• কবিতা

    কবিতা- ভালোবাসি

    ভালোবাসি
    -ডাঃ নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

     

     

    ভালোবাসা তার ভিন্ন আঙ্গিকে, চেহারায়,
    মানুষের মধ্যে নিজেকে উজার করে, হারিয়ে ফেলেছে —
    ভালবাসা নদীর জলের মতো বহমান ;
    সে তার বুকের উপর দিয়ে ভেসে চলা সব আবর্জনাকে নিয়ে,
    এগিয়ে চলে সাগরের দিকে-,নদীর মতো, সাগরের খোঁজে —
    কখনও শান্তসলিলা, আবার উদভ্রান্ত এক পথিক।।

    ভালোবাসি সবাই, তবু সবাই কি
    প্রতীক্ষায় থাকতে পারি,
    ভালোবাসার মানুষের জন্য!
    তখন কত ব্যস্ততা, অজুহাতের জাল বোনা ;
    যা ছিল অনেক, তাই তখন হাতেগোনা!!
    হিসেবী মগজে ব্রাত্য হয়েছে, ভালোবাসার আল্পনা।।

    তখন মেঘ করলে বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকতাম,
    বৃষ্টি এলে উঠোনে কিংবা রাস্তায় ভিজতে ভিজতে,
    ভেজার আনন্দে যেন উড়ে যেতাম,
    হাওয়াই জাহাজ কিংবা সেই পক্ষীরাজের মতো–
    আজ হারিয়েছে মেঘলা আকাশের, বুক ভরা অভিমান -!
    অনাবৃষ্টির তাই এতো কলরব, এত হাকডাক।।

    আজ “সময়” আমার, সবটুকু সময় কেড়ে নিয়েছে,
    দায়িত্ব আর কর্তব্যের ঘোড়া ছুটিয়ে,
    সারাদিন চলতে চলতে কখন যেন
    নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি,
    শুন্য প্রান্তরে, মরুতে —
    অপেক্ষা করতে পারিনি দশটা মাস, কিংবা বছর।।

    সবটুকু ভালবাসা জমিয়ে ফুলদানিতে ফুল হতে পারিনি;
    এই দশটা বছরে —
    হারিয়ে ফেলেছি আমার সেই “ভালবাসা”,
    যাকে নিয়ে ছিল আমার বাঁচা,
    বিজলীর গমকে, চমকে চলা;
    মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়ে ঝরা ,সব কথা বলা-
    যাকে ভালবেসে, “ভালবাসি” বলা, সবটুকু ভালো থাকা।।

  • কবিতা

    কবিতা- গর্ভধারিণী

    গর্ভধারিণী
    – ডঃ নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

     

    দশ দশটা মাস কি নিদারুণ যন্ত্রনায়,
    কাতর হতে হতে, কুঁকড়ে গিয়েছো,
    সয়েছো দারিদ্র্যের নিদারুন ভ্রকুটি;
    ক্লিষ্ট হয়েছো অনাহারে, তবুও বারবার,
    তোমার ঋজুতার কাছে সব কিছু হয়েছে নত।

    আকাশে কতবার ঘনিয়েছে মেঘ, নিকষ কালো-
    বিদ্যুতের ছোবল, শ্রাবণে, বসন্তে, বৈশাখে;
    হেনেছে কতবার; বজ্রপাত হয়, হয়েছেও-
    তারপর দিগন্তের বুক চিরে রামধনু ওঠে,
    দেখা যায় দূরে,শরতের নীলাম্বর!

    লোমকূপে,মজ্জায় বিদ্রোহের বহ্নি,
    ধমনী ঘুমিয়ে পড়ে, শোনিতের শীতল স্রোত,
    নিভিয়ে দিতে চায় সব “আগুন”, তবু তুমি –
    জেগে আছো,আগ্নেয়গিরির লাভায়; তবু তুমি
    জেগে ছিলে মৃত্যুর চোখে, চোখ রেখে;
    অপত্যর পথ চেয়ে, বহ্নিমান জীবনের,
    সব জ্বালাকে, মধুতে জারিত করে-
    বিষপান করে গেছো, অমৃতময় করে।

    কত উৎকন্ঠিত মুখ, হাসপাতালের ভিড়ে,
    তবু তুমি জেগে আছো, তোমার অপত্যর পথ চেয়ে,
    তোমার স্বপ্নকে ঘিরে, হাজারো উৎকন্ঠিত মুখ-
    শহরের হাসপাতালে, রবির মধ্যহ্ন পেরিয়ে,
    এখনও এই শুক্রবারের সায়াহ্নেও
    পলকহীন চোখ নিয়ে অপেক্ষায়-
    শুধু তোমাকে ভালোবেসে,শুধু তোমারই জন্য,
    মা- শুধু তোমারই জন্য।

    কিন্তু তুমি যে নিঃশব্দে পৌঁছে দিয়েছিলে নিজেকে,
    মরণের দরজায়, সকলের অজান্তেই বড় নিশ্চুপে-
    চিরকাল যে ভাবে ধুপের মতো পুড়ে
    গন্ধ বিলিয়ে দিয়েছো চারিধারে,
    তেমন করেই, হাসিমুখে-
    তোমার কড়া নাড়া, সেদিন
    মৃত্যুর দরজায়, বড় অভিমানে!
    শ্রাবণের ঘ্রাণটুকু নিয়ে,
    বসন্তের উজানে-
    জানতে পারেনি কেউ।

    সেদিন মৃত্যুর কাছে হেরে বিজয়িনী হয়ে গেলে-
    শুধু আমাকে ভালোবেসে, শুধুমাত্র আমার জন্য
    গর্ভধারিনী, তুমি আমাকে ভালোবেসে-
    মৃত্যুকে ভালোবেসে গেলে, জীবনের রঙ মুছে;
    শুধুমাত্র আমাকে দেখাতে পৃথিবীর আলো,
    গর্ভধারিণী তুমি,
    শুধু আমার জন্য-
    শুধুই আমারই জন্য।

  • কবিতা

    কবিতা- হতভাগিনী

    হতভাগিনী
    -ডঃ নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

     

    সঙ্গতি ছিলনা কানাকড়ি! যানবাহন ছাড়াই শীতের ভোরে,
    শহরের হাসপাতালের পথে, দৌড়ে গিয়েছিল ছেলেটি –
    গ্রামের রাস্তা ধরে, দীর্ঘ সাত মাইল পথ ;
    একাত্তর বছরের অসুস্থ মাকে, কাঁধে নিয়ে।
    হাসপাতালের ডাক্তারবাবুরা তখন কোথাও, অন্য কোন কাজে!
    পিতৃহীন যুবকের চোখে শুন্যতার কালো মেঘ, আসে ঘনিয়ে ;
    ঘড়ির কাঁটা বিকেল তিনটের ঘর পেরিয়ে রাত নটা-
    মুমূর্ষু বৃদ্ধার হৃৎস্পন্দন শোনবার সুযোগ করতে পেরেছেন-।।

    পেরেছেন ডাক্তারবাবু, ” নিজের কাজ” সামলে উঠে এতক্ষণ পর;
    মুমূর্ষু কোন মানুষের জীবনের, বিধান দেওয়ার সুযোগ!
    “একবার দেখুন ডাক্তারবাবু, আমার মাকে বাঁচান “
    মায়ের জন্য ছেলের আকুতি, সব বাঁধার প্রাচীর
    যেন ভেঙে দেয়,কয়েকফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে
    শীর্ন ছেলেটির চোখের কোল বেয়ে-
    শুনেছিলেন ডাক্তার, তবে তার মতো, “সময়” করে।।
    গাফিলতি মানতে চায়নি “রোগ “,ভীষন বিদ্রোহ করে,
    নির্বাক প্রতিবাদে,এগিয়ে গেছে তার গন্তব্যের দিকে।

    তিনটি দিন নাওয়া খাওয়া ভুলে, উদভ্রান্ত ছেলে,
    নিস্পলকে চেয়ে থাকে, মায়ের পান্ডুবর্ণ মুখের দিকে –
    যে মুখ আত্মজের সাথে,চোখের ভাষায় বলে যায় ;
    নিলামের হাটে জীবনের বাজী হেরে যাওয়ার কথা,
    কড়ির কাছে ;
    শ্মশানের চুল্লী অপেক্ষায় রাখেনি গেঁয়ো ছেলেটিকে;
    পরম আদরে বুকে টেনে নিল –
    অপাংক্তেয় ছেলের হতভাগিনী মাকে, প্রতীক্ষায় না রেখে ।।

  • কবিতা

    কবিতা- বিবর্ণ ক্যানভাস

    বিবর্ণ ক্যানভাস
    – নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

     

    সাত বছর আগের একটা পাতা
    প্রতিবছর জুন মাসের পাঁচ তারিখে,
    ঠিক সামনে চলে আসে লাবন্যর —
    মনে করতে না চাইলেও, মনে পড়ে যায় ;
    বিবর্ণ হয়ে যাওয়া,
    জীবনের একটি রঙিন পাতা;
    মন থেকে অনেক দুরের পথে,
    কোন আবর্জনা ফেলে দেবার জায়গায়
    পাতাটিকে রেখে আসতে চাইলেও,
    যা পারেনা সে –
    অদৃশ্য সিন্দুকের মুক্তকক্ষে,
    তাকে আজও বড় যত্নে,
    সাজিয়ে রেখে,
    লালন করে যায় লাবন্য —
    মাঝেমাঝে যখন সে নিজের সাথে
    একান্তে কথা বলে,
    সেই গোপন অথচ মুক্তকক্ষে
    লাবন্যর তখন অবাধ বিচরণ । ।

    রক্তাক্ত মনের সাথে,
    অসম লড়াইয়ের টানাপোড়েনে
    আজ লাবন্য বড় ক্লান্ত, বিধ্বস্ত-
    সব লাবন্যদের অমিত থাকেনা;
    থাকতে পারেনা –
    হারিয়ে যায় জীবনের কোন একটা সাইক্লোনে,
    অথবা মধ্যবিত্ত জীবনের প্রাত্যহিকতায়
    হাজারো নিয়ম, নিষেধ, ভয়,
    আর পাঁজিপুঁথির আস্ফালনে!
    উত্তাল জীবন তরঙ্গের অবাধ্যতায়,
    আটপৌরে জীবনের অদৃশ্য বেড়িতে
    তারা হারিয়ে যায়, জীবনের কানাগলিতে।

    এই লাবন্যদের ইচ্ছে না থাকলেও,
    রাত জেগে পার্টিতে যেতে হয়,
    মন না চাইলেও কথা বলতে হয়,
    সমাজের ইঁদুর দৌঁড়ে থাকা মানুষজনের সাথে,
    যেখানে সাফল্য মানেই প্রাচুর্য,
    যেখানে সাফল্য মানেই প্রতিপত্তি আর ক্ষমতার
    নির্লজ্জ প্রদর্শন!
    ইচ্ছে না থাকলেও বাড়িতে আসা,
    অতিথি, অভ্যাগতদের
    মন জুগিয়ে দু চারটে ভাল কথা বলতে হয়,
    মন কাঁদলেও সবার সামনে
    হাসি হাসি মুখে, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে হয়!

    আসলে ইচ্ছে থাকলেও এই লাবণ্যরা,
    শরতের নীল আকাশ দেখতে পায়না,
    দেখতে পায়না সাদা মেঘের ভেলায়
    ভেসে যাওয়া বকের নিরুদ্দেশ যাত্রা!
    লিখতে পারেনা কবি কালিদাসের মত “মেঘদূতম”
    ইচ্ছে করলেও প্রকৃতির বুকে হারিয়ে যেতে পারেনা-
    পারেনা সমুদ্র হৃদয় মানুষের হৃৎস্পন্দন শুনতে ;
    নিজের শুকিয়ে যাওয়া বুকটাতে,
    এক হিমেল দমকা ঝড়ের একটুকরো আভাস দিতে!
    লাবণ্যদের অনেক কিছু করতে নেই,
    নিন্দে হয়।

    লাবন্যদের গান গাইতে ইচ্ছে করলেও
    ঘর বন্ধ করে, সুরের আঙিনায়
    সসঙ্কোচে প্রবেশ করতে হয় ;
    পাছে অন্য কেউ তার প্রতিভার বিচ্ছুরণে
    মুগ্ধ হয় ;
    আলোকিত হয়ে কোন ঝর্ণাধারার,
    সন্ধান পেয়ে যায়!
    তবু এই না পাওয়ার মাঝেই তাঁদের
    প্রাপ্তির ভাঁড়ার পরিপূর্ণ,
    মনটাকে তাঁরা তানপুরার তারে,
    সেভাবেই নাড়া বেঁধে রেখেছে-
    আজীবনের সন্তুষ্টিতে,
    ইমন, কাফী, তোড়ি আর মল্লারের সাথে,
    বেহাগের মধুময় সহাবস্থানে
    শ্রাবণের আকাশেও রোদের ঝিলিক খেলে।।

    একটু পেলেই লাবণ্যদের
    অনেক পাওয়া হয়ে যায়,
    পার্থিব মোহ -মুক্তি,
    ওদের কবেই হয়ে গেছে!
    ওরা এখন কোন কিছুই আর আশা করে
    আশাহত হয়না –
    অনেকের মতো অনেক কিছু না পেয়েও
    ওরা “সব পেয়েছির দেশে”–
    খুব অনায়াসে পৌঁছে যায়,
    হাসিমুখে,
    ফেলে আসা কোন ক্যানভাসে আঁকা
    তাঁদের রঙিন ছবিগুলি,
    শুধু বিবর্ণ হতে থাকে,
    একেকটা দিন এভাবেই কেটে যায়;
    কেটে যাবে,
    বুক ভেঙে যাবে –
    তবু ওদের মুখ ফুটবেনা আগামীতে ;
    বিবর্ণ হতে চাওয়া, সেই রঙিন পাতাটিকে
    হৃদয়ে ঠিক আগের মতোই
    যত্নে রেখে দিয়ে, হাসবে সবার সামনে
    চোখের কোনায় দু’ ফোটা জল নিয়ে।

  • কবিতা

    কবিতা- বিশ্বকবি রবি

    বিশ্বকবি রবি
    – ডঃ নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়


    আজও প্রভাতের বাতাস তোমার সুরে,
    গান গেয়ে ওঠে,
    দোয়েল, কোয়েল, ময়নার সুরে
    আন্দোলিত হয় হৃদয়,
    ভৈরবী, মল্লারে-
    যেমন আন্দোলিত হয় বৈশাখী ঝড়ে,
    ফাগুনের ফাগ মাখা ভোরে;
    তেমনই শিউলি বিছানো
    আশ্বিনের ভোরেও তোমার স্পর্শ
    জড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথ ।
    আজও যে কথা ছন্দ খুঁজে পায়
    তোমার ঠিকানায়-
    সে কথা সব কবিতা হয়ে যায়।।
    আজও বিষাদে,আনন্দে,
    ছন্দে, নিরানন্দে-
    উৎসবের উন্মাদনায়-
    বিরহের যন্ত্রনায়,শোকে,
    ক্ষতে,হৃদয়ের রক্তক্ষরণে-
    সকল সুরহীনতায়-
    লাঞ্ছনায়,পরাধীনতায়,
    মনুষত্বর অবমাননায়,জীবনের শুন্যতায়
    আবার পরিপূর্ণতায়-
    সুখের অলিন্দে বিচরনের ক্ষনে-
    ক্ষত থেকে রক্তক্ষরনে,
    হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে –
    অবলার অশ্রুঝরার লগনে-
    সভ্যতার ভাঙনে, কিংবা হিংসার আস্ফালনে,
    বরিষ্ঠের দমনে-
    প্রেমহীনতায়,অত্যাচারের লেলিহান শিখায়-
    লাঞ্চনা,অপমান,মনুষত্বর অবমাননায়-
    প্রতিবাদের ভাষা কথা বলে,
    মুখর হয় মূক,
    বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, আজও তেমন করে,
    নব চেতনায়,তোমার ছন্দে,
    আগামীর পথে।।



    উৎসবে যেমন,শ্মশানে, গোরস্থানেও তেমন
    অবিচল তুমি-
    দু:খে যেমন,সুখেও তেমন করেই,
    তুমি বিদ্যমান!
    প্রভাতে, সাঁঝরাতে,রাত্রির নিস্তব্ধতায়
    বীণার মূর্ছনায়,তোমার অনুরণন –
    সুরে যেমন, অ-সুরের বিনাশেও তুমি উজ্জ্বল!
    জন্ম আছে,মৃত্যু নেই,
    ছন্দ আছে,ছন্দহীনতা নেই-
    সমগ্র চেতনায়,মননে স্বপনে
    পঁচিশে বৈশাখ,বা বাইশে শ্রাবণ নয় শুধু;
    সারাক্ষণ , প্রতিপলে,
    ঊষায় যেমন ,মধ্যাহ্নের জ্বলন্ত সূর্যের দীপ্তিতে
    তেমন করেই ভাস্বর, সাঁঝের স্নিগ্ধতায়
    রাত্রির নীরব গভীরতায় তোমার উপস্থিতি;
    তেমনই শরতে,বসন্তে,আষাঢ়ে,
    হেমন্তের পূর্ণিমা রাতে,পৌষালি ভোরে
    তিনশো পঁয়ষট্টি দিন,
    তুমি সব হৃদয় জুড়ে, আছো নিবিড় করে –
    বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ।।

  • কবিতা

    কবিতা- ঘামের মূল্য

    ঘামের মূল্য
    -ডাঃ নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

     

    ঘাম ঝরেছে মাঠের আলে, সোনায় ঝরা ধানের শীষে-
    ঘাম ঝরেছে ভানতে ও ধান, মাঠে মাঠে ফসল হাসে।
    ঘাম ঝরেছে তপ্ত উঠোন, হাপর টানে কামারশালায়
    ঘাম ঝরেছে মাঝির হালে, হাতুড়ি পড়ে কারখানায়।।

    ঘাম ঝরেছে,ওই শিশুদের, হারালো যারা দুধের বাটি-
    ঘাম ঝরেছে, পাথরভাঙা ওই রমনীর, অভাব যার নিত্য সাথী।
    ঘাম ঝরেছে, মা, বোনেদের হাসিমুখে, গৃহশ্রমের অর্ঘ দিতে –
    ঘাম ঝরেছে, শিক্ষাদানে, কাছারিতে, রোগ তাড়াতে মহান ব্রতে।।

    ঘাম ঝরেছে, সবাই যাঁরা, সহজ পথে, শ্রম দিল ওই “রুটির” খোঁজে-
    ঘাম ঝরেছে, নাট্যকলা,সাহিত্য,আর চারুকলা, নৃত্য, গীতে ।।
    ঘাম ঝরেছে দেশগড়তে, শতমতের ঐক্য নিয়ে আইনসভায়-
    ঘাম ঝরেছে, বৈরীতাকে মুছে ফেলে, কুসুম ফোটার স্বপ্ন দেখায়।।

  • কবিতা

    একুশের ভাষা

    একুশের ভাষা
    -ডঃ নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

     

     

    যে ভাষায় প্রথম ডেকেছি মাকে, “মা, মাগো, আমার মা-
    যে ভাষা বলে মেখেছি জীবনে, প্রথম রবির কিরণ,
    যে ভাষাতে প্রথম চিনেছি, জ্ঞানের মহা আকর,
    সেই তো আমার মাতৃভাষা, আদরের মহা রতন।

    সে বাংলাভাষা দিল মর্যাদা, রুধিরের বন্যায়
    বাঙ্ময় সে একটি সকাল,অমর একুশে ফেব্রুয়ারি-
    আগুন ঝরে আমার প্রাণের, একুশে ফেব্রুয়ারি।।

    সেই ভাষাতেই রবিঠাকুর, কান্তকবি, অতুল-
    দ্বিজেন্দ্রলাল, জসীমুদ্দিন, বিভূতি, নজরুল-
    উড়িয়েছে বিজয় কেতন, বিশ্বের দরবারে-
    মাতৃভাষায় হীরক দ্যুতি,
    চারুকলা, নৃত্য গীতের সুরে।

    সে বাংলাভাষা দিল মর্যাদা, রুধিরের বন্যায়
    বাঙ্ময় সে একটি সকাল, অমর একুশে ফেব্রুয়ারি-
    আগুন ঝরে আমার প্রাণের, একুশে ফেব্রুয়ারি।।

    পদ্মা,মেঘনা, ধলেশ্বরী,বুড়িগঙ্গা, যে ভাষা বলেছে এতকাল-
    একই ভাবে ব’লে, হিল্লোল ওঠে,
    কংসাবতী, তিস্তার জলে, দামোদর, গঙ্গায়।
    বারেবারে দেখি নতুন করে, সেই সোনার বঙ্গদেশ-
    ময়না, টিয়া, দোয়েল, শঙ্খচিলে, আজও নয়ন নির্নিমেষ।

    সে বাংলাভাষা দিল মর্যাদা, রুধিরের বন্যায়
    বাঙ্ময় সে একটি সকাল, অমর একুশে ফেব্রুয়ারি-
    আগুন ঝরে আমার প্রাণের, একুশে ফেব্রুয়ারি।।

    জব্বার,রফিক, বরকত, আরও শত বীরের, জীবন বলিদানে-
    বাংলাভাষা, বিশ্বে সেদিন রণজয়ী হয়ে, বসেছে সিংহাসনে।
    বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি, সোনালি আখরে লেখা দিন শুধু নয়-
    তামাম বিশ্বে, মর্যাদা, সন্মানে,
    বাংলাভাষাই সেদিন, দেখালো সূর্যোদয়।।

    সে বাংলাভাষা দিল মর্যাদা, রুধিরের বন্যায় ;
    বাঙ্ময় সেই একটি সকাল, অমর একুশে ফেব্রুয়ারি-
    আগুন ঝরে, আমার প্রাণের একুশে ফেব্রুয়ারি।

    এই বাংলাকে আমি প্রতিদিন, দেখি যে নতুন করে–
    স্বপ্ন, শ্বাসে জড়িয়ে মননে, দিন ছুঁয়ে, রাত, ভোরে।
    বারেবারে তাই এই বাংলায় ফিরে আসি যেন, আবার নতুন জন্মদিনে;
    সোনার বাংলায় সেই ভাষা বুকে,
    বাঁঁচবো আবার জীবনের নক্সীকাঁথা বুনে।

    সে বাংলাভাষা দিল মর্যাদা, রুধিরের বন্যায়
    বাঙ্ময় সে একটি সকাল, অমর একুশে ফেব্রুয়ারি,
    আগুন ঝরে প্রাণে আমার, একুশে ফেব্রুয়ারি।

  • কবিতা

    ভাল ছেলে

    ভাল ছেলে
    -ডাঃ নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

     

    দেখতে দেখতে আমাদের রূপা,
    বিবাহযোগ্যা হয়ে গেলো-
    যেন এই কিছুদিন আগের কথা, বলে মনে হয়-
    অন্নপ্রাশন, ইস্কুলের প্রথম দিন,
    ইস্কুলের শেষ পরীক্ষায়,
    ছোট্ট মেয়েটির সাথে নিজেকে
    চব্বিশ ঘন্টার রুটিনে
    আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা।
    আমার হাত ধরে, নাটকের মঞ্চে
    প্রথম গান গাওয়া,সব যেন-
    সেদিনের কথা!
    স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ;
    কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়
    বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে চাকরি-
    দেখতে দেখতে ছাব্বিশটা বসন্ত,
    যেন দৌড়তে দৌড়তে পেরিয়ে গেলো-
    অনেক বড় হয়ে গেল ছোট্ট মেয়েটা,
    হঠাৎ করে!

    সেই রূপা আজ অনেক বড় হয়ে গেলো
    সে আজ তার জীবনের
    এক বড় পরীক্ষার সামনে;
    মেয়েরা বড় হলে বাপ,মায়ের মনে
    সবচেয়ে আগে যে ভাবনার কালো মেঘ,
    ছেয়ে ফেলে মনের আকাশ-
    সুপাত্রস্থ করবার ভাবনা,
    আমিই বা তার ব্যতিক্রম হই কি করে!
    পাত্র দেখা শুরু হল, মামা, মাসী, জ্যাঠা,পিসী
    কেউ পিছিয়ে থাকলো না-
    ভালো পাত্রর তালিকা দীর্ঘায়িত হতে থাকলো
    সবাই একটা করে সম্বন্ধ নিয়ে আসে,
    মায়ের পছন্দ হয় তো মেয়ের হয়না
    মেয়ের পছন্দ হয়তো,মাসী আর মামারা-
    লাল পতাকা নেড়ে, নাকচ করে দেয়
    ঠিক পাকা কথা বলবার দিনেই,
    এভাবেই যবনিকা পড়ে,
    সাত সাতটি বাড়িতে
    বিয়ের মাচা বাঁধার সব সম্ভাবনা
    কখনো সলতে পাকাতে পাকাতে,
    কখনো তার আগেই।

     

    সেদিন উদভ্রান্ত অবস্থায় নীচের বারান্দায় বসেছিলাম-
    পাশের বাড়ির অমলেশ এসে বললো
    দাদা- এত চিন্তা করছেন কেনো!
    রুপু কি আমাদের ফেলনা মেয়ে-
    আইন নিয়ে পড়েছে, এখন ভালো চাকরি করছে-
    ওর বিয়ে কে আটকায়!
    দেখবেন একেবারে হৈহৈ করে,
    হয়ে যাবে ওর বিয়ে-
    আপনি সানাই বাজাবার তোড়জোড় শুরু করে দিন।
    অসহায় কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার দৃষ্টির সামনে,
    যে কথা রসিকতার মতো,
    বড় বেমানান।
    অমলেশ বললো,”আমার এক চেনা ছেলে আছে
    আমার বন্ধুপুত্র-
    সুপাত্র বললেও কম বলা হয়” ;

    আমেরিকায় থাকে- সুদর্শন
    প্রচুর টাকা,গাড়ী, বাড়ি, সম্পত্তির ছড়াছড়ি!
    খুব সুখে থাকবে মেয়ে আপনার।
    পিতৃহৃদয়ের খরাক্লিষ্ট মাটিতে,
    এ যেন আষাঢ়ের ধারা, চোত, বৈশাখ পেরিয়ে
    শীতলতার ছোঁয়া দিয়ে যায়, তৃষ্ণার্ত মাটিকে।
    পিতার বোবা দৃষ্টিতে শিকড় আকড়ে,
    জল থেকে-
    পাড়ে উঠবার একটা ইঙ্গিত ছিল;
    আমার প্রতিবেশী ভদ্রলোক অমলেশ
    সেটা পড়তে পেরেছিলো।
    সে বললো,দু’টি রোববার পরে চলুন দাদা-
    ছেলেটি, দেশে তিন দিন আগেই ফিরেছে,
    আজ শুক্কুরবার, কাল বাদ দিয়ে পরশু-
    ছেলের বাড়িতে রূপাকে নিয়ে যাবো।
    আমি বললাম, এখন কেন,
    দিন দশেক পরে আমরাই তো যাবো!

    এখন ছেলে মেয়েরা, নিজেরাই,
    নিজেদেরকে বুঝে নিতে চায়-
    তারপর পাকাকথা, সিন্দূরদান, সংসার,
    ওসব অনেক পরে,
    প্রতিবেশীর যুক্তি এড়ানো, ভার।।

    সাতসকালেই অতি উৎসাহে,
    আমরা পাঁচজন, হাজির-
    সাউদার্ন এভিনিউর, ঝাঁ চকচকে বহুতলে
    একটা এম্বাসেডরে, ভাড়া করা গাড়ি-
    ওখানে গাড়ি ছাড়া যেতে নেই,
    এমনই অলিখিত নিয়ম,
    বলেছিল আমার ক্লাস টুয়েলভে পড়া ছোটমেয়ে
    মাথা নেড়েছিলাম
    সায় দিয়ে।।

    ছেলে বিদেশে থাকে, ইঞ্জিনিয়ার-
    মস্ত বাড়ি, বিদেশী গাড়ি, আসবাব দামী,
    অনেক বেতন পায়, কোটি অধিক।
    কথা এগোল, তবে মুল কথাটা হল
    খাবার থালা হাতে ধরাবার পর;
    বরপণের তালিকাটা চলে এলো সাথে সাথেই।

    ৷ ৫ ।

    “পঞ্চাশ ভরি গয়না, নমস্কারি, দু’ লাখ টাকা নগদ,
    ফ্রিজ, টিভি, ঘর ঠাণ্ডা করবার যন্ত্র,
    এই কয়েকটা মাত্র জিনিষ, সারাজীবনের জন্য
    মেয়েকে দিতে পারবেন তো-“
    একটি মহিলা কন্ঠের, সুরেলা বান,
    বিদ্ধ করলো আমায়।
    ছেলের মাসী বললো, “ওরা দু’জন দু’জনকে,
    ভীষণ পছন্দ করে ফেলেছে,
    আপনারা দেনা পাওনায়
    রাজি হলেই আর কিসের দেরী!
    অঘ্রাণেই হয়ে যাক চার হাত এক,
    এই শ্রাবণেই সব হয়ে যাক পাকা
    কি বলে আপনাদের মন!”৷
    হঠাৎ বজ্রপাত হল মাথায়,
    একাত্তর বছরের বাবার,
    বাবার মলিন মুখটা কেমন যেন,
    ঘোর লাগিয়ে দিলো মাথায়,
    হঠাৎ নিজেকে হারিয়ে ফেলে,
    চীৎকার করে উঠলাম-
    “শুধু আমার এই জন্মে কেন!
    আরো পাঁচটা জন্মও যদি হয়-
    এভাবেই কেটে যাক, আমার জীবন ;
    অবিবাহিতা রয়ে যাবো, শুনবো গঞ্জনা
    বলুক না হয় আমায়
    বাবা,মায়ের গলগ্রহ হয়ে আছি আমি
    তবু সীমন্তে আর রাঙাবো না সিন্দুর
    “নিজের ঘর” না হয় হবে না আমার ,
    কোন ভিক্ষুকের বাসায় নিজের বাকী জীবনটা,
    কাটাবোনা, এভাবেই রয়ে যাব, অন্যভাবে
    আমার জীবনকে দেবো, নতুন পরিচয়!
    যদি পাই “মানুষ”,
    তবেই রাঙবে সিঁথি লাল সিঁদুরে-“।

    একটু দুরেই মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল
    আমার অমলেশ কাকা-
    কাছে গিয়ে তাঁর হাতটা ধরে বললাম,
    কাকা তুমি তো কোন ভুল করোনি,
    সবাই ভাল পাত্র বলতে তো শুধু,
    গাড়ি, বাড়ি, ধন-দৌলত
    এইসব কিছুকেই সবার উপর
    রেখে দিয়ে, ভাল আর খারাপের গন্ডী টেনে দেয়-
    মনের মূল্যায়ন কেউ করেনা!
    তাই তোমাদের সবারই কষ্টিপাথরে
    এরাই সোনার টুকরো, “ভাল ছেলে”।।

You cannot copy content of this page