-
অণু কবিতা- মান-অভিমান
মান-অভিমান
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়তুমি মুখ ফেরালেই
অভিমানী মন।
ফিরে দেখবার
কী’বা প্রয়োজন?মন কান্নায় ভিজুক,
হোক কিছু জল অপচয়।
জীবনে জীবন জড়ালে,
এমনই তো হয়!!কিছু কালো মেঘ
ছড়িয়ে পড়বে জানি।
কিছু ঝরাফুল,
খালি ফুলদানি।তবু কিছু মান-অভিমান
কারণে অকারণেই।
জানি মিঠে রোদ্দুর এনে দিতে
লাগে সেই তোমাকেই।। -
অণু কবিতা- আঙুল তুললে
আঙুল তুললে
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়আঙুল তুললে-
আউট হয়ে,
প্যাভিলিয়নে ফিরতে হবে।আঙুল তুললে –
সাজানো ঘর,
তাসের ঘরের মত ভাঙবে।আঙুল তুললে –
জানি তুমি টলবে তখন,
ওই আসনে।আঙুল তুললে –
জানি তুমি পাঠিয়ে দেবে,
নির্বাসনে।আঙুল তুললে –
রক্তচক্ষু… বলবে তখন
মিথ্যেবাদী।আঙুল না তুলেই –
তাই রইলাম সব
নির্বিবাদী। -
কবিতা- কোহিনুর
কোহিনূর
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়পাহাড়ী পথের বাঁকে,
নীল কুয়াশার দল ঘন হয়ে এল।
ঢেকে দিলো কত সম্পর্কের দাগ।
শিশিরের জলকুচি মেখে আবছায়া মুখ।
হিমেল বাতাসে অবশ মন।
হঠাৎই মখমলি রোদ্দুর এসে
সরিয়ে দিলো কুয়াশা।
আবার স্পষ্ট সবকিছু।
কত সাদা মেঘ ফিরে গেলো নীল আকাশে।
দূরে বনপাহাড়ের কোল ঘেঁষে,
উড়ে গেলো এক হলুদ পাখি।
সাথে উড়িয়ে নিলো আমার পরিযায়ী মনকে।
ভালোবাসার ওম পেতে,
ভালোবাসার কাঁটায়,
ভালোবাসার রঙে,
বাহারী নকশা বুনে চলে মন।
পান্না সবুজ তিস্তার বাঁকে,
তখন স্মৃতি রঙ আঁকে।
দূরে মায়াবী আলোয়,
বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখা
কোহিনূর লক্ষ দ্যুতি ছড়ায়।
হালকা মন কেমন শূন্য শূন্য লাগে।
কিছুই চাওয়ার নেই, কিছুই চাইতে নেই জেনেও
দুই হাত বাড়িয়ে দিই।
বনবীথিকায় ছাওয়া পথ ধরে,
হেঁটে চলি একজন্ম থেকে পরজন্মে।। -
কবিতা- উপলব্ধি
উপলব্ধি
– তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়বর্তমান তো দমবন্ধ কালো অন্ধকারে বন্দী।
ভবিষ্যৎ কালের গর্ভে, আলো নেই কোনো-
শুধু মৃত্যুর প্রতীক্ষা, আশাহীন।
অতীতও শুধু রেখে গেছে কিছু স্মৃতি।
কালের নিয়মে স্মৃতিরও বয়স বাড়ে,
হয়তো’বা মুছে যায় কিছু।যেতে যেতে বেদনা কুড়িয়ে যাই।
কিছু মুখ ভালোবাসাহীন, ঈর্ষায় নীল।
যেতে যেতে যদি কিছু ভালোবাসা, আলো আসে কুড়োবো দ্বিধায়।
বোকা আজও আমি প্রেম খুঁজি প্রেমিকের চোখের পাতায়।
উজানের ঢেউ দূরে চলে যায়,
পা আটকায় বালির চড়ায়।আরো কিছুদিন কমে আসে।
ছোট হয়ে যায় আয়ুর রেখা।
মুঠো ভরা স্বপ্নরা তবু থেকে যায় সাথে,
আর থাকে পিছুটান।কিছু স্মৃতি হয় অমলিন।
কিছু ক্ষত সুগভীর।
আজ শুধু জানি পাওয়াটা কঠিন,
হারানো সহজ…খুঁজে পাওয়া নয়।। -
কবিতা- নতুনের ডাক
নতুনের ডাক
– তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়যা কিছু পুরোনো তারই মাঝে শুনি নতুনের কোলাহল।
ডাক দিয়ে যায় নতুন সূর্য সোনালী আলোয় সোনার ধানে।
নানা রঙে সাজে অসীম আকাশ,
আসমানী নীল,গোধূলিতে রাঙা–
সাদা মেঘ ভাসে।
চিলের ডানায় সন্ধ্যা ঘনালে গভীর কালো সে।
ঝিকিমিকি চাঁদ খেলা করে ওই কালো দীঘি জলে।
পুরোন পৃথিবী নতুন প্রেমের গল্প বলে।কালো মেঘে ছাওয়া বৃষ্টির ধারা খেলা করে মাঠে,
চমকিয়ে যায় বিদ্যুৎ রেখা।
বৃষ্টিতে ভেজে প্রেমিকযুগল,
পুরাতন প্রেম বয়ে চলে নতুনের মাঝে…চিরনতুনের ডাক দেয়।মায়ের কোলে ছোট্ট শিশুটি,
ওর চোখে আজ সবই তো নতুন।
নতুন দিনের আলো ওর চোখের তারায় আঁকে বিস্ময়।বাধা না’মানা নবীন কিশোর ছুটে চলে ওই খুঁজতে আকাশ।
আকাশের মত সুনীল গভীর মন হয়ে থাক চিরনতুন।সময় তো থেমে থাকেনি কখনো।
সময় তো থেমে থাকেনা।
আগামীর বুকে শুনি শুধু নতুনের পদধ্বনি।
নতুন বাঁচুক– ওদের চোখেই রেখে যাব সব সোনালী স্বপ্ন।
সেই সব স্বপ্নেরা শিশিরের জলকুচি মেখে এঁকে দেবে এক-
বিভেদহীন, সুস্থ, স্বচ্ছ, সুন্দর, ভালোবাসাময় পৃথিবীর মুখ।। -
গল্প- শুভ বিবাহ
শুভ বিবাহ
– তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন একটা মেয়েকে খুব ভালো লাগতো অংশুমানের। কিন্তু সে মেয়ে তাকে বিশেষ পাত্তা দিতো না। আর দেবেই বা কেন? অংশুমান নিতান্তই গোবেচারা, ভালোমানুষ টাইপের। আজকাল মেয়েরা আবার একটু হ্যান্ডু কায়দাবাজ ছেলে পছন্দ করে। সে যাক গে। মনের দুঃখ মনেই চেপে মন দিয়ে পড়াশুনোটাই করেছে অংশু আর তারপর বেশ ভালো একটা চাকরী পেতেও অসুবিধা হয়নি ওর। তবে আর কোনো মেয়ের দিকে ফিরেও চায়নি কখনো।
সেই অংশুমানের বিয়ে। বাড়ির পরিজনের উপরেই দায়িত্ব বর্তেছে পাত্রী পছন্দ করার।অংশুর একটাই দাবী পাত্রী যেন পড়াশুনোয় একটু ভালো হয়।
পুরোদমে পাত্রী দেখা চলছে। যদিও খুব বেশী বাছাবাছি অংশুর পছন্দ নয়। আর পাত্রী দেখতেও ও যায় না। এসব ব্যাপারে বাড়ির গুরুজনের উপরেই নির্ভর করে আছে ও।
ফাইনালি দু’টি মেয়েকে সিলেক্ট করেছে ওরা।এদের মধ্য থেকে একজনকে বেছে নিতে হবে।তাই অংশুকে যেতে হয়েছে এবার।
একজন শ্রীতমা — শ্যামবর্ণা, সুন্দর মুখশ্রী, অপূর্ব চোখদু’টি-কেমন ভাসাভাসা। ওই চোখেই একবার চোখ পড়লো অংশুর। তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলো সে।
আরেকজন অপর্ণা। বেশ অবস্থাপন্ন পরিবারের একমাত্র মেয়ে। ফর্সা, সুন্দরী, বেশ লক্ষ্মী লক্ষ্মী দেখতে।
দু’টি মেয়েই গুণী, লেখাপড়ায় ভালো কিন্তু রঙের বিচারে অপর্ণাকেই পছন্দ করলো অংশুর পরিবার। তারা বললো লক্ষ্মী আসুক ঘরে।
কিন্তু অংশুর মন আটকে রয়েছে সেই কাজল কালো চোখে। বোনকে চুপিচুপি পছন্দের কথা বলেওছে। কিন্তু বাড়ির গুরুজনেরা তো বেশী অভিজ্ঞ। আর তাছাড়া অংশুর কথায় তারা পাত্তা দিতেও রাজী নয়। ঠাম্মা তো বলেই বসলো মেয়ে ফর্সা হলে কাচ্চাবাচ্চারাও ফুটফুটে হবে। এসব শুনে সে মুখ ফুটে আর কিছু বলতে পারলো না লজ্জায়। আর বলবেই বা কেন? এতো আর প্রেমের বিয়ে নয়। অভিভাবকরা যেটা ভালো বুঝবে সেটাই করবে।
আর তাছাড়া অংশুর দাদা প্রেম করে বিয়ে করেছে আর সেই বড়বৌকে বাড়ির কারোর পছন্দ না। সে মেয়ে না’কি বাড়ির কারো সাথে মানিয়ে চলতেই পারে না। নানা অশান্তির পর দাদা আলাদাই থাকে। অবশ্য অংশুর বৌদির সাথে ভালোই ভাব আছে। বৌদি চাকরী করে, স্বাধীনচেতা। তাই সব ব্যাপারেই নিজস্ব মতামত আছে তার। পুরোনো ধ্যানধারণায় আটকে থাকা মানুষজন সে’সব মানবে কেন?
এমতাবস্থায় বাড়ির ছোটবউকে নিজেরাই পছন্দ করে আনুক…এই ভাবনা থেকেই অংশু চুপ থাকে। অংশু নিজে সবার সাথে খুব এডজাস্ট করে চলতে পারে কারণ ও উদার প্রকৃতির। তাই ও ভাবে বাড়ির সবাই যদি বউকে পছন্দ করে তা’হলে ওর কোন অসুবিধা নেই। আর তাছাড়া খারাপ কিছু হলেও কেউ অন্তত ওকে দোষারোপ করতে পারবে না।
বিয়ের তোড়জোড় শুরু হ’লো জোরকদমে।বিয়েবাড়ি ভাড়া, বিয়ের কেনাকাটা, কার্ড ছাপানো, নেমন্তন্ন সব শেষ। এখন শুধু বিয়ের দিনের অপেক্ষা।
কাল অংশুর বিয়ে। নিকট আত্মীয়স্বজনরা এসে পড়েছেন।
একেবারে হৈহৈ ব্যাপার। বাড়ির ছোটছেলের বিয়েতে বাড়িটাও আলোয় আলোয় সেজে উঠেছে। খাওয়াদাওয়া, সাজগোজ নিয়ে সবাই ব্যস্ত। হাসি-মজা আনন্দের হাট বসে গেছে।হঠাৎ একটা ফোন এলো–বিয়ের কনে কা’র সাথে পালিয়ে গেছে। সবাই হতভম্ব। অংশুর বাবার মাথায় হাত। মা কেঁদে চলেছেন। বাকীরা সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত। নিমেষে বিয়েবাড়ির চেহারা পাল্টে গেলো।
শুধু অংশু ফুট কাটলো- লক্ষ্মী পালালো!অংশুমানের বাবা দীপনবাবু বিয়ে ভেঙে গেছে এটা সবাইকে ফোনে জানিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু এইপ্রথম অংশু বাধা দিলো। এত লোকজন, বন্ধুবান্ধব, অফিস কলিগ সবার সামনে ছোট হবে না সে। সে কালকেই শ্রীতমাকে বিয়ে করবে।
অগত্যা অংশুর ইচ্ছেয় আগের বাতিল করা পাত্রীর সাথেই যোগাযোগ করা হলো।
তারাও এত সুপাত্র হাতছাড়া করতে চাইলেন না। কিন্তু বেঁকে বসলো পাত্রী শ্রীতমা। তাকে বোঝাতে ছুটতে হলো অংশুকেই। তারপর দুজনে একান্তে কী কথা হ’লো কে জানে!! অবশেষে রাজী হলো সেই কৃষ্ণকাজল মেয়ে।দীপনবাবুও মেয়ের বাবা প্রতাপবাবুকে বুঝিয়ে বললেন- “আপনাদের কোন অসুবিধা হবে না।কাল শুধু মেয়েকে নিয়ে আমার আত্মীয়ের বাড়ীতে চলে যাবেন। আমরাই সব ব্যবস্থা করে নেবো। কুলদেবতা আর মাকালীর আশীর্বাদে সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। চিন্তা করবেন না। আর একমাস বাদে একটা দিন দেখে রেজিস্ট্রিটা করিয়ে নেবো। তখন আপনাদের লোকজনদের সব নিমন্ত্রণ করে দেবেন। আর কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবেন–ছেলের ঠাকুমার বয়স হয়েছে অসুস্থ, তাই তাড়াতাড়ি বিয়েটা দিতে চাইছেন ওরা। ব্যস তা’হলে সবদিক সামলিয়ে যাবে। আমি আবার দেখি ওইদিকে কীভাবে ম্যানেজ দেওয়া যায়।”
দুপক্ষের কথার শেষে বাড়ি ফিরে আসে ওরা।
অবশেষে নির্ধারিত শুভদিনে শুভবিবাহ সুসম্পন্ন হলো।
ফুলশয্যার রাত। বর-কনে মুখোমুখি।“অগত্যা বাধ্য হয়েই এই কালো মেয়ের গলায় মালা দিতে হলো তা’হলে?” বললো শ্রীতমা।
“মোটেই না। এটা আমার ইচ্ছের জোর। আমি চেয়েছিলাম তাই কালো নয় আলো জ্বললো আমার ঘরে ” বলে মৃদু হাসলো অংশু।
“বাহ দারুণ তো! তা এই ইচ্ছের জোরে তুমি আর কি কি করতে পারো মশাই?”
“তুমি আমার কথা রেখেছো। আমার সম্মান বাঁচিয়েছো। কৃতজ্ঞতা জানাবো না…কাছের বন্ধুকে শুধু আজ একটা কথা চুপিচুপি বলি– তোমায় যেদিন দেখেছি সেদিনই ভালো লেগেছে…আমার সারাজীবন ধরে তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসবো আর তোমায় যোগ্য মর্যাদা দেবো।
আর এখন থেকে দেখতে থাকো প্রিয়া, তুমি পাশে থাকলে আমি কি কি করতে পারি” বলে হেসে শ্রীতমার হাতদুটো মুঠোয় নিলো অংশু। -
কবিতা- অপেক্ষায় এক জীবন
অপেক্ষায় এক জীবন
– তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়সব অনুভূতি দেখানো যায় না।
যেমন সব ভালোবাসা গুছিয়ে বলা হয়ে ওঠে না।
ভালোবাসা আছে বলেই তো তোমাকে খুঁজি।
ভালোবাসা আছে বলেই তো তোমার কথা ভাবি।
ভালোবাসা আছে বলেই তো তোমার অনুভবের সঙ্গী হই।
ভালোবাসা আছে বলেই তো তোমার অপেক্ষায় কেটে যায় অনন্ত সময়।
এই ভালোবাসার কোনো শর্ত নেই–কোন প্রত্যাশা নেই।
শুধু ভালোবেসে আনন্দ আছে।
অপেক্ষার বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে পথ হাঁটি।
কখন যেন এই ভালোবাসাটাই আমার সঙ্গী হয়,
আমার সাথে পথ হাঁটে।
আর আমি তখন মনে মনে বলি,
পৃথিবীর সবটুকু ভালোবাসা তোমার হোক।
তুমি যদি এখন তোমাকে ভুলে যেতে বলো!
সে’ও কী সম্ভব!
ভুলে যাও বললেই কী ভুলে যাওয়া যায়?
এই যে এত ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড, দিন, বছর ধরে তোমাকে ভালোবাসলাম,
তোমার অপেক্ষায় থাকলাম,
হয়তো তার থেকেও অনেক অনেক বেশী সময় লাগবে তোমাকে ভুলতে।
কিন্তু এত সময় কি আমার হাতে আছে?
তারচেয়ে এই ভালো-
তোমার অপেক্ষায় কাটিয়ে দেবো এই একটা জীবন। -
গল্প- বড় শুভ দিন
বড় শুভ দিন
– তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়এখনো পায়ের জোর পুরোপুরি পায়না…হাঁটতে
একটু অসুবিধাই হয় প্রতীকের। গতবছরেও দিব্যি ছিলো কিন্তু বড়দিনে বন্ধুদের সঙ্গে হুল্লোড় করতে গিয়েই তো যত অঘটন।গতবছর বড়দিনে বন্ধুদের সঙ্গে পার্টি করবে বলে মায়ের কাছে পঁচিশ হাজার টাকার বায়না করেছিলো ও।মা বাবাকে জানান কিন্তু বাবা ওই টাকা দিতে রাজী হন’না।বলেন–“খাওয়াদাওয়া আনন্দ করতে এত টাকা কিসে লাগে?টাকা অনেক কষ্ট করে উপার্জন করতে হয়।”
এই নিয়ে সংসারে অশান্তিও কম হয়নি!কিন্তু শেষে সন্তানের স্নেহের কাছে হার মেনেছিলো মা।
যদিও নীরা বা জয়দেব কেউই চাননা তাদের সন্তানেরা বৈভবের মধ্যে মানুষ হোক।জয়দেববাবু এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। কিন্তু একটা সময় দারিদ্র্যের সাথে অনেক সংগ্রাম করেই বড় হয়েছেন তিনি। আজ স্বচ্ছল কিন্তু অতীতের কথা ভোলেননি ।তাই নিজে খুব সাধারণ ভাবেই জীবন কাটাতে ভালোবাসেন।তবে দরিদ্র হবার দুঃখ তিনি বোঝেন তাই গরীব-দুঃখীদের দিকে তাঁর হাত বাড়ানোই থাকে।সারাবছরই তিনি নানা সমাজসেবামূলক কাজে ব্যস্ত থাকেন।যদিও নিশ্চুপেই এসব কাজ করেন তিনি।তবে নীরাও এসব জানে আর স্বামীর এসব ভালো কাজে তার পুরো সমর্থন আছে।
ছেলেমেয়েকে ওরা ভালো স্কুলেই ভর্তি করেছেন।ছেলে প্রতীক দামী স্কুলে পড়ার সুবাদে সমাজের উচ্চবর্গীয় ছেলেমেয়েদের সংস্পর্শে এসে আধুনিক বিলাসিতার জীবন কিছুটা রপ্ত করে ফেলেছে।মাঝেমধ্যে মায়ের কাছ থেকে টাকাও আদায় করে সে।দু’দিন আগে জয়দেববাবু নিজে থেকেই পঁচিশ হাজার টাকা ধরিয়ে দেন প্রতীকের হাতে,বলেন–“নে খরচ কর দেখি!’
নীরা অবাক হয়।গতবছরের দুর্ঘটনার কথা ভেবে বুকটা কেঁপে ওঠে ওর।গতবছর এই বড়দিনেই তো প্রতীক আর ওর বন্ধুরা নেশাগ্রস্ত হয়ে গাড়ী এক্সিডেন্ট করেছিলো।নার্সিংহোমে দীর্ঘ চিকিৎসার পর আজ প্রতীক সুস্থ।সে এক দুঃসময়ের পর্ব।চীৎকার করে ওঠে নীরা—“ওর হাতে কেনো দিচ্ছো এতগুলো টাকা??”
জয়দেববাবু হাত দিয়ে থামিয়ে দেন নীরাকে আর বলেন– “শুধু টাকা নয়,একটা লম্বা লিস্ট ও দেবো ওকে।অনেককিছু কেনাকাটা করতে হবে। তুমিও যাবে ওর সাথে।”পরেরদিন প্রতীক,ওর বোন আর মা-সবাই মিলে অনেক কেনাকাটা করলো।তারপর বাড়ি ফিরে কেক,চকলেট,জামা,সোয়েটার,বই,খেলনা সব সুন্দর করে রঙিন প্যাকেটে সাজাতে বসলো।
পরেরদিন সব্বাইকে নিয়ে জয়দেববাবু গেলেন সেই আশ্রমে…যেখানে অনাথ বাচ্চা,পথশিশুদের ভিড়ে ওরা হারিয়ে গেলো। প্রতীককে সান্টাবুড়োর বেশে দারুণ মানিয়েছিলো!আর সান্টা যখন বাচ্চাদের হাতে উপহার তুলে দিচ্ছিলো,তখন বাচ্চাদের চোখ খুশীতে ঝলমল করছিলো…খুশী যেন উপচিয়ে পড়ছিলো ওদের মুখে।সান্তা প্রতীকের চোখেও জল চিকচিক করে উঠলো।
তারপর সবাই মিলে কচিকাঁচাদের সাথে মাংস, ভাত, মিষ্টি খেয়ে,খুব হৈ-হুল্লোড় করে বাড়ি ফিরলো ওরা।জয়দেব আর নীরাও খুব খুশী আজ।রাতে আজ কিছুতেই ঘুম আসছেনা প্রতীকের।মনের মধ্যে খুব কষ্ট হচ্ছে।খুব খারাপ লাগছে নিজেকে।নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে।সে এমন ছেলে যে এমন ভালো বাবাকেও কৃপণ ভেবে দোষারোপ করেছে।বড্ড লজ্জা লাগছে ওর।
ধীরে ধীরে দরজা খুলে বাইরে আসতেই দেখে বাবার লাইব্রেরী রুমে আলো জ্বলছে।তারমানে বাবা জেগে বই পড়ছেন।
ধীরে ধীরে ও দরজার ভারী পর্দা সরিয়ে বাবার সামনে গিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়ালো।বাবা মুখ তুলে নরম চোখে তাকালেন আর বললেন–” মনে রেখো,শুধু আত্মসুখের মধ্যে কোন মহত্ব নেই। বরং মানুষ হতে গেলে হৃদয়বান হতে হবে। তোমার যেমন সামর্থ্য তেমনভাবেই মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারো তুমি।শুধু নিজেরটুকু নিয়ে ভুলে থেকোনা।
আমার উচ্চশিক্ষার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু সংসারের অভাবের কাছে নতিস্বীকার করেছিলাম।ব্যবসাটাকে খেটেখুটে দাঁড় করিয়েছি খুব কষ্ট করে।তাই চাই তোমরা পড়াশুনো করে বড় হও…তোমাদের যেন কোন কষ্ট করতে না’ হয়।”“ক্ষমা করো বাবা।ওই ভুল আর হবেনা”
“আসলে আমাদেরই দোষ। ছেলেমেয়েদের আমরা আত্মসুখী, স্বার্থপর একটা মানুষ করে গড়ে তুলি। চারপাশের অভাব অভিযোগগুলো দেখতে দিইনা। শুধু বলি পড়াশুনো করে বড় হও।ভালো চাকরি করো,উপার্জনশীল হও।সফল হও।নিজেদের জীবন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য,বিলাস-ব্যসনে ভরিয়ে তোলো।ছেলেমেয়েরাও তাই শুধু নিজেদের ভালোবাসতে শেখে।পশুপাখীরাও তো খায়,ঘুমোয়। শুধু ভালো খাবো,ভালো পরবো,ভালো থাকবো –উন্নত মানুষ হিসাবে এই ভাবনার সার্থকতা কোথায়??
শুধু নিজেরটুকু নিয়ে ভুলে থেকোনা।আমি চাই তুমি নিজেকে মানুষ হিসাবে প্রমাণিত করো।”“মনে রাখবো বাবা । আমিও তোমার মত মানুষ হয়ে সবার পাশে থাকার চেষ্টা করবো”।।
-
কবিতা- কখনো না
কখনো না
– তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়অতীতকে ভুলে যেতে পারো তুমি অনায়াসে।
কিন্তু মনে রেখো, অতীত তোমাকে ভোলেনা
সবকিছু ফিরে ফিরে আসে তোমার জীবনে।
অতীত তোমাকে ভোলে না।সম্পর্কের শিকড় ভুলে যেতে পারো তুমি।
কিন্তু শিকড় তোমাকে ভোলে না।
বারেবারে টানে মাটির গভীরে।
শিকড় তোমাকে ভোলে না।সময়ের হিসেব করেছো কখনো?
বুঝেছো সময়ের দাম?
সময় শুধু দাগ রেখে যায়।
সময়তো কখনো ফেরে না।আর ভালোবাসা?
সে’তো হিসেব বিহীন।
ভালোবাসার ঋণ যায়না ফেরানো।
সে ঋণ তোমাকে ছাড়ে না। -
কবিতা- হে ঈশ্বর
হে ঈশ্বর
– তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়হে ঈশ্বর,
একটা খোলা আকাশই তো চেয়েছিলাম আর
চেয়েছিলাম তার নীচে নিশ্চিন্ত আশ্রয়।
এক থালা গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতই তো চেয়ে ছিলাম ঈশ্বর।
এক থালা সাদা ভাত।
জ্যোৎস্না মাখা একটা জীবন…বৃষ্টিমাখা শান্ত দিনই তো চেয়েছিলাম ঈশ্বর।আমিতো কাঙাল হতে চাইনি।
চাইনি গৃহহীন উদ্বাস্তু হতে।
চাইনি ভুখা পেটে হাত পাততে।
আমি তো ধর্ম চাইনি, চাইনি হানাহানি, অনিশ্চয়তা।
আমি তো রক্তাক্ত হতে চাইনি, চাইনি আগুন দেখতে।হে ঈশ্বর,
তুমি কি নিরন্ন মানুষের চোখের জল মোছাবে না?
ঘোচাবে না তার অভাব,দারিদ্র?
তোমার কাছে কিছুই কি চাওয়ার নেই আমাদের?
খুব কী অন্যায় হ’বে যদি তোমার কাছে চাই–
প্রতিদিনের কাজের নিশ্চয়তা।
প্রতিদিনের পুষ্টিকর খাবারের আশ্বাস।
মাথার উপর ছাদ।
শিক্ষার,স্বাস্থ্যের, সুচিকিৎসার নির্ভরতা।
শ্বাস নেওয়ার বিশুদ্ধ বাতাস আর প্রাণভরা শান্তি।
তুমি দেবে না ঈশ্বর?