• গল্প

    গল্প- কালো মেয়ে

    কালো মেয়ে
    – জ্যোৎস্না ভট্টাচার্য ত্রিবেদী

     

     

    কি রে তাহলে সত্যিই তুই যাবি না বাবু? অনুরাধা জিজ্ঞাসা করেন…
    – না মা, তোমাকে তো বলেইছি, আমি ও সবে নেই। মেয়ে ফেয়ে দেখতে যাওয়া, আর হাসি মুখে বসে গান্ডে পিন্ডে মিষ্টিমন্ডা গিলে আসা, আমার ও সব পোষাবে না। এই ব্যাপারটা তোমরাই মিটিয়ে নাও, বিয়েটা আমি গিয়ে করে নেবোক্ষন…. বলেই মিটি মিটি হাসে প্রিয় ওরফে প্রিয়াংশু।
    – সেই তো, তুমি কোনো ঝামেলা ঘাড়ে নেবে না খালি সেজে গুজে বিয়ে….মায়ের কথা শেষ হবার আগেই প্রিয় বলে ওঠে,
    – ওরে বাবা, বিয়ে করাটা কি কম ঝামেলা নাকি? কি মনে করো তুমি? জানো, ছেলেদের কতো দায়িত্ত্ব নিতে হয়। আস্ত একটা মেয়ের দায়িত্ব সারা জীবন ঘাড়ে নিয়ে বেড়াতে হবে। এটা কম কিছু?
    -তুই চুপ কর, কে যে কার দায়িত্ত্ব নেবে, সে আমার খুব জানা আছে। দেখি এ মেয়ে আবার কেমন হয়! ফুল পিসি তো বললো, খুব দায়িত্ত্বশীল, কাজে-কম্মে নাকি চৌখস আবার অনেক লেখাপড়াও করেছে। সবই ভালো….. বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন আর মনে মনে বলতে লাগলেন, খালি রংটা একটু যা চাপা। তা একটু চাপা হলে ক্ষতি নেই। আমার রিমুও তো তাই। বাবার মতো চাপা রং পেয়েছে। তাতে কি মেয়ে আমার কোনো অংশে কম? কেমন সুন্দর দেখতে, এক মাথা ঝাঁকড়া চুল, চোখ নাক সব ভালো। তবে না এক দেখাতেই শিলাজিৎ-এর বাড়ীর লোকের পছন্দ হলো। তা তেমনটা হলেই না হয় চলবে, অবশ্য আমার বাবু তো শিলাজিৎ-এর মতো কালো নয়। বাবু তো আমার মতোই হয়েছে, ধপধপে মাখনের মতো রং। ছেলেদের ওমন রং আর সুন্দর চেহারা খুব কমই দেখা যায়। যে মেয়ে ওর বৌ হবে, সে আস্ত একটি রাজপুত্তুরই পাবে, হুম…

    বিকেল চারটে নাগাদ, মেয়ে রিমু ওরফে রিমলিকে সাথে নিয়ে স্বামী স্ত্রী পরিতোষ বাবু এবং অনুরাধা দেবী সেজেগুজে গাড়ীতে গিয়ে বসলেন। নীলাদ্রিকে বলাই আছে কোথায় যেতে হবে, সে সেইমতো গাড়ী ঘুরিয়ে রওনা দিলো। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই মেয়ের বাড়ী পৌঁছে গেলেন ওনারা।

    যথেষ্ট আপ্যায়ন করে মেয়ের বাবা মা দাদা ওনাদের তিনজনকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে সাজানো গোছানো বসার ঘরে বসালেন। বসার একটু পরেই একটি মিষ্টি মেয়ে ঠান্ডা পানীয় হাতে ঘরে ঢুকলো। ওনারা মেয়ের বৌদি বলে পরিচয় করালেন। অনুরাধা তখন ভালো করে দেখলেন, মেয়েটির ওল্টানো চুলের ভেতর এক চিলতে লাল রেখা। বেশ দেখতে মেয়েটিকে। মনে মনেই ভাবলেন, বাব্বা, আজকাল কি সব হয়েছে, সিঁদূর যেন না পড়লেই হয়। কোনো রকমে বুড়ি ছোঁয়া… অবশ্য এ সব আবার বলা যাবে না, তার ছেলে মেয়ে দুজনেই রে রে করে উঠবে।

    ততোক্ষণে ঠান্ডা পানীয়তে গলা ভেজাতে ভেজাতে বাপ বেটী ওনাদের সাথে গল্পে মেতেছে। অনুরাধা চুপচাপ বসে ঘর সাজানো দেখতে ব্যস্ত, হঠাৎ মেয়ের মা রীতা দেবী জিজ্ঞাসা করলেন, কি হলো দিদি, আপনার কিছু অসুবিধা হচ্ছে?
    – না তো, অসুবিধা কিসের? অবাক হয়ে তাকান অনুরাধা।
    -না, আসলে আপনি তো সরবত খাচ্ছেন না আর কিছু বলছেনও না তাই….. রীতা দেবী হেসে বলেন।
    -না না, কিছু না, বলে সরবতের গ্লাসটা নিয়ে একটা চুমুক দেন। তারপর এমনিই কিছু কথা ওনার সাথে বলতে শুরু করেন।

    কিছুক্ষণ পর মেয়ের বৌদি এবং আর একটি মেয়ে, এই নিশ্চয়ই পাত্রী, দু’টো ট্রে ভর্তি মিষ্টি, নোনতা সব খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলো। খাবারের ট্রে টেবিলে রেখে মেয়েটি মাথা নিচু করে দাঁড়াতে, মেয়ের মা পরিচয় করালেন, এই আমার মেয়ে। মেয়েটি ধীরে ধীরে ওনাদের দুজনকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো, আর রিমুকে হাত জোড় করে- সামনে এসে যখন প্রণাম করলো অনুরাধা দেবীকে, তখন ভালো করে দেখলেন মেয়েটিকে। ও বাবা, এতো খুব কালো। মনটা তখনই বেশ দমে গেলো। মেয়েটি সামনেই চেয়ারে বসলো জড়োসড়ো হয়ে। আজকের দিনের মেয়েরা এতোটা লজ্জা ভয়ে জড়োসড়ো, আগে দেখেন নি। এর আগে যে কয়টা মেয়ে দেখেছেন সবই আল্ট্রা মর্ডান, শাড়ীই পরে না কেউ। সালোয়ার স্যুট বা অন্য কোনো মর্ডান ড্রেস। একটি মেয়ে তো আবার টাইট জিন্স তাও আবার হাঁটুর নিচে অব্দি আর ওপরে যেটি পরেছে সেও কোমর অব্দি এসে পৌঁছাতে পারছে না। দেখে মনে হচ্ছিলো, ছোট বোনেরটা পরেছে। দেখেই তো দুজনেই আঁতকে উঠেছে। তার মা আবার বলেই দিলেন, মেয়ে আমার এইসব ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরতেই ভালোবাসে। শাড়ী সালোয়ার কামিজ পরেই না।
    নাহ্, সে সব এক কথায় না বলেছেন। এই প্রথম একজনকে শাড়ীতে দেখলেন। কিন্তু এতো কালো… একবার দেখেই আর দেখার ইচ্ছা হচ্ছে না। মেয়েটির মুখটা কেমন, হাইট, হেলথ কিছুই দেখার বা জানার ইচ্ছা নেই। অথচ রিমু কেমন আলাপ জমিয়েছে দেখো। কি পড়েছে, এখন কি করছে, কি ভালোবাসে এই সব কথা জিজ্ঞাসা করছে। ওর বাবাও হেসে হেসে কথা বলছে মেয়েটার সাথে। ওনার রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। কি দরকার এই সবের, ওই ভুস্কুন্ডি কালো মেয়েকে উনি কোনো মতেই বাবুর বৌ করবেন না। ওনার রাজপুত্রের মতো সুন্দর ছেলে। মুখ গোঁজ করে বসে রইলেন। ওরা বাপ বেটী ভালো মতো সবার সাথে গল্প-গাছি করে, খাবারও কিছু কিছু খেয়ে তারপর বাড়ী যাবার কথা বললো। মেয়ের মা তখন অনুরাধা দেবীকে অনুরোধ করলেন, আপনি তো দিদি কিছুই নিলেন না। আর মেয়েকে কিছুই জিজ্ঞাসা করলেন না। প্লিজ একটু কিছু মুখে দিন..
    না না, আমি কিচ্ছু খাবো না দিদি, আমার বড্ড শরীরটা খারাপ করছে। এই বলে উঠে পড়লেন।

    তখন পরিতোষ বাবু আর রিমলিও বাধ্য হয়েই উঠে পড়লো। পরিতোষ বাবু অনুরাধার মুখের দিকে তাকিয়েই প্রমাদ গুনলেন। হঠাৎ করেই পুরো পরিবেশটাই বদলে গেলো। আনন্দের পরিবর্তে বিষাদ ঘিরে ধরলো। অনুরাধা দেবী হাত জোড় করে ওনাদের প্রণাম জানিয়েই বাইরে যাবার জন্য পা বাড়ালেন। স্বাভাবিক ভাবেই বাপ বেটী দুজনেই ওনাদের প্রনাম জানিয়ে অনুরাধাকে অনুসরণ করলো, এছাড়া কোনো উপায় ছিলো না। দুজনেই অনুরাধাকে বেশ ভয়ই পায়। এমনিতে মানুষ ভালোই, কিন্তু ভীষণ রাশভারি। অপছন্দের কিছু হলেই আর রক্ষে নেই। এখনও ঠিক তেমনটাই আশঙ্কা করলেন পরিতোষ বাবু। যাই হোক, কন্যা পক্ষও মোটামুটি বুঝেই গেলো মেয়ে ওনাদের পছন্দ হয়নি। বিশেষ করে ছেলের মায়ের, কালো মেয়ে পছন্দ নয়।

    রীতা দেবী ধরা গলায় বললেন, কি আশ্চর্য, আমার মেয়ের গায়ের রঙটাই খালি উনি দেখলেন, আর মেয়ের মুখখানা যে প্রতিমার মতো, মেয়ের যে এতো গুণ, এতো শিক্ষিত আমার মেয়ে, এতো মিষ্টি গানের গলা, কোনো কিছুই উনি দেখলেন না শুনলেন না…! খালি রঙটাই কি সব কিছু?

    ওদিকে গাড়ীতে উঠে বসেও কিছুক্ষণ পর্যন্ত অনুরাধা গুম হয়েই থাকলেন। পরিতোষবাবু আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেই ফেললেন, তুমি ওমন করে উঠে চলে এলে কেন? একটুও ভদ্রতা নেই তোমার? তুমি তো এতোটা রূঢ় কখনো ছিলেন না। আজ এমন করলে কেন?

    ফোঁস করে উঠলো অনুরাধা, চুপ করো তুমি। ওই মেয়ে? কালো ভূতের মতো চেহারা…!

    মা, ঠিক করে কথা বলো। রঙটা কালো হলে কি হবে, মুখখানা ভারি সুন্দর। আর কতো পড়াশোনা করেছে। কি সুন্দর মিশুকে, গলাটা কি মিষ্টি। গানও গায় বললো, নিশ্চয়ই খুব ভালো গায়।

    তুই চুপ কর, তোকে নিয়ে আসাই ভুল হয়েছে। কি বুঝিস তুই এ ব্যপারে?

    যাই হোক আর যতো গুণীই হোক, ও মেয়ে আমার বাবুর বৌ কক্ষনো হবে না। ওমন রাজপুত্রের মতো ছেলে আমার। তার ওই শাঁকচুন্নি বৌ…!

    আহ অনু, কি হচ্ছেটা কি! কারোর মেয়েকে তুমি ওভাবে বলতে পারো না। আচ্ছা বলতো, ওর ওই রঙটার জন্য কি ও দায়ী? ওর কোনো হাত আছে ওতে? না তো, তাহলে মেয়েটিকে দুষছো কেন? ঈশ্বর ওকে যেমন গড়েছেন ও তেমনই..

    এই সব কথা কাটাকাটি হতে হতে বাড়ী পৌঁছে গেলেন তিনজন। বাড়ী পৌঁছেই আগে খোঁজ করলেন, বাবু, বাবু কই রে? বাবু নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, কি হয়েছে মা? বাড়ী ঢুকেই এভাবে হাঁক ডাক করছো কেন? হলো-টা কি?
    শোন বাবু, ও মেয়ের সাথে তোর বিয়ে দেবো না। কিছুতেই দেবোনা। ও যতোই ফুল পিসির ননদের জায়ের মেয়ে হোক। আর বাবুর বাবা, তুমি এক্ষুণি ফোন করে ওনাদের জানিয়ে দাও। ব্যাস…. এই বলে অনুরাধা দুম দুম করে নিজের ঘরে ঢুকে দড়াম করে দরজা বন্ধ করলেন। বাবু এবং বাকি সবাই হতভম্ব হয়ে এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। বাবু মানে প্রিয় হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলো বোনকে, কি হয়েছে রে রিমলি? মা এতো ক্ষাপ্পা কেন? কোনো অপমানজনক কিছু…..

    আরে না না সে সব কিছু না। আয় ঘরে বলছি। বলে ওর ঘরেই গিয়ে ঢুকলো দুজনে। প্রিয়তোষ বাবু হতাশ হয়ে বসে পড়লেন সোফায়। নন্দুকে হাঁক দিলেন, এক গ্লাস ঠান্ডা জল দিয়ে যা নন্দু…

    ঘরে ঢুকে রিমলি দাদাকে আদ্যপান্ত সমস্ত কিছু বললো। মেয়েটি যথেষ্ট সুন্দর আর সব চেয়ে সুন্দর তার ব্যবহার, কথাবাত্রা। ইকোনমিক্সে মাস্টার্স করেছে। বি.এড-ও করেছে, একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে উঁচু ক্লাসেই পড়ায়। এ ছাড়া ক্লাসিকাল মিউজিকেও সিক্সথ ইয়ার পাস। গলাও ভারি মিষ্টি, যদিও গান শোনা হয়নি। কিন্তু নিশ্চিত খুব ভালো গায়, আঁকেও ভালো। ঘরে সুন্দর সুন্দর পেইন্টিংস সাজানো। এতো গুণী একটা মেয়েকে শুধু রঙটা একটু কালো বলে মা এমন বিচ্ছিরি ব্যবহার করে চলে এলো, কি ভাবলেন বল তো ওরা..!

    রিমলি হঠাৎ দেখলো ওর দাদা উদাস হয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে রিমলি বললো, কি রে দাদা, কি ভাবছিস? কালো মেয়ে তোরও পছন্দ নয়?

    প্রিয় যেন কিছুই শোনেনি, হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে বলে উঠলো, আমি যাবো…..
    রিমিলি তো অবাক! কোথায় যাবি দাদা…?
    আমি শতরুপার বাড়ী যাব। ওর সাথে কথা বলতে চাই। তুই ব্যবস্থা কর।

    রিমলি তো পড়লো মহা ফাঁপড়ে… সে এখন কি করে মা কে বলে এ কথা? আর ভীষণ অবাকও হলো। কিন্তু মা শুনলে যে মহা কেলেঙ্কারি বাঁধাবে। কিচ্ছু ভেবে পেলো না রিমিলি। আর দাদাও তো, ওই একটা কথা বলেই সে যে নিজের বইয়ের পাতায় মুখ ঢুকিয়ে বসে গেলো। আর তো হাজার জিজ্ঞাসা করলেও উত্তর পাওয়া যাবে না।

    চিন্তিত মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে বাবার কাছে এসে দাঁড়ালো। বাবা ভাঙা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন- কি হলো, ছেলেও কি মায়ের মতো কালো….
    -না বাবা, সব শুনে দাদা একবার শতরূপার সাথে কথা বলতে চাইলো। যেতে চাইলো ওদের বাড়ী। পরিতোষ বাবু খুশী হয়ে বললেন, সত্যি? জানতাম, ও যে আমার ছেলে। ওর মা যতোই বলুক…
    -সে না হয় হলো, কিন্তু কি করে এটা সম্ভব হবে? মা যদি জানতে পারে তাহলে ভাবতে পারছো? জানবে কেন তোর মা? আমি তেমনই ব্যবস্থা করবো। তুই খালি কিচ্ছু বলিস না, দেখ এবার আমি কি করি। বলেই একটু মিটমিটিয়ে হাসলেন।

    আজ বৃহস্পতিবার, আজ প্রিয়াংশুর সাথে শতরুপার দেখা করার কথা। অবশ্য বাইরেই, শতরুপার বাড়ীতে নয়। প্রিয়তোষ বাবু আর শতরুপার বাবা মিলে এমনটাই স্থির করেছেন। অনুরাধাদেবী ঘুণাক্ষরেও জানতে পারলেন না তাঁর পিঠ পিছে কি খিচুড়ি যে পাকানো হলো…

    ওই ঘটনার ঠিক আড়াই মাস পরে…. আজ শতরূপা বৌ হয়ে এ বাড়ীতে আসছে। গতকাল ধুমধাম করেই ওদের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। অনুরাধা দেবীর মন ভালো নেই। তাঁর অমতেই সেই কালো মেয়ের প্রেমেই পড়লো তার রাজপুত্রের মতো ছেলে! আবার বলে কিনা দরকার হলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে নিজের গায়ের রঙ। কালো করে নেবো রূপুর মতো। হায় রে…. এ কি দিনকাল পড়লো। মা ঠাকুমা, সত্যিই বলতো, কালো মেয়েদের স্বামীভাগ্য ভালো হয়, রূপবান বর পায় তারা।
    আর শুধু ছেলেই বা কেন, তার স্বামী আর পেটের মেয়েও তো তাকে ঠকালো। তাকে না জানিয়ে ওদের দেখা শোনা করিয়ে, ছিঃ ছিঃ… কি লজ্জা কি লজ্জা….

    অত্যন্ত মন খারাপ নিয়েই বরণডালা, শ্রী, সব তৈরী করলেন। একটা সুন্দর নতুন শাড়ীও পড়লেন, না হলে লোকে তো নিন্দে করবে।

    হৈ হৈ করে বর কনে এসে পড়লো। উনি চুপচাপ গিয়ে দুজনকে বরণ করলেন। হঠাৎ দেখেন সেই কালো মেয়ে নিচু হয়ে ওকে প্রণাম করে উঠেই জড়িয়ে ধরলো। মা গো, ক্ষমা করে দাও মা তোমার এই কালো মেয়েটাকে। আর তুমি রাগ করে মুখ গোমড়া করে থেকো না মা। আমিও তো তোমার একটা মেয়ে আজ থেকে মা….তোমার সব কথা শুনবো, অন্যায় করলে ভুল করলে তুমি বকবে আমি চুপ করে শুনবো মাগো…বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো…

    ব্যাস, আর চুপ থাকতে পারলো না অনুরাধা, চুপ কর মেয়ে, আজকের দিনে কাঁদতে আছে? নিজের গরদের শাড়ীর আঁচল দিয়ে শতরুপার চোখ মুছিয়ে দিলেন, এদিকে নিজের দু’গালও চোখের জলে ভাসছে। অথচ মুখে হাসি….

    পরিতোষ বাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, এই বাইরে দেখ তো, মনে হয় শিয়াল কুকুরের বিয়ে হচ্ছে রে, রোদ আর বৃষ্টি একসাথে… অনুরাধা তো একদিকে হাসছে আর এদিকে দু’চোখে জলের ধারা….
    এভাবেই হলো…… মধুরেণসমাপয়েৎ।।

  • কবিতা

    কবিতা- ভালোবাসার ভুল

    ভালোবাসার ভুল
    – জ্যোৎস্না ভট্টাচার্য ত্রিবেদী

     

     

    মা গো…

    ঘন মেঘের আস্তরনে ঢাকলো সেদিন চাঁদ
    নিশুত রাতে বনের মাঝে পাতলো ওরা ফাঁদ।

    সেদিন আমার ঘর পালানো ছোট্ট সুখের নেশা 
    সেই নেশাতেই পাগল আমি,পাইনি তো আর দিশা।

    বনের মাঝে বুনো ফাঁদে জড়াই মনের ভুলে
    ভালোবাসার কি যন্ত্রনা, উঠলো ভূবন দুলে।

    রাত জাগা চাঁদ রাতের শেষে মলিন হলো যবে
    অকাল সে ঘুম ভাঙ্গলো আমার,প্রভাত তখন হবে.

    নতুন প্রভাত নতুন আলো নতুন মানুষ আমি
    সব হারানোর ব্যাথায় কাতর কি করি না জানি।

    ঘরে ফেরার বন্ধ দুয়ার, নতুন ঘরও হয়নি চেনা
    ফিরবো কোথায়! দুনিয়াটাইতো লাগে ভীষণ অজানা।

    বনের মাঝে বসে ভাবি, কোথায় হলো ভুল
    ভালোবাসার এমন সাজা, হারালাম দুই কূল।

    মনে পড়ে মায়ের কথা, কতো সাবধান বানী
    তুচ্ছ সে সব করেছি হেলায়, যেন সবই জানি।

    বাবার শাসন, কাকার বকায়, ছিলো ভীষণ রাগ
    আর কেউ আজ বকবেনা তো লাগিয়েছি যে আগ।

    নিজের জ্বালা আগুনে আজ নিজেই ঝলসে মরি,
    মরন কি আর এতোই সোজা, আসবে তড়িঘড়ি?

    মরতে যে চাইনা মাগো, বাঁচতে আমি চাই
    একটু খানি জায়গা কি মা হবে না মোর ঠাঁই..!

    এই কলঙ্ক মাথায় নিয়ে কেমনে যাবো বল..
    পারবি কি মা সবাইকে আজ ভোলাতে করে ছল..!

    সেই যেমন ছোটো বেলায় বাবারে বুঝিয়ে ভুল
    নির্দোষ আমায় করতি প্রমান,আমি তো নির্ভুল।

    পারবি কি মা আজ ও তেমন সবারে বোঝাতে
    আমার কি দোষ ছিলো বল, শুধুই ভালোবাসাতে..!

    আমি যে মেয়ে, তাই বইতে হবে প্রেমের এই কলঙ্ক;
    যে ছেলে এই কালি দিলো সে তো নিষ্কলঙ্ক..!

    কি করি মা বলনা এখন, কোথায় আমি যাই…
    বসন খানিও এমন ছেঁড়া, লজ্জা ঢাকা দায়..!

    তবে কি মা তোর মুকুলিকা মুকুলেই শেষ হবে?
    ফুল হয়ে ফোটার আগেই পোকায় কাটলো যবে…
    তখনই তার নিয়তি যে স্থির হয়েই গেলো
    মরণ বিনা গতি নেই আর,সবই শেষ হলো।

    মরণ রে তুহুঁ মম শ্যাম সমান…

    ক্ষমা করো মা
    তোমার হতভাগী…

     

  • গল্প

    গল্প- সময় অসময়

    সময় অসময়
    – জ্যোৎস্না ভট্টাচার্য ত্রিবেদী

     

     

    আজ ডক্টর চ্যাটার্জির কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে আমার। কিছু মেয়েলি সমস্যা হচ্ছে গত কিছুদিন যাবত। উনি এ বিষয়েই স্পেশালিস্ট। সন্ধ্যে সাতটায় সময় দিয়েছে। ছটা নাগাদ তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম, যেতেই আধ ঘন্টা বা তার বেশীই লাগবে। সন্ধ্যে বেলা যা ভীড় রাস্তায়, অটো টোটো যাই নাও, সে তো চলবে শম্বুক গতিতেই। সুতরাং একটু আগে যাওয়াই…..

    সাড়ে ছটার আগেই পৌঁছে গেলুম। ভাগ্যক্রমে আজ আর রাস্তার ভিড় তেমন সমস্যা করেনি। গিয়েই দেখি বেশ ভিড় চেম্বারে। আমার ১৭ নং, এখন চলছে সবে ৮…. সুতরাং অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই। আজ উনি মনে হয় দেরি করে এসেছেন। এদিক ওদিক চেয়ে একটু বসার জায়গা খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ কোনের দিকে নজর পড়লো। আমাদেরই বয়সী এক মহিলা এবং সম্ভবত তার হাজব্যান্ড…. দু’জনেই গভীর ভাবে কিছু আলোচনায় ব্যস্ত। উল্টো দিকের বেঞ্চ থেকে একজন উঠে গেলো, সম্ভবত এবার তার নম্বর। আমি আর দেরি না করে সেখানে গিয়ে কোনোরকমে বসলাম। বসেই আবার তাদের দিকে নজর গেলো। মহিলাকে খুব চেনা চেনা লাগছে। অথচ কিছুতেই মনে করতে পারছি না। এই হয়েছে আজকাল, প্রায়ই এমন হয় রাস্তায় ঘাটে। অতি পরিচিত মানুষকেও চিনতে পারিনা।

    অনেকক্ষণ ভাবতে ভাবতে হঠাৎই মনে পড়লো, আরে, এতো আমাদের মধুমিতা। কতোদিন পর দেখা, বেশ মুটিয়েছে। অনেক পরিবর্তন, অবশ্য আমিও কিছু কম যাই না। যাই হোক, মনে পড়তেই আর না ডেকে পারি! যতোই হোক কিশোরী বেলার বন্ধু বলে কথা।

    আরে, মধু না?….ভদ্রমহিলা চমকে তাকালেন এবং যথারীতি অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপরই, আরে সুমি না? বলেই একগাল হাসি। ঠিক সেই আগের মতোই, গজ দাঁত দুটো ঝিলিক দিয়ে উঠলো। শ্যামলা চেহারার ভারী মিষ্টি মেয়ে ছিলো মধু। হাসিটা খুব সুন্দর ছিলো, আজও তেমনিই। পাশের ভদ্রলোক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে। মধু পরিচয় করালো ওর বরের সাথে আমার। অনিমেষ….. দু’জনেই নমষ্কার বিনিময় করলাম। অতঃপর সুযোগ বুঝে তাঁর সাথে আমার স্থান পরিবর্তন এবং নিজেদের কথায় বিভোর আমরা দুই বান্ধবী। মধুর এক ছেলে, বিএসসি ফার্স্ট ইয়ার আর মেয়ে ইলেভেন। আমার ছেলে মেয়ের কথাও হলো। আরো বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে বলতে, হঠাৎ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তোর কতো নং রে? ও বল্লো, ২২। আমার ১৭, আমি বললাম। আর তারপরই স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞাসা করলাম, তোর কি সমস্যা রে?
    নাহ্, তেমন কিছু নয়, মুখটা হঠাৎই একটু অন্ধকার…. আমায় জিজ্ঞাসা করলো মধু, তোর কি হয়েছে? এখানে কেন? আর একলাই বা কেন এসেছিস? তোর বর সাথে আসেনি?

    আমি বললাম, আরে না না। ওর আসার কি দরকার। আমি তো এনার কাছে প্রতি মাসেই আসি। আমার আসলে এখন…. খুব আস্তে করে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলি, প্রি-মেনোপজাল প্রবলেম চলছে কিছু। ওই যা হয় আর কি এই বয়সে। বয়সটা তো আর থেমে নেই বল…!

    মধু চুপচাপ শুনে, হঠাৎ বলে উঠলো, কেন..! কি এমন বয়স আমাদের? তোর কতো চলছে?
    আমি কিছুটা অবাক হয়েই বলি, সেকি রে, বয়স হয়নি? তুই আর আমি তো একই বয়সি, এক সাথে হায়ার সেকেন্ডারি পাস করেছি আমরা….! আমার ৪৫ চলছে, তোর ও….

    মধু তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, না না, আমি তোদের চেয়ে ছোটছিলাম রে। মনে পড়লো, ঠিকই, ও যখন ইলেভেনে ভর্তি হয়, তখন ই বলেছিলো। ও ১৫ বছরে মাধ্যমিক দিয়েছে। আর এইচ.এস. এর ফর্ম ভরার সময়ও দেখেছিলাম, ও আমাদের চেয়ে সত্যিই এক বছরের ছোটো। যাই হোক, বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই তো একবছরের ছোটো ছিলিস আমাদের চেয়ে। তার মানে তুই এখন ৪৪, তাই তো। ও অন্যদিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো। হঠাৎ খুব ব্যাস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, কতো নং চলছে, ১৭ পেরিয়ে যায় নি তো রে? আমি অবাক হয়ে বললাম, না না পেরোয় নি। সবে তো ১১ গেলো একটু আগে। ও যেন বেশ নিরাশ হলো।

    আমি কিছু না বুঝেই ওকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, তোর সমস্যাটা কি? ও কেমন যেন চমকে উঠলো, আর সামনে বসে থাকা বরের দিকে তাকালো। ওর বর মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। এতোক্ষণ ওর বর বেশ হাসি মুখেই আমাদের কলেজের গল্প শুনছিলো। কিন্তু হঠাৎ এমন পরিবর্তনের কারণ কিছুই বুঝে উঠলাম না। কিছুটা অবাক হয়েই আবার ওর দিকে তাকালাম। এতোক্ষণ যে মুখে ঝকঝকে হাসি মুক্তো হয়ে ঝরছিলো, এখন সেই মুখই আষাঢ়ের ঘন মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতোই অন্ধকার। আমি কিছুই বুঝলাম না, আবার ওর বরের দিকে তাকাতেই, হঠাৎই ওর বর ওখান থেকে উঠে চলে গেলো, সম্ভবত বাইরেই….

    বুঝলাম, সমস্যা যথেষ্টই গম্ভীর। কিন্তু সমস্যা যেমনই হোক, তার সমাধানও অবশ্যই আছে কিছু না কিছু। আর হয়তো আমি ওদের কিছু সাহায্য করতে পারি এ বিষয়ে, যতোই হোক, বাল্যবন্ধু বলে কথা। এইসব সাতপাঁচ ভেবে, আমি বললাম, কি রে অমন চুপ করে গেলি কেন রে? বল না তোর কি হয়েছে? আরে আমিও তো তোরই মতো একটা মেয়ে, আর তোর বন্ধুও তো। বল আমাকে কি সমস্যা তোর, হয়তো আমি কিছু সাহায্য করতে পারবো। বল না, কি হয়েছে?

    না রে, সাহায্য করার কিছু নেই। তেমন কিছু.…. বলেই মধু মাথা নিচু করলো। আমি অবাক হয়ে ওকে দেখছিলাম, হঠাৎ ওর পেটের দিকে নজর গেলো। এতোক্ষণ ও কোলের মধ্যে একটা ব্যাগ নিয়ে দু’হাতে ধরে বসে ছিলো তাই নজর পড়েনি। এখন দেখলাম, বাঁ হাতটা ব্যাগের পেছন দিয়ে নিয়ে গিয়ে নিজের পেটে বোলাচ্ছে। আর মুখ নিচু করে সেদিকেই তাকিয়ে….

    কি রে, পেটে কিছু হয়েছে তোর? আমি জিজ্ঞাসা করলাম…
    হ্যাঁ, ওই আর কি, বলে মুখটা তুলে একটু হাসলো। বড্ড ক্লিশে লাগলো এ হাসি। ঠিক আগের মতো নয়।
    কি হয়েছে পেটে? কোথায় কষ্ট? কতোদিন… এই প্রথম দেখাবি? আগে কেন আসিস নি? ইনি খুবই ভালো ট্রিটমেন্ট করেন রে। দেখবি, তোর যাই হয়ে থাকুক, তুই ঠিক ভালো হয়ে যাবি।
    বলছিস…? মধু অদ্ভুত ভাবে তাকালো আমার দিকে, ওর চোখে কি যেন……
    আমি বললাম, হ্যাঁরে, আমি বলছি, তুই দেখে নিস।
    আবার হাসলো মধু…….. না রে, ঠিক ভুল কিচ্ছু আর হবার নয়। যা হবার হয়ে গেছে। কিচ্ছুই আর করার নেই কারুরই….
    বড্ড ভয় করলো আমার, কি এমন হয়েছে মধুর? এমন ভাবে কেনো কথা বলছে? আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি….

    কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে মুখটা আবার আগের মতো নিচু করে পেটে হাত দিয়ে বিড়বিড় করে বললো, আমি প্রেগন্যান্ট…… বলে আস্তে করে আমার দিকে তাকালো। আমি অবাক হয়ে বড় বড় চোখ করে ওর দিকে তাকালাম, তারপর ওর পেটের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম, হ্যাঁ, সত্যিই তো, পেটটা তো অস্বাভাবিক রকম বড়। ঠিক মোটা হয়ে যাওয়া বা চর্বি জমার মতো তো নয়। একদমই অন্যরকম….

    এখন? কি বলছিস তুই?…….
    হ্যাঁ রে, ঠিকই বলছি…..
    কিন্তু কতোদিন? মানে ক মাস চলছে?…
    ….. সাত পেরিয়ে গেছে….!
    আমি অবাক…. কিছু করার কথা ভাবিস নি?
    – সময় ছিলো না, গত সপ্তাহে হঠাৎই পেটে যন্ত্রণা শুরু হলো, অদ্ভুত যন্ত্রণা। পাড়ার ডক্টরকে ডেকে আনলো অনিমেষ, তিনি দেখেই কিছু সন্দেহ করেছিলেন। কিন্তু কিছু বলেন নি, হালকা একটা ওষুধ দিয়ে, এনার কাছে রেফার করেন। পরের দিনই এসেছিলাম এখানে। তখনই সব জানতে পারি। আর এতোটা দেরি হয়ে গেছে, কিছুই করার নেই। অগত্যা…. বলে আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

    আমারও কিছুই বলার ছিলো না। এর মধ্যে আমার নম্বর এসে যাওয়ায় আমি ভেতরে চলে গেলাম। বেরিয়ে আর ওদের দেখতে পেলাম না। অনেক খুঁজলাম, অদ্ভুত তো। কোথায় চলে গেলো..? ফোন নং টাও নেওয়া হয়নি যে… ইসস, বড্ড ভুল হয়ে গেলো…. কি আর করা, ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসে অটো ধরার জন্য স্ট্যান্ডের দিকে এগোলাম।

    অটোতে বসে ভাবতে ভাবতে, কতো কথাই মনে পড়লো। তখন আমরা ইলেভেনে সদ্য ভর্তি হয়েছি। কি করে যেন আমাদের চারজনের খুব ভাব হয়ে গেছিলো, অল্পদিনেই প্রাণের বন্ধু…. নিজেদের বিষয়ে অনেক কথাই হতো। তেমনই একদিন আমরা কে কয় ভাইবোন জানা হচ্ছিলো। সবাই বলার পর, মধু ঠিক এমনই চুপ কিছুক্ষণ। তারপর বললো, ওরা তিন ভাইবোন। ও বড়, আর দুই ভাই ছোটো। স্বভাবতই ভাইরা কি পড়ে জানতে চাওয়াতে, মুখ নিচু করেই বললো, এক ভাই নাইনে পড়ে আর……. চুপ করে নখ খুঁটছে….. আমরা তো অবাক হয়ে অপেক্ষা করছি… রত্না বলে উঠলো, আর একভাই… কিসে পড়ে রে? ও যেন কুঁকড়ে গেলো…. একটুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ছোটো ভাই ৫ মাসের…! আমরা ভীষণ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে….. হঠাৎ ভীষণ রেগে গিয়ে বলতে শুরু করলো….. হ্যাঁ, আমার ছোটভাই ব্যাস ৫ মাসের। সামনের মাসে তার অন্নপ্রাশন বুঝলি? কি করবো বল? এতো কিছু সহ্য করা….. আর পারছি না রে। তাই তো এতোদূরের কলেজে ভর্তি হয়েছি। আমাদের স্কুলেই তো ১১-১২ ছিলো। আমার তো এখন কলেজে আসার কথাই নয়। কিন্তু ওখানে তো সব্বাই আমাদের চেনে। সবাই জানে আমার ভাই হবার কথা, কি করে যাবো বল ওই স্কুলে? সবাই তো হাসবে আমাকে দেখে, তাই না? দেখলাম, এক চোখ ভরা জল…..

    এরপর বেশ অনেকদিন পর, তখন আমরা অনেকটাই অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছি একে অপরের, বলেছিলো সব কথাই। ওর মা নাকি বুঝতে পারেনি আগে কিছুই। আর যখন বুঝেছিলো তখন প্রায় ন মাস চলছে। কিছুই করার ছিলোনা। তার মাত্র দিন পনের পরই ডেলিভারি হয়ে যায়। জানিনা ওর বাবা মা এ ব্যাপারে কতোটা লজ্জিত ছিলেন, ওনাদের কখনো দেখিনি আমরা। কিন্তু মধু যে ওই ভাইকে নিয়ে খুবই লজ্জিত সেটা বুঝতাম। কিন্তু আমাদের ১২ ক্লাস শেষ হতে হতে, ততোদিনে ভাই বেশ একটু বড় হয়েছে হাঁটতে, কথা বলতে শিখেছে অল্প। তখন যখন ও বাড়ী যেত, ফিরে এসে খুব খুশি হয়ে ভাইয়ের গল্প করতো দেখতাম। ভাইটা কতো বুদ্ধিমান, কতোটা দুষ্টু হয়েছে এই সব বলতো।

    আমি শুধু একটাই কথা ভাবছিলাম, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি একই মানুষের জীবনে, কিভাবে সম্ভব? শুধু পরিবেশ আর পাত্রের বদল ঘটেছে। ভাবছিলাম, মধুর ছেলে মেয়ে কি জানে ব্যাপারটা? মধু কি বলেছে ওদের? তারা কি ভাবে নেবে? তারাও কি লজ্জিত হবে বাবা মা এর এমন উদ্ভট অসংযমী আচরণে? তারা কি পারবে মেনে নিতে……. কি জানি কি করবে ওরা….
    এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন আমার নামার জায়গা এসে গেছে, খেয়ালই করিনি। ভাগ্যিস অটোর ছেলেটা বললো, ও দিদি, নামবেন তো এখানে… আমি চমকে উঠে দেখেই তাড়াতাড়ি নেমে ওর ভাড়াটা দিয়েই বাড়ীর দিকে পা চালালাম…..

  • গল্প

    গল্প- বাবুয়া ও কালুয়া

    বাবুয়া ও কালুয়া
    – জ্যোৎস্না ভট্টাচার্য ত্রিবেদী

    আজ চারদিন হয়ে গেলো বাবুয়া ঘরে ফেরেনি। অদিতি চুপচাপ বাইরের ঘরের জানলায় বসে বাবুয়ার কথাই ভাবছিলো। নাহ, এই মূহুর্তে বাবুয়া কোথায় গেছে, এখন কোথায় আছে, কেমন আছে, কিছু খেয়েছে কিনা এসব আর তার চিন্তায় নেই। তার মন জুড়ে এখন শুধুই স্মৃতির মেলা। বাবুয়ার জন্মক্ষণ থেকে গত বাইশটা বছর যত ভালো মন্দ স্মৃতি, সব তার মনের আকাশে শরতের মেঘের মতো ভেসে উঠছে। আবার বুদবুদের মতো মিলিয়েও যাচ্ছে। কখনো অদিতির মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে খুশীতে, আবার কখনো মলিন, জলে ভরে উঠছে দু’চোখ।
    ঢং ঢং করে জানান দিলো ঘড়ি পাঁচটা বাজছে। চমকে তাকালো জানলার বাইরে, ভোর হয়ে গেছে। পাখীরা বেরিয়ে পড়েছে তাদের নিত্যকার কাজে, পেপারওয়ালা, সব্জীওয়ালা, দুধওয়ালা সবাই যে যার কাজে চলেছে। শুধু অদিতিই আজ চার দিন এই জানলার সামনে চুপচাপ নিষ্কর্মা…..
    নাহ্, আর না, উঠে পড়লো অদিতি। অনেক কাজ পড়ে আছে, এভাবে বসে থাকলে কি চলবে… চার দিন পেটে কিচ্ছু পড়ে নি। পেটের ভেতর খিদে পেয়ে পেয়ে অদ্ভুত কষ্ট আর যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়েছে। আর না, এবার কিছু মুখে দিতে হবে। রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালো, একটু চা আর কটা বিস্কুট আপাতত…

    কি আর করা যাবে… ও তো যাবারই ছিলো। হয় নিরুদ্দেশ আর না হয় জেল। এ বরং ভালোই হয়েছে, পুলিস এসে বাড়ী থেকে টেনে নিয়ে যেত অদিতির চোখের সামনে দিয়ে, সেটা তো আরো অসহ্য, আরও অসন্মানের। তার চেয়ে এই ভালো, সবাই জানলো বাছা আমার নিরুদ্দেশ। একমাত্র অদিতিই জানে বাবুয়া…. কতো বড়ো অন্যায় করে চলেছিলো। ড্রাগস এর চালান, বাচ্চাদের স্কুলে বিক্রি। ছিঃ ছিঃ, একজন আদর্শবান স্কুল শিক্ষকের ছেলে হয়ে শেষে কিনা… ভাগ্যিস আজ অরীন বেঁচে নেই…. থাকলে তো এসব জানার পর সে নিজেই আত্মঘাতী হতো। কিন্তু অদিতি অতো বোকা নয়, হলোই বা ছেলে, সে খারাপ হয়েছে বলে অদিতি মরবে..! কেন? কখনোই না, বাঁচবে অদিতি, বাবুয়াকে ছাড়াই।
    এই সময় দেখে কালুয়া কোথা থেকে এসে ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে। ওর পোষা কুকুর ছানা, এখন একটু বড় হয়েছে। বাবুয়ার সাথে মিলিয়ে ওর নাম কালুয়া রেখেছিলো। বড্ড নেওটা অদিতির। ওকেই কোলে তুলে নিলো অদিতি, জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। গত চার দিনের জমিয়ে রাখা সমস্ত কষ্ট, সমস্ত কান্না চোখের জল হয়ে কালুয়াকে ভিজিয়ে দিলো। ও বেচারিও খায় নি চারদিন কিচ্ছু, বুঝেছে কিছু একটা ঘটেছে। চুপচাপ বাইরের ঘরে পড়েছিলো।
    হঠাৎ কুঁইকুঁই করে উঠতে অদিতির মনে হলো ওকেও খেতে দিতে হবে। তাড়াতাড়ি বিস্কুটের কৌটো খুলে চারটে বিস্কুট বার করে ভেঙে ওকে খেতে দিলো। আর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে মনে মনে বিড় বিড় করতে লাগলো, আজ থেকে শুধু তুই আর আমি। ব্যাস, এই দু’জন, তুই আমার জন্য আমি তোর জন্য। আর কেউ নেই পৃথিবীতে আমাদের…. আর কেউ নেই, তুই আর আমি, শুধু তুই আর আমি……

  • কবিতা

    কবিতা- চলে যাব

    চলে যাব
    – জ্যোৎস্না ভট্টাচার্য ত্রিবেদী

     

    চলে যাব, একদিন ঠিক চলে যাব
    ছেড়ে যাব মায়াময় এই পৃথিবী
    রঙীন কাঁচের মতো ঝিলিমিলি মধুময় এই সংসার
    এ্যকোরিয়ামে সাজানো ছোট ছোট রঙ বেরঙের মাছের মতো ঠুনকো ক্ষীণজীবি সব সম্পর্ক
    নিজের হাতে যত্নে গড়া দুষ্প্রাপ্য বনসাই-এর অথবা ক্যাকটাসের মতো নিকট আত্মীয়রা
    চলে যাব সবকিছু পেছনে ফেলে একদিন ঠিক চলে যাব।
    কিছু স্বপ্নে বহু মমতায় সাজানোয় এই ঘর দুয়ার
    আমার বড় প্রিয় সাধের প্রসাধনী আয়না
    যে কিনা সদাই ব্যস্ত আমার স্তাবকতায়
    সেরা সৌন্দর্য আমারই,
    অহরহ এই অমোঘ মিথ্যা স্তুতি
    যা আমাকে শুধু নিজের কাছেই অত্যন্ত দামি করে তুলত
    ফেলে যাবে পিছনে।
    আজ আর কারো কাছে দাম চাওয়ার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। দামী হওয়ারও।
    ওই যে দেখছো সেগুন কাঠের মহার্ঘ পালঙ্কখানি, ওর সর্বাঙ্গ জুড়ে দুষ্প্রাপ্য মনমুগ্ধকর সব কারুকাজ।
    আমি যেদিন প্রথম পা রাখি এই গৃহে, অবগুন্ঠনবতী বেনারসি চন্দন স্বর্ণালঙ্কার, বিপুল বৈভবের সমস্ত চিহ্ন সর্বাঙ্গে বহন করে লজ্জাবনতা এক সদ্য কিশোরী।
    দু’চোখ ভরে দেখেছিলেম অপরূপ কাষ্ঠশিল্পের নিদর্শন।
    সেদিন থেকে আজ অব্দি ওটা আমার বড্ড প্রিয়।
    সুখে দুঃখে আনন্দে বেদনায় আমার প্রিয় সখি।
    কত বেদনাময় নির্ঘুম রাতের সাক্ষী,
    সাক্ষী কত আদর সোহাগ প্রেম এবং অপ্রেমেরও। ছেড়ে যাব ওকে।
    ছেড়ে যাব যতসব সম্পর্কের ভার
    যত প্রিয় ও অপ্রিয় জন কাছের ও দূরের আপন ও পর।
    ফেলে যাব সব টুকু
    প্রশংসা অথবা আড়ালে করা ফিসফিস নিন্দা মুখোশের আড়ালে যত তোষামোদি শুভাকাঙ্ক্ষী, অথবা
    পায়ে পা লাগিয়ে তুমুল ঝগড়ার পর
    দুই হাত বাড়িয়ে বুকে জড়ানো জটিল বন্ধুত্ব।
    সব সব ফেলে চলে যাব ঠিক, ঠিক একদিন।
    পড়বে কি ঝরে দুফোঁটা অশ্রু কারো, শবের কপোলে আমার, গভীর দীর্ঘশ্বাসে আড়াল করবে কি কেউ উপছে আসা চোখের জল। কেউ কি একটিবারও বলবে না ‘যেওনা, যেওনা ওগো, যেতে নাহি দিব।’
    হয়তো বলবে কেউ কেউ, ‘আহা! বড় ভালো ছিল।’
    হয়তো মনে মনে খুঁজবে আমার বড় দেরাজের কোন কোন খাঁজে কি কি লুকানো থাকতে পারে,
    কোন তরঙ্গের চাবি বিছানার কোন কোনে লুকানো আছে।
    চোখে জল ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি লুকানো নিকটাত্মীয়ের দল।
    ছেড়ে যাব, সব ছেড়ে যাব।
    সেদিন যদি খুঁজতে চাও পেতে চাও
    আমার একটু খানি পরশ,
    তবে খুঁজো আমার পুরোনো ডায়েরির ছেঁড়া পাতায় অথবা পুকুর ঘাটের ভাঙ্গা সিড়িখানিতে।
    কিংবা রান্নাঘরে কুলুঙ্গিতে যত্নে তুলে রাখা কিছু খুচরো পয়সার ছেঁড়া বটুয়ায়, পেতে পারো আমার প্রিয় রঙিন ডূরে শাড়ির ভাঁজে অথবা অতি প্রিয় ওই আরসি খানির মলিন প্রতিবিম্বে।
    শুধু একটুখানি স্মৃতি পরশ আমি নয়, আমাকে নয়
    আমি তখন সব ফেলে পাড়ি জমাবো দূর দিগন্তের ওই পারে।
    ছেড়ে যাব সব ছেড়ে যাব, ঠিক একদিন….

  • গল্প

    গল্প- বাপি

    বাপি
    -জ্যোৎস্না ভট্টাচার্য ত্রিবেদী

     

    দিদি এই দিদি বলনা রে ওই অত তারার মধ্যে কোনটা আমাদের বাপি…..ছোট্ট পাঁচ বছরের ভাইটি প্রশ্ন করে তার চেয়ে তিন বছর এর বড়ো অতি অভিজ্ঞ দিদিকে।
    দিদি ও তখন হাঁ করে মাথার ওপর বিশাল আকাশের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে।
    ওই দেখ ভাই, ওই যে তারাটা জ্বল জ্বল করছে একটু বড়ো মতো ওটাই বাপি।
    ভাইটি হাঁ করে দেখতে থাকে। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে,
    দিদি বাপি কবে আসবে রে? আমার যে বড্ডো মন কেমন করে। কত দিন হয়ে গেল বাপি চলে গেছে। এখনো কেন আসছে না বল? আমার যে বড্ডো বাপির কোলে চড়ে বাজার যেতে ঘুরতে যেতে ইচ্ছা করে । বলনা দিদি কবে আসবে বাপি?
    দিদি অভিজ্ঞর মতো খালি মাথা নাড়ে। নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকে তারাদের দিকে।
    ভাই আবার জিজ্ঞাসা করে আচ্ছা দিদি একটা কথা বল সবার তো মা’রা ঘরেই থাকে কিন্তু আমাদের মা কেন যায় অফিস? আমার একটুও ভালো লাগে না মা’কে ছেড়ে এতক্ষণ থাকতে।
    দূর পাগল আমাদের যে বাপি নেই তাই তো মা’ই যায় বাপির অফিসে বাপির মতোই কাজ করতে…ছোট্ট দিদিটি উত্তর দেয়।
    ও তাই? তো বাপি কেন তাহলে আসছে না। বাপি কি দেখতে পাচ্ছে না আমার, তোর, মা এর কত কষ্ট। জানিস মা রোজ রাত এ কাঁদে লুকিয়ে লুকিয়ে। তুই তো মার পাশে ঘুমাস না আমি পাশে শুই তাই আমি ঠিক বুঝতে পারি।
    আর তাছাড়া আর একটা কথা রে দিদি মা এত সাদা সাদা কাপড় কেন পড়ে? মার তো কতো সুন্দর সুন্দর রঙের শাড়ি আছে। সেগুলো কেন পড়ে না রে। আমার দেখতে একটুও ভালো লাগে না। বড়মা ছোটমা মেজমা’রা কি সুন্দর লাল নীল শাড়ি পড়ে। আর ওই লাল টিপটাও আর মা পরে না। আগে কি সুন্দর দেখাতো বল ওই লাল আর হলুদ রঙের সুন্দর শাড়িটা পরে আর লাল টিপ লাগিয়ে মাকে। সবার চেয়ে সুন্দর দেখাতো তাই না বল দিদি।
    এবার দিদি মুখ খোলে… হ্যাঁ রে ভাই। মা’কে খুব সুন্দর লাগতো। কিন্তু মা আর কোনোদিন ওই সব রঙীন শাড়ি আর লাল টিপ পড়বে না রে। আমাদের মা এখন ওই সাদা শাড়িই পড়বে।
    কেন? দিদি কেন? সবাই পড়বে আমার মা কেন পড়বে না?
    দূর বোকা তুই কিছু জানিস না। আমাদের যে বাবা নেই। ঠাকুরের কাছে চলে গেছে। তাই মা-কে আর ওসব পড়তে নেই। দেখিস নি মা কি আর মাছ খায়? আর সবাই তো খায়। কিন্তু মা তো ঠামমির সাথে আলাদা খায়। আর ওই একাদশীও তো করে ঠাম্মার মতো। দেখিস নি।
    হ্যাঁ, দেখেছি তো। কিন্তু এ সব কি বাপি দেখতে পায় না? তবে কেন আসছে না চলে বাপি বল না রে।
    না রে ভাই, বাপি আর কোনো দিনই আসবে না। এ বাবা! কে বলেছে তোকে? ভাই তো অত্যন্ত অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
    দিদি তখন উদাস স্বরে বলে আমি জানি। বাপি আর ফিরবে না।
    ভাই ব্যাকুল হয়ে আবার জিজ্ঞাসা করে.. কেন রে.. বলনা কে বলছে তোকে এ কথা?বলনা দিদি…
    ধীর শান্ত মৃদু স্পষ্ট স্বরে বলে দিদি…মা বলেছে।
    মা? মা তোকে বলেছে বাপি আর ফিরে আসবে না?
    হ্যাঁ রে মা-ই বলেছে। কবে জানিস? সেই দিন যেদিন ভোর রাতে বাপিকে নিয়ে সবাই চলে গেলো। একটা সাদা গাড়ি এসেছিলো জানিস। সবাই বলছিল এম্বুলেন্স এসেছে। সকলে মিলে বাপিকে ধরাধরি করে নামিয়ে নিয়ে গড়িতে ওঠাচ্ছিলো। তখন আমি আর মা এই জানলায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। তখনই মা বলেছিলো…
    “মনি বাপিকে দেখে নে শেষ বারের মতো। আর তোর বাপি ফিরবে না রে। আর ফিরবে না।”
    সত্যি আর তো বাপি ফেরেনি বাড়ি। সেদিন সন্ধে বেলা জেঠু কাকু আরো কত লোক সবাই বাড়ি আসলো। জেঠু কাঁদতে কাঁদতে ঠামমিকে বললো মা গো পারলাম না ভাইকে ফিরিয়ে আনতে। সবাই কতো কাঁদলো। তুই তো খুব ছোট ছিলি তখন তাই তুই কিছু বুঝিস নি। আর ভোর বেলা বা সারা রাত যে বাপি খুব কষ্ট পেয়েছিলো সে সব ও তুই জানতে পারিস নি। তুই তো ঘুমাচ্ছিলিস। একমাত্র তুইই সেদিন রাতে ঘুমাচ্ছিলিস। আর সবাই জেগে ছিলো।
    ভাই খুব চিন্তিত মনে আবার জিজ্ঞাসা করে তবে কি হবে রে দিদি? বাপি কি সত্যি আর আসবে না? কেন? বাপির কি আমাদের দেখতে একটুও ইচ্ছা করে না? বাপি কি আমাদের ভালোবাসতো না রে?
    না রে ভাই। বাপি তো খুব ভালোবাসতো। তোকে আমাকে মা’কে ঠামমিকে আর সবাইকে। আর বাপি কি নিজের ইচ্ছায় গেছে বল। ঠাকুরই তো নিয়ে গেছে। আর ঠাকুর যাকে নিয়ে যায় সে আর ফিরতে পারে না রে।
    কিন্তু কেন? ঠাকুরের কি বাপি নেই নাকি। আমাদের বাপিকেই নিতে হলো? আর কাউকে পেলো না? ঠাকুর খুব বাজে। খুব বাজে। আমি আর কোনো দিন ঠাকুরকে প্রণাম করবো না। মা যতই বলুক করতে। করবোই না। চোখ জলে ভোরে আসে পাঁচ বছরের ছোট্ট পিতৃ হারা শিশুটির। আর তার হঠাৎ বড়ো হয়ে যাওয়া দিদি তাকে টেনে নয় কাছে। চোখের জল মুছিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে চলে। ভোলানোর চেষ্টা করে চলে। এভাবেই কেটে যায় দিন। মাস। বছর। আস্তে আস্তে সবই স্মৃতি হয়ে যায়। তলিয়ে যায় কত কিছু বিস্মৃতির অন্তরালে।

  • কবিতা

    কবিতা- একলা চলো রে…

    একলা চলো রে…
    – জ্যোৎস্না ভট্টাচার্য ত্রিবেদী

     

    মুখের কথায় ভালোবাসার মানুষ সর্বজন,
    স্বার্থে আঘাত হলেই বুঝি কে যে আপন জন…

    যতক্ষণ তাদের মতের ‘হ্যাঁ’তে মেলাই ‘হ্যাঁ’,
    বন্ধু স্বজন, সুজন তখন ভীষণ প্রিয় মন,
    যেই ক্ষণে তাদের মতের বিরোধ করি ভুলে,

    আপন পরের তকমাটা যায় সেইক্ষণেই খুলে….
    চারপাশের পৃথিবী এমন হাজার ভুলেই ভরা,
    কে যে আসল আর কেই বা ভুল, বৃথাই বিচার করা
    আসল কথা একটাই যা, বুঝেছি আজ সার,
    কে আপন আর কেই বা পর মিছেই চিন্তা আমার
    আমার নিজের আপন ‘আমি’, এটাই সঠিক জানি
    এসেছি একা, যাবোও একা, এটাই সত্য মানি…
    মাঝখানের এই কটা দিনের ঠুনকো আপন পর
    আজ ‘মলে’ কাল দু’দিন হবে, ভুলবে সকল ঘর।

  • কবিতা

    কবিতা- আমিই কেন…!

    আমিই কেন…!
    – জ্যোৎস্না ভট্টাচার্য ত্রিবেদী

     

    ইচ্ছে হয় কখনো কখনো
    আমিও না থাকি কোনো নিয়মে….
    যখন খুশি উঠি, যখন খুশি বসি…
    দেখি যখন কাউকে অনিয়মে জীবন কাটাতে
    নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস এধার ওধার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতে.…
    তখন ভাবি– আমি ই কেন এই ঝঞ্ঝাটে পড়ি
    সবার সব কিছু যথাস্থান এ গুছিয়ে রাখা
    আমিই কেন!
    রেখে দিই আমিও জল খেয়ে গ্লাস খাটের নিচে..
    ফেলে দিই খেয়ে টফির প্যাকেট বিছানার পিছে…
    কাচা কাপড় জামা শুকোতে না দিয়ে, রেখে দিই অমনি।
    কারুর অসুবিধা হলে হোক না, আমিই কেন?
    আমিই কেন বেঁচে যাওয়া সাবানের টুকরোতে স্নান সারবো ..!
    কেন আমিই শেষ হয়ে যাওয়া টিউব খুঁচিয়ে পেস্ট করবো..!
    আমিই কেন পাঁউরুটির ওপর নিচের পোড়া শক্ত টুকরোতে ব্রেকফাস্ট সারবো..!
    আমিই কেন….কেন আমিই পিষে যাবো প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ, সারাটা দিন…
    গৃহস্থীর এই চাকায় পিষে কেনো শেষ হবে আমারই জীবন..?
    আমিই কেন..!
    চলতে দিই এই সংসারকে, প্রতিদিনের সমস্যায় জর্জরিত হতে হতে, চলতে দিই…
    আমিই কেন..!

  • কবিতা

    কবিতা- আমার আমি কই —-

    আমার আমি কই 
    – জ্যোৎস্না ভট্টাচার্য ত্রিবেদী

     

    বলতে তো চাই অনেক কিছু ,বলতে সেকি পারি
    বলবো বলে মুখ খুলতেই স্তব্ধ গতি নাড়ী।
    বলার যে সব ধরন ধারন রপ্ত যে নয় মোটে
    বলতে গেলেই সত্যি টা যে ঠোঁটে কুলূপ আঁটে
    সত্যিগুলো কঠিন বড়ই কদর্য ও বটে,
    সত্য বচন শুনলে পড়ে বন্ধুচ্ছেদ ঘটে।।
    আসে পাশের মানুষ গুলো যতই আপন হোক,
    যে কথায় যার স্বার্থ হানি প্রকাশিবেই ক্ষোভ।।
    “সদা সত্য বলিবে “বাল্যকালের শিক্ষা
    বড় হলেই বদলে যাবে হবে না সত্য রক্ষা।
    “পরের ঘরে যাচ্ছ তুমি, বোবার শত্তুর নেই”
    এই কথাটি সর্বদা মনেতে রাখবেই।
    এই বলে মা বিদায় দিলো পরের ঘরের তরে,
    মনে গেঁথে মায়ের সে বাক্ গেলাম পরের ঘরে।
    আজন্ম সংস্কার, সত্যি বলার অধিকার
    দিয়ে বিসর্জন ,
    নতুন করে মিথ্যে মানুষ হোলো যে সৃজন।।
    মৌন থাকা আর মিথ্যে বলায় তফাৎ কত আর
    মৌনরূপী মিথ্যাকে তাই করলাম স্বীকার।।
    মেনেও নিলাম মানিয়ে ও নিলাম আমার হিসাব মতো।
    পরের ঘরের অন্যায় আর মিথ্যা ও ভুল যত।।
    সব ক্ষেত্রেই মৌন ব্রত করেছি ধারন
    সংসার আজ সোনার আমার সুখী গৃহকোণ।।
    সবাইকে সুখ দিতে গিয়ে নিজের শান্তি যত,
    ধীরে ধীরে সকল কিছুই হয়েছে তিরহিত।।
    এখন আমি সফল নারী, গৃহিনী, সফল মা,
    তবু কেন সকল সুখে সুখী হলেম না।
    সবাই বলে বৌমা ভালো, মা ও রত্নগর্ভা,
    আতিথেয়তায় সবার সেরা ঘরের সর্বেসর্বা।
    আমার মনে তবে কেন বিষন্নতার ছোঁয়া
    কি যেন এক হারিয়ে ফেলার কষ্টের বীজ বোয়া।
    নতুন মানুষ হাসি খুশি সবার মাঝে রই
    খুজে বেড়াই আকূল হয়ে ‘আমার আমি’ কই।

  • কবিতা

    কবিতা- দিতে পারি…

    দিতে পারি……
    – জ্যোৎস্না ভট্টাচার্য ত্রিবেদী

     

    দিতে পারি, হ্যাঁ দিতেই পারি
    কিন্তু কেন দেবো..
    (আমার) সব কিছু কি ফেলনা,
    চাইলেই সব দিয়ে দিলে
    ভাববে সবই মাগনা।
    যতক্ষণ না পাচ্ছ সে ধন
    চাইছো হাঁকু পাঁকু
    পাবার বিষম আকুলতায়
    করছো হাঁকু পাঁকু
    পেলেই হাতে ব্যবহার এ জীর্ণ করো সবই
    না পাবার ব্যাকুলতা ভুলবে নিমেষেই।
    সব কিছুরই মুল্য আছে,
    সে সব ভুলে যাবে
    সবটা তোমারই প্রাপ্য ছিল
    এমনটাই মনে হবে
    না পাবার দুঃখ কিছু, একটু তো ভোগ করো
    তবেই যদি পাবার পরে
    তার মূল্য বুঝতে পারো।
    .

You cannot copy content of this page