-
কবিতা- “চিঠি”
চিঠি
-সঞ্জিত মণ্ডলযে চিঠি লিখেছি তোমাকে অনেক রাতে-
সে চিঠির কোনো জবাব পাবো না জানি-
রাত জেগে যত বিরহী চিঠি লেখে-
ধরে নিও এটা সে রকমই পাগলামি।
ঢাকা গুলশান টোরেন্টোতে কি মিল,
পুরী ও কটকে কার ছবি ভেসে ওঠে –
দূরত্ব যদিও আজকাল কিছু নয়-
পিরামিড বাধা মিশরে আটকে থাকে।দরদী হৃদয় যার থাকে সেও জানে-
গাজা মরুভূমি কাদের রক্তে লাল-
কারা হানাহানি করছে দুনিয়া ময়-
কাদের ব্যথায় তুমি প্রলেপ দেবে।
সামর্থ্য আর ইচ্ছার হলো জয়-
জেনেছি ভুবনে তুমি এক বিস্ময় –
বেঁচে থাকাটাই কতটা জরুরী বলো-
তোমার দুচোখে করুণার ধারা বয়।আর্তজনের দুপাশে দাঁড়াতে চেয়ে-
নিজহাতে তুমি পৌঁছে দিচ্ছ ত্রাণ-
শিখিয়েছ মাস্ক কিভাবে পরতে হয়-
হাত ধুতে হলে কিভাবে তা ধুতে হয়।
তোমাকে দেখেছি ছুটছো বিশ্বময়-
অবাক চোখেতে চেয়ে দেখি আর ভাবি-
কি করে পারলে হিমালয় বাধা তের নদী পার হতে,
ভাইরাস ভয়ে সকলে যখন গৃহবন্দীই রয়।
তোমাকে কখনো ভয় করেনিকো গ্রাস-
সারা দেশ জুড়ে বিলি করে গেলে ত্রাণ,
এমন দরদী হৃদয় কোথায় পেলে-
বুঝেছি এ সবই বিধাতার মহা দান।এ চিঠি লিখেছি সাহস যোগাবো বলে-
উত্তর তুমি দাও বা না দিতে চাও-
জেনে রেখো কেউ পাশেই দাঁড়াতে চায়-
হৃদয় পুরের বাঁশি যে শুনেছে প্রিয়।
যা কিছু ভাবনা ভেবেছি এবার থেকে-
চিঠিতে জানাবো সব কথা এলোমেলো –
জীবনটা জানো প্রাণবায়ু পেতে চায়-
কোথায় যে তুমি থাকলে কি এলো গেলো।তবুও এখন সংবাদে রাখি চোখ-
হয়তো কোথাও ত্রাণ নিয়ে ছুটে যাও-
বিনা ত্রাণে আমি ক্রমশ ধ্বংস হই-
তুমি প্রাণবায়ু হয়ে আসবে কি বলো।
ডাক্তার তুমি জানো অনেক কথাই-
মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচাবে কি করে বলো-
ব্যথার পাহাড় জমেছে যে বুকে তার-
প্রাণবায়ু দিয়ে তুমি ই বাঁচাতে পারো।টরেন্টো কিংবা মিয়ামি যেখানে থাকো-
মেক্সিকো থেকে সিডনি শ্রীক্ষেত্র হোক-
একবার এসে গুলশানে দেখে যেও-
কে ভালোবেসেছে তোমার ওদুটি চোখ।
ইচ্ছা করলে হলিউডে যেতে পারো-
বলিউড থেকে ওলিউড টলিউড-
মিষ্টি হাসিতে আজও কি মুক্তো ঝরে-
কতোদিন হলো তোমাকে দেখিনি বলো।দূর থেকে নয় হাই হ্যালো বলে দিলে-
বুকের বেদনা তাতে কি কমবে বলো-
একটু পরশ পেতে চায় এ হৃদয় –
কবে দেখা পাবো একবার বলে দিও।
চিঠিতেই তাই বলছি স্পষ্ট করে-
ত্রাণ চায় শুধু আর্তজনেরা নয়-
বিরহী প্রেমিক সেও তো আর্ত হয়-
ঘুম ভাঙানিয়া গান তুমি গেয়ে যেও।। -
কবিতা- প্রেম দ্বন্দ্ব শান্তি ও শিশু
প্রেম দ্বন্দ্ব শান্তি ও শিশু
-সঞ্জিত মণ্ডলজীবনে শান্তি কতো দরকারি সেটা তো সকলে জানে-
মনে যত ব্যথা যত আকুলতা সে কথা কজনে শোনে।
প্রিয়া নেই যার সে থাকে না আর সে কথা সকলে জানে,
প্রিয়া থেকে যদি না থাকারই মতো মন কি সেকথা মানে?
ভালোবাসা যদি অকালে শুকায় সে ভালোবাসাটা মিছে,
কাছাকাছি শুধু দেহের মিলন তাতে কি প্রশান্তি আছে?
ভাষাহীনা যত বিরহ বেদনা কুরে কুরে খায় মন,
কাছাকাছি তবু মন ভেঙে দেয় দৈহিক সে মিলন।যে জীবনে সুখ দেখেনি কখনো সেও ভালোবাসা চায়,
ধনী দরিদ্র আতুর অবোধ প্রেমেতে বিভোর হয়।
বিশ্বাস করে ভালোবাসা যারে ভালোবাসো আজীবন,
অবিশ্বাসেতে জ্বলে পুড়ে যায় সুখের সে গৃহ কোণ।
সকলেই হয় মনেতে স্বাধীন সেথা হাত দেওয়া নয়,
দ্বন্দ্ব বিবাদ খুন ছাড়াছাড়ি অবিশ্বাসেতে হয়।মন যদি হয় নির্মল নীল বিশ্বাস রেখো প্রাণে,
অবিশ্বাসের আগুনে দগ্ধ মারা যাবে ধনে প্রাণে।
দৈহিক প্রেমে সুখ দুদিনের চিরদিন থাকে নাকো,
সংসারে সুখ আনে শিশু মুখ সন্তান কাছে ডাকো।
যত হানাহানি ঝগড়া ও রাগ সব গলে জল হবে,
শিশু মুখ দেখে সব ভুলে যাবে সকলেই সুখী হবে। -
কবিতা- আস্থা
আস্থা
– সঞ্জিত মণ্ডলনিজের উপর আস্থা রাখুন আস্থা রাখতে হয়-
গায়ের রঙে নয় পরিচয় গুণের বিচার হয়।
কাঁদতে কাঁদতে আছড়ে পড়া এমন দুঃখ নয়-
জীবনটা যে দুঃখ সুখের কান্না হাসির হয়।মা বাবা আর স্বামী স্ত্রীতে যত না দুঃখ হয়-
পাড়াপড়শি কুজন কানে বিষ ঢালে বিষময়।
হাত বুলালে যায় না ব্যথা দুঃখ গভীর হয়-
বাঁচতে শিখুন বাঁচার জন্যে আত্মহত্যা নয়।বুকের মাঝে যখন ব্যথা গুমরে কেঁদে যায়-
ভালো বাসুন আপনজনকে ভালো বাসতে হয়।
আপনজনের দায়িত্ব বোধ অনেক জান বাঁচায়-
উদাসীন আত্মীয় বন্ধু এক্কেবারেই নয়।সাধনাতে ভালো মনের আধার গড়তে হয়-
ঘুম বিহনে চোখ বসে যায় রাত্রি জাগা নয়।
গলার আওয়াজ বদমেজাজ আর অসহ্য রাগ হয়-
মনের ভীতর যত আগুন উগরে দিতে হয়।চাপা স্বভাব ভীরুতা ভাব নরম মনের হয়-
ঝগড়া করুন হাসতে থাকুন গোমড়া মুখো নয়।
জীবন যুদ্ধে মরণ বাঁচন তার কৃপাতেই হয়-
উদ্যোগীরা পুরুষ সিংহ হেরেও জিতে যায়।সবাই তো নয় রাজার ব্যাটা দুখীর ব্যাটাও হয়-
কিন্তু যদি লড়তে পারো করবে দুঃখ জয়।
জীবন যুদ্ধে হতেই হবে খুব অকুতোভয় –
দেখবে তুমি জিতবে তুমি করবে বিশ্বজয়।। -
কবিতা- বিস্ময়
বিস্ময়
-সঞ্জিত মণ্ডলপাহাড়ের নামগুলো মনে হয় কত না বিশেষ,
তবুও মনের কোনে মায়াময় কুহক বিস্ময়,
কেউবা অরুণোদয়, কেউ বিন্ধ্যাচল,
কেউবা ধবলগিরি, কেউ অস্তাচল।
কোথাও ত্রিশূল দেখি, কোথাও কেদার,
কোথাও কাঞ্চনগিরি কেউ পথ আছে জুড়ি,
কোথাও সে নাম ধরে শুভ্র হিমালয়।
মনে হয় যেন সেই আদিগন্ত স্রোতে,
সৃষ্টির প্রথম প্রভাতে, কোনো এক বাঁশিওয়ালা
খেলা করে, খেলা করে যায় অবিরল,
পৃথিবীর প্রথম সোপানে
সৃষ্টিসুখের এক পরম কল্যাণে, প্রভাত বেলায়।
যাদু করে রেখে দেয় অশান্ত সমুদ্র ঢেউ সেই নিরালায়,
তার অতি ক্ষুদ্র এক গুপ্ত ঈশারায়,
চিরায়ত জীবনের দৃপ্ত মহিমায়।স্তব্ধ হয়ে চেয়ে দেখি আকাশের নীল নীলিমায়
পাহাড়ের তরঙ্গের দল, ঊর্দ্ধমুখে চেয়ে আছে মৈনব্রতী ঋষিদের দল,
তারাদের দেশ যেন করেছে বিহ্বল!
যখন প্রভাত কালে রজত হিমানী পরে সোনালী কিরণে রোদ করে ঝলমল,
মনে হয়
সে যে এক রাজসিংহাসন অবিকল,
পাতা আছে স্রষ্টার ক্লান্ত হয়ে বসিবার আসন বিরল
আদিগন্ত পরিব্যাপ্ত সোনা মাখা সবুজ স্বপন!
আরপারে কবেকার স্থির হয়ে বসিবার কুহক মায়ার সেই কুবের ভবন।
পৃথিবীর যত কিছু আদরের সোহাগের অমিয় রতন,
চিরন্তন জমা করে মন ভরে পাহাড়ের সুনীল গহন।দেবলোক হতে নামে স্নিগ্ধমাতা গঙ্গা সুরধনি
সাথে লয়ে অমৃতের ধারা অবিরল, তোমার চরণতল ধৌত ধন্য করিবারে এ ধরণীতল
অসীম সোহাগ ভরে! মনে লয়ে বাসনা প্রবল।
হে বিধাতা, অন্নদাতা, যে আছ অন্তরে বাহিরে
সবার হৃদয়পুরে,
যতকিছু দান তুমি দাও অবিরল,
অবিরল চেয়ে থাকি তোমার সে দানে,
অযুত যুগের স্তব্ধ বিস্ময়ের পানে, আনতনয়ানে।
কান পেতে শুনি সেই সুমহান গান,
মনে হয় এই যেন ভুবন ভোলানো সেই গান
ভুবন মোহন সুরে ধরুক সে তান, সৃষ্টিসুখের সেই মহাভারতের গান,
কালের কপোলতলে
যার কথা লেখা থাকে অমৃতসমান।। -
কবিতা- প্রথম দেখা
প্রথম দেখা
– সঞ্জিত মণ্ডলপ্রথম দেখায় ভালো লেগে গেলে পরে-
সে দেখা কখনো কেউ কি ভুলতে পারে-
হোক সে কবিতা ফুল ফল ঘড়ি চুড়ি,
যাকে ভালো লাগে তাকে কি ভুলতে পারি।
এইবার যদি নারীর কথাই বলি-
চমকে উঠোনা বলবো যে কথা তারই,
প্রিয়দর্শিনী কতো কে যে সুন্দরী,
মিষ্টি হাসি কি কখনো ভুলতে পারি।দিন যায় দিন আসে নতুন করে –
ভাবনা বিলাসী মন কেমন করে,
স্পর্শ সুখের মতন কি আছে বলো,
বিরহীর বুকে কে প্রলেপ দিয়ে যাবে।
মিষ্টি হাসিতে বিশ্ব জয় হবে-
কঠিন কতোটা গোমড়ামুখোরা জানে,
মোহন বাঁশিটা কে বাজায় বেণুবনে,
শ্রীরাধা কেবল বাঁশির ডাকটি চেনে।দেখা হবে কবে সে কি আর আমি জানি
তোমার আশায় পথ চেয়ে কাল গুণি,
হাসিমুখে তুমি একবার দেখা দিও,
আশার আড়ালে হতাশা লুকাবো প্রিয়।
যেমন এসেছ সে দিন ঝড়ের পরে-
কালবৈশাখী ছিলো সেই রাতে ঘোর,
হঠাৎ দেখেছি আলোর সে ঝলকানি,
বিদ্যুৎ নয় তুমি এসেছিলে প্রিয়।সেই থেকে কতো পবিত্র হয়েছি জানো-
যেদিন তোমাকে প্রথম দেখেছি প্রিয়,
মনের মাঝেতে ঝড় উঠেছিলো কতো,
মনেতে আমার আজও গেঁথে আছো প্রিয়।
স্বপ্নের মাঝে দেখা দিয়ে গেলে তুমি-
সে আবেশ চোখে এখনো জড়িয়ে আছে ,
জানিনা আবার কবে দেখা পাবো,
অপেক্ষাতে কি এ জীবন কেটে যাবে। -
কবিতা- কবে থেকে ডুবে আছি
কবে থেকে ডুবে আছি
-সঞ্জিত মণ্ডলজানো অমৃতা, কবে থেকে ডুবে আছি,
অবোধ বালক জ্ঞান হয়নিকো মোটে-
তবু্ও তোমাকে কতো ভালোবেসে গেছি,
কে তোমাকে অতো সুন্দর করে দিলো!
দিশেহারা সেই জন্মলগ্ন থেকে,
তখন থেকেই বিস্ময়ে চেয়ে থাকি-
বিস্ময় ছিলো তোমার শ্রীমুখ দেখে,
ভালোবাসি তাই তুমি এতো সুন্দরী।আমার দু’চোখ বিস্ময়ে আজও নত,
হৃদয় দুয়ার খুলে রাখি অবিরত-
কি জানি কখনো বদলাবে নাকি তুমি,
মুখে আর বুকে অমৃত রয়েছে জানি।
যে বিধাতা গড়ে তোমার ও দেহ খানি,
ধন্য জীবন ধন্য শ্রী মুখখানি –
সন্তান পাবে অমৃত ভাণ্ড খানি,
প্রেমিক সুজন বলবে সোহাগ বাণী।চাঁদ তারা শুধু আকাশের গায়ে নয়,
নারীর কাছেও চাঁদ তারা হার মানে-
কে গড়েছে এই বিস্ময় ভরা নদী,
পাহাড় তো জানে ঝর্ণার পরিচয়।
অরণ্য জানে কোথায় বাহারী লতা,
যদি ঝড় ওঠে কতো ফুল ঝরে যায়-
ঝড় থেমে গেলে নতুনের ছোঁয়া লাগে,
ভালোবাসা, প্রেম, স্নেহ আরো উথলায়। -
কবিতা- শেষ বিকেলে মেঘের চিঠি
শেষ বিকেলে মেঘের চিঠি
– সঞ্জিত মণ্ডলডেকেছিল মেঘ বলেছিল কথা কবিতার কানে কানে,
জেনে রেখো আমি অশ্রুধারায় ঝরে যাই রাতে দিনে।
ব্যথা দিও না’কো হৃদয়ে আমার কাঠফাটা রোদে দিনে,
মনে রেখো আমি হৃদয়ে তোমার সৃষ্টি আনবো জিনে।
চিঠি পাঠিয়েছি কত না কাহাকে কেউ তোলেনিকো কানে,
কত কেউ কত হেয় না করেছে ঝরেছি বাদল দিনে।
জেনে রেখো আমি সৃষ্টি সুখের উল্লাস আনি মনে,
সৃষ্টি বাঁচবে, বিধাতা হাসবে, ফুলে ফলে পথ চিনে।
বোলোনা বন্ধু আড়ি করে আছ এমন মেঘলা দিনে,
জেনে রেখো আমি হাসি ফোটাবই গোমড়া মুখের দিনে।
তুমি কি দেখেছো সে রূপ আমার আকাশের কোনে কোনে,
চিঠি পাঠিয়েছি হৃদয়ে তোমার কাল বৈশাখী দিনে।
সে চিঠি পড়েছো বিশ্বাস করি তাই আমি পূজা পাই,
তুমি যে আমার অতি প্রিয় প্রিয়া তোমারে হৃদয়ে চাই।। -
কবিতা- ঘুম ভেঙে গেলো বলে
ঘুম ভেঙে গেলো বলে
-সঞ্জিত মণ্ডলআমি কি জেনেছি স্বপ্নে এসেছে কে-
ঘুম ভাঙা গান কেন সে গাইলো বলো,
রাতের তারাকে বার্তা দিয়েছি বলে,
চাঁদ হেসে শেষে আকাশেই ডুবে গেলো!
ফুল পরী নাকি জল পরী সে জানিনা-
দু’চোখ ভরে যা দেখেছি তা বলবো না,
স্বপ্নতে ছিলো মায়াময় অবয়বে,
পরীদের আমি কতোটুকু চিনি বলো?উর্বশী যদি রাতের আকাশে ভাসে-
ঘৃতাচী আকাশে উড়ায় আঁচল খানি,
ভরদ্বাজ কি ধারণ করতে পারে,
মাটির পাত্রে রাখে সে স্খলিত মণি।
শুকতারা সে কি সুদূরের ভালোবাসা-
চাঁদ হেসে দিলে জ্যোৎস্না ভাবেনি কেউ,
উত্তাল নদী সাগরেই মেলে যদি,
মোহনার কাছে ঘুরে মরে কতো ঢেউ।বেল পাহাড়ির দেশে যেতে গিয়ে ভাবি-
আকাশমণিরা হলুদ রঙের তারা,
ঝর্ণার ধারা কি দেখে আত্মহারা,
পূর্ণ মিলনে আনমনা হয় কেউ।
সম্ভোগ যদি পূর্ণ মিলন চায়-
আলিঙ্গনেই শুধু কি তৃপ্ত কেউ,
কোন কথাগুলো হয়নি’কো বলা তাকে
পূর্ণ মিলনে আসবে নতুন কেউ।। -
গল্প- বাদলদিনের হারানো স্মৃতি
বাদলদিনের হারানো স্মৃতি
-সঞ্জিত মণ্ডলআমাদের সবার প্রিয় কবিগুরুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ও স্মরণ করে, এক পুরানো স্মৃতির খাতার পাতা খুলি। গড়িয়াহাটের যে তল্লাটে নমস্য গায়িকা সুচিত্রা মিত্রের বাসস্থান, আমার অফিস তারই কাছাকাছি। বড় জমজমাট জায়গা। নানা কর্মসূচির মহড়া চলতে থাকে সেখানে প্রতি নিয়ত, তার বেশীর ভাগই হয় রাজনৈতিক নয় সাংস্কৃতিক।
মনে পড়ে, সে দিনটা ছিল, ঝরো ঝরো মুখরিত বাদলের দিন। বৃষ্টির জন্য হোক অথবা মাসের শেষ বলে হোক, অফিসে গ্রাহক সংখ্যা খুবই কম। কাঁচের জানালার বাইরে বৃষ্টিস্নাত দিন দেখতে দেখতে মন মোর মেঘের সঙ্গী। কারো বা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে, কারো বা খোলা আকাশের নীচে ভিজতে ভিজতে বৃষ্টি দেখায় এক অনির্বচনীয় স্বর্গীয় সুখানুভূতি হয়। বৃষ্টি দেখতে ভালোবাসেনা, এমন বাঙালী আছে কিনা জানিনা। থাকলেও তাদের সংখ্যা হয়তো নিতান্তই কম।
আমিও বাঙালি, তন্ময় হয়ে বৃষ্টি দেখছি। ঝাপসা বেলার আবছায়াতে দেখছি আমি চেয়ে, থমথমে মেঘ ভিড় করেছে সারা আকাশ ছেয়ে। কেয়াতলার সুউচ্চ অট্টালিকা যেমন আর রবীন্দ্র সরোবরের গাছগাছালিও তেমন, সবই মনে হচ্ছে, ধোঁয়া, ধোঁয়া, ধোঁয়া। সইতে পারিনা, কথা কইতে পারিনা, ব্যথা ভুলতে পারিনা বৃষ্টিতে।
এই অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরার বেলায় মন আমার প্রজাপতি হয়ে শুধুই তোমাকে চায়। মনে মনে বলি তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, তোমাকেই চাই, তোমাকেই চেয়েছি প্রিয়তমা। এখানেই, এই অফিসেই, যদি চলে আসো, গুটি গুটি পায়ে, পারলে ভেজাবো তোমায় আপন মনে। মনে হয় আজিকার এমন বাদল দিনে, তোমার হৃদয়খানি পারবো আমি নিতে জিনে।
এমনই স্বপ্নময়তার মাঝে শ্রীমতী সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া রবীন্দ্র সংগীত গান ভেসে আসে-
“আমি শ্রাবণ আকাশে ওই দিয়েছি পাতি
মম জল-ছলো-ছলো আঁখি মেঘে মেঘে।
বিরহদিগন্ত পারায়ে সারা রাতি অনিমেষে আছে জেগে।।
যে গিয়েছে দেখার বাহিরে আছি তারি উদ্দেশে চাহি রে,
স্বপ্নে উড়িছে তারি কেশরাশি পুরবপবনবেগে।।
শ্যামল তমালবনে
যে পথে সে চলে গিয়েছিল বিদায়গোধূলি-খনে
বেদনা জড়ায়ে আছে তারি ঘাসে, কাঁপে নিঃশ্বাসে–
সেই বারে বারে ফিরে ফিরে চাওয়া ছায়ায় রয়েছে লেগে।।”আমি স্তব্ধ। “যেন কোন শৈলশিখর পারে, এক ঝাঁক বুনোহাঁস পথ হারালো!!
একা একা বসে আছি জানালা পাশে,
সে কি আসে আমি যারে বেসেছি ভালো।।”
চমকের এখানেই শেষ নয়, বিশেষ করে আজকের দিনে তা তো হবার নয়। আমার ভাঙা হৃদয়ের দখিন দুয়ারে হলো সোনালির উদয়। আমার মনের গহীনে সে এক তোলপাড় করে ঢেউ তুলে দিয়ে ডুব দিয়ে গেছে বিস্মৃতিচারণায়। সে কথা লিখেছি আমি মনোজোছনায়, চৈত্রপবনে, আমারই লেখা নীল দিগন্তে নামে লেখা বইখানায়।
সোনালি তার নাম।
সেদিনও ছিল ঝিরঝিরে হালকা বৃষ্টি মুখরিত দিন। ক্লাস টেন-এ পড়ি তখন, কোচিং-এর পড়া সেরে ফিরছি যখন। দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে, কদম গাছের নীচে। বলি তাকে ডেকে, কি হল গো মেয়ে, কেন তুমি অমন করে আছো চেয়ে নীপবীথির পানে। বলো নাগো কিসের মায়ায়? আমার কাব্য করা কথায়, মাথা নীচু করে বলেছিল সে, দুটো কদম ফুল পেড়ে দেবে আমায়? দ্বিরুক্তি করিনিকো আমি, ভিজে গাছে চড়ে, তিনটে ফুল পেড়ে তার হাতে দিয়েছিলাম তুলে।
মাথা নীচু করেই বলেছিল সে, বড় তিনটে যে দিলে? বলেছিলাম ডেকে, দুটো চেয়েছিলে, দুটোই না হয় নিলে, তৃতীয়টা ফিরে তুমি দেবে আমাকেই। ওতে লেগে থাকবে তোমার হাতের পরশ। বাড়ি ফিরে তোমার দেওয়া ফুলের পরশ মাখবো সারা গায়ে। লাল হয়ে উঠছিলো তার কপোল, মৃদু হেসে বলেছিলো, আমায় পরশ পেলে কি এমন সুখ পাও! সত্যি চাও তো বলো, নিজেকেই পুরো দিয়ে দেবো তোমায়। বলেছিলাম হেসে, আজকে শুধু পরশটুকুই দাও। কি আশ্চর্য চারিদিকে চেয়ে দেখে আমার বুকে মাথাটি তার রেখে সলাজ চোখে মুখের পানে চেয়ে বলেছিল, একটা চুম্বন দাও, তুমি একটা চুম্বন দাও।আর কিছু নয়, সেই প্রথম সেই শেষ। শুনেছি অনেক পরে, ওরা চলে গেছে মামার বাড়ির দেশে। আজ তবু মনে হয়, যে ছিল স্বপন চারিণী, তারে ভুলিতে পারিনি। যেন কোন স্বপ্ন মায়ায় আজও ব্যথাভরা বুকে ভাবি, বড় হয়ে গিয়ে সোনালিরা সব কোথায় যে হারিয়ে যায়, প্রাণপণ খুঁজে আজও পাইনি আমি তোমায়।
মনে মনে আমি কবিগুরুকেই আনি, গুনগুন করে গাই,“কোন পুরাতন প্রাণের টানে
ছুটেছে মন মাটির পানে।।
চোখ ডুবে যায় নবীন ঘাসে, ভাবনা ভাসে পুব-বাতাসে-
মল্লারগান প্লাবন জাগায় মনের মধ্যে শ্রাবণ- গানে।।
লাগল সে দোল বনের মাঝে
অঙ্গে সে মোর দেয় দোলা যে।
যে বাণী ওই ধানের ক্ষেতে আকুল হলো অঙ্কুরেতে
আজ এই মেঘের শ্যামল মায়ায়
সেই বাণী মোর সুরে আনে।।”থাক, সেদিনের কথাখানি। কবিগুরুর গানের রেশ টানি। কাকে নাকি বলেছিলেন তিনি, যখন তোমার গলায় আমার গান শুনি, মনে হয় গানখানি তোমাকেই দেখে লিখেছি যেন আমি। আর, আমরা তো জানি, তাঁর কত শত গান যেন অমর লেখনী। তবু তারও মাঝে মনে হয়, বরষার গানগুলি রূপে রসে গন্ধে বারিতে অন্তত আমার কাছে শ্রেষ্ঠ সুনিশ্চয়। যে গান শুনলে পরে জুড়ায় দেহ মন, জুড়ায় পরাণ, ভালোবাসি বড় ভালো লাগে বিশ্ব বন্দিত রবিকবির গান। আজও বৃষ্টি পড়লেই মনে হয়,
“চিত্ত আমার হারালো আজ মেঘের মাঝখানে–
কোথায় ছুটে চলেছে সে কোথায় কে জানে।।
বিজুলি তার বীণার তারে আঘাত করে বারে বারে,
বুকের মাঝে বজ্র বাজে কী মহাতানে।।
পুঞ্জ পুঞ্জ ভারে ভারে নিবিড় নীল অন্ধকারে
জড়ালো রে অঙ্গ আমার, ছড়ালো প্রাণে।
পাগল হাওয়া নৃত্যে মাতি হল আমার সাথের সাথি-
অট্ট হাসে ধায় কোথা সে, বারণ না মানে।।”বাদল দিনের হারানো স্মৃতিকথা আপাতত এখানেই ইতি টানলাম।
-
কবিতা- ভুলে যেতে চাই
ভুলে যেতে চাই
– সঞ্জিত মণ্ডলভুলে যেতে চাই চেষ্টাও প্রাণপণে-
সদা হেরে যাই অবাধ্য পিছুটানে,
এতোটাই যদি আজও পিছনেই ডাকো,
কি করে পারলে তড়িঘড়ি পর হতে!
ভুল শোধরাতে সহানুভূতির হাওয়া –
গায়ে জ্বর মনে অস্থির কাঁপুনিটা,
আজও কি করে যে এমনটা পিছু ডাকো,
ভুলের মাশুল জীবনে মিটবে নাকো।মনে হয়েছিল তুমি বুঝি জিতে গেছ-
গাড়ি বাড়ি আর দাস দাসী পেলে কতো,
ভবঘুরে কবি রোজগার নেই অতো,
মন ঠিক বোঝে প্রেমের সঙ্গে উপাচার লাগে কতো।
তোষামুদে প্রেমে প্রথমেই পরাজয়-
বেড়াজাল শুধু অবস্থা ভেদে নয়,
তবু সুন্দর শ্রীমুখটা বুকে রেখে,
মনের দরজা খুলে রাখি বোধহয়।নিরাশার কথা কখনো ভাবিনি মনে-
বিশ্বাস নাকি ভ্রান্তি জানিনা সেটা,
বিবেকের বাণী আর শুনি না’কো কানে,
এখনো এ মনে তুমিই অপরাজিতা।
জানো অমৃতা, সেদিনগুলোকে স্বপ্নই মনে হয়-
কোনো দিন তুমি ছেড়ে চলে যেতে পারো,
নদী সাগরের ঢেউ জানি ফিরে আসে,
জানিনা সে ঢেউ করবে কি আশাহত।
দারুচিনি দ্বীপ মনের ভিতরে আছে-
এসো, দুজনেই খুঁজি তার পরিচয়,
একদিন ঠিক খুঁজে পেয়ে যাব জানি,
শুনবো না কথা বুকে নেব নিশ্চয়।।