-
ঝরে যায়
ঝরে যায়
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়ঝরে যায়…ঝরে যায়।
ঝরে পড়ে ফুল, পাতা,চাঁদের আলোক।
ঝরে যায় পাখীর পালক।
বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে মেঘ ঝরে।
গান থেকে সুর ঝরে।
শব্দেরা কথা হয়, ঝরে পড়ে কবিতায়।
মন থেকে স্মৃতি ঝরে,
প্রতিদিন একটু একটু করে।
ঝরে যায় বিশ্বাস।
ঘৃণা হয়,ঘৃণা হয়।মুঠোভরা আনন্দ ঝরে পড়ে চেতনায়।
চক্ষের জল ঝরে বিষাদের আঙিনায়।
সময় ও তো ঝরে যায়।
সময়ের হাত ধরে ঝরে যায়,
জীবনের এই বেলা।
সোনাঝরা দিনগুলো ডেকে যায়।
ঝরে পড়া সুখগুলো স্মৃতি হয়।
স্মৃতি হয়…স্মৃতি হয়।ঝরে যাওয়া ব্যথাগুলো ছুঁয়ে থাকে মনে।
ভালোবাসা কাঁদে হাসে বুকের গহনে।
তারপর একদিন যাবার সময় হলে,
নীরবে, কিছু না ব’লে,
দেহ থেকে প্রাণটাও ঝরে যায়।
ঝরে যায়…ঝরে যায়।। -
প্রথম আলাপ
প্রথম আলাপ
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়আমারই মনের রঙে এঁকেছি তোমায়–প্রথম আলাপে।
আমার অপেক্ষার পাত্র ভরে উঠেছিলো- শুধু একপলক তোমাকে দেখে।
তারপরে শুধুই পূর্ণতা।
কখন যেন ভালোবাসা গোলাপ হল।
তার মিষ্টি গন্ধ পেলেই বুঝতাম তুমি এসেছো।
যখন ফাগুন হাওয়া গান গাইত।
যখন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙে সেজে উঠত।
তখনই তোমার আবীর রাঙা মনকে ছুঁতে পারতাম।
তোমার হাত ধরে হেঁটে যেতাম, দূরে-বহুদূরে।
কোন কথা বলতেনা তুমি-আমিও না।
শুধু নীরবতা অনেক কথা বলে যেতো।
পশ্চিম আকাশে মায়াবী গোধূলি আলো হেসে বলে যেতো…যাচ্ছিইই।
সেই মায়াবী স্তব্ধতা থেকে ফিরে আসতাম স্বপ্নের ডানায়।
দু’চোখের প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠত আলো–ভালোবাসার আলো।
আর আমরা ভেসে যেতাম বসন্তের উতল প্রেমিক হাওয়ায়।। -
আজও বেঁচে আছে
আজও বেঁচে আছে
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়আজও বেঁচে আছে ঘাসের আগায় শিশিরবিন্দু কণা।
আজও মেলে দেয় আকাশের বুকে হলুদ পাখির ডানা।আজও বেঁচে আছে রূপালী আলোর নরম লাজুক চাঁদ।
আজও তো লুকিয়ে পাহাড়ের বুকে গভীর গোপন খাদ।আজও বেঁচে আছে লাল টুকটুকে গোলাপের কুঁড়িদল।
আজও উড়ে যায় নীলচে ডানায় প্রজাপতি চঞ্চল।আজও বেঁচে আছে দিনযাপনের খুনসুটি ভরা সুখ।
আজও সুর তোলে উষ্ণতা ভরা জীবনের হাসিমুখ।আজও বেঁচে আছে গোধূলিতে রাঙা জীবনের বিশ্বাস।
আজও প্রাণজুড়ে ভালোবাসা ভরা তোর-আমার নিশ্বাস।আজও বেঁচে আছে রাগরাগিণীর মিলে যাওয়া যত সুর।
আজও ছুটে চলে রঙিন এ মন দূর থেকে বহুদূর।সবকিছু নিয়ে বেঁচে থাকা আর বাঁচানোতে বড় সুখ।
রোদ্দুরে মাখা,বৃষ্টিতে ভেজা, জীবনের চেনা মুখ। -
অঙ্ক ক্লাসে
অঙ্ক ক্লাসে
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়কোচিং ঘরের অঙ্ক ক্লাসে,
সেই মেয়েটা পড়তে আসে।তার হাসিতে মুক্ত ঝরে।
সে কিন্তু অঙ্ক করে।আমার হিসেব ভুল হয়ে যায়।
শূন্য ভরি খাতার পাতায়।মাঝেমাঝে চকিত তাকায়।
চোখে প্রেমের ঢেউ খেলে যায়।অঙ্ক ছেড়ে স্বপ্ন দেখি।
তার ছবিটাই স্বপ্নে আঁকি।অঙ্ক কি আর এতই সোজা?
তোর মনটাও কঠিন বোঝা !একটু ফিরে তাকাস যদি,কি আর ক্ষতি?
মনে ভিতর ডানা মেলে রঙবেরঙের প্রজাপতি।একদিন সে এগিয়ে আসে,
আমায় দেখে মুচকি হাসে।তাই না দেখে, “ঢিপ ঢিপ ঢিপ” বুকের ভিতর।
মনের মধ্যে দুরন্ত এক বৈশাখী ঝড়।চোখের দিকে সোজা চেয়ে,
কঠিন স্বরে বললো সে মেয়ে —“তাকিয়ে থেকে লাভ কি হবে?
পরীক্ষাতে গোল্লা পাবে।
কেরিয়ারটা আগেই গড়ো।
তারপর নয় প্রেমটা করো।। -
ঋতুর রঙ্গ
ঋতুর রঙ্গ
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়হেথায় দেখ শীত যে আসে,
ভীষণ কেঁপেকেঁপে।
বর্ষা দেখ বৃষ্টি নিয়ে,
আসে কেমন ঝেঁপে।গ্রীষ্মে কেমন দখিন হাওয়া,
মন জুড়িয়ে যায়।
বসন্তে ওই কোকিল ডাকে,
মন আকুলি হায়!হেমন্তে ওই রোদের কণা
সোনার ধানে পড়ে।
সর্ষে ক্ষেতে হলুদ-সবুজ
রঙগুলো সব ধরে!শরতে,কাশফুলের ওই পথটি
দিয়ে মাদুর্গা আসে।
মনে তখন আঁকিবুঁকি,
খুশীর ছবি ভাসে।এমন সোনার পৃথিবীতে,
বাঁচতে কে’না চায়?
বারেবারেই ফিরতে হবে,
মাটির আঙিনায়।। -
অমানুষ
অমানুষ
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়এখনও অনেকটা পথ চলতে হবে তোমায়-
পথে পড়বে- হিংসার উপত্যকা,
অবিশ্বাসের পাহাড়,
মিথ্যের ঝর্ণা।
প্রলোভনের সমুদ্র,
অবহেলা,অসম্মানের নদী।তোমাকে হতে হবে ধনী,স্বার্থপর, অমানুষ।
ভোগবাদই হবে তোমার জীবনের একমাত্র পথ।
যা অতি সহজেই ভুলিয়ে দেবে,তোমার মানবতাকে।
তুমি হয়ে উঠবে কাণ্ডজ্ঞানহীন,
নিষ্ঠুর এক অমানুষ।
আর এই পৃথিবীটা হবে —
লালসার পৃথিবী,
ভোগের পৃথিবী,
বঞ্চণার পৃথিবী,
খুন-ধর্ষণের পৃথিবী।। -
মায়ের মন
মায়ের মন
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়বান্টি ফোন ধরেই বললো–বাবাই,আমরা পুজোয় কলকাতা যাচ্ছি…তুমি যাবে তো?
—না,রে সোনা,ছুটি নেই… পরেরবার ঠিক যাবো।
—আমি আর দুষ্টুমি করবো না।তুমি তাহলে তাড়াতাড়ি আসবে তো??
—তোর দুষ্টুমি আমার ভালোই লাগে সোনা। কাজের খুব চাপ।এরা ছাড়লেই দৌড়ে চলে যাব তোর কাছে।
পাশের ঘর থেকে রিয়া শুনছে…বান্টি তার বাবাই-এর সাথে কত্ত গল্প,আবদার,খুনসুটিতে মেতেছে।আর্য রোজ ভিডিও কল কোরে ছেলের সাথে একঘন্টা বকবক করবেই।প্রায় একবছর হয়ে গেলো ও বদলী নিয়ে বেঙ্গালুরু থেকে দিল্লীতে চলে গেছে।
কেমন আছে?কি করছে?কি খাচ্ছে?আমার কথা ভাবে?
দূর যা পারে করুক।আমার থেকে এত্ত ভালোবাসা নিয়ে এখন তা অন্যকে বিলোচ্ছে…আর এই আর্যই ওকে একদিন না দেখে থাকতেই পারতো না…রিয়ার দু’চোখ জলে ভরে উঠলো।ঠাকুরদালানে সবাই বসে… আড্ডা,গান,গল্প,মজা,হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে।সবাই এসেছে…শুধু ছোটজামাই আর্য আসেনি বলে নীলাদেবীর মনটা খারাপ…আর্য একাই হুল্লোড়ে বাড়ি মাতিয়ে রাখে ।
বান্টিকে বললেন—কি’রে বাবাকে আনলি না?
—বাবা তো দিল্লীতে।
—-কবে গেছে?
—ওই যে বড়দিনে সান্তাই তো বাবার হাত দিয়ে টেডিবিয়ারটা পাঠালো…ওটাকে জড়িয়েই তো আমি রোজ ঘুমোই।নীলাদেবী মনে মনে ভাবলেন—দশমাস!! কই আর্য বা রিয়া তো তাকে একথা জানায়নি।মনে একটু খটকা লাগলো।
ঘুমোবার আগে রিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন—জানিস,সংসারে অনেক কুকথা, মন্দ ব্যবহার,অভাব অভিযোগ সামলে তোদের বড় করেছি।মানিয়ে নিয়েছি ভালোমন্দের সাথে,সংসারকে আঁকড়ে থেকেছি…ছেড়ে যাইনি কখনো।সংসারের ঝড়ঝাপটা সামলেও ভালো থাকার চেষ্টা করেছি শুধু তোদের হাসিমুখগুলো দেখবো বলেই।আর ভালোবাসলে সব পারা যায় রে।
—-তুমিই আমার দুগ্গামা…তুমি সব বোঝো… তাইতো তোমার কাছে এলে বড় শান্তি পাই মা।
পুজো কাটলো।আজ দশমী।”মা” এর বিদায়। ‘দুগ্গামা” সবাইকে ভালো রেখো সারাটাবছর।
রাতে আর্য বিজয়াদশমীর প্রণাম জানিয়ে ফোন করলো শ্বশুড়-শাশুড়িমাকে।
শাশুড়িমা অনুযোগ করলেন—এবার তুমি এলেনা বলে পুজোবাড়ি অন্ধকার।এরপরের বার কিন্তু সবার আগে তোমার আসা চাই।
—হ্যাঁ মা নিশ্চয়ই।রিয়া বোঝে এটাই মায়ের ভালোবাসার টান।আর এই টানেই আর্য ঠিক ফোন করেছে।
আর্যের বন্ধুত্ব,আর্যের ভালোবাসা সবসময় রিয়াকে ঘিরে থাকে।ওই যে রিয়ার একমাত্র friend, philosopher & guide….
রিয়া ভাবে–
মা হয়ে বান্টির হাসিমুখ দেখার জন্য একটু মানাতে পারবেনা?পারবেনা এই একবারের ভুলটাকে শুধরে দিতে??খানিকবাদেই আর্যের মেসেজ
“তুমি আর বান্টি আমার সবটুকু ভালোবাসা নিও।আমাকে বাদ দিয়ে পুজো তা’হলে ভালোই কাটালে বলো??”অনেকদিন বাদে রিয়া আজ রিপ্লাই দিলো—-“ভালো থেকো।আর পারলে সত্যি ভালোবেসো।”
-
মহাকালের ডাক
মহাকালের ডাক
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়সকলেই পাবে সেই অমোঘ ফতোয়া-
চলে যেতে হবে।
সব আনন্দ, বেদনা, উল্লাস, হাসি,গান,প্রেম,বিচ্ছেদ,ঈর্ষা ও প্রতিশোধ-
হাহাকার করে দেওয়ালে দেওয়ালে।
শুধু পড়ে থাকে একমুঠো ধুলো আর স্মৃতির পাহাড়।
মনে জমে থাকা ক্ষোভ-রাগ- বিদ্বেষ… ভালোবাসা হয়ে গেছে আজ।
অন্ধকারগুলো আলো হয়ে গেছে – জীবনের সুখে।
এতদিন ধরে যা কিছু পেলাম,
কত রঙরস, আনন্দগান,
জীবনের প্রতিটি ক্ষণ,
বয়ে চলেছে এই ধমণীতে।
আজ আর কোন চাওয়া নেই ।
সব চাওয়া পাওয়া হলো আজ।
সব ঘাত-প্রতিঘাত, তাপ-উত্তাপ শুষে নিয়ে এগিয়ে চলেছি কালস্রোতের টানে।
একদিন জীবনের সাঁকো পার হয়ে গিয়ে অমর হবো…
তোমাদের হৃদয়ে হৃদয়ে…ফিনিক্স পাখির মতো। -
ছায়াময়
ছায়াময়
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়সকল সময় সঙ্গে চলো।
ছায়া হলেও বন্ধু ভালো।আনন্দ আর দুঃখে আমি তোমায় পাই।
তোমায় নিয়েই একসঙ্গে এগিয়ে যাই।তোমার সঙ্গে চলতে চলতে,
কতরকম গল্প বলি।
বন্ধুছায়া তোমার সাথেই
আমার যত গলাগলি।কিন্তু যখন ঘুটঘুটে ওই অন্ধকারে,
তোমায় খুঁজে পাইনা।
নিকষ কালো,ভয় দেখিয়ে একা করে,
একটুও তা চাই না।। -
ভালোই আছে
ভালোই আছে
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়যে গেছে সে গেছেই
চলে অনেকদূরে।
হয়ত সে আজ ভালোই আছেঅচিনপুরে।
হয়ত সে আজ করছে খেলা
মেঘের সাথে।
হয়ত সে আজ দীপ জ্বেলেছেনিশুত রাতে।
হয়ত সে আজ গল্প করে চাঁদের সাথে
তারার দেশে।
সেথায় বাতাস পারিজাতের
গন্ধে মেশে।জ্যোৎস্না মেখে যায় গেয়ে গান
মধুর সুরে।
যে গেছে সে ভালোই আছে
অচিনপুরে ।