• কবিতা

    আমার ভারত

    আমার ভারত
    -কৃষ্ণ বর্মন

     

     

    সার্বভৌম ভারত ধর্মনিরপেক্ষ ভারত
    গনতান্ত্রিক ভারতের প্রজা আমি।
    তথাকথিত প্রজার মত রাজতন্ত্রের যাতনা কলে
    আমি নিষ্পেষিত অসহায় নই।
    রাজদন্ডের দন্ডবৎ ভয় নেই আমার ভারতে।
    শৃঙ্খলের নিষ্ঠুর বন্ধন টুটে বহু আগেই
    অন্ধকারের গর্ভ থেকে উদিত হয়েছে
    সাম্য আর স্বাধীনতার সূর্য।

    আমার ভারত বীর্যে বলিষ্ঠ
    আমার ভারত শোর্যে শ্রেষ্ঠ
    আমার ভারত ত্যাগে অকৃপণ
    আমার ভারত শান্তির শ্বেত কপোত।

    আমার ভারত আমার দেশ
    নব চেতনার নব উন্মেষ।

    অথচ ধর্মের নামে জাতের নামে
    ক্ষতবিক্ষত আমার দেশ আমার মা।
    এই ভারতের আলোক শিশুকেই রাতের অন্ধকারে
    আবর্জনায় রেখে যায় জন্মদাত্রী।
    আবর্জনা কুড়োতে কুড়োতে
    সমাজের আবর্জনার মতই ওরা বড় হয়
    ফুটপাথে,কারখানায়,দোকানে।
    রক্তে বারুদে বিষাক্ত বাতাস
    শ্লথ বিষক্রিয়ায় হত্যা করতে চায়
    শান্তির অমৃতবানী।
    অর্থের দ্বৈরথে ভোগী হয়ে ওঠে যোগী
    পথ হারায় ভগীরথ।

    তবুও আমার ভারত আমারই।

    আজো আমি স্বপ্ন দেখি—-
    আমার ভারতের
    নেতাজীর ভারতের
    মহাত্মার ভারতের
    রবি ঠাকুরের ভারতের
    নজরুল আর ভগৎ সিং-এর ভারতের।

    হে আমার নূতন ভারতের নব কিরন
    তোমরাই একদিন সূর্য হবে,
    তোমরাই আনবে সেই প্রভাত,
    আলো যেখানে অলৌকিক নয়,
    ভয় পেওনা সাময়িক রাত।

  • কবিতা

    ঐশ্বরিক

    ঐশ্বরিক
    – কৃষ্ণ বর্মন

     

     

    ইষৎ আভাষে ইশারায়
    ইতস্ততঃ সব সঙ্কোচকে দূরে সরিয়ে
    তোমাকে ঈশ্বর ভেবেছিলাম বলে
    ইতরের দল পথে ঘাটে তীর্যক উক্তিতে
    তিতিবিরক্ত করে তুলেছিল আমার প্রতিটি দিন।
    তোমার চোখ বলেছিল আজও কাউকে বিশ্বাস করা যায়।
    তোমার নিঃশ্বাসে ছিল নির্ভরতার প্রতিশ্রুতি।
    এক পা দুই পা করে এগোতে এগোতে
    অনেকটা বন্ধুর পথ পেড়িয়ে
    চোখ বন্ধ করাটা আমার বড় ভুল ছিল।
    আজও সেই ভুলের মাশুল গুনছি।

    ঈশ্বর নেই।
    তবুও না জানি কেন ঈশ্বর ভক্তি
    আজও একই রকম অটুট আছে।
    আসলে ঈশ্বর পাল্টে যায়
    অথবা মানুষ থেকে ঈশ্বরে উত্তীর্ণ হওয়া ঈশ্বর
    আবার নেমে আসে অমানুষের পর্যায়ে
    অথচ বিশ্বাস পাল্টায় না।

  • কবিতা

    হরিজন

    হরিজন
    -কৃষ্ণ বর্মন

     

     

    ওরা হরিজন
    ওরা কোনোদিন হয়ে উঠতে পারেনি কারো প্রিয়জন।
    প্রয়োজনে ওরা অন্দরমহলে প্রবেশ করতে পারে
    অপ্রয়োজনে বাড়ীর ত্রিসীমানাতেও নয়।
    ওরা যে পথে যায়
    সে পথ মাড়ায় না সভ্যজন
    ওরা হরিজন
    কোনোদিন হয়ে উঠতে পারেনি কারো প্রিয়জন।

    ওরা তো হরির জন
    তবুও হরির কৃপা থেকে বঞ্চিত ওরা।
    হরির প্রেম প্রীতি ভালবাসা পৌছায় না ওদের কাছে।
    হরিনামে উদ্ধার হয়ে যায় কত পাপী তাপী
    অথচ ওদের অচ্ছ্যুৎ দশা ঘোচে না।
    নামের গুনে খোঁড়ায় নাচে
    কথা বলে বোবা
    ওদের কথা কেউ বলে না।

    ওরা পতিত
    তবে পতিত পাবন ওদের আপন নয়।
    সমাজের পুঁতিগন্ধে ভরে ওঠে ওদের জীবন
    তবুও জীবনের সুবাস ছড়ায় ওরা।
    মেথরের পরিচয় বহন করতে করতে
    ওরা মথ হয়ে যায়
    অথচ অলিতে গলিতে ছেড়ে দেয়
    রঙীন ভালবাসার প্রজাপতি।
    তবুও ওরা হরিজন
    আজো হয়ে ওঠেনি কারো প্রিয়জন।

  • কবিতা

    শব্দ চিরন্তনী…..

    শব্দ চিরন্তনী…..
     -কৃষ্ণ বর্মন

     

     

    শব্দের শবযাত্রা চলে প্রতিদিন প্রতিক্ষণ।
    কেউ তাঁদের দাহ করে কেউ দেয় কবর।
    যত আফসোস যত খেদ যত ক্ষোভ
    জমা থাকে শব্দে শব্দে
    গঙ্গা জল ঢালার পর আজ সব শীতল ছাই।

    কবরের মাটিতে মিশে যায়
    স্বপ্ন,আকাঙ্খা আর ইচ্ছের শব্দেরা।
    স্পন্দনহীন শব্দ শব কাফন জড়িয়ে
    নিশ্চিন্ত নিরাপদ নিদ্রায় যায় শেষের কবিতায়।

    শবযাত্রা আবহমানকাল ধরে প্রবাহমান।
    কোনো বিচ্যূতি বা বিঘ্ন নেই।
    তবুও সব শব্দ শবযাত্রায় সামিল হয় না।
    সব শব্দ শব হওয়ার জন্য জন্মায় না।
    কিছু কিছু শব্দ সরবে কিংবা নীরবে
    শবে শবে প্রাণ সঞ্চার করে
    চিরন্তনী হয়ে ওঠে।

  • কবিতা

    নিঝুম ঘুম

    নিঝুম ঘুম
    -কৃষ্ণ বর্মন

     

     

    ঘুমোতে যাওয়া
    কারণ ঘুমোতে যেতে হয়
    ঘুম ঘুম চোখ
    তবু ঘুম নেই
    যদি দুই চোখ বুজেও আসে
    ঘুম আসে না মনে
    মস্তিষ্ক জেগে থাকে চিন্তা দুঃশ্চিন্তায়
    ঘটনা দুর্ঘটনার আবছা ছবির চলমান স্রোতের আঘাতে
    আৎকে ওঠা মাঝ রাতে কিংবা প্রান্তিক ভোরে
    সবাই ঘুমোতে যায়
    পৃথিবীও যায়
    কারণ ঘুমোতে যেতে হয়
    ঘুম ঘুম চোখ
    তবু ঘুম নেই
    ঘুম আসলে নিঝুম জেগে থাকা
    ঘুম ঘুম ভাব তবুও অভাবী স্বপ্নকে জাগিয়ে রাখা।

  • কবিতা

    পাথুরে কবিতা…..

    পাথুরে কবিতা..
    -কৃষ্ণ বর্মন

     

     

    প্রতিদিন খুব সযত্নে একটি একটি করে
    পাথর বসিয়ে চলেছি বুকের ভিতর।
    পাথরগুলি কোনো হিমালয় কিংবা আল্পস থেকে আনা নয়,
    সেগুলি খুব প্রিয়জন কিংবা বন্ধুর দেওয়া।
    ওরা ভাবছে ওই পাথর দিয়ে সর্বসুখ,

    গৌরব আর নিরাপদ ভবিষৎ-এর প্রাসাদ গড়ব আমি
    ওরা জানে না..
    আমি এখনও অতটা দক্ষ কারিগর হয়ে উঠতে পারিনি।
    আজও আমি গড়তে গিয়ে
    প্রতি মুহূর্তে ভিতরে ভিতরে ভেঙে যাই।

    পাথর জমাতে জমাতে
    যদি কোনো দিন পুরো আমিটাই পাথর হয়ে যায়
    সেদিন যত খুশি আঘাত কোরো,
    যত খুশি পাথর ছুড়ো !
    অভিমান অভিযোগের কবিতা লিখে
    সেদিন কাউকে আর বিব্রত করব না।

  • কবিতা

    সফল সরণী

    সফল সরণী
    -কৃষ্ণ বর্মন

     

     

    আবেগের অভিজাত বায়না পূরণে ব্যর্থ ছেলেটা
    ফুটপাথে এখন অভিযোজনের নুড়ি কুড়ায়
    রাজপথ দিয়ে হেঁটে যায়
    তাঁর এক সময়ের সঙ্গী অভিজাত আবেগরা
    ছেলেটি ওদের চিনতে পারে
    ছেলেটি ওদের পিছু ডাকতে চায়
    ডাকগুলো ভিতরেই বাক্স বন্দী হয়ে রয়ে যায়
    তাদের আর ডাক হরকরা হয়ে ওঠা হয়না।

    একদিন সব নুড়ি কুড়ানো হয়ে যাবে
    একদিন সব আবেগ গুলোই হাঁটবে
    অভিজাত রাজপথ দিয়ে
    তাঁদের পদচারণায় ফুটপাতে
    উড়বে না আর ধূলিকনা
    কোনো নুড়িই রাজপথকে করবে না আলিঙ্গন
    সেদিন ব্যর্থ ছেলেটা
    সেদিন অসংখ্য ব্যর্থ ছেলেরা
    আবেগের অভিজাত দাবীতে নয়
    বরং আভিজাত্যের আবেগে
    রাজপথ আর ফুটপাথকে
    একত্রে সময় সারণীর
    সফল সরণীতে হাতে হাত ধরে হাঁটবে।

  • কবিতা

    মহালয়ার ভোরে

    মহালয়ার ভোরে
    -কৃষ্ণ বর্মন

    আজ মহালয়ার ভোরে
    বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের দৃপ্ত স্ত্রোত পাঠ ও মন্ত্র উচ্চারণ শুনেছি আমি।
    শুনেছি “বাজলো তোমার আলোর বেণু”।
    জেগেছে দুর্গা জেগেছে শক্তি।
    তর্পনে আর অর্পনে জেগেছে ঘুমিয়ে থাকা শুভ শক্তি।

    আজ ভোরেই তো হয়েছে
    সুরের হাতে অসুরের বিনাশ।
    অশুভ শক্তির নিধনে শুভ শক্তি পেয়েছে অমরত্ব।
    সমস্ত দুর্যোগ আর দুর্গতির অনিবার্য করালগ্রাস থেকে
    মানব মুক্তির মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছে
    প্রভাতী মহালয়ায়, গঙ্গার ঘাটে, মন্দিরে।
    শান্তি,শক্তি ও সাম্যের অমোঘ বাণী শুনিয়েছে
    মুখরিত আকাশ বাতাস।

    আজই আমি শুনেছি
    সদ্য বিবাহিতাকে আগুনে পুড়িয়ে মারার খবর।
    আজই বাড়ি ফেরার সুনসান পথে পা বাড়িয়ে
    বাড়ি ফেরেনি সুজাতা।
    হয়তো কাল সকালে হদিশ মিলবে
    ট্রেন লাইনের ঝোপে কিংবা খালে।
    আজই ভোরে চুপি চুপি
    তোয়াল দিয়ে মুড়ে প্লাস্টিকের প্যাকেটে
    ডাস্টবিনে ফেলে রেখে গেছে
    সদ্য অঙ্কুরিত উমাকে।
    আজকের দিনেও মেয়েটি গলায় বক্সের সুরে
    গান গাইতে গাইতে হাত পেতেছে নিত্যযাত্রীদের কাছে।
    বৃদ্ধাশ্রমে দরজার দিকে পথ চেয়ে বসে থাকা
    অপাংক্তেয় বুড়িটার অপেক্ষা শেষ হয়নি আজও।

    আজ সকালেই গোপনে কন্যাভ্রুণের গর্ভপাত
    করিয়ে আসতে বাধ্য করা হয়েছে হানিফাকে।
    ঋতুকালের মাসিক দিনে মনের ভুলে
    ঠাকুর ঘরে চলে গিয়েছিল বলে
    সারা দুপুর বাড়ির উঠোনে কাঠফাটা রোদ্দুরে
    এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে সীমন্তিনীকে।

    আজ ভোরেই অসুরের বিনাশ হয়েছে।
    এবারও ঘর আলো করে বাপের বাড়ি আসছে উমা।

  • কবিতা

    পূজোর গন্ধ

    পূজোর গন্ধ
    – কৃষ্ণ বর্মন

     

     

    ভোরে ঝরে পড়া শিউলির গন্ধে
    সন্ধ্যার মন কেমন করা কামিনীর গন্ধে
    গ্রামের মেঠো পথের ধারে ডোবায়
    ভিজিয়ে রাখা পচা পাটের গন্ধে
    পাগল করা এক পূজোর গন্ধের আভাস পাওয়া যেত এক সময়।
    পূজোর গন্ধে মাতোয়ারা হত সবাই।
    পূজোর গন্ধে মাতাল মন কেয়া পাতার নৌকা হয়ে
    শ্বেতাভ আকাশ সমুদ্রে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে
    নিরুদ্দেশ হত অনির্দিষ্ট পথে।

    এখনও গন্ধ আছে।
    মাতলামি আছে এখনও
    তবে শিউলির নয়।
    এখন এখানে মৃত্যুর গন্ধ।
    বারুদে বারুদে এখন মৃত্যুর ঘ্রাণ
    পূজোর গন্ধে বিলীন হয়ে
    শৈশব নিষ্প্রাণ।

  • কবিতা

    ভাগীদার

    ভাগীদার
    -কৃষ্ণ বর্মন

    একটা বিরল সকালে অবিরল গরলকে
    যারা সুস্বাদু পানীয় তরল বলে
    সহজ সরল মানুষকে পান করিয়ে বলে
    এটাই তো জীবনের রসদ
    তাঁরাই পূজিত হয় শর্তসাপেক্ষ আনুগত্যে।
    ওরা বারবারই ভুলে যায়
    মরুভূমি কখনো কাউকে একা গ্রাস করে না।
    পাহাড়ে কিংবা পরিখা দিয়ে ঘেরা শত শত দূর্গও
    আজ ঘুমিয়ে পড়েছে বালির নিরাপদ চাঁদর গায়ে জড়িয়ে।

    যাকে সাক্ষী রেখেছিল শেষ বিচারের জন্য
    সেও দায়ভার থেকে মুক্তি নিয়ে
    অভিব্যক্তিহীন নিষ্প্রাণ আনন্দে
    ছন্দমিল খুঁজছে আরেকটা
    আধুনিকতা বর্জিত কবিতার জন্য।

    এই সকাল শেষ সকাল নয়।
    বিষ পান করতে করতে
    যেদিন ওরা বিষের নেশারী হয়ে উঠবে
    সেদিন নিজেরাই ছোবল নেবে জিভের ডগায়।
    সেদিন জমিয়ে রাখা বিষের ভাগীদার
    হওয়ার জন্য প্রস্তুত থেকো।

You cannot copy content of this page