-
কবিতা- স্বামী
স্বামী
–প্রদীপ শর্ম্মা সরকারছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলো,
দাঁত তো নয় সাদা মূলো।
বেরোজগেরে ধম্মের ষাঁড়,
ফুটো নৌকোয় বাইছে দাঁড়।জড়দ্গব নারাণশিলা,
দুষ্টকোপী পাথর নীলা।
দুচক্ষের নষ্টবালু,
ভীমরতি বেশ আলুথালু।নীরেট মাথা গবেট ষণ্ড,
পত্নীপ্রিয় আকাট ভন্ড।
দৃষ্টিনিরোধ গন্ধমাতন,
নিমের ডালের কষ্ট দাঁতন।বংশীধারী কলির কেষ্ট,
মদমত্ত মাতাল শ্রেষ্ঠ।
চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা,
যূপকাষ্ঠে বলির পাঁঠা।তামাদি এক সাবেক ঢেঁকি,
অবিশ্বাসী বেজায় মেকী।
ঘ্যানর ঘ্যানর সারাক্ষণ,
গায়ে এঁটুলি অনুক্ষণ।কথার ‘পরে কথা সাজায়,
পিরিং পিরিং সেতার বাজায়।
অকাজ পেলে বেজায় ফুর্তি,
টগবগিয়ে ঘোটক মূর্তি।প্যাচালপারা খেয়াল গান,
গিলতে হেথায় হোথায় যান।
ঠিক ধরেছ,ইনিই আমি,
হতভাগা মূর্ত স্বামী। -
কবিতা- পুরস্কার
পুরস্কার
–প্রদীপ শর্ম্মা সরকারএক মালসা আগুন নিয়ে কাগজে ছিটিয়ে দিলে–
হ’য়ে উঠলো দ্রোহকাব্য।
এক আকাশ সংবেদনার বারি সিঞ্চন করলে পাথর বুকে,
হ’য়ে উঠলো অনুভূতির স্নেহাধার।
এক থোকা সত্য ছুঁড়ে দিলে নীলিমায়,
হ’য়ে উঠলো অবোধের জ্ঞানাঞ্জন।একবার সুর মিলিয়ে গলা ছাড়লে সপ্তমে,
জীবন হয়ে উঠলো গীতিময়–
এক করে দিলে দিনরাত– ঘামে,রক্তে আর বীর্যে ;
জন্ম নিলো নাছোড় সূর্য্যবীজ,
একনাগাড়ে পঁয়ষট্টি পেড়িয়ে থামতে গেছিলে–
নীতির প্রতিরোধে বাঁধা পড়ে গেলে।একলহমার চমক ছিল না কর্মে,
শেষ অধ্যায়ে এসে রূপান্তরিত মর্মর–
একদিন ছবি হবে জেনেও
প্রচারের আলো মাখলে না গায়ে–
একধামা মুড়ি জোগাতে গিয়ে
ফিরে তাকানো হ’ল না হলুদ বসন্তের দিকে–
একেশ্বরবাদী হয়ে বহুত্বের বিশ্বাসে কুড়াল চালালে–
প্রতিবাদী তকমা জুটে গেল–
কালকুঠুরির আমৃত্যু আশ্রয় তো নিশ্চিত হ’ল! -
কবিতা- বয়সের ছায়াপথ
বয়সের ছায়াপথ
-প্রদীপ শর্ম্মা সরকারবয়স্কেরা হারিয়ে গেলেও
জড়িয়ে আছেন বুকের ফাঁসে
দিব্যসুখে স্মিতহাস্যে ফোকলা মুখে।দুইপাটি মাড়ির মাঝে
প্রাণপণে পিষতে থাকা পানের মন্ড ,
অতীত স্মৃতি আগলে রাখা পল–
পরিশেষে বীতশ্রদ্ধ উগড়ে দেওয়া
আদ্যিকালের চর্বিত চর্বণ।বয়স্যেরা গোলাপ হাতে এগিয়ে এলেও
তারার দেশে হাসিমুখে ছায়াপথে বয়স্করা,
নবীন প্রাণের উনুন ঘিরে,
ইতিহাসের সোঁদা পাতার জল ঝরায়–
যদিও জানে,
উপাখ্যানের উঠোন জুড়ে
অবিশ্বাসের শিওলি। -
কবিতা- ভাবনা
ভাবনা
–প্রদীপ শর্ম্মা সরকারভাবনা চলে নদীর মত
প্রেম আনন্দ বেদনা ক্ষত
এঁটেল ফসিল কচুরী পানা
সুখের ভিয়েন দুঃখ দানা
মন ছাঁকনিতে ছেঁকে নেওয়া
নতুন-রোদে মেলে দেওয়া।ভাবনা হাসে চাঁদের মত
ঝলক খুশির পলক যত
একের পরে অপর মিলায়
অভ্র ঝিলিক বালুকণায়
দিনের শেষে সাগর পাড়ে
জলতরঙ্গ শ্রবণ কাড়ে।ভাবনা কাঁদে অশ্রুসাগর
এক নিমেষে ভাঙা বাসর
এয়ো স্ত্রীয়ের তন্বী শরীর
বিকোয় পাটায় বিলাস তরীর
সিঁদুর দিলো যে গোধূলি
সেই আলোতেই বধূ বিলি।ভাবনা নাচে বাজে ত্রিতাল
সন্ধ্যা রাত্রি সকাল বিকাল
নাচের মুদ্রা নটরাজের
তেজস আঁখি ডাকের সাজের
এক বাহুতে মুন্ড দোলে
অন্য বাহু ফসল তোলে।ভাবনা এখন অলস মদির
তুলসী তলায় ভক্ত সুধীর
সে অনায়াস ক্ষিপ্র তড়িৎ
শীতল বাতাস স্থিত সরিৎ
ভাবনা আসে নিঝুম রাতে
দুনিয়া যখন পক্ষাঘাতে। -
কবিতা- কালের আদেশনামায় ক্ষমা নেই–
কালের আদেশনামায় ক্ষমা নেই
-প্রদীপ শর্ম্মা সরকারগলাজলে দাঁড়িয়ে গায়ত্রী জপ করেছি একশো আট বার,
ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের আকিঞ্চন স্তুতি করেছি
বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় চেপে,
তুলসীকে মহীরুহ জ্ঞানে পুজো করেছি –ধুলোয় মিশে যেতে যেতে অহর্নিশি–
জাতপাতের ছ্যুৎমার্গ মেনে
ডোম ঘরণীর যুবতী যোনি হেলায় তুচ্ছ করেছি–
আবেগজলে বন্ধ্যা নারীর জরায়ু ভাসিয়ে দিয়েছি
একের পর এক মিথ্যার প্রলেপ চাপিয়ে;
বিন্যস্ত বীজমন্ত্রে
দেবদাসীর সমস্ত স্বপ্ন উজাড় করে দিয়েছি
একনিষ্ঠ পিতার চোখের মণি কেড়ে নিয়েছি–
হারেমের অবিসংবাদিত ডানাকাটা পরীদের
নিরাবরণ ক্ষুধার্ত দেহবল্লরীতে
একে একে বেদনা রোপন করেছি–
তারপর সোল্লাস গণ- ধর্ষণযজ্ঞ উপভোগ করেছি–তারপর প্রভূত প্রতিপত্তি,
অপরিমেয় মণিকাঞ্চণ সুখ,
বিলাসের সপ্তম স্বর্গ পরিক্রমা শেষে
অমরত্ব কামনা করেছি–
ইতিহাসের পদলেহন করেছি –মেঘের ওপারে একঝিলিক হেসে
ইতিহাস রচয়িতা অদৃশ্য হয়েছেন–
ডাক পড়েছে চলে এসো,
জবাবদিহি ক’রতে হবে। -
কবিতা- প্রায়শ্চিত্য
প্রায়শ্চিত্য
–প্রদীপ শর্ম্মা সরকারচারদিকে বড় গুমোট।
সন্ধের অবকাশে একটু প্রকৃতি সান্নিধ্য চায় শরীর,মন–
চারকোলের মত ঝুরঝুরে পোড়া মনটা
তাসের উপরের লাস্যময়ীর প্রতিকৃতি দেখে আর উন্মাদ হয় না ;
অনুভূতিগুলো তেজ হারাতে হারাতে
ঘোর বর্ষার অমাবস্যা যেন।
ষড়রিপু জয় করার অহমিকা নেই আমার,
তারা স্বেচ্ছায় ছেড়ে চলে গেছে স্যাঁৎসেতে জুবুথুবু আধার।মায়ের কাছে শুনেছি আমি এক অপরিণত জাতক,
সময়ের আগেই আত্মপ্রকাশের জন্য উসখুস প্রাণ।
এমন জাতকের সময়ের চৌখপ্পি পার হওয়া দুষ্কর –
পোষ মানা গৃহপালিত যেমন অকালে ঝরে যায়।এক সংখ্যার নামতা ধাতস্থ হবার আগেই
জোড়া সংখ্যার ধারাপাতে বিপর্যস্ত।
নিয়মের অঙ্ক শেষ হবার আগেই
সিঁড়িভাঙা রপ্ত করার মূর্খামির মূল্য চোকাতে হবে না!
তাই তো আজ বেলাশেষে
একদা দৃপ্ত তাপসের তপস্বী
বিনয়ের বন্দিশ গেয়ে চলি প্রায়শ্চিত্যের ভেক ধরে। -
কবিতা- বন্ধ্যা জীবন
বন্ধ্যা জীবন
– প্রদীপ শর্ম্মা সরকারআমি তো নই কোন দ্যুতি,
অথবা গাঢ় অন্ধকারে জ্বলে ওঠা সাদা অন্ধের যষ্টি–
আমি তো নই কোন কবিতার প্রচ্ছন্ন সারমর্ম,
গোধূলির মত কণে দেখা আলো,
ফুটিফাটা প্রান্তরে একমাত্র নবজাতক অঙ্কুর–––তবে কেন আমার কণ্ঠে ভৈরবীর আশ্রয়!
আমার হাতে কেন ঊষাগন্ধী নরম আলো আঁকার তুলি!
আমার পায়ে কেন প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনের গুরু দায়!আসলে আমি অসময়ে বানপ্রস্থের অভিশাপ মাথায় নিয়ে
জুবুথুবু প্রাকসন্ন্যাস অসমর্থ জীবন সৈনিক –
আমার কাছে জীবন-মৃত্যু একই অর্থ বহন করে।
প্রাঞ্জল ভোর,অনিবার প্রেম,সুরাবহ অমৃত বাণী
এখন আর আমার দরজায় অতিথি হ’য়ে আসে না–এখন আমি রোজ সন্ধ্যা থেকে চাঁদের মধ্যযাম পর্যন্ত
ভালোবাসা ভিক্ষা করি,
ঘৃণা আর হতাশা ফেরি করি–
শেষ কবে হেসেছিলাম মনে পড়ে না,
শেষ কবিতা ও শেষ গান আজ বিস্মৃতির অতলে। -
কবিতা- বাঁধন
বাঁধন
–প্রদীপ শর্ম্মা সরকারআকাশে বাতাসে একটা আঠালো নির্যাস, বেঁধে রাখার মন্ত্র;
একটা কুসুম উত্তাপ ঘিরে আছে না চেনা সম্পর্কের খুঁটিগুলোকে–
গোধূলির আনচান আকর্ষণও হার মেনে ফিরে গেছে–বিণি সুতোর বাঁধন শুনেছি অটুট হয়,
শুনতে সুতো, আসলে মুখ্য রক্তবাহী শিরা
হৃদয় উৎসে জন্ম নিয়ে মস্তিষ্ক পরিক্রমা করে;
আরোহন ও অবরোহনে প্রয়োজন হ’লে
বিবাদী স্বরকেও ছুঁয়ে যায় পরম আশ্লেষে। -
কবিতা- অস্তিত্ব
অস্তিত্ব
–প্রদীপ শর্ম্মা সরকার“আমি” যদি একটা অস্তিত্ব হয়
“তুমি”ও তবে তাই।
এতো আলাদা আলাদা থাকার কৌশল কেন?
প্রথম পুরুষ, দ্বিতীয় পুরুষ, তৃতীয় পুরুষ
ব্যকরণেও কেমন ছেয়ে গেছে পুরুষাকার!
লিঙ্গ নিয়ে জেরবার জনগন
দাবী করে, লড়াই করে–
মহিমা প্রতিষ্ঠার জন্য তুমুল ঝগড়া––ফাঁক দিয়ে সময় গলে যায়
নারীবাদী,পুরুষবাদী সকলেই আস্ফালন করতে করতে বৃদ্ধ হয়ে যায়।
অনেক আকচাআকচির পর স্থির হয়
কোন শব্দেই আর লিঙ্গ নির্দেশক স্বরবর্ণ যোগ হবে না–
লিঙ্গ নির্বিশেষে সারা গায়ে লৌহসদৃশ পেশী হবে,
কোমল শব্দটা পরিত্যাগ করা হবে–
সবাই হবে শক্তের ভক্ত,
শক্তের প্রতি নরমের বা নরমের প্রতি শক্তের
দুর্বলতা উধাও হবে–
একপ্রকার সমকামীতা প্রতিষ্ঠা পাবে।বেশ তো হোক না।
জরায়ু প্রতিস্থাপিত হোক পুরুষের দেহে,
নারীর বীর্যে ভেসে যাক পুরুষের জঠর।
অস্তিত্ব সঙ্কট দূর হোক।
ভালোবাসা দীর্ঘ অবকাশে যাক।কণ্ঠস্বর চিকণ হলেই কি নারীত্ব দাবী করা যায়?
ভুল হল বোধ হয়–
নারী বলে দেগে দেওয়া যায়?
বরং অস্তিত্বের নাম হোক পেশী–
মনের স্থান দখল করুক দেহ,
আরো কিছু দেহজ বর্জ্যে ভরে যাক মাটি–উর্বর মাটি––বহু অস্তিত্বের নবজন্ম হোক।
সঙ্কট এড়ানো যাবে তো!
যদি এড়ানো যায় তবে ধ্বংসের কি হবে? -
কবিতা- বিচারের বাণী
বিচারের বাণী
– প্রদীপ শর্ম্মা সরকারগলাগলি গাছেরা পাতার চুম্বনে অন্তরঙ্গ।
সূর্য্য লজ্জায় সবুজ ডিঙিয়ে যায়।
বাতাস বেদম শ্বাস নিয়ে বিপরীত বিহারে যায়।
রাসের দিনে গাছেরা অন্ধকার নিশ্চিত করে,
যামিনী শশীর নিম আলোয় আগমণীর পথ প্রশস্ত করে।
এ তো অত্যন্ত ঘৃণ্য তস্করবৃত্তি!জীবনের অর্থ খুঁজতে গিয়ে কত যে অনর্থ চোখে পড়ে!
বিধির বিচারে অবৈধ কিছু থাকতে পারে না –
কীট পদদলিত হয় আভূমি অবস্থানের কারণে,
প্রণম্য পদযুগলের কি অপরাধ!বিচারের বাণী মোটেও কাঁদে না,
নীরবে নিভৃতে অশ্রুমোচন!
সে তো দূরস্থান;
সূর্য্য, আকাশ,বাতাস,
চাঁদ,তারা,ফুল,পাতা
কেন যে পরস্পর বিরোধী আচরণ করে!