• কবিতা

    কবিতা- শেষ দাবী

    শেষ দাবী
    – পায়েল সাহু

     

     

    বিরাট বড়ো একটা ঢেউ চাই আমার কিম্বা নিস্তব্ধ নিস্তরঙ্গ নদীর জল,
    যে আমার অস্তিত্বকে মুহূর্তে বিলীন করে দিতে পারবে,
    এতো টুকু ছাপ না রেখেই।

    প্রবল ঝোড়ো বাতাস চাই আমার কিম্বা শান্ত ধীর বাতাস,
    যে আমাকে কর্পূরের মতো মিশিয়ে নেবে নিজের সঙ্গে,
    কোথাও কোনো গন্ধ ছাড়াই।

    প্রবল এক বহ্নিশিখা চাই আমার অথবা উত্তপ্ত অগ্নিগোলক,
    যে মুহূর্তে আমাকে গ্রাস করে নিশ্চিত করবে শেষচিহ্নরূপী নাড়ির অস্তিত্বের।

    অথবা….

    প্রবল এক ভালোবাসার আলিঙ্গন চাই
    অথবা উষ্ণ আদর,
    যে মুহূর্তে প্রলেপ দেবে ক্ষত বিক্ষত মনের আঙিনায়,
    যে বাঁচিয়ে রাখবে প্রবল ঝোড়ো হাওয়ার মুখে,
    নিভন্ত অগ্নিশিখার মোহনায়।
    যার ছোঁয়ায় আবারও সিক্ত হবে পাথুরে এ অন্তর।

  • কবিতা

    কবিতা- দাবি

    দাবি
    – পায়েল সাহু

    শুধু এটুকুই চাওয়া….
    তোমার বুকের গভীর শুধু আমার হোক,
    সুদৃঢ় যত আলিঙ্গন কেবল নির্ভরতার হোক,

    তোমার অভিমানী আলাপের রোদ্দুর ভেজা দুপুর,
    শুধুমাত্র আমায় ঘিরেই বাজুক সে আদুরে নূপুর।

    তোমার সমস্ত কান্না আমায় ভিজিয়ে শান্ত করুক
    হৃদয়ের তুফান,
    গোপন যত হতাশা ঝরে দিয়ে যাক পরমাত্মার সম্মান।

    তোমার সমস্ত রাগের প্রকাশ হোক কেবল আমার নামেই,
    তোমার যত অধিকারের দাবীতে হৃদয় যেন হারায় খেই।

    তোমার চোখের ওই গভীরতায় হারাক আমার অপলক দৃষ্টি,
    আকুল ভালোবাসায় তুমি আমার ঈশ্বরের সেরা সৃষ্টি।

    তোমার গায়ের গন্ধে হোক আমার যুদ্ধজয়,
    তোমার আলিঙ্গনে পরাস্ত হোক আমার নিরাপত্তাহীনতার যত ভয়।

  • কবিতা

    কবিতা- ভ্যালেন্টাইন্স উইক

    ভ্যালেন্টাইন্স উইক
    -পায়েল সাহু

     

     

    7th feb

    লাল গোলাপের কোমল ছোঁয়ায় শুরু যত ভালোবাসার
    অজ্ঞাত এক কাঁটার খোঁচায় হৃদয় আকাশ মেঘ-মেদুর।
    অহংকারী Rose Day এসে মনে করায় হারানো প্রেম,
    ভালোলাগা আজ হারিয়েও তবু উঁকি মারে চেনা মুখের ফ্রেম।

    8th feb

    শখ করে আজ বসে থাকা পথ চেয়ে সকাল থেকে
    লজ্জা মাখা আরক্ত মুখের ফুটছে হৃদয় তীব্রবেগে,
    Propose Day র আশায় বসে অভিযোগেরা আজ জলাঞ্জলি,
    দিন কেটে যায় রাত্রির আশায় নেভে আশার সব দীপগুলি।

    9th feb

    প্ৰিয় চকোলেটের স্বাদে নাকি ভালোবাসা বাড়ে দ্বিগুণ বেগে,
    উপহারের জুড়ি মেলা ভার তার উৎসবে বা অনুরাগে।
    Chocolate Day হেসে বলে যায় বৃথাই শুধু এ ভালোবাসা,
    সবচেয়ে প্ৰিয় সঙ্গী বুঝি খুঁজেছে এবার নতুন বাসা।

    10th feb

    সবার প্ৰিয় আদুরে ভীষণ তুলোর নরম গোলা
    রঙিন যত সাজপোশাকে ভাল্লুকের দল সাজে
    Teddy Day উদযাপিত প্রেমিকার প্ৰিয় উপহারের নামে
    পুরোনো প্রেম প্রাণপণ বাঁচে অপ্রত্যাশিত অবহেলার দামে।

    11th feb

    Promise Day সার্থক হোক ছেড়ে যাওয়ার অঙ্গীকারে
    সারাজীবনের যত কথা হারাক কোনো অন্ধকারে
    ভালোবাসার রঙিন খাম ভিজুক বরং চোখের জলে
    আদুরে যত গোপন কথা ডুবুক কোনো গভীর জলে।

    12th feb

    স্পর্শরা সব দিশেহারা আজ ভালোবাসার আবদারের,
    বিশ্বাস আর ভরসার বুক আজ ছোঁয়াচ বাঁচায় প্রশ্রয়ের |
    Hug Day কেবল হাস্যকর তারিখ মাত্র ক্যালেন্ডারের,
    প্রেমের শহর হাতড়ে বেড়ায় বলিষ্ঠ দুই কোমল হাতের।

    13th feb

    ঠোঁটের ছোঁয়া দোর দিয়েছে অজানা কোনো গুম ঘরে
    মনপলাশী ছবি আঁকে পুরোনো দিনের রোমাঞ্চ ঘিরে
    মনে মনেই পৌঁছে দেওয়া ঠোঁটের নরম উষ্ণতার
    Kiss Day আজ হেসে বলে এসব ভীষণ অ-দরকার।

    14th feb

    মনের যেথায় আনাগোনা নিত্যদিনের অবসরের,
    Valentine’s Day নিছক প্রতীক ভালোবাসা জাহিরের।
    প্রাণের মাঝে তারই ছোঁয়া, বুকের ওমে বাস
    ভালোবাসার টান থাকবে মনে অভিমানীর বারোমাস।

  • কবিতা

    কবিতা- ধিক্কার

    ধিক্কার
    – পায়েল সাহু

     

     

    গভীর রাতের নিস্তরঙ্গ বাতাস ছুঁয়ে যায়
    কানে কানে বলে যায় অতীতের গল্প,
    শুধু ভুল আর ভুলে ভরা ইচ্ছের ধিক্কারে
    শিহরিত হয় শরীর আর মন।
    আত্ম সমালোচনার বিচার সভা বসে
    নিস্তব্ধ রাতের অখণ্ড অবসরে,
    অভিযোগের তীব্র আগুনে প্রতি রাতে
    দহন জ্বালায় মৃত্যু বরণ করে অন্তরাত্মা।
    হাসিমুখের ছাই চাপা আগুনে,
    প্রতিনিয়ত বিসর্জিত সম্পর্কের শব।
    তবু জীবন এগিয়ে চলে আপন স্বচ্ছন্দতায়
    আরও কিছু ভুলের নেশায়,
    সমস্ত চাহিদাকে কুক্ষিগত করার ইচ্ছেয়,
    অসাবধানী সিদ্ধান্তে না চাইতেও আরো কিছু
    সম্পর্কের মৃত্যু মিছিলের অগ্রভাগে।

  • মুক্ত গদ্য

    মুক্তগদ্য- পরিহাস

    পরিহাস
    – পায়েল সাহু

     

     

    লোকটার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা এসে দাঁড়ালো বেশ বড়ো একটা ঘরের দরজায়, মেয়েটাকে ঘরে ঢুকে দরজা আটকাতে বলেই লোকটা তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো অফিসে।ঘরটায় দুটো চৌকি পাতা, পাশাপাশি। বিরাট মোটা মোটা দুটো তোষক গুটিয়ে রাখা, পাশে ওয়াড় | বালিশ, পাশবালিশ, সেগুলোর ওয়াড়, চাদর স্তুপ করে রাখা। মেয়েটার সঙ্গে আনা বেশ কয়েকটা ব্যাগ, তাতে মা বাবার ভরে দেওয়া প্রচুর জিনিস।

    তেইশ পেরোনো মেয়েটা ওই লোকটার মাত্র এক মাস আগে বিয়ে করা বৌ, সদ্য কলেজ পাশ করে কম্পিউটার ট্রেনিং নিচ্ছিলো….. আর এই ঘরটা ওই লোকটার অফিসের কোয়ার্টার |
    মেয়েটা দাঁড়িয়ে থাকে না, জীবনে প্রথমবারের জন্য সম্পূর্ণ একার চেষ্টায় মোটা তোষকগুলো খুলে ওয়াড় পরিয়ে পেতে ফেলে, চাদর পাতে, সুন্দর করে বালিশ সাজায় |
    একটা একটা করে ব্যাগ খুলে জিনিস সাজাতে থাকে তার নতুন সংসারে, “সংসার” সেদিন হয়তো সে মানেটাও বুঝতো না শব্দটার। হয়তো সেই সুযোগটাই নিয়েছিল তার স্বামী, সমস্ত কাজেই হাত তুলে দিয়ে ওই ছোট্ট মেয়েটার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতো সমস্ত দায়িত্ব। এমন নয় যে স্বামী ভদ্রলোক জানতেন না যে মেয়েটি বাবা মায়ের একমাত্র ভীষণ আদুরে সন্তান, তার কোনো কাজ করার অভ্যাস নেই, সে কিছুই প্রায় জানে না, রান্নাটুকুও না, সব কিছু জেনেই তিনি বিয়ে করেছিলেন।
    মেয়েটির বাবা মাও এই বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন কারণ ছেলেটি মেয়েটির থেকে বয়সে বেশ বড়ো, ভেবেছিলেন তাঁদের মেয়েকে সামলে রাখবে জামাই, যত্নে রাখবে।

    অফিস ক্যাম্পাসে ঘর হওয়ায় স্বামী ভদ্রলোকটি যখন তখন চলে আসতেন তাঁদের নিজের ঘরে, না না নতুন বৌয়ের টানে নয়, খাবার খেতে, তার না কি ক্ষিদে পায় বারবার, সদ্য বিবাহিতা মেয়েটি আতংকিত হয়ে পড়তো তার স্বামীর আচরণে, সারাদিনে কতবার কি কি রান্না করে তাকে খেতে দিতে হবে ভেবেই তার কান্না পেতো, readymade খাবার তার স্বামী খাবেন না, তাকে বেশ গুছিয়ে পরিবেশন করতে হবে। আর না দিলেই অপমানজনক কথা তার জন্য অপেক্ষা করতো, হ্যাঁ, যদিও বিয়ের বয়স মাত্র একমাস |

    মেয়েটা ভাতের ফ্যান গালতে পারতো না, বেশিরভাগ দিন তার হাতে গরম ফ্যান, গরম ভাত পড়ে যেতো, বঁটি দিয়ে সবজি কাটতে পারতো না, তবু সময়ের মধ্যে ভাতের থালাটা তাকে সাজিয়ে দিতেই হতো।
    “ভরা পেটে ফল ” তাই স্বামী ভদ্ৰলোকটি দুপুরে খাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে পা নাচিয়ে বৌকে আদেশ দিতেন তাকে ফল কেটে দেওয়ার। অবাক লাজুক মেয়েটি চুপ করে দেখতো তার স্বামীর ব্যবহার, প্রায় প্রতিদিন আঙ্গুল কেটে রক্ত বেরিয়ে গেলেও জানতে দিতো না সে তার স্বামীকে। তার মনে পড়তো মায়ের কথা, যিনি ফল কেটে মেয়ের মুখের সামনে ধরে সাধাসাধি করতেন খাবার জন্য। নাহ, মেয়েটি ভুল করেও স্বামীর জন্য কাটা ফল নিজে খেতো না, নিজে নিয়ে খাওয়ার অভ্যাস যে তার নেই, অবশ্য তাকে সাধবার কেউ ছিলোও না |
    মাস তিনেক পর মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়ে, প্রচন্ড জ্বর আসে তার, সুদূর রাজ্য থেকে মেয়েটির বাবা গিয়ে তাকে নিয়ে আসেন নিজের কাছে, মা বাবার সেবা যত্নে মেয়েটি সুস্থ হয়ে উঠলেও স্বামীর কাছে আর ফিরতে চায় না, আতংকিত হয়ে পড়ে, যদিও ভুল করেও কখনো প্রকাশ করেনা মা বাবার কষ্টের কারণে |
    তবু “সংসার” ছেড়ে থাকতে নেই তাই মেয়েটিকে আবার ফিরতেই হয় তার আশ্রয়ে। গর্ভবতী হয়ে পড়লেও যেখানে তার স্বামী চিকিৎসা করাতে চান না লোকলজ্জার ভয়ে। হ্যাঁ ওনারা বিবাহিত, তবু সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী অন্তসত্ত্বা, লোকে কি বলবে! তাই ডাক্তারের কাছে না নিয়ে গিয়ে লোকটি মেয়েটিকে তার বাপেরবাড়িতে রাখতে আসেন।
    “কাঁচা নাড়ি” পথের ধকল সহ্য করতে না পেরে রক্তপাত শুরু করে, নতুন জীবনের সব আশা নিস্প্রাণ হয়ে পড়ে।

    মাঝখানে কেটে গেছে পনেরোটা বছর|

    মেয়েটি এখন একটি সন্তানের মা। বিয়ের দু’ বছর পর গর্ভবতী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার স্বামী বিছানা আলাদা করে নিয়েছিলেন, সেদিনের সেই অল্পবয়সী মেয়েটির শারীরিক চাহিদার কথা বিন্দুমাত্র না ভেবেই। শারীরিক দূরত্ব শুরু থেকেই ছিলো, এই ঘটনায় মানসিক বন্ধনটুকুও কেটে গেলো। পুরো গর্ভাবস্থায় ভুল করেও স্ত্রীকে সময় দেওয়ার ভুল করেননি ভদ্রলোক |
    অবলা লাজুক মেয়েটির খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আজ সেই মেয়েটি বেশ জাদরেল গিন্নী। ভয়ংকর তার গলার জোর। নিজের চাহিদা, ইচ্ছে কিভাবে পূরণ করে নিতে হয় এখন সে বেশ ভালোই জানে এখন। পরিস্থিতি তাকে শিখিয়ে দিয়েছে। মানসিক শান্তি, শারীরিক তৃপ্তির জন্য সে এখন আর তার স্বামীর মুখাপেক্ষী নয় কোনোভাবেই।
    গত দশ বছর আগেই তার সঙ্গে তার স্বামীর মানসিক বিচ্ছেদ ঘটেছে চিরতরে। পরিবর্তে সে শিখে নিয়েছে নিজের স্বামীকে ঘৃণা করতে, তাকে দমিয়ে রাখতে, শিখেছে দাপট দেখাতে |
    সব ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলো শুরুতেই, চেয়েছিলো নিজের জীবনটাকে সুন্দর করে সাজাতে, পারেনি, পারেনি নিজের মায়ের চরম শাসনে। দুর্ব্যবহারে, মানসিক আশ্রয়হীনতায় ভুগতে ভুগতে একের পর এক পুরুষের কাছে খুঁজে গেছে শুধু ভালোবাসা, মানসিক আশ্রয়।
    “সংসার”টা আজ সে নিখুঁত ভাবে করে, এতটুকু ত্রুটি নেই কোথাও, রকমারি রান্নায় সে এখন একাই একশো।

    পাশের ঘরের বিছানায় লেপের ওয়াড় পরাতে পরাতে স্বামী ভদ্রলোকটি বলে ওঠেন, “খুব মুশকিলের ব্যাপার এটা, উল্টোপাল্টা হয়ে যাচ্ছে।” মেয়েটি একবার উঁকি মেরে দেখে আসে পাশের ঘরে, স্মৃতির ঝলকানিতে তীব্র ঘৃণায় সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে মুচকি হেসে ফিরে যায় নিজের ঘরে, যেখানে শুধু মাত্র তার অধিকার, যেখানে সে তার সন্তানের সঙ্গে থাকে।

  • গল্প

    গল্প -আঁধারে আলো 

    আঁধারে আলো
    – পায়েল সাহু 

     

     

    মাঝে মাঝেই আজকাল সহ্যশক্তি ছাড়িয়ে যায় রুদ্রর ব্যবহার তবু মুখ বুজে সহ্য করতে করতে রুমা ভাবে একদিন সে সব কিছুর জবাব ঠিক দেবেই। অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নেয়। অনেক সময় রুদ্রর কথাও ভাবে, এই অতিমারীর সময় লকডাউনে কারখানার কাজটা হারিয়ে দিনের পর দিন বাড়ি বসে অভাবের সংসারে কারই বা মাথার ঠিক থাকে। সরকারের দেওয়া রেশনে কোনো মতে দিন গুজরান হচ্ছে। তার মধ্যেই নেশার খোরাকি ঠিক আছেই। তবু আনমনে তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে অতীতের কথা ভেবে।

     বাড়ি থেকে পালিয়ে সামান্য কারখানায় কাজ করা অনাথ যুবক রুদ্রকে ভালোবেসে বিয়ে করার ঠিক দু বছরের মাথায় একটি বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলের চাকরিটা পেয়ে রুমা ভেবেছিলো তাঁদের অভাবের সংসারের এবার একটু সুরাহা হবে। স্বনির্ভর হওয়ার আনন্দে সারাদিন অজস্র পরিকল্পনা করছিলো রুমা। কিন্তু খুশি হতে পারেনি রুদ্র, কোনো যুক্তি না দেখিয়েই সরাসরি বারণ করে দিয়েছিলো। রুমার হাজার অনুরোধ, কান্না কোনোকিছুই রুদ্রর মন গলাতে পারেনি বরং যতদিন গেছে রুদ্র ভীষণ ভাবে অচেনা হতে থাকে রুমার কাছে। মদের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে সবসময়। সামান্য কথার অবাধ্য হলেও গায়ে হাত তুলতে অব্দি দ্বিধা করতো না রুদ্র। হয়তো রুমার স্বাবলম্বী হতে চাওয়াটা তার অকর্মণ্যতাকে ভীষণ স্পষ্ট করে তুলেছিল।

    রুদ্র কারখানায় কাজ করলেও স্বপ্ন দেখতো অনেক বড়ো। লটারীর টিকিট কাটার নেশায় পেয়ে বসেছিল তাকে। অতি সামান্য আয়ের বেশিরভাগটাই চলে যেতো লটারির টিকিটের পেছনে। কখনো কখনো দু’ পাঁচশো টাকা পেয়ে গেলে তাকে আর পায় কে। আর সেই রাতগুলোতে চলতো রুমার ওপর পাশবিক অত্যাচার|

    এই পরিস্থিতিতে রুমা একটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে সে কোনোদিন মা হবে না, নিজের সন্তানের কাছে রাতদিন চোখের জলে ভেসে ছোট হতে পারবে না | এই ব্যাপারটা আজও গোপন থেকে গেছে রুদ্রর কাছে।

    দম দেওয়া পুতুলের মতো রুদ্রর বাধ্য হয়ে কাটিয়ে দিলো এতগুলো বছর। রুদ্রর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কটাও তলানিতে এসে ঠেকেছে, কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে চলছে।

    মাঝে মধ্যেই পুরোনো দিনগুলোর কথা মনে পড়লে নিজেই অবাক হয়ে যায়, রুদ্রর সামান্য অসম্মানে গা জ্বলতো রুমার আর আজ রুদ্রর যে কোনো শারীরিক কষ্ট বা বাড়ি বয়ে রুদ্রর কাছে টাকার তাগাদা করতে আসা মহাজনের অপমানে রুমার মনে অদ্ভুত একটা আনন্দের সঞ্চার করে।

    ভয়ংকর একটা প্রতিহিংসার আগুন জ্বলতে থাকে আপাত নিরীহ প্রতিদিন অত্যাচারিতা রুমার মনে। যদিও সবটুকুই মনের চৌহদ্দিতেই সীমাবদ্ধ থাকে।

    মন খারাপ লাগলেই বাড়ির কাছেই দক্ষিনেশ্বরের গঙ্গার ঘাটে এসে বসে রুমা, ওই উথাল পাথাল জলের গভীরতায় বিসর্জন দিয়ে আসে সব দুঃখগুলো। মা বাবার একমাত্র মেয়ে ছিলো রুমা, অতি আদরে কেটেছে ছোটবেলাটা, বিলাসিতা না হলেও অভাব ছিলো না কোনোকিছুর, এমনকি রান্না অব্দি করতে শেখেনি কোনোদিন ভালো করে। খুব সুন্দর গান গাইতে পারতো রুমা, ভেবেছিল গানের স্কুল খুলবে ভবিষতে।

    সেই মেয়ে মা বাবাকে লুকিয়ে এক কাপড়ে চলে এসেছিলো রুদ্রর হাত ধরে।

    সময়ের সাথে সাথে মা বাবা রুদ্রকে মেনে নিলেও রুদ্র কোনোদিনই আপন করেনি তাঁদের। এমনকি রুমারও  বাপের বাড়ি যাওয়ায় কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিলো। তবু রুমা কখনো কখনো লুকিয়ে চলে যেতো মায়ের কাছে।

    মেয়ের জন্য দুবেলা চোখের জলে ভাসেন তাঁরা। রুমার পরিস্থিতির কথা জেনে অনেকবার তাঁরা অনুরোধ করেছেন ফিরে আসার জন্য, কিন্তু রুমা রাজি হয়নি।

    আজ একটু বেলার দিকে বাজার গেছিলো রুমা একটি সংস্থার দেওয়া ত্রাণ আনার জন্যে, ফেরার পথে রোদ এড়াতে গলি পথ দিয়ে ফিরছিলো বাড়ি। “দিদি ও দিদি আমার মেয়েটাকে বাঁচান দিদি” বলে আচমকাই এক মুখে মাস্ক ঢাকা এক মহিলা ছুটে এসে রুমার পায়ের কাছে একটা পুঁটুলি ফেলে রেখে কোথায় যেন ছুটে চলে গেলো। ঘটনার আকস্মিকতায় রুমা তখন  দিশেহারা। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরলো বাচ্চার কান্নার আওয়াজে। তড়িঘড়ি হাতে ধরা ত্রাণের ব্যাগ ফেলে রেখে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নেয় রুমা। মাস তিনেকের বাচ্চাটি কোলের ওম পেয়ে কান্না ভুলে হেসে ওঠে রুমার দিকে তাকিয়ে।

    সন্তান স্নেহে উথলে ওঠে রুমার মাতৃ হৃদয়। ভীষণ এক ভালোলাগা ঘিরে ধরে তাকে। আশেপাশে কিছুক্ষণ খুঁজেও মহিলাটিকে আর দেখতে না পেয়ে কোনো কিছু না ভেবে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসে বাচ্চাটিকে নিয়ে।

    একে এই ভয়ংকর অতিমারী পরিস্থিতি, পুলিশে জানালে এই বাচ্চাকে যদি কোনো হোমে নিয়ে যায় আর সেখানে ঠিকমতো যত্ন না হয়? যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে? না না, রুমা কাউকে দেবে না এ মেয়েকে, ও বুকে করে আগলে বড়ো করবে। এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ের পরিচর্যায় মেতে ওঠে নতুন মা।ছোট্ট মেয়ের নাম দেয় “রেনিসা” কিন্তু সন্ধ্যে গড়াতেই দুশ্চিন্তায় মুখ কালো হয়ে যায় রুমার। রুদ্রকে কি বলবে সে? যদি মেনে না নেয়? যদি পুলিশে খবর দেয়? যদি মারধর করে রুমাকে? 

    কিন্তু রুমা যে এই একরত্তি মেয়েকে কাছছাড়া করতেই পারবে না। যখন এই মেয়ের আসল মা এসে মেয়েকে ফেরত চাইবে তখন কি করবে সে? নানারকম চিন্তায় মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকে সে। 

    বেশ অনেক রাতে প্রচন্ড নেশাগ্রস্ত হয়ে রুদ্র ফিরলো বাড়িতে। রাতে কিছু বুঝতে না পারলেও সকালে প্রচন্ড চমকে গেলো বাচ্চাটাকে দেখে।

    যথারীতি অশান্তি শুরু করে দিলো। কিন্তু রুমার জেদের কাছে হার স্বীকার করতে বাধ্য হলো তখনকার মতো।

    রুমা ভাবলো রুদ্র হয়তো মেনে নিলো বাচ্চাটিকে, কিন্তু রুমার ভাবনা যে কতোটা ভুল, তার চরম প্রমাণ পেলো এক সপ্তাহ পরেই।

    “কাল সকালে বাচ্চাটাকে সকাল সকাল তৈরি করে দেবে, ওকে নিয়ে এক জায়গায় যাবো” রুদ্রর এই কথায় অবাক হয়ে যায় রুমা।
    -“এই করোনা পরিস্থিতিতে ছোট বাচ্চাকে নিয়ে তুমি কোথায় ঘুরতে যাবে? এই কদিনে একবারও তো কোলে নাও নি!” রুমার কথার উত্তরে রুদ্র আবার বলে ওঠে, “এক নিঃসন্তান দম্পতির সঙ্গে কথা বলেছি, এই বাচ্চাটার বিনিময়ে দু’ লক্ষ টাকা দেবেন ওনারা,  খুব বড়ো লটারী পেয়ে গেছি আমি, এই করোনা পরিস্থিতি চলুক কতদিন চলবে, আমার চিন্তা নেই, ঘরে বসে লাখপতি হয়ে দিন কাটাবো রাজার হালে..” বলে হা হা করে হাসতে থাকে রুদ্র।

    “নাআআআ কক্ষনো নয়, এ মেয়ে আমার কাছে গচ্ছিত, ওর মা যখন ফেরত চাইতে আসবে, কি জবাব দেব আমি তাকে?” গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে রুমা।

    “কি বললি? আমার হাতের লক্ষ্মী কেড়ে নিবি তুই? আজ তোকে মেরেই ফেলবো” বলে অকথ্য অত্যাচার চালায় সেদিন রুদ্র। রুমার চিৎকারে পাড়া প্রতিবেশীরা ছুটে এসে বাঁচায়।

    যদিও রুদ্রর তাতে হেলদোল নেই বিশেষ।আকণ্ঠ পান করে রুমাকে আরো একবার হুমকি দিয়ে শুয়ে পড়ে সেদিনের মতো।

    সারারাত মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকে রক্তাক্ত রুমা। তার এই একরত্তি মেয়েই তার জীবনের নতুন আলোর দিশা, মেয়ের জন্যই ওকে বাঁচতে হবে। মেয়েকে রক্ষা করতেই হবে। সব অত্যাচারের জবাব দিতেই হবে এবার। গত পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে অনেক আগেই  যে দৃঢ় পদক্ষেপ রুমার নেওয়া উচিৎ ছিলো আজ তার ছোট্ট মেয়ে সেই মনোবল জুগিয়েছে ওকে। ভোর রাতে উঠে মেয়ে নিয়ে রওনা হয় পুলিশ স্টেশনের দিকে। রুদ্রর বিরুদ্ধে 498(A)  ধারায় case দিয়ে পুলিশের সহায়তায় পৌঁছে যায় তার বাপের বাড়ি।
    বাবা মা যেন রুমাকে ফিরে পেয়ে যেন হাতে চাঁদ পান।
    রুমার কোলে ছোট্ট রেনিসাকে দেখে আনন্দের হাট বসে যায় বাড়িতে | 

    এই ভয়ংকর অতিমারী হাজার হাজার মানুষের প্রাণঘাতী হয়েও জাগিয়ে তুলেছে মানুষের মধ্যে প্রাণপণ বাঁচার আশা। সব খারাপই খারাপ নয়, কিছু ভালো চেতনার উপহারও বটে।

  • গল্প

    গল্প- মায়া

    মায়া
    -পায়েল সাহু

     

     

    এলাটিং বেলাটিং শৈল,
    কিসের খবর আইলো
    রাজামশাই একটি বালিকা চাইলো……

    পাগলীটা গেয়ে যায় সারাদিন একই গান, ছেঁড়াখোঁড়া শাড়ি, বয়সের গাছ পাথর নেই, সে বুড়ি কি খায়, কোথায় থাকে কে জানে, কিন্তু রায়চৌধুরী বাড়ির চারপাশেই শুধু ঘুরে বেড়ায়, তাও আবার সন্ধ্যে হলেই।

    রায়চৌধুরী বাড়ির সংলগ্ন বহু বছরের জাগ্রত শিব মন্দির, রায়চৌধুরী গিন্নী মানত করেছেন এবার যেন তার বৌমার অহনার গর্ভে একটি কন্যা সন্তান আসে।

    একটু অবাক হলেন তো শুনে? সবার মতো পুত্র সন্তান কামনা না করে কন্যা কেন? সেটা জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে কয়েকশো বছর।

    অত্যাচারী উগ্র জমিদার দুস্মন্ত রায় চৌধুরীর শাসনে প্রজারা অতিষ্ঠ। খাজনা মেটাতে না পারলেই ঘরের বৌ ঝিদের ধরে নিয়ে যায় জমিদারের পেয়াদারা| বেশ কিছুদিন পর যখন ফিরিয়ে দিয়ে যায় তখন হয় কেউ জীবন্ত লাশ, নয়তো ফেরে মৃতদেহ হয়ে।
    জমিদার বাবুর চারজন স্ত্রী, কেউই তাকে পুত্র সন্তান দিতে পারেননি, প্রতিবারই কন্যা জন্মেছে আর জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মুখে নুন দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। তবু জমিদার বাবু আশা ছাড়েন না পুত্র সন্তানের, ফি বছর তাঁর একজন বা দুজন স্ত্রী গর্ভবতী হন। তার চতুর্থ স্ত্রীর এটি দ্বিতীয় সন্তান হতে যাচ্ছে।

    আতঙ্কে আশংকায় রায় চৌধুরী ছোটো গিন্নী বাড়ির সংলগ্ন শিব মন্দিরে দিবারাত্র মাথা কুটে মরেন তার সন্তানের আয়ু কামনা করে|
    যথা সময়ে তিনি একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেন। ধাই মা-রা জমিদারের কাছে সে খবর পৌঁছে দিলে জমিদার তার কন্যা সন্তানকে মেরে তৎক্ষণাৎ জলে ভাসিয়ে দেওয়ার হুকুম দেন।
    ওদিকে আঁতুড়ঘরে জ্ঞান ফেরার পর ছোট গিন্নী সব শুনে কাঁদতে কাঁদতে জমিদারকে অভিশাপ দেন তাঁর বংশে এরপর থেকে শুধু পুত্র সন্তানই জন্মাবে, যে পরবর্তী কালে হবে তার পিতৃহন্তা। যদি কোনো ভাবে কখনো বংশানুক্রমে কন্যা সন্তান জন্ম নেয় এবং তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয় সেই কন্যা মুক্ত করবে এই অভিশাপ।
    এরপর তিনি ওই শিব মন্দিরের ত্রিশূল বুকে ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করেন, শিবলিঙ্গ স্নান করে রক্তে।

    সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অভিশাপ ফলবতী হয়। জমিদার দুস্মন্ত রায়চৌধুরীর ছেলে জন্মায়, নির্বাণ রায়চৌধুরী। সেও বাবার মতোই অত্যাচারী হয়ে ওঠে। ছোটো থেকেই তার বাবার পাওয়া অভিশাপ সম্পর্কে সে বেশ ভালোই অবগত। আর তাই তিনি অভিশাপ খন্ডনের জন্য হয়ে ওঠেন পরম শিবভক্ত। কিন্তু এই শিব পূজা নিয়ে তার বাবা দুস্মন্ত রায়চৌধুরীর সঙ্গে চরম মতবিরোধ শুরু হয়, এমন কি দুস্মন্ত মন্দিরটি ভেঙে ফেলারও হুকুম দেন, তখন নির্বাণ গুপ্তচর লাগিয়ে নিজের বাবাকে হত্যা করেন।
    এরপর নির্বাণ যথাসময়ে বিবাহ করেন, এবং তার দৃঢ় বিশ্বাস যে তার শিবভক্তির কারণে অভিশাপ কিছুতেই ফলবে না, কিন্তু তার পুত্র সন্তান জন্মের রাতেই সাপের কামড়ে তিনি মারা যান।
    এরপর থেকে শুরু হয় এক অলৌকিক ঘটনা। প্রতি রাতে প্রবল ঘন্টাধ্বনি সহকারে শুরু হয় শিবের মন্দিরে পূজা। পূজারীকে দেখা যায় না কিন্তু প্রতিদিন সকালে শিবলিঙ্গের ওপর ফুল মালা দেখা যায়। সকলের মনে হতে থাকে জমিদার নির্বাণ রায়চৌধুরীর আত্মা আসেন পুজো করে নিজের বংশের অভিশাপ খণ্ডন করতে। সেই থেকে আজও এই অলৌকিক ঘটনা ঘটে চলেছে।
    জমিদারের জমিদারি বহুদিন অবলুপ্ত, কিন্তু বংশের একমাত্র পুত্র সন্তান যখনই পরবর্তী কালে পুত্র সন্তানের পিতা হন, তারপরেই কোনো না কোনো কারণে তিনি মারা যান।
    এই বাড়ির নববধূ অহনা, তার জন্মকাহিনীও বেশ অদ্ভুত। সদ্যজাত মেয়েটি পড়ে ছিলো আস্তাকুঁড়ে আর একটি বিরাট সাপ ফণা তুলে তাকে পাহারা দিচ্ছিলো। অনেক মানুষ ভক্তিভরে তাকে দুধ কলা দিয়ে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে, বাচ্ছাটিকে নেওয়ার প্রয়াস করলেও সেই চেষ্টা বিফল হয়।
    সেই রাতে ওই পথ দিয়ে ফিরছিলেন এক নিঃসন্তান দম্পতি। জায়গাটি তখন প্রায় জনশুন্য, শিশু কন্যাটিকে দেখে তাঁদের চোখে জল এলেও তাঁরা সাপের ভয়ে এগোতে পারেননি, দূর থেকে প্রণাম করে চলে যাচ্ছিলেন, আর তখনই হঠাৎ সেই সাপ ফণা নামিয়ে চলে যায়। ঈশ্বরের দান মনে করে সেই কন্যাসন্তানকে তাঁরাই লালন পালন করেন। কিন্তু কখনোই এই মেয়েকে তার জন্ম বৃত্তান্ত জানতে দেন নি।

    অহনা এ যুগের মেয়ে, যথেষ্ট শিক্ষিতা এবং চাকুরীরতা, সব কিছু জেনে শুনেই সে রায়চৌধুরী বাড়ির ছেলে প্রলয়কে বিয়ে করেছে | বিয়ের পর থেকে শ্বশুর বাড়ির সন্নিকটের এই শিব মন্দিরের অলৌকিক ঘটনা দেখে আসছে এবং বহুবার চেষ্টা করেছে সন্ধে থেকে মন্দিরে গিয়ে সারারাত কাটিয়ে এই রহস্যভেদ করতে। অহনার আগে যারাই এই রহস্যভেদ করার চেষ্টা করেছে তাঁদের প্রত্যেকের মৃতদেহ পাওয়া গেছে পরের দিন ভোরবেলা। কিন্তু অহনা যেদিন রাতেই মন্দিরে থেকেছে সে রাতেই আশ্চর্য জনক ভাবে এতো বছরের অলৌকিক ঘটনা ঘটেনি শুধু কিছু ফুল মালা পাওয়া গেছে মন্দিরের দরজায়।

    বিয়ের বছর দুই পরে অহনা এখন সন্তান সম্ভবা আর নিজের ছেলের প্রাণভিক্ষার জন্যই রায়চৌধুরী গিন্নী কাতর প্রার্থনা করে চলেছেন যাতে অহনার গর্ভে কোনো পুত্র সন্তান না আসে কারণ বংশের অভিশাপ অনুযায়ী পুত্র সন্তান জন্মালেই তার ছেলের মৃত্যু ঘটবে।

    অহনা আজকাল একটু চিন্তায় থাকে, শাশুড়ির কান্না আর রাতদিন ঠাকুর পুজোয় সে ভাবতে থাকে তবে কি সে গর্ভবতী হয়ে ভুল করলো? বিশেষ করে যখন থেকে জানা গেছে তার গর্ভে একটি নয়, দুটি সন্তান, শাশুড়ি পুজো করা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁর স্থির বিশ্বাস নিশ্চয়ই দুটোই ছেলে হবে যদিও প্রলয়ের কোনো ভাবনা চিন্তা নেই, “যা হবে দেখা যাবে” একথা বলে সান্তনা দেয় মা আর বৌকে।

    এসব ভাবতে ভাবতেই অফিস থেকে ফেরার সময় একদিন অহনা আনমনে হাঁটার সময় রাস্তায় হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হতেই আচমকা দুটো শক্ত হাত তাকে জড়িয়ে ধরে। অবাক হয়ে অহনা দেখে তার বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়ায় যে পাগলিটা সন্ধ্যে হলেই; সে এসে তাকে জড়িয়ে ধরেছে, অদ্ভুত সুন্দর এক গন্ধ সেই পাগলীর গায়ে, কেমন যেন “মা মা গন্ধ” অহনা নিজেকে সামলে কিছু বলে ওঠার আগেই পাগলীটা ওকে ছেড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি কোথায় যেন চলে যায়।
    সেদিনের পর থেকে ওই পাগলীটা কোথায় যেন হারিয়ে গেলো।

    ঠিক এর একমাস পরে একদিন ভোর রাতে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসে অহনা।
    স্বপ্নে সে দেখে ভীষণ সুন্দরী এক বিবাহিতা রমণী তাকে এসে বলছে “তোর গর্ভে আমার মেয়ে ফিরে এসেছে রে মা, তবে আমার অভিশাপ অনুযায়ী একটি ছেলেও আছে তোর গর্ভে, বহু বছর আগে যে অভিশাপ আমি দিয়েছিলাম তা যদি খণ্ডন করতে চাস তবে তোর ছেলের জন্মের একমাস পর শিব মন্দিরের লিঙ্গ ওই ছেলের রক্তে স্নান করাবি, তবেই সারাজীবনের মতো শাপমুক্তি ঘটবে” এই কথা বলে তিনি মিলিয়ে যান।
    স্বপ্নে দেখা রমণী অহনার অচেনা হলেও তাঁর চোখের দৃষ্টিটা যেন সেদিনের সেই পাগলীটার মতোই।

    এমন ভয়ানক শাপ মুক্তির কথা ভাবতেই শিউরে ওঠে অহনা, তবু কাউকে কিছু না বলে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় শিব মন্দিরের দিকে।
    মন্দিরে গিয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ওখানেই জ্ঞান হারায়। বেশ কিছুক্ষণ বাদে অনেক লোকের হইচই শুনে তার জ্ঞান ফিরলে সে দেখে তার মাথার কাছে বিরাট বড়ো এক সাপ ফণা তুলে বসে আছে আর তাই দেখে মন্দিরে পুজো দিতে আসা লোকেরা হৈচৈ করছে।

    অহনা ধীরে ধীরে উঠে বসতেই সাপটা কোথায় যেন চলে যায়। এই ঘটনা চারদিকে চাউর হয়ে যেতে অহনার মা বাবা এসে অহনার জন্ম বৃত্তান্ত জানান অহনার শ্বশুর বাড়িতে এসে। সমস্ত কথা শুনে অহনা মনে এক অদ্ভুত জোর পায়। তার মনে হয় ভগবান তার সহায়, কোনো বিপদ আর তার হবে না। যদিও তার স্বপ্নের কথা সে বাড়ির কাউকে জানায় না, মনে মনে ঠিক করে সে এর শেষ দেখে ছাড়বে।

    নিদির্ষ্ট সময়ে অহনা তার যমজ সন্তান একটি ছেলে ও একটি মেয়ে প্রসব করে।
    বাড়িতে খুশির ঢেউ বয়ে যায়। ঠিক একমাস পর এক রাতে অহনা তার ছেলেকে নিয়ে সবার অগোচরে উপস্থিত হয় সেই মন্দিরে, ঠিক যখন সেখানে প্রবল ঘন্টাধ্বনি সহকারে সেই অলৌকিক পূজারী পূজা করে চলেছেন। অহনা মন্দিরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে মন্দির শান্ত হয়ে যায়, কোথাও কোনো শব্দ নেই আর। নিজের বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটার শব্দ ছাড়া অহনা আর কিছু শুনতে পাচ্ছে না তখন।
    নিজের স্বামীর মঙ্গল কামনায়, শ্বশুরবাড়ির অভিশাপ কাটাতে চরম সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে আজ | স্বপ্নে পাওয়া আদেশ অনুযায়ী সে তার ছেলেকে তুলে ধরে মন্দিরের শিব লিঙ্গের ঠিক উপরে, চোখ বন্ধ করে অঞ্জলি দেওয়ার মতো করে ছেলেকে ফেলে দেয় শিব লিঙ্গের ওপর। ঠিক পরমুহূর্তেই তীব্র কান্নার আওয়াজ শোনার জন্য যখন সে প্রস্তুত, কোনো আওয়াজ না পেয়ে সে তাকিয়ে দেখে সেই পাগলী নিজের কোলে শুইয়ে আদর করছে অহনার ছেলেকে, আনন্দে চিৎকার করে উঠে পাগলীর পা ধরে কেঁদে ফেলে অহনা।

    “ওঠ মা, আমি পারলাম না তোর সন্তান কেড়ে নিতে। বহু বছর আগে স্বামীর অত্যাচারে সন্তান হারানোর শোকে যে অভিশাপ দিয়েছিলাম, আজ তোর কোলে সন্তান ফিরিয়ে দিয়ে তার শাপমুক্তি ঘটালাম।” অহনা দেখে কোথায় সেই পাগলী ভিখারি, এক অপরূপা রমণী তার কোলে ছেলেকে তুলে দিয়ে মন্দির প্রাঙ্গন ছেড়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছেন। “মা যেও না, যেও না, দাঁড়াও..” বলে চিৎকার করে ওঠে অহনা।
    ততক্ষণে ভোর হয়েছে, অহনা আর ছেলেকে বাড়িতে কোথাও দেখতে না পেয়ে প্রলয় ছুটে এসেছে মন্দিরে।
    অহনা সব কথা খুলে বলে প্রলয়কে।
    দুজনে সাষ্টাঙ্গে দেবাদিদেব মহাদেবকে প্রণিপাত করে শাপমুক্ত জীবনের সূচনা করে।
    তারপর থেকে মন্দিরে আর কোনোদিন রাতে কেউ ঘন্টাধ্বনি শুনতে পায় নি।

  • গল্প

    গল্প- সুখের আশায়

    সুখের আশায়
    -পায়েল সাহু

     

    ভীষণ দ্বিচারিতায় ভুগছে নয়না, এতটা দ্বন্দ্ব তো সন্দীপের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর সময়েও হয় নি। সব কিছু আছে তার, তবু মনে সুখ নেই, সব কিছুর ঊর্ধে শরীরের সুখটাই তার কাছে বড়ো। মাঝে মাঝেই কেঁদে ফেলে এই না পাওয়াটুকুর জন্য আর ভাবে কই আর পাঁচজন তো তার মতো এই অ-সুখে নেই |
    হোয়াটস্যাপে মেসেজ করার পর দীর্ঘক্ষণ কেটে গেছে, সন্দীপ মেসেজ দেখেনি। খানিক বিরক্ত হয়েই ফোন করে সন্দীপকে। প্রথম বার রিং হয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয় বারে ফোনটা তোলে সন্দীপ। “ভীষণ কাজের চাপ, পরে কথা বলছি ” বলেই নয়নাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে দেয় সন্দীপ। তারপরেও নয়না আরো কয়েকবার ফোন করে কথা বলার জন্য, কিন্তু প্রতিবারই অপরদিকের নারীকণ্ঠ বলে ওঠে নাম্বারটি ব্যস্ত আছে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে নয়না।

    নয়না, বছর ছত্রিশের গৃহবধূ। ছেলে মেয়ে ও সরকারি চাকুরে স্বামী নিয়ে তার ভরা সংসার। বাবার একমাত্র মেয়ে হওয়ায় একটু বেশি আদুরী, একটু জেদী তবে স্বামী তার মাটির মানুষ, কখনোই নয়নার কথার বাইরে কোনো কাজ করেন না।
    নয়না খুব হাসি খুশি মিশুকে একটি মেয়ে, বন্ধু বান্ধবীদের আড্ডায় সবসময় সেই হয়ে ওঠে মধ্যমণি। আত্মীয় স্বজনের সঙ্গেও তার মিষ্টি ব্যবহারে সকলেই তাঁকে বেশ ভালোবাসেন।
    নয়নার সমস্যাটা একান্তই গোপন। বিয়ের পর হানিমুনে গিয়ে নয়না বুঝতে পারে তার বর শারীরিক ভাবে বেশ দুর্বল, নিজের স্ত্রীকে পূর্ণ তৃপ্তি দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর নেই। সেই থেকে শুরু নয়নার টানাপোড়েনের জীবন। নয়না বরকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে একরকম জোর করেই ডাক্তারের কাছে পাঠায়, আর নিজেকে বোঝায় সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ডাক্তারের কাছে গেলেও নয়নার স্বামী রজত কোনোদিনই কোনোরকম ওষুধ খেতো না,উল্টে অজুহাত দিতো ওই ওষুধ তার শরীরের ক্ষতি করে দেবে।| নয়নার হাজার অনুরোধ উপরোধের ফল হয় উল্টো, রজত ক্রমশ নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে থাকে, এমনকি ছুটির দিনেও অফিস যাওয়া শুরু করে।
    ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়ে নয়না। টিভি,গল্পের বইও যেন একাকিত্ব কাটাতে পারে না। বছর খানেক পর গানের চর্চাটা আবার শুরু করতে নতুন করে ভর্তি হয় গানের ক্লাসে। এখানেই আলাপ হয় সন্দীপের সঙ্গে। অফিসের পর অবসর কাটাতে গিটার বাজিয়ে গান করা সন্দীপের প্ৰিয় কাজ।
    সন্দীপ নয়নার চেয়ে প্রায় আট বছরের ছোটো হলেও দুজনের মধ্যে সুন্দর একটি বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বন্ধুত্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে দুজনে সারাদিনের যাবতীয় কথা একে অপরকে না বললে যেন শান্তি পায় না। দুজনের বন্ধুত্ব কখন যে প্রেমের সম্পর্কে পৌঁছে গেছে ওরা নিজেরাও বুঝতে পারে না, হয়তো নয়নার চোখের জল আর অসহায়ত্ব অবিবাহিত সন্দীপকে বাধ্য করে নয়নাকে কাছে টানতে।

    রজতের মা বাবা গ্রাম থেকে এসেছেন ছেলে বৌয়ের কাছে কিছুদিনের জন্য বেড়াতে।
    “বিয়ের তো পাঁচ বছর পার হয়ে গেলো বৌমা, আমরা কি আর নাতি নাতনির মুখ দেখতে পাবো না? আর কতদিন আছি তার কি ঠিক আছে!” রাতের খাবার টেবিলে বসে সবার সামনেই রজতের মা বলে ওঠেন নয়নার দিকে তাকিয়ে। নয়না কথাটা শুনে রজতের দিকে তাকাতেই চোখ নামিয়ে নেয় রজত। “আসলে রজতের কাজের খুব চাপ মা, বাড়িতে একদমই সময় দিতে পারে না আর আমি একা কি করে বাচ্চা সামলাবো বলো? তাই ভাবা হয়নি ওই বিষয়ে” নয়নার উত্তরে রজতের মা ছেলের দিকে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন “কি ব্যাপার বাবু?এসব কি শুনছি? আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না, ছয় মাস সময় দিচ্ছি, এর মধ্যেই সুখবর শুনতে চাই আমি।”
    নয়নাকে অবাক করে দিয়ে পরের সপ্তাহেই রজত কলকাতা শহরের একজন নামী গাইনোকোলজিস্টের এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে ফেলে। কিন্তু ততদিনে রজতের প্রতি নয়নার মনে ভীষণ একটা ঘৃণা জন্ম নিয়েছে। গত চার বছর ধরে সন্দীপের সঙ্গে শারীরিক মিলনে সে তৃপ্ত আর সেই তৃপ্তি দূর করেছে তার মনের যাবতীয় হতাশা।

    দেখতে দেখতে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার দিন চলে আসে। নয়না অনেক ভেবেও কোনো উপায় বের করতে এই এপয়েন্টমেন্টটা ভেস্তে দিতে পারে নি।
    ডাক্তার বাবুর কাছে রজত নিজে থেকে তাঁর শারীরিক যাবতীয় সমস্যার কথা বলে। ডাক্তার বাবু বেশ কিছু ওষুধ আর ইনজেকশন লিখে দেন রজতকে, একমাস পর রিপোর্ট দিতে বলেন।
    নয়না পড়ে মহা বিপদে, এই মুহূর্তে তার যা মানসিক পরিস্থিতি তাতে সন্দীপ ছাড়া আর কারোর সঙ্গেই শারীরিক মিলন সম্ভব নয় তার পক্ষে, হ্যাঁ সে নিজের স্বামী হলেও নয়। সন্দীপের সঙ্গে প্ল্যান করে সে রজতের ওষুধের শিশি থেকে ওষুধ ফেলে দিয়ে একই রকম দেখতে ভিটামিন ক্যাপসুল ঢুকিয়ে রাখে, আবার কোনোটায় এন্টাসিড ট্যাবলেট। কিন্তু বদলাতে পারে না ইনজেকশনগুলো, ওগুলো রজত নিজেই সময়মতো ডাক্তারের কম্পাউন্ডারের কাছ থেকে নিয়ে আসে।
    ইনজেকশন এর দৌলতেই হোক বা মানসিক দৃঢ়তার কারণেই হোক রজত নয়নার সঙ্গে শারীরিক মিলনে সক্ষম হয় খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও |
    নয়নার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে, এতগুলো বছর ধরে সে যা চেয়েছে আজ সত্যি হতে দেখেও সে খুশি হতে পারে না কিছুতেই, আসলে মানসিক ভাবে ভীষণ একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে ততদিনে, শুধু সমাজ, নিজের মা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ডিভোর্স না নিয়ে দমবন্ধ করে সংসার করতে সে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এখন রজতের এই সঙ্গ তাও শুধু সন্তান উৎপাদনের জন্য, সহ্য হচ্ছে না কিছুতেই নয়নার।
    সন্দীপকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে নয়না।
    হঠাৎই সন্দীপের কাছে অদ্ভুত এক দাবী করে বসে নয়না, যদি তার গর্ভে সন্তান আনতেই হয় তবে তা যেন সন্দীপের হয়, রজতের সন্তান সে চায় না।
    অদ্ভুত এক ভালোলাগায় ভেসে যায় সন্দীপ।

    দু মাস পরের কথা, নয়নার প্রেগন্যান্সি টেস্ট আজ পসিটিভ এসেছে। এতো শীঘ্র সুখবর আসাতে রজত একাধারে খুশি হলেও একটু অবাকও হয়েছে তার এই সাফল্যে। নিজের সুস্থতায় তার সম্পূর্ণ বিশ্বাস না হলেও সন্তান আসার খবরে সে মনের সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে দেয়। বরং স্বস্তি পায় এই ভেবে যে ভবিষ্যতে নয়নার সঙ্গে শারীরিক মিলন না করলেও চলবে তার, সন্তান লাভের জন্যই তো তার এতো প্রচেষ্টা, সেটা ভীষণ ভাবে সফল তাই এসব নিয়ে আর না ভাবলেও চলবে |
    অন্যদিকে সন্দীপও আনন্দের সাগরে ভেসে যায়।তবে শারীরিক কিছু জটিলতা এবং গর্ভস্থ যমজ বাচ্ছার জন্য ডাক্তারের পরামর্শমতো নয়নার বাড়ি থেকে বেরোনো সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
    সন্দীপের সঙ্গে যোগাযোগ এখন কেবল মাত্র ফোনেই। কিন্তু নয়নার শারীরিক কারণে আস্তে আস্তে সেটাও কমতে থাকে ধীরে ধীরে।

    সন্দীপ, অসম্ভব সুপুরুষ একটি ছেলে। চাকরি মোটামুটি করলেও তার রূপের জোরে এবং দারুণ গিটার বাজানোর জন্য প্রচুর মেয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। বলাই বাহুল্য সন্দীপ দারুণ এনজয় করে পুরো ব্যাপারটা।
    প্রায় প্রতিদিনই তার শয্যা সঙ্গিনী বদলানো অভ্যাসে পরিণত হয়। সন্দীপ যে এই সব মেয়েদের ভালোবাসে তা নয়, শুধু সুযোগের সদব্যবহার করে। অবশ্য মেয়েরাও প্রেমের জোয়ারে ভেসে সন্দীপের কাছে নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়।
    এহেন চরিত্রের ছেলে হয়েও নয়নার সঙ্গে কিভাবে এতো গভীর ভাবে জড়িয়ে পড়ে, সন্দীপ নিজেও ভেবে পায় না। নয়নার সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার পর আর কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতেও তার ইচ্ছে করেনা আজকাল। নয়নাকে সে কোনোদিন বিয়ে করে সংসার করতে পারবে না জেনেও পাগলের মতো ভালোবাসে সন্দীপ। নয়নার মুখের একটু হাসির জন্য সে তার জীবন অব্দি বাজি রাখতে পারে। নিজেকে অনেকবার প্রশ্ন করেছে এতো প্রেমের কারণ কি? কি লাভ এই ভালোবাসায়? কোনো উত্তর পায়নি, শুধু বুঝেছে এই সম্পর্কটা ওকে সুখে রেখেছে। অনেকবার সরে আসতে চেয়েছে মনে মনে, কিন্তু নয়না সামনে এসে দাঁড়ালেই তার সব ভাবনা, সব হিসেব গুলিয়ে যায়।
    নয়না যেদিন বললো ও তার বিবাহিত স্বামী রজতের নয়, সন্দীপের সন্তানের মা হতে চায়, জীবনটা ধন্য হয়ে গেছিলো। আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলো নয়নার চাহিদা পূরণ করতে।
    যেদিন নয়না প্রেগন্যান্সির রিপোর্টটা জানালো মনে হয়েছিলো স্বর্গ সুখ বুঝি একেই বলে। এখন নয়নার সঙ্গে দেখা তো দূর, কথা অব্দি হয় না, প্রথম দুমাস নিয়মিত কথা হতো, কিন্তু তারপর থেকে নয়নার শরীরে নানারকম জটিলতা দেখা দেয়, ডাক্তারও ফোন থেকে দূরে থাকতে বলেন। আজ ছয় মাস ওদের কথা হয় নি।| কোনো অছিলায় যে নয়নার বাড়ি যাবে সে উপায়ও নেই, কারণ ওখানে কেউই ওকে চেনে না, কোনোদিন যায়ওনি। সন্দীপ ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে ওঠে নয়নার জন্য। তার গিটারের সব সুর যেন শেষ হয়ে গেছে। দিনগুলো যেন দীর্ঘশ্বাসে কাটছে তার। একসময়কার প্লে বয় আজ চোখের জল ফেলছে প্রেমিকার চিন্তায়।

    নার্সিংহোমে যাওয়ার আগে নয়না ফোন করে সন্দীপকে। যদি ফিরে না আসে, যদি আর কথা না হয় সেই আশঙ্কায়। ফোনে কথার বদলে দুজনে দুজনের কান্নার শব্দ শোনে কিছুক্ষণ।
    পরদিন সকালে সন্দীপের হোয়াটস অ্যাপে ছবি আসে তার দুই ফুটফুটে সন্তানের, একটি ছেলে ও অপরটি মেয়ে। আনন্দে উদ্বেল সন্দীপ ভীষণ খুশি হয়েও হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে কোনোদিন তার সন্তানদের অধিকার না পাওয়ার হতাশায়। হঠাৎ তার মনে হতে থাকে মস্ত বড়ো ভুল সে করে ফেলেছে। সে কোনোদিন কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারবে না তার সন্তানদের, তার সামনেই তার সন্তানরা অন্য একজনকে বাবা বলে ডাকবে। সারাজীবন এগুলো সে সহ্য করবে কি করে? নয়না কোনোদিন তাকে বিয়ে করবে না, তাহলে? এতো বড়ো ভুল সে কি করে করে ফেললো শুধু নয়নার মন রাখতে গিয়ে। কেন একবারও ভেবে দেখলো না তার নিজের ভবিষ্যত?
    প্রশ্নগুলো সারাদিন রাত সন্দীপের মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। নয়না আবার আগের মতো ফোন করছে, মেসেজ করছে, কিন্তু সন্দীপ যেন খেই হারিয়ে ফেলেছে।
    বাচ্ছাদের বয়স এখন তিন মাস, নয়নাও সুস্থ হতেই সন্দীপের সঙ্গে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। বাচ্ছাদের দেখে যেতে বলছে বাড়ি এসে।
    কিন্তু সন্দীপ রোজই কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে নয়নাকে। আসলে বাচ্ছাদের দেখলে সে নিজেকে কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারবে না। হয়তো কেঁদে ফেলবে সবার সামনেই।
    অনেক ভেবে সন্দীপ স্থির করে সম্পর্কটা এবার শেষ করতেই হবে, নাহলে সে কিছুতেই ভালো থাকতে পারবে না। কলকাতার বাইরে চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা পাকা করে ফেলে সে খুব দ্রুত।

    বেশ সুন্দর একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে নয়নার সঙ্গে তার বাচ্ছাদের ডাক্তারের। চেম্বার ছাড়াও প্রায়ই ফোনে কথা চলে দুজনের। নয়না বোঝে ডাক্তার বাবু ওর প্রেমে পড়েছেন। নয়নার যে খুব খারাপ লাগে তা নয় কিন্তু সন্দীপ? ও কি ভাববে? ও যদি জানে নয়না নতুন একজনের সঙ্গে প্রেম করছে কি বা ভাববে সে… কিন্তু সন্দীপ যেন কেমন বদলে গেছে। বার বার ফোন বা মেসেজ পেয়েও সন্দীপ কোনো উত্তর দেয় না, কথা বললেও কেমন যেন বিরক্ত হয়ে উত্তর দেয়। নয়নার ভীষণ মন খারাপ হয় আর তাই সে ডাক্তারবাবুকে ফোন করে মন হালকা করে।
    নয়না একসময় ভাবতো সন্দীপই তার জীবনের একমাত্র প্রেম কিন্তু এখন সে দিব্বি উপলব্ধি করছে প্রেম জীবনে বারবার আসে, আর যেচে আসা প্রেমকে গ্রহণ করতে হয়। আজ নয়নার বাচ্ছাদের ডাক্তার ওকে ‘অফার’ করেছেন ‘লং ড্রাইভ’- এ যাওয়ার জন্য। দোনামোনা করতে করতে নয়না শেষ ফোনটা আজ করেছিলো সন্দীপকে, কিন্তু সন্দীপ আজও ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোন কেটে দেওয়ায় নয়না সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলে নতুন সম্পর্কে জড়ানোর।

    জীবন এভাবেই এগিয়ে চলে।

    অবিবাহিত সন্দীপ কোনো এক দূর দেশে বসে আজও তার সন্তানদের কথা মনে করে চোখের জল ফেলে, আর নয়না তার বিবাহিত জীবনের সুন্দর সংসারের আড়ালে একের পর এক নতুন সম্পর্কে জড়াতে থাকে কেবলমাত্র শারীরিক সুখের আশায়।

  • গল্প

    গল্প- মনোবল

    মনোবল
    – পায়েল সাহু

     

     

    সময়ের সাথে সাথে অভিজ্ঞতা বাড়ে। সম্পর্কের সমীকরণগুলো পালটে যায়, চেনা মানুষ হয় অচেনা, অচেনা হয়ে ওঠে পরম আত্মীয়।
    ভরসা করার মতো একটা হাত প্রয়োজন হয়।বিশ্বাস করার মতো মন প্রয়োজন হয়। দুঃখের দিনে কাঁদার জন্য একটা কাঁধ প্রয়োজন হয়। সুখের দিনে আনন্দ করার জন্য সঙ্গী প্রয়োজন হয়।
    ছোট থেকে পরিবারের সঙ্গে সমস্ত অনুভূতি ভাগ করে অভ্যস্ত প্রাণগুলো দিশাহারা হয়ে আঁকড়ে ধরে social media তে আলাপ হওয়া মানুষগুলোকে। মনের প্রাণের একই রকম অনুভূতিগুলো তাদের কাছাকাছি এনে জন্ম দেয় নতুন সম্পর্কের।

    আর ঠিক এমনই অবস্থা তিন্নির। মা বাবা দাদাকে নিয়ে তিন্নির সুখী পরিবার, দাদা এখন চাকরি সূত্রে মুম্বাইতে থাকার দরুণ বাড়িতে তারা মাত্র তিনজন । তবে বন্ধুবান্ধবী আর পড়াশোনা নিয়েই সময় কেটে যেত হুল্লোড়বাজ তিন্নির। কিন্তু এই করোনা আবহে সমস্ত কিছু যেন তছনছ হতে বসেছে। লকডাউনের শুরুর দিকে বেশ মন দিয়ে কিছুদিন পড়াশোনা করছিলো, কিন্তু যত দিন যাচ্ছে সেটা থেকেও মন উঠে যাচ্ছে যেন। বন্ধু পাগল তিন্নির মন কাঁদে বন্ধুদের জন্যে, কিন্তু শুরুতে যেভাবে সকলের সঙ্গে ফোনে কথা, ভিডিও কল হতো, এখন আর কারোরই যেন তেমন উৎসাহ নেই, কথা বলার ইচ্ছেটাই নেই কারো | ভীষণ মনমরা সকলেই সারাক্ষণ। অগত্যা উপায় একমাত্র ফেসবুক। সারাক্ষণ প্রচুর মানুষ নানা রকম পোস্ট করে চলেছেন, বেশ ভালোই লাগে তিন্নির। অনেক রকম গ্রূপেও যুক্ত হয়েছে সে, কোনটা লেখালেখির তো কোনোটা রান্নার আবার কোনোটা মজার |
    এই সব কিছুর সঙ্গে জড়িয়েও এতো লোককে নিজের মতো ব্যস্ত থাকতে দেখেও তিন্নি যেন আরো অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কি করবে বুঝতে পারে না, লেখালেখির গ্ৰুপগুলোতে সবাইকে লিখতে দেখে ভাবে সেও কবিতা লিখবে। কিন্তু মৃত্যু, অবসাদ, নিকোটিন, একাকিত্ব এই শব্দগুলো ছাড়া কিছুই যেন লিখে উঠতে পারে না, নিজের ওপর নিজেই বিরক্ত হয়ে ওঠে|
    Social mediaতে আলাপ হওয়া নতুন মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলতে যায়, কিন্তু সকলেই যেন তারই মতো হতাশায় ভরা জীবন কাটাচ্ছেন|
    একটা একটা করে দিন কেটে যায়, প্রতিটা দিনের শেষে সে ভাবে আরো একটা দিন কেটে গেলো তার বোবা অনুভূতিগুলো নিয়ে। এমন ভাবেই একদিন ফেসবুকের একটি লেখালেখির গ্রূপে তিন্নির হঠাৎ চোখে পড়ে একটি অঙ্কন প্রতিযোগিতার নির্দেশকায়, যেখানে লেখা ছিলো সেরা তিনজনকে নিয়ে একটি অনলাইন কর্মশালা তৈরি হবে, বাড়িতে বসেই সেখানে যোগদান করবেন বেশ কিছু বিভিন্ন বয়সের মানুষ, শুধু তাই নয় ঐ কর্মশালা থেকে উপার্জন করা অর্থই হবে প্রতিযোগিতায় বিজেতাদের পুরস্কার |
    তিন্নি ভুলেই গেছিলো যে সে ভীষণ ভালো আঁকতে পারে, তার আঁকা ক্যানভাসে অনেক পরিচিতর বাড়ি সুসজ্জিত। তিন্নি যেন নতুন করে শ্বাস নেয়।নিজেকে প্রস্তুত করে প্রতিযোগিতার জন্যে। সে বুঝতে পারে জীবনের যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে বের হতে গেলে নিজেকেই সবার আগে নিজের পাশে দাঁড়াতে হয়।
    দু সপ্তাহ পর….
    তিন্নি নিজের আঁকা ক্যানভাসগুলোর ছবি বিক্রির মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে ফেসবুককে। বিপুল সাড়া পাওয়ায় উৎসাহিত হয়ে সে নিজেই একটি পনেরো দিন ব্যাপী কর্মশালার আয়োজন করে ফেলেছে সামান্য প্রবেশ মূল্যের বিনিময়ে এবং সেখানেও বেশ ভালোই সাড়াও পেয়েছে, প্রথম প্রয়াস সফল হলে সে দ্বিতীয় পদক্ষেপ নেবে এমনটাই ঠিক করে রেখেছে |

    আজকাল তিন্নি আবার হাসিখুশি থাকে আর ভীষণ ব্যস্তও বটে প্রতিযোগিতায় বিজয়িনী হিসেবে যৌথ অঙ্কন কর্মশালা এবং তার নিজের কর্মশালা নিয়ে।

    নিজের সমস্ত মানসিক অসুস্থতা দূর করে সে ফিরে এসেছে আবার জীবনের মূল স্রোতে যেখানে তার সঙ্গী সাথীদের থেকেও তার বেশি প্রয়োজন তার নিজের অভিজ্ঞতা আর অর্জিত সাইকোলজির বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে অবসাদ গ্রস্ত হয়ে পড়া বিভিন্ন পরিচিত, অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের মনোবল বাড়ানো, তাঁদের মুখে নতুন করে হাসি ফিরিয়ে দেওয়া |

  • কবিতা

    কবিতা- ভালো থাকিস

    ভালো থাকিস
    – পায়েল সাহু

     

     

    দেখলি কেমন হারিয়ে গেলাম
    হঠাৎ করেই বদলে গেলাম
    ভেবেছিলি নাকি এমন হবে?
    হাত বাড়ালেই ছুঁতিস যাকে
    দিবারাত্র তোর গন্ধ মেখে
    বেঁচে থাকার গান সকালসন্ধে
    কি হলো এমন হারিয়ে দিলি
    জোর করে তাকে তাড়িয়ে দিলি
    তাড়াবি যদি কেন টানলি?
    বুকের মাঝে জায়গা দিলি?
    ভালবেসে এতো কষ্ট দিলি?
    দ্যাখ না একবার চোখটি তুলে
    গেলি নাকি তার মুখটি ভুলে?
    দিনরাত তার বকম বকম
    লাগত খারাপ যখন তখন
    তুই ছাড়া যে কেউ নেই আপন
    এটাই ছিল একমাত্র কারণ।
    তুই হয়তো ভালোই আছিস
    ধুলো ঝেড়ে বেঁচে গেছিস।
    শোন না ওরে, শিখিয়ে দে না
    ভালোবেসে ঠকানোর মন্ত্রখানা
    আমিও বাঁচি জীবন খানা
    আর সয়না এ যন্ত্রণা!
    দিন রাত সব একই লাগে
    অসহায় প্রাণ শান্তি খোঁজে
    শান্তি সে তো তোর কোলেতে
    তোর হাসিতেই মন গলে যে!
    কিসের এত কান্না বলতো
    মন গলানোর চেষ্টা যত।
    শুরু থেকেই যে করেছি ভুল
    এখন তার দিচ্ছি মাসুল
    ভরসা শুধুই চোখের জল
    ভোলায় দুঃখ অবিরল।
    শোননা ওরে, বলছি আমি
    মন নিয়েছিস অনেক দামী।
    সেই যে এক মধ্য রাতে
    মন নিয়েছিস চুপিসাড়ে
    ফিরিয়ে দে যেমন ছিল
    ধুলো মাখা, কাঁটাওলা
    সঙ্গে দিস কয়েকটা বছর
    ভালবাসার রং মাখা ভোর
    মিথ্যে যত স্বপ্ন আশা
    মিথ্যে যত স্বপ্নে ভাসা।
    মন কেমনের ঠিক ওপারে
    রয়েছিস যে তুই দাঁড়িয়ে
    রইলি নাহয় মুখ ফিরিয়ে
    ভাল মন্দ যা কিছু আমার
    মনে মনেই বলবো তোরে
    তুই ছাড়া যে আজো তেমন
    নেই বুঝি আপন কোনো প্রিয়জন,
    তবু আমি হারিয়ে গেলাম
    চোখের সামনে ঝাপসা হলাম
    ভালো থাকিস, সুখে থাকিস
    আর যেন কারো মন না ভাঙিস ।

You cannot copy content of this page