• কবিতা

    কবিতা- সুন্দরবন

    সুন্দরবন
    -তাপসী শতপথী পাহাড়ী

     


    স্বপ্নের আবিল দৃষ্টিতে তুমি অনন্যা,
    হে পরমা সুন্দরী!
    অঙ্গে অঙ্গে তব কত আয়োজন,
    কত সৌন্দর্য প্রসারী।
    আপন স্বাতন্ত্রে মগ্ন হে তন্বী কিন্নরী!
    হে বৃক্ষ সুন্দরী!

    তবু মানচিত্রে দেখি মানব পরখে,
    তোমার অস্তিত্ব শুধু একটি বৃক্ষকে ঘিরে!
    করুন সৌন্দর্যে গাথা তোমার জীবনী,
    প্রতিক্ষনে সংগ্রামের জ্বলন্ত কাহিনী।

    আজো নিশ্চুপ নিরালায় সৌন্দর্যের ফাঁকে ফাঁকে,
    তুমি জানো না, প্রতিদিন কত হায়নারা ওৎ পেতে থাকে!
    কত শ্বাপদেরা আগ্রাসী অপেক্ষায়,
    কত বিষাক্ত হুলের দংশনে
    মহুলিরা তীব্র যন্ত্রনায় কাতরায়।

    সংকীর্ণতার গলি পথ বেয়ে তবু চলে জীবনতা,
    স্যাঁত স্যাঁতে জল কাদা মেখে!
    নোনা হয়ে যায় আত্মা , প্রতিদিন –

    রাত ভোর রক্তাক্ত সংগ্রামগুলো দেখে!
    ঝড় আসে,ঝঞ্ঝা আসে বারবার বন্যার কবলে,
    হা-হা-কার কতবার প্রকৃতির অমোঘ ছোবলে!

    তবু ও তোমার গল্প নিবিড় অরণ্যে রয় ঢেকে,
    জানতে চায় না কেউ তোমার রোদন।
    শুধু সুন্দরীর তকমাএঁটে হয় তো বা চিরদিন
    থেকে যাবে মানচিত্রে হে সুন্দর বন!

  • কবিতা

    কবিতা- পদ্ম পাতায় স্বপ্ন

    পদ্ম পাতায় স্বপ্ন
    -তাপসী শতপথী পাহাড়ী

     


    স্বপ্ন আমার পদ্ম পাতায়
    টলমল শুধু করে।
    এই আছে তো এই বুঝিবা
    জলের উপর পড়ে।
    রাখতে গিয়ে সেথায় তারে
    কাটল সারা রাত।
    পদ্ম পাতা আর দুটো দিন
    বাঁচিয়ে তারে রাখ।
    পড়লে জলে হারিয়ে যাবে,
    আর পাবো না আমি।
    হাতড়ে বৃথা সাঁতার দেবো
    গভীর জলে জানি।
    জলপরিকে বলব ডেকে
    হাঁপিয়ে ওঠে শেষে,
    হারিয়ে গেল স্বপ্ন আমার
    তোমার দেশে এসে।
    কোথায় পাবো তারে আমি,
    হারিয়ে যাওয়া স্বাদ।
    পদ্ম পাতায় স্বপ্ন আমার,
    হল যে বরবাদ।

  • গল্প

    গল্প- ভোরের স্বপ্ন

    ভোরের স্বপ্ন
    – তাপসী শতপথী পাহাড়ী

     

     

    প্রত্যেকের মধ্যে একটা স্বপ্নের জগৎ থাকে। সেই স্বপ্নকে সে ছোটো বেলা থেকেই লালন করে। আজ খোয়াইও তার স্বপ্ন পূরনে পা বাড়িয়েছে। আজ তার কলেজের প্রথম দিন। বহুদিনের অপেক্ষার পর সেই স্বপ্ন পূরনের সুযোগ এসেছে। সে যখন ছোটো ছিল কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করতো বড় হলে সে কী হতে চায়, সে সপ্রভিত উত্তর দিত- ‘দিদিমনি হবো’। এইভাবে ছোটো থেকেই দিদিমনি
    হওয়ার প্রতি একটা অদ্ভুত টান জন্মেছিল তার। এমনকি সে তার খেলার পুতুলগুলোকে ছাত্র বানিয়ে পড়াতে বসে যেত লাঠি নিয়ে। প্রত্যেকটা পুতুলকে এক একটা মিষ্টির নামে ডেকে বলতো,
    -এই যে মন্ডা অ আ পড়। এই যে দানা নামতা কর। কচুরি তুই ছড়া বল। এইভাবে সারাদিন পুতুলগুলোর পড়াশুনো নিয়ে ব্যস্ত থাকতো সে। আজ দেখতে দেখতে সে খোয়াই কত বড় হয়ে গেল কিন্তু এখনো ও সেই স্বপ্নকে ছাড়েনি। চার বোনের মধ্যে সে-ই ছিল বেশি মেধাবী কিন্তু যখন তার বয়স আঠারো, একটু উঁচু ক্লাসে পড়তে যাবে তখনই তার বাবা মারা যান। তাই পড়াটা তখন তার জীবনে একটা বিলাসিতা হয়ে ওঠে। পরিবারের পক্ষ থেকে নানা বাধা আসে তার পড়ার পথে। এমন কি কলেজে তার ভর্তির ব্যাপারটাও আটকে যায় অর্থের অভাবে। সেদিন সে প্রচুর কেঁদেছিল কিন্তু তার কান্না বদ্ধ ঘরটায় শুধু মাথা কুটে মরেছে, কেউ শোনেনি! সান্ত্বনা দিতে কেউই এগিয়ে আসে নি। তাই বাধ্য হয়েই নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছে, আরম্ভ করেছে টিউশন কিন্তু পরের বছর কিছু টাকা জমলে যখন ভর্তির কথা ভাবছে, তখন পড়লো কঠিন অসুখে। বন্ধু সন্দীপকে ডেকে বলল- যা না ফর্মটা পূরন করে দিয়েছি, একটু জমা করে দে।
    সেদিন সন্দীপ তার কথামতো ফর্ম জমা করতে গেলেও যখন লিস্ট বেরোয় তখন দেখে তার নাম বেরোয় নি। সে বুঝতে পারে সন্দীপই কিছু করে থাকবে না হলে তার চেয়ে কম নম্বর পাওয়া ছেলে মেয়েদের নাম আছে অথচ তার নেই! পরে জানতে পারে তার কথাই সত্যি, সে ফর্মটাই জমা দেয় নি কারণ তার বাস আসার সময় হয়ে যাচ্ছিল তো। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে কে আর ফর্ম জমা দেয়! তাই সে তার অন্য এক বন্ধুকে জমা দিতে বলে ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। সে বছর খোয়াই -এর আর কলেজে ভর্তি হওয়া হলো না! সেদিন খুব কষ্ট পেলো খোয়াই। সাহিত্য নিয়ে পড়ার সমস্ত স্বপ্ন তার ধূলোয় মিশে গেলো। এখন আবার পরের বছরের জন্য অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই কিন্তু তা করতে হলে অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু উপায়? হ্যাঁ, তাকে অন্য কলেজে সীট ফাঁকা আছে কিনা দেখতে হবে। তাই আর দেরি না করে সে অন্য কলেজের খোঁজ নিতে গেল কিন্তু কোথাও তেমন সুবিধে করতে পারলো না। অবশেষে যদিও একটা পেলো কিন্তু বাংলায় অনার্স আর হলো না যদিও কলেজের জি.এস বলেছে কয়েক দিনের মধ্যেই সীট ফাঁকা থাকলে ব্যবস্থা করে দেবে। সেই আশায় সে এখন বুক বেঁধে ক্লাসগুলো করছে। কারণ তাকে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করতেই হবে, সে লেখক হতে চায়, দিদিমনি হতে চায়। এই ভাবে সে কয়েকটা দিন অন্যান্য ক্লাসগুলো করতে থাকে, কিন্তু কিছুতেই যেন মন সায় দিচ্ছে না, যতক্ষন না অনার্স পায়। একদিকে অর্থের চিন্তা অন্য দিকে অনার্সের চিন্তা তাকে যেন অতিষ্ঠ করে তুলছে। তাই সে একদিন বাংলা ডিপার্টমেন্টের স্যারকে বলল- স্যার আমি অনার্সের ক্লাসগুলো করতে চাই, যদিও এই মুহূর্তে আমার অনার্স নেই, তবে পেয়ে যাবো স্যার, প্লিজ আপনি যদি এখন অনুমতি দেন আমি ক্লাসগুলো করতে পারি, না হলে অনেকটা পিছিয়ে যাবো! তার কাতর অনুরোধে সেদিন নিমাই স্যার তার ক্লাসের ব্যবস্থা করে দেন, খুব ভালো প্রফেসর ছিলেন উনি। ওনার কাছে টিউশন ও পড়ার সুযোগ পায় সে। সেযুগে এরকম প্রফেসর পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। সে যাই হোক অবশেষে অপেক্ষার পর স্বপ্ন পূরন হলো। অনার্স পেয়ে সে এখন রাত দিন পড়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। একদিকে টিউশন অন্যদিকে এতো পড়ার চাপ সব সামলাতে তাকে বেশ বেগ পেতে হলো। সারাদিন ক্লাস করার পর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে টিউশন করা আর যেন কিছুতেই শরীরে সইছিল না তাই সে ঠিক করল সপ্তাহে তিনদিন ক্লাস করবে। তাই করলো।অনার্সের ক্লাসগুলো করে কোনোমতে বাড়ি ফিরে আসে। একটি মাত্র বাস আর তা যদি না পায় তাহলে ভোগান্তির শেষ নেই, সেই সাত কি.মি. বাস স্ট‍্যান্ড থেকে হাঁটতে হবে। তাই অন্য ক্লাসগুলো অফ করেই তাকে ছুটে আসতে হয়। পরের দিন আবার ভোর বেলাতে ছুটতে হবে, নাহলে ঠিক সময়ে টিউশনে পৌঁছতে পারবে না। তাই খুব ভোরে উঠে একটা সাইকেল ধরে বাসস্ট‍্যান্ড যায়, টিউশন পড়ে, কলেজ করে তারপর বাড়ি ফেরে। এইভাবে সপ্তাহে তিনদিন রুটিনমাফিক ক্লাস করে। একে একে ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ার, থার্ড ইয়ার কাটিয়ে দিয়ে বেশ যোগ্যতার সাথে উত্তীর্ণ হয়। আজ কলেজের সব স্যাররা তার রেজাল্টে খুব খুশি। তাকে সম্বর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থাও হয়। কিন্তু তার গর্বের সেই চরম মুহূর্তগুলো সে কাছের কোনো মানুষের সাথে ভাগ করতে পারে না, কারণ তার রেজাল্টে বাড়ির লোক যতোটা না উচ্ছ্বসিত তার চেয়ে বেশি চিন্তিত। পড়ার চেয়েও মেয়েকে উপযুক্ত পাত্রে বিয়ে দেওয়াই ছিল মধ্যবিত্তের একমাত্র স্বপ্ন। তাই তার স্বপ্ন যে নিছক একটা বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয় তা তার পরিবার ভালোভাবেই বুঝিয়ে দেয়। মেয়ে হয়ে জন্মেছো অথচ বিয়ে না করে এরকম ধিঙ্গিপনা চলবে না- প্রতিবেশীর এ হেন কথাবার্তা শুনতে নারাজ পরিবার। তাই সময় থাকতে থাকতে বিয়ের ব্যবস্থায় নেমে পড়ে পরিবার। খোয়াই কিছুতেই রাজি হয় না। তাকে যে আরো পড়তে হবে। এম.এ, বি.এড, সাহিত্য নিয়ে চর্চা, হতে হবে দিদিমণি, হতে হবে সাহিত্যিক। এখন বিয়ে করলে কি করে হবে!এখন কিছুতেই সম্ভব না। এ কথা সে বাড়িতে জানিয়েও দিয়েছে, কিন্তু কে কার কথা শোনে। এ নিয়ে তুমুল অশান্তি শুরু হয়ে যায় মা, দাদা, দিদিরা তাকে চারদিক থেকে চেপে ধরে। খোয়াই হাজার চেষ্টা করেও তাদের বোঝাতে পারেনা। তার সব চেষ্টা জলে যায়। রাগে, দুঃখে, অভিমানে বেশ কয়েক দিন সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়, মনমরা হয়ে বসে থাকে। কিন্তু কোনো লাভ নেই। শেষ পর্যন্ত সে তার ভাগ্যের পরিণতিকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। পড়াশোনার সাথে সব সম্পর্ক চুকিয়ে এক অনির্দেশ্য পথের পথিক হতে হয় খোয়াইকে। জীবনের স্বপ্নকে খুইয়ে সে এখন রায় পরিবারের ব্যস্ত গৃহিনী। এক একটা স্বপ্নকে এক একটা কুঠুরিতে তালাবন্ধ রেখে আজ সে অনেক দূরে চলে এসেছে। আজ আর কোনো স্বপ্ন দেখতে সাহস পায় না সে। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থায় কি বা স্বপ্ন দেখবে সে। এখন তো তাকে সবাই চেনে সেলাই দিদিমনি হিসেবে। ভাগ্যের এই উপহাস কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারেনা খোয়াই। কিছু একটা করতে হবে, কিছু একটা উপায় কিন্তু কি! কি ভাবে! সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সে একটা উপায় বের করে। হ্যাঁ সে দিদিমনিই হবে, আবার পড়াতে হবে তাকে,করতে হবে টিউশন। সে আবার শুরু করে দেয়। দেখতে দেখতে তার ছাত্র সংখ্যাও বেশ বেড়ে যায়। কত বাচ্চারা আজ তার কাছে আসে,পড়ে। জীবনে প্রতিষ্ঠিত নাই বা হতে পারলো কিন্তু এতো বাচ্চার কাছ থেকে যে ভালোবাসা সে আজ পাচ্ছে সেটাই বা কম কিসে? সে প্রতিজ্ঞা করেছে সবাই কে নিজের মতো করে মানুষের মতো মানুষ করবে। হ্যাঁ সে যে আজ সবার দিদিমনি।…

  • অণু কবিতা

    অণু কবিতা- অযাচিত মন

    অযাচিত মন
    -তাপসী শতপথী পাহাড়ী

    আমার উদ্বাস্তু মন
    ছোটে শুধু তাহার সন্ধানে,
    যা অবিরত পীড়া দেয়
    সীমা মাঝে অসীম বন্ধনে।
    যত না কাঙ্খিত আমি
    তার চেয়ে বেশি অযাচিত।
    যত প্রাপ্য মোর সাথে
    তার চেয়ে বেশিই বঞ্চিত।
    তবু মোর সত্য চিরদিন,
    অবিচল নিষ্ঠা পথে
    বিশ্ব মাঝে আনিবে সুদিন।

  • গল্প

    গল্প- পেঁয়াজ বিভ্রাট

    পেঁয়াজ বিভ্রাট
    – তাপসী শতপথী পাহাড়ী

     

     

    হরেন বাবুর এ হেন আচরণে তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছে নিতাই। হবে নাই বা কেন, সে সামান্য সব্জী বিক্রেতা। প্রতিদিন হরেন বাবু একবার করে আসবেন আর পেঁয়াজগুলো টিপতে থাকবেন আর বলবেন,
    -এ পেঁয়াজ গুলো মোটেই ভালো নেই, ভেতরগুলো সব কালো। তা কত করে নিচ্ছ হে?
    প্রতিদিন একই উত্তর দিতে কার আর ভালো লাগে! তাই নিতাই বেশ বিরক্তির সুরেই বলল-আপনি কি জানেন না? প্রতিদিনই তো এসে একবার করে টিপে যান, কেজি একশো পঞ্চাশ।
    – কী বল হে! একি মাংস নিচ্ছি নাকি! দিনের পর দিন যে বাড়িয়েই দিচ্ছো। আবার কোনটা পচা, কোনটা কালো।
    -তা আপনাকে নিতে কে বলছে, যান না অন্যখানে, বউনির সময় যত্তসব ঝামেলা!
    -নেবো নেবো তাই নেবো। নেহাত তোমার কাছে সব দিন নি, না হলে কে ছুঁতো এই পচা পেঁয়াজ! বলে গজ্ গজ্ করতে করতে তিনি অন্য একটা সব্জী বিক্রেতার দিকে এগিয়ে যান। দেখতে পান পাসের বাড়ির যদুকে।
    – কি হে যদু বলি বাজার-টাজার হলো? তা কী কী নিলে? পেঁয়াজ-টেঁয়াজ কিনলে? যদু মাথা নেড়ে সায় দিল।
    -দেখি তো কেমন পেঁয়াজ। আমিও একটু কিনবো বলে খপ করে তার থলির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলেন।
    – বাঃ বাহ্ বেশ চকচকে তো! আহা হাত দিলেই ঝাঁজ পাওয়া যায়। দেখছো কি সুন্দর গায়ের রং!বলে বেশ কয়েকবার থলের মধ্যে থাকা পেঁয়াজগুলো যেন চটকাতে লাগলেন।
    কিন্তু হরেন বাবুর নিত্য দিনের এই বদ অভ্যাস তার আর ভালো লাগে না। একটু বিরক্ত হয়েই থলেটাকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যদু। নেহাৎ পাড়া প্রতিবেশী বলে মুখে কিছু বলা যায় না, তা বলে প্রতিদিন এভাবে হাত ঢুকিয়ে পেঁয়াজ টেপা কারই বা পছন্দ হয়! যদু যতটা পারে হেন তেন বলে এড়িয়ে যায়। হরেন বাবু ঠিক জানেন কোথায় ভালো পেঁয়াজ পাওয়া যায়। কিন্তু ওখানে যেতে তাঁর সাহস হয় না। কিছুদিন আগেই দরদাম নিয়ে বেশ কথা কাটাকাটি, তর্কাতর্কি হয়ে গেছে। এমন কি হাতাহাতির পর্যায়েও পৌঁছে যায়। হরেন বাবু হুমকি পর্যন্ত দেন তার নামে F.I.R করবেন। তাই সে মুখো হওয়ার আর উপায় নেই। অগত‍্যা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যান অতিপরিচিত বুড়ি সব্জীওয়ালির কাছে যে কিছু ছোটো ছোটো প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া পেঁয়াজ, কিছু ধসা আলু , লঙ্কা আর সামান্য কিছু পেঁয়াজকলি নিয়ে বসে আছে। হরেন বাবু দেখলেন যা করতে হবে এখানেই করা যাবে, একটু চেপে ধরলে বেশ কম দামেই পাওয়া যাবে পেঁয়াজটা।
    -কি বুড়িমা আজও ওই কয়টা পেঁয়াজ নিয়ে বসে আছো! আজ আবার পেঁয়াজ কলিও আছে দেখছি। বেশ ডাঁসা ডাঁসা। কিন্তু পেঁয়াজগুলো কবেকার?এ তো দেখছি পেঁয়াজের চেয়ে খোসাই বেশি! তা কত করে নিচ্ছো?
    -দাও না যা দিবে যেমন বাজার দর চলছে।

    হরেন বাবু বেশ উৎসাহিত হয়ে বললেন,- বেশ বেশ নাও পঞ্চাশ টাকা দরে দু’শো গ্রাম দাও।
    – না না তা হবে না। নব্বই টাকার নিচে হবে না। যাওনা দেখবে সবাই কেমন দেড়শো টাকা হাঁকাবে।
    – আরে, এ পেঁয়াজ কি সে পেঁয়াজ নাকি! রেখেছো তো কবেকার পচা, ধসা, শুকনো, যার খোসাই বেশি, দাও দাও হবে হবে বলে যেই না হরেন বাবু পেঁয়াজে হাত দিতে গেছেন বুড়ি খপ করে হাতটা ধরে ফেলেছে।-আরে রাখো রাখো হবে না।
    -আরে হবে হবে, দাও তো বলে দু’জনের মধ্যে পেঁয়াজ নিয়ে হূলুস্থূলু বেঁধে গেল। কিছুক্ষণ এ নিয়ে টানাটানি চলল। শেষ পর্যন্ত হরেন বাবুকে পরাস্ত হয়ে বলতে হলো- ইহ তিষ্ঠ ইহ তিষ্ঠ। অগত‍্যা পেঁয়াজের মায়াভুলে পেঁয়াজকলিতে হাত পড়ে তাঁর।
    – ঠিক আছে ঠিক আছে। তোমাকে পেঁয়াজ দিতে হবে না। পেঁয়াজ কলিই দাও । নাকি তাও একশো টাকা কেজি?
    বুড়ির পেঁয়াজকলির দাম কম শুনে দু’ আঁটি নিয়ে বাড়ি মুখো হলেন। আর না অনেক হয়েছে। সেদিনও এ পেঁয়াজ নিয়ে তাঁকে কম অপদস্ত হতে হয়নি! পাত্রের বাড়ি তাড়া দিচ্ছে বলে ঘটক এসে শুনিয়ে গেল কথা কিন্তু তারা কি বুঝবে মধ্যবিত্ত পিতার পেঁয়াজের কি জ্বালা! হরেন বাবুও প্রতিজ্ঞা করেছেন যতদিন না পেঁয়াজের দাম কমছে ততদিন মেয়ের বিয়ে দেবেন না। এককেজি মাংসে কতটা পেঁয়াজ লাগে তার হিসেবে যে খরচ হবে সে টাকাটা কে দেবে শুনি! তার উপর আজ আবার ঝামেলা পোয়াতে হলো। কার মুখ দেখে যে আজ উঠলাম? ঠিক ঠিক ওই প্রিয়ংবদা। আহা কি প্রিয় ভাষণ সর্বদা। গিয়েই তো আবার শুনতে হবে, সারা দিনের যত ঝামেলার রোশ এসে পড়লো পত্নী প্রিয়ংবদার উপর। তিনিও উন্মুখ ছিলেন বিস্তর দেরি দেখে। দুরন্ত বেগে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সেই বেগ এতো তীব্র ছিলো যে সারা ঘরময় সব্জী ছড়িয়ে পড়লো, কিছু ডাস্টবিনে গেল আর পেঁয়াজকলি দিয়ে মাছের চচ্চড়ি যখন পাতে পড়লো তখন বিকেল চারটে। একে তো সকালের হেনস্থা তার ওপর এতো ঝড় সব মিলিয়ে হরেন বাবুকে বেশ অগ্নিশর্মা করে তোলে। দু’জনের মধ্যে রাত পর্যন্ত বেশ তর্কাতর্কি, ঝগড়া, গিন্নির খাওয়া বন্ধ, দোর বন্ধ। অবশেষে শেষ আশ্রয় স্থল বাপের বাড়ি। এদিকে হরেন বাবুও বেশ কয়েকদিন রাগান্বিত হয়ে আর খোঁজ নিলেন না পত্নীর। কিন্তু খোঁজ তো নিতেই হবে, না হলে চলবে কি করে! চলবে চলবে করে তো এতো দিন চলে গেল, পেঁয়াজ ছাড়া চলতে পারে কিন্তু প্রিয়ংবদা ছাড়া অসম্ভব। তাই বাধ্য হয়েই পত্র লিখতে হয় তাঁকে-

    প্রাণেশ্বরী,
    প্রিয়ংবদা
    এতদিনে তোমার অত্যুচ্চ ক্রোধ, দম্ভ নিশ্চয়ই নির্বাপিত হইয়াছে। তুমি যত শীঘ্র সম্ভব স্বস্থানে ফিরিয়া আসিবার জন্য প্রস্তুত হও। সুখবর হইল যে এবারে বাজার হইতে তোমার রন্ধনের প্রয়োজনে একসাথে পাঁচ কেজি ঝাঁঝ যুক্ত রসালো পেঁয়াজ আনিয়াছি। তুমি শীঘ্র আসিয়া মহানন্দে রন্ধন কর।
    ইতি
    হতভাগ্য ,
    এই বলে পত্রখানি পত্নীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিলেন।

  • কবিতা

    কবিতা- শেষ স্তব্ধতা

    শেষ স্তব্ধতা
    – তাপসী শতপথী পাহাড়ী

     

    সমস্ত ব্যস্ততাকে কাটিয়ে
    একদিন ঠিক দাঁড়াবো
    তোমার মুখোমুখি বনলতা.
    তুমি শুধু নাটোরের তো নও!
    সমগ্র বিশ্বসত্ত্বা আলিঙ্গনাবদ্ধ
    হতে চায় তোমার সাথে।
    জীবনের সমস্ত বিড়ম্বনাকে তুচ্ছ করে
    এক নিগূঢ় প্রশান্তির হাতে‌।
    অমৃত কুম্ভের সন্ধানে সে যাত্রা-
    পড়ন্ত বেলায় সমস্ত স্তব্ধতায় তা মিশে যায়।
    তাই, ক্লান্তিহীন এক নিশ্ছিদ্র নিরালায়
    সমস্ত আত্মা তৃপ্ত হোক,
    এক সার্বজনীন বনলতায়।

  • কবিতা

    কবিতা- মানব সভ্যতা

    মানব সভ্যতা
    – তাপসী শতপথী

     

     

    অভ্যাসের স্বাভাবিকতা নষ্ট করে যখন দেখি-

    মাংসের দোকানে ভীড় করে মাছিদের চেয়ে বেশি মানুষের দল
    তবে তো নিশ্চিত এটা,
    একদিন,খাদ্য খাদকের সম্পর্ক হবে গোটা পৃথিবীটা.

    তারপর মহাভোজ শুরু হবে
    জীবনের গ্রীনরুমে, চারদিকে সুখাদ্যের স্তূপ,
    পাবলিক সীটে দেখি চকচকে চোখজোড়া,
    কুকুরের চেয়ে বেশি কাড়াকাড়ি করে আজ লোভীদের দল.
    তবে তো নিশ্চিত এটা,
    একদিন লুট হবে গোটা পৃথিবীটা.

    অভ্যাসের চোখ নষ্ট করে যখন দেখি

    জীবন্ত দেশটাতে জড়রাই বেশি কথা বলে,
    ওয়েবের ডটকমে,কিম্বা ইমেলে.
    তবে তো নিশ্চিত এটা,
    তীব্র গতি পেয়ে, যন্ত্র হবে একদিন গোটা পৃথিবীটা।

  • অণু কবিতা

    অণুকবিতা- সময় প্রবাহ

    সময় প্রবাহ
    – তাপসী শতপথী

     

     

    হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত আমি
    পারছি না আর চলতে,
    কত কথা সেই শুরু থেকে বলা
    পারছি না আর বলতে।
    বৃদ্ধ এ মন কুব্জ এ দেহে
    অনেকটা পথ হাঁটলাম।
    নীহারিকা থেকে ধ্রুবতারা হয়ে
    কত অজানাকে চিনলাম।
    অবশেষে আমি অবসর দেশে
    তোমাতেই পাই খোঁজ।
    প্রতিক্ষণ আসি ক্ষণেতে হারায়
    সময়ের স্রোতে রোজ।

  • কবিতা

    কবিতা- লাঠি

    লাঠি
    – তাপসী শতপথী

     

    অন্ধ সাথী আমার লাঠি আজকে তুমি নাই,
    হাতড়ে খুঁজে ফিরছি তোমায় কোথায় বলো পাই?
    শক্ত দেখে বাঁশটি কেটে যত্ন করে তোমায়,
    তেল মাখিয়ে পাকিয়েছিলাম ঝাঁঝাঁ রোদ বেলায়।
    শক্ত করে বেশটি ধরে সে দিন থেকে তুমি,
    সঙ্গে সঙ্গে ছিলে সদাই বন্ধু পেলাম আমি।
    আজ হারিয়ে কোথায় গেছো দুঃখে কিম্বা রাগে!
    অন্ধকে কি কষ্ট দিতে এতই ভালো লাগে?
    পাড়ার ছেলে ভয় করতো তুমি পাশে ছিলে,
    পিঠের উপর পড়তে তুমি আম পাড়তে গেলে।
    ভয়ে তখন কাঁপতো সবাই হাতে দেখে লাঠি,
    তরতরিয়ে যেতাম ছুটে হোক না শক্ত মাটি।
    গুরু মশাই হাতে লাঠি বন্ধু ছিলে ভাই,
    শিষ্যদের মানুষ করতে তোমার জুড়ি নাই।
    এই সমাজও চাইছে আজ শক্ত একটা লাঠি,
    অবোধগুলোর পড়লে পিঠে মানুষ হবে খাঁটি।

  • কবিতা

    কবিতা- মেঘবালিকা

    মেঘবালিকা
    – তাপসী শতপথী

     

    মেঘবালিকা মেঘবালিকা
    একটি মেয়ে ছিল জানি,
    মেঘবালিকা লাজবতী আজ
    মেঘলা দিনের ঘোমটা টানি।
    মেঘ বালিকা শ্বেতবলাকা
    উড়তো কেমন ডানা মেলে,
    হারিয়ে যেত মেঘবালিকা
    মনের সুখে পথটি ভুলে।
    মেঘবালিকা মেঘবালিকা
    স্বপ্ন আঁকা ছবির পটে,
    মেঘবালিকা ভালোবাসার
    সোহাগ লেগে ঝলসে উঠে।
    মেঘবালিকা মেঘবালিকা
    একটু ফুলের ভালোবাসা,
    সরল বুকে দু’ হাত ভরে
    কুড়িয়ে নেওয়ার পায় যে নেশা।
    মেঘবালিকা ছোট্ট নীড়ে
    স্বপ্ন সাজায় রাতটি জেগে,
    অভিমানে তার মুখটি রাঙ্গা
    ভালোবাসার সোহাগ লেগে।
    কিন্তু হঠাৎ উঠল যে ঝড়
    মেঘবালিকার সুখের নীড়ে,
    উড়িয়ে দিলো সব কিছু তার
    ভালোবাসার শিকড় ছিঁড়ে।
    মেঘবালিকা মেঘের পরি
    ঢাকলো যে আজ কালো মেঘে,
    স্বপ্ন যে তার ধূলায় পড়ে
    ধূসর হলো মলিন লেগে।
    মেঘবালিকা আকাশ পারে
    মনের সুখে ছিল ভালো,
    মেঘবালিকা বুঝল না আজ
    তার যে কেন এমন হলো।
    মেঘবালিকা জলের পরি
    দু’ চোখে আজ জল যে ভরে,
    তাই আকাশ থেকে মেঘবালিকা
    বৃষ্টি হয়ে পড়লো ঝরে।

You cannot copy content of this page