-
কবিতা- বানভাসি
বানভাসি
–তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়সেদিন হৃদয় আকাশে ছড়ালো
নতুন সূর্যের মায়ামাখা ভোর।
ঝিরিঝিরি হাওয়া ঢেউ
তুলে গেলো এ হৃদয় বরাবর।আদরের এক পালতোলা নৌকো
প্রেমের উজান বেয়ে চলে।
ব্যথার নুড়ি কুড়িয়েছি যত,
ছুঁড়ে দিই নদী জলে।সেই প্রেম অগোচরে
হারালো জীবন থেকে।
জল ছলছল চোখে
আপনমনে খুঁজি তাকে।আবছা আলোয় সজল চোখে
বিষণ্ণ এক মন।
বৃষ্টিতে আজ ভিজছে সবই,
পাহাড়, নদী, বন।সারাদিন বৃষ্টি শুধু,
ঝরছে নিরবধি।
মনের মধ্যে বানভাসি এক,
দু’কুল ছাপা নদী। -
কবিতা- অপেক্ষার শেষে
অপেক্ষার শেষে
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়অন্তহীন অপেক্ষার শেষে
নিঃসীম অন্ধকার।
বিষন্ন মনে মরা স্বপ্নেরা
জমাট পাথর।মন তাও রোদ ছুঁতে চায়,
চায় জ্যোৎস্নার মায়া।
সবটুকু অন্ধকার মুছিয়ে,
সরাতে চায় ক্ষয়াটে ছায়া।জন্ম থেকে জন্মান্তরে,
মাটি,জল,আলোর পরশ লেগেছে প্রাণে।
অনন্ত প্রেমের ধারা,
উঠেছে জেগে,আবেশে ছুটেছে হৃদয় গহনে।রাতচরা পাখী উড়ে যায়,
আকাশের চাঁদ ছুঁয়ে।
জোছনায় মাখামাখি নরম মায়া,
দহন ক্লান্ত হৃদয় দেয় জুড়িয়ে।। -
কবিতা- অন্ধকার ক্লান্তি
অন্ধকার ক্লান্তি
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়নীতি নেই,আদর্শ নেই,শিক্ষা নেই,কাজ নেই,আলো নেই।
আদর্শহীন জীবনে প্রাণও নেই।
আছে শুধু বেচাকেনা।
এখানে মানবতাও বেচা যায় অল্প দামে।
এখানে নীতি,আদর্শ,শিক্ষা,সম্মান বেচে দিয়ে দুর্নীতির জপমালা কেনা যায়।এখানে হারিয়ে যাওয়ার গল্প আছে।
কিন্তু ফিরে আসার কোনো গল্প নেই।এখানে অসততার চোরাবালিতে ডুবে যাওয়ার গল্প আছে।
কিন্তু চোরাবালি থেকে নিজেকে টেনে তোলার কোনো গল্প নেই।জীবনের বিষাদ কারাগারে বন্দী জীবন মৃত্যুমুখী।
মিথ্যের পাহাড়ে রোদ নিভে যায়,
অন্ধকার ক্লান্তি নামে।। -
কবিতা- অভিমানী
অভিমানী
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়শরীরটা বেঁচে আছে, তবু বলো
মন কেন মরে যায়?
অভিমানী কথাগুলো সব,
দু’টি ঠোঁটে নীরবতা পায়?বাঁচবে কি করে বলো মন…
প্রিয়জন,ভালোবাসা ছাড়া?
আলোগুলো কেঁপে নিভে যায়।
মন খালি পথ ভুলে গিয়ে,
প্রিয়জন,ভালোবাসা হারায়।মুহূর্তরা আসছে ফুরিয়ে,
হারিয়েছে কত মন।
জীবন থেকে জীবনকে কেড়ে,
খুঁজে চলি আপনজন।হাজার প্রতিশ্রুতির মাঝে…
আজও হাতে হাত রেখে চলা।
আজও স্বপ্নগুলো রোদ মাখে,
মনে মেঘ – বৃষ্টির খেলা।। -
গল্প- খুশীর রঙ
খুশীর রঙ
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়
জীবনে রঙের তো কোন অভাব ছিলো না অপর্ণার। রামধনুর সাত রঙের মেলায় ও ছিলো রঙীন এক প্রজাপতির মতো। বাবা-মায়ের আদরের ছটপটে মেয়েটি লেখাপড়া করে একটা চাকরী যোগাড় করেছিলো প্রাইভেট ফার্মে।জীবন বেশ চলছিলো তরতরিয়ে। বাড়ির দায়দায়িত্ব তেমন কিছু ছিলো না… নিজের উপার্জিত অর্থ নিজের খুশীমতো খরচ করতে পারতো সে। বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা,আড্ডা,শপিং করে বেশ মজায় কাটছিলো দিন। পিছন ফিরে তাকালে অপর্ণার মনে হয় সেই দিনগুলোই তার জীবনের সোনালী দিন ছিলো। এত স্বাধীনতা তাড়াতাড়ি হারাতে চায়নি সে…তাই বিয়ের বয়স একটু বেড়েই গেছিলো। যদিও এখনকার দিনে অল্পবয়সে কোন মেয়েই’বা বিয়ের ফাঁদে পড়তে চায় যদি তার সামনে এমন একটা খোলা আকাশ থাকে?
যদিও মা তাড়া দিতেন… প্রায় প্রতিদিনই নিয়ম করে বলতেন –দ্যাখ, মেয়েদের সঠিক সময়ে বাচ্চা হওয়াটা জরুরী নয়তো পরে নানা সমস্যা হয়। অপর্ণা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলতো আগে বিয়ে না আগে বাচ্চা??
মা উত্তরে বলতো –“জানিসতো এখন মর্ডান মেডিকেল ব্যবস্থায় বিয়ের আগেই বাচ্চার চিন্তা করে মানুষ, যারা দেরী করে বাচ্চা নিতে চায় তারা ওভাম সংরক্ষণ করে। যত বয়স বাড়ে ওভামের কোয়ালিটি খারাপ হতে শুরু করে।”
সত্যিই আমার মা কত্ত জানে! এই কথা বলে আরো হাসতো অপর্ণা। তারপর বলতো–” অত চিন্তা কোরোনা, তোমার মেয়ে বুড়ি হবার আগেই বিয়ে করবে।”
শুনে মা চুপ করতেন।
অবশেষে ব্যাঙ্ক চাকুরে তপনের সাথে বিয়ে হয়েছিলো অপর্ণার। বিয়ের পরেও তিন-চার বছর বেশ হেসেখেলে,ঘুরে বেড়িয়ে রোমান্স করে কাটিয়ে দিলো ওরা। তারপর বাচ্চা নিলো। সুন্দর একটা ফুটফুটে দেখতে বাচ্চা হ’লো ওদের। কিন্তু বাচ্চাটা একটু বড় হতেই ওরা বুঝলেন বাচ্চা স্বাভাবিক নয়। কানে শুনতে পায়…তাকায় কিন্তু কথা বলতে পারেনা। মুখ দিয়ে লালা ঝরে শুধু। ডাক্তার বলেন বাচ্চার বুদ্ধির বিকাশ হয়নি ঠিকঠাক। একথা শুনে অপর্ণা-তপনের মাথায় হাত। এইসময় ছেলেকে ঠিকমত দেখাশোনার জন্য চাকরীটাও ছাড়তে হোলো অপর্ণার। তারসাথে ছেলের জন্য যোগ হলো এক তীব্র মানসিক কষ্ট। সন্তানকে বড় করতে গিয়ে বিষন্নতা গ্রাস করলো অপর্ণাকে।বিষন্নতার রঙ বোধহয় কালো। সেই কালো ছায়া ওদের সংসার,ওদের দাম্পত্য সম্পর্ককেও বিষিয়ে তুলেছিলো। আশেপাশের আত্মীয়পরিজন অপর্ণাকে দুষতে লাগলেন। অপর্ণা ভাবলো সবই তার খারাপ কপাল… নয়তো…।
পাশের বাড়ির রীমা বউদি একদিন বললেন–অপর্ণা ওকে “হ্যাপী হোম” বলে যে শিশু বিকাশ কেন্দ্র আছে… ওখানে ভর্তি করে দাও। ওরাই কথা, লেখাপড়া, খেলাধূলা,হাতের কাজ সব শেখাবে যত্ন করে। আমার বোনের ননদের ছেলেকেও দিয়েছিলো।এখন নিজের কাজ দিব্যি সব পারে… দিয়েই দেখো।
বৌদির কথামতো ওরা গেলো হ্যাপী হোম এ। ওখানকার ডাক্তার পরীক্ষা করলেন জয়কে।অপর্ণাকে বললেন–চিন্তা করবেন না।ওকে অনেক ভালোবাসা আর সময় দিতে হবে আপনাকে।দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।
ওখানে অপর্ণা দেখলো ওর ছেলের মতই নানাবয়সের অনেক বাচ্চা আছে।তাদের কেউ কেউ ঠিক করে হাঁটাচলাও করতে পারেনা। ওদের সবার সাথে মাকেও থাকতে হয় ওখানে।মায়েদেরও মাঝে মাঝে ক্লাস হয়…সেখানে মায়েদেরও গাইডলাইন দেওয়া হয় কীভাবে তারা বাচ্চার সাথে ব্যবহার করবেন।বাচ্চাকে সামলাবেন।
অত বাচ্চার কষ্ট দেখে আরো যেন কান্না পেয়ে গেলো অপর্ণার।ওদের সবার মায়েদের মুখগুলোও যেন কেমন করুণ… ঠিক অপর্ণার মতই।ও ভাবলো যেসব বাচ্চারা স্বাভাবিক,সুস্থ সেসব বাচ্চার মায়েরা কত লাকী অথচ তারাই পরীক্ষায় বাচ্চা দু’এক নম্বর কম পেলে কত শাসন ধমক অত্যাচার চালান বাচ্চাদের উপরে। ওরা ভাবতেই পারবেনা এই বাচ্চাগুলোর মায়েরা শুধু বাচ্চার আধোবুলি ফোটার অপেক্ষায় কাটিয়ে দেন কতো বছর!!
ওর চোখের জল দেখে ওখানকার এক টিচার এগিয়ে এলেন –বললেন আমরা তো আছি…সব শিখে যাবে আপনার বাচ্চা…শুধু ধৈর্য্য চাই…মনের বল চাই।মন নরম হলে আর কথায় কথায় চোখের জল ফেললে হবেনা। দেখুন ওদের… কত বড় বড় ছেলেমেয়ে হাঁটতে পারেনা…মায়েরা কোলে কোলে নিয়ে আসেন…কত্ত কষ্ট করেন…তাও হাসীমুখে থাকার চেষ্টা করেন।আমরা বলেছি আপনারা কাঁদলেন মানে আপনারা হেরে গেলেন।এখানে মায়েরা একসাথে গল্প করেন। রান্না করে এনে নিজেদের মধ্যে খাওয়াদাওয়া করেন।ছেলেমেয়েকে এখানে আমাদের কাছে রেখে নিজেরা একটু বেড়িয়ে আসেন…কেনাকাটা করেন….হাসীতে মজায় থাকেন।আমরা সেটাই বলি।নিজেরা ভালো না থাকলে বাচ্চাদের ভালো রাখবেন কি করে শুনি??
অপর্ণা ওদের কথা মেনে চলতে লাগলো।অন্য বাচ্চার মায়েদের সাথে আলাপ হলো।তাদের সাথে সুখদুঃখের গল্প করে মনটাও হাল্কা হলো।সবাই এখানে একে অপরের দুঃখের ভাগীদার।
এমন করেই প্রায় ছ’মাস কেটে গেলো।অপর্ণা জয়ের মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছে।ও একটু একটু শব্দ করতে পারে,কথা বুঝতে পারে,কমিউনিকেট করতে পারে।আর রঙ পেন্সিল দিয়ে ছবি রঙ করে।এসবই টিচারদের অসীম ধৈর্যের ফসল। অবশ্য অপর্ণাও আছে ছেলের সাথে।ও তো মা…ওকে তো পারতেই হবে…এ ও যেন এক জীবন যুদ্ধ।
সেদিন ছাদে ছেলেকে নিয়ে ঘুরছিলো অপর্ণা।মাথার উপর আকাশটা আজ একটু বেশীই নীল।হঠাৎ জয় মুখ দিয়ে ছোট্ট একটা শব্দ করে উঠলো।অপর্ণা চমকে উঠলো…জোরে চিৎকার করে বললো কি বললি সোনা??!!!ছেলের মুখ দিয়ে আবারো ছিটকে বেড়িয়ে এল আধো আধো একটা শব্দ “মা”। মায়ের খুশী যেন ছড়িয়ে পড়লো ওই গোটা আকাশে, বাতাসে।আর মনটা ঝকমক করে উঠলো খুশীর সোনালী রঙে।।
-
গল্প- রবীন্দ্রনাথকে ছুঁয়ে
রবীন্দ্রনাথকে ছুঁয়ে
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়মৃন্ময়ী আর দিগন্তের প্রাণভোমরা ওদের মেয়ে সমাপ্তি। ও লেখাপড়ায় খুব ভালো… নরম, মিষ্টি মন আর খুব বুঝদার। ছোট থেকেই শিক্ষিকা হবার ইচ্ছে ছিলো ওর।ছোটবেলায় স্কুল থেকে ফিরেই খাওয়াদাওয়া করে খেলতে বসে যেতো। দুপুরে কিছুতেই মেয়েকে ঘুম পাড়াতে পারতো না মৃন্ময়ী। প্রথম প্রথম চেষ্টা করে পরে হাল ছেড়ে দিয়ে নিজেই ঘুমিয়ে পড়তো। ছোট্ট মেয়ে তখন ওর খেলাঘরের পুতুলগুলোকে সামনে বসিয়ে দিদিমণি সাজতো। পড়াতো, পড়া ধরতো, শাসন করতো, গান শোনাতো, গল্প করতো ওদের সাথে। এমন মিছিমিছি খেলা করতে করতেই কখন যে বড় হয়ে গেলো মেয়েটা! এখন তো ও সত্যি সত্যিই একটা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের দিদিমণি। মেয়ের আরেকটা শখ গান। খুব ছোট থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছে সমাপ্তি। পরে গুরুজীর কাছে ক্লাসিকালে তালিম নেয়। খুব মিষ্টি গলা সমাপ্তির। ওর গলায় যেন সাতসুর খেলা করে।
এমন মেয়েকে তো উপযুক্ত পাত্রস্থ করা চাই। মৃন্ময়ী আর দিগন্ত চেয়েছিলো যেন ওদের মেয়ে নিজের পছন্দমত জীবনসঙ্গী খুঁজে নেয়। দিনকাল পাল্টেছে। তাদের পুরোনো যুগ তো আর নেই… আজকালকার লেখাপড়া জানা, চাকুরীরতা মেয়েদের ব্যক্তিত্ব অন্যরকমের…তারা অচেনা অজানা ছেলেকে হুট করে বিয়ে করে নিতে চায় না। আগে সবকিছু দেখে ছেলের সাথে মনের মিল হলে তবেই রাজী হয়। আর বাবা-মাও তাতেই মত দেন। কিন্তু এ মেয়ে সেসব পথেই গেলো না। ওর ইচ্ছে বাবা-মায়ের পছন্দসই পাত্রকেই ও বিয়ে করবে। বাবামায়ের উপর পুরো নির্ভরতা ওর আছে। গুরুজনেরা শুধু ছেলে নয় তার পরিবারকে দেখে আর তাদের অভিজ্ঞ চোখ অনেককিছুই ঠিক ভুল বুঝতে পারে যা অনেকসময় প্রেমের রঙিন চোখে ধরা পড়েনা। কিন্তু তাও বাইরে থেকে অনেক কিছুই ভালো লাগে… পরে নানা খুঁত বেরোয়। আসলে একসাথে এক ছাদের তলায় না থাকলে মানুষ চেনা যায় না…এটাই ভাবে মৃন্ময়ী।
সে যা হোক ওরা এক বহুল প্রচারিত দৈনিকে “পাত্র চাই” কলমে বিজ্ঞাপন দিলেন। বহু পাত্রপক্ষ যোগাযোগ করলো। তার থেকে কয়েকজনকে বেছে আলাদা করলেন দিগন্ত।
এর মধ্যে একটি ছেলের বাড়ি সল্টলেকে… ইঞ্জিনিয়ার…ভালো চাকরী করে…সাহিত্য-সঙ্গীত অনুরাগী। এই পাত্রের বাড়িতে প্রথম ফোন করেন দিগন্ত। পাত্রের বাবা ওনাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ করেন। দিগন্ত এক রবিবার সকালেই সল্টলেকে ওদের বাড়িতে যান।বাড়ির নাম দেখেই চমক লাগে…গেটের সামনে নেমপ্লেটে লেখা “সোনার তরী”। বাড়ির সামনে বাগানে সাদা থোকা থোকা ক্যামেলিয়া ফুটে রয়েছে। আরো কত ফুলের গাছ। সবুজ ঘাসে মোড়া লন। মালী বাগানে কাজ করছে আর পাশে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক। দিগন্ত গেটের কাছে দাঁড়াতেই উনি এগিয়ে এলেন…নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন…আসুন আসুন। আমিই অমিতের বাবা দেবাশীষ রায়।
বাড়ির বৈঠকখানা দিব্যি সাজানো-গোছানো। একটা শিল্প ভাবনা আছে…সবকিছুতেই যেন একটা সুন্দর রুচির ছাপ। দিগন্ত অবাক হয়ে দেখলেন একদিকের দেয়াল জুড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক বিশাল প্রতিকৃতি। দিগন্ত বুঝেই গেলেন এই বাড়ির মানুষজন রবীন্দ্র ভক্ত… সুরুচিসম্পন্ন। আর মনে মনে ভাবলেন যদি বিয়ে হয় মেয়ে এখানে ভালোই থাকবে।
আরো চমক বোধহয় বাকী ছিলো! দেবাশীষবাবুর সাথে কথা বলতে বলতেই কফি আর স্ন্যাকসের ট্রে নিয়ে হাজির ওনার স্ত্রী। তাঁকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন দিগন্ত। এ যে বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মালিনী রায়! যাকে টিভির পর্দায় প্রায়ই দেখেন দিগন্ত। বেশ উত্তেজিত হয়েই দিগন্ত বলেন–কী আশ্চর্য!! অমিত আপনার ছেলে?দেবাশীষবাবুতো একবারও আপনার কথা বলেননি।
অত্যন্ত শান্ত, ভদ্র মালিনীদেবী ঈষৎ হেসে বললেন- আমার কথা আর তেমন কী বলার আছে? আমরা সবাই রবীন্দ্রনাথের চরণাশ্রিত…তাঁকে আশ্রয় করেই আমাদের দিনযাপন। তিনিই আমাদের আরাধ্য দেবতা, সুখে, দুখে, ভালোবাসায়, রাগে,অভিমানে তিনি আমাদের সাথে রয়েছেন। তিনি আছেন বলেই আমরা আছি।
মালিনীদেবী আরো বলেন- আপনার মেয়েকে আমাদের পছন্দ হয়েছে…একজন শান্তস্বভাবের গান জানা মেয়েকেই চাই আমাদের ছেলের জন্য। বুঝতেই তো পারছেন! আর কোনো চাহিদা নেই। তবে অমিতকেও দেখুন…ও আমার ছেলে বলে বলছিনা…অবশ্যই খোঁজ নিয়ে দেখুন… আজকালকার দিনে এমন ছেলে সত্যিই দুর্লভ।
অমিত বাড়িতেই ছিলো। ওর সাথেও আলাপ করলেন দিগন্ত। বেশ হাসি ভরা মুখ অমিতের। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় খানিকটা মুখ দেখেই মানুষ চিনতে পারেন দিগন্ত। ছেলেটাকে দেখে… ওর সাথে কথা বলেই বেশ ভালো লাগে দিগন্তের।
এবার মালিনীদেবী আরো অবাক করে দিয়েই একটা প্রস্তাব রাখেন দিগন্তবাবুর কাছে… বলেন- সামনের সপ্তাহেই মেয়েকে নিয়ে, স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরে যান আমাদের বাড়ি। একেবারে মেয়ে দেখাও হয়ে যাবে… আবার মেয়েও আমাদের বাড়ি, পরিবেশ সব দেখে যেতে পারবে। অমিতের সাথে আলাপও হয়ে যাবে। আমি সব ব্যাপারে মেয়েদেরকে আগে প্রাধান্য দিই…লেখাপড়া জানা আজকালকার মেয়েদের তো নিজস্ব কিছু পছন্দ অপছন্দ থাকে। আর দেখবেন বাড়ির মেয়েরা, বৌরা ভালো থাকলে বাড়িটাও উজ্জ্বল হয়…বলে মৃদু হাসলেন মালিনী। এত বড়, গুণী একজন শিল্পী অথচ এতটুকু অহংকার নেই। যেন মাটির মানুষ। নিজে হাতেই খাবার পরিবেশন করছেন…চা করে আনছেন!
ওদের সবার সাথে আলাপ করেই বেশ ভালো লাগে দিগন্তের।
পরের সপ্তাহেই সমাপ্তি আর মৃন্ময়ীকে নিয়ে দিগন্ত আবার যান সোনার তরীতে। ওদের আলাপচারিতায়, গানে, গল্পে ভরে ওঠে সোনার-তরী। সমাপ্তির মিষ্টি গলার গান শুনে খুব খুশী হন মালিনী। বলেন, এবারে আমার সোনারতরী পুর্ণ হয়ে উঠবে।
কথায় কথায় মালিনী সমাপ্তিকে বলেন-আমার ছেলের শুধু একটাই অসুবিধা… সেটা যদি তুমি মানিয়ে নিতে পারো… তাহলেই বিয়ের সব ঠিকঠাক গুছিয়ে ফেলবো।
সমাপ্তি একথায় একটু ঘাবড়ে যায়।বাবামায়ের দিকে একটু থতমত ভাবে তাকায় সে… তারাও যেন একটু ভাবনায়।
কচি কলাপাতা রঙের চুড়িদার, কানে গলায় হাল্কা গয়না, ছোট্ট টিপ, ছিমছাম সাজে দারুণ দেখাচ্ছে সমাপ্তিকে। দূরে অমিতের সাথে চোখাচোখি হতেই মৃদু হাসলো অমিত।
মৃন্ময়ীই জিজ্ঞেস করলেন ঠিক কী ব্যাপারে অসুবিধা?
মালিনী উত্তরে বললেন- সেরকম কোনো বড় ব্যাপার নয়… তবে আমার ছেলেকে মাঝেসাঝে বিদেশে যেতে হয় অফিসের কাজে… তখন সমাপ্তিকে একলা থাকতে হবে।
মৃন্ময়ী তাড়াতাড়ি বলেন- একলা কোথায়?আপনারা আছেন … স্কুল আছে … গান আছে আর রবিঠাকুর আছেন।
মালিনী বলেন- ঠিক তাই। দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি… এই গান গাইলেই অমিতবিহনে দিনগুলো চট করে কেটে যাবে।
সবাই একযোগে হেসে উঠলেন। লজ্জারাঙা সমাপ্তির চোখ তখন লুকিয়ে একপলকে ছুঁয়ে দিলো অমিতকে। অমিতও যেন এতদিন ধরে খুঁজছিলো এই দু’টি চোখ।
-
গল্প- তিন বর
তিন বর
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়নববর্ষের সকালবেলা থেকেই জিকো তাড়া লাগাতে শুরু করলো…দাদুভাই, ঠাম্মি তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট করে ড্রেস পরে নাও।দাদুভাই তুমি ধুতি, পাঞ্জাবী পরবে আর ঠাম্মি,তোমায় কিন্তু আজ মা, গরদের শাড়ীটাই পরতে বলেছে।
খানিকবাদে অমিয়বাবু দেখলেন ওনার ছোটছেলে আর বৌমা সুন্দর সেজেগুজে রেডি হয়েছে আর জিকোবাবুও আজ পাঞ্জাবী পরে একেবারে ফুলবাবু। বছরের প্রথম দিন সবার বাঙালী সাজ দেখে অমিয়বাবু খুশী হলেন। বললেন, যাক্ তাও একটা দিন অন্তত তোমরা বাঙালী সাজে।
ধুতি, শাড়ী তো আজকালকার মানুষজন অনুষ্ঠান বাড়ি ছাড়া পরে না।
তা এত সেজেগুজে আমরা কোথায় যাবো জিকোবাবু?
দাদুভাই, আমরা কোথাও যাবো না কিন্তু আজ সবাই আমাদের বাড়ি আসবে।
শুনে ঠাম্মি বলে উঠলো- আজকে বছরের প্রথম দিন লোকজন এলে তো তাদের পেটভরে খাওয়াতে হবে-রে জিকো। সেসব আয়োজন তো কিছুই করা হয়নি! তোরা যে কি করিস! আগে বলবি তো!!
জিকো আর তার বাবা পাপু মুখ টিপে হাসতে থাকে। পাপু বলে মা, তুমি এত চিন্তা কোরো না… আজ সব ব্যবস্থা করবে ভূতের রাজা।
“ভূতের রাজা” সে আবার কোথা থেকে আসবে?
আসবে আসবে ঠাম্মি। আর আজ যা কিছু হবে সব ভূতের রাজার বরে। দেখতে থাকো।
এর মধ্যেই পাপু বাইরের ঘরে ল্যাপটপটা এনে ঝুঁকে পড়ে কাজ করতে বসলো।জিকোর হাতেও মোবাইল। বউমা মিমিও মোবাইলে মন দিয়েছে।
অমিয়বাবু বিরক্ত হলেন- এই এখনকার এক নতুন জীবন হয়েছে…মোবাইল, ল্যাপটপ ছাড়া একমুহূর্ত এদের চলে না।সবসময় চোখের সামনে যন্ত্র ঝুলিয়ে রেখেছে।মুখ তুলে একটু কথা বলতেও সময়ের অভাব।আজকাল তো জিকোর লেখাপড়া, পাপু, মিমির অফিসের কাজ… সবই ঘরে বসে এই যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে।
এই যন্ত্র যেন যন্ত্রণা অমিয়বাবু আর মীনাদেবীর কাছে। ওনারা এসব শিখতেও চান না। কতবার ছেলেমেয়েরা বাবা-মাকে স্মার্টফোন কিনে দিতে চেয়েছে। কিন্তু ওনাদের সেই এককথা…আমাদের সাবেকী ফোনেই দিব্যি চলে যাচ্ছে… ওসব যন্ত্রণার দরকার নেই।
একদিন তো অমিয়বাবু রেগেমেগে বলেই ফেললেন- মোবাইলের নেশার মত খারাপ আর কোন নেশা নেই। তিনি মনে করেন এই সোশ্যাল মিডিয়াই সোশ্যাল দূরত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে। নিজের মানুষেরা দূরে চলে যাচ্ছে।পাশের মানুষের সাথে কথা বলার সময় নেই…সব সময় ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে অচেনা মানুষদের সাথে সময় কাটিয়ে দিচ্ছে এরা অথচ চেনা মানুষরা ক্রমশ অচেনা হয়ে যাচ্ছে। কথা বলার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। কেউ এখন ফোন করে জিজ্ঞেস করে না… কেমন আছো তুমি?
অমিয়বাবু আর মীনাদেবীর আজকাল বড় একা লাগে। ছেলেমেয়েরা দূরে দূরে…বছরে একবার আসে তারা…তাও মাঝেসাঝে বাদ যায়। সবাই যে কতদিন একসাথে হয়নি। তাও পাপুটা কাছে আছে বলে রক্ষে। একটু সন্তানের মুখটা তো দেখতে পাচ্ছেন। নাতি জিকোকে স্নেহের ছোঁয়া ছুঁতে তো পারছেন!
অমিয়বাবু এবার জোরে বলে উঠলেন-আমাদের শুধুশুধু সেজেগুজে বসিয়ে রাখার মানেটা কি? তোমরা কি করবে জিকোবাবু??
মিমি বললো- আসলে বাবা, সবাই নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে তো… তাই উত্তর দিচ্ছি।তোমরা একটু ধৈর্য্য ধরো…এক্ষুণি ভূতের রাজার বরের জোরে হাততালি দিলেই তোমরা চলে যাবে তোমার বড়মেয়ে, জামাই আর তিতলির কাছে সিঙ্গাপুরে।
একথাটা বলতে না বলতেই স্ক্রীন জুড়ে বড়মেয়ে ঝিমলিকে দেখতে পেলেন অমিয়বাবু আর মীনাদেবী। মেয়ের পিছনে জামাই বাবাজীবন উঁকি দিচ্ছে। আর ওই তো পেছনে তিতলি হাত নাড়ছে আর বলছে “শুভ নববর্ষ” দাদান। সবাই হাতজোড় করে প্রণাম করছে ওদের।
চোখ গোল হয়ে গেলো জিকোর দাদুভাই আর ঠাম্মির। এরপরই ল্যাপটপের স্ক্রিনে দেখা গেলো মুম্বাই থেকে বড়ছেলে অপু, বৌমা আর রিকোকে, শিলিগুড়ি থেকে ছোটমেয়ে ইমলি, জামাই আর নাতনী রিমলিকে।
সব্বাইকে একসাথে দেখে অমিয়বাবু আর মীনাদেবীর চোখ খুশীতে চকচক করছে।কত্তদিন পর একসাথে সব্বাইকে দেখতে পারছেন। কথা বলতে পারছেন।
অমিয়বাবু বললেন- তোদের মনে আছে ১লা বৈশাখের দিন তোদের মা কতরকম রান্না করতেন। কত আনন্দ হতো।একসাথে সবাই মিলে হৈ হৈ করে বছরের প্রথম দিনটা কী মজাতেই না কাটতো। আজ ভারচুয়ালি তোরা সবাই এলি আমাদের ঘরে কিন্তু তোদেরতো কিছু খাওয়াতে পারছি না।
ঝিমলি আর ইমলি একসাথে বলে উঠলো “আমরা তো আজ ভালোমন্দ খাবই কিন্তু এখন আড্ডা, গল্প, গান তো হোক।
এইভাবেই নববর্ষের সকালটা নবহর্ষে কেটে গেলো…এক নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হলো সবার মন। বিশেষত অমিয়বাবু আর মীনাদেবীর অশক্ত মনে ভালোবাসার পরশ দিয়ে গেলো তার ছেলেমেয়েরা। ছেলেমেয়ে, বৌমা, নাতি-নাতনীদের গিটার, গান, আবৃত্তি, নাচ, গল্প, আড্ডার শেষে ইমলি বললো-বাবা, মা এবারে তোমরা দু’জনে একসাথে একটা গান করো…কী সুন্দর গাইতে তোমরা!
সবাই একসাথে সায় দিলো। অগত্যা ওরা দু’জন দীর্ঘদিনের অনভ্যস্ত গলায়… একসাথে গাইলেন… “এইতো হেথায় কুঞ্জছায়ায়…স্বপ্ন মধুর মোহে…এইজীবনের যে কটি দিন পাবো…তোমায় আমায় হেসে খেলে কাটিয়ে যাব দোঁহে….স্বপ্ন মধুর মোহে…….”
এরপর দুপুরের লাঞ্চ…মোবাইলে অনলাইনে অর্ডার করে বিখ্যাত দোকান “ভোজ” থেকে খাবার আনানো হলো।
সাদা ভাত, শুক্তো, মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল, ঝুরি আলুভাজা, পটলের দোলমা, মোচার ঘন্ট, চিংড়ীর মালাইকারী, মাটন কসা, দই, মিষ্টি…
পরিতৃপ্তি করে খেয়ে দাদুভাই জিকোর কানে কানে চুপি চুপি বললেন… তোদের এই যন্ত্রপাতিগুলো মানে মোবাইল, ল্যাপটপ… এগুলো কিন্তু বেশ কাজের জিনিষ।
একগাল হেসে জিকো বললো দাদুভাই আজ ভুতের রাজার দেওয়া তিন বরের… এক নম্বর… যা চাই খেতে, পরতে পারলাম। ভূতের রাজার দুই নম্বর বরে গান, বাজনাও ভালোই হলো। আর তিন নম্বর… এই হাতে ছোঁয়া দিয়ে যেখানে খুশী যাওয়াও গেলো… দেখলে তো এক নিমেষে কলকাতা, মুম্বাই, শিলিগুড়ি, সিঙ্গাপুর কেমন জুড়ে গেলো!
তাহলে বলো– “ভূতের রাজার জয়”।
-
গল্প- মাথা গরম
মাথা গরম
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়মহুয়ার বিয়ে হয় এক ব্যবসায়ী পরিবারে। পরিবারের ছোট বৌ সে। ওর বর ধীমানের আলাদা ব্যাবসা। ধীমানের বড় দাদা বিমান পারিবারিক ব্যাবসাই দেখাশুনা করে।
মহুয়ার শাশুড়ী চুপচাপ মানুষ…শ্বশুর একসময় না’কি খুব রাগী ছিলেন। তবে বয়সের ভারে এখন আর সেই রাগ নেই…চুপচাপই থাকেন এখন… তবে শাশুড়ীমা এখনো ওনাকে বেশ ভয়ই পান।এখনো রান্নায় একটু এদিক ওদিক হলে খাবেন না…শাশুড়ীমাকে কোথাও যেতে দেবেন না। এসব আগের মতই আছে। আর রাগের দায়ভার এখন বর্তেছে দুই বউ -এর উপর… কারণ তারাই এখন সংসার সামলাচ্ছে। একটু ত্রুটি বিচ্যুতি ঘটলেই উষ্মা প্রকাশ করেন তিনি। বৌরাও তটস্থ থাকে সবসময়।
মহুয়া শ্বশুরবাড়িতে এসেই বুঝলো এটা রাগের বাড়ি… বাড়ির ছেলেদের রাগ যেন নাকের ডগায়। আর সেটা বাড়ির দুই ছেলে যে উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছে তা বুঝতে একটুও বাকী নেই ওর। বাড়ির পুরুষেরা বোধহয় ভাবে –রাগ দেখানোটাই পুরুষত্বের লক্ষণ! বৌদের প্রথম থেকেই রাগ প্রকাশ করে ভয় দেখিয়ে রাখলে তারা আর বাড়তে পারবে না…অর্থাৎ ওদের কন্ট্রোলে থাকবে। বড়বৌয়ের উপর এ পরীক্ষা করে ভালোই ফল মিলেছে। এবার ছোট বৌ-এর পালা। কিন্তু এরা তো জানে না ছোটবৌ বাঘা তেঁতুল!
বিয়ের পর বরকে ফেরার পথে শাড়ীর দুটো ম্যাচিং ব্লাউস এনে দিতে বলেছিলো মহুয়া। ব্লাউস এনে প্যাকেটটা মহুয়ার হাতে দিতে ও সেটাকে বাইরেই রাখলো…পরে আলমারীতে তুলে রাখবে ভেবে। তারপর নানা কাজে ভুলে যায়। দু’দিন ওটা বাইরে পরে আছে দেখেই… ধীমানের মাথা গরম! এত কষ্ট করে বউয়ের জন্য কিনে এনেছে আর সে কী’না সেটা অবহেলায় বাইরে ফেলে রেখেছে! ক্রোধে চিৎকার করে উঠে মহুয়াকে বললো- দাও, ওগুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে নর্দমায় ফেলে দেবো। অতর্কিত এই চিৎকারে নতুন বউ মহুয়া একটু অবাকই হয়… প্রথমটায় থতমত খেলেও পরে মুখে একটা কথাও না বলে, গটগটিয়ে হেঁটে গিয়ে ব্লাউসের প্যাকেটটা বরের হাতে দিয়ে বলে- “নাও ছেঁড়ো। তোমার কষ্টের টাকায় কেনা… তুমি ছিঁড়বে না তো কে ছিঁড়বে?” ধীমান অবাক চোখে বৌয়ের দিকে তাকালো। ওর চিৎকার যে বউয়ের মনে একটুও ভয় জাগাতে পারলো না… এটা দেখে একটু যেন বিমর্ষই হলো। রাগের ভাব দেখিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
এমনই বারবার হতে থাকলো… মুখে কথা বলে না কিন্তু কাজে করে দেখায়… এক তুড়িতে রাগের ভয় উড়িয়ে দেয়।
বর ভাসুর একবার বড় জায়ের উপর রাগ করে চালের ড্রাম থেকে চাল নর্দমায় ঢেলে দিলো। বড় জা চোখে জল নিয়ে পরিষ্কার করতে যেতেই মহুয়া বাধা দিলো- বললো দিদি, ওনাদের পয়সায় কেনা চাল নর্দমায় ওনারাই ঢালছেন…পরিষ্কার ওনারাই করবেন। তুমি কোরো না। আর আজ ভালোই হলো ভাত রান্না করতে হবে না… সবাই উপোস দিক…চলো তুমি আর আমি সিনেমা দেখে বাইরে খেয়ে ফিরবো। হিসেবমত রাগ দেখিয়ে বাড়ির ছেলেরাই বাইরে খায় আর ঘরের বউরা উপোস দিয়ে চোখের জল ফেলে। এ যেন এক উল্টো পুরাণ!! পরে নর্দমা ভাসুরকেই পরিষ্কার করতে হয়েছিলো। মহুয়া বড়জাকে হেসে বলেছিলো- দেখলে, যেমন কর্ম তেমনি ফল।বড়জা মৃদুলা বলেছিলো- চুপ কর, চুপ কর।
সেদিন কী একটা কথায় উত্তেজিত হয়ে নিজের ভাতশুদ্ধ খাবার থালা ছুঁড়ে মারলো ধীমান… ভাত ডাল মাছ সব টেবিলে, মাটিতে ছড়িয়ে একাকার! বাকী যারা খাচ্ছিলো তাদেরও খাওয়া প্রায় পন্ড। এবারও বেশ জোরের সাথে প্রতিবাদ করলো মহুয়া বললো- অন্যের খাওয়া নষ্ট করার অধিকার কে দিয়েছে? ভদ্রতা জানা নেই? নিজে না খেলে উঠে চলে গেলেই তো হয়! এই নোংরা আমি পরিষ্কার করবো না… কেউ করবে না…এরকমই থাকবে অসভ্যতার প্রমাণ হিসেবে।
শাশুড়ী বললেন- তোমাকে কি বাড়ির লোক কিছুই শেখায়নি…বাড়ির ছেলেদের বাইরে কত কাজের চাপে মাথা গরম থাকে…তাদের খাওয়ার সময় উত্তেজিত না করলেই তো হয়।
এবারে মহুয়া আরো রেগে গিয়ে বলে-আপনাদের এই প্রশ্রয়েই তো আজ এই অবস্থা! সভ্যতা ভদ্রতা শেখাতে পারেননি। ওরা বাইরে খাটছে আর আমরাও তো ঘরে উদয়াস্ত খেটে চলেছি।
পরেরদিন কাজে যাবার আগে খেতে গিয়ে ধীমান দেখলো টেবিল সেরকমই নোংরা পরে আছে…মনে মনে লজ্জিত হলো সে৷ ওকে দাঁড় করিয়ে রেখে ওর সামনেই মহুয়া সব শুকিয়ে যাওয়া এঁটোকাঁটা পরিষ্কার করলো…ওর সাথে হাত লাগালো ধীমান… যতই হোক নিজের বিয়ে করা সুন্দরী বউ। বেশী রেগে থাকলে নিজেরই ক্ষতি। হাত লাগিয়ে বুঝলো কাজটা সহজ নয়।
এভাবেই শিক্ষা!
ধীমান বোঝে অত অল্পেতে মাথাগরম করা.. রাগ দেখানো ঠিক নয়। বরং ক্ষণিকের রাগকে কীভাবে প্রশমিত করা যায় সেটাই শেখার। আজকাল ইউটিউবে নানা ভিডিওতে এসবই শেখায়। আসলে ক্রোধও ষড়রিপুর এক রিপু। আর রাগের বশে মানুষ সেকেন্ডের মধ্যে কত খারাপ কাজ করে বসে। রাগ হলে সেইজায়গা থেকে চলে যেতে হয়…একশ থেকে উল্টো দিকে গুনতে হয়… জোরে জোরে শ্বাস নিতে হয় ছাড়তে হয়…প্রাণায়াম করতে হয়…এমনকি ডাক্তার অবধি দেখাতে হয়!! ও মনে মনে ঠিক করে আজ থেকেই নিজেকে শুধরোবে।
শাশুড়ীমা মহুয়াকে বলেন- তোমার পুলিশ হওয়া উচিত ছিলো।
মহুয়া বলে- আমার মামা পুলিশ… শ্বশুড়বাড়ির কারুর বেচাল দেখলেই কেস দিয়ে দেবো।
সবাই হাসে ওর কথায়।ও গম্ভীরমুখে বলে- মোটেই হাসির কথা বলিনি, এখন কিন্তু বাড়ির বৌদের জন্য আইন শক্তিশালী। তাই সবাই সাবধান, নয়তো অত্যাচারের কেসে জেলের ঘানি টানতে হবে- ভাসুর,শ্বশুর,বর, শাশুড়ী সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বেশ জোরে জোরেই কথাগুলো বলে মহুয়া।
-
গল্প- মিষ্টি গুজব
মিষ্টি গুজব
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়জগু মিত্র রোডে ঢুকেই বাম পাশের সরু গলিটার শুরুতেই মাধবের মিষ্টির দোকান “সত্যনারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার”। দোকানটা অনেক পুরোনো। মাধবের বাপ-ঠাকুরদার আমলের। এখন তো মাধবেরও বয়স হয়ে গেছে। ঠিকমত দেখাশুনো করতে পারে না।চাকরীর বাজার খুবই খারাপ। তাই মাধবের ছেলে লেখাপড়া শিখেও মিষ্টির দোকান চালায়। যদিও ওর খুব ইচ্ছে ছিলো চাকরী করে। কিন্তু সে ইচ্ছেয় বালি।
পাড়ায় এই একটামাত্র মিষ্টির দোকান ছিলো আগে। আর চারদিকে পুরোনো একতলা দোতলা বাড়ি ছিলো সব। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই পাল্টে গেলো সবকিছু। ছোট বাড়িগুলো ভেঙে মস্ত ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরী হচ্ছে।আর তাদের একতলায় কত রকমের দোকান! তার মধ্যে যে মিষ্টির দোকানগুলো তৈরী হয়েছে সব ঝাঁ চকচকে। সুন্দর ডেকরেশন করা কাঁচের শোকেসে নানারকম নতুন ধরণের মিষ্টি। আর লোকে ওইসব দোকানেই ভিড় বাড়াচ্ছে।
টাকার অভাবে মাধবের দোকান যে তিমিরে সেই তিমিরেই। সেই আদ্যিকালের অন্ধকার দোকান, তার উপর গলির মধ্যে… কারো নজরেও পড়ে না। পাড়ার ফ্ল্যাটবাড়ির লোকজনও সব নতুন আর আধুনিক। এই পুরোনো দোকানে তাদের ভক্তি নেই। তবে একটা সময় খুব রমরমা ছিলো মাধবের ব্যবসার। তখন প্রতিযোগিতা কম ছিলো।পাড়ায় এত দোকান ছিলো না। আর মাধবের হাতের রসগোল্লা আর দই, সন্দেশের খুব খ্যাতি ছিলো। বিয়ে বাড়ি, শ্রাদ্ধবাড়ি, উপনয়ন সবেতেই মাধব অর্ডার পেতো। কিন্তু এখন সেদিন আর নেই। এখন মাছি তাড়ায় ওর ছেলে সাধন।
সেদিন বন্ধুদের আড্ডায় সাধন দুঃখ করছিলো। এই মূল্যবৃদ্ধির বাজারে সংসার চালানোই মুশকিল। সেখানে দোকান সাজানোর কল্পনা করাই বৃথা। আর লোন নিতেও ভরসা হয় না। সব শুনে ওর বন্ধু সুনীল বললো-“দাঁড়া,একটা বুদ্ধি বার করি।”
বন্ধুমহলে সুনীলের বুদ্ধির কদর আছে…শুধু বুদ্ধি নয়, ওর মাথায় দুষ্টবুদ্ধি কিলবিল করে!
যেমন ভাবা তেমন কাজ। পাড়ায় পাড়ায় রটে যেতে দেরী হলো না যে সত্যনারায়ণের দই খুব লাকি। ওই দই খেয়ে বা ফোঁটা লাগিয়ে পরীক্ষা, চাকরী, প্রমোশন এমনকি বিয়ে সব তড়তড়িয়ে উৎরে যাওয়া যায়। ভাগ্যবিশ্বাসী পাঁচ আঙুলে স্টোনের আঙটি পরা মানুষ যে এসবে বিশ্বাস করবে তা বলাইবাহুল্য। আর আরো একটা কথা রটলো। মাধবের দোকানের রসগোল্লাও অমৃত। যা খেলে পেটের রোগ সারবেই, অব্যর্থ।
ব্যস পাড়ায় পাড়ায় এই বার্তাটি রটে গেলো ক্রমে। একেই বলে গুজবের বিজ্ঞাপন। গুজব পাখনা মেলে উড়তে লাগলো! মাধবের দোকানের দই মিষ্টির কদর বাড়লো…বিক্রিও বাড়লো উত্তরোত্তর। মাধবের বুদ্ধিতে কারিগরেরা আরো সুস্বাদু মিষ্টি বানাতে লাগলো। দোকানটা সবার নজরে এলো।সবাই জানলো…মিষ্টির সুখ্যাতি হলো।এতদিন যারা পাশ কাটিয়ে চলে যেত তারাও দই কিনলে মাধবের থেকেই কেনে। দই-এর কল্যাণে কা’র ভাগ্য খুলেছে জানা নেই তবে খারাপ কারো হয়নি!
মাধব আর ওর ছেলে সাধন এবার টাকা পেয়ে দোকানটা সাজাতে শুরু করে। আর সাধনের বন্ধুরা আবদার করে মিষ্টি খাওয়ার জন্য। তাই আগামী পয়লা বৈশাখ ওদের সবার নেমতন্ন সত্যনারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডারে।তাই মধুরেণসমাপয়েৎ। আর গুজব! এমন গুজব কিন্তু ভীষণ মিষ্টি।
-
গল্প- খুশী পরিবার
খুশী পরিবার
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়যৌথ পরিবার তো এখন বড় একটা দেখা যায় না। তবে প্রদীপদের পরিবারটা বড় পরিবারের তকমা লাগিয়ে রেখেছিলো অনেকদিন।
এখন নতুন প্রজন্মে ছেলেপিলেদের বিয়ে হচ্ছে… তারা একটু আধুনিক ভাবে হাতপা ছড়িয়ে থাকতে চায়…তাই ঘর চাই… তারপর ভালো চাকরীর সন্ধানে বাইরে যাওয়া চাই। আর করবেটাই’বা কি? ভালো পড়াশুনো করে তো আর যা হোক কিছু কাজ করা যায় না! বড়দার ছোটছেলে বাইরে চাকরী করে… আর বড়ছেলের বিয়ে হয়েছে…এবাড়িতেই থাকে। মেজদার এক মেয়ে আর এক ছেলে… দুজনেই বাইরে পড়তে গেছে। প্রদীপের দুই মেয়ে ছোট…পড়াশুনো করে।বোনেদের বিয়ে হয়ে গেছে সব ভালো পরিবারে। তারা সবাই ভালোই আছে।
বাড়ির সবাই মিলে একদিন ঠিক করলো… এই বিশাল পুরোনো বাড়ি মেরামত করা অনেক ঝামেলার…আর এই আগেকার স্টাইলের বাড়িতে বারান্দা, উঠোন এইসব করে জায়গার অপচয়। তাই বাড়ি সারানোর থেকে এবাড়ি ভেঙে নতুন প্ল্যানে বাড়ি করা হোক। প্রোমোটারের তৈরী ফ্ল্যাট ওরা চায় না। শুধু তিনতলা বাড়িটা আবার নতুন করে বানাতে চায়। এক একটা তলা মর্ডান প্ল্যান মাফিক বানাবে। তাতে বড় ডাইনিং কাম ড্রয়িংরুম… বড় বড় তিনটে করে বেডরুম, মর্ডান বাথরুম, কিচেন সবই হবে। টাকার অভাব ওদের নেই। নিজেরা চাকরী করে। এখন তো পরের প্রজন্মও দাঁড়িয়ে গেছে। আর ওরাও এই পুরোনো বালি ঝুরঝুরে, স্যাঁতসেঁতে আদ্যিকালের বাড়িতে থাকতে চায় না।
ভালো আর্কিটেক্টকে দিয়ে প্ল্যান বানিয়ে কন্ট্রাকে মিস্ত্রী লাগিয়ে বাড়ি বানানো শুরু হলো। নিজেরাও ওরা দেখাশুনো করলো। অবশেষে তিনতলা এক বিশাল বাড়ি তৈরীও হলো। তিনভাই নিজেদের সুবিধামত এক এক তলা নিলো। যদিও প্রত্যেকের আলাদা আলাদা সংসার। তাও সবাই মিলে কাছাকাছি থাকা। অনুষ্ঠান, পার্বণে পাঁচফোড়নের মত মিলেমিশে আনন্দ-খুশী উপভোগ করা।
বাড়ি তো বানানো হলো। কিন্তু গৃহপ্রবেশ তো করা চাই। এই অতিমারীর প্রবাহে.. অসুখ-বিসুখের কারণে বাইরের লোক ডাকা যাবে না। শুধু পরিবারের সবাই মানে ভাইরা, বোনেরা মিলিত হবে আর নিষ্ঠাভরে পুজোটা করে একটু খাওয়াদাওয়া। সত্যনারায়ণ পুজো সকাল সকালই হয়ে গেলো। এবার ভোজনের আয়োজন।
রান্নার জন্য বাজার ওরাই করে দিয়েছিলো। রান্না করতে এলো ওদের বহুদিনের চেনা এক উড়ে ঠাকুর আর তার জোগারে। এই রাধুনের হাতের রান্না না’কি অসাধারণ। উনুন ধরিয়ে বিশাল কড়াই বসিয়ে রান্না শুরু করলো রান্নার ঠাকুর।
খানিকবাদে খবর এলো উড়ে ঠাকুর গামছা পড়ে একবার যাচ্ছে…আর একবার আসছে….। তার যাওয়া আর আসার চক্করে রান্না মাথায় উঠলো। তাকে পেটখারাপের ওষুধ দিয়ে একটা ঘরে শুইয়ে রাখা হলো। পরে একটু সুস্থ হলে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো।
অগত্যা বাড়ির মহিলা আর পুরুষেরা রান্নায় হাত লাগালো। সে এক এলাহী ব্যাপার! বাড়ির দুই ছোটমেয়ে রিনি আর ঝিনি তো হেসে অস্থির… তারা দেখে তাদের দুই জ্যেঠু ভাত, ডাল, মাছ রান্না করছে। বিশাল কড়াই নামাচ্ছে। ওদের বাবাও চাটনী, তরকারি রাঁধছে!
রোজ তো বাড়ির মেয়েরাই রাঁধে। আজ তাদের ছুটি তারা শুধু বলে বলে দিচ্ছে।
তারপর খাওয়াদাওয়া, হৈ চৈ… মজা, ইয়ার্কি, একে অপরের পিছনে লাগা… ভাই, বোন, ভাইপো, বোনপো, ভাগ্নে-ভাগ্নী ফোঁড়নের সব উপকরণ মজুত। এর নামই “প রি বা র” বড় পরিবার, খুশী পরিবার।