-
কবিতা- রাগ
রাগ
– মানিক দাক্ষিতবাঁচতে বাঁচতে রাখবে নাকি, সমাজটাতে
কোন একটা দাগ?
তবে দেরী কেন, ঝেড়ে ফেলো মনটা থেকে
আছে যত রাগ।
কর্ম করে ধর্ম করো, হিংসা ছুঁড়ে সাগরেতে
মনে আনো ত্যাগ;
দেখবে চিত্ত কোমল হয়ে হৃদয়টাতে
বাড়ছে অনুরাগ।
ধৈর্য্য ধরে লক্ষ্যে এগোও–সময়কালে
পাবে জীবন-স্বাদ।
তোমার কীর্তি থাকবে তোমার, জীবনেতে
কেউ নেবে না ভাগ।
তবে দেরী কেন, ঝেড়ে ফেলো মনটা থেকে
আছে যত রাগ। -
গল্প- মাতৃঋণ
মাতৃঋণ
-মানিক দাক্ষিতআজ পাঁচদিন হলো রতনের মা নিখোঁজ। থানায় ডায়েরী করে রতন উদভ্রান্তের ন্যায় চারদিকে হন্যে হয়ে মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। পরিবারে মাকে নিয়ে চারটি প্রাণী। এখন
তিন। স্ত্রী, আট বছরের ছেলে টিঙ্কু আর নিজে। তিন বোন। সবাই বিবাহিতা। বাবাই মেয়েদের দেখেশুনে ভাল ঘরে বিয়ে দিয়ে গেছেন। গতবছর হঠাত্ স্ট্রোক হয়ে মারা
গেলেন। বাবার অঢেল বিষয় সম্পত্তির দেখাশোনার দায়িত্ব বর্তালো একমাত্র ছেলে রতনের ওপর। প্রথমটা ঘাবড়ে গেলেও বুদ্ধিমতী স্ত্রীর আন্তরিক সহযোগিতায়
ধীরে ধীরে বিষয়-সম্পত্তির বিষয়টা বেশ ভালভাবেই রপ্ত করে নিল। হঠাত্ মা নিখোঁজ হয়ে রতনের হিসাবটা কেমন যেন গরমিল হয়ে গেল। মায়ের শোকে রতন আজ পাগলপ্রায়। পাড়ার নানাজন নানা কথা বলে।
কেউ বলে-“রাক্ষসী বউটার জন্যেই ভালমানুষ শাশুড়ীটা স্বামীর ভিটে ছেড়ে বিবাগী হয়েছে। বড্ড দজ্জাল! কেবল একলা খাবো, একলা পড়বো!”
কেউ বলে- রতনটতো বউয়ের কথায় ওঠে-বসে।এক্কেয়ারে ভেড়ুয়া! এইসব দেখেশুনে কোন ছেলের মা সংসারে থাকতে পারে বলো!”
রতনের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে কেউ বলে-“বেচারা! মায়ের শোকে শেষমেষ ছেলেটা যেন মারা না পড়ে!” কথার খেই
ধরে ওপাড়ার পদীপিসি মনের আবেগে সুর করে বলে- “থাকবে না! মা বলে কথা! পৃথিবীতে মায়ের মত জিনিস আর কি আছে!”আট বছরের টিঙ্কু সারা বাড়ী একা একা ঘুরছে। বাড়ীটা কেমন যেন থমথমে ভাব। স্বাভাবিক ব্যস্ততার চাকাটা কেমন যেন থমকে গেছে। কেউ এখন আর তাকে
খাবার জন্যে পীড়াপীড়ি করছে না। পড়ার জন্যে চোখ পাকাচ্ছে না। বাবাটা কেমন যেন হয়ে গেছে!
টিঙ্কু মাকে প্রশ্ন করে-“বাবা ঠাকুমাকে খুব ভালবাসতো, তাই না মা?”
আঁচলে চোখ মুছে মা বলে-“হ্যাঁ বাবা, সব ছেলে-মেয়েরাই মাকে ভালবাসে। ছেলে-মেয়েদের কাছে মা অনেক বড় বাবা।” বিজ্ঞের মত চোখ দু’টো বড় করে টিঙ্কু মাকে বলে-“মা স্বর্গের থেকেও বড়, তাই না মা?” মায়ের সংক্ষেপে উত্তর, “হ্যাঁ”।
সহজ সরল টিঙ্কু নিষ্পাপ ফুলের মত মুখটা মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে জিগ্যেস করে- “তুমি ঠাকুমাকে ভালবাসতে?”
মা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়। সামনে বসে
থাকা তিন ননদের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে- হ্যাঁ, আমরা সবাই তোমার ঠাকুমাকে ভালবাসতাম। তোমার ঠাকুমাতো আমারও মা।” রাগে অভিমানে আট বছরের টিঙ্কু চীত্কার করে ওঠে-“মিথ্যুক, তুমি এক নম্বরের মিথ্যুক। তুমি মিথ্যুক, বাবা মিথ্যুক। ভালবাসতে তো জমি-জায়গা নিয়ে সারাক্ষণ দু’জনে মিলে ঠাকুমার সাথে ঝগড়া করতে কেন! ঠাকুমা কেন একা বসে বসে কাঁদতো! কেন তোমরা আমায় ঠাকুমার কাছে
যেতে দিতে না!” শিশুটার দু-গাল বেয়ে ঝরে
অবিরল অশ্রুধারা।গত সন্ধ্যায় রতন থানার বড়বাবুকে বেশ কড়া করে দু-কথা শুনিয়ে এসেছে। বলেছে- “পুলিশের লোকগুলো সব অকর্মার ঢেঁকি। কোন কর্মের নয়। জলজ্যান্ত মানুষটা আজ পাঁচদিন নিখোঁজ। এখনও পর্যন্ত মানুষটার কোন হদিস মিলল না! করেন কি
আপনারা! নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমান!
নাকি পাওনা না পেলে গাওনা গান না!”
রাগে চীত্কার করে উঠেছেন বড়বাবু- “সাট-আপ, বাড়ী যান। কালকেই মাকে ফিরে পাবেন।”
রতনের ঠোঁটে অবজ্ঞার হাসি। মুখে বিড়বিড় করে বড়বাবুর বলা দু’টি শব্দ উচ্চারণ -“ফিরে পাবেন!”
পরের দিন বেলা দশটা। বাড়ীভর্তি লোক রতনের বাড়ীতে। থানার বড়বাবু সদলবলে ঢুকলেন।
রতনের প্রশ্ন-“মাকে পেয়েছেন?”
বড়বাবুর চটজলদী উত্তর- “পেয়েছি”
দু’জন ছাড়া বাড়ীভর্তি লোকের চোখে-মুখে প্রাপ্তির উল্লাস। রতনের বিস্ময় প্রশ্ন- “কোথায়?”
রহস্যময় মুখে বড়বাবু হাসতে হাসতে বললেন- “সেটা তো আপনি বলবেন!”
রতন রেগে যায়- “তার মানে?”
বড়বাবুর চোয়াল শক্ত হয়- “মেরে হাড়গোড় সব ভেঙে দেবো। সত্যি কথা বলুন, মা কোথায়?”
বড়বাবুর রক্তচোখ দেখে রতন একটু ঘাবড়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে- “কি বলছেন আপনি!”
বড়বাবুর চোখে-মুখে আত্মপ্রত্যয়-“ঠিকই বলছি, নিজের জালে নিজেই জড়িয়েছেন। আপনার দেওয়া বয়ানের সাথে আপনার স্ত্রীর বয়ান কিছুটা মিললেও আপনার ছেলের দেওয়া বয়ান সম্পূর্ণ আলাদা। আপনার এবং আপনার স্ত্রীর দেওয়া বয়ানে আপনার মা নিখোঁজ হয়েছিলেন সন্ধ্যাবেলায়। কিন্তু আপনার ছেলে বলেছে, রাতে শোবার সময় ঠাকুমার সাথে বাবা-মায়ের তুমুল ঝগড়া হয়েছিল। সুতরাং.. রতন ভেঙে পড়ে। শীতেও তার শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম পড়ে। বড়বাবুর একটার পর একটা জেরার মুখে সে জেরবার হয়। স্বীকার করতে বাধ্য হয় সম্পত্তির লোভে সেদিন রাতে তার মাকে সে নিজের হাতে
খুন করেছে। চোখ পাকিয়ে বড়বাবু গর্জন করে ওঠেন-“লাশ কোথায়!”
রতন মাথা নীচু করে কাঁচু-মাচু হয়ে বলে- “সেপটিক ট্যাঙ্কে।”
বাড়ীভর্তি লোক হতভম্ব–হতবাক! শরীরের রক্ত সবার যেন হিম হয়ে আসছে..গা কাঁটা দিয়ে উঠছে। কি ভয়ংকার ভাবে মাতৃঋণ পরিশোধ ছেলের!
বড়বাবু রাগে অন্ধ হয়ে সজোরে লাথি মারেন
রতনের পেটে। রতন হুমড়ী খেয়ে পড়ে টেবিলের ওপর। মাথা ফেটে যায়। জ্ঞান হারায় সে। টেবিলে সযত্নে রাখা কাঁচে বাঁধানো মায়ের ছবিটা বড়বাবুর পায়ের সামনে ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে। বড়বাবু
সপ্রতিভ ভাবে তাকান ছবিটার দিকে। চমকে ওঠেন। এ-তো কোন নারীর রূপ নয়! এ-তো শাশ্বতকালের চিরন্তন জননীর রূপ। বুকে তাঁর একরাশ যন্ত্রণা! মুখে তাঁর করুণ আকুতি…যেন বলছেন- “বড়বাবু,
আমার রতনকে মারবেন না। অবুঝ। ক্ষমা করে দিন।” -
কবিতা- আগুন নিয়ে খেলো না
আগুন নিয়ে খেলো না
-মানিক দাক্ষিতওগো রাজা সময় আছে
আগুন নিয়ে খেলো না,
বৈচিত্র্যময় ঐক্য দেশে
বিভেদ-আগুন জ্বেলো না।
গোঁড়া ধর্মের জেহাদ জিগির
এই দেশেতে চলবে না,
যতই করো নিজের আইন
গণদেবতা মানবে না।
শান্ত সাগর উঠছে ফুঁসে
টের কি তুমি পাচ্ছো না?
মৃত্যু হেথায় তুচ্ছ অতি
জেনেও তুমি জানছো না!
তোমার শাসন এমনি হবে
আগে তো কেউ জানতো না,
জানলে জেনো তোমায় রাজা
মোটেই কেউ করতো না।আপন জেদে চক্ষু মুদে
ধর্মের খেলা খেলো না,
মানব ধর্মে বেসে ভালো
ঘোচাও মর্ম যন্ত্রণা। -
কবিতা- তুমি তো সেই চিত্ত
তুমি তো সেই চিত্ত
-মানিক দাক্ষিততুমি তো সেই চিত্ত
যে আমার মধ্যে শুদ্ধ অশুদ্ধ ভাবে থেকে
অতিষ্ঠ করছো আমাকে !
কখনও তুমি আমার পরম বন্ধু
আবার কখনও চরম শত্রু।
বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মধ্যে
তুমি আমাকে জিইয়ে রেখেছো।
তুমি ‘মম চিত্ত’ হয়েও কিন্তু
আমার আপন নও।
কখনও অশুদ্ধভাবে জঘন্য কর্মে লিপ্ত করে
আমায় বিপদের মুখে ঠেলেছো।
আবার কখনও শুদ্ধভাবে
মঙ্গলদীপ জ্বালিয়ে
আমার জীবনকে করেছো আলোকিত।
দোটানায় বড্ড নাস্তানাবুদ।তুমি শুদ্ধ চিত্ত দুর্গা হয়ে
আমার মধ্যে থাকো।
অশুদ্ধ চিত্ত মহিষাসুরকে বধ করে
তুমি আমাকে এখনই করো মুক্ত। -
কবিতা- ফিরে আসুক মানবপ্রীতি
ফিরে আসুক মানবপ্রীতি
-মানিক দাক্ষিতমানুষের খোলসে তোমাদের দেহখানি ঢাকা,
বিতাড়িত বিবেকের কক্ষ মরুভূমিময় ফাঁকা।নিষ্ঠুরতার খোলা তরবারি নিয়ে হাতে,
দিবা-রাত্র ধ্বংসের খেলায় রয়েছো মেতে।মানবতার পবিত্র ছোঁয়া নাগালের বাইরে;
অমানবিক কর্ম তোমাদের শরীরে, অন্তরে।কখনও কি ভেবেছো মানুষের জন্ম ইতিহাস?
বিন্দুরূপী ভ্রুণ কিভাবে হয় মানবে প্রকাশ?কতগুলো বছর পার হয় রোদে আর ঝড়ে,
কতগুলো বসন্ত পেরোয়–মনে কি পড়ে?নিমেষে প্রাণ কাড়ো, দেহ নিয়ে করো খেলা!
কিসে আসে শান্তি, নাই চিন্তা, শুধু অবহেলা।মানবিক মূল্যবোধ যদি না জাগে মনে,
জীবনের মূল্য দাও, মেরো নাকো প্রাণে।হিংসা ছেড়ে শান্তি আনো, করুণ মিনতি–
শত্রু নয় বন্ধু ভাবো, ফিরুক মানবপ্রীতি। -
বিশ্বাস
বিশ্বাস
-মানিক দাক্ষিতসন্ধ্যাবেলায় রতনের টি.ভি. সারাইয়ের দোকানে বসে গল্প করছি। হঠাত্ রায়বাবু রিক্সাতে কোলে একটা মাঝারি সাইজের কালার টিভি নিয়ে এসে হাজির। গলায় উদ্বিগ্ন আর দুশ্চিন্তার ছাপ।
“বাবা রতন, দেখোতো টিভিটা। চলতে চলতে হঠাত্ বন্ধ হয়ে গেল।”
রতনের ব্যবহার অমায়িক–যাকে বলে চমত্কার।চোখের নিমেষে গণশার চায়ের দোকান থেকে এক কাপ চা আনিয়ে রায়বাবুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
“আপনি চা-টা খান, আমি দেখে নিচ্ছি। টিভিটা খুলে চোখ ছানা-বড়া করে রতন রায়বাবুর দিকে তাকাতেই রায়বাবু গভীর উত্কণ্ঠায় জিগ্যেস করেন, ‘কি হল রতন ?”
—“টিভিটার তো একেবারে দফা রফা হয়ে গেছে। অনেকগুলি পার্টস পুড়ে গেছে। অনেক টাকার ধাক্কা।”আমতা আমতা করে রায়বাবু টাকার অঙ্কটা জানতে চাইলে রতন চোখ বন্ধ করে হিসেব কষে বলে,”ধরে রাখুন হাজার দেড়েক। —তার বেশীও হতে পারে।”
রায়বাবু রতনের হাতদুটো চেপে ধরে করুণ মিনতি করে বলে, “আর বেশীটা করো না। ঐ দেড়হাজারের মধ্যেই রেখে দাও। বুঝতেই তো পারছো, পেন-
শানের ঐ টাকা থেকেই আমায় দিতে হবে। আমি ঘণ্টাখানেক পরে এসে টিভিটা নিয়ে যাব।”রতন লাফিয়ে ওঠে, বলেন কি –একঘণ্টা! আমার পাক্কা তিনটে দিন লেগে যাবে। আপনি তিনদিন পরে এসে নিয়ে যাবেন।”
রায়বাবু চলে গেলে রতন আমার দিকে তাকিয়ে কৌতুহল মিশিয়ে বলে, “কি রে, কিছু বুঝলি?”
আমি ঘাড় নেড়ে না বলতেই রতন মুচকি হেসে বলে, “টিভিটার কিচ্ছু হয়নি। একটা ঝাল খুলে গেছে—কানেকশান পাচ্ছে না—দেখ!” –বলে নিমেষে ঝালটা লাগিয়ে সুইচটা অন করে টিভিটা চালিয়ে দিল।
আমি অবাক বিস্ময়ে রতনকে বললাম, “তা’লে রায়বাবুকে তুই যে বললি, অনেকগুলো পার্টস পুড়ে গেছে। দেড় হাজার টাকা লাগবে?”
রতন হো হো করে হেসে উঠল—“ওসব তুই বুঝবি না, এ-সব ব্যবসায়িক চাল।’
মনটা ভারী হয়ে গেল। ব্যবসায়িক চাল! লোক ঠকিয়ে কায়দা করে টাকা আদায় করা একরকম চিট! সোজা কথায় চিটিংবাজী।
বিষণ্ন মনে রতনকে বলি, “ভদ্রলোককে না ঘুরিয়ে টিভিটা তো দিয়ে দিতে পারতিস ?”
এবার রতন রীতিমত রেগে গিয়ে ভর্ৎসনার সুরে আমাকে বলে, “বেটা, তুই শুধু বোকা নস, মস্ত বড় একটা গাধা। এইজন্যে লেখাপড়া শিখেও জীবনে কিছুই করতে পারলি না! আবে ঢেঁড়স, টিভিটা যদি এক্ষুণি দিয়ে দিতাম, তাহলে টাকাটা ট্যাঁক থেকে বার করতে গায়ে লাগতো। আমায় চোর ভাবতো। বিশ্বাসটাই চলে যেত। তিন দিন পরে দিলে কি ভাববে জানিস ? ভাববে, টিভিটার পিছনে অনেক সময় দিয়েছি.……অনেক খেটেছি।”
মাথাটা ঝিনঝিন করে উঠল। বোকা আমিটা গাধার মত আস্তে আস্তে পা ফেলে বাড়ীর দিকে রওনা দিলাম।
-
খেলা
খেলা
-মানিক দাক্ষিতখেলা আছে হরেকরকম যাবে কি সব বলা?
খেলার মধ্যে খেলার সাথে আছে ছলা কলা!
খেলার স্মৃতি বড়ই মধুর নয় যে হেলা-ফেলা,
খেলার সাথে জড়িয়ে আছে সবার ছোটবেলা।
খেলার সাথে দস্যিপনা আছে যে কান-মলা,
খেলার মধ্যেই গাছে ওঠা সাঁতার শিখে ফেলা।
খেলার জন্যে বাবার বকা মায়ের হাজার জ্বালা,
অভিযোগের মাত্রা ছাড়া কান যে ঝালাপালা।
সেসব খেলা হারিয়ে গেছে, খেলার ঘরে তালা,
মুঠো ফোনের মাদকতায় নি:সঙ্গ পথ চলা।লীলা খেলা প্রণয় লীলা আছে জুয়া খেলা,
হরেকরকম খেলা আছে যাবে কি সব বলা!যারা মহত্ সেজে ছদ্মবেশে দিয়ে পরম বাণী,
নিরীহ মানুষের জীবন নিয়ে খেলছে ছিনিমিনি।
তাদের খেলার বিভীষিকা ভাবলে কাঁপে বুক,
বিষের ছোঁয়ায় যাচ্ছে ক্ষয়ে জীবনীশক্তি সুখ।
কোন খাবারে নাইকো ভেজাল বলতে পার ভাই,
সব দেখেও নাই প্রতিবাদ শিবের গাজন গাই।
ওরাই দশের মধ্যমণি আঙুল ফুলে গাছ,
আমরা হলেম চূনোপুঁটি, ওরা হাঙর মাছ।
ওদের খেলা মারণ খেলা নাইকো মানবতা,
চোখের সামনে ঘটছে সকল শ্মশান নীরবতা।
কতদিন আর এমনিভাবে খাবে পড়ে মার,
এবার জাগো পাল্টা মারো করো পগার পার।জেনো, তোমার কর্ম তোমার খেলা বিশ্ব চরাচর,
বিশ্বমাঝে আমরা যেথায়, সেটাই খেলাঘর। -
একতারা
একতারা
-মানিক দাক্ষিতকমলা রঙের সাজানো বাউলের বেশ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে কৃষ্ণদাস বাউল। কৃষ্ণদাসের সাজগোজ দেখে বোষ্টুমি কৃষ্ণদাসী এগিয়ে আসে–“এই সাত সকালে কোতায় বেরুচ্চো?”
হাসতে হাসতে কৃষ্ণদাস বলে–“জানিস না আজ মকর সংক্কান্তি! জয়দেবের মেলা।”
কৃষ্ণদাসীর মুখ তেউলে হাঁড়ি।
–“অনেক তো মেলা করলে! এবার রাকো। পেটের যোগাড় করো। ভিক্ষেয় বেরোও।”
কৃষ্ণদাস তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। –“ছি: ছি:, ও-কতা মুকে আনলি কি করে? জয়দেব আমার আদিগুরু।
মেলায় গেয়ে তেনাকে আজ আমাদের ছেদ্দার সাতে পেণ্ণাম করার দিন। একটা দিন উপোস দিলে এমন কিচু খেতি হবে নি।”
কয়েক মূহূর্ত চুপ থেকে কৃষ্ণদাসী কৃষ্ণদাসের চোখে স্থির দৃষ্টি রেখে বলে–“আমি তোমার সঙ্গে যাবো জয়দেবের মেলায়।কৃষ্ণদাস শশব্যস্ত হয়ে ওঠে। একটা অবাঞ্ছিত বস্তু এঁটুলির মত গায়ে সেঁটে যাবার ভয়ে সে উদ্বিগ্ন চঞ্চল হয়ে ওঠে।–“না-না, তোকে আর কষ্ট করে যেতে হবেনি। তুই ঘরে থাক। আমি একাই যাই।”
কৃষ্ণদাসী জ্বলে ওঠে। –“আমার জানতে ছাপি নেই। মেলায় ছেদ্দা-ভক্তি করতে যাচ্চো, না গুষ্টির পিণ্ডি
দিতে যাচ্চো! মনে করচো ডুবে ডুবে জল খেলে শিবের বাপও টের পাবে নি, না? আমি জানি তুমি কিজন্যি মেলায় মেলায় ঘোরো। পেথমকার বোষ্টুমিকে একোনো তুমি মন থেকে ভুলতে পারোনি। তুমি মেলায় মেলায় তারই খোঁজ করতি যাও।”কৃষ্ণদাসীর মুখের কথাগুলো কৃষ্ণদাসের মরমে কাঁসরের মত বেজে ওঠে। বুকটা হাহাকার করে।এতদিনের গোপন অব্যক্ত কথাটা কৃষ্ণদাসী ঠিক ধরে ফেলেছে। সেদিনের ঘটনাটা বেশ মনে পড়ে কৃষ্ণদাসের।
মহাপ্রভুর জন্মদিনে সেবার বোষ্টুমি গুরুদাসীকে সঙ্গে নিয়ে ভিক্ষেয় বেরিয়েছিল। বোষ্টুমির খঞ্জনীর সাথে
নিজে একতারা বাজিয়ে বীরচাঁদপুরে কাঁধের ঝুলি ফুলে ফেঁপে ঢোল। তাও কম করে পঁচিশ ত্রিশ কেজি
চাল, নগদ দুশো টাকা। কৃষ্ণদাসের মনে আনন্দ আর ধরে না। সারা রাস্তা খোসমেজাজে বোষ্টমীর সাথে
গল্প আর মাঝে মাঝে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে এসেছিল। মাঝরাস্তায় একদল নিষ্পাপ বালকের দল আটকেছিল। দুহাত তুলে আনন্দে লাফাতে লাফাতে বলেছিল–“ও কেষ্টকাকু, সে-সেই গানটা একবার গাও না! নিরাশ করেনি।একতারা বাজিয়ে মনের আনন্দে কৃষ্ণদাস গান ধরেছিল—
“ছ’টা বাঘ ঢুকেছে ঘরেতে।
তারা বাগ মানে না, ধরা দেয় না, ফেলল বিষম দায়েতে।।
মারবার তরে ধনুক নিলাম তীর নিলাম দুটো হাতেতে,
কে একজনা করলে মানা, বধো নাকো প্রাণেতে।
বললে এদের তুষ্ট করে রাখ মিষ্ট কথাতে………”গান শেষ করে একের পর এক বালকগুলোকে কাছে টেনে আদর করেছিল। ছেলেগুলো অবাক চোখে কৃষ্ণদাসের একতারার দিকে চেয়েছিল। তারা শুনেছে ঐ একতারার মধ্যেই নাকি কৃষ্ণদাস বাউলের প্রাণ
আছে। একতারা ভেঙে গেলে নাকি কৃষ্ণদাসও মরে যাবে। কৃষ্ণদাস চোখ বন্ধ করে ভক্তিভরে দুহাতে একতারাকে কপালে ঠেকিয়ে হনহনিয়ে পা চালায়। পিছনে গুরুদাসী। ডেরায় ফিরতে ওদের বেলা গড়িয়ে যায়। দুজনের কাঁধে ঝোলানো ঝুলি আজ ভিক্ষার সামগ্রীতে পূর্ণ। দুজনের চোখে মুখে আনন্দ। উভয়ের আনন্দের মধ্যে বিস্তর ফারাক। একজন আনন্দিত তার কৃতিত্বের অহংকারে আর একজন আনন্দিত তার প্রাণের ঠাকুরের মুখের হাসিতে। ডেরায় ফিরে গুরুদাসী নিজের ঝুলি কাঁধ হতে নামিয়ে বাউল ঠাকুরের ঝুলি কাঁধ হতে নামায়। দুটি পা জল দিয়ে ধুয়ে কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুছে দেয়। একগ্লাস জল, হাতের তেলোয় একটু ঝোলা গুড় দিয়ে মাথায় ভাঙা হাতপাখাটা নাড়ে। ক্লান্ত বোষ্টুম কৃষ্ণদাস গুরুদাসীর সেবায় ঠাণ্ডা হয়। কিন্তু না, বেশী- ক্ষণ থাকে না। বিপত্তি বাধে গুরুদাসীর একটু ভুলে। একতারাকে ঘরে রাখতে গিয়ে পা হড়কে পড়ে গেছে গুরুদাসী। একতারা ছিটকে একেবারে উঠোনে। আর যায় কোথায়! বিশাল স্তুপীকৃত বারুদের মধ্যে একটা জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি। কৃষ্ণদাস আগে কখনও যা করেনি–জীবনে যা করবে বলে ভাবেনি, তাই করে বসে। চোখ মুখ তার লাল হয়ে ওঠে। এলোপাথাড়ি চড় আর লাথি মারতে থাকে গুরুদাসীকে। বেহুঁস হয়ে মাটিতে পড়ে যায় গুরুদাসী। রাগে কৃষ্ণদাসের চোখদুটি গনগনে আগুনের মত লাল হয়ে ওঠে।–“আঁ, আমার গুরুর পিতি হতছেরাদ্দি! পাপিষ্টা মেয়েমানুষ। তোর নরকেও থান হবেনি। বাড়ী হতে তুই এক্ষুনি বেরিয়ে যা।”
কৃষ্ণদাসের দুচোখ বেয়ে গড়গড়িয়ে জল পড়ে। বীরচন্দ্রপুরের বঙ্কিম রায় মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে গুরুদেব তাকে এই একতারাটি হাতে দিয়ে বলেছিলেন– “কেষ্ট, তুই এই একতারাকে সারা জীবনের সাথী করে রাখবি। কখনও কাছছাড়া করবি না। সযত্নে রাখবি। সংসার থেকে মুক্তি পাওয়া যায় ভোগে নয়, ত্যাগে। এই বৈরাগী একতারাই তোকে মুক্তির পথ দেখাবে।”
সেই থেকে কৃষ্ণদাসের ধ্যান-জ্ঞান একমাত্র সাধনার বস্তু এই একতারা। এর অপমান সে একদম সহ্য
করতে পারে না। বেহুঁস হয়ে পড়ে থাকা গুরুদাসীর পাশ থেকে ছিটকে পড়া একতারাকে দুহাতে তুলে
বুকে চেপে ধরে কৃষ্ণদাস হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে– “অপরাধ নিও না গুরু। আমি তো তোমায় কোনোদিন অছেদ্দা করি নেই। এই পাপিষ্টা মেয়েমানুষটা তোমার পতি ছেদ্দা ভক্তি হারিয়েচে।”সূর্য পাটে বসেছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে আকাশে কালো অন্ধকার নেমেছে। নেমেছে কৃষ্ণদাসের দুটি প্রাণের সংসারে কালো বিষাদের ছায়া। বোষ্টুমি বোষ্টুমের পা ধরে ক্ষমা চায়। অশ্রুসজল চোখে করুণ মিনতিতে বলেছে–“এবারের মত খেমা কর বাউল ঠাকুর্। তুমি তো আমার প্রাণের ঠাকুর। তোমাকে ছেড়ে আমি কোথায় যাবো! কোথায় আমার যাওয়ার জায়গা আচে বলো? “
কৃষ্ণদাস খেঁকিয়ে উঠেছে–“অজয় নদী আছে, দড়ি আছে, কলসী আছে- তোর যাওয়ার অনেক জায়গা আছে, চলে যা। আমার ছাপ কতা একানে তোর জায়গা নেই।”
পরদিন কাকভোরে কৃষ্ণদাস উঠে দেখে ঘর শূণ্য। গুরুদাসী নাই। চলে গেছে। শুধু বিছানার একপাশে
পড়ে রয়েছে তার একতারা। ঘটনাটা আজও কৃষ্ণদাসের মনে ছবি হয়ে ভাসে। বড় অনুশোচনা হয়।লালমাটির পথ ধরে কেষ্টদাস বাউল এগিয়ে চলে দুবরাজপুরের পাকা সড়কের দিকে। বাঁধা কাঁচা সড়ক
থেকে নেমে মাঠের আলপথ ধরে। ধানগাছের শিশিরে ভেজা খালি পা নিয়ে হনহনিয়ে ছুটেছে কৃষ্ণদাস। মুখে তার গুনগুনিয়ে গান —“আমি কোথায় পাবো তারে
আমার মনের মানুষ সে রে
হারায়ে সেই মানুষ, তার উদ্দেশে
দেশ বিদেশ বেড়াই ঘুরে।”আগে কৃষ্ণদাস শান্তিনিকেতনের মেলা, নানুরের বাউল মেলা জয়দেবের মেলা সব জায়গাতেই পায়ে হেঁটে গেছে। এখন পারে না। বাসে চেপে ভোঁ করে চলে যায়। মজাও লাগে আবার দু:খও হয়। আগে পায়ে হেঁটে সাধ্য সাধনা করে মেলায় পোঁছাতে হত। মনে হত মেলায় আসাটা তার সার্থক হয়েছে।
কেন্দুলীর মোড়ে বাস থেকে নেমে কৃষ্ণদাস একরকম ছুটতে থাকে। দুপুরের আগে পৌঁছাতে পারলে ব্রাহ্ম’ক্ষণে অজয় নদে মা গঙ্গার দর্শন পাবে। হাজার চেষ্টা করেও কোনো বছর সে ব্রাহ্ম’ক্ষণে হাজির হতে পারেনি। সে জানে এটা দেখতে পাওয়া বড় পূণ্যের দরকার। এইব্রাহ্ম’ক্ষণে অজয়ে গঙ্গার আগমণকে কেন্দ্র করে একটা গানও বেঁধেছে। গত বছর মেলায় বাউলদের আখড়ায় গেয়ে খুব নাম পেয়েছিল। প্রবাদ আছে — কবি জয়দেব পঁয়ত্রিশ মাইল পায়ে হেঁটে মাঝে মাঝে কাটোয়ায় গঙ্গা স্নান করতে যেতেন। একবার মকর সংক্রান্তির দিন শরীর অসুস্থতার দরুণ যেতে পারেননি। মনে ভীষণ ক্ষোভ ও দু: খ। অসুস্থ জয়দেব বিছানায় শুয়ে মা গঙ্গাকে স্বপ্নে দেখলেন। মা গঙ্গা বললেন–“এবার থেকে প্রতি মকর সংক্রান্তিতে অজয়ে আমি উজান বেয়ে যাবো। তুই ওখানেই স্নান করবি।”
এখনও ব্রাহ্ম’ক্ষণে মূহূর্তের জন্যেও নাকি অজয় উজান বয়।কৃষ্ণদাস স্পষ্ট শুনতে পায় মেলা থেকে ভেসে আসা অসংখ্য কৃত্রিম দানবের কণ্ঠে বাউল গান। কৃষ্ণদাসের
বাউল মন পেখম তুলে ময়ূরের মত খুশীতে ডগমগ নগ্ন পা দুটো তার নৃত্যের তালে তালে ছুটতে থাকে।
শরীরের রক্তে এখন এসেছে তার আনন্দের হিল্লোল। বীরভূম জেলা ও বর্ধমান জেলার সীমান্তে অজয় নদের তীরে বসা জয়দেবের মেলায় যেন মানুষের মেলা বসেছে। মেলায় ঢোকার আগে কৃষ্ণদাস দুহাতে একতারাটা কপালে ঠেকিয়ে গড় হয়ে প্রণাম করে। চোখ বন্ধ করে কি যেন বিড়বিড় করে বলে। কণ্ঠে নেমে আসে সুধাময়ী বাউল গান–“ধন্য আমি বাঁশিতে তোর
আপন মনের ফুঁক।
এক বাজনে ফুরাই যদি
নাইরে কোন দুখ।।
ত্রিলোক ধাম তোমার বাঁশি
আমি তোমার ফুঁক।।”গাইতে গাইতে কৃষ্ণদাস সামনের আখড়ায় প্রবেশ করে। আখড়ায় তখন চলছে পুরাদমে বাউল গান। অবনী দাস, সুরদাস, জীবন দাস বাউল ছুটে আসে। সকলে একে একে কৃষ্ণদাসকে বুকে জড়িয়ে ধরে অন্তরের অভিবাদন জানায়। কৃষ্ণদাসের দুচোখে আনন্দের বারিধারা। মেলায় অসংখ্য আখড়া থেকে বাউল গান, হরিনাম সংকীর্তন ভেসে আসে মাইকের দানব কণ্ঠ থেকে। একটানা কুড়িখানা গান গেয়ে কৃষ্ণদাস আখড়ার বাইরে বেরিয়ে আসে।
এক বোষ্টুমি রসিকতা করে–“কি গো বাউল ঠাকুর, হাঁপিয়ে গেলে নাকি! পাশে বোষ্টুমি থাকলি বোধ হয় এমনভাবি হাঁপাতিহতুনি।”
‘বাউল ঠাকুর’ সম্বোধন শুনে কৃষ্ণদাসের বুকটা ছ্যাঁত্ করে ওঠে। তার গুরুদাসীও যে ঠিক এমনিভাবেই
ডাকতো। কৃষ্ণদাস বোষ্টুমির মুখের দিকে একনাগাড়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।বোষ্টুমি লজ্জা পায়। –“অমন করি হ্যাংলার মত দেকচো কি! “
কৃষ্ণদাস নীরব। সে এতক্ষণ হয়তো হারিয়ে যাওয়া গুরুদাসীর চোখ দুটোকে এই বোষ্টুমির চোখের মধ্যেই খুঁজছিল। কৃষ্ণদাস আড়ষ্ট গলায় বলে–“তোমার বোষ্টুম ঠাকুর কোথায়?”
বোষ্টুমি খিল খিল করে হেসে ওঠে।
কৃষ্ণদাস অস্বস্তি বোধ করে।–“হাসচো যে!”
মুখে কাপড়ের আঁচল চেপে হাসতে হাসতে বোষ্টুমি বলে, “তোমার মুখে আমার বোষ্টুম ঠাকুরের খোঁজ শুনে। বোষ্টুম ঠাকুর আমার কদমখণ্ডীর ঘাটে গেছে।”কৃষ্ণদাসের খেয়াল হয়। কপাল চাপড়ায়। ব্রাহ্ম’ক্ষণ শেষ হয়ে গেছে এতক্ষন! এবারও তার কপাল মন্দ। মনমরা হয়ে একতারা হাতে মেলায় ঘুরতে থাকে। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। কৃষ্ণদাস পাগলের মত ঘুরতে থাকে–দুচোখ দিয়ে কিসব গিলতে থাকে–কি যেন খুঁজতে থাকে। একবার বেদনাশা বটগাছ, একবার বাউলদের আখড়া, একবার জয়দেবের সিদ্ধাসন–ঘুরন চড়কির মত ঘোরে। উদভ্রান্তের মত একবার শ্মশানের পাশ দিয়ে চলতে চলতে দেখে পিঁপড়ের সারির মত মানুষের দল চলেছে।বিস্মিত হয়ে জিগ্যেস করে–“এই সাঁজের বেলায় তোমরা কোথায় যাও?”
একজন উত্তর দেয়–” কদম খণ্ডীর ঘাট। শোননি, ওখানে ত্যাগমাতা এসেছেন?
ওনাকে দেখতে যাচ্ছি।”
অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাদের পিছু পিছু চলে কৃষ্ণদাস। কদমখণ্ডীর ঘাটে এসে দেখে শীর্ণকায় আলুথালু কেশে এক
মধ্যবয়স্কা নারী ধ্যানমগ্না। পরনে গৈরিক বসন। চারপাশে অসংখ্য মানুষের ভিড়। বাউল কীর্তনীয়ার দল তাদের গানের ডালি সাজিয়ে ত্যাগমাতাকে নিবেদন করছে। কৃষ্ণদাস একতারা তুলে ভিড় ঠেলে একেবারে ত্যাগমাতার সামনে এসে দাঁড়ায়। ধ্যানমগ্না ত্যাগদেবীর কোটরাগত চোখ দুটির দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে কৃষ্ণদাস। একতারা বাজিয়ে গলা ছেড়ে গান ধরতে যায়। কিন্তু পারে না। কম্পিত হস্তের অদক্ষ চালনায় একতারার তার ছেঁড়ে। গানের গলা স্তব্ধ হয়ে যায়। শুধু গলা থেকে একটা অস্পষ্ট চাপা শব্দ বেরিয়ে আসে–“গু-রু-দা-সী!”
ত্যাগমাতা চোখ মেলে তাকান। কৃষ্ণদাস আর দাঁড়াতে পারে না। ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসে। নিমেষে হাতের একতারা ছুঁড়ে ফেলে দেয় অজয়ের বুকে। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে—-অজয়ের ঘোলা জলে একতারার কালো মুখটা কেমন হাবুডুবু খেতে খেতে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। -
বুদ্ধে পরতস্তু স:
বুদ্ধে পরতস্তু স:
-মানিক দাক্ষিততোমরা কি জানো তোমাদের ক্ষমতা অসীম?
কিন্তু ক্রমশ: কমে ছানিপড়া চোখের নিষ্প্রভ আলোয়
কিংবা স্নায়ুর তীব্র উন্মাদনায়।বৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডবে হাত-পা ছাড়ে,
তবুও জোনাকী জ্বলে বাবুই-এর শিল্পী বাসায়।
অন্ধকারের সাথে ভয়াবহতা বাড়ে
স্বপ্ন গড়ায় অবচেতন মনে।ইস্পাতের চাকচিক্যতা ঢলে পড়ে
মরচে ধরে ধংসের আবর্জনায়।
অযত্নে বাদলের হাওয়ায় নিষ্ক্রিয়
বহুমুখী বারুদের অযথা শক্তি।বর্ধিষ্ণু অস্থিতে কতকাল ক্ষয়িষ্ণু চিন্তা
নেড়ে যাবে অকাল ঘণ্টাটা।
যুগ যুগান্তরে ইন্দ্রিয়ের বশ্যতা স্বীকারে
দেখা গেল সুখের পরিণতি।ঠিক কথা ইন্দ্রিয়ের অসুর শক্তি পরাস্ত হলেই
জীবের উর্দ্ধগতি মনের আলোকে।
বুদ্ধি বড় তর্কবাগীশ সতর্ক প্রহরী,
মনের শক্তি তাই তার কাছে জড়।সকলে পরাস্ত কিন্তু আলো থেকে আলোয়
অবশেষে আত্মশক্তির চরম প্রকাশ।
পথ বড় দুর্গম– কণ্টকাকীর্ণ।
কর্মসংগ্রামে জয়লাভ সুনিশ্চিত
যদি জাগাতে পারো স্বীয় আত্মশক্তিকে। -
তবেই পাবে মহাপ্রাণ
তবেই পাবে মহাপ্রাণ
-মাণিক দাক্ষিতযুগ যুগ অনুর্বর চিত্তভূমির
আছে দুই শয়তান;
ভোগ্যবীর মহাশন, জাতপুত্র ক্রোধাগ্নির
ক্ষমতা পর্বতপ্রমাণ।লিপ্সা হস্তে বাসনার শস্য আত্মসাত্
ব্যতিক্রমহীন নিয়মে,
চাষ হয় শস্য ফলে—জ্ঞান বন্দীরাত
কাটায় অজ্ঞান-ভবনে।জন্মাবধি পিতা-পুত্রের মিলিত চেষ্টায়
ভোগের বিশাল সাম্রাজ্য।
তবু কামনার নিবৃত্তি কোথায়? তেষ্টায়
ছাতি ফাটা নৈরাজ্য।।মানবের মহাশত্রু অনুর্বর চিত্তভূমির
এই দুই শয়তান,
বিচারের ফলকে ধংস হলে
উর্বর ভূমিতে পাবে মহাপ্রাণ।
–