-
অণুগল্প- স্বপ্ন ভাঙে, স্বপ্ন গড়ে
স্বপ্ন ভাঙে, স্বপ্ন গড়ে
-নৃপেন্দ্রনাথ মহন্তওরা এসে দাঁড়াল একফালি নাবাল জমিতে। মজা নদী ছিরামতীর কোল ঘেঁষে। নদীখাতে এখন আর জল বয়ে যায় না। যে যে পেরেছে যতটা পেরেছে দখল করে কেউ ধান, কেউ পাট লাগিয়েছে। ওদের কেনা ভূমিখণ্ড অবশ্য দখলের মালিন্যমুক্ত।ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ রায়তি জমি।
নিভে যাওয়া স্বপ্নের প্রদীপে নতুন করে অগ্নি সংযোগ করে ওরা এলো। এলো আলোছায়ার মিতালির মতো ঘনিষ্ঠ হয়ে।একে অপরের কোমরে হাত রেখে। এলো ঝর্ণার উদ্দামতায় আলপথের দু’পাশের ঝোপঝাড় লতাপাতা সবাইকে নন্দিত করতে করতে।
ওদের একজন দিনু–অর্থাৎ দীননাথ দেবশর্মা, অন্যজন রিংকি দাস। এখন দাস পদবি খুইয়ে সেও দেবশর্মা। গৃহশিক্ষকতা দু’জনেরই পেশা।
স্বামী-স্ত্রী দু’জনের মিলিত উপার্জনে, নিজেদের সাধ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে কিংবা সেই সাধ-আহ্লাদের টানে, নগদ সাড়ে চার লক্ষ টাকায় কেনা এই তিন শতক জমি বর্তমানে ওদের স্বর্গের সিঁড়ি হয়ে ছিরামতীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থান করছে। আর হাজার দশেক টাকা জোগাড় করে এক হাফ নেতার হাতে দিতে পারলেই কেল্লাফতে। মিলে যাবে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় গৃহনির্মাণের টাকা। তৈরি হবে ওদের স্বপ্ননীড়।
হ্যাঁ, স্বপ্ননীড়ই ওরা নাম দেবে বাড়িটার।ওরা ভুলে যাবে একাধিক স্বপ্নভঙ্গের ইতিকথা।
দিনুকে ঘিরে প্রথম স্বপ্ন দেখেছিল তার বাবা হরিচরণ।সেবারই দিনু দ্বিতীয় বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছিল। তাদেরই গ্রামের তিন তিনজন ছেলেমেয়ে তার কিছুদিন আগেই প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক পদে নিয়োগপত্র পায়। দোকান কর্মচারী হরিচরণ শুলুকসন্ধান করে জানতে পারে নেতাদের হাতে লাখ দশেক টাকা গুঁজে দিতে পারলে তার ছেলেও প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতার চাকুরি পেতে পারে। আর চাকুরি মানে নিয়মিত মাস মাইনে। দিন এনে দিন খাওয়ার দিনের অবসান।
বাজারের কাছাকাছি কাঠা তিনেক জমিতে বাড়ি ছিল হরিচরণের। বাড়ি বলতে মুলিবাঁশের বেড়া দেওয়া একটা টিনের চালা,তার বারান্দায় একটা খুপরি, খানিকটা তফাতে ছেঁড়াফারা পলিথিনের আচ্ছাদন দেয়া রান্নাঘর। জমিটা সাড়ে নয় লাখ টাকায় বিক্রি করে রেলের সরকারি জমিতে ঘর বেঁধেছিল সে। আর জমি বিক্রির টাকার সাথে স্ত্রীর কানের দুল বিক্রি করা টাকা যোগ করে দিয়ে এসেছিল এক এজেন্টের হাতে।তারপর অপেক্ষা আর দিন গোনা। অবশেষে ছেলেকে স্বপ্ন হস্তান্তর করে জগৎ সংসার থেকে হরিচরণের বিদায়। তার মাস দেড়েক পরেই বিদায় নেয় তার একান্ত অনুগামিনী স্ত্রী দিনুর মা-ও। একেবারে একা হয়ে যায় দিনু।সেই একাকীত্বের দিনগুলোতে দিনুর পাশে এসে দাঁড়ায় রিংকি।
একক প্রচেষ্টায় কোনো স্বপ্নই পূরণ হবার নয় বুঝেই হয়তো ওরা জোট বেঁধেছিল। মিলিত চেষ্টায় মিলিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবার তাগিদে। এককালে স্বপ্ন ছিল, ওদের মধ্যে যে কেউ একজন চাকুরি পেলেই ওরা বিয়ে করবে। এখন সে স্বপ্ন থিতিয়ে গেছে। এখন স্বপ্নে শুধু স্বপ্ননীড়। -
কবিতা- অভিনয়
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
অভিনয়
-নৃপেন্দ্রনাথ মহন্তআমরা সবাই অভিনেতা।
সংসারের, রাজনাতির রঙ্গমঞ্চে
যথাসাধ্য অভিনয় করি
মুখ্যচরিত্রে কেউ কেউ,অধিকাংশই পার্শ্ব অভিনেতা।অভিনয়ের চরিত্র নেই
চরিত্রের অভিনয়ে প্রায় সকলে নিপুণ।তবে কিছু কিছু অভিনেতার ভুলো মন
মাঝে মাঝে সংলাপ ভুলে যায়
তখন অভিজ্ঞ অভিনেতা হলে
মনগড়া সংলাপে মঞ্চ মাতায়
যেন রবীন্দ্রসংগীত গায়
চটুল আধুনিক সংগীতের সুরে।মুশকিল হয় নবাগত সহশিল্পীর
খেই খুঁজে না পেয়ে থমকে দাঁড়ায়
যেন সে ঢুকে পড়েছে অন্ধ গলিতে অচেনা কলকাতায়।অভিনয় পণ্ড হয়।অধিকারীর রক্তচাপ বাড়ে।
সংসার ভাঙে।দল ভাঙে।মন্ত্রীসভাও ভেঙে যায়।
-
কবিতা- কথা বলো কাকলি
।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ।।
কথা বলো কাকলি
-নৃপেন্দ্রনাথ মহন্তকথা বলো কাকলি,
সুস্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলো
বাংলা ভাষার সুমিষ্ট রোদে আমি স্নান করি।নতুন শব্দরা আসুক বিচিত্র গন্ধ মেখে গায়
আমি নতুন পদ্য লিখি পুরোনো খাতায়।না,মেসেজ নয়।মোবাইলে পাঠানো মেসেজ
সে তো ননভার্বাল কমিউনিকেশন
তোমার অবাঙালি বন্ধুদের জন্য তোলা থাক।না,ইমোজিও নয়।ও ভাবে প্রতীকী অনুভূতি প্রকাশ কোরো না,কাকলি।
তুমি ধীরে ধীরে আবেগশূন্য হয়ে যাবে।
আবেগ ও অনুভূতির সীমাহীন বৈচিত্র্যকে
কি ইমোজির ছকেবাঁধা প্রতীকে বেঁধে ফেলা যায়?তুমি কথা বলো , চোখেমুখে কথা বলো
শরীরী অভিব্যক্তি দিয়ে
রংপুরের রংদার বিচিত্র বাংলায়।দূরে থাকলে চিঠি লিখো
না,পিকচার লেটার দিয়ে নয়।
চিঠি লিখো বর্ণ পরিচয়ের পুরোনো অক্ষরে।কথা বলো,কথা বলো কাকলি।
তোমার উচ্চারণ, তোমার কথা বলার ধরন
আর রজনীগন্ধার মতো শ্বেতশুভ্র হাসিতে
পিয়ানো বেজে ওঠে আমার অন্তরে
তুমি সব নিভিয়ে দিয়ো না ইমোজির ফুসমন্তরে। -
কবিতা- আমিও মূর্তি ভাঙতে চাই
আমিও মূর্তি ভাঙতে চাই
– নৃপেন্দ্রনাথ মহন্তআমিও মূর্তি ভাঙতে চাই।
আমার কোনো অনুরক্তি নাই
দুঃখ নাই,ক্ষোভ নাই কোনো
দীর্ঘস্থায়ী দীর্ঘশ্বাস নাই
কেবল নৈঃশব্দ আছে
আছে বিষণ্ণতার অশরীরী ভয়
যখন বেণুবনে অন্ধকারে ডেকে ওঠে পেঁচা
নিষ্ঠুর কর্কশ গর্জনে কাঁপে হরিণ-হৃদয়।খসে যাক ঝরে যাক পাতা কিংবা ফল
ঝলসে যাক স্বপ্নগুলো সব
শুধু পাঁকে পাঁকে অথবা সিঞ্চিত ঝাড়ির জলে
ঘাসে ঘাসে ফুটে থাক ফুল–
আমি জ্যোৎস্নার শরীর থেকে সুতো খুলে নিয়ে
প্রকৃতিকে বুনে দেবো শাড়ি
তারপর ভাঙবো,ভাঙবো মূর্তি সব।চেয়ে দেখো–সব মূর্তি আমারই
যাকে তোমরা ভাবমূর্তি বলো। -
কবিতা- এক বিভ্রান্ত সময়ে বেঁচে আছি
এক বিভ্রান্ত সময়ে বেঁচে আছি
-নৃপেন্দ্রনাথ মহন্তযখন অদ্যকে অগ্রাহ্য করে বয়স্ক হৃদয়
ডুবে যেতে চায় আঠারোর সুগন্ধি হাস্নুহানায়
সুনীল আকাশে সহসা মেঘেদের ডাক।আমি হতবাক।
জানি,এ এক বিভ্রান্ত সময়
কখনো মনে হয় গ্রহণ লেগেছে চাঁদে।পৃথিবীর ছাদে।
কখনো মরীচিকা মনে হয় সব।অথবা জান্তব
উল্লাসে ছিন্ন করে শৃঙ্খলার পাশ–কিছু দলদাস।
দড়ি ছেঁড়া গোরুদের মতো অসংযত
মানুষের নিষ্ঠুর আঘাতে বৃন্তচ্যুত জ্যোৎস্না
বকুল ফুলের মতো ঝরে পড়ে।থরে বিথরে।
কখনো মনে হয় জ্যোৎস্না নয়, রোদও নয়
বৃন্তচ্যুত হয় আমাদের নিরালম্ব বিভ্রান্ত সময়।প্রভু,আমি পাশবিক স্বৈরাচারকে নিয়তি মেনেছি
আমি বিবেককে ঘুম পাড়িয়ে
আত্মতৃপ্ত হয়ে এই বিভ্রান্ত সময়ে বেঁচে আছি। -
কবিতা- ছাব্বিশে জানুয়ারি
ছাব্বিশে জানুয়ারি
-নৃপেন্দ্রনাথ মহন্তছাব্বিশে জানুয়ারি
রিক্ত হাতে আকাশ পাওয়ার দিনমাত্র দিন তিনেক
পালিত হয়েছে নেতাজির জন্মদিন।দিন শুধু পালনীয়
শুধু ফুলমালা,সুচতুর বক্তৃতাশুনে মনে প্রত্যয়
এবার জ্বলবে অন্ধকারের চিতা।হতাশায় মন ভাঙে
দেখে রাজা সব প্রজার কবর খোঁড়েশবগুলো অপেক্ষায়
চিতায় উঠবে কেউ নেমে যাবে গোরে।তবু
ছাব্বিশে জানুয়ারি
নতুন দিন প্রজাতন্ত্রী পথ ধরেদিন যায় শঙ্কায়
চোখে স্বপ্ন,বুকে আশা ভিড় করে। -
কবিতা- পঞ্চদশপদী কবিতা
পঞ্চদশপদী কবিতা
নৃপেন্দ্রনাথ মহন্তসূর্যপানে তাকিয়ে থাকি অনায়াসে গ্রহণকালে
গজরাজ গর্তে যখন, ব্যাঙও তাকে লাত্থি মারে
এ নিয়ে আক্ষেপ কেন?সংসারের এটাই রীতি।হম্বিতম্বি কোরো নাকো, বসে থাকো ঘাপটি মেরে
নয় থাকো এখন তুমি যে তিমিরে সেই তিমিরে
জাবর কেটে লাভটা কী বস্তাপচা প্রাচীন স্মৃতি?একসময় গ্রহণ কেটে সূর্য বেরিয়ে আসে
তোমার উপায় নেই জড়িয়ে আছো শক্ত পাশে
হৃদট্যাবের কীবোর্ডে বোতাম টেপো এলোমেলো।নেটওয়ার্ক বিহনে অত্যাধুনিক ফোর-জি ভ’রে
কোন্ বার্তা পাঠাবে বলো মুঠোফোন দৌত্য করে?
বুকের জলায় ডাহুক ডাকে! তাতে কী এলো-গেলো?চোখ থাকতে অন্ধ হলে, কী লাভ বলো চক্ষু খুলে?
বৃথা তুমি জল ঢেলেছো কাঁটায়ভরা বৃক্ষমূলে
একটাও ফুল ফোটেনি ; বিঁধছে বুকে কাঁটাগুলো। -
কবিতা- বিশ-কুড়ি যখন কুঁড়ি
বিশ-কুড়ি যখন কুঁড়ি
-নৃপেন্দ্রনাথ মহন্তজানিনে তো ধূমল মেঘ
হি-হি কেঁপে ভরদুপুরে
কোথায় যায়!তবে কি সে প্রেমের বশে
মুখবুজে নীল আকাশে
ঘুম ছড়ায়?উল্কা খসে অভিমানে
কি তার ব্যথা সে-ই জানে
খঞ্জ রাত।সূর্যের ঘুম ভাঙেনা
বাজে কটা নেই সেদিকে
দৃষ্টিপাত।উত্তুরে বাতাস বয়
বয়স্কদের মৃত্যুভয়
রক্তচাপসর্বাঙ্গে হিম ছড়ানো
ভরসা শুধু ভাঙা সাঁকো
উনুন-তাপ।শিশিরের বিরামহীন
অশ্রুপাত।শেষের দিন
ভয়ংকর!বিশ- কুড়িতে ভরসা কী?
একূল ওকূল ফর্সা কি!
জয় শঙ্কর। -
অণু গল্প- কাটমানি
কাটমানি
-নৃপেন্দ্রনাথ মহন্ত
দ্বিপ্রাহরিক রান্নায় ব্যস্ত টুম্পা দাসের হঠাৎ মনে পড়লো ঘরে গুঁঁড়ো হলুদ বাড়ন্ত। তার বছর ছয়েকের মেয়ে হৃষিতা ছাড়া সেই মুহূর্তে বাড়িতে কেউ নেই।টুম্পা আটপৌরে পোশাকে বাড়ির বাইরে যায় না।অর্পণ সাহার মুদিখানা খুব কাছেই, হৃষিতাদের খেলার মাঠের লাগোয়া।টুম্পা তাই হৃষিতার শরণ নিল।ডাকলো: হৃষি, একটু আয় তো মা! হৃষিতা আসতেই বললো, তোর অর্পণ কাকুর দোকান থেকে এক প্যাকেট হলুদ গুঁড়ো এনে দিতে পারবি?
:কেন পারবো না? আমি কি ছোটোটি আছি নাকি?
সে যে আর ছোটোটি নেই তার পাকা পাকা কথায় হরদম তার প্রমাণ মেলে।টুম্পা তাকে দশ টাকার একটা নোট দিয়ে বললো : এই দশটাকার নোটটা অর্পণ কাকুকে দিয়ে বলবি এক প্যাকেট গুঁড়ো হলুদ দাও।কাকু দুটাকা ফেরৎ দেবে।
: জানি, জানি।অত বলতে হবেনা।আমি কি রিংকির মতো বাচ্চা নাকি? ওর কথা শুনে টুম্পা হাসে।
সে যে বাচ্চা নয় তা প্রমাণের জন্য সে বড়দের কথা গোগ্রাসে গেলে।সময় সুযোগ পেলে উগরে দেয়।ওর মা-বাবা যখন কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে তখন সে তাদের কথাগুলো যেন কান দিয়ে, ত্বক দিয়ে, সর্বসত্ত্বা দিয়ে শুষে নেবার চেষ্টা করে।
টুম্পা বলে, ঠিক আছে যা।ফেরৎ দুটাকা আবার মাঠে ফেলে আসিস নে যেন।
টাকা নিয়ে হৃষিতা এক ছুট।টুম্পা গেটের কাছে মেয়ের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে।হৃষিতার ফিরতে সময় বেশি লাগে না।হলুদের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে টুম্পা বলে: দুটাকা ফেরৎ দেয় নি?
: দিয়েছে তো?
:কোথায়? তোর হাতে তো দেখছি নে!হারিয়েছিস তো?
:না, হারাইনি।সত্যি বলছি।আমি কি একেবারে বাচ্চা নাকি?
: তা হলে! কী হল টাকাটা?
:ওটা তো কাট মানি মা। এই যে। বলে কোমরে গোঁজা একটা চকোলেট বের করে দেখায়।
টুম্পা তো তাজ্জব। -
কবিতা- একটু খানি থাম্
একটু খানি থাম্
– নৃপেন্দ্রনাথ মহন্তএকটুখানি থাম্, ওরে, একটুখানি থাম্।
স্বপ্নলোক থেকে এবার একটুখানি নাম্।
তুই ভুলে যাচ্ছিস এটা ভারত
দেশপ্রেমিকের পাগলাগারদ
এখানে শুধু শুধুই ঝরাচ্ছিস তুই ঘাম।অনেক হয়েছে। এবার একটুখানি থাম্।
মাথার সায় নেই তবু মেলতে হচ্ছে চোখ
দেখতে হচ্ছে যাকিছু দেখাচ্ছে কিছু লোক।তাদের খাতায় লিখিয়ে নাম
জুটছে বটে হরেক ইনাম
বাজারে গিয়ে বাজিয়ে দ্যাখ্ কত তার দাম।একটুখানি থাম্ ওরে, একটুখানি থাম্।