-
কবিতা- সে
সে
-সীমা চক্রবর্তীপ্রতিবার আসি বলে যায়, যাওয়ার সময়,
এই বার ‘চলি’ বলে সেই যে গেলো চলে
হাতে দিয়ে একগোছা রক্ত গোলাপ
আর তো এলো না ফিরে
প্রতীক্ষার প্রতি পলে
নদী হয়ে বয়ে যায় একরাশ দ্বিধা সংশয়…তারপর কত বার পৃথিবীতে দিনরাত এসে চলে গেছে
বসন্তও ঘুরে গেছে, গেছে বৃষ্টির দিন,
আমার নিস্তব্ধতা কে ঘিরে দৃষ্টি হয়েছে ক্ষীণ
উৎকন্ঠিত আমি আজও আশায় আশায়…
শব্দ পেলেই বারবার দরজা খুলে দেখি
ফিরে কি এলো সে কী ?
যায় না দৃষ্টি বেশি দূর অলিগলি রাস্তায়
তবু চেয়ে থাকি এক বুক শূন্যতা নিয়ে অসীম নীরাবতায়
সে নেই কোনখানে, অথচ আমি গভীর বিশ্বাসে।কথা ছিল ‘চললাম’ বলে আমি যাবো আগে
দিয়ে যাবো তার হাতে রজনীগন্ধার স্তবক,
দিকশূন্যপুরে… এভাবে বড় একা লাগে
সে যে আমাকে হারিয়ে আগেই গেলো চলে
ব্যথিত দৃষ্টিতে আমি একা জেগে পরাজয়ের মালা গ’লে.. -
কবিতা- সেদিন ফিরে এসো
সেদিন ফিরে এসো
-সীমা চক্রবর্তীএমনও দিন আসবে
যেদিন কন্ঠ তোমার ভুলে যাবে সুর তান
ভুলে যাবে কারো ভেজা অভিমান
ভুলে যাবে তোমার সারা জীবনের সঞ্চয়,
সেদিন তুমি ফিরে এসো চলে…
ফিরে এসো আমার আয়ত্তের পরিধিতে
শেষ বেলা’কার হিসেব নিতে
আনমনে গেয়েছিলে যত নিবিড় নিরালার গান…।যখন ডাহুক ডাকা উদাস দুপুরে, নিঃসঙ্গতার নিগূঢ় বাঁধনে
প্রাণপণে ভেবে চলেছো ফেলে আসা স্বরলিপি,
তবু দিচ্ছে না ধরা কারণে বা অকারণে
অন্ধকারে হাতড়ে চলেছো অযাচিত উৎকন্ঠার ঢিপি…
সেদিন তুমি ফিরে এসো চলে
ফিরে এসো আমার সাদামাটা মনের আঙিনায়,
যেখান থেকে দূরের ঐ আকাশ ছোঁয়া যায়
চাঁদ নেমে আসে জাফরিকাটা অলিন্দে
ক্লান্ত দু’চোখে নির্ভাবনার শান্তি নামায়।তোমার রাতও একদিন প্রাচীন হবে
প্রাচীন হবে তোমার অভিজ্ঞান,
তোমার প্রভাতী সূর্য ধরবে না সেদিন ভৈরবি তান,
ছড়িয়ে যাবে বাঁধন খোলা যন্ত্রণারই গান।
তখন তুমি ফিরে এসো চলে
ফিরে এসো অমলিন বিশ্বাসে
এক আকাশ ভালোবাসার প্রতিদানে… শেষ বেলায়,
নিজেকে বেঁধেছি আশ্বাসে , ঝিম ধরা অবকাশে
তোমার ভুলে যাওয়া সাবেকি গানের প্রাচীন বর্ণমালায়…। -
কবিতা- ক্ষত
ক্ষত
-সীমা চক্রবর্তীঅপলক চোখে গোধূলি বারান্দায় আলগোছে দাঁড়িয়ে
আলসেমিকে দু’পায়ে মাড়িয়ে…
সাঁঝের আলো গাছের পাতায় শুয়ে আড়মোড়া ভাঙে,
ঘরে ফেরার আনন্দ পাখিদের ডানা ছুঁয়ে তিরতির…
আকাশ জুড়ে নানা রঙের ভীড়…
এসব তো আগেও দেখেছি,
তবুও যে আজ মনকে দিচ্ছে নাড়িয়ে…. ।এক বস্তা যন্ত্রণা বুকের পাথরে ঘঁষা খেয়ে
অন্ধকারে চকমকির মতো জ্বলছে
সে আগুন বড় অসহায়… বড় নিস্পাপ…
বলতে না পারা কথা’রা মরা মাছের মতো চেয়ে…
উষ্ণ ধারার কল্লোলিনী হতে গিয়ে
অদৃশ্য শাসনে জমেছে মেরু ঠোঁটে
হিজিবিজি অক্ষরেরা কাঁপা কাঁপা অস্ফুটে,
বুঝি না… এ কেমন অভিশাপ….!!!গোধূলির ধূসরতা ক্রমশ আঁধার মাখছে,
অস্পষ্ট আকাশে কী বিবর্ণ বিপন্ন একফালি চাঁদ !!!
হয়তো তার ভাঙা অংশ নিয়ে জানাতে চায় ফরিয়াদ।
জোছনার মৃদু আলোয় তাই করুণ উৎসব
তারই মাঝে জীবন যেন অনাদিকাল নীরব।আলটপকা স্বপ্ন-আশা’রা কখনো ফিরে ফিরে আসে
আবেগি হতে চেয়ে বিদেহীর মতো ভাসে…।
বিরামহীন ঘড়ির কাঁটায় সময় যাচ্ছে বয়ে
স্তব্ধ আমি রয়ে গেছি আয়না’র বোঝা হয়ে।
ঘুম যেন মৃত্যুর মতো
চাইলেও যায় না পাওয়া যথাযথ…
রাত শেষে দু’চোখে তাই অযাচিত ক্ষত…। -
কবিতা- শুধু একবার
শুধু একবার
-সীমা চক্রবর্তীতোমার স্বেচ্ছায় নির্বাসনের গন্ডিতে আমি
বিধ্বংসী ভূকম্প তুলবো,
তোমার মনের অতলে জমা স্থির লোনা জলে
আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বালবো।
পুড়িয়ে দেবো দূর্বল মুহূর্ত-ধারী হৃদয়
কম্পনে ঝুরঝুর করে ঝরে পরবে বঞ্জার শব্দরা,
তোমার উদাসীন দৃষ্টি থেকে ছিনিয়ে নেবো প্রত্যয়।
যে মনের দোরে খিল এঁটেছ নির্দ্বিধায়
সেখানে একবার শুধু একবার, ঝড়ের তান্ডব চাই
যে নির্লিপ্ততার চাদরে নিঃশব্দের ফসল বুনেছো
বজ্রপাত ঘটাবো তার গায়ে…।তোমার নীরাবতার পুরু খোলসে যে শ্যাওলার আস্তরণ,
আমি এসিড বৃষ্টি তে ফাটল ধরাবো
তোমার আবেগী শৈথিল্যে চরম সর্বনাশ এনে
টলটলে নির্মল জীবনের উদ্ভবে অন্তরালহীন বাসর বসাবো।
আসলে তোমার আত্মমগ্নতা আমাকে বড় বিচলিত করে…
এক দুর্বিষহ যন্ত্রণার দিনলিপি রোজ লেখা হয় প্রাণে,
তাই, একবার শুধু একবার…
আমার স্বপ্ন চেতনার কিছু ছাপ রেখে যেতে চাই
তোমার ভিতর… জ্ঞানে… বা অজ্ঞানে…। -
কবিতা- বিবাদ
বিবাদ
-সীমা চক্রবর্তীআমারও তো ছিল ঐ একই কথা
একই অধীরতা
ছিল আদুরী আশ্লেষী গভীরতা
তবুও কেন কিছুই গাঁথা গেলোনা তার মতো করে ?
যৌথ পথ চলা যেন থমকে গেলো পথেরই প’রে…
অকারণে হেসে ওঠা বেতাল কথার ছন্দে
যেমনই থাকি
তবু তো ছিলাম ভালো আর মন্দে
নাই বা জানতে চাইলো “কেমন আছো?”
তবুও ছিলাম রাত টা বাদে সকাল সন্ধ্যে।যখন ভালোবাসা ঘর বাঁধলো, তখনই শুরু বিবাদ
আমার আর আরণ্যক হওয়া হলো না
আমি হলাম দিকশূন্য
সে হলো আবাদ।
হাতে ধরে শিখিয়ে ছিল সুরে শব্দের মারপ্যাঁচ
সেই ঝংকারে হঠাৎই বিষাদের আঁচ
শেষ অধ্যায় টুকু ফিরিয়ে দিলো অক্লেশে
আদুরী সময়ের মন – মুকুরে, নতুন করে
লক্ষ কোটি হিজিবিজি দাগ
যেন শমন জারি হলো ভালোবেসে।
জানলার এপাশে ক্রমাগত হাতুড়ির ঘাত
ওপাশে আলোর বন্যায় ডুবে আছে পুনম কি রাত।
থাকাটুকু ছাড়া এখন আমার আর কিছুই নেই। -
কবিতা- মুখোমুখি একদিন
মুখোমুখি একদিন
-সীমা চক্রবর্তীবৃষ্টি ভেজা শ্রাবণ ছিল তখন, প্রথম দেখার দিন
তারপর ধুয়ে গেছে কত অযুত কাল
ক্রমে ভেঙেছে স্বপ্ন, অলস দিন…
বদলে গেছে দিন যাপনের অভিমুখ
তবু আজও মুখোমুখি আমরা দুজন
পুরনো কথার রেশে সেই একই দুঃখসুখ।
যদিও ঠোঁটের উপর বসে মৌন কালো রাত
আবার শপথ বাক্যের নেই প্রতিশ্রুতি
নেই সেদিনের মতো মরশুমি বর্ষার ধারাপাত।অপ্রেমে… দুজনে মুখোমুখি, না বলা কথার ভিড়ে
এক কাপ উষ্ণ চা’এর জোয়ারে,
এ যেনো পরস্পরের অলিখিত চুক্তি,
বিগত সাত জন্মের শেষে
অপাংক্তেয় জীবন খোঁজার ছলে, জীবনের রঙ্গমঞ্চে
অচেনা টানে মিশে আছি বিহ্বল আবেশে।
মনে মনে সাজিয়ে চলেছি কতকথা,
কত গল্প, মান অভিমান, কত গোপন ব্যথা
বুকের অতলান্তে বন্দী, যেন কয়েদখানা
ভাবি, প্রেম কি হয় শুধুই একপেশে…?
না আরও কিছু আছে জীবনের শেষে….প্রমিত কথারা অনুচ্চারিত অলস ঠোঁটের ফাঁকে
ভুলবোঝাবুঝির মস্ত ঢেউয়ে ভিজে চুপকথার ডানা…..
মুখোমুখি…. তবু চোখ সুদূর
মনের খবর কে আর রাখে,
কেই’বা ভাঙে তার নিভৃত যাপন,
গম-রঙা আলো যেন দুজনের মাঝে টানা,
আজও রয়ে গেছে তোমাকে তেমন করে জানা….. !!! -
কবিতা- যদি তার দেখা পাই
যদি তার দেখা পাই
– সীমা চক্রবর্তীযদি তার দেখা পাই মেঠোপথে
অথবা লক্ষ দারুচিনি গাছের ভীড়ে
সে কি চিনতে পারবে আমারে ?
এমনই তো ভেবে ছিলাম তিরিশ বছর আগে…..
যখন জীবন ছিলো তরতাজা পুরো ভাগে
আজ তিরিশ বছর পর, এই প্রান্ত বেলায় এসে
জীর্ণ দেহে….. ক্লান্ত চোখ… বলিরেখার জটাজালে
হাল ভাঙা নাবিকের মতো, হতাশার শেষ বন্দরে,
যদি কোনো বিষন্ন সকালে
দেখা হয়ে যায় তার সাথে আমার
দু’দণ্ড চেয়ে, মৃদু হেসে সেকি করবে
কুশল বার্তার লেনদেন …
তার ঠোঁটে এখনও আছে কি লেগে বনলতা সেন…. ?হয়তো বিদর্ভ নগরে , নয় অন্য কোনো উপনগরে
হয়তো নবান্নের দেশে, বা মলয় সাগরে,
হয় যদি আমাদের দেখা….
ভোরের স্নিগ্ধ শিশিরের আয়নার প্রতিবিম্বে
যেখানে নতুন করে রোদ্দুর মাখে চিল
সব পাখি ঘরে ফিরে যায়… নদী মেশে মোহনায়….
পান্ডুলিপি লেখায় যখন হয়ে যায় গরমিল
তখন যদি নিয়ে আসি
দুহাত ভরে সিংহলের সমুদ্র সফেন
তার চোখে কি তখনও থাকবে লেগে বনলতা সেন…?তিরিশ বছরের ধূসর জীবনের রৌদ্র প্রখর রাস্তায়
হঠাৎ করেই যদি দেখা হয়ে যায় মুখোমুখি
ঝরে পরা শুকনো পাতায়
হয়তো তারাদের ভীড়ে
ক্লান্ত প্রাণে……. সন্ধ্যার নীড়ে
হয়তো বা দুজনেই আধা – সুখী….।
দেখা যদি হয় একটি বার
যেখানে জীবনের সব রং অন্ধকারে মিলেমিশে একাকার…।
শুধু তাকে ভালোবেসে….
আজ ত্রিশ বছর পেরিয়ে এসে,
পৃথিবীর নিভে আসা রং মেখে
খুব জানতে ইচ্ছে করে….
যে নামে হৃদয়ের তন্ত্রিতে তার বেজে উঠতো বিঠোফেন…
এখনও কি তার বিহ্বল দৃষ্টিতে লেগে নাটোরের বনলতা সেন….? -
কবিতা- দূরত্ব
দূরত্ব
– সীমা চক্রবর্তীফেরার ইচ্ছে থাকলেও ফেরাটা আর হয়ে ওঠেনি
দিন দিন দূরত্ব বেড়ে গেছে,
যদিও দূরত্বের পরিমাপ করা হয়নি কখনো
পার্থক্যটা চরম,
বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে আছে,
দেখা দেওয়া এক চুল-চেরা ফাটল
একদিন দুই মেরুকে ছুঁয়ে দিল,
বিহ্বল প্রাণ পাবেনা জেনেই
চাইনি কিছু নিটোল!
জোড়াতালি দিতে গিয়ে সব আরও এলোমেলো অগছালো।
এক অদৃশ্য পাঁচিল যেন দুজনের মাঝে,
চাপা পড়েছে তাতে কত স্মৃতি কত সখ আহ্লাদ,
সে পাষাণ নির্বিকারে দাঁড়িয়ে…অদয় জল্লাদ।কিছুই তো ফেরে না কখনো …
যারা যায় তারা কেউই ফেরে না
শুধু জলের দাগ শূন্য চরে ছাপ রেখে যায়,
তামাদি ঘ্রাণ আমাদের দূরত্ব বাড়ায়…
বয়স বাড়ে, দু’টো মনের মাঝে দূরত্ব তারও বেশি বাড়ে….
বাড়ে পাঁচিলের ঘনত্ব,
ক্রমশ আঁধার ঘনায় এ পারে
হয়তো বা ওপারেও….
তবু আর হয় না ফেরা,
ভুলে যায় কোনো একদিন ভালোবেসেছিল তারা…
কত অঙ্গীকার, কত প্রতিশ্রুতি,
কত রক্তক্ষরণ আর দীর্ঘশ্বাসে লেখা হয় এক জন্মের আহুতি। -
কবিতা- হঠাৎ যদি
হঠাৎ যদি
-সীমা চক্রবর্তীহঠাৎ আবার স্মৃতির গলি পথে
কেমন হতো আসতে যদি ফিরে,
নোনা জলের লজ্জা ধুয়ে দিতে
নামতো বৃষ্টি ক্লান্ত শহর ঘিরে।নতুন করে ফুটতো রাঙা পলাশ
অতর্কিতে বদলাতো সময় আবার,
আরো একবার পথ হারাতো মন
লেনা-দেনার চলতো কারবার।ফিরতে যদি আশার উজান বেয়ে
তুমুল জোয়ারে ভাসতো ভাঙা বন্দর,
ফাগুন হাওয়া বইতো শহর জুড়ে
ভাঙনের গান ভরতো মনের অন্দর।সত্যি কি আর ফিরবে কোনোদিন
সোনা-রোদের লাজুক দিনগুলি,
স্মৃতির খেয়ায় মাঝ-দরিয়ায় ভেসে
অমৃত ভেবে বিষাক্ত পাঁক তুলি। -
কবিতা- তবুও
তবুও
-সীমা চক্রবর্তীযাবো বললেই, যায়না যাওয়া জানি
তবুও আছি যাবারই পথ চেয়ে,
জমেছে মনে মস্ত একটা মেঘ
যখন তখন বৃষ্টি নামায় ধেয়ে।একটা প্রবল ঝড় আসছে জানি
তবুও আছি বিকারহীন পড়ে,
ভাঙেই যদি দরজা জানলা ছাদ
চারদেওয়ালও যাবেই জানি নড়ে।দাঁড়িয়ে আছি চোরাবালির উপর
আধা শরীর ডুবেই গেছে কবে,
তবুও মুখে মারছি রাজা মন্ত্রী
ভাবছি মনে সুখেই আছি ভবে।সব মেঘেতে বৃষ্টি হয়না জানি
তবুও যখন আকাশ ভরে মেঘে,
অহল্যা মনের চপল ছোঁয়া নিয়ে
ময়ুর হওয়ার স্বপ্ন দেখি জেগে।মন পুড়লে যায় না দেখা জানি
তবুও তাতে শ্মশানের গন্ধ ভাসে,
একটা পা চিতায় আছে উঠে
আজো অন্য পা জীবন ভালোবাসে।