয়িং রুমটার বাম দিকে সারি দিয়ে পাঁচখানা ঘর আর ডান দিকে তিনটে ঘর, কিচেন আর ডাইনিং রুম। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলে একটা লম্বা করিডর, যার পাশে পাশেই সার দিয়ে দশ খানা ঘর। নীচ থেকে যে সিঁড়ি দোতলায় উঠেছে সেটা মাঝখানে একটা জায়গায় এসে মিশেছে, সেখান থেকে আবার দু’দিকে ভাগ হয়ে উপরে উঠে গেছে। ঐ জায়গাটায় এসে মোহনা দেখলেন সেখানে দেওয়ালের মাঝখানে একটা দরজা। দরজাটায় অপূর্ব কারুকার্য করা, খুব পুরনো অথচ তার আকর্ষণীয়তা একটুও কমেনি। মোহনার সব থেকে আশ্চর্য লাগলো দরজার গায়ে লাগান তালাটা। একটু অদ্ভুত দেখতে, তার উপর একটা রুপালী রঙের চেন লাগানো, দেখে রুপোই মনে হচ্ছে আর সেই চেন থেকে অনেকগুলো ওঁ, স্বস্তিক চিহ্ন ঝুলছে। মোহনা কৌতূহলী হয়ে তালাটাতে হাত দিতেই ওর হাতটা যেন কেউ চেপে ধরলো সেই সঙ্গে কেউ যেন পিছন থকে টেনেও ধরলো ওকে। মোহনা সঙ্গে সঙ্গে পিছনে ফিরে দেখলেন কেউ নেই, ভাবলেন হয়তো মনের ভুল। আবার দরজার দিকে ফিরে তালাটায় হাত দিতে যাবে এমন সময়ই–চলবে……….
-
কবিতা- অক্ষহিনী
অক্ষহিনী
-অযান্ত্রিক
বুকের বামপাশে একদলা মাটি জমা আছে,
তার উপর হাড়ের কাঠামো, পাঁজর,
পাশা খেলার গুটি,ছয়ের বদলে ছয়,
চোখের বদলে উরু।
কম্পনের দাবীতে নামকরণ, হৃদপিন্ড।
ভাবুকের পৃথিবী ক্ষত বিক্ষত বহুদিন ধরেই,
কষ্টের থেকে উঠানামার পথ,চিরদিন,
নোনা জলে,রক্তে পিচ্ছিল,তবুও,
বৈধ অবৈধ বিচারের কুর্ণিশ ,অপারক দামী।
বুকের বাম পাশে দুখানা প্রকোষ্ঠ, বন্ধ্যা জমি।
অত্যাচার সহ্য করেও তাকে আমি হৃদয় বলিনি।
মাটির দলার থেকে নিঃসীম ,অসংখ্য গলিপথ,
নীচের দিকে গেছে নেমে জঠরের মোড়,
যকৃৎ চায়ের দোকান ,ভেজাল বক্তা,রোগাকীর্ণ শ্রোতা
অবরোধে বাতিল খাদ্য গতিপথ অথচ সিঁদুর ,
ধুপবাতি, ফুলে রোজ পূজার আয়োজন,প্রেমের প্রসাদ।
অগ্ন্যাশয়, পুকুরের ধারে ব্যাস্ততা সাক্ষী অক্ষহিনী,
বৈদ্যের উপাচারে, তাই তাকে কোনোদিন শরীর বলিনি। -
কবিতা- অন্ধকার
অন্ধকার
-অযান্ত্রিকধর্মের নামে জখম ,আততায়ীর হিসেব নেয়া যাক,
পারবে না শাসনের নামে রং বদলাতে বরফের
আগুনে নিশানে নিশানে চারিদিক যতই সাজাক,
শিরদাঁড়া কিন্তু ভেঙ্গে যায়নি আজও মানুষের।ফাটিয়ে দিলে মাথা,রক্ত মাখা রুমাল হবে নিশান,
ভেঙে দিলে পা ,স্ক্র্যাচে স্ক্র্যাচে ভর করে হবে মিছিল।
টুঁটি টিপে ধরে থামবে না কোনো প্রতিবাদী স্লোগান,
ভয়ের ঘর ছেড়ে মানুষ ধীরে ধীরে হবেই সামিল।রাগ তুলে রেখে রেখে,লালচে হয়ে গেছে সোনা রোদ,
হিসেব দিতে দিতে আর কাঁদছে না মরে যাওয়ায়,
তোমার আমার ঘরে মতবাদ যেটুকুই আছে মজুত,
দেখ এইবার সব সাজিয়ে রেখেছি ভাতের থালায়।ভেঙেচুরে দিলে আবার গড়ে নেবো ঠিক সেটা,
পুড়িয়ে দিলেও ছাই উড়ে এসে বলে দেবে।
পুঁতে দিলে যেনো মাটিই বিপ্লব প্রণেতা,
মৃতদেহও দেখো দাঁড়াবে মানুষ হিসেবে।যেকোনো মানুষ, যেকোনো অন্য নামে,
স্বাধীনতা পোষে শরীরে এবং মাথায়,
অন্যায় চিরকাল, বিক্রি হয় বেশি দামে।
প্রজা চিরকাল রাজাকে বাঁচতে শেখায়। -
কবিতা- বুকের বেহালায়
বুকের বেহালায়
-অযান্ত্রিক
বেঁচে থাকা নিয়ে বিবাদ করেছো,
ভালোবাসা নিয়ে বসেছো মুখমুখি,
দুপারে দু দিকে একলা বাতি ঘর,
কষ্টের হাওয়া চিরকালই মোহনা অভিমুখী।কাগজে কাগজে ছড়িয়েছো নিজের নাম,
ভাত ঘুমে তবু উঁকি দেয় ওড়না বিলাস।
প্রেমেতে ভেঙেছে কতবার বিড়াল ছানা,
বহুবার এঁটো হওয়া ছলবলে চায়ের গেলাস।মুঠো করে রেখেছিলে যেটুকু গমের বীজ,
শান্তির কথায় খুঁটে খেয়ে গেছে পায়রার দল।
নিশ্চুপ বেঁচে থাকা নিয়ে বিবাদ করেছো,
গরিব ভালোবাসা বোঝোনি,ওটাই সম্বল।সকালের বিস্কুট জুড়ে দাঁতের সোহাগ,
রং ছোঁয়া লেগে থাকে না পিরিচ পেয়ালায়।
মহান বোঝাতে সহজেই সাজা যায় নিরো,
আগুনে পুড়ে যেতে যেতে মন ,সুর তোলে ,বুকের বেহালায়।। -
কবিতা- এক এক করে
এক এক করে
-অযান্ত্রিক
এক একটা ঘর ঘুমন্ত লোক,
এক একটা ঘর অট্টহাসি।
এক একটা ঘর শোকের তলে,
মুখ ভাসে মুখে চোখের জলে।এক একটা দ্বার ছায়া ছাপ হীন,
এক একটা দরজায় উঁচু চৌকাঠ।
এক এক দুয়ারে ভিড়ের আভাস,
বুক থেকে বুকে দীর্ঘশ্বাস।এক এক জানলা শুধু উদাসীন,
এক এক জানালা পথের দিকে,
আসছেনা কেউ ঘরের পথে,
বাম বুকে ক্ষত উছলে ওঠে।এক একটা ছাদ পায়চারী মন,
এক এক করে সব হারালে যেমন।
অসাড় বরফ সাদা চাদরে ঢেকে,
এক এক করে হয় দূর কাছের থেকে। -
কবিতা- তৃপ্তি
তৃপ্তি
-অযান্ত্রিক
শরীরের মাপ,
সাড়ে ছয় হাত।
আর কত বেশী লাগবেথান কাপড়ে জড়িয়ে শুয়ে
আলতা জলে দুই পা ধুয়ে,
জাগবে তুমি ,জীবন থেকে জাগবে।শেকল পরে ,ঘর দুয়ারে,
খড়কুটো জমা নিত্য বাড়ে।
লাগবে সেকি, নদী পেরোতে লাগবে?সোনায় দানায় ভরিয়ে কোঁচর,
মাস দিন কাল শতেক বছর।
থাকবে,সেকি শেষ অবধি থাকবে?সব কিছুতেই শেষের কথা,
শুরু থেকেই নির্ভরতা।
জন্মে মোলে সেইতো তুমি কাঁদবে।জমিয়ে ,খেয়ে, লাভ কি হলো?
সাধের শরীর ছাই সাজাল,
মাটির নাভি ,মাটিতেই পরে থাকবে।বয়াম ভরে পুরোনো ঘৃত,
আজকে মূর্ছা,কালকে মৃত,
সময় শুধু ছায়াটা মনে রাখবে।
কাজ গুলো সব আজ নাহলেও,
কালকে মনে রাখবে। -
কবিতা- পোর্ট
পোর্ট
-অযান্ত্রিক
আমরা সুপরিকল্পনা নিয়ে শব্দ সাজাতে থাকি,
মাথার মধ্যে খেলে যেতে থাকে অপাপবদ্ধতা।
চারা গাছের সভায় যাই, শব্দের বক্তব্য রাখি,
স্মারক সামগ্রী নিয়ে হাতে, ভুলে যাই মৌলিকতা।আমরা জঙ্গলে যাই ,বড় বড় গাছের কাছে যাই,
ঝরে পরা পাতার ,শুকিয়ে ওঠা ডালপালা মাঝে,
নিজেদেরই ছায়া দেখি,নিজেদেরই শরীর হাতরাই,
তবু বুঝিনা শুয়া পোকাই একদিন প্রজাপতি সাজে।ভাবনাটাই সম্পদ,দৃষ্টিভঙ্গি বাহ্য অথচ মূল্যবান নয়,
নিশ্চয়তা প্রাকৃতিক উপায় জানে ,প্রতিম গাছেদের সভায়।
নিজের মালা হাতে নিজেকেই পাই ,বহমান সংকটে প্রায়,
পরিকল্পনার শব্দ শুকিয়ে আসে ,ঘরে রোদেলা বারান্দায়।স্রোতের সাথেই হেটে গেলে পেরোনো যায় ছোট ভুল চুক,
দূরের কোনো বিষ আজ অমৃত শারীরিক বহতা চুমুক।
অগুনিত কথার সাজিয়ে আনলে ,জানি ফিরিয়ে দেবে তাও,
হে ঈশ্বরী শব্দ ,আর কত কাল কাটাবো মধ্য নিশি,
এসো হাত ধরো, কবিতা যাপন থেকে পরিত্রাণ দাও। -
কবিতা- প্রতিহিংসা
প্রতিহিংসা
-অযান্ত্রিক
প্রতিহিংসার একটা নেশা আছে নিলোফার,
যেমন,পান পাত্র হাতে নিয়ে টলমল করে ওঠে মানুষ,
মাথায় চড়ে ওঠে, রক্ত, নেশা! নেশা বোঝো নিলোফার?
নিজেই পাক খায় আবেগের জোয়ারের মাঝে ,
যেন বান ডাকা নদীতে ভেসে যাওয়া মাঝিহীন শালতি।
ঘুরপাক খায়, ক্ষমা চায়, ঈশ্বর নয়, সেই সব মানুষের কাছে,
যাদের বুকে হাত ডুবিয়ে অনায়াসে একদিন উপরে এনেছে হৃদয়।
ক্ষমা চায়, নারীদের কাছে, ফুলের কাছে ,
তবুও, প্রতিহিংসা চায় বদলা।
যারা কোনোদিন প্রেমের নামে ,
মেয়েদের চোখ থেকে ঝরিয়ে ছিলো রক্ত,
মুঠোর মধ্যে নিয়ে চেপে ধরেছিলো মোহগ্রস্থ নারী শরীর,
পাঁজরের ফাঁকে ফুটে ওঠা
গোলাপের মতো হৃৎপিণ্ডের ফুল ছিঁড়ে আনে, কচলিয়ে ফেলে,
মাটিতে,দুপায়ে মাড়িয়ে এগিয়ে যেতে থাকে প্রতিশোধের আগুনে।
তাদের মৃত্যু নেই নিলোফার, শেষ শ্বাসের আগেও এরা,
পুরুষ্ট ঠোঁটের উপরে বসায় ঠোঁট, জংঘায় এঁকে রাখে কামনার ছবি।
তাঁদের, তুমি কি করে শেখাবে, প্রতিহিংসা শুধু কেড়ে নিতে পারে।
আর আজও মানুষের উপরির প্রতি লোভ কেটে যায়নি। -
কবিতা- হায় রে
হায় রে
-অযান্ত্রিক
দেখে যাই ,ভেঙে পরা সিংহদুয়ার,
দেখে যাই ,ভুলে যাওয়া মানুষের মুখ।
দেখে যাই, পথে সদ্যোজাত দেবালয়,
দেখে যাই ,মরে যাওয়াই সস্তা অসুখ।দেখে যাই ,শারীরিক প্রেম ভালোবাসা,
দেখে যাই ,ধরা পড়ে যাওয়ার, ছোট ঘৃণা,
দেখে যাই, দুহাতে জাপ্টে ,খদ্দেরি হওয়া,
দেখে যাই, রাতে মেয়েটা খদ্দের পেলোনা।দেখে যাই, একা হয়ে যাওয়া মায়ের মুখ,
দেখে যাই, একা বাবা ,ছবিতে পরে মালা।
দেখে যাই, দেরী করা সন্ধ্যায় বাজে শাঁখ,
দেখে যাই, জমা পাহাড়ের, সব কথাই না বলা।দেখে যাই, রিড বসে যাওয়া হারমোনিয়ামে,
দেখে যাই, গলা সাধছে দুই বেণী বাঁধা ছোট মেয়ে।
দেখে যাই, সুবিধা ছড়িয়ে হয়ে যাওয়া ঈশ্বর
দেখে যাই, প্রনামির থালার দিকে আছে চেয়ে।দেখে যাই , জন্মাচ্ছে পঙ্গপালে প্রতিদিনই,
দেখে যাই, মাথা নীচু জাত এক শ্রেণীর।
দেখে যাই ,বলছে না কেউ কোথাও,
দেখে যাই, বলছে না কেউ হাত ওঠাও।